গল্পের ম্যাজিক:: গাছের বাচ্ছা মাছের বাচ্ছা - চুমকি চট্টোপাধ্যায়

গাছের বাচ্ছা মাছের বাচ্ছা

চুমকি চট্টোপাধ্যায়

ঘুম থেকে উঠেই অন্বয়ের মনে পড়ে গেল যে আজ শনিবার। মেজাজটাই তেতো হয়ে গেল উফ্ আজ আবার সেই বিচ্ছিরি বারটা আজ বলে নয়, প্রতি শনিবারই এটা হয় অন্বয়ের
কেন হয়? প্রতি শনিবার কি ওর কোনপরীক্ষা থাকে? কড়া কোনস্যারের টিউশন থাকে কি?  কিম্বা এমন কোনকাজ যা অন্বয়ের মোটেই করতে ইচ্ছে করে না?
না, এসব কিছু নয় তবে? বলছি, বলছি..........।

সেন্ট মার্টিন স্কুলের ক্লাস সেভেনের ছাত্র অন্বয় মিত্র। পড়াশোনায় ঠিকঠাক তবে যেটার জন্যে স্কুলে বেশ নামডাক অন্বয়ের তা হল ডিবেট হ্যাঁ, ডিবেটে স্তাদ স্কুলকে অনেক প্রাইজ এনে দেয় বলে টিচাররাওকে ভালোবাসে

জয়েন্ট ফ্যামিলি অন্বয়দের বাবা, মা, বোন, কাকাই, কাকিন, ভাই, ঘনশ্যামদা পারুলদি আর সবার ওপরে ঠামাই অন্বয়ের বাবা তপনবাবু ব্যাংকে কাজ করেন মা ঈশিতা দেবী ফুড ডিপার্টমেন্টে আছেন বোন অনন্যা তিন বছরের ছোট অন্বয়ের থেকে একই স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে

পড়াশোনা নিয়ে বাবা মা বা বাড়ির কেউই চাপ দেয় না অন্বয়কে বা ওর বোনকে বরং এক্সট্রা কারিকুলার অ্যক্টিভিটিতেই বেশি সাহ দিয়ে থাকে সবাই তপনবাবুর মতে, যেটাই করো না কেন, হান্ড্রেড পারসেন্ট দাও তাহলে জীবনে ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে এদিক দিয়ে কোনচাপ নেই অন্বয়ের অন্যান্য বন্ধুদের বেলায় ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়... সব সময় বেশ চাপে থাকে তারা
বোনটা একটু নালশেকুটে তবে দাদার ওপর আস্থাও কম না দাদা যে মুখেই মারিতং জগত সেটা এই বয়সেই বুঝে গেছেও
কাকাই হল অন্বয়ের ক্যারম পার্টনার। ছুটির দিনে জমিয়ে ক্যারম চলে বাড়িতে সঙ্গে গরম গরম তেলেভাজা সেও বাড়িতে বানানো কাকিন যা বানায় না! কোনকথা হবে না আর আছে ছোট্ট কাটুস, কাকাই- কাকিনের দেড়বছরের ছেলে অন্বয় বাড়ি থাকলে আর দেখতে হবে না বল নিয়ে ওর পেছন পেছন ঘুরতে থাকবে খেলার জন্যে খুব কায়দা করে ওকে কাটায় অন্বয় না হলেই কাক-  চিকার অর্থা চিল চিকার জুড়ে দেবে

ঘনশ্যামদা বাজার করে, বাইরের অন্যান্য কাজ করে পারুলদি ঘরের কাজে হেল্প করে ঠামাই এর কথা তো আগেই বলেছি ঠামাই খুব ডিসিপ্লিন মেনটেন করা পছন্দ করেন দাদুন মিলিটারি ক্যাপটেন ছিলেন তো ঠামাই এর অভ্যাস হয়ে গেছে ডিসিপ্লিন্ড লাইফ যেমন ধর, ঘুম থেকে উঠে সবাইকে এককোয়া রসুন, একটু করে হলুদ আর এক টুকরো আমাদা খেতেই হয় এতে নাকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে হয়তো ঠিকই বলেন ঠামাই এবাড়ির লোকজন খুব একটা ভোগে না এছাড়াও গরম কালে মৌরি- ভেজানো জল, ভাতের পাতে টকদই... এই সব আর কী বাড়ির কেউই ঠামাই এর কথা বিশেষ অমান্য করেনা বিশেষ করে দাদুন চলে যাবার পর থেকে
একটা ব্যাপারে এবাড়ির সবাই একরকম সেটা হল প্রত্যেকেই প্রচন্ড খেতে ভালবাসে এবং আমিষের দিকেই পাল্লা ভারি।
নাতি- নাতনিদের ঠামাই খুবই আহ্লাদ দেন
তবে তো দিব্যি কুল ফ্যামিলি তা হলে শনিবার নিয়ে অন্বয়ের এত অ্যালার্জি কেন?

হবে নাই বা কেন? প্রতি শনিবার যে পুরোপুরি নিরামিষ রান্না হয় অন্বয়দের বাড়িতে ঠামাইয়ের নির্দেশ ওনার মতে একদিন অ্যানিম্যাল প্রোটিন বাদ দেওয়া উচিত তা ছাড়া আজ কাল যা মাছ- মাংসের দাম, একদিন বাদ দিলে একটু সাশ্রয়ও হবে
এইজন্যেই অন্বয়ের মোটেও ভাল লাগে না শনিবার ওই সব গাছ- পাতা খাওয়া যায়? আর পনির তো -- ইয়াক্
মাটন, চিকেন, মাছ না হোক, নিদেন পক্ষে ডিম তো হতে পারে সস্তায় পুষ্টিকর! কিন্তু ওইযে, ঠামাইয়ের কথার ওপর কথা নয় মনে মনে সবাই অখুশি কিন্তু বলতে পারেনা বেশি বড় হয়ে গেলেও ঝামেলা

অনন্যা অনেকদিন ধরে ঘ্যান ঘ্যান করছে অন্বয়ের কাছে 'অ্যাই দাদা, তুই তো কথায় সব্বাইকে কুপোকাত করিস, ঠামাইকে হারিয়ে দে না কথায় যাতে শনিবার আর ভেজ খেতে না হয়
কিছু তো একটা করতে হবে ভেজের হাত থেকে মুক্তি প্লাস ডিবেটর হিসেবে বোনের কাছে প্রেস্টিজ বাঁচানো।


আজও একটা ইন্টারস্কুল ডিবেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে অন্বয়দের স্কুল কৃতিত্বটা সত্তর ভাগই অন্বয়ের বেস্ট স্পিকারের ট্রফিটাও ওই পেয়েছে স্কুল থেকে ফিরে লাফাতে লাফাতে ঠামাইয়ের কাছে আগে যায় অন্বয় বাবা, মা এখন অফিস থেকে ফেরেনি ঠামাই তো বিগলিত নাতির কৃতিত্ত্বে গায়- মাথায় হাত বুলিয়ে, কপালে দুটো হামি দিয়ে বলেন, ' দাদুভাই কী খাবে বল যা খেতে ইচ্ছে করছে বল, রবিবার রান্না হবেখন'

এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল অন্বয় খাওয়া- দাওয়া প্রসঙ্গ না উঠলে আরও যুক্তি ফলায় কী করে?
আজ শুক্রবার, কাল শনিবার... জয় বজরঙ্গবলী!
'ঠামাই, একটা কথা জিজ্ঞেস করব তোমাকে?'
'হ্যাঁ, নিশ্চয় দাদুভাই বলনা'
'আচ্ছা, পেঁয়াজ আমিষ না নিরামিষ?'
'পেঁয়াজ তো আমিষ কেন দাদুভাই?'
'পেঁয়াজ কোথায় হয়? গাছে তো?'
'তা তো বটেই গাছ থাকে মাটির ওপরে আর পেঁয়াজ মাটির নিচে কেন, তুমি জানো না?'
'জানি তো'
'তবে?'
'তাহলে কী দাঁড়াল ঠামাই, গাছ নিরামিষ আর তার ফল আমিষ তাইতো?'
'হুম' --- ঠামাই ঠিক ধরতে পারেননা গাড়ি কোন দিকে যাচ্ছে
'তা হলে ঠামাই তুমি বল, মাছ আমিষ হলেও তার ডিম তো নিরামিষ হওয়া উচিত নয় কী?'
'সে কী কথা দাদুভাই! মাছের ডিম কী করে নিরামিষ হবে? সে তো মাছেরই বাচ্ছা'
'মাছের বাচ্ছা কিন্তু মাছ তো নয় না সে চলে ফেরে, না তার মুখ- চোখ- লেজ আছে নিরামিষ গাছে যদি আমিষ বাচ্ছা হয় তবে আমিষ মাছের বাচ্ছা নিরামিষ হবে না কেন? তুমি ভাল করে ভেবে দেখ'
এটা যে বিলকুল কুযুক্তি তা ভালই জানে অন্বয় কিন্তু যুক্তি সু হোক বা কু, মানুষকে কনভিন্স করে মেনে নিতে বাধ্য করায় বলেই তো চ্যাম্পিয়ন
ঠামাই কিছু বুঝতে না পেরে বলেন, 'আচ্ছা বেশ, তা যদি হয়েও থাকে, তাতে কী হবে?
'তা হলে শনিবার করে আমরা মাছের ডিম খাব ভাজা, ডালনা... কাকিন রাঁধবে তোমার কথাও থাকল আর আমাদেরও দিলখুশ'

ঠামাই হেরেই গেলেন বড়নাতির কাছে ঘনশ্যামদাকে পরের দিন মাছের ডিম আনতে বলে দিলেন বাড়ির সবাই যখন জানল ঘটনাটা, একসাথে বলে উঠল... ‘থ্রি চিয়ার্স ফর অন্বয়বাবু'
হাততালি দিল পুঁচকে কাটুসও মহাখুশি অনন্যা ওর দাদা গ্রেট!
কাল শনিবার, অন্বয়দের বাড়িতে গাছের বাচ্ছা দিয়ে মাছের বাচ্ছার ফাটাফাটি ডালনা হবে..... আসবে নাকি?

ছবি- তন্ময় বিশ্বাস এবং রাখী নাথ

লেখক পরিচিতিঃ কিশোর ভারতীর সম্পাদকীয় দফতরে আছেন প্রায় দশ বছর। কবিতা ক্লাবের সদস্যদের প্রেরণায় লেখা শুরু করেন। পত্র ভারতীর সঙ্গে তিরিশ বছরের সম্পর্ক। অবসর পেলেই ছোটোদের জন্য কলম ধরেন।

1 comment:

  1. অনবদ্য ... ছোটদের জন্য এমন মজার লেখা পড়বার জন্য মুখিয়ে থাকব।

    ReplyDelete