সোনার আলো হীরের দ্যুতি
শ্রেয়সী চক্রবর্তী
ফিল্ম রিভিউ – হীরের আংটিঃ পরিচালক – ঋতুপর্ণ ঘোষ (১৯৯২)
১৯৯২ সালে আমরা যারা ছোট ছিলাম, কিংবা আজকের এই ২০১৫-এ যারা নতুন যুগের ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা এবং যে সব নতুন শিশু আগামীদিনের বাঙালি সংস্কৃতির নতুন জুতোয় পা গলাবে … তাদের সব্বার কাছেই এটি অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় যে হাল-আমলের বাংলা ছবির শ্রেষ্ঠতম পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ তাঁর প্রথম ছবি ‘হীরের আংটি’ বানিয়েছিলেন শিশুদের জন্য, আমাদের সকলের ছোটবেলার জন্য। আর এই সিনেমাটির বিশেষত্ব এখানেই যে বিখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়–এর লেখা মূল উপন্যাসটির রস সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণ রেখেও পরিচালক সোনার বাংলার সোনার ছেলেমেয়েদের হাতে সিনেমার যে রসভাণ্ডটি তুলে দিয়েছিলেন সেটি নিজেই একটি অনন্য ক্রিয়েশন অর্থাৎ নতুন সৃষ্টি।
হিরের আংটি বইটির প্রচ্ছদ |
বন্ধুরা তো জানোই পুজো এসে গেছে। আকাশে মন ঝিলমিল করা শরতের সোনা রোদ্দুর। তোমাদের মধ্যে কারা কারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজ পাঠ’ বইটা পড়েছ বলো দেখি? সেই যে সহজ পাঠে বলা আছে না… “ছুটির দিনে কেমন সুরে/ পূজার সানাই বাজায় দূরে/ তিনটে শালিক ঝগড়া করে/ রান্নাঘরের চালে!!” এমনি এক পূজার ছুটির দিনে পূজার সানাইয়ের গল্প দিয়ে শুরু হয় গেনুদা’র সঙ্গে হাবুল আর তিন্নির গ্রামের বাড়িতে মজাদার দুপুর। গেনুদা কিন্তু শুধুই গেনুদা নন, তিনি হলেন গিয়ে খাস “রামদুলালের নাতি” এবং রাজপুত্র গন্ধর্বনারায়ণ; তাঁর ঘোড়া আছে, সৈন্য সামন্ত আছে, রাজ্যপাট আছে, রাজ্যের শত্রু আছে আর আছে এক কমল হীরের বিশাল দামী আংটি। কিন্তু এত কিছু ভালো এবং মন্দ থাকার পরেও এই পৃথিবীটার রৌদ্রে অমৃত, জলে অমৃত, বায়ুতে অমৃত... অর্থাৎ তিনি আনন্দ করে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চান। আর হ্যাঁ তাঁর একটা রংবেরঙের ঝোলাব্যাগ আছে, তাতে যে আলপিন টু এলিফ্যান্ট কি জিনিস নেই তা বলা শক্ত ! কিন্তু এহেন গেনুদার কাছে হাবুল আর তিন্নির মত দুটো ছোট্ট মিষ্টি ভাইবোন মোটেও ছিল না। কিভাবে গেনুদা এই ভাইবোনদের খুঁজে পেলেন তার গল্পই হল “হীরের আংটি”।
|
|
কিন্তু তাহলে “রামদুলালের নাতি” আর ষষ্ঠীচরণের কি হবে?? ও হ্যাঁ বলাই তো হয়নি, হাবুল যে গ্রামে থাকে আর তার বোন তিন্নি আমেরিকা থেকে বাবা মায়ের সঙ্গে যে গ্রামে দাদুর কাছে পূজার ছুটি কাটাতে এসেছে, সেই গ্রামের ‘নামকরা’ (আসলে ‘বদনাম’ করা) ছিঁচ্কে চোর হল ষষ্ঠীচরণ। ছিঁচ্কে হলেও ষষ্ঠী চোর মোটেও নিজেকে এলেবেলে ভাবে না। সে স্বপ্ন দেখে সে হবে একদিন এক বিশাল রক্তজল করা হারে রে রে রে রে ডাকাতদলের মালিক! আর তার জন্যই সে লোকের ঘটিটা, বাটিটা চুরি করে বেড়ায়। বেচারা টাকা চুরি করতে সুযোগ পায় না। টাকা তো সব ব্যাঙ্কে থাকে; তাই। তা সেই ষষ্ঠীচরণ এসেছিল হাবুলদের বাড়ির অতিথি “রামদুলালের নাতি” গন্ধর্বনারায়ণ ওরফে গেনুদার সেই খুব দামী হীরে বসানো ঝকমকে সোনার আংটিটা চুরি করতে। আর এসে কিনা শুনে ফেলল, হাবুলদের এই সম্পত্তি জমি বাড়ি বাগান পুকুর দুর্গাপূজা কিছুই নাকি হাবুল দের নয়, সবই নাকি হাবুলের দাদুকে গচ্ছিত রাখতে দিয়ে গিয়েছিলেন এক সময়ের বিখ্যাত ডাকাত “রামদুলাল”। শর্ত ছিল তিরিশ বছরের মধ্যে যদি রামদুলালের নাতি গন্ধর্বনারায়ণ ফিরে আসে, যার হাতে থাকবে ঐ বিখ্যাত হীরের আংটি আর তাকে চিনে নেবে শ্বেত আর লোহিত নামে রামদুলালের দুই সাকরেদ লাঠিয়াল, তাহলে রামদুলালের নাতিকেই তার সব সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবেন হাবুল- তিন্নির দাদু।
হাবুল আর তিন্নি |
অথচ তিরিশ বছর পূর্ণ হওয়ার সময়, মহালয়ার দিন সকালে সিল্কের চাদর দুলিয়ে, নতুন পাঞ্জাবী পরে যে গন্ধর্বনারায়ণ উপস্থিত হলেন হাবুলদের বাড়িতে আর বিকেলে তাঁরই জন্য বন্ধ হয়ে গেলো গ্রামের বাড়ির দুর্গাপুজো; আর মহালয়ার রাতেই কি না রোমহর্ষক কাহিনীর মধ্যে দিয়ে জানা গেলো আসলে তিনি আসল গন্ধর্বনারায়ণই নন!!!! সব ওই শ্বেত আর লোহিতের কারসাজি! আর তার সঙ্গে সঙ্গেই হাবুলের ছোটকার ঝাক্কাস্ অ্যাকশনের মধ্যে দিয়ে ঘটে গেলো আরো একটা ম্যাজিক! ভালো লোকের কাছে পরাজিত হল অনেক শক্তিশালী দুষ্টু লোক। অনেক বছর পর জীবনের ভালো আর মন্দ গুলো তোমরা যখন জানতে শিখবে, তখন দেখবে হীরের আংটি সিনেমার এই ভালো স্বভাবের, ভালো মানুষের জিতে যাওয়ার গল্পটা তোমাদেরকে নতুন করে লড়াই করার শক্তি যোগাবে, ভালো মানুষ হয়ে ওঠার প্রেরণা দেবে। হীরের আংটি সেই প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ভালোত্বের, মনুষ্যত্বের গল্প বলে। আর বলে সম্পর্কের কথা। গেনুদা একা মানুষ, তাই না গেনুদা অত সহজে ওই বাজে লোকগুলোর খপ্পরে পড়েছিল। যেই না হাবুল তিন্নি কে পেলো গেনুদা, অমনি তার মনের কত বদল হল বল দেখি! সে সব সম্পত্তি ফিরিয়ে দিল হাবুলের দাদুকে, মায় কমল হীরের অসম্ভব দামী আংটিটাও সে হাবুলকে দিয়ে গেলো ভালোবাসার ‘অভিজ্ঞান’, মানে চিহ্ন হিসেবে, এটাই বা কি কম কথা! এই লোভ না করতে শেখার গল্পই হল হীরের আংটি।
হাবুল - তিন্নির দাদু |
বন্ধুরা আজ মহালয়ার দিনে “ম্যাজিক ল্যাম্পের” আলোয় তোমাদের মুখ চোখ যখন আনন্দে আর বিস্ময়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, তখন খুব সহজে, না না সিনেমার জন্য ডিভিডি বা সিডির দরকার নেই; অনেক সময় মহালয়ায় এটা টিভিতেই দিয়ে দেয়! অথবা স্রেফ এখানে ক্লিক করে ‘ইউটিউব’ খুলে কম্পিউটারেই দেখে ফেলো না বহু বছর আগের আরেক মহালয়ার দিনের গল্প ‘হীরের আঙটি’। দেখবে এই সিনেমা আর তার অভিনেতাদের তোমরা কোনোদিনই ভুলতে পারবে না, সে তোমরা একদিন যত বড়ই হয়ে যাও না কেন! এই অভিনেতাদের মধ্যে অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই; আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই এই ছবির পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ-ও। কিন্তু বাংলা সিনেমার সিন্দুকে রেখে যাওয়া তাঁর ‘হীরের আংটি’ এখনও ঝলমল করছে বাঙালীর মনে।।
কি বন্ধুরা তাহলে এবার পুজোর শুরুতেই দেখে নিচ্ছ তো ‘হীরের আংটি’?!
-------
[ছবি সূত্রঃ ইন্টারনেট]
এই ছবিটা আমাদের ছেলেবেলায় এক আনাস্বাদিত ভাল লাগা এনে দিয়েছিল। মনে আছে শীর্ষন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্পটা পড়ার আগেই এই ছবিটা দেখে ফেলেছিলাম। তাতে অবশ্য পরে গল্পটার স্বাদ আলাদা করে পেতে কোন অসুবিধা হয় নি। নিঃসন্দেহে বিশ্ব সিনেমার মানে ছোটদের ছবির নিরিখে একটা খুব ভাল কাজ। লেখিকাকে অনেক ধন্যবাদ অনেক পুরনো একটা আশ্চর্য অলস দুপুরের স্মৃতি পুনর্জাগরূক করিয়ে দেয়ার জন্য। আশা করব এখনকার ছেলেমেয়েরাও এই ছবি দেখে সেই জাদু পৃথিবীর খোঁজটা পাবে।
ReplyDeleteআপনাকে অনেক অভিনন্দন আপনার মন্তব্যের জন্য... আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় উপরের দিকে থাকা এই সিনেমা আজ এই বড় হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে আমাকে আবার আমার স্মৃতি সত্তা শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যায়... তাছাড়াও সিনেমাটির মধ্যে এমন এক শুদ্ধতা খুঁঁজে পাই আমি, যা আজকের দিনে অমিল এবং অচল -ও হয়তো... তবু মায়া রহিয়া যায় ... লেখিকা :)
Delete