গল্পের ম্যাজিক:: সুহাসের হাসি - রাজীবকুমার সাহা

সুহাসের হাসি

রাজীবকুমার সাহা


     রুই মাছের মাথা নারকোল দিয়ে খেয়েছ কখনও? বেশ পাকা মাথা? খাওনি তো? আমাদের সুহাসের কিন্তু এটাই ছিল খুব প্রিয় খাবার। ছিল বলছি এই কারণে, সুহাসের সাথে আমার দেখা নেই দীর্ঘদিন। সুহাস আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। ছোটখাটো চেহারা, হাড় জিরজিরে লিকলিকে হাত পা। কিন্তু হাসিটি ছিল একেবারে চোয়াল ছড়ানো। অন্যের বিপদ-আপদে মুহূর্তের মধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়ত। আবার যখন তখন ভয় দেখিয়ে লোককে জব্দ করতেও স্তাদ ছিল। আমার এই অকুতোভয়, পরোপকারী আর সদাহাস্যময় বন্ধুটিকে ভালবাসতাম খুব। ওর গজদাঁতের হাসিটা ছিল খুব মিষ্টি। তবে রেগে গেলে বা ইচ্ছে করলে ও খি খি করে এমন একটা হাসি হাসত যা দেখলে বা শুনলে রীতিমত শিউরে উঠতে হয়। এটাকে কুটিল না জটিল, ভূতুড়ে না অদ্ভুতুড়ে বলা যায় মাথায় আসত না।



     একমাত্র লেখাপড়া ছাড়া আর কোনও ব্যাপারেই মনের দোটানায় পড়ে সুহাসকে টেক্কা দিতে পারিনি। পরে বুঝেছি, মন দিয়ে পড়াশোনা করা আর মনকে আলোকিত করে সেই নির্মল রশ্মি নিঃস্বার্থভাবে কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দেওয়া এক জিনিস নয়। আমি পারিনি, সুহাস পেরেছিল।

     বইয়ের পাতায় সুহাসের মগজটা ততটা খেলত না, যতটা খেলত দুষ্টুমি বুদ্ধিতে।

     তখন আমরা ক্লাস এইট কি নাইনে পড়ি। শীতের সময়, পৌষের শেষ কি মাঘের শুরু সেবার শীতটাও পড়েছিল বেশ। সবাই জানে, এমন শীতে গাছ থেকে নামিয়ে তাজা খেজুরের রস সকালের রোদে বসে গ্লাস ভর্তি করে খেতে বড়ই মিষ্টি লাগে। আমাদের এলাকাটা ইদানীং শহরের তকমা পেলেও সেসময় একটু পাড়াগেঁয়ে গোছেরই ছিল। আর সৌভাগ্যবশত আমাদের বাড়ি থেকে অল্প দূরেই একটা পোড়ো মাঠের ধারে গোটা তিনেক খেজুরগাছও ছিল। স্বভাবতই ছেলেবেলায় আমরা শীতের সকালে খেজুর-রস থেকে বঞ্চিত হইনি।

     গাছগুলোর মালিক ছিল আমাদের পাড়ার মনাদা। মনাদা রোজ দুপুরের পরে খেজুরগাছগুলোর গলা চেঁছে, কাঠি গুঁজে একটা করে হাঁড়ি বেঁধে দিয়ে চলে যেত। আর সারা রাত ধরে সেই কাঠি বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা রস নেমে হাঁড়িগুলো ভর্তি হয়ে থাকত। বেশি শীত পড়লে কখনও বা হাঁড়ি উপচে রস পড়ত মাটিতে। মনাদা রোজ অন্ধকার থাকতে ভোরে গাছে উঠে রসের হাঁড়িগুলো কোমরে গোঁজা আংটায় করে নামিয়ে আনত। যারা চাইত তারা পাত্র হাতে গাছের নীচে গেলে মনাদা দুই কি তিন টাকা লিটার দরে খেজুরের রস বিক্রি করত। আর বাকিটা বাড়ি নিয়ে গিয়ে জ্বাল দিয়ে নলেনগুড় তৈরি করে বিক্রি করত।
     তো একবার হয়েছিল ক, কয়েকবার চাওয়া সত্ত্বেও মনাদা এক টুকরোও নলেনগুড় সুহাসের হাতে তুলে না দেওয়ায় খানিকটা চুরি করে ফেলে সুহাস। এ নিয়ে সুহাসের বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করে ওর বাবাকে সালিশি মেনে একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলে মনাদা। সুহাসের বাবা সরল-সিধে মানুষ। সামান্য নলেনগুড় নিয়ে এই অপমান মেনে নিতে পারেননি। প্রচণ্ড মার মেরেছিলেন সুহাসকে সেদিন। ঠাণ্ডা মানুষ হঠা রেগে গেলে যা হয় আর কী!

     বাবার হাতে মার খেয়ে মনে মনে ফুঁসতে থাকলেও মুখে কিছু বলেনি সুহাস। ঘটনাটা ওর মনেও কম আঘাত করেনি। আমার ডাকাডাকি, কাকিমার কান্নাকাটি উপেক্ষা করে দু’তিনদিন নিজের ঘরের খিল আটকে বসেছিলদানাপানি স্পর্শ করেনি। ওর আদরের কুকুর ভোলাও খুব চিকার চেঁচামেচি করত সুহাসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সুহাসকে বের করা যায়নি। পরে বুঝেছিলাম, এই ক’দিন একা বসে মনাদাকে শায়েস্তা করার মতলব ভাঁজছিল সুহাস

     হঠা একদিন বিকেলবেলা আমায় ডেকে নিয়ে গিয়ে ওর কীর্তি দেখাল সুহাস। কোত্থেকে বাঁশ, খড়, মাটির হাঁড়ি আর এক টুকরো সাদা কাপড় যোগাড় করে একটা বীভস মূর্তি বানিয়েছে ও। ওর গোপন বাক্স থেকে বের করে আমাকে এক ঝলক দেখিয়েই আবার বাক্সবন্দী করে ফেলল তক্ষণা। চোখে মুখে রহস্যের হাসি ঝিলিক মারছে। প্রথমে চট করে ধরতে না পারলেও সুহাসের চোখ মুখ দেখে ওর উদ্দেশ্যটা টের পেয়ে গেলাম। আর সাথে সাথে পই পই করে বারণও করলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা! সে রাত্রেই খেজুরগাছের পাশের একটা লিচুগাছের ডালে ওই ভয়ঙ্কর পুতুলটা ওর প্ল্যানমতো ফিট করে এল। দু’গাছি কালো রঙের রশি লিচুগাছটার ডাল থেকে খেজুরগাছ অবধি এমনভাবে টেনে এল যাতে এক গাছ থেকে পুতুলটাকে আরেক গাছে অনায়াসে টেনে আনা যায়। অন্ধকারে কালো রঙের রশি দেখা যাবে না বলে মনে হবে যেন সত্যি সত্যিই ভয়ঙ্কর একটা কিছু এক গাছ থেকে আরেক গাছে হাওয়ায় ভর করে চলে আসছে। 

     ভোর চারটে বাজার খানিক আগেই বিছানা ছেড়ে লিছু গাছটায় উঠে লুকিয়ে রইল সুহাস। দু’হাতে দুটো রশির প্রান্ত। শীতের ভোর, আকাশের গায়ে তখনও বেশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভোরের আলো ফুটতে ঢের দেরি। খানিক পরেই মনাদা খেজুর গাছের তলায় চলে এল ভোর-কীর্তন গাইতে গাইতে। পবের আকাশটা ততক্ষণে হালকা হতে শুরু করেছে একটু একটু করে। জুতোজোড়া খুলে রেখে অভ্যস্ত কায়দায় খেজুর গাছের মাথায় উঠে এল তরতর করে মনাদারোজকার মতো যেই মাত্র রসের হাঁড়িটার বাঁধন খুলেছে মনাদা, এমন সময় লিছুগাছ থেকে রশিতে পড়ল টান। সড়সড় করে সাদা থান পড়া কিছু একটা তেড়ে আসতে লাগল হাওয়ায় ভর করে মনাদার দিকে। কিন্তু কুয়াশার পর্দা ভেদ করে স্পষ্টভাবে কিছু দেখা যাচ্ছে না।  আর যখন দেখতে পাওয়া গেল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ভালো করে ওটার দিকে চোখ পড়তেই মুহূর্তের মধ্যে ‘ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের’ প্রভাতী সুর গেল থেমে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কানে আসছে একটা অদ্ভুত বিটকেলে হাসি – খি খি খি। মুখে অস্ফুট একটা গোঙানির মতো আওয়াজ করে গৌরাঙ্গের ওপর বিন্দুমাত্রও আস্থা না রেখে সোজা রামনাম জপতে জপতে টেনে হিঁচড়ে শরীরটাকে খেজুর গাছের অর্ধেকটা পর্যন্ত নামিয়ে আনল মনাদা। তারপর এক লাফে বাকি অর্ধেকটা পার করে কোনোমতে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়েই পড়ি মরি করে এক ছুট লাগালবাবা গো, মা গো, ভূতে মেরে ফেলল গো বলে চেঁচাতে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল মনাদা
     এই ছিল আমাদের সুহাস।
    
     সুহাসের বাবা অবনীবাবুর হাসপাতালের চাকরি। ছোট চাকরি, আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না। আমরা ক্লাস ইলেভেনে পড়ার সময়ই অবনীবাবু বদলি হয়ে চলে গেলেন পরিবার সমেতসুহাসের সাথেও আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। সজল চোখে মালপত্রসহ বন্ধুকে ম্যাটাডোরে তুলে রওনা করিয়ে দিয়েছিলাম। সুহাস ওর নতুন ঠিকানাটা এক টুকরো কাগজে লিখে আমার হাতে গুঁজে দিয়েছিল মনে আছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কাগজের টুকরোটাও মলিন হতে হতে এক সময় কোথায় যে হারিয়ে গেল, খুঁজে পেলাম না। ঠিকানাটা মুখস্থ করে রেখেছিলাম। কিন্তু কাগজে লেখা গোটা গোটা অক্ষরগুলোও আস্তে আস্তে স্মৃতির আকাশে আবছা হতে হতে মিলিয়ে গেল এক সময়। শেষ পর্যন্ত আর ঠিকানাটাও মনে নেই।

     আমি মন দিয়ে পড়াশোনা করেছি। বড় হয়েছি। মোটা বেতনের চাকরি করছি। যা যা না করলে সমাজে মুখ থাকে না সবই করেছি। পাশাপাশি আর সবাইকার মতো সুহাসকেও মন থেকে প্রায় মুছে ফেলেছি।

     কিন্তু সুহাস যে আমায় ভোলেনি তার প্রমাণ পেলাম দিন তিনেক আগে।

     একদম আনকোরা চাকরিটা নিয়ে হপ্তাদুয়েক হল এখানে এসে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। পাড়ার মুখেই একটা বাজার আছে। নিত্যদিনের খরচপাতিটা ওখান থেকেই করি আমি। একা থাকি, একদিন বাজার করলে তিনদিন চলে যায়। সেদিনও অফিসের বাস থেকে নেমে সোজা বাজারে ঢুকলাম গিয়ে। তিনদিন চারদিন ধরে লাগাতর বৃষ্টি হচ্ছে। কাদা পচে গিয়ে কালো হয়ে থিকথিক করছে চারদিক। এই সন্ধের মুখেও বাজারে লোকজন নেই তেমন। আমি সোজা মাছ-বাজারে ঢুকে বেশ পাকা দেখে একখানা রুইমাছ থলেতে পুরে বেরোবার মুখেই কাঁধে একটা ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শ পেলাম। শীতল আবহাওয়ার দরুনই হোক আর যে কারণেই হোক, হাতের স্পর্শটা এতটাই ঠাণ্ডা ছিল, যে চমকে উঠলাম। ভ্রূকুটি করে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি আমারই বয়সী একটা তালঢ্যাঙা লোক আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। জামাকাপড় ভিজে লেপটে রয়েছে গায়ে। খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম নির্বাক।

     “কী রে তুই! এখনও চিনতে পারিসনি?” বলে লোকটা যেই হেসেছে, ভ্রূকুটিটা সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গিয়ে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আমার। সেই ভুবনভোলানো গজদাঁতের হাসি!
     “আরে সুহাস! তুই?” উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ল আমার গলায়।
     “হ্যাঁ রে! তা রুইটা তো বেশ পাকা সাইজের নিলি দেখলাম। একজোড়া নারকোল নে না বেশ ঝুনো দেখে।”

    যা ব্বাবা, রুইমাছ কিনলে সাথে নারকোলও কিনতে হয়! হঠা একটু থতমত খেলেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সুহাসের ‘নারকোল দিয়ে রুইয়ের মুড়ো’-এর কথা মনে পড়ে গেল। আর সাথে সাথেই হা হা করে প্রাণ খুলে হেসে দুই বন্ধু এসে বসলাম একটা চায়ের দোকানের টুলে। বেশ শীত শীত লাগছে। দুটো চায়ের কথা বলতেই সুহাস বারণ করে দিল। বলল, “তুই খা অন্তু, আমি তো চা খাই না জানিসই।”
     আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “হ্যাঁ, কিন্তু তখন খেতিস না বলে এখনও খাবি না তা কি হয়! ভিজে চুপসে আছিস, এক কাপ খা, বেশ আরাম লাগবে।”
     সুহাস আমার কথা পাত্তা না দিয়ে বলল, “তারপর বল, এখানে কী করছিস? চাকরি?”
     আমি মাথাটা দু’বার উপর-নিচু করে বললাম, “আরে আমারও তো একই প্রশ্ন রে! তুই এখানে? কী করছিস এখন?”

     প্রশ্নটা কানে আসতেই হঠা উদাস হয়ে গেল সুহাস। লম্বা একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আমার আর করা। বাবার চাকরি যদ্দিন ছিল মা চালিয়ে নিত এক রকম। চাকরি পেরিয়ে পেনশনে যেতেই মা’র হাতের দড়িরও পাঁক খুলতে লাগল। অনেক ধরা-করা করে আমি শেষ পর্যন্ত একটা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিতে......”
     আমার চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে বললাম, “থাকিস কোথায় তোরা এখানে?”
      সুহাসের দেওয়া ঠিকানা জেনে বললাম, “বাহ! এ যে আমার অফিসের লাগোয়া। কই দেখিনি তো তোকে?”
     সুহাস একটু তাচ্ছিল্যভরে জবাব দিল, “দেখবি কোত্থেকে? বাড়িতে থাকলে তো? সারাদিন হয় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি নয় গ্যারেজেই পড়ে থাকি। গ্যারেজই এখন আমার সব।”
     আমি একটু হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কাকু... কাকিমা...”
     “হ্যাঁ রে হ্যাঁ, এখন সুখেই আছে, চ।”
     “বাড়ি ছেড়ে চলে এলি, ঝগড়া করেছিস?”
     “সে হয়েছে কিছু একটা। পরে বলব একদিন। এখন চল তো! ওঠ।”
     কথাগুলো বেশ তাড়াতাড়ি বলে উঠে দাঁড়াল সুহাস। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায়?”
     “এই কাছেই। একটা খুব সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাব তোকেভালো লাগবে তোর। উঠে আয়!”
     আমি দোনামনা করে বললাম, “এই বৃষ্টিতে? তাছাড়া অন্ধকারটাও কেমন মিশমিশে দেখেছিস? দেখতেই পাব না কিছু।”
     আমার চোখে চোখ রেখে খি খি করে সেই অদ্ভুত হাসিটা হাসল সুহাস। তারপর রুখে দাঁড়িয়ে বলল, “দেখতে হবে না। শুধু অনুভব করবি আয়।”

     সুহাসের গলায় এমন কিছু একটা ছিল যা আমি আর বাধা দিতে পারলাম না। তাছাড়া এতদিন বাদে ছোটবেলার একমাত্র বন্ধুকে পেয়ে এত ভালো লাগছিল যে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণটা হারিয়ে ফেলছিলাম আস্তে আস্তে। থলেটা তুলে নিয়ে যন্ত্রচালিতের মতো সুহাসের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। বাজার ছাড়িয়ে, পাকা রাস্তা থেকে কাঁচা রাস্তায় নেমে, ধানক্ষেতের আল বেয়ে, কাঁটা ঝোপঝাড় মাড়িয়ে হেঁটেই চলেছি।

     হাঁটতে হাঁটতে এক সময় জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ রে সুহাস, কোথায় যাচ্ছি আমরা বলতো?”
     সুহাস মুখঝামটা দিয়ে বলল, “আচ্ছা, তখন থেকে অত বেগড়বাই করছিস কেন বলতো? আমার পিছু পিছু হাঁটতে থাক না মুখ বুজে।”
     শেষ পর্যন্ত একটা ঢালুমতো জায়গায় এসে পৌঁছলাম কিছুক্ষণ পরে। মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে হেঁটেই চলেছি আমি। অন্ধকারে কিছুই ঠাহর হচ্ছিল না। চারদিকে বৃষ্টির শব্দ আর ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। মাথা থেকে পা যেন দশমনি পাথর হয়ে আছে। শেষে পায়ের নিচে বালি পেয়ে আর কানে অস্পষ্ট একটা কুলকুল আওয়াজ আসতেই বুঝলাম আমরা একটা নদীর পাড়ে এসে পৌঁছেছি। কাছেপিঠে কোথাও শেয়াল না শকুন ডাকছে। একবার মনে হচ্ছে কুকুরের কান্না, আর একবার মনে হচ্ছে কারও বাচ্চা কাঁদছে। ধপ করে বালির ওপর বসে পড়লাম আমি। একে সারাদিনের খাটুনি, তায় আবার এই অবেলায় বৃষ্টি ভেজা – শরীরের শক্তি যেন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসছে।

     বসে পড়ে বললাম, “আচ্ছা সুহাস, তুই কী বলতো? সেই খ্যাপাটেই থেকে গেলি চিরটা কাল? এই বাদলায় বনে-বাদাড়ে ডেকে নিয়ে এলি, যদি সাপ-টাপ কিছু একটা কামড়াত অন্ধকারে? কেন, একদিন বিকেল-টিকেলে আসা যেত না?”

     কোনও জবাব পেলাম না। পরিবর্তে একটু দূর থেকে যেন সুহাসের সেই অদ্ভুত খি খি হাসি কানে ভেসে এল। মিথ্যে বলব না, গাটা কেমন যেন ছমছম করে উঠলসুহাসকে আবার ডাকলাম। এবারও সাড়া পেলাম না। হঠা দূরের আকাশে একবার বিদ্যু চমকাল। আবছা আলোয় দেখলাম একটা বাঁশঝাড়ের পাশে বসে আছি আমি। আর সুহাস দাঁড়িয়ে আছে আমার ঠিক পাশেই। এক ঝলক আলোতে সুহাসকে যেন আরও বেশি ঢ্যাঙা লাগল দেখতে। অন্ধকারে আর বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না। শীত শীত করছে। সারাটা শরীর ঝিমিয়ে পড়ছে একটু একটু করে। ভাবলাম, অনেকটা পথ ভেঙে এসেছি এই বাদলা মাথায় করে, তাই হয়ত এমন লাগছে। এখন জ্বর-টর কিছু একটা না বাঁধালেই হয়।

     গলায় বেশ জোর নিয়েই সুহাসকে ডেকে বললাম, “সুহাস, তোর মনে আছে, আমরা সন্ধেবেলায় মাঠ ফেরত সাইকেল চেপে কতদূর চলে যেতাম? মনে আছে তোর? অ্যাই সুহা...”

     আর বলতে পারছিলাম না। গলার জোর পড়ে আসছিল। শেষের কথাগুলো নিজের কানেই কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকছিল। টের পেলাম সুহাস এসে বসল পাশে যেন বলছিল কিন্তু স্পষ্ট করে শুনতে পাচ্ছি না, কানে জড়িয়ে যাচ্ছে গলার স্বরটা অস্বাভাবিক ফাঁপা। ভেবে দেখলাম, শরীরটা আস্তে আস্তে খারাপ লাগছে বেশি। মাথায় বৃষ্টি নিয়ে এই জলের ধারে আর বসে থাকা ঠিক নয়। হঠা যেন বেশ শীত করতে শুরু করেছে। একটু একটু করে সমস্ত গায়ের জোর আবার একত্রিত করে সুহাসকে বললাম, “না ভাই, আর বসে থাকা ঠিক হবে না। এবার ওঠ। চল ফিরে যাই। বাড়ি যাবি তো?”
     “কার বাড়ি? তোকে তো বললাম তখন, আমি বাড়ি যাই না।”
     “তবে আমার ওখানেই চল। রাতটা কাটিয়ে যাবি আজ।”
     বলেই লক্ষ্য করে দেখলাম, একটু দূরে কারা যেন একটা মড়া নিয়ে আসছে নদীর দিকে হরি ধ্বনি দিতে দিতে।
     দুই বন্ধু উঠে পড়লাম। আবার সেই রাস্তা। কাঁটা ঝোপ, কাঁচা পথ তারপর পাকা রাস্তা। হঠা হঠা দমকা হাওয়ায় দুজনের ভিজে জামাকাপড়গুলো পতপত করছে। পাকা রাস্তায় উঠে দেখলাম জনমনিষ্যি তো দূর, রাস্তার কুকুরগুলো পর্যন্ত নেই। বৃষ্টির জোরটা কমে গিয়ে এখন ঝিরঝির পড়ছে। শরীরটা এতক্ষণে আবার আগের জায়গায় ফিরে গেছে।

     বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে বললাম, “সত্যি সুহাস, তুই ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছিস। ঠিক যেন শরচন্দ্রের লালু। আমায় পর্যন্ত ছাড়লি না, ঠিক নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে ভয় পাইয়ে আনলি।”


     আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল ও। গেট আর দরজার তালা খুলে সুহাসকে ভেতরে নিয়ে এলাম। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি আর সারাদিন বন্ধ থাকার ফলে ঘরটা যেন আইসক্রিম ফ্যাক্টরির মতো ঠাণ্ডা হয়ে আছে। সটান বাথরুমে ঢুকে জামাকাপড় বদলে চটজলদি বেরিয়ে এসে দেখলাম সুহাস মেঝেতেই বসে পড়েছে। তাড়াতাড়ি বললাম, “সে কি রে! মেঝেতে কেন? ঠিক আছে আর বসতে হবে না। বাথরুমে যা, আমি তোর জন্যে কাপড় বের করে আনছি।”
     একগাল হেসে উঠে পড়ল সুহাস। বলল, “না রে, আজ থাক। এই চিনে গেলাম, আর একদিন আসব।”
     “ওমা! তুই না বললি থাকবি আজ?”
     “ওটা আমি নই, তুমি বলেছিলে বন্ধু।”
     মুখে সেই ভুবনভোলানো মধুর হাসি। আমি নাছোড়বান্দা হয়ে বললাম, “সে একই হল। না না, আজ তোকে থাকতেই হবে এখানে। কত গল্প করব ভেবে রেখেছি। আজ তোকে ছাড়ছি না।”

     কিন্তু মিনিট দশেক বাদানুবাদের পরেও সুহাসকে টলানো গেল না। হাল ছেড়ে দিয়ে শেষে বললাম, “আচ্ছা ঠিক আছে, না থাকিস খেয়ে তো যাবি? জাস্ট মাছের ঝোল আর গরম ভাত। বেশিক্ষণ লাগবে না রাঁধতে।”
     এই বলে হঠা হুঁশ হল, মাছের ব্যাগটা বারান্দাতেই পড়ে আছে। তালা খোলার সময় রেখেছিলাম নামিয়ে। তাড়াতাড়ি দরজার দিকে পা বাড়াতেই সুহাস বাধা দিয়ে বলল, “ওটা এখন থাক অন্তু, এনে কাজ নেই। আমি চলে যাচ্ছি। যাবার আগে একটা কথা শুধু...”

     গলাটা হঠা কেমন যেন পালটে গেল সুহাসের। গা ছমছম করা একটা স্বর। মুখখানা ভীষণ গম্ভীর। জিজ্ঞেস করলাম, “কী কথা?”
     “মনাদার সাথে সেই নলেনগুড়ের ঘটনাটা মনে পড়ে তোর? ছোটবেলায়? গুড়টুকু যে আমিই চুরি করেছি সে খবরটা কে লাগিয়েছিল রে মনাদার কানে? অ্যাঁ? ছিলাম তো শুধু তুই আর আমি।”
     ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কোনওমতে একটু ঢোঁক গিলে তোতলাতে লাগলাম, “আ-আমি, আমি, মানে ইয়ে...”
     এত বছর পরে এই বয়সে আবার ছোটবেলার সেই কলঙ্কটা এসে সামনে দাঁড়াবে ভাবতে পারিনি কখনও। লজ্জায় চোখ রাখতে পারছিলাম না সুহাসের চোখে। মাথাটা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছি। আবার সুহাসের গলা ভেসে এল। তবে এবার গলার স্বরটা বেশ অস্বাভাবিক ঠেকল কানে।

     “বাবার হাতে মার খেয়েছিস কখনও বড় হয়ে? খেলে বুঝতিস ওটা শরীরের চেয়ে মনেই লাগে বেশি। এবারে তাহলে প্রতিশোধটা নিয়েই নিই, কী বলিস অন্তু? শেষবারের মতো চুকেবুকে যাক!”
     আমি চমকে উঠে হাঁড়িমুখে কোনও রকমে এক চিলতে হাসি টেনে আনার চেষ্টা করে বললাম, “অ্যাই যাহ্‌! কী আবার ফাজলামো শুরু করেছিস বলতো? তোর এই যখন তখন যাকে তাকে ভয় দেখানোটা এবার ছাড়
     আমার কথার ধার দিয়েও গেল না সুহাস। বলল, “যদি তোর ঘাড়টা মটকে দিয়ে যাই এখানে কেমন হয় বলতো? কেউ টেরও পাবে না, খি খি খি...”

     এবার গলার স্বরের সাথে সাথে চেহারাটাও ক্রমশ পালটাতে লাগল ওর। গোটা চেহারাটা হিংস্র হয়ে উঠতে লাগল একটু একটু করে। চোখ দুটো ভাটার মতো জ্বলছে। শুকনো চেহারাতে দাঁতগুলো আর হাড় ক’খানা স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল আস্তে আস্তেমাথাটা দপদপ করছে আমার একনাগাড়ে। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, ক হতে চলেছে এই মুহূর্তে। সুহাসের চেহারা দেখে এখন বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই যে, ও এখন আর ফাজলামো করছে না কারণ, কথাগুলো  বলেই আমার দিকে এগিয়ে এল সুহাস। দু’হাতের আঙুলগুলো দুটো গ্লাস ধরে রাখার ভঙ্গিতে আমার গলার দিকে এগিয়ে আনছে। আমার সারা শরীর গরম হয়ে উঠতে লাগল। পরক্ষণেই হিম হয়ে এল আবার। হাত পাগুলো নিজের বলে মনে হচ্ছে না আর। একেবারে অবশ হয়ে গেছে। হঠা লক্ষ্য করলাম, সুহাসের হাতের আঙুলগুলো কেমন যেন পাখির পায়ের আঙুলের মতো হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সব ক’টা আঙুল থেকেই লম্বা লম্বা ধারালো নখ বেরিয়ে আসছে। গোটা মাথাটা, বুকটা আর ডান পা’টা থেঁতলে আছে একেবারে। ভীষণ শক্ত কিছুর ওপর কোনও নরম জিনিস আছড়ে পড়লে যেমন হয়। চাপ চাপ রক্ত লেগে আছে। হাসব কী কাঁদব, কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারছিলাম না। মা’র মুখটা বারবার ভেসে উঠছে মনে। ভাবছি, এই রাতদুপুরে কাকেই বা ডাকব। ইচ্ছে করেই খালি বাড়িটা ভাড়া করেছিলাম যাতে একটু গুছিয়ে বসে তারপর বাবা মাকে গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা যায়। এখন দেখছি এই খালি বাড়িতেই বেঘোরে মারা পড়ব। তীব্র টিউবলাইট দুটোর আলোতেও চারদিক কেমন যেন ঝাপসা লাগছিল।

     হঠা একটা কথা মনে পড়তেই পেছন ফিরে তাকালাম। জোরালো লাইটের আলোয় আমার পায়ের কাছে ছায়া পড়েছে। পরক্ষণেই সুহাসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর ছায়া পড়েনি মেঝেতে। বুকটা এবার ধড়াস ধড়াস আওয়াজ করতে লাগল।

     আমি আস্তে আস্তে পেছতে লাগলাম আর সুহাস এগোতে লাগল। এক সময় টেবিলে ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম মেঝেতে। গলা কাটা মুরগির মতো থরথর করে সারা শরীর। আমার অবস্থা টের পেয়ে সুহাস হেসে উঠল। খি খি করে সেই অদ্ভুত হাসি। আমার গা গুলিয়ে উঠছিল। বেশ কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে তারপর আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে সুহাস বলে উঠল, “ছেড়ে দিলাম যা! যা মাছটা নিয়ে আয় এবার। আমি গেলাম।”

     চকিতে দরজার বাইরে মাছের ব্যাগটার দিকে চোখ ফেরাতেই অনুভব করলাম একটা গুমোট অথচ বরফ-ঠাণ্ডা বাতাস যেন ঘরময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঘাড় ফেরাতেই দেখলাম সুহাস উধাও। ঠাণ্ডা বাতাসটা শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে এদিক ওদিক। কোনওমতে উঠে দাঁড়ালাম। পা দুটো কাঁপছে ঠকঠক করে। তারপরও শরীরের সবটুকু শক্তি এক করে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখি আলমারিটার মাথায় এক বিশাল আকারের বাদুড় বসে আছে। বীভস চেহারা। চোখে সেই জ্বলন্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে মাথা, বুকের কাছটা আর একটা পা রক্তাক্ত। আর মুখে অসংখ্য ছোট ছোট দাঁতের দু’পাশে দুটো অপেক্ষাকৃত লম্বা দাঁত। সুহাসের গজদাঁতের মতোই খানিকটা। আমি তাকাতেই ফাও ফাও শব্দে তেড়ে এসে আমার বাম পাশ ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

     নিজের চোখ বা কান, কোনওটাকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না পুরোপুরি। ও কআসলে সুহাসই? সুহাস... সুহাস এরকম করতে পারে আমার সাথে? যদি তাই হয়, ও ক তাহলে...? আর ভাবতে পারছিলাম না। একটুক্ষণ অপেক্ষা করে মনে অনেক সাহস এনে বারান্দা থেকে ব্যাগটা টেনে নিয়ে এলাম এক শ্বাসে। দরজায় দাঁড়িয়েই ব্যাগটা ফাঁক করে মাছটা টেনে আনলাম। দেখি, এত বড় রুই মাছটার মাথাটা কে যেন কামড়ে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। আর বাকিটা একেবারেই অক্ষত। সহ্য করতে পারলাম না। কারণ, কাটা মাছ দেখতে এক রকম। আর কামড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যাওয়া মাছ দেখতে... ও মা গো!
     এতক্ষণের সংশয়টা সত্যিতে প্রমাণিত হতে দেখে আর থাকতে পারলাম না। পা দুটো টলমল করতে করতে আঁধার নেমে এল চোখে। বেশ জোরালো একটা চিকার শুরু করেছিলাম মনে আছে। কিন্তু চিকারের শেষটা আবছা হয়ে মেঝেতেই নেতিয়ে পড়লাম আমি।

     পরদিন বেশ বেলাতে ঘুম ভেঙে জানতে পেরেছিলাম, আমার চিকারটা এতটাই জোরালো ছিল যে এই বৃষ্টির মধ্যেও পাশের বাড়ির লোকেদের কানে গিয়েছিল। ওরাই তক্ষণা এসে জলটল দিয়ে গরম দুধ খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে রাখে। আর একজন থেকেও যায় আমার ঘরে রাতে।

     দু’দিন অফিস যাইনি। তারপর যেদিন গেলাম, লাঞ্চ আওয়ারে খুঁজে পেতে সুহাসের বাড়ি গেলাম। সুহাস ঠিকানাটা এত সোজা করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, যে কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়নি। গেটটা ভেজানো ছিল। ঢুকে দেখলাম, বারান্দায় ভুলো শুয়ে আছে কুণ্ডলী পাকিয়ে। সুহাসের কুকুর। এত বছর পরেও ভুলোকে চিনতে পারলাম ঠিক। তবে বেশ বয়স হয়ে গেছে বোঝা যায়। আমাকে এক পলক দেখেই খ্যাঁক খ্যাঁক করতে করতে বাড়ির পেছনের দিকে চোঁচা দৌড় দিল। আবার ফিরে এসেই আমার থেকে অনেকটা সরে গিয়ে কার যেন আদর খেতে লাগল। হাওয়ার গায়ে জিহ্বা দিয়ে চাটতে চাটতে অনবরত লেজ নাড়ছে আর কেঁউ কেঁউ শব্দ করছে। চারদিক তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই। গাটা আবার ছমছম করে উঠল।

     কাকু-কাকিমার অনেক বয়স হয়ে গেছে। কাকিমা তো চোখেও দেখতে পান না ঠিকঠাক। তারপরও পরিচয় পেয়ে যথেষ্ট আপ্যায়ন করলেন। ঘরটা অসম্ভব ঠাণ্ডা। দরজা জানালা সব বন্ধ। চা খেতে খেতে আস্তে আস্তে সুহাসের কথা জিজ্ঞেস করলাম। ডুকরে কেঁদে উঠলেন কাকিমা। কাঁদতে কাঁদতে খুলে বললেন সব।

     সুহাস ট্রান্সপোর্ট এজেন্সিতে কাজ নিয়ে মাস দেড়েকের মাথায় একটা রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। গাড়ি চালানো শিখছিল অল্প কয়েকদিন ধরে। একদিন ভোরবেলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে মোড় ঘুরতেই একটা লরির সাথে মুখোমুখি হয়ে...।
     বলব ক বলব না ভাবতে ভাবতে এক সময় দু’দিন আগের ঘটনাটা সংক্ষেপে বললাম ওঁদের। কথার মাঝেই মুখ দুটো একেবারে সাদা হয়ে গেল কাকু-কাকিমারদেরকাকুর একটা হাত বেশ জোরে ঝাঁকিয়ে কাকিমা চেঁচিয়ে উঠলেন, “আমি তখন থেকে বলছি, ওঁর পিণ্ডটা দিয়ে এসো, দিয়ে এসো। গয়ায় না পারো এখানেই ব্যবস্থা হয় শুনেছি। এসব শোনার পরও ঠেকিয়ে রাখতে চাও?”
     কাকু একবার চকিতে কাকিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওঁর সাথে আমাদেরটাও নয়... বয়স তো আর কম হয়নি। ক বলো?”
     কাকিমা চটেমটে বললেন, “শুনলি, শুনলি অন্তু, তোর কাকুর কথাবার্তা?’’
     তারপর মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “ছেলেটা মরার পর থেকেই এই করে যাচ্ছে। কখন ক বলছে তার কোনও ঠিক ঠিকানা থাকে না। আমার হয়েছে মরণ!”

     কাকু শশব্যস্ত হয়ে বললেন, “আমি, আমি এর মধ্যেই ওবাড়ির হারুকে বলে ব্যবস্থা করছি। শুধু পুরোহিতকে একটিবার দিনক্ষণটা জিজ্ঞেস করে নিতে হবে।”
     গেট পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই একটা লোক এগিয়ে এল। বলল, “আপনি? এই বাড়িতে কী করছিলেন অতক্ষণ ধরে?”
     থতমত খেয়ে বললাম, “সুহাস আমার বন্ধু। ওঁর বাবা মাকে একটু দেখতে গেছলাম। আপনাকে তো ঠিক...”
     লোকটা হাঁ করে একটু তাকিয়ে থেকে বলল, “আমি হারু, হারধন সরকার। আপনি সুহাসের বাবা মা’র সাথে দেখা করে এলেন?”
     “হ্যাঁ, অনেকক্ষণ বসেছিলাম। অনেক কথা হল। কেন?”
     “আপনি কি মিথ্যেবাদী, না প্রেতাত্মা মশাই? মাস দুয়েক আগে তিনজন যারা একই সাথে অ্যাকসিডেন্টে মারা গেল, আ-আপনি তাঁদের সাথে কথা বলে এলেন?”
     “মানে? কী আজেবাজে বকছেন আপনি?”
     “মানেটা হচ্ছে, সুহাস সেদিন ভোরে ওঁর বাবা মাকেও উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল গাড়িতে শখ করে। তারপর কিছুদূর গিয়ে একটা মোড় ঘুরতেই... কেউই বাঁচেনি সেদিন। তিনজনই স্পটডেড।”
     আমি টলতে টলতে কোনও মতে এগোতে লাগলাম অফিসের দিকে।
     তারপর থেকে এখনও মাঝেমাঝে সুহাসের সেই ভূতুড়ে হাসির শব্দ কানে বাজে আমার। আর সাথেসাথেই বুকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে।
___________

অলংকরণ –পুষ্পেন মণ্ডল

লেখক পরিচিতিঃ ত্রিপুরার মন্দিরনগরী উদয়পুরে জন্ম। বেড়ে ওঠা এবং স্থিতি গোমতী জেলার কাকড়াবনে। পেশায় একজন ফার্মাসিউটিক্যাল ডিস্ট্রিবিউটর। নেশা, বই পড়া, সিনেমা দেখা আর কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় অনেকদিন ধরেই লেখালেখি করছেন।

5 comments:

  1. Rajib, Durdharsha likhecho. jawab nei. Besh Bhalo nah, Satyi bolte, BHOY laglo

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!

      Delete
  2. ঝরঝরে লেখার হাত আপনার। আরও লিখুন।

    ReplyDelete
  3. ফার্স্ট ক্লাস। ভয়ের আবহটা বেশ ভালো তৈরি হয়েছে। আরো পড়ার আশায় রইলাম।

    ReplyDelete