রবিন জেঠুর ক্যামেরা
পুষ্পেন মণ্ডল
রবিন জেঠুর ক্যামেরাটা আমার হাতে এসেছিল অনেক গুলি হাত ঘুরে। ইনি বাবার ছোট বেলার বন্ধু ছিলেন। মাঝে দীর্ঘ দিন আমাদের সাথে কোনও যোগাযোগ ছিল না। তিনি মারা যাবার পর বাবা খবর পেয়ে এক বন্ধকি দোকান থেকে ক্যামেরাটা উদ্ধার করেছিলেন। আসলে তিনি ছিলেন এক ভবঘুরে প্রকৃতির মানুষ। বাবা বললেন,“শুনেছিলাম এই নিকোম্যাটের জুম লাগান ক্যামেরাটি নেপালে এক সাহেবের কাছ থেকে কিনেছিলেন রবিন দা, বছর তিরিশেক আগে। শেষ জীবনে টাকার প্রয়োজনে হয়ত বন্ধক দিতে হয়েছিল।”
প্রায় দু থেকে আড়াই কেজি ভারি। পুরানো আমলের রিল লাগানো সিস্টেম। এখন ডিজিট্যাল যুগে এই ধরনের ক্যামেরা একেবারেই অচল। ম্যানুয়াল সেটিং জুম। ক্যাপ খুলে আইহোলে চোখ রাখতে ভেতরটা ঘোলাটে মনে হল। লেন্সের গায়ে ফাঙ্গাস পড়েছে বোধ হয়। কালো কালো ছোপ। বাবা এই পুরানো জিনিসটা কেন বন্ধকি দোকান থেকে ছাড়াতে গেলেন কে জানে? যাই হোক সেটা আসার পর থেকে বুক সেলফের এক কোণে পড়ে রইল অনেক দিন। এবং ক্রমশ স্মৃতির পলিতে চাপা পড়ে গেল।
ঘটনাটা ঘটল আমি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হবার পর। বোটানির এক্সকারসানে চার পাঁচদিনের জন্য গ্যাংটক যাব। যাবার দিন ট্রেন ছাড়ার দু ঘণ্টা আগে মৃণাল ফোন করে জানাল যে তার ডি.এস.এল.আর. ক্যামেরাটা গণ্ডগোল করছে। ছবি তোলার পর সেভ হচ্ছেনা। মনে হয় সার্কিটের কোনও সমস্যা। দোকানে না দিলে সারানো যাবে না।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “এখন কী হবে? আমাদের গ্রুপে তো ঐ একটা ভালো ক্যামেরা। কী ছবি নিয়ে প্রোজেক্ট জমা দেব!”
এক্সকারসানের জন্য স্যার পাঁচজন করে এক একটা গ্রুপ করে দিয়েছেন। আমার সাথে আছে মৃণাল, সাহেব, অরিজিৎ আর তন্ময়। সে বলল, “আমিও তো চিন্তায় মরছি। অন্য সবাইকে ফোন করেছিলাম। ওরা বলল অর্ডিনারি ডিজিট্যাল ক্যামেরা ছাড়া কিছুই যোগাড় করা যাবে না। কিন্তু তাতে আর কত ভালো ছবি হবে? দূরের ছবি তো কিছুই আসবে না। তোর কোনও চেনা লোকের কাছে ভালো ক্যামেরা পাওয়া যাবে?”
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “ট্রেন ছাড়তে আর কত বাকি ভাই? এখন কাকে বলব? ব্যাগ গুছানো রেডি। আর কিছু হবে না। ফোন রাখ।”
বাবা শুনে বললেন, “তুই এক কাজ কর, রবিনদার ঐ পুরানো নিকোম্যাট ক্যামেরাটাই নিয়ে যা। এক সময়ে ঐ ক্যামেরাতেই দারুণ ছবি হয়েছে। আমি দেখেছি। টেকনিক্যালি পুরানো হলেও জাপানী জিনিস তো!”
তা শেষমেশ ঐ ক্যামেরার জন্য আমার লাগেজ আরও আড়াই কেজি ভারি হয়ে গেল। আর মনের মধ্যে থেকে গেল অস্বস্তি। ক্যামেরাটা তো নিলাম কিন্তু এর ঝামেলা অনেক। এর রিল এখন পাই কোথায়? আর রিল পেলেই হবে না সেটাকে ঠিকঠাক সেট করতে হবে। ফ্ল্যাশ গানের জন্য লাগবে চারটে পেনসিল ব্যাটারি।
রাত্রের ট্রেনে স্লিপার কোচে কলেজের ছেলেমেয়েদের হৈচৈ আর হুল্লোড়ে সে কথা ভুলে গেলাম। পরের দিন সকালে নিউজলপাইগুড়িতে নেমে ব্রেকফাস্ট সেরে বাসে করে সোজা গ্যাংটক। পাহাড়ের রাস্তায় গাড়ি উঠতেই মনটা ডানা মেলে উড়ে গেল দূরে ঝাউগাছ আর শাল, সেগুন, রডোডেনড্রনের জঙ্গলে। তারপর এলো চা বাগানের সারি। সবার হাতে ক্যামেরা। পটাপট ছবি তুলছে। আমার সম্বল এনড্রয়েড ফোন। জবর জং ক্যামেরাটা পড়ে রয়েছে লাগেজের সাথে বাসের পেটের মধ্যে। কাছে থাকলেও তাতে ছবি তোলা যেত না। রিল নেই। আর বন্ধুরা দেখলে নিশ্চয় টিটকিরি করত।
গ্যাংটকে যখন পৌঁছলাম দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সন্ধ্যাবেলা লাগেজ থেকে ক্যামেরাটা বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে বের হলাম হাঁটতে। অনেক গুলি দোকানে খুঁজে শেষে এম.জি.মার্গের এক প্রান্তে এক নেপালি ভদ্র লোকের কাছে পেলাম ফুজি কোম্পানির একটা রিল। বত্রিশটা ছবি উঠবে এতে। তিনি নিজেই ক্যামেরাটা খুলে রিল ভরে দিলেন। আর বললেন, এই ধরনের ক্যামেরার ব্যবহার এখন অনেক কমে গেছে। খদ্দের পাওয়া যায় না। তবে জিনিসটা নাকি অ্যান্টিক। এখন এর সেকেন্ড হ্যান্ড দামও অনেক। তারপর ব্যাটারি ভরে ফিরলাম হোটেলে। দেখা যাক কাজ কতটা হয়। বন্ধুদের সাথে ফ্ল্যাশ গানে বেশ কয়েকটা ছবি তোলা হল। ডিজিট্যাল ক্যামেরায় যেমন রিওয়াইন্ড করে আগের তোলা ছবি দেখে নেওয়া যায়, এতে সে সুযোগ নেই। রিল পুরো শেষ করে ল্যাবে দিয়ে ওয়াশ করতে হবে। তবে ছবি দেখা যাবে।
বন্ধুদের সাথে হৈহৈ করে কাটল কটা দিন। প্রজেক্টের কাজে প্রতিদিন সকালে গ্যাংটক শহরের পাশে একটা গ্রামে যেতে হচ্ছে। অনেক নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা ‘রোরোচু’। সেপ্টেম্বরের ঠাণ্ডাটা এখানে বেশ কড়া। আর মাঝে মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি। শেষ দিনে সেখানে নিরিবিলি জঙ্গলের মধ্যে পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট্ট বুদ্ধিস্ট গুম্ফা আবিষ্কার করলাম আমরা। অসম্ভব সুন্দর নৈসর্গিক সেই পরিবেশ। পাথরের গায়ে খোদাই করা তিব্বতি ভাষায় ‘ওম্ মণিপদ্মে হুম্!’। শুধু পাথর নয় গুম্ফার গায়ে, গোল ঘণ্টার উপর, সব জায়গায় লেখা ঐ একই মন্ত্র। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে জুতো খুলে আমরা প্রবেশ করলাম গুম্ফার ভেতরে। চন্দন ধূপের গন্ধে মম করছে। সোনালী রঙের বুদ্ধ মূর্তির সামনে একজন বয়স্ক মোটাসোটা লামা হলুদ রঙের ফতুয়ার উপর লাল কাপড় জড়িয়ে ধ্যান করছেন। চোখ বন্ধ। প্রদীপ আর মোমবাতির আলোয় একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ সাহেব “খ্যাঁক খ্যাঁক” করে হেসে উঠল। কী ব্যাপার? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সে আঙুল তুলে কিছু একটা দেখার জন্য বলছে। চোখ পড়ল লামার চকচকে ন্যাড়া মাথায় ঠিক ব্রহ্মতালুর উপরে একটা সাদা টিকটিকি চুপ করে বসে আছে। আশ্চর্য!!
“ওটা কি ওনার পোষা টিকটিকি? হিহি.. হিহি..” সাহেব বরাবরই এরকম ফাজিল। আমরা সবাই ইশারায় তাকে চুপ করতে বললাম। কিন্তু সে সমানে হেসেই যাচ্ছে।
আমি এর মধ্যে ক্যামেরা বের করে ফ্ল্যাশগানে একটা ছবি তুলে নিয়েছি। চকাৎ করে আলো লাগতে লামা চোখ খুলে তাকালেন। সাংঘাতিক সে চাউনি। চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। আমরা তাড়াহুড়ো করে ওকে টেনে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। তাতেও সাহেবের হাসি আর থামছে না। গুম্ফা থেকে বেরিয়ে সরু পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখলাম লামা বারান্দায় বেরিয়ে আমাদের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন যেন ভস্ম করে ফেলবেন।
গুম্ফাটা পেরিয়ে উত্তর পশ্চিম দিকে পাহাড়ের ঢালে ট্রপিকাল জঙ্গল থেকে আমরা কিছু নমুনা সংগ্রহ করতে গেলাম। প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির গুল্ম পাহাড়ি ফুলের গাছ দেখা যায় এই অঞ্চলে। তার মধ্যে অর্কিড, প্রিমুলা, রডোডেনড্রন, বাঁশ, ওক, কনিফার, ফার্ন আর বহু করমের ঔষধি গাছ, সবই আছে। বড় গাছেদের মধ্যে আছে পাইন, ওক, শাল, সেগুন, চেস্টনাট, ম্যাপল প্রভৃতি। নমুনা সংগ্রহের পাশাপাশি আমার ক্যামেরা দিয়ে যথারীতি দরকার মত ছবি তুলে যাচ্ছি। জানিনা আদৌ ছবি গুলি কতটা ভালো উঠছে!
একটা ম্যাকাও প্রজাতির রংবাহারি পাখি চোখে পড়ল। তার ঘন নীল, রক্তিম লাল, গাড় হলুদ রঙে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। যত বার তাকে জুম করে ফোকাস করার চেষ্টা করছি, ততবার সে উড়ে এক গাছের ডাল থেকে অন্য গাছে চলে যাচ্ছে। আমরাও নাছোড়বান্দা হয়ে তার পিছু ধাওয়া করলাম। জঙ্গলের ঢালে এগোতে এগোতে বেশ গভীরে চলে গেলাম। প্রফেসার আর বাকি সবাই পিছনে পড়ে রইল।
এদিকের জঙ্গলটা আরও ঘন। নিস্তব্ধ বনে মাঝে মাঝে কাঠঠোকরার ঠকঠক ...ঠকঠক আওয়াজ, কিম্বা “চিহু.. চিহু.. চিহু..” করে অচেনা কোনও পাখীর ডাক। পায়ের নীচে বড় বড় ফার্ন আর ঝরা পাতাদের উপর জমা হওয়া শেওলার একটা বিশুদ্ধ বুনো গন্ধ। লম্বা লম্বা গাছেদের মাথা গুলি কুয়াশায় ঢাকা। হাঁটতে হাঁটতে অরণ্যের মুগ্ধতা অদ্ভুত নেশার মত গ্রাস করছে আমাদের। পাখীটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ নামল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। বড় বড় ফোঁটা বাড়তে লাগল ক্রমশ। এই কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে বৃষ্টির ফোঁটা গুলি হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে একেবারে। আমাদের কাছে না আছে রেনকোট আর না কোনও ছাতা। দিশেহারা অবস্থায় চোখে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে একটা কাঠের বাড়ি। সবাই মিলে দৌড়লাম সেই দিকে। মাথাটা তো আগে বাঁচাতে হবে।
ভাঙাচোরা সিঁড়ি দিয়ে দুড়দাড় করে উঠে বারান্দায় দাঁড়ালাম। সবুজ শ্যাওলায় মোড়া কাঠের বাড়িটা বহু আগাছা শিকড় চালিয়ে আরও জরাজীর্ণ করে ফেলেছে। অরিজিৎ ভালো করে নিরীক্ষণ করে বলল, “এটা মনে হয় কোনও ইংরেজ আমলের তৈরি পরিত্যক্ত বাড়ি।” মৃণাল আরও উৎসাহ দেখিয়ে কাঠের শ্যাওলা ধরা দরজায় জোরসে একটা ধাক্কাদিয়ে গটগট করে ভেতরে ঢুকে গেল। বলল, “দেখি কোনও সাহেব ভূতকে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা!” শব্দ শুনে দুটো বড় বুনো বাদামী রঙের বেড়াল পালালো জানালা দিয়ে লাফ মেরে। “আমি তো এখানে, আমাকে আবার কোথায় খুঁজতে যাচ্ছিস?” সাহেব চেঁচিয়ে জানান দিল। “আরে তোর মত সাহেব নয়, আমি খুঁজছি ইংরেজ সাহেবের ভূত। এই সব পড়ে থাকা পুরানো বাড়িতে মাঝে মধ্যে তাঁদের দেখা পাওয়া যায়।”
ওদের পিছন পিছন ভেতরে ঢুকলাম। ছাদ থেকে ঝুলছে বেশ কটা বাদুড়। স্যাঁতস্যাঁতে কাঠ পচা গন্ধ। মাকড়শার জাল দেয়ালের কোণ গুলি ছেয়ে ফেলেছে।
তন্ময় বলল, “এটা নিশ্চয়ই শিকারের জন্য কেউ তৈরি করেছিল।”
“হ্যাঁ, হতে পারে। এই অঞ্চলে হিমালয়ান লেপার্ড আগে অনেক ছিল।” সাহেব বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বলল।
“আরে, তুই তো আগের জন্মে শিকারে আসতিস। মনে নেই?” মৃণাল টিটকিরি মারল তাকে।
“বাজে কথা বলবি না।”
অরিজিৎ বলল, “সেই টিকটিকি লামাকে দেখে ওরকম হাসছিলি কেন? টেনে না নিয়ে আসলে সে তোকে ভস্মই করে দিত।”
“অতোই সোজা? আমাকে কি ও পাহাড়ি বোকা হাঁদা ছেলে মনে করেছে, যে কটকট করে তাকালেই ভয় পেয়ে যাব? এই সব ভন্ড সাধুদের আমি খুব চিনি। আমার তো মনে হয় ঐ টিকটিকিটা নকল।”
মৃণাল সাহেবকে সমর্থন করে বলল, “হ্যাঁ হতেই পারে। অসম্ভব কিছু নয়। এই সব অশিক্ষিত লোকেদের বোকা বানানোর কত রকম উপায় যে এরা বার করে।”
আমি বললাম, “ভূতের দেখা পাওয়া যাবে কিনা জানি না। তবে সাপের দেখা পাওয়া যেতে পারে।”
“পাহাড়ি সাপ প্রচণ্ড ক্ষিপ্র আর বিষাক্ত হয় শুনেছি।” তন্ময় বলল। “এ জায়গা থেকে যত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়া যায় তত ভালো।”
অরি বলল, “কিন্তু বাইরে তো ঝমঝমে বৃষ্টি। এখুনি তো থামবে না।”
“সাপ শীতল রক্তের প্রাণী। এত ঠাণ্ডার জায়গায় থাকবে বলে মনে হয় না। তবে পাইথন জাতীয় সাপ থাকলেও থাকতে পারে।” সাহেব জানাল।
মৃণাল বলল, “সাপেরা পায়ের আওয়াজ বুঝতে পারে। আমরা যদি লাফালাফি করি তাহলে তার ভাইব্রেশানে যদি কাছাকাছি কোনও সাপ থাকে তাহলে সরে যাবে।” বলেই সে লাফাতে শুরু করল। আর তার দেখাদেখি বাকি তিনজনও লাফাতে লাগল।
কিন্তু ঘটনাটা ঘটল সাংঘাতিক। মেঝেটা পুরো কাঠের পাটা জুড়ে জুড়ে তৈরি। আর পুরানো কাঠে ঘুণ ধরেছিল নিশ্চয়ই। মচাৎ করে একটা পাটা মাঝখান থেকে ভেঙে চোখের পলকে একটা আর্ত চিৎকার করে সাহেব ঢুকে গেল ভেতরে। আমরাও পরিত্রাহি স্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম। নীচেটা অন্ধকার। এমনিতেই মেঘলা দিনে আলো কম। আমাদের কাছে টর্চও নেই।
“আ.. আ..” করে ভয়ার্ত চিৎকার আসছে সাহেবর গলা থেকে।
কাঠের ভাঙা পাটাটা সরিয়ে মৃণাল গলা ফাটিয়ে বলল, “সাহেব, ঠিক আছিস তুই? আমি নীচে নামছি।”
সে যেন কিছুই শুনতে পেল না। চিৎকার করেই যাচ্ছে। মনে হয় ভয় পেয়েছে খুব। আওয়াজটা আসছে অনেক নীচে থেকে। কাউকে যে ফোন করে সাহায্য চাইব তারও উপায় নেই। দেখলাম আমাদের কারোর ফোনেই কোনও টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রথমে মৃণাল নামল। তারপর আমি। বাকিদের উপরেই থাকতে বললাম। কাঠের পাটার মধ্যে দিয়ে শরীরটা কোনও রকমে গলিয়ে সাবধানে নেমে দেখলাম, বাড়িটার ঠিক নীচে পাহাড়ের গায়ে একটা গুহার মুখ। শ্যাওলায় এতোই পিচ্ছিল যে মৃণাল পা রাখার সাথে সাথেই শরীরের ব্যালেন্স হারিয়ে সড়াৎ করে ঢুকে গেল ভেতরে। আর আমার জ্যাকেট আঁকড়ে ধরার জন্য আমিও টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলাম গর্তের মধ্যে। উপর থেকে পড়ার সময়ে মাথাটা গিয়ে লাগল একটা পাথরে। ঝিমঝিম করে উঠল। তারপর ব্ল্যাক আউট।
..... যখন জ্ঞান ফিরল দেখি জল কাদার মধ্যে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। চারিদিকে অন্ধকার। মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। হাত দিয়ে দেখলাম কানের পাশে রক্ত চিটচিট করছে। সামান্য আলো আসছে উপর থেকে। গুহার মুখটা আনুমানিক তিরিশ ফুটের মত উপরে। নীচে থেকে ওঠার কোনও উপায় নেই। গা জলকাদা আর শ্যাওলায় মোড়া। অন্ধকারে চোখটা সয়ে যেতে দেখলাম ভেতরের দিকে গুহার একটা পথ ঢুকে গেছে। বাকি দুজন গেল কোথায়? “সাহেব.... মৃণাল...।” চিৎকার করে ডাকলাম। কোনও প্রত্যুত্তর নেই। আবার গুহার উপরের দিকে মুখ করে চেঁচালাম, “অরি.... তন্ময়...।” উপর থেকেও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। ভয় পেয়ে গেলাম খুব।
ভাবলাম সাহেব আর মৃণালও তো নীচে পড়ে গিয়েছিল। ভেতর দিয়ে কি তাহলে কোনও রাস্তা আছে? কিন্তু ওদিকটা খুবই অন্ধকার। পকেট হাতড়ে এ্যনড্রয়েড ফোনটা বের করলাম। দেখলাম এটা কাজ করছে। টর্চ মোডে দিতেই অনেকটা আলো ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। ক্যামেরার ব্যাগটা আমার কাঁধেই ঝোলানো ছিল। সেটা নিশ্চয়ই পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে ভেঙে চুরে গেছে।
ধীরে ধীরে ভেতর দিকে এগোলাম। গুহার হাইটটা কম। মাথা নীচু করে হাঁটতে হচ্ছে। নরম মাটিতে দু জোড়া জুতোর ছাপ স্পষ্ট। তার মানে ওরা এদিকেই গেছে। এ পাহাড় পাললিক শিলায় তৈরি। কাদা মাটি বেশি। কত লক্ষ বছর আগে এই হিমালয় পর্বতমালার জায়গায় টেথিস সাগর ছিল। ইউরেশিয়ান প্লেট আর ভারতীয় প্লেটের সংঘর্ষের ফলে এই চেহারা নিয়েছে। জল পড়ে এই পাললিক শিলাগুলি নরম হয়ে আছে। গুহার ভেতরের দিকে যত ঢুকছি, মনে হচ্ছে যেন এটা প্রকৃাতিক গুহা নয়। এই রাস্তা কেউ বানিয়েছে। গুহার উপর নীচে, চারিদিকে মাটি আঁচড়ানোর দাগ। ভালো করে দেখলাম চারটে নখের আঁচড়। এবং সে গুলি বেশ মোটা আর তীক্ষ্ণ। সাম্প্রতিক তৈরি হয়েছে এই রাস্তা। যে বা যারা এটা খুঁড়েছে তারা মানুষ বলে মনে হয় না। নীচে লক্ষ করলাম চার আঙুল ওলা বড় বড় পায়ের ছাপ। ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। একি কোনও প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর আস্তানা? হিংস্র বা মাংসাশী প্রাণী হলে মৃত্যু অনিবার্য। বেরুনোর পথ তো একটাই, পিছনে ফেলে এসেছি। সেখান থেকে বাইরের সাহায্য ছাড়া উপরে ওঠা আমার সাধ্য নয়। অতএব এদিকেই এগোতে হবে। যদি অন্য কোনও রাস্তা পাওয়া যায়। ভয়ে ভয়ে এগোলাম।
বেশ কিছুদূর গিয়ে রাস্তাটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। চিন্তায় পড়ে গেলাম। কোন রাস্তা ধরব? ডানদিকেরটা দেখলাম সামান্য উপর দিকে উঠেছে। হয়ত এটাই পাহাড়ের গা দিয়ে বের হবার রাস্তা। সবে ভাবছি সেদিকেই যাব এমন সময়ে একটা চিৎকার! মৃণাল আর সাহেবের গলা। আওয়াজটা ডানদিকের গুহা থেকেই আসছে। পরিত্রাহি স্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে হুড়মুড় করে এসে পড়ল ওরা। আমাকে দেখে বলল, “পালা.. পালা..এই দিকে।” দৌড়াতে শুরু করলাম তাদের সাথে। দ্বিতীয় গুহায় ঢুকে প্রাণ ভয়ে দৌড়চ্ছি। কী তাড়া করছে পিছনে? সেটা আর জিজ্ঞাসা করা হল না। পিছন দিক থেকে একটা বিদঘুটে কান ফাটানো শব্দে সারা শরীর শিরশির করে উঠল। এরকম ডাক কোনও পার্থিব জন্তুর হতে পারে বলে আমার ধারণা নেই। একটা গরম হাওয়া পিছন থেকে এসে ধাক্কা মারছে। অন্ধকারের মধ্যে মাঝে মাঝে মুখ ঘুরিয়ে দেখছি এক জোড়া জ্বলজ্বলে ভয়ঙ্কর লাল চোখ। হঠাৎ কী মাথায় এলো, হাতের কাছে অন্য কিছু না পেয়ে কাঁধ থেকে ঐ ভারি ক্যামেরাটা খুলে ছুড়ে মারলাম ঐ জ্বলন্ত চোখ লক্ষ করে।
তারপর অনেকক্ষন ধরে হ্যাঁচোর পাঁচর করে জল কাদা মেখে এঁকেবেঁকে সেই গুহা পথটা ধরে দৌড়ানোর পর সামনে একটা ক্ষীণ আলো চোখে পড়ল। পিছনের আওয়াজটা তখন কমে এসেছে। শেষে একটা ঝোপের মধ্যে দিয়ে বাইরে বের হলাম আমরা। দেখলাম দিনের আলো কমে গেছে আর বৃষ্টিও বন্ধ হয়েছে। কিন্তু এ কোন জায়গা? জঙ্গল এখানে অনেকটা ফাঁকা ফাঁকা। পাহাড়ের একদম নীচে। কিছুটা দূরে ছোট বড় পাথরের পাশ দিয়ে কলকল করে বয়ে চলেছে একটা জলস্রোত। চোখে মুখে জল দিয়ে আর অনেকটা জল খেয়ে পাশেই নুড়ি বিছানো তীরে হাঁপিয়ে শুয়ে পড়েছি আমরা। আশা করি এখানে খোলা জায়গায় আর সেই জন্তুটা তাড়া করবে না। আর যদি তাড়া করেও তাহলে আমাদের পালাবার ক্ষমতা আর নেই।
আমি উৎকণ্ঠার সাথে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী জিনিস ছিল ওটা?”
সাহেব ঢোক গিলে বলল, “জানিনা... আমরাও দেখিনি। শুধু ভয়ঙ্কর আওয়াজে আমাদের পিলে চমকে গেছে।”
মোবাইলে দেখলাম সাড়ে ছটা বাজে। এবং ভাগ্য ভালো এখানে টাওয়ার আছে। ফোন করলাম প্রফেসারকে।
“কোথায় তোমরা?” তিনি উৎকণ্ঠার সাথে জানতে চাইলেন।
বললাম, “পাহাড়ের নীচে নদীর ধারে শুয়ে আছি। অন্ধকার হয়ে আসছে। রাস্তা চিনে ফিরতে পারব না।”
তিনি বললেন, “ওখানেই থাকো। আমি গ্রামের লোকেদের নিয়ে নামছি।”
আস্তে আস্তে সূর্যের আলো চলে গেল। অদ্ভুত নিস্তব্ধতা চারিদিকে। তখন ঠাণ্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছি আমরা। জানিনা কী আছে কপালে। ভয়ে বার বার ফোন করছি শুধু। শেষে অনেক প্রতীক্ষার পর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চার পাঁচটা টর্চের আলো দেখে ধড়ে প্রাণ এলো। অন্ধকারের মধ্যে স্যারের সাথে এগিয়ে এলো অরি আর তন্ময়। পিছনে বেশ কিছু লোকের সাথে পুলিশও আছে।
হোটেলে পৌঁছাতে রাত দশটা হয়ে গেল। মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে হসপিটাল থেকে। গরম জলে গা হাত ধুয়ে খাওয়া সেরে বিছানায় গিয়ে উঠলাম। বাকি ঘটনা অরি আর তন্ময় ভাগাভাগি করে বলল। যা শুনলাম তাতে চুল আরও খাড়া হয়ে গেল।
আমরা গর্তে পড়ে যাবার পর ওরা বৃষ্টির মধ্যেই প্রাণপণে দৌড়েছে উপরে খবর দিতে। আবার জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা হারিয়ে অনেক দেরিও হয়েছে পৌঁছাতে। গ্রামের লোকেদের ডেকে নিয়ে এসে যখন আবার সেই কাঠের বাড়িটায় পৌঁছেছিল ওরা, তখন অবাক হয়ে দেখে মেঝেতে কোনও কাঠও ভাঙেনি। আর বাড়িটার নীচেও কোনও গুহা বা গর্ত নেই। হাজার বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। সবাই ভেবেছে কোনও কারণে এরাই মিথ্যা কথা বলছে। শেষে খোঁজার জন্য পুলিশেও খবর দেওয়া হল। কিন্তু গোটা জঙ্গলে সারাদিন চিরুণী তল্লাশি করেও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ ওদেরকে জেরা করার জন্য থানায় নিয়ে যাচ্ছিল তখনই ফোন আসে আমাদের। শুনে আমরা গুম খেয়ে গেলাম। এটা কি কোনও অলৌকিক ফাঁদ? না স্বপ্ন? তাই বা হয় কী করে? আমার মাথা তো সত্যি সত্যি ফেটেছে। তবে কি সেই লামার প্রতিশোধ? মায়াজাল?
“আমার ক্যামেরাটা গেল!” আমি অনেকক্ষন চুপ করে থাকার পর আক্ষেপের সুরে বললাম।
অরি জিজ্ঞাসা করল, “সেটা কখন হারালি?”
“হারায়নি। আমরা যখন প্রাণ ভয়ে দৌড়চ্ছি, আর ঐ জন্তুটা ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে, তখন ক্যামেরাটা ছুঁড়ে মেরেছিলাম।”
“তার মানে ক্যামেরাটার জন্যই তোরা বেঁচে গেছিস।” তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল।
ঘুমের মধ্যে আবার সেই গুহার ছবি দেখলাম। লামা আমাদের দিকে তাকিয়ে শরীর দুলিয়ে হাসছে। সেকি অট্টহাসি! আর তার পিছনে বিশালকায় পোষা টিকটিকি। তার লাল জবা ফুলের মত চোখ, থেকে থেকে শুধু ল্যাজ নাড়ছে। শীতের রাতে আমরা সবাই ঘেমে অস্থির। কিন্তু সবাই একই স্বপ্ন কী করে দেখলাম?
পরের দিন সকালেই ফেরা। হোটেলের নীচে বাস দাঁড়িয়ে হর্ন দিচ্ছে। লাগেজ গুছিয়ে চেক আউট করার সময়ে ম্যানেজার ডেকে বলল, “একটা ক্যামেরা কেউ ফেলে যাচ্ছে। রুমের মধ্যেই পড়েছিল।”
আমি দেখে অবাক। এটা তো আমার ক্যামেরা। রুমে এলো কখন? বাসে বসে লক্ষ করলাম, সবই ঠিক আছে শুধু চামড়ার কভারে চার আঙুলের তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়।
মাথাটা ভোম হয়ে কলকাতায় ফিরলাম। সেই ঘোর কাটতে আরও মাসখানেক সময় লাগল। এর মধ্যে কবে না জানি বাবা ক্যামেরা থেকে রিলটা বের করে ওয়াশ করতে দিয়ে এসেছিলেন। কদিন পরে ছবি গুলি যখন নিয়ে এলেন অবাক হয়ে দেখলাম, এত সুন্দর ছবি অনেক দামী ডিজিট্যাল ক্যামেরাতেও হয় না। প্রতিটা ছবি যেন বাঁধিয়ে রাখার মত। ভারী জিনিসটা ঘাড়ে করে নিয়ে যাওয়া সার্থক হল।
শুধু একটা ছবিতে চোখটা আটকে গেল। গুম্ফার মধ্যে তোলা ছবিটাতে সোনালী বুদ্ধের নীচে শুধু একটা মোটাসোটা টিকটিকি। লামা কোথায়?
____________
অলঙ্করন – লেখক
darun
ReplyDeleteঅসাধারণ। কিই যে ভালো লাগলো....
ReplyDelete