গোলটেবিল:: ভৌতিক অলৌকিক (রিভিউ):: দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী, তন্ময় বিশ্বাস, সহেলী চট্টোপাধ্যায়, সৌগত সেনগুপ্ত, ঋজু গাঙ্গুলী

গোলটেবিল বিভাগে সবাইকে স্বাগত। বর্তমান কিশোর সাহিত্যের কিছু মণিমানিক্য নিয়ে আমরা হাজির হচ্ছি প্রতিবার।

 আজকের বই

ভৌতিক -অলৌকিক ( অভিজ্ঞান রায় চৌধুরী )
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ --সুদীপ্ত মণ্ডল ।
প্রকাশক- পত্রভারতী
দাম- ২০০ টাকা


ভৌতিক অলৌকিক (রিভিউ)

দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী

অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর লেখায় অভিনবত্ব মানবিক অনুভূতির এক অভূতপূর্ব মিশেল খুঁজে পাওয়া যায় ভূতকল্পবিজ্ঞান, রহস্য বা নির্মল হাসির গল্প সব ক্ষেত্রেই তাঁর কলম অসাধারণ ওনার কল্প বিজ্ঞানবিজ্ঞাননির্ভর গল্পগুলির সাথেও অনিবার্য্ ভাবে মিশে থাকে রসবোধ, পরিমিতিবোধ মানবিকতা "ভৌতিক অলৌকিক" বইটি তারই একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ যদিও নাম "ভৌতিক অলৌকিক" পাঠক এখানে খুঁজে পাবেন সব ধারার গল্পই তাই যদি কেউ ভূতের গল্পের সাথে নির্মল হাসির গল্প বা অদ্ভুত রসের গল্প পড়তে ভালবাসেন, তিনি কিন্তু নিরাশ হবেন না বরং এই বইটি পড়লে লেখকের অন্যান্য বইগুলিও খুঁজে পড়তে শুরু করবেন একথা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি

১৮ টি নানা স্বাদের গল্পে সেজে উঠেছে এই বইটি প্রকাশক পত্র ভারতী প্রত্যেকটি গল্পই শুরু করলে শেষ না করে পারা যায় না

ভয়ের গল্প গুলিতে গা ছমছমে আবহাওয়া এবং নিখুঁত প্লট এর সমাবেশে সত্যজিত, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বা শরদিন্দু কথা মনে করিয়ে দেয় প্রতিশোধ, ভূত মানেই চান্স, ৩৮ বিচউড স্ট্রিট বা নিছক একটু ভয় দেখানোয় প্লট এর অভিনবত্ব, সুচারু বাচনভঙ্গী, এবং শুরু থেকে শেষ অব্দি পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতালেখক যে একজন দারুণ গল্প বলিয়ে, তার পরিচায়ক আবার অন্যদিকে রাজা বাবু  কে "ভালো ভূতের গল্প" ঘরানার গল্প বলা যায় একজন আদ্যন্ত ভালো মানুষের গল্প স্বাদে গন্ধে লীলা মজুমদার বা শীর্ষেন্দুর কথা মনে করিয়ে দেয় এর মানবিক আবেদন পাঠকের মনে দাগ কাটে "প্রতিবেশী" গল্পটিও আলাদা করে উল্লেখ করব যেটি স্থান পেয়েছে পত্র ভারতীর ভয় রহস্য ১০১ সংকলনে অনুপম পরিবেশ রচনা, সূক্ষ্ম রসবোধএই ভৌতিক গল্পটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে

মানবিক গল্প হিসেবে একটি উল্লেখ যোগ্য গল্প হলো "সুবীর কথা রাখবে তো?" আরও একবার মনে করিয়ে দেয় লেখক এর রচনার একটি বিশেষ দিক হলো মানবিকতা

"নিধিরামে অপদস্থ" গল্পটি একটি নির্মল হাসির গল্প পড়ে মনে হয়েছে এখন কেন আর ধরণের নির্মল হাস্যরস এর গল্প দেখি না লেখকের কাছে হাসির গল্পের এই দুর্দিনে প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে

কল্পবিজ্ঞানের গল্প হিসেবে পিছনে হাঁটা”, "প্রফেসর ইয়াকোয়ার মৃত্যু রহস্য", বা "কম্পিউটারের অদ্ভুত তিন ভবিষ্যতবাণী" অসাধারণ আবার মনে করিয়ে দেয় লেখকের নিজস্ব ক্ষেত্র হলো কল্পবিজ্ঞান যেখানে তিনি বিগত ২০ বছর ধরে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চলেছেন

আলাদা ভাবে উল্লেখ এর দাবী রাখে "তাজমহল" গল্পটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় এমন অভিনব গল্প আরেকটি পড়েছি বলে তো মনে হয় না তাজমহল নির্মাণ এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোন রহস্য এবং তা কী করে জড়িয়ে আছে আমাদের অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের কালচক্রের সাথে জানতে হলে অবশ্যই পড়তে হবে এই গল্প

উঁহু, এর বেশী আর বলব না গল্প গুলো সম্পর্কে, এখনকার পাঠকেরা যারা এই ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছেন যে কিশোর সাহিত্যে আর ভালো লেখা হচ্ছে না তারা এই গল্প সংকলনটি অবশ্যই সংগ্রহ করে পড়ে ফেলুন এবং চটপট সংগ্রহ করে  ফেলুন লেখকের অন্যান্য গল্প সংকলন গুলিও আর এই রকম নতুন নতুন বইয়ের খবর বন্ধুদের জানানোর জন্যে তো আছেই "ম্যাজিক ল্যাম্প"



ভৌতিক অলৌকিক রিভিউ 


তন্ময় বিশ্বাস

ভৌতিক অলৌকিক! শব্দ দুটো সমার্থক হয়েও যেন আলাদা। পৃথক। ভূত মানেই অলৌকিক। কিন্তু, অলৌকিক মানেই ভূত নয়। যাক গে দর্শনের কচকচানিতে না গিয়ে আসি বইটার কথায়।


বইএর গল্প গুলো কে কল্পবিজ্ঞান, ভৌতিক, আর সামাজিক এই তিন ভাগে ভাগ করতে গিয়েও পারলাম না। পড়তে গিয়ে সব বিভাগগুলো যেন মিলেমিশে গেলো। হয়ে গেলো একাকার। কল্পবিজ্ঞানের গল্পে আছে তীব্র মানবিক সত্বা। সামাজিক মূল্য বোধ। কখনো বা রোমাঞ্চ। অনিলিখার সাথে সাথে আমরাও পাড়ি দি 'তাজমহল'এর রহস্য উদঘাটনে। জড়িয়ে পড়ি 'প্রফেসার ইয়াকোয়ার মৃত্যু রহস্য'এ। কখনো বা অংশ নি দূর্দান্ত 'আধঘণ্টার অভিনয়'এ। ভবিষ্যৎ হানা দেয় 'শুধু কুড়ি মিনিট'র জন্য! সামাজিক মূল্য বোধ, দায়বদ্ধতা আছে ভৌতিক গল্প গুলোতেও। এক মাস্টার মশাই ফিরে আসে। তার ছাত্রের কাছে। তার একটাই চিন্তা 'সুবীর কথা রাখবে তো'? কখনো বা একজন উপকারি মানুষকে ভূতেরা বানিয়ে ফেলে তাদের 'রাজাবাবু'। আছে অশরীরির 'প্রতিশোধ'। কখনো 'দিনটা খুব ইন্টারেস্টিং' করে তোলে ভিনগ্রহি অশরীরী! '৩৬ বিচিউড স্ট্রিট' থেকে 'পিছনে হাঁটা'। রহস্য আর রোমাঞ্চ। আসলে সবই চান্স অফ ফ্যাক্টার।'ভুত মানেই চান্স'। তাই না? শেষ হয়েও যেন শেষ হয় না। থেকে যায়। মনের কোনও এক গভীরে ছাপ ফেলে যায় টানটান মেদহীন ভাষা আর নিটোল গল্পের প্লট। সুদীপ্ত মণ্ডলের অলংকরণ ভালোই লাগল। তবে সব অলংকরণ রঙিন ছাপা হলে আরো ভালো লাগতো। সব মিলিয়ে অবশ্য সংগ্রহযোগ্য বই। তবে বইটার ট্যাগলাইনে 'ভুত বিশ্বাসী রাতে পড়বেন না' এই ধরণের সতর্কবার্তা সম্পূর্ন নিষ্প্রয়োজন। আমার মনে হয় এতে বইএর ক্ষতি। পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন হরর বই এটি নয়। যে কোনও ভূত বিশ্বাসী বইটা রাতে পড়তে পারেন। নিশ্চিন্তে।

                 

ভৌতিক অলৌকিক রিভিউ

সহেলী চট্টোপাধ্যায় 


ভৌতিক আর অলৌকিক এই দুটো শব্দ এক সাথে শুনলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মোট আঠারোটি গল্পের মধ্যে কল্পবিজ্ঞান ও আছে কয়েকটা। আমি ভূতের গল্প ই বেশি পছন্দ করি। রাতে পড়তে মানা করা হলেও বইটা আমি রাতেই পড়েছি। আসলে রাত্তিরে এই ধরণের বই পড়ার মজাটাই আলাদা।


প্রথম গল্প ‘প্রতিশোধ’। অসাধারণ একটা গা ছমছমে পরিবেশ তৈরি করেছেন লেখক ট্রেনের কামরার মধ্যে। শুধু পরিবেশ নয়, প্লটও যথেষ্ট গা ছমছমে। তবে বেশি ভয় নেই। তার দরকারও নেই।


‘নিছক একটু ভয় দেখানো’ শুরু হয়েছিল নিছক একটু মজা থেকে। সেটা যে শেষ পর্যন্ত এমন সাংঘাতিক রসিকতায় গিয়ে দাঁড়াবে আন্দাজ ও করতে পারিনি।


‘ভূত মানেই চান্স’ এর শুরুটা বেশ আড্ডার ছলে। তারপর পরিস্থিতি ঘুরে যায় সম্পূর্ণ অন্য খাতে।

‘দিনটা খুব ইন্টারেস্টিং’ পড়ে মনে হল আমার ও দিনটা এমন ইন্টারেস্টিং হলে খুব ভালো হত।


‘শুধু কুড়ি মিনিট’ আমি দম বন্ধ করে পড়েছি। শেষ দিকটা পাঠক বারবার পড়বে। বাংলা সাহিত্যে এমন কিছু গল্প আছে যেখানে শেষের দিকটা পাঠক বার বার করে পড়ে।


‘নীলকুঠিতে কিছুক্ষণ’ থাকলে অতীতে পৌঁছে যেতে আপনি বাধ্য।


অতীত , ভবিষ্যৎ আর বর্তমানের অদ্ভূত মিশেল ‘তাজমহল’। এরকম গল্প আগে কখনও পড়েছি বলে ঠিক মনে পড়ছে না।


‘প্রতিবেশী’ মজার গল্প। যদিও এতে বেশ সাসপেন্স আছে। একটা গল্পের মধ্যে এত রকম স্বাদ আনা খুব কঠিন। অভিজ্ঞান রায় চৌধুরীর কাছে অবশ্য খুব সহজ কাজ।


‘চশমা আর অপ্রস্ততবাবু’ একটি ভিন্ন স্বাদের ভূতের গল্প। এমন একটা চশমা যদি আমিও পেতাম!


‘প্রফেসার ইয়াকোয়ার মৃত্যু রহস্য’ ঠিক পরিস্কার হল না আমার কাছে।


‘নিধিরাম অপদস্থ’ বেশ মজার গল্প। তবে এটিও সায়েন্স ফিকশান।


‘আধঘণ্টার অভিনয়’ এবং ‘ঠিক বিচার’ উন্নত মানের দুটি সায়েন্স ফিকশান। শেষ দিকটা মন খারাপ করে দেয়।


আবার ভূতের কথায় ফিরে আসি। ‘সুবীর, কথা রাখবে তো!’ এবং ‘রাজাবাবু’ ভূতের গল্প। ‘রাজাবাবু’ ভীষণ রকম পজিটিভ একটা গল্প। জীবনের ইতিবাচক দিক উঠে এসেছে এখানে আর এই জন্যই গল্পটা আমি এগিয়ে রাখব ।


‘কম্পিউটারের তিন ভবিষ্যদবাণী’ শুনলে আপনারা ঠকবেন না ( অর্থাৎ পড়লে)। বরং লাভবান হবেন।


‘আমার সময় নেই’ কথাটা কারণে অকারণে আমরা অনেক লোককেই বলতে শুনেছি। আমরাও ব্যাবহার করি মাঝে মাঝে অথবা প্রায়ই। যাদের সময় একদমই নেই একটু দম ফেলার বা পরিবারের জন্য তারা দয়া করে একটু সময় বার করে ‘পিছনে হাঁটা’ গল্পটা একবার পড়ে নেবেন। আপনার সময় না বাড়লেও দৃষ্টিভঙ্গি হয়ত বদলে যাবে।


‘৩৮ বিচউড স্ত্রিট’ থেকে ঘুরে আসুন একবার। মন্দ লাগবে না গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি। তবে আমি আর যাচ্ছি না এই রাস্তায়। কী জানি কী ভাবে আবার ওদের সাথে দেখা হয়ে যায়!


শেষে একটা কথা বলার আছে যারা ভূত – প্রেত ভালোবাসেন অথবা সায়েন্স ফিকশান তারা অবশ্যই বইটি একবার পড়ে দেখবেন। লেখকের কাছ থেকে আর ও এরকম কিছু বা এর চেয়েও ভালো কিছু পাবো সবাই আশা রাখছি।



ভৌতিক অলৌকিক - অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

সৌগত সেনগুপ্ত 


সমসাময়িক বাংলা কিশোর সাহিত্যে অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী এক পরিচিত নাম। শ্রী রায়চৌধুরী গত কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে শুধুমাত্র ছোটদের জন্য লিখে চলেছেন। যদিও ওনার লেখার বিষয় প্রধানত কল্পবিজ্ঞান, উনি ভৌতিক এবং অলৌকিক কাহিনি লিখতেও একই রকম পারদর্শী। সেটা কেমন? জানতে হলে পড়তেই হবে ভৌতিক অলৌকিক নামের এই বইটি।

ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং অনীশ দেব-এর পর ভৌতিক অলৌকিক নামে এবারে অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর সংকলন প্রকাশ করেছে পত্র ভারতী। ১৮টি গল্পের এই সংকলনের দাম মাত্র ২০০ টাকা। প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেছেন সুদীপ্ত মন্ডল।

এই বই এর প্রতিটি কাহিনি হয় কোনও ভৌতিক ঘটনা নিয়ে, না হয় কোনও অলৌকিক ঘটনা নিয়ে, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলে না। কিছু কাহিনির পটভূমি ইংল্যান্ড বা আমেরিকা, কিছু আমাদের দেশের, এমন কি আমাদের রাজ্যের পটভূমিতে লেখা। ভালো ভূত খারাপ ভূত উপকারী কিংবা অপকারী সব রকমের ভূতের সঙ্গে মোলাকাত হবেই আপনার।

এছাড়াও কিছু বিজ্ঞান নির্ভর কাহিনি আছে যা আপাত দৃষ্টিতে অলৌকিক মনে হলেও আজ তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখা সম্ভব। মূলত এই ধরনের কাহিনিতে আমরা অনিলিখাকে পেয়ে থাকি। আধঘন্টার অভিনয়, প্রফেসার ইয়াকোয়ার মৃত্যুরহস্য, কম্পিউটারের অদ্ভুত তিন ভবিষ্যদবাণী এই রকম কাহিনির উদাহরন।

কাজেই ভৌতিক পরিবেশ বজায় রাখতে হলে, চটপট কিনে ফেলুন বইটা আর ডুবে যান ভৌতিক আবহে। শেষে প্রকাশকের মত আমিও বলব, যথেষ্ট সাহস না থাকলে বইটি রাতে পড়বেন না।


ভৌতিক অলৌকিক রিভিউ 

ঋজু গাঙ্গুলী


ছোটোদের জন্যে লেখা যে কত বড় আর কঠিন কাজ, সেকথা শিশু-কিশোর সাহিত্যের জগতে নবাগত এবং প্রতিষ্ঠিত সব লেখকই জানেন| অথচ অনেকের কাছেই শুনেছি যে গোয়েন্দা, হাসি বা ভূত: এই তিনের যে কোন একটি উপাদান নিয়ে কিছু একটা লিখে ফেললেই সে লেখা নাকি ছোটদের পছন্দ হতে বাধ্য| আলোচ্য বইটির রিভিউ করতে গিয়ে তাই প্রথমেই যে কথাটা মনে হয় তা হল: বইটির প্রকাশক “পত্র ভারতী” নির্ঘাৎ উপরোক্ত সরলীকৃত ফান্ডাটা কিছুটা হলেও বিশ্বাস করেন, নইলে শিশু-কিশোর সাহিত্যে এই সময়ের অন্যতম সেরা গল্পকারের এমন চমৎকার একঝাঁক ছোটগল্পের বিপণন করতে গিয়ে “ভূত-বিশ্বাসীরা খবর্দার (বানান ফ্ল্যাপ থেকে) রাতে এই বই কখনই পড়বেন না|” লিখে বাজার গরম করার চেষ্টা করতেন না|


এবার আসা যাক গল্পের কথায়| শিরোণাম-হীন একটি অন্তরঙ্গ প্রাককথনের পর এই বইতে যে গল্পগুলো এসেছে তারা হল:


1. প্রতিশোধ: এই বইয়ের দুর্বলতম এবং নানাবিধ অসংগতিতে ভরা গল্পটি দিয়ে বইটা শুরু বলে প্রথমেই হোঁচট খেতে হয়| এই ধরণের গল্প বছর পঁচিশেক আগে রেডিওতে শুনে ভালো লাগত, কিন্তু আজকের যুগে গল্পের ত্রূটিগুলো বড্ড বেশি করে ধাক্কা দেয়|

2. নিছক একটু ভয় দেখানো: এই নিটোল ছোটগল্পটি দিয়েই বইটা শুরু হওয়া উচিত ছিল, যাতে লেখকের মাপা হাতের ছোঁয়ায় ‘কহানি মে ট্যুইস্ট’-টা দারুণ উপভোগ্য হয়েছে|

3. ভূত মানেই চান্স: প্রথম গল্পটার তুলনায় ভালো, কিন্তু শেষের চমক (যেটা একটু আলাদা রকমেরই ছিল)-সত্বেও গল্পটা আমার খুব ভালো লাগেনি|

4. দিনটা খুব ইন্টারেস্টিং: এটা ভূতের গল্প নয়, কল্পবিজ্ঞানের গল্পও নয়| তবে উদ্ভট রসের গল্পটা ছোটদের মুখে হয়তো এক ঝলক মুচকি হাসি ফোটালেও ফোটাতে পারে|

5. শুধু কুড়ি মিনিট: এ কি লেখকের কমফোর্ট জোনে ফিরে আসার ফল, নাকি সম্পাদকীয় ঘ্যানঘ্যানানি বা ফরমায়েশ না থাকায় মুক্তির প্রকাশ? কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক এই গল্পটি পড়ে এক ঝটকায় খুঁজে পাওয়া যায় সেই লেখককে, যাঁর কলম বিজ্ঞান-সুবাসিত অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি পড়ার ক্ষেত্রে আজকের প্রজন্মকে সব থেকে বেশি করে উত্সাহিত করেছে| দুর্দান্ত গল্প!

6. নীলকুঠিতে কিছুক্ষণ: বেশ ভালো ভাবে শুরু করেও গল্পটা বড্ড তাড়াতাড়ি প্রেডিক্টেবল হয়ে পড়ল, আর তার ফলে একটা গা-ছমছমে সেটিং নিয়েও লেখকের চেষ্টাটা মাঠে, বা নীলকুঠিতে মারা গেল|

7. তাজমহল: এই বইয়ের সেরা লেখা এই গল্পটি, যা ভৌতিক নয়, অলৌকিক তো নয়ই| ইতিহাস, কল্পবিজ্ঞান, আর বিশুদ্ধ ফ্যান্টাসি দিয়ে গড়া, এবং বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কিছু কল্পবিজ্ঞান কাহিনিকে মনে করিয়ে দেওয়া এই গল্পটি (নাকি ঘনাদার উদ্দেশ্যে অনিলিখার শ্রদ্ধাঞ্জলি?) সত্যিই ফ্যান্টাস্টিক!

8. প্রতিবেশী: অ..সা..ধা..র..ণ বললেও কম বলা হবে এই গল্পটিকে| কৌতুক, ভয়, রোমাঞ্চ, এবং শেষের “হঠাৎ আলোর ঝলকানি” হয়ে আসা সত্যিটা, এই সব মিলিয়ে গল্পটাকে যেখানে নিয়ে গেছে তা অভাবনীয়| যেসব পাঠক এই গল্পটা প্রথমবার পড়বেন, এখন থেকেই তাঁদের ব্যাপকভাবে হিংসে করতে শুরু করেছি|

9. চশমা এবং অপ্রস্তুতবাবু: একটি ফিল-গুড ফ্যান্টাসি, যা আদ্যন্ত প্রেডিক্টেবল হলেও সুপাঠ্য বলে পড়তে ভালোই লাগে|

10. প্রফেসর ইয়াকোয়ার মৃত্যুরহস্য: এই গল্পটি ইতিমধ্যেই লেখকের অন্য একটি সংকলনে স্থান পেয়েছে, তাই এর বদলে অন্য গল্প দিলে ভালো হত| তবে কল্পবিজ্ঞান আর মূল্যবোধ মিশিয়ে লেখা এই গল্পটা আবারও পড়তে ভালোই লাগে|

11. নিধিরামে অপদস্থ: শীর্ষেন্দুর টপ ফর্মে লেখা গল্পগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এই নির্মল হাসির গল্পটি| ছোট হোক, বা বড়, পাঠক মাত্রেই এই গল্পটি মুচকি-মুচকি হেসে উপভোগ করবেন: এমনটা আশা করাই যায়|

12. আধঘন্টার অভিনয়: অলৌকিক মানে আসলে আলো-আঁধারির জগৎ, যেখানে সত্যের জোরালো আলো পড়লে বোঝা যায়: সবটাই ফাঁকি| কিন্তু সত্যিই কি তাই হয়? অনিলিখাকে কেন্দ্রে রেখে লেখা এই অসাধারণ গল্পটি প্রথমে ভয়, পরে অলৌকিক রস, আর শেষে তার মানবিকতায় পাঠককে এমনভাবে স্পর্শ করে, যে গল্পটার রেশ তা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও থেকে যায় অনেক-অনেক সময় ধরে|

13. ঠিক বিচার: ভূত আর কল্পবিজ্ঞান, দুয়ের উপস্থিতি সত্বেও ঠিক কোনও গোত্রেই ফেলা যাবেনা এই গল্পটিকে| কিন্তু তবুও, গল্পটাকে আপনি চট করে খরচের খাতায় ফেলেও দিতে পারবেন না| কেন? সেটা আপনাকে পড়ে দেখতে হবে|

14. সুবীর, কথা রাখবে তো!: ছকে বাঁধা শুরু, আদ্যন্ত চেনাজানা সেটিং, কিন্তু তবু গল্পটাকে ভোলা অসম্ভব তার মানবিকতার জন্যে, তার ছত্রে-ছত্রে ভেসে আসা সেই আকুতির জন্যে, যা হয়তো আমাদের সবার মনে প্রতিধ্বনিত হয় নিজের দেশের কথা ভাবলেই| এ গল্প নিছক ভূতের নয়, তার চেয়ে অনেক ওপরে এর স্থান|

15. রাজাবাবু: আর একটি ফিল-গুড ফ্যান্টাসি, যেমনটি আমরা এক সময় পেতাম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কলমে| লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানতেই হচ্ছে এমন সহজ আর মন-ভালো-করা গল্পটি উপহার দেওয়ার জন্যে|

16. কম্পিউটারের অদ্ভূত তিন ভবিষ্যদ্বাণী: অনিলিখার আরেকটি টানটান কাহিনি, যা বিজ্ঞান, অপবিজ্ঞান, “ক্রাইম ডাজ নট পে”, “তাহলে কি...?” এইসব মিলিয়ে শেষ হয়েও শেষ হয়না, বরং একগাদা প্রশ্নের জন্ম দেয়| কিন্তু লেখক কি গল্পের শিরোণাম হিসেবে একটা গোটা বাক্য ছাড়া কিছু পাননি?

17. পিছনে হাঁটা: ভূত আছে, কল্পবিজ্ঞানও আছে, কিন্তু এই গল্পের কেন্দ্রে আছে একটাই সত্যি, যা লালনের গানে আমরা শুনেছি, অথচ বুঝিনি: “এমন মানব জনম আর কি হবে, মন যা কর ত্বরাই কর এই ভবে”|

18. ৩৮ বিচউড স্ট্রিট: গা-ছমছমে এই গল্পটা পড়তে বেশ লাগে, যদিও সত্যজিৎ আর শরদিন্দু-র গল্পের যে কোন পাঠকই বুঝে যাবেন যে গল্পে কী ঘটতে চলেছে|

বইটি সুমুদ্রিত| সুদীপ্ত মণ্ডলের আঁকা প্রচ্ছদ আর অলংকরণ কোথাও কোথাও ফ্ল্যাট হলেও মিনিমালিস্ট সাদা-কালো আঁকায় দারুণ (যেমনটা আছে “আধঘন্টার অভিনয়”-তে)| তবে বইটার সবথেকে বড় খুঁত দুটো:

(১) গল্পগুলোর প্রথম প্রকাশ সংক্রান্ত কোন তথ্যই এতে নেই| ফলে সময়ের সাথে লেখকের কলমের বিবর্তন বোঝার কোন উপায় পাঠকের কাছে নেই|

(২) গল্পগুলোর বেশির ভাগই নির্ভেজাল ছোটগল্প হিসেবেও রসোত্তীর্ণ| তা সত্বেও ‘ডরনা জরুরি হ্যায়’ স্টাইলে বইয়ের ফ্ল্যাপ, ব্যাক-কভার, প্রাককথন: সর্বত্র কেন যে গা-জোয়ারি করে “ভয় পাও, ভয় পাও” মন্ত্র জপা হয়েছে, সেটাই বুঝলাম না|

অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ গল্পের সংকলন এটি নয়, কিন্তু ভূত না খুঁজে নিটোল গল্পের সন্ধানে যদি বেরিয়ে থাকেন, তবে এই বইয়ের স্টপেজে দু দণ্ড জিরিয়ে নিন| বলা তো যায়না, হয়তো এই জায়গাটা আপনার সত্যিই ভালো লেগে গেল| আর আপনার মত একজন পাঠককে পেয়ে লেখক আমাদের উপহার দিয়ে চললেন আরও ভালো লেখা| অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী-র গল্প জগতে আপনাকে স্বাগতম|


অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
_________
(লেখকদের মতামত সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত)

No comments:

Post a Comment