“টাকা জিনিসটা আমার কাছে খুবই মূল্যবান মিস্টার বাগচী। তবে একটা জটিল রহস্যভেদ করার আনন্দ তার চেয়েও দামি”। (গুপ্তধনের গুজব) “ঠিকঠাক কেস হলে এই প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি কখনই টাকার হিসেব করে না” (আরাকিয়েলের হীরে)।
মিতিন, নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শাণিত চেহারার বুদ্ধিদীপ্ত এক তরুণীর মুখ। থার্ড আই এর প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জি। প্রজ্ঞাপারমিতা হলেন বৌদ্ধদের দেবী যিনি জ্ঞান দান করেন, অনেকটা আমাদের সরস্বতীর মতো। মিতিনের তাই প্রজ্ঞাপারমিতা নাম সার্থক। বোনঝি টুপুর মিতিনের সহকারী। আবার স্বামী পার্থও তাকে কম সাহায্য করে না রহস্য উন্মোচনের ব্যাপারে। আবার অনেক টিটকিরিও মারে মাসি বোনঝি কে। পার্থ আর মিতিন সমবয়সী। পার্থ প্রেসে কাজ করে। রবিবার ছুটির দিনটুকু একটু আয়েস করে কাটাতে ভালোবাসে। আর ভালোবাসে খেতে, প্রকৃত অর্থেই সে খাদ্য রসিক। এমন কী ভালো রান্নাও পারে। গুপ্তধনের গুজব উপন্যাসে আমরা দেখেছি ক্লান্ত মিতিন আর টুপুরের জন্য রান্না করে থালা সাজিয়ে দিচ্ছে পার্থ। সেদিন মিতিন আর টুপুরের ওপর দিয়ে অনেক ধকল গেছিল। পার্থর কল্পনাশক্তি প্রখর, মাঝে মধ্যে নিজের সম্পর্কে একটু বাড়িয়ে বলে ফেলে। জাস্ট মজা করার জন্য, তবে সন্তুর বন্ধু জোজোর মতো অতোটাও নয় (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ায়ের কাকাবাবু আর সন্তু সিরিজ)। পুরানো কোলকাতার বিষয়ে অনেক খবর রাখে। মাঝে মাঝে টুপুর কে জ্ঞান বিতরণ করে। শব্দ-জব্দ, সুদোকুর সমাধান করতে ভালোবাসে।
মিতিন নিজে অনেক বড় মাপের ডিটেকটিভ, পুলিশের উপর মহলের লোকেরাও মাঝে মাঝে মিতিনের পরামর্শ নিতে আসে। অপরাধতত্ত্বের সমস্ত বিভাগ নিয়ে দিনরাত চর্চা করে। ফরেন্সিক সায়েন্স, অপরাধীদের মনঃস্তত্ত্ব, নানা রকমের অস্ত্রশস্ত্রের খুঁটিনাটি, অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, নানা রকম আইন সব কিছু নিয়েই চর্চা করে মিতিন। পুরানো জটিল কেস গুলো নিয়েও চিন্তা করে। কিন্তু কেউ প্রশংসা করলেই উড়িয়ে দিয়ে বলে, “গ্রেট-ফেট কিছুই নই। শুধু চোখ-কানটা খোলা রাখি। মনের দরজাটাও। ভাবনা চিন্তা তৈরি হওয়াটাও একটা প্রসেস। এর জন্য প্রয়োজন চর্চা, অধ্যাবসায়, আর নিষ্ঠা। আর একটু কমনসেন্স”। (কেরালায় কিস্তিমাত)। এই গুণগুলো তার মধ্যে পুরো মাত্রায় আছে।
দিনরাত অপরাধতত্ত্ব নিয়ে পড়ে থাকলে কী হবে? সে নিজেও পাকা রাঁধুনি। মাঝে মাঝেই আরতিকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই রান্না করতে শুরু করে দেয়। ‘টিকরপাড়ার ঘরিয়ালে’ও মিতিন কে রান্না করতে দেখা গেছে। যখন যেটা করে মিতিন সমান মনোযোগ দিয়েই করে, তা সে ডিমের কালিয়াই হোক বা গোয়েন্দাগিরিই হোক। “ঝটাঝট বেগুন কাটছে, কচাকচ লঙ্কা কুচোচ্ছে, টুপুর চার খানা ডিম ছাড়ানোর আগেই এক ডজন খোসা জড়ো করে ফেলল। শসা, টম্যাটোয় নুন, লেবু মাখিয়ে স্যালাডও রেডি হয়ে গেল এক প্লেট”। (টিকরপাড়ার ঘরিয়াল) ছেলে বুমবুমকেও অনেকটা সময় দিতে হয় মিতিনকে। বুমবুম ভালোবাসে চিপস খেতে আর ভিডিও গেম খেলতে। বিশেষ করে রোড র্যাশ তার খুব পছন্দের গেম।
আর আমাদের টুপুর স্কুলের ছুটি পড়লেই মাসির কাছে চলে আসে। রহস্যের পেছনে ছুটতে ওর দারুণ ভালো লাগে। অবশ্য মিতিনমাসির বাড়ির নিত্য নতুন রান্নার আকর্ষণও আছে একটা। টুপুরের মা সহেলির পছন্দ নয় যে টুপুর এখন থেকেই মিতিনমাসির ল্যাঙবোট হয়ে ঘুরুক। ভদ্রমহিলা ভীষণ আরামপ্রিয়। হাউজ ওয়াইফ। মার্কেটিং করতে ভালোবাসেন। আর ভালোবাসেন ঘর সাজাতে। মিতিনের একদম উল্টো। বরং পার্থ’র সাথে মেলে কিছুটা। টুপুরের ভালো নাম ঐন্দ্রিলা। ওর বাবা অবনী ইতিহাসের অধ্যাপক। ভীষণ গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। বেড়াতে গেলেও মোটা মোটা বই সঙ্গে নিয়ে যান। নীরস প্রবন্ধের বই। পার্থর সঙ্গে দাবা খেলতে ভালোবাসেন। ইতিহাস চর্চা শুধু তাঁর পেশা নয় নেশাও বটে। টুপুরকে সাপোর্ট করেন। ওরা হাতিবাগানে থাকে। মিতিন মাসি থাকে ঢাকুরিয়ায় ।
অপরাধীদের সঙ্গে লড়তে গেলে নিজেকে সুস্থ রাখাটা খুব দরকার। চাই নিয়মিত শরীর চর্চা। মিতিন নিয়মিত শরীরচর্চা করে। ক্যারাটের প্যাঁচ পয়জার গুলো ওর ভালোই জানা আছে। বেশ অনেকবার মিতিনকে আমরা মারপিট করতে দেখেছি। ‘সর্প রহস্য সুন্দর বনে’তার মধ্যে অন্যতম। এই উপন্যাসে মিতিনকে রিভলবারও ব্যবহার করতে দেখা যায়। তবে চালাবার প্রয়োজন পড়েনি।
স্বাস্থ্য সচেতন মিতিন দোকানের স্যালাড খায় না পারতপক্ষে, এমন কী বাড়ির কাউ কে খেতে দেয় না। বেশিক্ষণ কেটে রাখা শশা পেঁয়াজে নাকি জীবাণু টানে খুব। (হাতে মাত্র তিনটে দিন) মাঝে বেশ কিছুদিন বাড়িতে শুধু স্বাস্থ্যকর খাবার বানাতো, তবে শেষ পর্যন্ত সেই রুটিন আর বজায় রাখা যায়নি। (মারকুইস স্ত্রিটে মৃত্যু ফাঁদ) এই প্রসঙ্গে পুলিশের ডি.আই.জি. অনিশ্চয় মজুমদার কে ভুলে গেলে আমাদের চলবে না। ডাক নাম ভেল্টু। এই মানুষটিও বেশ খাদ্যরসিক। বপুটিও বিশাল। বেশ অনেক উপন্যাসেই মিতিনের শরনাপন্ন হয়েছেন মিস্টার মজুমদার অথবা মিতিন তাঁর সাহায্য নিয়েছে।
মিতিনের জেরা করবার ধরণটিও বেশ লক্ষ্য করবার মতো। ক্রমাগত কথা চালাচালি করে সুন্দর ভাবে সহজ করে দেয় অপর পক্ষকে। তবে মিতিনের প্রথম আত্মপ্রকাশ কিন্তু বড়দের জন্য। প্রথম উপন্যাস ‘পালাবার পথ নেই’ একসময় রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে প্রকাশিত হত। এছাড়াও ‘বিষ’, ‘মারণ বাতাস’, ‘তৃষ্ণা মারা গেছে’ প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য লেখা হয়েছিল। এই গল্পগুলোয় টুপুর নেই, এখানে মিতিনের সহকারী পার্থ। কিশোরদের জন্য মিতিনের প্রথম আবির্ভাব ‘সারাণ্ডায় শয়তান’ উপন্যাসে । (পুজোসংখ্যা আনন্দমেলা ২০০২ )
মিতিন, পার্থ, টুপুর আর বুমবুম সিঙ্গাপুর ঘুরতে যায় ‘ছকটা সুডোকুর’ উপন্যাসে। ভারতীয় সেনা বিভাগের গোপন তথ্য বিদেশে পাচার করে দিচ্ছিল এক চক্র। মিতিনের হস্তক্ষেপে এই সমস্যার সমাধান হয়। সিঙ্গাপুরে মিতিন আর টুপুর কে নানা রকম বিদেশী ডিশ টেস্ট করতে দেখা গেছে। যেমন বাটার টোস্ট, টার্কি সসেজ, স্ক্রাম্বলড এগ, পিৎজা, পাস্তা, নাশিং গোরে, শুশি, স্কুইড ভাজা। শুধু রেস্টুরেন্ট এর মালকিনকে বোঝানো গেল না বলে বেবি অক্টোপাস আর চাখা হল না। তবে পার্থর মুখে বিদেশী খাবার বিশেষ রোচে না। প্রত্যেকটা উপন্যাসেই জমিয়ে খাওয়া দাওয়ার বর্ণনা। মনে হয় সুচিত্রা ভট্টাচার্য নিজেও খাদ্য রসিক ছিলেন। তাই মিতিন, পার্থ, টুপুরও ভালো খেতে ভালবাসে। এর আগে মতি নন্দীর কলাবতী সিরিজে খাওয়া দাওয়ার অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। পাঠকদের জিভে জল সামলে রাখা বেশ কঠিন হয়ে যায়।
তবে মিতিনের উপন্যাস গুলোর একটা বিশাল প্লাস পয়েন্ট হল বিভিন্ন সম্প্রদায় যাদের আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বলি তাদের সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। ইহুদী, আর্মেনিয়ান, পারসিক, চীনা, জৈন ইত্যাদি বিভিন্ন সম্প্রদায় সম্বন্ধে বহু জানা অজানা তথ্য আমাদের সমৃদ্ধ করে। তাদের সংস্কৃতি, সামাজিক রীতি-নীতি, খাদ্যাভাস, উৎসব –অনুষ্ঠান সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারি আমরা। আর্মেনিয়ানদের বড়দিনের উৎসব হয় ৬ জানুয়ারী। ২৫ শে ডিসেম্বর তারা শুধু একটা মোমবাতি জ্বালায়। (আরাকিয়েলের হিরে) চীনাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হল মুন ফেস্টিভাল (ঝাও ঝিয়েন হত্যা রহস্য)। আর পারসিকদের নোওরোজ। (হাতে মাত্র তিনটে দিন) আর নিষ্ঠাবান জৈনরা ফ্রিজে রাখা ঠাণ্ডা জল পর্যন্ত খায় না। অনেক জীবাণু নাকি মারা যায় তাতে (দুঃস্বপ্ন বারবার)।
শুধু তাই নয় বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলির অতীত ইতিহাস সম্পর্কেও বহু মুল্যবান তথ্য পাই শুধু মাত্র এই মিতিন মাসির অ্যাডভেঞ্চার গুলো পড়ে। অদ্ভুত একটা ভালো লাগার সৃষ্টি হয়।
এবার তোমাদের মিতিন আর টুপুরের অ্যাডভেঞ্চারগুলোর একটা তালিকা দিয়ে দিই।
১। সারাণ্ডায় শয়তান --- ২০০২
২। জোনাথনের বাড়ির ভূত --- ২০০৩
৩। কেরালায় কিস্তিমাত --- ২০০৪
৪। সর্প –রহস্য সুন্দরবনে---২০০৫
৫। ঝাও ঝিয়েন হত্যা রহস্য---২০০৬
৬। ছকটা সুডোকুর ---২০০৭
৭। আরাকিয়েলের হিরে ---২০০৮
৮। গুপ্তধনের গুজব --- ২০০৯
৯। হাতে মাত্র তিনটে দিন ---২০১০
১০।কুড়িয়ে পাওয়া পেন ড্রাইভ--- ২০১১
১০।কুড়িয়ে পাওয়া পেন ড্রাইভ--- ২০১১
১১।মারকুইস স্ট্রিতে মৃত্যু ফাঁদ ---২০১২
১২। টিকরপাড়ার ঘড়িয়াল --- ২০১৩
১৩। দুঃস্বপ্ন বারবার ---২০১৪
১৪। স্যান্ডার সাহেবের পুঁথি ---২০১৫
‘কুড়িয়ে পাওয়া পেন ড্রাইভ’ বাদে বাকি সমস্ত উপন্যাস আনন্দ থেকে প্রকাশিত। ‘কুড়িয়ে পাওয়া পেন ড্রাইভ’ প্রকাশিত হয়েছে পত্রভারতী থেকে।
সুচিত্রা ম্যাডাম চলে গেলেও মিতিনমাসি, টুপুর, পার্থ, বুমবুম রয়ে যাবে চিরদিনের জন্য। তাই শেষ বলে কিছু নেই। অনেক নতুন পাঠক আসবে মিতিনদের জানতে আর আমরা পুরানো পাঠকরা বার বার ফিরে দেখব মিতিন মাসির অ্যাডভেঞ্চার গুলোকে। হারিয়ে যাবো কখনও ঝাড়খণ্ড কখনও কেরালায় কখনও সুদূর সিঙ্গাপুরে কখনও বা হিমাচলে, কখনও আবার লাদাখে!
ছবিঃ পুস্পেন মণ্ডল
No comments:
Post a Comment