সিনেমা: সিন্ডেরেলা
রিভিউ: ঋজু গাঙ্গুলী
সিনেমা: সিন্ডেরেলা
সিন্ডেরেলা! নামটা শোনা মাত্র ছোটোবেলা থেকে শুনে বা পড়ে আসা একটা গল্প চোখের সামনে ডানামেলা প্রজাপতির মতো রঙিন আলোর ফুলকি ছড়িয়ে দিয়ে ভেসে ওঠে| কী সেই গল্প?
সৎ মায়ের আর সৎ বোনেদের অত্যাচারে খুব কষ্ট পেত একটা মেয়ে| তাদের জন্যে সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর চিমনির ধারে ছাই আর অঙ্গারের মধ্যে বসে থাকত সে, আর তাই এক বোন তাকে বলত সিন্ডারটেইল, কিন্তু অন্যজন (যে একটু শান্ত আর ভালো) তাকে বলত সিন্ডেরেলা| একদিন সে খবর পেল, যে রাজকুমারের ইচ্ছেয় রাজবাড়িতে আয়োজিত হতে চলেছে এক নাচের অনুষ্ঠান| গোটা দেশের সব মেয়েরা সেই অনুষ্ঠানে যাবে, যাবে তার দুই হিংসুটি বোনও| সিন্ডেরেলা তাদের চমত্কার করে সাজিয়ে দেয়, কিন্তু সে নিজে যেতে পারে না সেখানে| কী করে যাবে সে? তার না আছে ভালো পোষাক, না আছে সেই রাজকীয় অনুষ্ঠানে যাওয়ার মতো ঘোড়ায় টানা গাড়ি আর কোচম্যান, যা না থাকলে রাজবাড়ির দরজায় দাঁড়ানো গোমড়ামুখো প্রহরীরা সবাইকে আটকে দেয়| দুঃখিনী সিন্ডেরেলাকে সাহায্য করতে তখন এগিয়ে আসেন তার ফেয়ারি গডমাদার| তাঁর ম্যাজিকে বাগানের সবথেকে বড়ো কুমড়োটা হয়ে যায় এক চোখ-ধাঁধানো ছয় ঘোড়ায় টানা গাড়ি, খাঁচায় আটকে পড়া ছ’টা নেংটি ইঁদুর হয় ছ’টা টগবগে ঘোড়া, একটা ধেড়ে ইঁদুর হয় কোচম্যান, ছ’টা টিকটিকি হয় জমকালো ফুটম্যান, আর সিন্ডেরেলার ছেড়াখোঁড়া পোশাক নিমেষে বদলে যায় মণিমুক্তো বসানো আর সোনা-রুপো দিয়ে বানানো পোশাকে| তারপর সে পায়ে দেয় একজোড়া কাঁচের জুতো (আহা, তেমন অসাধারণ জুতো আমরা চোখেই দেখিনি, তাই আমি আর কী বর্ণনা দেব তার?)| গডমাদারের বলা সাবধানবাণী (রাত বারোটার মধ্যে তাকে ফিরতেই হবে, এক মুহূর্তও যদি দেরি হয় তাহলেই সব হয়ে যাবে আগের মতো) মাথায় নিয়ে সে পৌঁছে যায় নাচের আসরে| সেখানে তার সৌন্দর্য দেখে রাজকুমার তার প্রেমে পড়ে যান, কিন্তু নাচে আর আনন্দে ঘড়ির কাঁটা কখন যে বারোটার দাগ প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে, তা সে বুঝতেই পারেনি| তারপর দৌড়-দৌড়-দৌড়! শেষে যখন সে ফিরে আসে নিজের বাড়িতে তখন তার পোশাক-কোচ-ঘোড়া-কোচম্যান-ফুটম্যান সবই আগের অবস্থায় ফিরে গেছে, আর পা থেকে পড়ে গেছে এক পাটি জুতো সেই রাজপ্রাসাদেই|
কিন্তু রাজকুমার যে তার প্রেমে এক্কেবারে কাবু সে কথা বোঝা গেল যখন দেশ জুড়ে রাষ্ট্র হল এই কথা: ওই এক পাটি জুতো যার পায়ে ফিট হবে, রাজকুমার বিয়ে করবেন সেই কন্যাকেই| এরপর হুলুস্থল না বেঁধে উপায় আছে! প্রথমে রাজপ্রাসাদের অল্পবয়সী মেয়ে আর মহিলারা, তারপর দেশের নামকরা পরিবারের মেয়েরা, শেষে দেশের সব মেয়েকে ওই জুতো পরানোর চেষ্টা হল, কিন্তু জুতো পায়ে ফিট হল শুধু সিন্ডেরেলার| তারপর সব্বার জন্যে হ্যাপি এন্ডিং, মায় সিন্ডেরেলার দুই হিংসুটি বোনের জন্যেও, কারণ সিন্ডেরেলা তাদের ক্ষমা তো করেই, তাদের জন্যে দুটি ভদ্রগোছের বর-ও যোগাড় করে দেয়| এই গল্পটা তো আমাদের সবারই জানা, তাহলে এই নিয়ে একটা নতুন সিনেমা কেন, আর কেনই বা সেই সিনেমা নিয়ে ম্যাজিক ল্যাম্পে এই লেখা? এ কথার উত্তর দেওয়ার আগে এই গল্পটার ইতিহাস খুউব সংক্ষেপে বলে দিই|
আজ থেকে দু হাজার বছরেরও বেশি আগে, যিশুখ্রিষ্ট জন্মানোর ৭ বছর আগে আমরা রোডোপিস নামের এক ক্রীতদাসীর কথা জানতে পারি, আকস্মিক ভাগ্য-পরিবর্তনের ফলে এবং নিজের গুণে যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল মিশরের রাজপুত্রের| ৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ চিনের দুয়ান চেংশিহ–এর লেখায় আমরা পাই য়েহ-সিয়েন-এর কথা, যে সৎ মা আর সৎ বোনেদের অত্যাচার উপেক্ষা করেও শেষ অবধি জীবনের যুদ্ধে জিতে গেছিল, কারণ ১০ ফুট লম্বা একটা মাছ তাকে দিয়েছিল খাবার, সোনা আর মুক্তো, মাছরাঙার পালক-লাগানো পোশাক, এবং সোনার তৈরি ছোট্ট-ছোট্ট জুতো| দেশে দেশে গল্পটা একটু-আধটু বদলে যায়, যেমন স্কটল্যান্ডের রাশিন কোটি তার উপহার পায় একটি লাল রঙা বাছুরের থেকে| তবে আমরা যে গল্পটা চিনি-জানি, সেটি স্থান পায় শার্ল পেরো-র সংকলিত এবং লিখিত “টেলস অফ মাদার গুজ”-এ, ১৬৯৭-এ| এর পরে ১৮১২-য় গ্রিম ভাইদের সংকলনে অ্যাশেনপুতেল নামে আমরা এই গল্প পাই, কিন্তু তাতে একটা গাছ থেকে সিন্ডেরেলা তার সব উপহার পায়, আর সেই গল্পে রক্তারক্তি বড্ড বেশি|
সিন্ডেরেলা নিয়ে প্রথম সিনেমা হয়েছে ১৮৯৯-এ ফ্রান্সে, মোটে ৭ মিনিট লম্বা ছিল সেই ফিল্মটি| হলিউড ১৯১৪-য় এই গল্প নিয়ে সাইলেন্ট মুভি বানিয়েছে| তবে আমাদের সবার চেনাজানা সিন্ডেরেলা-কে আমাদের কাছে পেশ করেন ওয়াল্ট ডিজনি তাঁর ১৯৫০-এর মিউজিক্যাল অ্যানিমেশন-এ, শার্ল পেরোর লেখা অবলম্বনে| সে সিনেমা শুধু যে জবরদস্ত হিট হয় তাই নয়, আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট-এর বিচারে সে সিনেমাটি সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম অ্যানিমেটেড সিনেমাগুলোর তালিকায় ৯ নম্বরে জায়গা পায় (বাকি সিনেমাগুলোর নাম বলতে গেলে সম্পাদকমশাই রাগ করবেন, তাই চুপিচুপি লিংকটা দিয়ে রাখি শুধু: http://www.afi.com/10top10/category.aspx?cat=1)|
২০১৫-র ফেব্রুয়ারি মাসে ওয়াল্ট ডিজনি পিকচার্স আমাদের আবার দেয় সিন্ডেরেলাকে নিয়ে একটি নতুন সিনেমা| ১৯৫০-এর ক্লাসিকটির থেকে অনেক উপাদান নিলেও এই সিনেমাটি কিন্তু নীলের বদলে কালচে রং, আলোর মধ্যে বেশ কিছুটা অন্ধকার, আর অনেকটাই দুঃখকষ্টে ভরা| এলা (সিন্ডেরেলা)-র ভূমিকায় লিলি জেমস, প্রিন্স চার্মিং (কিট)-এর ভূমিকায় রিচার্ড ম্যাডেন, এবং ফেয়ারি গডমাদারের চরিত্রে হেলেনা কার্টার চমত্কার অভিনয় করলেও লেডি ট্রেমেইন, তথা সিন্ডেরেলার সৎ মা-র চরিত্রে পাক্কা ভিলেইন হিসেবে অভিনয় করে কাঁপিয়ে দিয়েছেন কেট ব্লানচেট| কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে তিন-তিনবার অস্কার জেতা ডিজাইনার সিডনি পাওয়েল এই সিনেমায় চরিত্রদের সাজসজ্জার দায়িত্বে থাকায় স্ক্রিন জুড়ে সত্যিই দেখার মতো পোশাকের ছড়াছড়ি ছিল| তবে এই ফাঁকে তোমাদের একটা টপ-সিক্রেট খবর জানিয়ে রাখি: সিন্ডেরেলার পায়ের কাঁচের জুতোর জন্যে মিউজিয়াম ঘেঁটে ডিজাইন বানানো গেলেও কাঁচ তো আর ঝকমক করে না, তাই এই সিনেমার জন্যে মোট ৮ জোড়া জুতো শেষ অবধি বানানো হয়েছিল স্বারোভস্কি থেকে, ক্রিস্টাল দিয়ে; কিন্তু বেচারি নায়িকা সেগুলো আদৌ পরতেই পারেন নি, তাই তাঁকে চামড়ার জুতো পরিয়েই শুটিং করা হয়, আর সিনেমা বানাবার সময় সেটা ডিজিটালি বদলে করে দেওয়া হয় কাঁচের, মানে ক্রিস্টালের জুতো!
তাহলে মোদ্দা কথাটা কী দাঁড়াল? দেখা যাবে এই সিনেমাটি, যা ইতিমধ্যেই ওয়াল্ট ডিজনি হোম ভিডিও এন্টারটেইনমেন্ট-এর মাধ্যমে ব্লু রে আর ডিভিডি হয়ে এসে পড়েছে তোমার আশেপাশে? সিনেমাটা দেখার মতো তো বটেই, আর আর একটা দারুণ সারপ্রাইজ দিয়ে রাখি| সিনেমাটার সঙ্গে স্পেশাল ফিচার হিসেবে রয়েছে আমাদের সবার সুপার-ডুপার পছন্দের সিনেমা “ফ্রোজন”-এর একটা ছোট্ট সিকুয়েল: ফ্রোজন ফিভার, আর স্ক্রিনের সামনে বসে সেইটি দেখার জন্যে সোফা নিয়ে আমি মারামারি করতেও রাজি আছি| তাহলে দেরি নয়, ছোট করে দেখে নাও সিন্ডেরেলার এক চিলতে ট্রেইলার: https://www.youtube.com/watch?v=WRuHM6rLSF8
যাবার আগে মনে করিয়ে দিই, সিনেমাটা যখন দেখতে বসবে, তখন পাশের সিটটা খালি রেখো কিন্তু, নইলে হাতে পপ-কর্ন নিয়ে ঢুকে আমি বসব কোথায় শুনি?
বড্ড ভাল লিখেছেন। এমন লেখা আপনাকেই মানায়। আমি সত্যি সত্যি সিনেমাটা দেখার ব্যবস্থা করছি যত শীঘ্র সম্ভব।
ReplyDeleteপ্রসঙ্গত, স্নো হোয়াইট দেখে আমি ভেবেছিলাম এমন ছবি শ্রেষ্ঠ অ্যানিমেটেড ফিল্ম হবে না কেন? পরে জানলাম তা-ই হয়েছে।
অসংখ্য ধন্যবাদ। মেয়ের সঙ্গে সিনেমাটা দেখে ভরপুর আনন্দ পেয়েছিলাম। আপনিও দেখে ফেলুন চটপট।
Deleteছবিটা আগেই দেখেছি, তবে লেখাটা পড়ে সেই ছবির স্মৃতি দ্বিগুণ মনোরম হয়ে গেল, তাতে সন্দেহ নেই। একটা ছোট্ট পয়েন্ট, ছোটদের লেখায় 'প্রেমে হাবুডুবু' এর পরিবর্তে অন্য শব্দ ব্যবহার করা যেত মনে হয়। :) শেষ লাইনটা দুর্দান্ত, ছোটদের সংগে এভাবে মেন্টালি লিংক করতে পারলে ওদের আনন্দের সীমা থাকে না। ঋজুবাবুর কলম চলতে থাকুক, আমরা অন্তত সেটাই চাইব :)
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ। সবিনয়ে জানাই, আজকের ছোটোরা আমাদের চেয়েও বড়ো, তাই ওরা এগুলো ভালোই বোঝে। তবুও, পরের বার লিখতে গিয়ে একটু অন্য রকম করে লেখার নাহয় চেষ্টা করব। পাশে থাকুন।
Deleteছবিটা ভালই লেগেছিল কিন্তু এই লেখার গুনে সেই অভিজ্ঞতাটা আরো মনোরম হয়ে উঠল মনের ভাঁড়ারে। কেনেথ ব্রানাখ তার শেক্সপীরিয় পরীক্ষা নিরীক্ষার পাশাপাশি আমাদের ছোট বেলার স্মৃতি মহল হাতড়ে এই প্রশংসনীয় কাজটি করেছেন বলে তাকেও ধন্যবাদ। আর কেট ব্ল্যাঞ্চেট এক অসামান্যা অভিনেত্রী ... হিংসুটে সৎ মার চরিত্রে তার অভিনয় অনবদ্য।
ReplyDeleteপ্রতিক্রিয়া জানানোর জন্যে অনেক ধন্যবাদ| পাশে থাকুন| পুজো ভালো কাটুক|
Deletecinemata dekha hoyni , echheo chilo na dekhar , kintu lekhata pore mone hochhe dekhle mondo hoyna :)
ReplyDeleteথ্যাংকু| এমনি করেই পাশে থাকুন|
Deleteচমত্কার বর্ণনা . দেখিনি তবে দেখতেই হবে কন্যার সাথে . কলম চলতে থাকুক এমনি ভাবেই. পূজোর শুভেচ্ছা রইলো
ReplyDeleteঅশেষ ধন্যবাদ| এমনি করেই পাশে থাকুন| পুজো খুব ভালো কাটুক|
Delete