গল্পের ম্যাজিক:: প্রজেক্ট কে নাইন - তন্ময় বিশ্বাস


প্রজেক্ট কে নাইন 
তন্ময় বিশ্বাস
10/2/2232 (10:01:23:54 AM)

'তোমার অ্যাসাইমেন্ট রেডি?'

'হ্যাঁ...... ইয়ে মানে না... আজ রাতের মধ্যেই কমপ্লিট হয়ে যাবে।

'আজ লাস্ট ডেট। আই হোপ সেটা মনে আছে?'

'ইয়েস স্যার'

'বাকিদের সফট ফাইল কিন্তু জমা পড়ে গেছে। এবং প্রত্যেকেরটাই বেশ ইন্টারেস্টিং। আই হোপ তোমারটাও তাই হবে?'

'একদম স্যার।'

'ওকে বেস্ট অফ লাক।'

বসের চৌকো মতো মুখখানা অদৃশ্য হয়ে গেল বস সামনে এলেই আমার মাথা হ্যাং মারে।  আগেকার দিনেই ভালো ছিল ফোনে শুধু অন্য প্রান্তের কথা শোনা যেত। কথা বলতে বলতে কান খোঁচানো যেত। চোখ মুখ কুঁচকেমুখ ভেংচানো যেত। কিংবা বাড়িতে বসেও দিব্যি বলা যেতবাজার করছিআর এখনসামনে খানে থ্রি ডি হলোগ্রাম এসে হাজিরআর তার ওপর বসের ওই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা চোখ দুটো। যেন দুটো লেসার গান!
আজ এমনিতে আমার অফ ডে। অন্য দিন হলে এই অফ ডে গুলো তে ড়ান্ত রকমের বোর   বাবার মুখে শুনেছিলামআগেকার দিনে লোকে ছুটির দিনে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিতকিন্তু আজকের দিনে এই জিনিসে বড্ড অভাব।
এখন তো বাজারে ‘ডলফিন ব্রেন’ টেকনোলোজি চলে এসেছে। ব্রেনের ওপর ছোট্ট একটা লেজার সার্জারিব্যস। ব্যাপারটা কিছুই নয়ডলফিন যেমন কখনও পুরোপুরি ঘুমোয় নাডলফিনের  ব্রেনের একটা সাইড যখন ঘুমায় অন্যটা তখন সচল থাকে। এই সার্জারিতে মানুষের ব্রেনও ঠিক তেমনি হয়ে যাবে। অর্থাএকজন চাইলে দুমাস বিশ্রাম না নিয়ে কাজ করে যেতে পারেতবে মানুষের ব্রেন অবশ্য আরও বেশি জটিল। সেটা কীভাবে এমন করা হচ্ছেঅত টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি আমি জানি না।

যাই হোকঅফ ডে গুলো বোরিং হলেও কেটে যেত। কিন্তুকথায় আছে সুখে থাকতে রোবটে কিলোয়পাকামি মেরে ওই হতচ্ছাড়া অ্যাসাইমেন্টটা নিতে গেলাম!

আমাদের কোম্পানি একটা মাল্টিন্যাশানাল রোবটিক্স কোম্পানি। সারা পৃথিবী কে যান্ত্রিক করার ভার একা যেন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তা সেখানেই একটা নতুন প্রোজেক্ট শুরু হতে চলেছে। কিছু একেবারে ইউনিক রোবট বানানো হবে। যা আগে কেউ বানানো তো লাইট ইয়ার দূরের কথাকেউ কল্পনা পর্যন্ত করে নি। এবং সে গুলো যেন সোসাইটির উপকারেও লাগে!

এমনিতে  লিস্টে আমার নাম ছিল না। কিন্তু ওই যে বললাম সুখে থাকতে রোবটে কিলোয়। ভাবলাম মাঝে অফ ডে। অ্যাসাইমেন্টফ্যাসাইমেন্ট থাকলে দিব্যি কেটে যাবে।

আর এখনমাথা সব কটা চুল একটা একটা করে ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। যেচে নিয়েছিআর বস এখন যেচে জিজ্ঞেস করতে আসছে।

একটা ক্লিনিং রোবটের কথা ভাবছিলাম। বিল্ডিং গুলোর গায়ে রোজ রোজ যা ধুলো জমেতা আর বলার নয়। আর তা পরিষ্কার করা আরেক ঝক্কি। ২০০৩০০ তলার প্লেন দেওয়ালপরিষ্কার করা তো মুখের কথা নয়!

কিন্তুরোবটের ডিজাইন কী হবেযত ওপরে যাওয়া যায় হাওয়ার দাপট তত বাড়ে। ওই হাওয়ার দাপট সামলানোর ক্ষমতা থাকা চাইএমন ডিজাইননা আমার দ্বারা হবে না। অন্য কিছু ভাবতে হবে।

তাই মাইন্ড ফ্রেসের জন্য হোম কম্পিউটারেরস্টোর রুমের ফাইলটা খুলে বসলাম। এখানে আমার পূর্বপুরুষদের যে সব জিনি ফেলে দেওয়া হয়েছেসে গুলো স্ক্যান করে রাখা আছে। যাতে ভবিষ্যতে যদি প্রয়োজন হয়তবে যেন থ্রিডি প্রিন্টারের সাহায্যে সেগুলো আবার বানিয়ে নেওয়া যায়।

ফাইল সার্ফ করতে করতেই জিনিসটা  প্রথম চোখে পড়ল একটা রেক্টট্রাঙ্গুলার পাতসম্ভবত কাঠের তৈরি। আগেকার দিনে অন্যালগ সাইন বোর্ড গুলো যেমন হতো অনেকটা সেরকম  দেখতে। বোর্ডে একটা কিছু লেখা আছেআর নিচে অদ্ভুত একটা প্রাণীর ছবিহাতে আঁকা। শুধু মুখটা  দেখা যাচ্ছে। খাড়া খাড়া দুটো কানলম্বাটে মুখ আর ধারাল দু পাটি দাঁত।  

লেখাটা বাংলাতেই লেখা। কিন্তু সমস্যা হল সেই কোন ছোট বেলায় স্কুল পাশের জন্য বাংলা শিখেছিলাম। এখন বাংলা মোটামুটি বলতে পারলেওপড়তে গেলে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়!

যাই হো প্রায় ১৫মিনিট ২০ মাইক্রো সেকেন্ডের চেষ্টায় লেখাটা উদ্ধার করতে পারলাম।তিনটে শব্দ ‘কুকুর’, ‘হইতে’, ‘সাবধানমানে কোন কিছুর থেকে সাবধান করা হচ্ছে। সম্ভবত এই প্রাণীটার নামই কুকুর।কিন্তু  জিনি আগে দেখিনি!

আমার কম্পিউটারের থিংক ক্যাচার  খারাপতাই ভয়েজ কমান্ড দিতে হল।

কু-কু-

সাথে সাথে ডান দিকে দেওয়াল জুড়ে ভেসে উঠল অদ্ভুত একটা পশুর ছবি। গায়ের রং লালের দিকেইমাঝে মাঝে সাদার ছিটে। চারটে পায়ের ওপর ভর দিয়ে পশুটা দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে ছোট্ট মতো একটা লেজ। বুঝলাম সাইন বোর্ডে এর ছবি আঁকা হয়েছে। কিন্তু এটার কান দুটো কেমন ঝোলা ঝোলা!  

তারপর স্ক্রিনে নানা তথ্য ফুটে উঠতে লাগল অপ্রয়োজনীয়গুলো বাদ দিয়ে যা বুঝলাম। এই পশুটার বিজ্ঞান সম্মত নাম ক্যানিশ ফ্যমিলিয়ারিস। আদিম যুগে যখন মানুষ জীবজন্তদের পোষ মানাতে চেষ্টা করেতখন এই কুকুর  নাকি প্রথম পোষ মানে!

এরা ছিল খুব প্রভুভক্ত প্রাণী প্রভুর জন্য প্রা দিতেও নাকি দুবার ভাবত না। আর এদের ঘ্রাণ শক্তি আর শ্রবণ শক্তি এতটাই পাওয়ার ফুল ছিলযে পুলিশ ডিপার্টমেন্টেও  কাজে লাগানো হত।

একসময় পৃথিবীতে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জাতের কুকুর পাওয়া যেতশুধু আমাদের এই কলকাতার রাস্তাতেই নাকি 20th সেঞ্চুরি তে প্রায় ৩হাজার কুকুর ছিল। সারা অঞ্চল দাপিয়ে বেড়াত। কিন্তু তারপর অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। এধার ওধার হাইরাইজার বিল্ডিং আর মানুষের অত্যাচারে এরা শেষ হতে হতে বিলুপ্ত হয়ে যায়। শুধু ভারতে নয় অন্যান্য দেশেও তাই। দেখভাল করার সময় না থাকায় তখন আর কে কুকুর পুষতে চাইত না.......ইত্যাদি ইত্যাদি।

পড়া শেষ করে হাঁক দিলাম‘H008, এদিকে আয় তো একবার  

হ্যাঁ বলুন।  আরেক বার ওয়ার্ন করছি। আমাকে তুই তোকারি করবেন না প্লিজ।

উফকী দিন কাল এল এখন রোবট চাকরগুলো কথা শোনাচ্ছেযত নষ্টের গোড়া ওই ‘রোবট রেস্পেক্ট অ্যাক্ট’ ধারা টা। ওটা পাশ হওয়ার পর থেকেই ব্যাটারা মাথায় উঠে বসেছে। বাবাদের  সময় এমনটা  ছিল না। মুখ বুজে নিজের কাজ করে যেত। সাত চরেও রা কাট না। আহা নাম  টাও কী মিষ্টি। রঘু। খটাং খটাং করে লাফেরা করতো গোল গোল চোখ আর মুখে একটা ফিক্সড হাসি।

কিন্তু কী আর করা যাবেসেই রোবট গুলো তো এখন ব্যানড করে দিয়েছে। তার জায়গায় এসেছে এই অবতারগুলো চক চকে বডি কভার। প্লেন কাঁচে ঢাকা মুখ। চোখ মুখের কোন বালাই নেই। চলা ফেরার কোন  আওয়াজ নেই। আছে যেটা সেটা  দেমাক। তাও যদি বুঝতাম অ্যান্ড্রয়েড!

এই সাইন বোর্ড টা দেখছ?’

হ্যাঁ স্যার

এটা আমাদের বাড়িতে কী ভাবে এল তার ফুল ডাটা চাই। ওকে?’

ওকে স্যার। আপনি কি কোথাও বেরুচ্ছেন?’ 

কেন তোমার পারমিশন নিতে হবে নাকি?’

 গুলো জিজ্ঞেস করা আমার পোগ্রামিং এর মধ্যে পরে।

উফহ্যাঁ টাইম ট্র্যাভেল এজেন্সি তে যাচ্ছি। আর কিছু?
টেক কেয়ার

10/02/2232 (12:00:30:23 PM)

মনে মনে কথা বলাটা আমার একরকম অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আসলে এটা আমার একটা হবি। আমি আমার ব্রেনে একটা স্পেশাল বায়োচিপ ইনস্টল করেছি। আমি মনে মনে বা মুখে যা বলিযা শুনিসব গিয়ে স্টোর হয় ওই চিপে। এবং চিপ সেটা আবার হোম কম্পিউটারে পাঠিয়ে দেয়। ওখানে সব ডেটা গুলো টাইম সমেত স্টোর হয়ে যায়। আগেকার দিনে অনেকের যেমন ডায়েরী লেখার অভ্যাস ছিল। ব্যাপারটা  অনেক টা সেরকম।

এখন বসে আছি টাইম ট্র্যাভেল এজেন্সির রিশেপসানে। টাইম ট্র্যাভেল কলকাতায় এই প্রথম। তা চালু হয়েছে মাস তিনেক হয়ে গেল আমার আগে ট্রাই করা হয় নি।

কুকুরের কথা জানার পর মাথায় একটা আইডিয়া এলঅ্যানড্রয়েড কুকুর বানালে কেমন হয়এখন তো চারদিকে অ্যানড্রয়েড এর ছড়াছড়ি। কিন্তুঅ্যানড্রয়েড পশুর ওপর তেমন কাজ হয় নিএকবার অ্যানড্রয়েড ডাইনোসরের কথা উঠেছিল বটে। কিন্তুডাইনোসর তো কোন কাজেই লাগে না। আর কুকুর তো খুব ইউজ ফুল অ্যানিমাল। এটা যদি একবার বানানো যায়........!

ওফ!
প্রজেক্ট কে নাইন!চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছি।কাল অফিসে সবাই এটা নিয়েই বলাবলি করছে। বসের চৌকো  মুখে এক গাল হাসি।পিঠ চাপড়ে বলছে, ' ওয়েল ডান রায়চৌধুরী। '

আর তার কিছু দিন পর। পৃথিবী ছেয়ে যাচ্ছে অ্যানড্রয়েড কুকুরে। তারা ছুটে যাচ্ছে মানুষের আপদে বিপদে। ছড়িয়ে দিচ্ছে আনন্দ। আর ইতিহাসের পাতায় টুক করে ঢুকে পড়ল আমার নামতবে কুকুর গুলোর নাম আবার আমার নামে না রেখে বসে!

মিঃ রায়চৌধুরী?’ 

একটা ভদ্রস্থ পোশাক পরা ছেলে এগিয়ে এল বেশ স্মার্ট অ্যানড্রয়েড না মানুষ বোঝা যাচ্ছে না।

হ্যাঁ আমি

ওয়েলকাম টু আওয়ার এজেন্সি। বলুন কী ভাবে সাহায্য করতে পারি?’

আমি টাইম ট্র্যাভেল এর ব্যাপারে জানতে এসেছি। খরচ পাতি...’

দেখুন স্যার একচুয়েল কোনও ফিক্সড রেট নেই।আপনি কোথায় যাবেনকোন সময় যাবেন এবং কতক্ষণ থাকবেন তার ওপর ডিপেন্ড করছে।
এই ধরুনআমি ওই মোটামুটি একবিংশ শতকের কলকাতায় যাবোতো....’

হ্যাঁ এতে খুব বেশি খরচ পড়বে বলে মনে হয় না। আপনি যতক্ষণ থাকবেন তার ওপর এখন....’
খুব ভালইয়ে...মানে সাইড এফেক্ট-টেফেক্ট কিছু আছে নাকি?’
না নাকিসের সাইড এফেক্ট?’
এই ধরুন ওখানে গিয়ে কিছু করে বসলাম তো তাতে ইতিহাস বদলে যাবে না?’
এবার অ্যান্ড্রয়েড ছোকরা মুখে একটা রহস্য রহস্য হাসি মেখে বলল ‘ইতিহাস বদলানো যায় না স্যার। আপনি চাইলেও পারবেন না। তাহলে সব অ্যারেঞ্জ করবো স্যার?’
হ্যাঁ 
তারপর একগাদা ফর্মালিটির বেড়া টপকেঅবশেষে অ্যানড্রয়েড ছোকরা আমাকে ছোট একটা রুমে নিয়ে এল অ্যানড্রয়েড বলছিকারণ আজ কাল আর মানুষ এত আন্তরিক ভাবে কথা বলে  না!
ঘরটা বেশি বড় নয়। ফ্লুরসেন্ট পেন্ট দিয়ে রঙ করা। আজকাল এটা খুব উঠেছে। ঘরে আলোর দরকার হয় না রঙই যথেষ্ট!
ঘরটার ঠিক মাঝখানে গোল মতো একটা চাকতি। তার ওপর খাড়া করা আছে একটা কাঁচের টিউব। ব্যাস প্রায় চারফুট মতো। আর টিউবটাকে ঘিরে গুচ্ছের যন্ত্রপাতি। ঘরের একপাশে রাখা একটা সুপার কম্পিউটার। ছোকরা কম্পিউটারে কিছু করল তারপর একটা জিনি আমার  হাতে তুলে দিয়ে বলল ‘স্যার এটা আপনার লাগবে। এই ডিভাইসে অনেক ডাটা স্টোর করা আছে। কোন কিছুর সম্বন্ধে জানতে হলে এটা তার সামনে ধরবেন বা ভয়ে কমান্ডও দিতে পারেন।
কেন আমার সুপার গ্লাসে হবে না?’
না স্যার। ওখানে তো সিগনাল পাবেন না  
আমার হাতে যে ডিভাইস টা দিল সেটা দেখতে অনেকটাম্যাগ্নিফাইং গ্লাসের মতো। ছোট একটা গোল স্ক্রিন আর একটা হাতল। হাতলে দুটো সুইচ।
এই যে লাল সুইচ টা দেখছেন। ওটা টিপলে আপনি আবার রিটার্ন চলে আসবেন। যান এবার ওই টিউবের মধ্যে দাঁড়ান  
আমাকে টিউবের মধ্যে পুরে ছেলেটা সুপার কম্পিউটারের কাছে চলে গেল ছেলেটাকে আমার বেশ ভালো লেগে গেছে। হোক না অ্যানড্রয়েড। ওর নামটা জানা হল না।
হঠাআমার চারদিকে কয়েকটা লাল আলো জ্বলে উঠল। লাইট বলও বলা যায়। আস্তে আস্তে বল গুলো আমার চার দিকে স্যাটেলাইটের মতো পাক খেতে লাগল ক্রমশই তাদের বেগ বাড়ছে। একটু পরেই লাল ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম না। লাল লাল আর লাল। তারপর হঠা করেই সব অন্ধকার হয়ে গেল। একদম ব্ল্যাক আউট!

কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখ সয়ে গেল। প্রথমেই চোখে পড়ল একটা আলো। টিম টিম করে জ্বলছে। যেন এখুনি অন্ধকার তাকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেবেএটা একটা লাইট পোস্ট।

আমি দাঁড়িয়ে আছি খুব সরু একটা রাস্তায়। রাস্তাটা দড়ির মতো এঁকে বেঁকে এগিয়ে গেছে।  আমিও এগলাম। আশেপাশে সার সার বাড়ি ঘর কোনটাই দু-তিন তলার বেশি নয়চারদিক   খাঁ খাঁ। যেন এখানে আমিই একমাত্র জীবিত প্রাণী। বাড়িগুলো পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। কোথাও  কোথাও চটে গিয়ে ইঁট বেরিয়ে পরেছে। বাড়ি গুলোর গায়ে একটা অদ্ভুত জিনি চোখে পড়ল। দেখতে অনেকটা ভেলভেটের মতো। সবুজ সবুজ রঙ। হাতের ডিভাইস টা বাগিয়ে ধরলাম। সাথে  সাথে গোল স্ক্রিনে রকমারি ইনফরমেশন ফুটে উঠল। এটার স্থানীয় নাম শ্যাওলা। এটা মস জাতীয় একধরণের মূল বিহীন উদ্ভিদ। সাধারণত স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় জন্মায়। এই সময়েমানে ২০০৭  দেওয়ালে ফাইবার কোটিং দাওয়া হত না। তাই জল সোপ করে এই শ্যাওলা জন্মাত

আবার চলতে লাগলাম। এখানে ওখানে অন্ধকার জমে আছে। সূ্যোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে। চারদিকে কেমন যেন পুরানো পুরানো গন্ধ। পাড়াটা বেশ পুরানো  যেন অন্ধকার মেখে দাঁড়িয়ে আছে আস্ত সব ইতিহাস।

হঠালাইট পোস্ট গুলো সব কানা হয়ে গেল পাওয়ার কাটএই সময়ে পাওয়ার সাপ্লাই খুব খারাপ ছিল। তাই মাঝেই এমন হত।

কিন্তু কী আশ্চর্য , কই অন্ধকার হল না তোচারদিক এক আশ্চর্য রুপোলী আলোয় ভরে গেলওপরের দিকে তাকালাম। একটা বিশাল আকাশ। তাতে ফুটে আছে অসংখ্য তারা আর থালার মতো একটা চাঁদ। এটা তবে চাঁদের আলোচাঁদের আলো এত সুন্দর হয়এত মায়াময়সত্যি আমি কোনদিন চাঁদের আলো দেখিনি। সভ্যতার আলোর চোটে ২২৩২ এর মাটিতে চাঁদের আলো পৌঁছায় না।

আকাশ থেকে যেন রুপো ঝরছে। ডিভাইসটাতে এই আলোর খুব সুন্দর একটা নাম পেলাম। ‘জ্যোস্না!’

আমাদের যুগটা সব পেয়েছির যুগ। অসম্ভব শব্দটা নাকি বিজ্ঞানীরা মুছে দিয়েছেন!কিন্তু তারা কি পারবেআবার এই জ্যোস্নাএই ইতিহাস, পুরানো পোড়ো বাড়িগুলো ফিরিয়ে দিতেনাপারবে না।কারণ তারা নিজেরাই তা ছিনিয়ে নিয়েছে।  

হঠা একটা শব্দ কানে এল গোঁ গোঁ-গরর্।আমার ঠিক ডান পাশে আলো ছায়া মাখা একটা সরু গলি। আর সেখানে দাঁড়িয়েই আমাকে ঠিক যেন শাসাচ্ছে চারপেয়ে একটা জীব। তার চকচকে দাঁতগুলো থেকে চুঁইয়ে পড়ছে জ্যোস্না। ডিভাইসটা সামনে ধরলাম। হ্যাঁ সন্দেহ নেই এটাই সেই ‘কুকুর’!

কুকুরটা একই রকমভাবে গোঁ  গোঁ  করতে করতে এগিয়ে এল তার জ্যোস্না ভেজা শরীরটা কী রঙের তা বোঝা যাচ্ছে না। এরা রাতে পাড়া পাহাড়া দিত। সন্দেহ জনক লোক দেখলেই তেড়ে যেত। তা আমাকে দেখেও যে সন্দেহ হবে তাতে র আশ্চর্য কী!আমার পোশাক শা   যুগের থেকে অনেকটাই আলাদা  

সে আরও কয়েক পা এগিয়ে এল নাখের ফুটো গুলো ছোট বড়ো হচ্ছে। গন্ধ নিচ্ছে। এক অজানা গন্ধ। এবার ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমার কাছে একে ঠেকানোর মতো কিছু নেই। তাই হাত রালাম ডিভাইসের লাল বোতাম টার ওপর।

ঠিক তখন ওর পিছন থেকে কুঁইকুঁই করে একটা শব্দ এল কেউ যেন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।  
কুকুরটা সাথে সাথে সেদিকে ছুটে গেল আর কী আশ্চর্য আমিও ভয়ডর ভুলে পিছন পিছন এগলামএকটু এগিয়েই একটা কানা লাইট পোস্ট। তার ঠিক নিচেই শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে প্রায়  একফুট লম্বা একটা প্রাণী। কুকুরটা তার সারা গা চেটে দিচ্ছে। যেন আদরে ভুলাচ্ছে তার ছানাটিকে। তার গোলাপি জিভ থেকে ঝরে পড়ছে একরাশ স্নেহ। একরাশ মমতা।

আমি কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলাম। সে একবার ফিরে তাকালো। তারপর আবার নিজের কাজে মন দিল এদের মস্তিষ্ক মানুষের মতো উন্নত নয়। তাই প্রকৃতি এদের দিয়েছে কিছু ক্ষমতা। যেমন মানুষ চেনার ক্ষমতা। বিজ্ঞান হাজার চেষ্টাতেও যা আয়ত্ত করতে পারবে না।
মা কে কাছে পেয়ে ছানাটি এখন বেশ শান্ত। শুধু মাঝে মাঝে ক্ষীণ ভাবে কুঁই কুঁই করে কী সব যেন  অভিযোগ করছে!
ছানাটার পিঠের কাছে একটুকরো অন্ধকারডিভাইসের আলো সেখানে ফেলে চমকে গেলাম। ওখানে একটা দগ দগে ঘাচামড়া ছিঁড়ে গিয়ে লাল হয়ে আছে। হলুদ মতো একটা রস গড়িয়ে পড়ছে।
 নিয়ে ছানাটা বেশি দিন বাঁচবে না!
আমার পকেটে সব সময় এক পাউচ আইরেটেড পাউডার থাকে। এটা এখন খুব পপুলার প্রোডাক্ট। যে কোন কাটা ছেঁড়া জায়গায় ছড়িয়ে দিলেসেখানকার কোষ পাদনের হার বহুগুণ বেড়ে যায়। এবং কিছুক্ষণ  পরে সেখানে কাটা দাগ ছাড়া আর কিছু থাকবে না!  
বাঁ হাতটা মা কুকুরটার মাথায় রাখলাম। সেখানে ছোট ছোট লোম। হাত বোলালে সরে সরে যাচ্ছে। সে আরামে চোখ বুজল। সেই সূ্যোগে ডানহাতে ধরা পাউডার ছড়িয়ে দিলাম ছানাটার পিঠে। ওষুধটাই একটু চির বির করে। সেই জন্যই বোধহয় পুঁচকে টা কুঁইকুঁই করে উঠল। সাথে সাথে মা তার ছানা দিকে তাকালো। কিন্তু ততক্ষণে ম্যাজিক শুরু হয়ে গেছে। ঘায়ের গর্ত দ্রুত ভরাট হচ্ছে। একটা সময়ের পর ছাই রঙের আস্তরণের নিচে সব কিছু ঢাকা পড়ে গেল!

তখন মায়ের আনন্দ আর দেখে কে। কুঁইয়াও কঁউয়াও করে আমার চারদিকে লাফালাফি শুরু করে দিল একবার আমার কাছে এসে গা ঘষছে পরক্ষনেই লেজ নাড়তে নাড়তেজিভের আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে আমার হাত মুখ। এরা উপকার বোঝে!  

পুঁচকেটাও ততক্ষণে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ভুক ভুক করে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। আর এত জরে জোরে লেজ নাড়ছে যে নিজেই ব্যালেন্স করতে পারছে না।

আরে বাচ্চাটা মাঝে মাঝে কাঁপছে কেনতখনি খেয়াল হল এয়ার কন্ডিশন শুট পরে আছি বলে কিছু বুঝতে পারছি না। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। ডিভাইসে দেখলাম ১৩ ডিগ্রি.সি। এই শীতের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা কি ওর আছে?

বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বড় বড় দুটো চোখ মেলে। দু চোখে টলমল করছে দুটো চাঁদ।

তুলতুলে নরম শরীরটাকে নিয়ে এগিয়ে চললাম। মাটাও চলল সাথে সাথে। আমি যেন তার অনেক দিনের চেনা। আমার ওপর তার অগাধ বিশ্বাস। ওর অবচেতন মন বলছে যে ওর বাচ্চা সুরক্ষিত। শুধু মাঝে মাঝে দু পায়ে ভর দিয়ে উঠে দেখে নিচ্ছিল তার সন্তান কে!

নিজেকে আমার বড় অচেনা লাগছিল। আচ্ছা যন্ত্রে কি আদৌ এদের ধরা যায়২২৩২ এর কোন  ডিজাইনকোন পোগ্রামিং কি ছুঁতে পারবে এদের এই ভালোবাসাএই কৃতজ্ঞতা বোধ?  

একটা বাড়ির গেট খুলে ঢুকলাম। গেটে কোন রকমের লক নেই। দোতলা বাড়ি। সামনে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে বাগান। বড়ো বড়ো ঘাসের ওপর বরফের মতো জ্যোস্না জমে আছে। এক জায়গায় শুকনো পাতার ঢিবি। সেখানেই ছানাটাকে  নামিয়ে রাখলাম। এবার ফেরা যাক। শেষ বারের মতো তাকালাম। মা কুকুরটা পাতার ওপর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়েছে। ছানাটার মাথা  মায়ের কোলে গোঁজা। আরামে বোজা দুটো চোখ। চাঁদের আলো হাত বোলাচ্ছে তাদের সারা  শরীরে।

ডিভাইসের লাল সুইচটায় চাপ দিলাম। সাথে সাথে চার দিক থেকে ঘিরে ধরল সেই আলোর দল।
আচ্ছাসকালে যদি বাড়ির মালিক ওদের তাড়িয়ে দেয়শুনেছি কিছু কিছু মানুষ এদের প্রতি এতটায় নিষ্ঠুর হত যে পিটিয়ে বা কেরোসিন ঢেলে মেরে ফেলতেও পিছপা হত নাসেরকম  কিছু...... কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। লাল লোগুলো পাক খেতে খেতে আমাকে  ঢেকে ফেলেছে। লাল ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। আর তার পরেই সব অন্ধকার!

10/2/2232 (8:23:20:13 pm)

'শ্যাওলা!''
ইয়েস স্যার।
টোয়েন্টি ওয়ান সেঞ্চুরিতেও এগুলো দেখা যেত দেওয়ালে জল শোপ করে জন্মায়। ''ওকে...''আমার ক্লিন রোবটটাকেও  ওই ডিজাইনে বানাতে চাইছি। এটা ভ্যাকুয়ামের সাহায্যে দেওয়ালের সাথে চেপ্টে থাকার ফলেহাওয়ার ফোর্সটাকে ইগ্নোর করতে পারবে। আর রোঁয়া গুলো একটু নাড়াচাড়া করে সহজেই ক্লিন করতে পারবে। তবে এই দেওয়াল বেয়ে চলাফেরা করার ব্যাপারটা অন্য ডিপার্টমেন্ট এর হেল্প নিতে হতে পারে।'' হুমম ইন্টারেস্টিং। কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার হল না। ওকেতুমি কাল এসে ডিটেলে আমাদের বোঝাও। গুড নাইট।''ওকে। গুড নাইট স্যার। 'জানলার সামনে থেকে বস মিলিয়ে গেল কাঁচের ওপারে একটা হলুদ চাঁদ।  চাঁদের আলো নেই। জ্যোস্না নেই। শুধু উদাস ভাবে চেয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। সভ্যতার দিকে।ডানদিকে তাকালাম। স্ক্রিনে ভেসে আছে আগেকার যুগের একটা  টু ডি ফটোগ্রাফ। এটা H008,  আমাদের ফ্যামিলির ফাইল ঘেঁটে খুঁজে পেয়েছে। ফটোটা পিছনে দেখা যাচ্ছে একটা দোতলা  বাড়ি। এটা আমাদের ২০ জেনারেশান আগের বাড়ি। আর সামনে বেশ পোজ দিয়ে মা এর সাথে বসে আছে একটা কুকুর ছানা। যেন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বিজ্ঞান কে।  হ্যাঁ ছানাটার পিঠে আইরেটেড পাওডারে শুকিয়ে যাওয়াএকটা কাটা দাগ!

__________

ছবি-তন্ময় বিশ্বাস

2 comments: