প্যারাডাইস থেকে প্যারামাউন্ট – সাতানব্বই বছরের শরবত
সৌগত সেনগুপ্ত
বন্ধুরা তো মাঝে মাঝেই কলেজ স্ট্রীট যাও। পড়ার বই বা গল্পের বই কিনতে। কিংবা কলেজ স্কোয়ারের দুর্গাপুজো দেখতে। আজকে তোমাদের সেই কলেজ স্ট্রীট পাড়ার একটা দোকানের কথা বলব। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে, বরিশাল থেকে কলকাতায় এসে শরবতের দোকান খোলেন প্রয়াত নীহার রঞ্জন মজুমদার। সেই দোকানের নাম ছিল প্যারাডাইস। ১/এ বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট ছিল প্রথম ঠিকানা।
খুব কম সময়ের মধ্যেই উত্তর কলকাতার বনেদী পরিবারের সিরাপ আর শরবত খাওয়ার নতুন ঠিকানা হয়ে উঠল এই প্যারাডাইস। আমজনতার মধ্যে তখনও দোকানে এসে শরবত খাওয়ার চল ছিল না। পরবর্তী কালে কলেজের ছাত্র থেকে বিপ্লবী যুবাদেরও আনাগোনা শুরু হয় প্যারাডাইসে। এমনকি বিপ্লবীদের গোপন নথিপত্রও আদান প্রদান হত এখানে।
এর ফলেই তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের নজরে পড়ে গেল সংস্থাটি। নাম বদলিয়ে পাশেই ১/১/১ডি বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীট-এর ঠিকানায় শুরু হল প্যারামাউন্টের যাত্রা। যা এখনও চলছে। ৯৭ বছর পার করে দোকান থেকে প্যারামাউন্ট হয়ে উঠেছে এক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এর কণর্ধার শ্রী মৃগেন মজুমদার, প্রয়াত নীহার রঞ্জন মজুমদারের উত্তরপুরুষ।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে সেসময়ের প্রায় সমস্ত মনীষীরাই এখানকার শরবতের স্বাদে মুগ্ধ হয়েছেন। সত্যজিৎ রায় যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন, তখন তিনিও অনেকবার এই দোকানে এসেছেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ছিলেন বাঙালিদের মধ্যে ব্যবসার পথিকৃৎ। তিনি চাইতেন ব্রিটিশের গোলামি না করে বাঙালিরা ব্যবসায় আরও উদ্যোগী হন। তিনি নিজে যেমন বেঙ্গল কেমিক্যাল তৈরি করেছিলেন তেমনই অন্যান্য উদ্যোগীদেরও সহায়তা করতেন।
সেইসময়ে প্যারাডাইসের শরবতের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল। আচার্য রায়ের রেসিপিতে প্রথম বানানো হয় “ডাব শরবত।” যার মূল উপাদান ছিল ডাবের জল আর শাঁস। পাওয়া গেল সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে পুষ্টিকর পানীয়। এতো বছর পেরিয়ে এসে এখনও প্যারামাউন্টের সুপারহিট আইটেম ডাব শরবত।
ইতিহাস তো জানা গেল, এবার জানি কী ভাবে যেতে হবে এই দোকানে? কলেজ স্কোয়ারের পুবদিকের গেট (অর্থাৎ যে গেট দিয়ে কলেজ স্কোয়ারের পুজো দেখে বেরুতে হয়) দিয়ে বেরিয়ে সামনেই প্যারামাউন্ট। পুজোর সময়ে গেলে ঠাকুর দেখা আর শরবত খাওয়া একসঙ্গে সেরে নিতে পারবে। সোমবার থেকে শনিবার সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
এবার দেখে নিই এখানে কী কী শরবত পাওয়া যায়। মূলত তিন রকম শরবত পাওয়া যায় এখানে। স্পেশাল ড্রিঙ্ক, ক্রীম বেসড ড্রিঙ্ক আর সিরাপ। স্পেশাল ড্রিঙ্কের মধ্যে পাওয়া যায় কোকো মালাই, পাইন্যাপেল মালাই, স্ট্রবেরি মালাই, রোজ মালাই, ভ্যানিলা মালাই, গ্রেপস ক্রাশ আর কোল্ড কফি। এছাড়া প্যাশন ফ্রুট আর ডাব শরবত ও ড্রিঙ্কের মধ্যে পড়ে। ক্রীম বেসড ড্রিঙ্কের মধ্যে রোজ, ব্যানানা, লেমন, অরেঞ্জ, পাইনঅ্যাপেল, গ্রীন ম্যাঙ্গো, ভ্যানিলা উল্লেখযোগ্য। সিরাপের মধ্যেও পাওয়া যায় - রোজ, লেমন, অরেঞ্জ, গ্রীন ম্যাঙ্গো, লিচু এমনকি ট্যামারিন্ড বা তেঁতুলের সিরাপ ও পাওয়া যায়।
একসময়ে এখানে সফটড্রিঙ্কস আর আইসক্রীম পাওয়া গেলেও এখন শুধুমাত্র শরবত আর সিরাপই পাওয়া যায়। আর এগুলো সবই খাদ্যগুণ সমৃদ্ধ, বাজার চলতি সফটড্রিঙ্কসের মত শুধুমাত্র ক্যালরি বর্ধক নয়। অন্যান্য উপাদান বাজারে পাওয়া গেলেও, ডাব শরবতের জন্য স্পেশাল জোগানদার আছেন, যিনি রোজ ডাব পৌঁছে দিয়ে যান। দোকানে ঢুকলে দেখা যায় এক পাশে সার দিয়ে ডাব রাখা রয়েছে!
ছোট দোকানে একসঙ্গে ২০ জনের মত বসার ব্যবস্থা। দোকানের দেওয়ালে স্টাফ করা হরিণের শিং। সঙ্গে একটা বোর্ডে যেসব বিখ্যাত মানুষের পদধূলিতে ধন্য এই স্থান তাঁদের নামের তালিকা। আছে বিভিন্ন মণীষীদের ছবি। টেবিলটপ গুলো সেই সময়ের ইতালিয়ান মার্বেলের। যদি বসার জায়গা না থাকে বা বাড়ির জন্য নিয়ে যেতে চাও এদের টেক অ্যাওয়ে সার্ভিসও আছে। এমনকি বিয়ে সহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে প্যারামাউন্ট শরবত পরিবেশন করে থাকে।
সব শেষে আসি দামের কথায়। সিরাপ ও শরবতের দাম ৪০ টাকা থেকে শুরু । সবথেকে বেশি দাম ১৫০ টাকা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দামের কিছু পরিবর্তন হতেও পারে। তাহলে আর দেরি কেন? বাবা-মা কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে প্ল্যান করে ফেল কবে যাবে প্যারামাউন্টে। আর একটা কথা, শুধু গরমকালেই না, শীতকালেও কিন্তু সমান সুস্বাদু প্যারামাউন্টের সিরাপ এবং শরবত।
___________
ছবি — লোপামুদ্রা বাগ
প্যারামাউন্ট-এর সরবতের মতোই সুস্বাদু লেখার জন্যে ধন্যবাদ সৌগত; কিন্তু এখন যে রোজ মালাই-এর তেষ্টা পেয়ে গেল, তার কী হবে?
ReplyDeleteএরপর কলেজ স্ট্রিটে দেখা হলে ডাব সরবত থেকে চকো মালাই সব হবে
DeleteKobe dab sorbot khete jabo?
ReplyDeleteপরের বার দেশে আসলেই যাব অর্ণবদা
Delete