ইতিহাস:: হারানো শহরের খোঁজে:: মেঘের শহর মাচুপিচু - রুদ্র সেন


মেঘের শহর মাচুপিচু

রুদ্র সেন


দক্ষিন আমেরিকা যা কিনা ল্যাটিন আমেরিকা নামে ও পরিচিত সেখানেই বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম পর্বতমালা অ্যান্ডিজের দর্প কে চূর্ণ করে গড়ে উঠেছিল একটি সভ্যতা, যাকে আমরা ইনকা সভ্যতা বলে থাকি। আজ থেকে ৬৫০ বছর আগে দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন ছোটো বড় জনজাতিদের নিয়ে এক ছাতার তলায় ইনকারা গড়ে তুলেছিল এক অত্যাশ্চর্য সভ্যতাকে যা স্থায়ী হয়েছিল মাত্র একশ”র কিছু বেশি বছর। কিন্তু এর মধ্যেই তাদের গৌরব কিছু কম ছিল না। শিল্প সংস্কৃতি আর যুদ্ধ কৌশলে অপরাজেয় ছিল তারা। বর্তমানে কলোম্বিয়া , ইকুয়েডর ,পেরু, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা আর চিলির বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছিল দক্ষিন আমেরিকার সর্ব বৃহৎ সভ্যতা যা রোমান সাম্রাজ্যের চেয়ে আয়তনে কিছু কম ছিল না।

ইনকারা বিশ্বাস করত ভিরাকোচা বলে একজন দেবতা বিশ্বব্যাপী বন্যার হাত থেকে পৃথিবী কে রক্ষা করে মাটি দিয়ে তৈরি করেছিলেন ইনকাদের। তাই তারা ভিরাকোচা আর সূর্য দেব ইনতি কে প্রধান দেবতা বলে পুজো করত। এছাড়া ও ছিল অনেক দেবতা যারা চন্দ্র, পাহাড়, নদী, হ্রদ, বজ্র ইত্যাদির মাধ্যমে পূজিত হতেন। ইনকাদের নির্বাচিত রাজাকেও তারা দেবতা জ্ঞানে পুজো করত। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল তারা না জানত লোহার ব্যাবহার, না জানত চাকা কি জিনিস! তাদের নিজস্ব কোনো লিপি পর্যন্ত ছিল না। ছিল শুধু কিপু বলে দড়ির মত একরকম জিনিস। এতে ফাঁস পড়িয়ে তারা বিভিন্ন বিষয়ের খবর দূত মারফত আদান প্রদান করতে পারত। এক একটা ফাঁসের এক এক রকম অর্থ থাকত যা শুধু ওরাই বুঝতে পারত। সংবাদ আদান প্রদানের এক অদ্ভুত কৌশল, অনেক জায়গায় আদিবাসীরা মেসেজ আদান প্রদান করে ঢাক বাজিয়ে, অর্থাৎ এক প্রকার সাংকেতিক ভাষার সাহায্য নিত।
কিন্তু এতো কিছুর পর ও স্প্যানিশ সাম্রাজ্যবাদী দের আক্রমণ তারা ঠেকাতে পারেনি। স্প্যানিশদের লোহার অস্ত্র আর ঘোড়ার মোকাবিলা করার মত যুদ্ধগত যোগ্যতা তাদের ছিল না। এরপর নৃশংস ভাবে শেষ ইনকারাজ আতাহুয়ালাপা কে হত্যা করা হয়। অবশিষ্ট ইনকারা জঙ্গল কিংবা অ্যাণ্ডিজের আরও উঁচু স্থানে পালিয়ে জীবন বাঁচায়।

কালের অমোঘ নিয়মে যদিও ইনকারা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায় কিন্তু থেকে যায় তাদের কীর্তি। যুগে যুগে বিভিন্ন অভিযাত্রী আর স্বর্ণলোভীর দল দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন জঙ্গল আর পার্বত্য অঞ্চল তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ইনকাদের হারিয়ে যাওয়া শহরের সন্ধান পায়নি। সোনার শহর “এল ডোরাডো”র জনশ্রুতি চালু হয়। এই নিয়ে প্রচুর গল্প কাহিনী আমাদের দেশে ও তৈরি হয়েছে। যা আমাদের বাংলা সাহিত্যকে অনেকটা সমৃদ্ধ করেছে বিশেষ করে বাংলা কিশোর সাহিত্যকে।

এমনই একজন অভিযাত্রী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং শখের পুরাতাত্ত্বিক হির‍্যাম বিংহ্যাম খোঁজ চালাচ্ছিলেন। ইনকাদের শেষ আশ্রয় ভিলাকাবাম্বার। পেরুর বিভিন্ন পার্বত্য অঞ্চলে চলছিল তাঁর অভিযান। নিজের দেশ, স্ত্রী, সন্তানকে ছেড়ে চালানো সেই অভিযানে এক সময় তাঁর নৈরাশ্য আসছিল। সেই হারিয়ে যাওয়া শহরের সন্ধান তখন ও পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর কাছে আতিথ্য গ্রহন কালে তিনি জানতে পারেন পাশের একটি পাহাড়ের মাথায় নাকি একটি ছোটো পরিত্যাক্ত পাথরের শহর রয়েছে। কিন্তু তা গভীর জঙ্গলে ঢাকা। কাঠ সংগ্রহকারীরা সেই স্থানের কথা বলেছিল, কিন্তু তেমন ভাবে অভিযান সম্ভব হয়নি। ১৯১১ সালের ২৪ শে জুলাই স্থানীয় একটি কৃষক ছেলে কে নিয়ে তিনি হাজির হলেন পাহাড়ের ওপর সেই পরিত্যাক্ত শহরে। জঙ্গলে ঢাকা সেই জায়গায় বেশ কিছু পাথরের বাড়িও চোখে পড়ল কিন্তু হ্যিরাম তখন ও ভিলাকাবাম্বার মোহে আচ্ছন্ন তাই তিনি যে কিসের সন্ধান সেদিন মানব সমাজ কে দিলেন তার ধারণা হয়ত সেদিন সম্ভব ছিল না। তাই জঙ্গল পরিস্কারের নির্দেশ দিয়ে তিনি চলে গেলেন ভিলাকাবাম্বার সন্ধানে। ১৯১২ সালে তিনি যখন আবার ফিরলেন তখন ঝোপ ঝাড়ের ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসা একটা আস্ত শহর ঝলমল করছিল। রোদ আর মেঘের সাথে যে কিনা যুগ যুগ ধরে খেলে এসেছে। ইনকাদের একদম নাম না জানা হারিয়ে যাওয়া শহর “মাচুপিচু”।

কী জন্য নির্মিত হয়েছিল এত দুর্গম জায়গায় সেই মেঘের কোলের শহর আর কী ভাবেই বা তা স্প্যানিশ হানাদার বাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে যায় তা নিয়ে এখন ও ধন্ধের অবসান হয়নি। রিও ভিলকানোটা বা উরুবাম্বা নদীর ধার ঘেঁষে উঠে যাওয়া একটি পাহাড়ের মাথায় শুধু মাত্র পাথর দিয়ে এমন একটি শহর কী ভাবে বানানো সম্ভব হল তা ভাবলে আজও অবাক হতে হয়, যেখানে ইনকারা লোহা বা চাকার ব্যবহার পর্যন্ত জানত না! পুরাতাত্বিকদের মতে আনুমানিক ১৪৫০ খ্রীস্টাব্দে ইনকারাজ পাচাকুটির নির্দেশে নির্মিত হয়েছিল এই শৈল শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। মানুষের অদম্য ইচ্ছা আর কায়িক পরিশ্রমের কাছে প্রকৃতিও হার মানতে বাধ্য হয়েছিল যে দিন সম্পন্ন হয়েছিল এর নির্মাণ কাজ। কী ছিল না সেই শহরে! চাষের জন্য পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ি বানিয়ে ফসল ফলানোর ব্যাবস্থা। উন্নত নিকাশ ব্যাবস্থা, বৃষ্টির জল কে ধরে রেখে তা দিয়ে প্রতিদিনের কাজ চালানো সমেত অন্য কিছু। এ ছাড়াও সূর্য দেব ইনতির জন্য মন্দির, রাজ নিবাস , শস্য সংরক্ষণের ব্যাবস্থা সমেত আধুনিক নগর জীবনের সব উপকরণ।

পাথরের তৈরি এই শহরের প্রধান উদ্দেশ্য নিয়ে মত বিরোধ থাকলেও মনে করা হয় রাজার প্রমোদ নিবাস বা সূর্য দেব ইনতি কে উৎসর্গ করে নির্মিত হয়েছিল এটি। তবে অনেকেই মনে করেন শত্রু আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ও নির্মিত হয়ে থাকতে পারে এই শহর। স্প্যানিশ দের বিবরণ থেকে অদ্ভুত ভাবে বাদ পড়ে গেছে এমন একটি অনুপম স্থাপত্যের প্রসঙ্গ। মনে করা হয় কুঝকোতে ইনকা দের রাজধানীর পতন আর তাদের সাম্রাজ্যের পতনের পরে মাচুপিচুর অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব ছিল না কারন তখন তা রাজ অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। তাই ১৫৭২ খ্রীস্টাব্দে মাচুপিচু পুরোপুরি পরিত্যাক্ত হয়ে লোক চক্ষুর অন্তরালে চলে যায়।

আজও পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সুন্দর শহরের মর্যাদা পেয়ে চলেছে স্বর্গের কাছাকাছি এই শহরটি। এবং ইউনেস্কো একে ওয়াল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদাও দিয়েছে। প্রতি বছর অগণিত পর্যটক হ্যিরাম বিংহ্যাম হাইওয়ে ধরে পৌঁছে যান মাচুপিচুকে দেখতে। যা পেরুর পর্যটনে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

3 comments:

  1. খুবই তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা!
    পড়ে ঋদ্ধ হলাম...

    ReplyDelete
  2. খুবই তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা!
    পড়ে ঋদ্ধ হলাম...

    ReplyDelete
  3. খুবই তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা!
    পড়ে ঋদ্ধ হলাম...

    ReplyDelete