চোদ্দো শাক রহস্য
সে আজ থেকে অন্ততঃ চার দশক আগের কথা। সোঁদরবন অঞ্চলের এক অজ গাঁয়ের ছেলে
আমি। ফলে পোকা-মাকড়, গাছ-গাছালি আর
পাখ-পাখালির সাথে পরিচয় আশৈশব। আমাদের প্রত্যন্ত গ্রামে দুর্গাপুজোর আঁচ পাওয়া যেত
না, কারণ গ্রামের কোথাও দুর্গাপুজো হত না। দুর্গাপ্রতিমা দেখতে গেলে তিন মাইল
হেঁটে তারপর পাঁচ কিলোমিটার ভিড়ে ঠাসা
বাসে চেপে তবেই শহরে যেতে হত। অষ্টমী বা নবমীর দিন যেতাম বাবা-মায়ের সাথে। কিন্তু
এতে যে শারীরিক কষ্ট হত তাতে প্রতিমা দেখার আনন্দ উবে যেত। কালীপুজোর বেলাতেও তাই।
তাই গ্রামের মানুষের কাছে সবচেয়ে আগ্রহের পুজো ছিল লক্ষ্মীপুজো আর দীপাবলি। খুব
ঘটা করে সব বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হ’ত। আমার কাছে স্পেশাল আকর্ষণ ছিল খইয়ের ধান বাছা ও উনুন থেকে সদ্য নামানো
গুড় মাখানো নারকেল কোরা গোল্লা পাকিয়ে নাড়ু বানানো। ঠিক তার পরের আকর্ষণ ছিল
দীপাবলি ও গোয়াল পুজো। দীপাবলি মানেই মাটির প্রদীপ তৈরি করা। তখন বিদ্যুৎহীন
আমাদের গ্রামে দীপাবলিতে বাড়ি বাড়ি প্রদীপ জ্বালানো হত। মোমবাতির
চল ছিল না, কিংবা বলা ভালো মোমবাতি কেনার মতো সামর্থ্য মানুষের
ছিল না। পুকুরপাড় থেকে কাদা তুলে তা ভালো করে
চটকে চটকে বানাতাম প্রদীপ। সেগুলোকে প্রতিদিন দিনের বেলা উঠোনে শুকোতে দিতাম।
কার্পাস তুলো দিয়ে, কিংবা পুরোনো ধুতি ছেঁড়া পাকিয়ে সলতে
বানাতাম। পাশের গ্রামে থাকা একমাত্র ধান ভাঙানো মেশিনের মালিকের কাছ থেকে সংগ্রহ
করতাম পোড়া মোবিল। এজন্য আগে থেকে বুকিং করতে হত। পোড়া মোবিল না পেলে অগত্যা ভরসা
সরষের তেল। কালীপুজোর আগের দিন রাতে টালির চালের উপর, দাওয়ায় আর পুকুরে তক্তা
ভাসিয়ে তার উপর প্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়াতেই ছিল আনন্দ। ঘরের উঠোনে তুলসী মঞ্চের
সামনে জ্বালিয়ে দেওয়া হত গুণে গুণে চোদ্দোটা প্রদীপ। ঠাকুমা বলত, ভূত চতুর্দশীতে
চোদ্দোটা প্রদীপ জ্বালালে ভূতেরা পালায়। ভূত চতুর্দশী হল দীপাবলির দিন, মানে
কালীপুজোর আগের দিন। কখনও কখনও লম্বা বাঁশের আগায় জ্বলন্ত লন্ঠন বেঁধে বাঁশটা
পুঁতে দেওয়া হত। অনেক দূর থেকে দেখা যেত সেই আলো। আলোর চারপাশে ভিড় করত শ্যামাপোকার দল। দীপাবলির পরের দিন, অর্থাৎ কালীপুজোর দিনের ভোরবেলা
গোয়ালঘরে গোরুদের পুজো করা হত। তাদের শিংয়ে হলুদ ও কপালে সিঁদুর মাখানো হত। ঘুমজড়ানো
চোখে খেতাম পুজোর প্রসাদ। আর তার পরেই আখের একটা ডান্ডা ও কুলো নিয়ে ছুটতাম
রাস্তায়। ডান্ডা দিয়ে সপাটে আঘাত করে কুলোয় ঢিপ-ঢিপ বোল তুলতাম আর “ধা রে মশা ধা, নলবনে যা, নলের টোপর মাথায় দিয়ে স্বর্গে উঠে যা” বলতে বলতে শিশিরভেজা ঘাস মাড়িয়ে আলপথ ধরে দৌড়োতাম। পাড়ার শিশু-কিশোরদের সমবেত “ধা রে মশা ধা, নলবনে যা, নলের টোপর মাথায় দিয়ে স্বর্গে উঠে যা” ধ্বনিতে গোটা পাড়া মুখরিত হয়ে উঠত।
তবে দীপাবলির আগের দিনের বিকেলটাও আমার কাছে ছিল অন্যতম এক আকর্ষণীয় দিন।
যখন খুব ছোটো ছিলাম তখন একটা চুবড়ি হাতে নিয়ে দিনের আলো নেভার আগে ঠাকুমার সাথে বেরোতাম শাক তুলতে। দেখতাম ঠাকুমা এখানে-ওখানে ঘুরে
ঘুরে খালের ধার, পুকুর পাড়, আলের ধার কিংবা মাঠ থেকে নানা রকমের শাক তুলত। তোলা হত
বাগানে চাষ করা কিছু শাকও। তবে ঠাকুমা গুণে গুণে দেখত মোট চোদ্দ রকমের শাক হয়েছে
কিনা। যখন ঠাকুমা শাকগুলো তুলত আমিও হাত লাগাতাম। তারপর সেই শাক এনে টালির চালের উপর তুলে রাখা হত। সকাল হলে
দেখতাম রাতের শিশিরে ভিজে শাকগুলো আগের দিনের বিকেলের মতোই তাজা রয়েছে। তারপর মা
সেই শাক রান্না করত। আমাদের বাড়িতে শাকের ভাজাই খাওয়া হত। কেন জানি না, ওই দিনের
শাকের স্বাদ যেন আমার মুখে অন্যদিনের থেকে বেশি ভালো লাগত। একটু বড় হবার পর আমি
একাই চোদ্দো শাক তুলতে যেতাম। ততদিনে চিনেও গিয়েছিলাম শাকেদের নাম-ধাম। স্নাতক
স্তরে পড়তে যাওয়ার কারণে শহরমুখী হবার আগে পর্যন্ত আমিই বরাবর তুলতাম চোদ্দো শাক।
ঠাকুমা বলত, ভুত চতুর্দশীতে চোদ্দো প্রদীপ জ্বালানোর সাথে সাথে চোদ্দো শাক খাওয়াও
নিয়ম। “কেন নিয়ম” তার উত্তর তখন ঠাকুমার কাছে পাইনি। আজও যে সঠিকভাবে পেয়েছি তা বলতে পারি না। কেবল অনুমান করতে পারি মাত্র।
ঠাকুমা গত হয়েছেন প্রায় ২৭ বছর। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে নানা সামাজিক
পরিবর্তনের সাথে আমারও মানসিক নানা পরিবর্তন ঘটেছে। হয়েছি শহরবাসী। দীপাবলিতে
চোদ্দোশাক খাওয়ার কথা আর মনেই থাকে না। চোদ্দোশাক তোলার সেই সুখকর কৈশোর স্মৃতির
পাতায় জমেছে ধুলো। এমন সময় আমার অগ্রজপ্রতিম অমিতাভদার কাছ থেকে পেলাম অনুরোধ
– পরের সংখ্যায় চোদ্দো শাক নিয়ে লেখ। আমার কেমন যেন সন্দেহ
হচ্ছিল, পারব তো? অমিতাভদার আশ্বাস – তুই-ই পারবি। ব্যস, লেগে গেলুম স্মৃতির পাতার
উপর থেকে ধুলো পরিষ্কার করতে। ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলুম নানা বই ও জাল ফেললুম
আন্তর্জালে। যা যা পেলুম, তা নিয়েই নেমে পড়লুম মাঠে।
বিশেষ কিছু রোগের ক্ষেত্র ছাড়া শাক যে দুনিয়ার সব প্রান্তের
পুষ্টিবিজ্ঞানীদের কাছে খাদ্যতালিকার আদরণীয় ও আবশ্যক আইটেম তা আমরা অনেকেই জানি।
আর বাঙালির পাতে শাকের গুরুত্ব চিরকালীন। সুখী দাম্পত্য জীবনের রহস্যের কথা
প্রসঙ্গে প্রাকৃত ভাষায় বাংলার অন্যতম প্রাচীন রচনা ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’-এ শাকের উল্লেখ রয়েছে। বলা হয়েছে -
ওগগর ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক
ঘিত্তা দুগ্ধ সংযুক্তা।
মোইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা দিজ্জই
কান্তা খা পুণবন্তা।
অর্থাৎ
কোনও স্ত্রীলোকের পরিবেশন করা কলাপাতায় গাওয়া ঘি দিয়ে গরম ভাত সাথে দুধ, মৌরলা মাছ আর নলচে শাক যিনি খান তিনি পুণ্যবান। নীহাররঞ্জন
রায়ের লেখা “বাঙালীর ইতিহাস” গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে যে
প্রাচীনকালে গ্রামের গরিব বাঙালির অন্যতম প্রধান খাবার ছিল শাক-সব্জি। ষোড়শ শতকের
চৈতন্যকাব্যগুলিতেও বাঙালির খাবার হিসেবে শাকের উল্লেখ রয়েছে। শ্রীচৈতন্যদেব নিজেই
নানা ধরণের শাক পছন্দ করতেন। তবে কালীপুজোর আগের দিন অর্থাৎ ভূত চতুর্দশীর দিন
চোদ্দো শাক খাওয়ার রীতি কবে থেকে চালু হল বা কেন চালু হল তার সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই।
কারও মতে শস্যদায়িনী দেবী শাকম্বরী অর্থাৎ দুর্গার আরাধনার পরেই আসে কালীপুজো। তাই
দুগ্গামায়ের সাথে যেমন নবপত্রিকার গাঁটছড়া বেঁধে দেওয়া হয়েছে তেমনই কালীমায়ের
সাথে চোদ্দো শাকের গাঁটছড়া বাঁধা হয়েছে। আবার সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, শরৎ থেকে শীত
ঋতুতে পদার্পণের সময় ঋতু পরিবর্তনজনিত নানা রোগ হয়। তাই ভেষজগুণসম্পন্ন চোদ্দ শাক
খেয়ে সেইসব রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি হয়েছে এই রীতি। আমার মনে হয় এই
যুক্তিটা অনেক বেশি গ্রহণীয়।
যদিও আমরা ছোটোবেলায় যে চোদ্দো শাক সংগ্রহ করতাম বা এখন বাজারে যে চোদ্দো
শাকের আঁটি ভূত চতুর্দশীর দিন বিক্রি হতে দেখি তার সাথে প্রচলিত চোদ্দো শাকের খুব
একটা মিল নেই, কারণ সব জায়গায় সব শাক পাওয়া যায় না। তাই বাঙালি চোদ্দো শাকের
ব্যাপারে কিছুটা শিথিলতা দেখিয়েছে। ভুত চতুর্দশীতে প্রচলিত চোদ্দো শাক খাওয়ার কথা
পাওয়া যায় ষোড়শ শতাব্দীর স্মৃতিশাস্ত্রকার
রঘুনন্দনের লেখা “কৃত্যতত্ব” গ্রন্থে যেখানে তিনি প্রাচীন স্মৃতির গ্রন্থ “নির্ণয়ামৃত”-এর অভিমত অণুসরণ করেছেন। শ্লোকটি
হল –
"ওলং কেমুকবাস্তূকং, সার্ষপং
নিম্বং জয়াং।
শালিঞ্চীং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শেলুকং গুড়ূচীন্তথা।
ভণ্টাকীং সুনিষন্নকং শিবদিনে খাদন্তি যে মানবাঃ,
প্রেতত্বং ন চ যান্তি কার্ত্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে তিথৌ।"
শালিঞ্চীং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শেলুকং গুড়ূচীন্তথা।
ভণ্টাকীং সুনিষন্নকং শিবদিনে খাদন্তি যে মানবাঃ,
প্রেতত্বং ন চ যান্তি কার্ত্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে তিথৌ।"
অর্থাৎ চোদ্দো শাক
হল ওল, কেঁউ, বেথো, কালকাসুন্দা, সরষে, নিম, জয়ন্তি, শালিঞ্চা, হিংচে, পলতা,
শুলকা, গুলঞ্চ, ঘেঁটু ও শুষনি। এই সব শাক শুভদিনে যে মানুষ খায় কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথির ভূত
চতুর্দশীতে তার কাছে প্রেত ঘেঁষতে পারে না। এখানে প্রেত বলতে যদি
রোগজীবানুদের বোঝানো হয় তবে তা যথার্থই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ ভূত আর জীবানু
উভয়কেই তো চোখে দেখা যায় না! সুতরাং দেখে নেওয়া যাক, এই চোদ্দো শাকের ভেষজ গুণ –
ওলঃ বিজ্ঞানসম্মত নামঃ Amorphophalluscampanulatus
সাধারণ বিবরণঃ ওল
গাছ প্রায় সবাই চেনে। সমগ্র ক্রান্তীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ কন্দজাতীয় সবজি হিসাবে
ওল সবার প্রিয়। মাটির নিচে থাকা কন্দ থেকেই পাতা জন্মায় পরের বছর। পাতা হয়
একটাই। পাতার বৃন্ত বেশ মোটা হয় ও মাটি ভেদ করে ওঠে বলে কান্ড বলে ভ্রম হয়। একটাই
মাত্র পত্রফলক হয় বৃন্তের আগায়। ওলের মেরুন রঙের বেশ বড়ো একটা পুষ্পমঞ্জরী মাটি
ভেদ করে উঠে আসে। ওলের কন্দে ক্যালসিয়াম অক্সালেটের কেলাস বেশি থাকলে খাওয়ার সময়
গলা চুলকোয়।
ভোজ্য অংশঃ কচি
পাতা, পাতার বৃন্ত এবং কন্দ।
ভেষজ গুণাবলীঃ ওলের
শুকনো কন্দের গুঁড়ো অর্শ, হাঁপানি, টিউমার, প্লিহার বৃদ্ধি ও রক্ত আমাশার ঔষধ
হিসেবে প্রাচীনকাল থেকে ভারতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। টাটকা মূল ব্যবহৃত হয় কফনাশক ও
বাতের চিকিৎসায়। কাঁকড়া বিছার কামড়ে পত্রবৃন্তের রস ব্যবহৃত হয়।
কেঁউঃ বিজ্ঞানসম্মত নামঃ Costusspeciosus
সাধারণ বিবরণঃ কেঁউ
হল আদার এক জাতভাই। এ হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উদ্ভিদ। ভারতে রাস্তার
ধারে, পতিত জমিতে বা অরণ্যের নিচু জায়গায় কেঁউ যথেষ্ট দেখা যায়। মাটির নিচে এর কন্দ জন্মায়।
তবে পাখিরা এর বীজসহ ফল খেয়ে দূরে মল ত্যাগ করলে মলের সাথে বেরনো বীজ থেকে চারাগাছ
জন্মায়। এভাবে কেঁউ দূরে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফুলের রঙ সাদা আর ফলের রঙ লাল। বীজের রঙ
কালো। ফুলসহ পুরো পুষ্পমঞ্জরী দেখতে খুব সুন্দর হয় বলে অনেকে একে বাগানে লাগায়।
তবে অসাধারণ ভেষজগুণের জন্য এই উদ্ভিদটি প্রাচীনকাল থেকে ভারতে সমাদৃত।
ভোজ্য অংশঃ নরম
পাতা
ভেষজ গুণাবলীঃ কেঁউ
পাতার রস ভালো হজমকারক ও ক্ষুধাবর্ধক। জ্বর, আমাশা, ডায়েরিয়া, কফ,
কাটা-ছেঁড়া, ক্ষত, চর্মরোগ, জন্ডিস, আরথ্রাইটিস, কোষ্ঠকাঠিন্য, কুষ্ঠ, হাঁপানি,
ব্রঙ্কাইটিস, রক্তাল্পতা, কৃমি, চুলকানি, বমিভাব ইত্যাদি রোগের ঔষধ ও সাপে কাটার
প্রতিষেধক হিসেবে কেঁউ পাতার নির্যাস প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় সমাজে ব্যবহৃত হয়ে
আসছে।
বেথুয়াঃ বিজ্ঞানসম্মত নামঃ Chenopodium album
সাধারণ বিবরণঃ গ্রাম
বাংলার খুব পরিচিত শাক হল বেথুয়া বা বেথো। মাঠে-বাগানে আপনা-আপনি জন্মায় আগাছার
মতো, কেউ চাষ করে না। বাজারে আঁটি বেঁধে বিক্রি হতে দেখা যায়। ২/৩ ফুট লম্বা বীরুৎ
জাতীয় গাছ। পাতার রঙ ফ্যাকাশে সবুজ। কান্ডে উঁচু শিরা আর বেগুনি রেখা দেখা যায়। লম্বাটে
পাতার ওপরে বেশি মোম থাকায় জল ধরে না, আর পাতার নিচে সাদাটে পাউডারের মতো আস্তরণ
থাকে। বেথুয়া শাকে প্রচুর ভিটামিন–এ, ভিটামিন–সি, লোহা, ক্যালসিয়াম,
ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস ও জিঙ্ক এবং গুরুত্বপূর্ণ ৮ টি
অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে।
ভোজ্য অংশঃ ছোটো
গাছের পুরো বিটপ অংশ, আর বড়ো গাছের পাতাসহ ডগা।
ভেষজ গুণাবলীঃ কোষ্ঠবদ্ধতা,
রক্তাল্পতা, অম্বল, কৃমি, বৃক্ক-পাথুরি, মুখে ঘা, পায়েরিয়া, ত্বকের রোগ, বাত ও
অর্শ প্রতিরোধে বেথুয়া শাক খুব উপকারী। গর্ভরোধক হিসেবে এর ব্যবহার রয়েছে।
কালকাসুন্দাঃ বিজ্ঞানসম্মত নামঃ Senna sophera
সাধারণ বিবরণঃ আদতে
ক্রান্তীয় আমেরিকার এই গুল্ম জাতীয় গাছটি এখন সারা ভারতে রাস্তার দু’ধারে, পতিত জমিতে, জঙ্গলে সর্বত্র দেখা যায়। উচ্চতা হয় প্রায় ৩ মিটার। পাতা যৌগিক প্রকৃতির এবং প্রতি পাতা ৮-১২ জোড়া
পত্রক নিয়ে গঠিত। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে সুদৃশ্য হলুদ রঙের বেশ বড়ো বড়ো ফুলের
মঞ্জরী হয়। শুঁটিও হয় বেশ লম্বা।
ভোজ্য অংশঃ নরম
পাতা ও কাঁচা শুঁটি।
ভেষজ গুণাবলীঃ অ্যালার্জি,
কোষ্ঠবদ্ধতা, হুপিং কাশি, কফ, জ্বর, বেতো জ্বর, ম্যালেরিয়া, কঞ্জাংকটিভাইটিস ও
ক্ষত নিরাময়ে কালকাসুন্দার পাতার রস খাওয়া হয়। মৃগি রোগীদের চিকিৎসায় গোটা
উদ্ভিদের রস ব্যবহার হয়। রজঃস্রাবের সময় যন্ত্রণা হলে মূলের ক্বাথ কাজ
দেয়। আবার ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় কালকাসুন্দার বাকল ভেজানো জল খেলে উপকার হয়।
নিমঃ বিজ্ঞানসম্মত
নামঃ Azadirachtaindica
সাধারণ বিবরণঃ
নিমের উৎপত্তি হল ভারতীয় উপমহাদেশ। এই বহুবর্ষজীবী বৃক্ষটিকে আমরা সবাই চিনি। এর
নরম পাতা অনেকেই সকালবেলা চিবিয়ে খান। খুব তেতো স্বাদ। কচি নিম পাতা দিয়ে বেগুন
ভাজা বা নিমের ফুল ভাজা খেতে আমরা অনেকেই খুব ভালোবাসি। নিম কাঠে ঘুন ধরে না বা
উইপোকা লাগে না। নিমগাছের সব অংশই ভেষজ গুণ সম্পন্ন। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
নিমকে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ নামে অভিহিত করেছেন।
ভোজ্য অংশঃ কচি
পাতা ও ফুল।
ভেষজ গুণাবলীঃ নিম
পাতা বা পাতার রস কুষ্ঠ, চর্মরোগ, বহুমুত্র, জন্ডিস, একজিমার ভালো ঔষধ।
ব্লাড সুগারের রোগীরা প্রতিদিন সকালে ১০-১২টা করে নিমপাতা চিবিয়ে খেলে সুগার কমে। পোকামাকড়ের
কামড়ে মূলের ছাল বা পাতা বেটে লাগালে উপকার হয়। পাতা বাটা মাথায় মাখলে উকুন মরে। মূলের
গুঁড়ো জলে মিশিয়ে খাওয়ালে বাচ্চাদের কৃমি নাশ হয়। নিম তেলের শুক্রানুনাশক ক্ষমতা
থাকায় এটি জন্মনিয়ন্ত্রক হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। নিমের ছাল ভিজিয়ে জল খেলে
অজীর্ণ রোগ সারে।
সরষেঃ বিজ্ঞানসম্মত নামঃ Brassica juncea
সাধারণ বিবরণঃ সরষের
আদি নিবাস ইউরেশিয়া অঞ্চল হলেও প্রায় গোটা ভারতে বহুদিন ধরেই রবি শস্য হিসেবে এর
চাষ হয়ে আসছে। যখন সরষে গাছে ফুল আসে তখন পুরো ক্ষেত হলুদ রঙে রেঙে ওঠে আর
মৌমাছিদের গুঞ্জরণে মেতে ওঠে। ফুল থেকে জন্মায় সুন্দর ছোটো ছোটো শুঁটি। শুঁটির ভেতরে থাকে হালকা হলুদ বা বাদামি রঙের বীজ। বীজ থেকে প্রাপ্ত
তেল ভারতে রান্নার কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হলেও এর শাকের জনপ্রিয়তাও কম নয়। গ্রিন
স্যালাড হিসেবেও সরষে শাক কাঁচা খাওয়া হয়। আর মশলা হিসেবে সরষের ব্যবহার তো সারা
ভারতেই প্রচলিত।
ভোজ্য অংশঃ পাতা ও
পাতাসহ কচি কান্ড এবং বীজ।
ভেষজ গুণাবলীঃ ত্বক,
যকৃৎ ও চোখের পক্ষে সরষে শাক খুব উপকারি। ভিটামিন K, C ও E এবং ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও
লোহার সমৃদ্ধ উৎস হল এই শাক। এই শাক খেলে ক্যানসার, হৃদরোগ ও অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস
হবার সম্ভাবনা কমে। এছাড়া আর্থ্রাইটিস, অস্টিওপোরোসিস ও রক্তাল্পতা রোগের নিরাময়ে
সরষে শাক যথেষ্ট উপকারি।
শালিঞ্চাঃ বিজ্ঞানসম্মত নামঃ Alternantherasessilis
সাধারণ বিবরণঃ
অনেকে এই শাককে সাঁচিশাকও বলে। ভারতে যে কোনও জলাশয়ের ধারে এই বীরুৎ
জাতীয় লতানে উদ্ভিদটিকে দেখা যাবে। রাস্তার ধার বা নিচু জমিতে সামান্য
আর্দ্রতা থাকলেই সেখানে শালিঞ্চা জন্মায়। সাধারণ মানুষ একে আগাছা বলেই মনে করে।
ইংরেজিতে এর নাম Joyweed। প্রতি পর্ব থেকে
মূল জন্মায়। পাতার কক্ষ থেকে সাদা রঙের বৃন্তহীন ক্ষুদে ক্ষুদে ফুল জন্মায়।
ভোজ্য অংশঃ পাতাসহ
ডগা।
ভেষজ গুণাবলীঃ চোখ,
চুল ও ত্বকের জন্য শালিঞ্চা শাক খুব উপকারী। ডায়েরিয়া, অজীর্ন, হাঁপানি, কফ, জ্বর,
রাতকানা, খোসপাঁচড়া, একজিমা, অর্শ ও অন্ত্রে ঘায়ের চিকিৎসায় এই শাক খেলে উপকার হয়।
এই শাক খেলে মায়ের স্তনদুগ্ধের পরিমাণ বাড়ে। প্রতিদিন ৭৫ গ্রাম
করে শালিঞ্চা শাক খেলে ডায়াবেটিস রোগীর রক্তে সুগারের পরিমাণ
কমে। চোখে জল পড়া, কনজাংক্টিভাইটিস, মায়োপিয়া ও ছানির চিকিৎসায় মূলের রস ব্যবহৃত
হয়। গোরুর দুধের সাথে শালিঞ্চা পাতার রস মিশিয়ে খেলে শরীরে শক্তি ও জীবনীশক্তি
বাড়ে। কাঁটা বা হুল বিঁধলে ক্ষতস্থানে শালিঞ্চা পাতা বেটে লাগালে কাজ দেয়।
জয়ন্তীঃ বিজ্ঞানসম্মত নামঃ Sesbaniasesban
সাধারণ বিবরণঃ সংস্কৃতে ‘জয়ন্তিকা’ শব্দ থেকে জয়ন্তী নামের উদ্ভব। নোনা
মাটি, ক্ষার মাটি, জলমগ্ন মাটি, অনাবৃষ্টিতে খটখটে শুকনো মাটি – সব মাটিতেই জয়ন্তী মানিয়ে নেয়। জয়ন্তী গাছ হল শিম পরিবারের
শাখা-প্রশাখাযুক্ত উদ্ভিদ। এরা ৩-৮ মিটার লম্বা হয়। প্রতি থোকায় ২-২০টি হলুদ রঙের
ফুল জন্মায়। প্রতি শুঁটিতে ১০-৫০টি বীজ থাকে।
ভোজ্য অংশঃ কচি সবুজ টাটকা পাতা।
ভেষজ গুণাবলীঃ উদরাময়, বহুমূত্র, শ্বেতি, মৃগী, মানসিক
সমস্যা, জ্বর, ফুসফুসের যক্ষ্মা, কিডনির সংক্রমণ, গনোরিয়া ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায়
ও কৃমিনাশকের কাজ করে। সদ্য প্রসূতিদের জন্য এই শাক খুব উপকারি। মেধা ও
স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও জয়ন্তী পাতার রস খাওয়ানো হয়।
গুলঞ্চঃ বিজ্ঞানসম্মত
নামঃ Tinosporacordifolia
সাধারণ বিবরণঃ গুলঞ্চের
আদি নিবাস ভারত। এটি বেশ বড়োসড়ো গুল্মজাতীয় লতানে পর্ণমোচী উদ্ভিদ। এর ধূসর রঙের
বাকল পাতলা কাগজের মতো। হৃৎপিন্ড আকৃতির পাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়। গাছের সব পাতা
যখন ঝরে যায় তখন ফুল আসে। ফুল একলিঙ্গ, তবে ভিন্ন ভিন্ন গাছে স্ত্রী ও পুরুষ ফুল
ফোটে, অর্থাৎ ভিন্নবাসী। ছোটো ছোটো ফুলের রঙ হলদে-সবুজ। ১-৩টি লাল রঙের মটরের মতো
ফল হয়। ভারতের পর্ণমোচী অরণ্যে এই লতা দেখা যায়। গুলঞ্চ বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় ও
সংরক্ষিত উদ্ভিদ।
ভোজ্য অংশঃ পাতা।
ভেষজ গুণাবলীঃ গুলঞ্চকে
স্বর্গীয় উদ্ভিদ বলে গণ্য করা হয় এর ভেষজ গুণের জন্য। ডায়াবেটিস, উচ্চ কোলেস্টেরল,
অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, পাকস্থলীর গোলমাল, লিম্ফোমা সহ অন্যান্য ক্যানসার, কুষ্ঠ,
যক্ষ্মা, কোষ্ঠকাঠিন্য, বাত, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, হেপাটাইটিস, পেপটিক আলসার,
গনোরিয়া, সিফিলিস, শোথ, জ্বর ইত্যদি নানা রোগের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় গুলঞ্চ
ব্যবহৃত হয়। গুলঞ্চ শাক খেলে অনাক্রম্যতন্ত্র উজ্জীবিত হয়। গুলঞ্চের রস নিয়মিত
খেলে আয়ু বাড়ে, যৌবন দীর্ঘস্থায়ী হয়, সুস্বাস্থ্য হয়, ত্বকের রঙ উজ্জ্বল হয়, ক্ষুধা
বাড়ে ও বন্ধ্যাত্ব দূর হয়। গুলঞ্চ খেলে বৃক্কে পাথর জমার সম্ভাবনা থাকে না এবং রক্তে
ইউরিয়ার মাত্রা সঠিক থাকে।
পলতা বা পটল পাতাঃ বিজ্ঞানসম্মত নামঃ Trichosanthesdioica
সাধারণ বিবরণঃ পটল
লতা সবাই না দেখলেও পটল খায়নি এমন মানুষ নেই। সবজি হিসেবে পটল যতটা জনপ্রিয় শাক
হিসেবে পটল পাতা বা পলতা ততটাই অপরিচিত। পটল হল সহবাসী, একলিঙ্গ লতানে উদ্ভিদ। এর পাতার আকার হৃৎপিন্ডের মতো। ভারতে পুরো গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎকাল জুড়ে
পটলই অন্যতম প্রধান সবজি।
ভোজ্য অংশঃ পাতা ও
ফল।
ভেষজ গুণাবলীঃ
শ্বাসতন্ত্রঘটিত যে কোনও রোগ সারাতে পটল পাতা উপকারি। রক্তবর্ধক ও রক্তশোধক হিসেবে
এবং লিভার ও চর্ম রোগ সারাতে পটল পাতা খুব কার্যকর। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত
ব্যক্তিদের রক্তে শর্করার পরিমাণ কমাতে এবং রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে পটল
পাতার কার্যকরী ভূমিকা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন। পটল পাতা নিয়মিত খেলে
কোষ্ঠকাঠিন্য ও মানসিক অস্থিরতা দূর হয়। পটল পাতা ক্ষিদে ও হজমশক্তি বাড়ায়। জন্ডিস,
কফ, জ্বর, পিত্তজ্বর, টাইফয়েড, অর্শ, কৃমি, ডায়েরিয়া ইত্যাদি রোগে পটল পাতা খেলে
কাজ দেয়। ক্ষতস্থানে পটল পাতার রস লাগালে তাড়াতাড়ি সারে।
ভাঁট বা ঘেঁটুঃ বিজ্ঞানসম্মত নামঃ Clerodendruminfortunatum
সাধারণ বিবরণঃ ঘেঁটু
হল অসাধারণ ভেষজগুণসম্পন্ন বহুবর্ষজীবী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। প্রায় শাখাহীন গাছ। বড়ো
বড়ো ডিম্বাকার পাতা। কান্ড ফাঁপা। কান্ডের আগায় অসংখ্য হালকা বেগুনি বা গোলাপি ছিট যুক্ত সাদা ফুল সমন্বিত
পুষ্পমঞ্জরী জন্মায়। পাকা ফলের রঙ কালো।
ভোজ্য অংশঃ পাতা।
ভেষজ গুণাবলীঃ ঘেঁটুতে
প্রচুর ফ্ল্যাভোনয়েড থাকায় এটি ক্যানসার প্রতিরোধে সক্ষম। এছাড়া চুল পড়া, হাঁপানি,
কফ, বাত, জ্বর, চর্মরোগ, লিভারের রোগ, মাথার যন্ত্রণা, কৃমি, কোলেস্টেরল, ব্লাড
সুগার, উদরাময় ইত্যদি রোগ প্রতিরোধে ঘেঁটু পাতা খুব কার্যকর। ঘেঁটু পাতা
বেটে ঘা বা ফোলা জায়গার ওপর লাগালে তাড়াতাড়ি সারে।
হেলেঞ্চা বা হিংচেঃ বিজ্ঞানসম্মত নামঃ Enhydrafluctuans
সাধারণ বিবরণঃ
হিংচের চপের দৌলতে এই শাকটিকে অনেকেই চেনে। হেলেঞ্চা বা হিংচে হল জলজ লতানে
গাছ। এর মূল জলাশয়ের পাড়ে কাদা-মাটির মধ্যে থাকে, আর আগা ছড়িয়ে পড়ে জলে বা কাদা
মাটির উপর। কান্ডের পর্ব থেকে মূল জন্মায়। কান্ড ফাঁপা। পাতা লম্বা ও কিনারা
খাঁজবিশিষ্ট। শীতকালে কান্ডের আগায় গুচ্ছাকারে সাদা রঙের ফুল ফোটে।
ভোজ্য অংশঃ পাতাসহ
ডগা।
ভেষজ গুণাবলীঃ আয়ুর্বেদে
হেলেঞ্চাকে রক্তশোধক, পিত্তনাশক, ক্ষুধাবর্ধক, ব্যথানাশক, জীবানুনাশক ও জ্বরনাশক
হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই শাক নিয়মিত খেলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ে। কোষ্ঠকাঠিন্য,
হাঁপানি, ডায়েরিয়া ও স্নায়ুরোগের ভেষজ চিকিৎসায় হেলেঞ্চা ব্যবহৃত হয়। দীর্ঘ
জ্বরভোগের পর হেলেঞ্চা শাক দিয়ে মাছের ঝোল খেলে ক্ষুধা বাড়ে ও মুখে রুচি ফেরে। হেলেঞ্চা
শাকে যথেষ্ট অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট থাকায় এর ক্যানসার প্রতিরোধী ভূমিকা
রয়েছে। মাথার যন্ত্রণায় মাথায় এই শাক বেটে লাগালে যন্ত্রণা কমে। হেলেঞ্চা শাক
নিয়মিত খেলে ব্লাড সুগার কমে।
শুষনিঃ বিজ্ঞানসম্মত নামঃ Marsileaquadrifolia / Marsileaminuta
সাধারণ বিবরণঃ
শুষনি হল জলজ ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ। ভারতসহ দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়া, চিন, মধ্য ও দক্ষিণ
ইউরোপে শাক ও ভেষজ উদ্ভিদ হিসেবে শুষনি খুব পরিচিত। নরম কান্ডের এই লতানে উদ্ভিদটি
জলাশয়ের পাড়ে বা ভেজা জায়গায় জন্মায়। পাতা যৌগিক প্রকৃতির। পত্রবৃন্তের আগায় একটা
বিন্দু থেকে চারদিকে চারটি সম আকৃতির পত্রক জন্মায়। এ জন্যই বিজ্ঞানসম্মত নামে ‘quadrifolia’ শব্দটি রয়েছে। সমস্ত ফার্নের মতো এদেরও ফুল বা ফল হয় না।
রেনুর মাধ্যমে বা অঙ্গজ পদ্ধতিতে এরা বংশবিস্তার করে। এদের গাঢ় বাদামি রঙের
স্পোরোকার্প উৎপন্ন হয় যার মধ্যে রেনু থাকে।
ভোজ্য অংশঃ পাতা।
ভেষজ গুণাবলীঃ জনশ্রুতি
রয়েছে যে শুষনি শাক খেলে ঘুম পায়। তাই নিদ্রাহীনতায় যাঁরা ভোগেন তাঁদের নিয়মিত
শুষনি শাক খেলে কাজ দেয়। এ ছাড়া নিয়মিত শুষনি শাক খেলে মাথার যন্ত্রণা,
তীব্র মানসিক চাপ, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, গায়ে ব্যথা, পায়ের
পেশির অনিয়ন্ত্রিত সংকোচন, বাত, জিভে ও মুখে ক্ষত, চর্মরোগ ইত্যদি দূর হয়। শুষনির কাশি ও কফ নিরাময়কারী ভূমিকা বিজ্ঞানীদের দ্বারা প্রমাণিত। চোখের
রোগ, ডায়াবেটিস ও ডায়েরিয়া নিরাময়ে শুষনি পাতার রস কার্যকর। সন্তান প্রসবের পর মায়েরা শুষনি শাক খেলে দুগ্ধক্ষরণ বাড়ে। সাপের কামড়ে
শুষনি পাতার রস দিয়ে চিকিৎসা করার প্রচলিত রীতি রয়েছে।
শেলুকা বা শুলফাঃ বিজ্ঞানসম্মত নামঃ Peucedanumgraveolens / Anethumsowa
সাধারণ বিবরণঃ মশলা
উৎপাদক উদ্ভিদ হিসেবে শুলফার খ্যাতি। কাঁচা গাছ ও বীজ মশলা হিসেবে রান্নায় ব্যবহৃত
হয়। আর শাক হিসেবে ব্যবহৃত হয় পাতাসহ ডগা। ইংরেজিতে এর নাম Indian Dill আর হিন্দিতে সোয়া। মধ্য এশিয়ায় আদি
বাসভূমি হলেও এখন এর বিস্তার পুরো ইউরোপ ও এশিয়ায়। মুলতঃ ঠান্ডা এলাকায় জন্মায়। প্রায়
৯০ সেমি লম্বা একবর্ষজীবী বীরুৎজাতীয় এই উদ্ভিদের কান্ড খাড়া হলেও বেশ
নরম এবং ফাঁপা। পাতা বহু খন্ডে খন্ডিত, মৌরি পাতার মতো। কান্ডের আগায় এক জায়গা থেকে অনেক শাখা বেরোয় আর তাতে
ছাতার মতো বিন্যাসে পুষ্পমঞ্জরী উৎপন্ন হয়। পুষ্পমঞ্জরীতে অসংখ্য ফুল থাকে। এজন্য
সংস্কৃতে শুলফাকে বলে শতপুষ্প। ফুলের রঙ উজ্জ্বল হলুদ। পুরো গাছটারই
একটা তীব্র সুগন্ধ আছে। বীজ সুমিষ্ট গন্ধযুক্ত ও স্বাদে তেতো।
ভোজ্য অংশঃ পাতাসহ
ডগা এবং বীজ।
ভেষজ গুণাবলীঃ মাতৃদুগ্ধের
পরিমাণ বাড়াতে ও বাচ্চাদের পেটের রোগ সারাতে শুলফা শাক খুব উপকারী। বাচ্চাদের
গ্রাইপ ওয়াটারের একটা উপাদান এই শুলফা শাক থেকে আসে। চোখের রোগ, চোখে
ঘা, পুরানো ক্ষত, জ্বর, স্নায়ু রোগ, জরায়ুর ফাইব্রয়েড ইত্যদি রোগের নিরাময়ে শুলফা
খুবই কার্যকর। বাচ্চাদের পেটফাঁপায় শুলফা বীজ জলে ভিজিয়ে সেই জল খেলে দারুণ কাজ
দেয়। শুলফা বীজ থেকে প্রাপ্ত তেল সায়াটিকা বাত, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস,
স্পন্ডাইলোসিস, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, কফ ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
আগেই বলেছি যে এই চোদ্দো শাকের সবগুলো আজকাল সব জায়গায় পাওয়া যায় না। তাই
বাঙালি ভূত চতুর্দশীতে চোদ্দো শাক খাওয়ার রীতি বজায় রাখতে গিয়ে শাকের তালিকাকে
অনেকটা পরিবর্তন করে ফেলেছে। এখন শহুরে এলাকায় যে চোদ্দো শাক বেশি প্রচলিত সেগুলো
এই সব শাকের মধ্যে থেকেই নির্বাচিত – পালং, মুলো, লাল শাক, কলমি, শুষনি,
সরষে, পাট, নটে, ধনে, মেথি, পুঁই, লাউ, কুমড়ো, হিংচে ও গিমে। অবশ্য গ্রামের দিকে
চোদ্দো শাকের তালিকায় পুনর্ণবা, কুলেখাড়া, বন নটে, কাঁটা নটে, তেলাকুচো, চিকনি, থানকুনি, শতমূলি, আমরুল, নুনিয়া ইত্যদিও সংযুক্ত হয়েছে। বলাবাহুল্য এইসব
শাকের ভেষজ ও পুষ্টিগত গুণও অসাধারণ।
স্থানভেদে ও শাকভেদে নানা শাকের রেসিপি নানারকম। তবে বেশিরভাগ বাঙালি এই সব
শাকের ভাজা বা চচ্চড়ি খেতে পছন্দ করে। শাকের পুরোনো ও পরিমার্জিত তালিকা লক্ষ্য
করলে দেখা যাবে যে পুরোনো তালিকার বেশিরভাগ শাকই ছিল প্রকৃতির স্বাভাবিক শাক। নয়া
তালিকার অনেক শাকও স্বাভাবিক শাক। এদের আমরা চাষ করি না। এগুলো
মাঠে-ঘাটে আপনা-আপনি জন্মায়। এই শাকে না আছে কোনও কীটনাশক, না আছে কোনও রাসায়নিক
সার। ফলে এই সব শাকের পুষ্টিগুণ অসাধারণ। পালং, নটে, মুলো, পুঁই ইত্যদি
শাক চাষে ব্যাপক কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। তাই আমরা যদি মাঠে-ঘাটে
জন্মানো শাকগুলি বেশি বেশি খেতে পারি তবে আমাদের স্বাস্থ্য রক্ষা করা অনেক সহজ
হবে। এ জন্য এইসব দেশিয় শাকগুলোকে চিনতে হবে। মোবাইল আর ল্যাপটপের দুনিয়ায় সারাদিন
ঘোরাঘুরি করলে তো আর এই সব শাক চেনা সম্ভব নয়। পাশাপাশি জানতে হবে এই সব শাক
রান্নার পদ্ধতিও। যাঁরা রেসিপি জানতেন, সেই সব মা-ঠাকুমা-দিদিমারা আজ অনেকেই বেঁচে
নেই। বর্তমান প্রজন্ম ফাস্টফুড নির্ভর। শাক-সবজি সেখানে ব্রাত্য। সুস্থভাবে বাঁচতে
গেলে আমাদের বছরের ৩৬৫ দিনকেই করে নিতে হবে ভূত চতুর্দশীর দিন। প্রাকৃতিক শাক-সবজি
ছাড়া এই বিষ-জর্জরিত দুনিয়ায় বাঁচা খুব মুশকিল।
_____
চমৎকার লিখেছেন। সত্যি ঠাকুরমার কথা মনে করিয়ে দিলেন। তিনি খেত-খামার খুঁজে শাক আর নানারকম ছাতি সংগ্রহ করে আনতেন, আজ আমরা না জেনে সে কাজ করতে গেলে হয়ত বিষক্রিয়ার মরব। অজ্ঞানতার জন্যে আমরা যে কত ভাল জিনিষের থেকে বঞ্চিত হচ্ছি!
ReplyDeleteasadharan...........eta amar janar khub ichchha chhilo........onek onek dhonyobad
ReplyDeleteচমৎকার
ReplyDeleteKhub sundar
ReplyDeleteAmrao tulechi .shak ..vorbela uthe dal bendhe.(.gramer mato chill takhan ..Birati ..pratapgarh ..)..pratyeker baritei ..sabji fuler ..Bagan chilo ..amader to aam jam peyara jamrul kala ..tar sathe 8ta lichu gach chilo ..jaihok amra bacchara sab bari bari giye ..jar jar bari te ja ja sabji ba shak tultam ..tarpar ma ..segulo theke 14 ta kore shak beche..beche ..ak akta anti kore bendhe diten ...amra abar see gulo pratyeker baritei te diye astam ..utsaber Moto ..like valo laga anonda chilo ...anuvaber ..az ta bodhogamyer baire ..ma anekdin chale gachen ..Ami anekdin pratha ta korechi ..akhon bazare je anthi bendhe choddo shak bole bikri hay ..Tate sab thakeona ..amio akhon chinte parina ..Amar barite tabe thankuni jatio gach rekhe diyechi .
ReplyDeleteKhub valo laglo ..apnar lekhar bishoyti ..dhanyobad ..vaia ..
Lekhata Osadaron laglo
ReplyDeleteযেমন তথ্যসমৃদ্ধ তেমন সমৃদ্ধ লেখন শৈলী
ReplyDeleteDarun.... amader kusongoskar gulor modhey o vigyan ache.
ReplyDeleteAsadharon
ReplyDeleteSatti darun...
ReplyDeleteপাঠকের মতামত লেখককে সমৃদ্ধ করে। আমি সব পাঠকের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।
ReplyDeleteচিরঞ্জীব বনৌষধি by আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য তে পাচ্ছি-
ReplyDeleteরঘুনান্দন যেমন ১৬ শতাব্দী তে ঐ ১৪ শাকের গুণকীর্তন করেছেন তেমনই শাকের মহত্ব আরও বহু পূর্বে চরক সমহিতা, ও আয়ুর্বেদে ও উল্লেখ আছে। in fact শাক বলতে আমরা যে সাধারনত পাতা-শাক বুঝি সেটা যে ভুল সেই ভুলটাও needs to be rooted out. তরকারি urdu word. বাংলায় শাক-সব্জি। There is a certain redundancy in the বাংলা word শাক-সব্জি. আয়ুর্বেদে বলছে ঃ পত্রং পুষ্পং ফলং নালং কন্দং সংস্বেদজং তথা।শাকং ...... অর্থাৎ আমরা যতরকম সবজি ব্যাবহার করি সেগুলিকে ৬ টি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে - (১) পালং, নটে , পুঁই, বাধাকপি, ইত্যাদি পত্রং বা পাতাশাক (২) ফুলকপি, মোচা, বকফুল ইত্যাদি পুষ্পং বা পুষ্প শাক (৩) লাউ, কুমড়ো, বেগুন, ঢেঁড়স, পেঁপে obviously ফলশাক (8) ওল কচু লাউ কুমড়ো শালুক ইত্যাদির ডাটা গুলি নালং বা নালশাক(৫) আলু ওল কচু মুলো এরা root বা কন্দ শাক finally (৬) ভুঁইছাতা বা mushroom হচ্ছে সংস্বেদজ শাক ।
এই তো গেল botany এবার ভূগোল । ঋক্বেদে আছে - শাক নামে একটি ( ভারতের পূর্ব দিকে) দ্বীপে শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ বাস করত। এখানের বাসিন্দারা শাক আহার করত। মহাভারতে দেখি এই শাক দ্বীপ জয় করেছিল অর্জুন। পরে তীর্থ করতে এই দ্বীপের শাকম্ভরী দেবীর কাছে এসেছিলেন যুধিষঠির, যে দেবীর প্রধান আহারছিল শাক । বোঝা যাচ্ছে শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণগনই এই শাক চতুর্দশী ব্রতের প্রবর্তন করেছেন, যা কিনা আজকাল এই বাংলাতেই বেশী প্রসিদ্ধ। মা মনসার অপর নাম শাকিনী - তাঁর পুজার প্রধান উপকরন শাক, শুধু পত্র শাক নয়।
আমার ধারনা শাক concept predates the Manu-smriti division of আমিষ - নিরামিষ. কারন শক্তি আর শাক দুটো শব্দেরই ধাতু এক যার মানে শক্ত- সমর্থ। মানুষ যা খেয়ে শক্তি আহরন করে তাহাই শাক।
বাহ দারুন, খুব সুন্দর একটা তথ্য পেলাম আজকের প্রজন্ম চোদ্দ শাগ কি জানেনা খুব ভালো লাগলো আপনার লেখা পড়ে
ReplyDeleteদারুন।
ReplyDeleteঅসাধারন!!!!
ReplyDeleteজানালাম অনেক কিছু, বিশেষ করে শাকের আয়ুর্বেদিক গুনাগুন।
ReplyDelete🙏 অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ।
অমর পাতা উপকারিতা সম্পর্কে জানাবেন।। এইটা কেউ চিনে না।
ReplyDeleteঅসাধারণ গবেষণা মূলক কাজ । সুস্বাস্থ্য য়ের প্রয়োজনে সকলের কাজে লাগবে। অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDeleteগৌরী দে দাশ।