বিজ্ঞান:: জলের নিচে ডক্টরস্‌ চেম্বার - কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

জলের নিচে ডক্টরস্‌ চেম্বার
কমলবিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

ডাক্তার মাছ Wrasse


আমি আজ তোমাদের এমন এক গল্প বলব যা শুনে তোমাদের রূপকথার গল্প বলেই মনে হবে। তবে এই গল্প কোনও রাক্ষস-খোক্ষস, দত্যি-দানো বা আকাশপথে উড়ে আসা পরিদের নিয়ে নয়। যাদের কথা বলব তাদের সঙ্গে ইচ্ছে করলে তোমরা দেখা করতে পারবে। ভাবছ কীভাবে যাবে সেখানে? আমার গল্পটা পড়লেই বুঝতে পারবে।
অসুখ করেছে? কী করবে? নিশ্চয়ই ডাক্তার দেখাবে? ডাক্তারবাবু ওষুধ লিখে দেবেন। আর তা খেয়ে ভালো হয়ে যাবে। এ পর্যন্ত ঠিক আছেকিন্তু ডাক্তারবাবু যদি জলের নিচে থাকেন? আর তার চেম্বারটিও যদি জলের তলায় হয়? তাহলে ডাক্তার দেখাবে কীভাবে? ডুবুরির পোষাক পরে যাবে সেখানে? ভাবছ, এ আবার কেমন ডাক্তার? চেম্বার খোলার আর জায়গা পেল না? শেষে কিনা জলের নিচে? তাহলে আসল কথাটা বলি। এই ডাক্তারখানা আমাদের জন্য নয়। এখানে চিকিৎসা হয় মাছেদের। উঁহুঁ, অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ নয়, রীতিমতো সমুদ্রের মাছ।
অসুখ শুধু মানুষের হবে এমন তো কোনও কথা নেই? পশু, পাখি, গাছ, লতাপাতা সবারই অসুখ হতে পারে। তাহলে মাছই বা বাদ যাবে কেন? ওদেরও অসুখ হয়। পুকুরে, খালে, বিলে যে সব মাছ চাষ করা হয় বা অ্যাকোয়ারিয়ামে যে সব মাছ সাজিয়ে রাখা হয় তাদের অসুখ করলে মাছের বিশেষজ্ঞরা দেখভাল করেন। কিন্তু সমুদ্রে যে সব মাছ আছে তাদের অসুখ করলে কে দেখবে? সমুদ্রের তলায় গিয়ে চিকিৎসা করা তো আর মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়? তাছাড়া সমুদ্রের নিচে কোনও মাছের অসুখ করলে ডাঙায় বসে তো আর জানা যায় না? এছাড়াও আরও একটা ব্যাপার আছে। খরচখরচা কে দেবে? জলের নিচে যে জগৎ রয়েছে তাদের নিয়ম আর আমাদের সমাজের নিয়ম তো আর এক নয়? সেখানে টাকা পয়সার কোনও ব্যাপার নেই। সবকিছু ফ্রি। তাহলে কে সেই ডাক্তার যাঁর মাছেদের প্রতি এত ভালোবাসা? নিখরচায় চিকিৎসা করার জন্য জলের নিচে গিয়ে চেম্বার খুলে বসেছেন?
আমাদের সমাজে ডাক্তার হতে গেলে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। মাছেদের জগতে তার কোনও প্রয়োজন নেই। সেখানে যে কেউ ডাক্তার হতে পারে না। প্রকৃতির নিয়মে বিশেষ কয়েকটি জাতের মাছ আছে যারা পেশায় ডাক্তার। এদের কাছে চিকিৎসা করাতে যেসব রোগী মাছেরা আসে তাদের কিন্তু কোনো গাঁটের পয়সা খরচ করতে হয় না। নিখরচায় চিকিৎসা করলেও ডাক্তার মাছেরা তাদের কর্তব্যে অবহেলা করে না। বরং সব সময় চেষ্টা করে রোগীদের সাহায্য করতে। ডাক্তার না হয়েও কারও অসুখ হতে দেখলে উপদেশে উপদেশে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলা আমাদের স্বভাব। পারলে দু’চারটে ওষুধও প্রেসক্রাইব করে দিইমাছেদের মধ্যে এধরনের স্বভাব দেখা যায় না। ডাক্তার মাছ ছাড়া কেউই ডাক্তারি করার চেষ্টা করে না। এ ব্যাপারে এরা ভীষণ শৃঙ্খলাপরায়ণ। এই একটি ক্ষেত্রে মাছেরা মানুষকে টেক্কা দিয়েছে।
আমাদের মধ্যে যেমন সব দেশেই ডাক্তার আছে মাছেদের রাজত্বেও তেমন প্রায় সব অঞ্চলেই ডাক্তার মাছের দেখা পাওয়া যায়। প্রায় পঁয়তাল্লিশ রকমের মাছ এই পেশায় যুক্ত। অঞ্চল ভেদে এদের গায়ের রঙ ভিন্ন ভিন্ন হয়। এ ব্যাপারে উষ্ণমণ্ডলের ডাক্তারবাবুরা নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলের ডাক্তারবাবুদের থেকে অনেক বেশি চটকদার। নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলের ডাক্তার মাছেদের গায়ের রঙ সাধারণত সাদামাটা হয়। সেখানে উষ্ণমণ্ডলের ডাক্তার মাছেদের গায়ে থাকে উজ্জ্বল রঙের লম্বা লম্বা দাগ। গায়ের এই বিশেষ ধরনের রঙ ডাক্তার মাছেদের চিনতে সাহায্য করে। আমরা যেমন গাড়ির সামনে ‘রেডক্রস’ চিহ্ন দেখলেই বুঝতে পারি এটি ডাক্তারবাবুর গাড়ি তেমনি এই বিশেষ গায়ের রঙ বা পোষাক দেখেই মাছেরা চিনতে পারে তাদের ডাক্তারবাবুদের। এই পোষাকই আবার শিকারি মাছেদের হাত থেকে ডাক্তার মাছেদের প্রাণে রক্ষা করে। আসলে ওরাও বোঝে যে ডাক্তারবাবুদের খেয়ে ফেললে ওদের রোগ সারাবে কে? তাই ডাক্তার মাছেদের শিকার ভেবে ওরা ‘কপাৎ-কোঁৎ’ করে না।
মাছেদের মধ্যে কিছু দুষ্ট মাছ যে নেই এমন নয়। যেমন ব্লেনি মাছ (Blenny fish)এদের গায়ের রঙ আর সুপরিচিত ডাক্তার মাছ র‌্যাসে (Wrasse)-র গায়ের রঙ প্রায় কাছাকাছি। এরা এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ভুয়ো ডাক্তার সাজে। রোগীরা ভুল করে এদের কাছে এলেই এরা মহানন্দে ভোজ শুরু করে দেয়। বিনা খাটুনিতে শিকার ধরার এমন সুযোগ কি ছাড়া যায়? সত্যিকারের ডাক্তার মাছেরা কিন্তু এমনটি কখনই করে না। বরং মাঝেমাঝে তারাই শহিদ বনে যায়। সে কথায় পরে আসছি। আগে দেখে নেওয়া যাক ডাক্তার মাছেরা কীভাবে চিকিৎসা করে থাকে।
ডাক্তার মাছেরা যেসব অঞ্চলে বসবাস করে সেই সব অঞ্চলই হয়ে ওঠে এক একটা ডাক্তারখানা। সমুদ্রের নিচে কোথায় কোন ডাক্তার মাছ আছে সে খবর রোগী মাছেদের কাছে পৌঁছতে সময় লাগে না। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে কিছুদিনের জন্য তারা এসে আস্তানা গাড়ে এই সব ডাক্তারখানার চৌহদ্দিতে। স্যুটেড-বুটেড ডাক্তারবাবু চেম্বারে বসে আছেন। পাশে রাখা আছে স্টেথস্কোপ। রোগীরা চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করছেন। ডাক এলে দুরু দুরু বুকে দরজা ঠেলে চেম্বারে ঢুকছেন — আমাদের সমাজে ডাক্তারবাবুদের ছবিটা অনেকটা এরকম। মাছেদের দেশে কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম। ডাক্তার মাছেদের সুনির্দিষ্ট এলাকা তথা চেম্বার থাকলেও এরা চেম্বারে এক জায়গায় বসে থাকে না। পুরো এলাকা জুড়েই ঘুরপাক খেতে থাকে। সেই সঙ্গে রোগীরা কেমন আছে, কার কী অসুবিধা হচ্ছে তারও খোঁজখবর নেয়। নতুন কোনও রোগীকে আসতে দেখলেই ছুটে যায় তার কাছে। প্রথমে প্রীতি সম্ভাষণ। তারপর শুরু হয় খোঁজখবর নেওয়া — কী ধরনের অসুখ হয়েছে, অসুখ কতটা জটিল আকার ধারণ করেছে ইত্যাদি। আগেই বলেছি, আমাদের সমাজে ডাক্তার দেখাতে হলে রোগীকে বেশ ভালো মতোই ট্যাঁকের কড়ি গুণতে হয়। তার সঙ্গে আছে ওষুধ, পথ্যের খরচ। রোগী মাছেরা কিন্তু এব্যাপারে নিশ্চিন্ত। ডাক্তার দেখানোর জন্য কোনও খরচ করতে হয় নাআসলে ডাক্তার মাছেরা সবাই সেবাপরায়ণ। তাই মাছেদের ডাক্তারখানাগুলিকে সেবাকেন্দ্র বলাই ভালো। অনেকেই হয়তো ভাবছ ছুরি, কাঁচি, ওষুধ, পথ্য ছাড়া ডাক্তার মাছেরা চিকিৎসা করে কীভাবে? শুনলে অবাক হবে। শুধুমাত্র দু’টি ঠোঁটের সাহায্যে এরা চিকিৎসা চালিয়ে যায়। সব ধরনের রোগের চিকিৎসা এরা করতে পারে না ঠিকই, তবে আঘাত লেগে সৃষ্টি হওয়া ক্ষত, ব্যাকটিরিয়া বা ছত্রাক আক্রান্ত ক্ষত, মুখের ভিতরে বা বাইরে পরজীবীর আক্রমণ ইত্যাদি রোগগুলির চিকিৎসা এরা ভালোভাবেই করে থাকে। এই ধরনের রোগই মাছেদের বেশি হয় বলে ডাক্তার মাছেদের সেবা কেন্দ্রে রোগীর ভিড় লেগেই থাকে। রোগীর মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবুর হয়তো মনে হয়েছে রোগীর পাখনার নিচে ক্ষত হয়েছে। অমনি সে পাখনার কাছে মুখ নিয়ে ঠুক্‌ ঠুক্‌ করে দুটো ঠোক্কর মারল। যেন বলতে চাইছে, ওহে পাখনাটা একটু তোলো , কী হয়েছে দেখি। রোগীও বুঝে গেল, তাকে পাখনা তুলে ধরতে বলা হচ্ছে। পাখনা তুলে ধরতেই ডাক্তারবাবু পাখনার নিচে গিয়ে খুঁটে খুঁটে সবকিছু পরিষ্কার করে দেয়। হয়তো কানকোটা একটু খুলে রাখতে হবে, সেখানে ছত্রাক আক্রমণ হয়েছে। আবার সেই আলতো ঠোক্কর। রোগী কানকো আলগা করতেই ডাক্তারবাবুর শুরু হয়ে গেল সাফাই-এর কাজ। দেহের বাইরেটা চেকআপ করতে বা চিকিৎসা করতে ডাক্তারবাবুদের কোনও অসুবিধা হয় না। সমস্যা হয় যদি রোগীর মুখের ভিতরে কোনো ক্ষত থাকে। সেটা তো আর বাইরে থেকে চিকিৎসা করা যায় না? মুখের ভিতরে শরীরটাকে ঢুকিয়ে দিয়ে তবেই চিকিৎসা করতে হয়। আর তখন যদি কোনও রোগী কপাৎ-কোঁৎ করে ফেলে? তাহলে তো ডাক্তারবাবুর ভবলীলা সাঙ্গ। তবে কি ডাক্তারবাবুরা কোনো রোগীর মুখের ভিতরে ক্ষত হলে চিকিৎসা করবে না? সেবার কাজে যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছে তাদের কি ভয় পেলে চলে? তাই অকুতোভয়ে ডাক্তার মাছেরা সুড়ুৎ করে রোগীর হাঁ-করা মুখে ঢুকে পড়ে। আগেই বলেছি, রোগীরা জানে ডাক্তারবাবুকে গলাধঃকরণ করলে পরে তাদের চিকিৎসা করবে কে? তাই ডাক্তারবাবু কাজ সেরে মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত রোগীরা মুখ হাঁ করেই রাখে। উষ্ণমণ্ডলের ডাক্তার মাছেরা তো বারকুইডার মতো হিংস্র মাছের মুখের ভিতরে নির্ভয়ে ঢুকে পড়ে। চিকিৎসার কাজ সেরে আবার সুস্থ শরীরে বেরিয়েও আসে। নাতিশীতোষ্ণমণ্ডলের ডাক্তার মাছেদের ভাগ্য কিন্তু এত ভালো নয়। কারণ এখানে কিছু দুষ্ট মাছ আছে। এরা রোগী সেজে ডাক্তারবাবুর চেম্বারে চলে আসে। ডাক্তারবাবু সরল মনে এদের মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত চেকআপ করে কোনও রোগ খুঁজে না পেয়ে যেই না মুখের ভিতর ঢুকেছে অমনি দুষ্ট মাছটি গপ্‌ করে ডাক্তারবাবুকে গিলে পেটে চালান করে দেয়। এরা তো আর চিকিৎসা করাতে আসেনি! এসেছে শিকার ধরতে। মজার কথা হল যে ডাক্তার মাছেরা যখন এদের দেহের বাইরেটা চেকআপ করে তখন এরা ঘাপটি মেরে থাকে — যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। ডাক্তার মাছ তো শহিদ হল। এবার অন্য ডাক্তার মাছেরা কী করবে? কর্মবিরতি (Strike) পালন করবে, না ধর্নায় বসবে? না, কোনওটাই এরা করবে না। সেবা করাই এদের ধর্ম। আর সেই কাজ করতে গিয়ে যদি শহিদ হতে হয়, হতে হবে?— এমনই এদের ভাবখানা।
আমাদের সমাজে ডাক্তারবাবুরা যেখানে সেখানে চেম্বার খোলেন নাপসার জমবে এমন জায়গা বেছে নিয়ে চেম্বার খোলেন ডাক্তার মাছেরাও কিন্তু জলের নিচে যেখানে সেখানে চেম্বার খোলে না। এদেরও পছন্দ-অপছন্দের জায়গা আছেএদের পছন্দের জায়গাগুলি হল, জলের নিচে যেখানে সাদা বালি আছে, পাথরের স্তূপ আছে, প্রবাল আছে এমন সব জায়গা। ফলে ডাক্তার মাছেদের চেম্বার চিনতে রোগী মাছেদের কোনও অসুবিধা হয় না।
ডাক্তার মাছেদের কথা তো শুনলে। এটাও জানলে যে প্রায় সর্বক্ষণ এরা চিকিৎসা করতেই ব্যস্ত থাকে। কখনও ভেবেছ কি, এরা খায় কখন, কী-ই বা খায়? না খেয়ে তো বেঁচে থাকা যায় না? আসলে এরা খাওয়া দাওয়া আর সেবা দুটোই একসঙ্গে করে। রোগীর দেহের পরজীবী, ক্ষতস্থানের মৃতকোষ এদের খাদ্য। এই খাদ্য সংগ্রহের জন্যই পরোপকারে এরা এত উৎসাহী। তাহলে বুঝতে পারছ, সেবার নামাবলী গায়ে চাপিয়ে যে সেবাকার্য এরা করে তা একেবারে নিঃস্বার্থ নয়।
এবারে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ, ঐ রূপকথার দেশে কীভাবে যেতে হবে? হ্যাঁ, হয় ডুবুরির পোশাকে নয়তো ডুবোজাহাজে। সেখানে গেলে ডাক্তারবাবুকে দিয়ে শরীরটা একবার দেখিয়েও নিতে পার। খরচপত্তর কিছু লাগবে না।
***********
ছবিঃ আন্তর্জাল

1 comment:

  1. KBB একজন চলমান বিশ্বকোষ, সিধুজ্যাঠার নব্য সংস্করণ। এখানেও তার অন্যথা হয় নি। জানতে পারলাম জীবজগতের কিছু সম্পূর্ণ অজানা তথ্য।

    ReplyDelete