প্রবন্ধ:: জন্মশতবর্ষের আলোকে রুয়াল ডাল ও তাঁর রূপকথা রাজ্যের একঝাঁক জীবজন্তু - রাখী পুরকায়স্থ


জন্মশতবর্ষের আলোকে রুয়াল ডাল ও তাঁর রূপকথা রাজ্যের একঝাঁক জীবজন্তু
রাখী পুরকায়স্থ

আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগে ১৯১৬ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর, যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ওয়েলস দেশের রাজধানী কার্ডিফে জন্মগ্রহণ করেন এক সুপ্রসিদ্ধ কালোত্তীর্ণ শিশুসাহিত্যিক। স্বভাবতই ২০১৬ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর অবধি বেঁচে থাকলে আজ তিনি একশ বছর বয়সী হতেন। তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিশু-কাহিনিকারদের মধ্যে একজন বলে গণ্য করা হয়। আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পৌঁছেও তাঁর অপরূপ রূপকথার ঝুলি ভর্তি মণিমাণিক্য শিশু-কিশোরদের মনের কল্পজগতে সমানভাবে জ্বলজ্বল করছে। দেশ-কাল-পাত্রের সীমানা ছাড়িয়ে তাঁর গল্পকথার বর্ণময় ছবিগুলো ছোটবড়ো সকলের হৃদয়পটে চির অম্লান। তিনি আর কেউ নন, আধুনিক রূপকথার জনক - রুয়াল ডাল। তাঁর জন্মের পর একশ বছর অতিক্রান্ত, তবুও আজও তাঁর অসামান্য শিশু-কিশোরপাঠ্য কাহিনিগুলোকে বাদ দিয়ে শৈশব ও কৈশোর কল্পনা করা আমাদের পক্ষে কঠিনগল্পের বইয়ের পাতায় ও শিশু-চলচ্চিত্রের পর্দায় তাঁর সৃষ্ট অবিস্মরণীয় চরিত্রগুলো আজও জাদুকাঠির রঙিন ছোঁয়ায় আমাদের মনে বয়ে আনে অনাবিল আনন্দের ধারাস্রোতআমরা সেই কল্পনা তরঙ্গের বাঁধভাঙা তোড়ে ভেসে চলে যাই দূর-দিগন্তপারের স্বপ্নিল রূপকথার দুনিয়ায়, যেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় বসে থাকে রঙবেরঙের দুষ্টু-মিষ্টি জীবজন্তু, পোকামাকড়, পাখি ও মজাদার ছেলেমেয়েদের দল।
ব্রিটিশ লেখক রুয়াল ডাল ছিলেন একজন ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক, কবি ও চিত্রনাট্যকার। তিনি কিন্তু নিজেকে শুধুমাত্র শিশুসাহিত্যের আঙিনায় সীমাবদ্ধ রাখেননি। ১৯৪০-এর দশক থেকে তিনি ছোটবড়ো সকলের জন্যই কলম ধরেছেন এবং পরবর্তীকালে বিশ্বের সর্বাধিক বিক্রিত লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তাঁর লেখা বইয়ের ২৫০ মিলিয়নেরও অধিক সংখ্যক কপি বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়েছে বলে বি.বি.সি.-র একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। তাঁর লেখা বইগুলো পৃথিবীর ষাটটি বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে তিনি যে আকাশচুম্বী উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন তা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো
টাইমস পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ফিলিপ হোয়ার্ডের মতে, কিংবদন্তি ব্রিটিশ শিশুসাহিত্যিক এনিড মেরি ব্লাইটনের পর রুয়াল ডালই হলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক। শিশু-কিশোরদের জন্য তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘The Gremlins’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালে ঘটনাচক্রে এই উপন্যাসটি তাঁর জীবনের প্রথম প্রকাশিত লেখা বলেও জানা যায়। উপন্যাসটি British Royal Air Force-এর এক কাল্পনিক দুষ্টু প্রাণী গ্রেমলিনকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছিলপরবর্তীকালে শিশু-কিশোরদের জন্য তাঁর লেখা বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে ‘James and the Giant Peach’, ‘Charlie and the Chocolate Factory, The Magic Finger, Fantastic Mr. Fox, Danny - the Champion of the World, The Enormous Crocodile, ‘The Twits’, ‘Goerge’s Marvellous Medicine’, ‘The BFG, ‘The Witches’, ‘The Giraffe and the Pelly and Me’, ‘Matilda’, ‘Esio Trot’ এবং ‘The Minpins’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক, অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সমীক্ষায় শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিক হিসেবে রুয়াল ডালের নাম বার বার উঠে এসেছে। ১৯৮৩ সালে তাঁকে World Fantasy Award for Life Achievement পুরস্কার প্রদান করা হয় ১৯৯০ সালে শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য তাঁকে British Book Awards’ Children’s Author of the Year সম্মানে ভূষিত করা হয়।

রুয়াল ডালের পিতা হারাল্দ ডাল ও মাতা সোফিয়ে মাগদালিয়েনে ডাল ছিলেন নরওয়েজিয় বংশোদ্ভূতনরওয়েজিয় মেরু অভিযাত্রী রুয়াল আমন্ডসেনের নামে পিতা-মাতা তাঁর নামকরণ করেছিলেনযদিও তিনি যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে জন্মগ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন, নরওয়েজিয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি দ্বারা তিনি ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর প্রথম ভাষা ছিল নরওয়েজিয়। সেই ভাষাতেই তিনি পিতা-মাতা ও তিন বোনের সাথে কথা বলতেন। শিশু ও কিশোরবেলায় তিনি তাঁর মায়ের সাথে অনেকগুলো আনন্দময় স্মৃতিবিজড়িত গ্রীষ্মের ছুটি নরওয়েতে কাটিয়েছিলেন সেখানে তিনি ডাইনি, দৈত্য-দানব ও বেঁটে ভূতের কান্ডকারখানায় ভরা স্কেন্ডিনেভিয়ান উপকথার সংস্পর্শে আসেন। শিশুদের জন্য তাঁর লেখা অসংখ্য গল্পের চরিত্রচিত্রণে সেসব স্কেন্ডিনেভিয়ান উপকথার আজব চরিত্রগুলোর প্রতিফলন যথেষ্ট স্পষ্টরূপে বিদ্যমানছোটবেলায় রুয়াল ডাল তাঁর মায়ের কাছে অনেক নরওয়েজিয় পৌরাণিক ও লোককাহিনি শুনতেন। তাঁর লেখকসত্ত্বার ওপর তাঁর মা এবং সেই ছোটবেলায় শোনা নরওয়জিয় কাহিনিগুলোর শক্তিশালী প্রভাব পড়েছিল। এছাড়া তাঁর মা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বিভিন্ন ধরনের বই পড়ার জন্য তাঁকে উৎসাহিত করতেনএভাবে বাল্যকাল থেকেই তিনি সাহিত্যের একজন একনিষ্ঠ পাঠক হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রিয় লেখকদের মধ্যে ছিলেন Rudyard Kipling, Charles Dickens, William Makepeace Thackeray এবং Frederick Marryat উনবিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তী নরওয়েজিয় লেখক Jonas Lauritz Idemil Lie-এর লেখা নরওয়েজিয় লোককথা নির্ভর ভৌতিক গল্পগুলোর তিনি একান্ত অনুরাগী ছিলেন। এই সমস্ত কালজয়ী লেখকেরা ও তাঁদের লেখাগুলো রুয়াল ডালের জীবন ও লেখার ওপর দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। পরবর্তী জীবনে পিতা রুয়াল ডাল যখন তাঁর পাঁচ সন্তান অলিভিয়া, টেসা, থিও, ওফেলিয়া এবং লুসিকে রাতে ঘুমোবার আগে স্বরচিত গল্প শোনাতে শুরু করেন তখন থেকেই তিনি শিশুদের জন্য গল্প-উপন্যাস লেখার ব্যাপারে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হন।

রুয়াল ডাল সৃষ্ট শিশুসাহিত্যের বহুমূল্য ভান্ডারে আমরা সর্বদাই একঝাঁক আশ্চর্যজনক ও কৌতূহল উদ্দীপক জীবজন্তুর সন্ধান পাই। শিশুদের জন্য তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাসের প্রায় সবক’টিতেই হরেকরকমের মজাদার জন্তু, পোকামাকড় ও পাখির চরিত্র তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। ছোটবেলায় নরওয়েতে গ্রীষ্মের অবকাশ কাটাবার সময় ও চাকরি-জীবনে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে থাকাকালীন পশু-পাখি-পোকামাকড় সম্পর্কিত বেশ কিছু মজাদার অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল, যা তাঁকে এই অপূর্ব চরিত্রগুলি গড়ে তুলতে রসদ যুগিয়েছিল। তাঁর দুইটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ Boy, Tales of Childhood এবং Going Solo-এর পাতায় এই সুন্দর অভিজ্ঞতাগুলি খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়া, বিদেশ বিভূঁইয়ে থাকাকালীন তিনি তাঁর মাকে অনেক চিঠি লিখতেন। সেই চিঠিগুলিও তার মজাদার অভিজ্ঞতার প্রামাণ্য দলিল। শিশুদের জন্য রুয়াল ডালের লেখা যে সকল উপন্যাসগুলি আমাদের সেইসব কাল্পনিক জীবজন্তুতে পরিপূর্ণ রূপকথার দেশে নিয়ে যায় তাদের মধ্যে James and the Giant Peach, Fantastic Mr. Fox, The Enormous Crocodile এবং The Twits বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
রুয়াল ডাল ও পোকামাকড়দের মধ্যে সুস্পষ্ট সংযোগ রচনা করেছে যে উপন্যাসটি তা অবশ্যই ‘James and the Giant Peach’ একদল আশ্চর্য পোকামাকড়ের চরিত্রের ইতিবাচক চিত্রাঙ্কন থেকে পোকামাকড়দের প্রতি তাঁর ভালবাসা ও সহানুভূতির মনোভাব উপন্যাসটিতে সুস্পষ্টরূপে ধরা দিয়েছেউপন্যাসটির একটি অংশে তিনি লিখেছেন, “তারা দেখতে ভয়ানক হলেও আদতে তারা একটুও ভয়ানক নয়। বস্তুত তারা কোনওকালেই ভয়ানক ছিল না। তারা অত্যন্ত দয়ালু ও উপকারী প্রাণী” পোকামাকড় সম্পর্কে তাঁর মতামত যথার্থরূপে ব্যক্ত হয়েছে উপন্যাসের এই উদ্ধৃতিটির মাধ্যমে‘James and the Giant Peach’ তাঁর লেখা প্রথম ক্লাসিক উপন্যাস। অনেকক্ষেত্রে ‘The Gremlins’ উপন্যাসটিকে ছোটদের জন্য তাঁর প্রথম লেখা বলে উল্লেখ করা হলেও বহুদিন শুধুমাত্র বড়োদের জন্য গল্প-উপন্যাস লেখার পর প্রকৃতপক্ষে ‘James and the Giant Peach’ ছিল ছোটদের জন্য আধুনিক রূপকথা লেখায় তাঁর প্রথম সচেতন প্রয়াস বইটি তাঁর বড়ো দুই কন্যা অলিভিয়া ও টেসাকে উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৬১ সালে বইটির প্রথম প্রকাশের মধ্য দিয়ে একজন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক হিসেবে তাঁর জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে।
বাকিংহ্যামশায়ারে রুয়াল ডালের বাড়ি লাগোয়া ফলের বাগানে ছিল একটি চেরিফলের গাছ। গাছটি দেখে তাঁর মাথায় এক আজব চিন্তা এল। তিনি ভাবতে লাগলেন, হঠাৎ একদিন যদি একটি চেরিফল বড়ো হতে হতে বিশালাকৃতি ধারণ করে তাহলে কিন্তু বেশ হয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। তিনি রূপকথার জগতে নবদিগন্তের সূচনা কার্যে উঠে পড়ে লাগলেন। কিন্তু ক্রমশ মন পরিবর্তন করে দৈত্যাকার চেরিফলের চিন্তা বাদ দিয়ে ক্রমবর্ধমান নাসপাতি, এমনকি আপেলের কথাও তিনি বিবেচনা করে দেখলেন। অবশেষে তিনি সেই ঐন্দ্রজালিক অভিযাত্রার বাহন হিসেবে একটি দৈত্যাকার পীচফলকেই বেছে নিয়েছিলেন।
‘James and the Giant Peach’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জেমস হেনরি ট্রোটার একটি নিষ্পাপ অথচ বুদ্ধিমান বালকমাত্র চার বছর বয়সে পিতামাতাকে হারিয়ে দু’জন নিষ্ঠুর ও নীচ প্রকৃতির আত্মীয়া আন্ট স্পাইকার ও আন্ট স্পঞ্জের সাথে সে বাস করতএই পৃথিবীতে তার কোনও বন্ধু ছিল না। একদিন জেমস আবিষ্কার করল এক সুড়ঙ্গ সুড়ঙ্গপথে সে পৌঁছে গেল এক পেল্লায় জাদুকরি পীচফলের ভেতরে অবস্থিত এক গোপন কুঠুরিতে। সেখানে সে পেয়ে গেল সাতটি বন্ধু - সাতটি আজব পোকা! জাদুবলে পরিবর্তিত হয়ে তারা মানুষের মতোই লম্বা চওড়া। মানুষের মতোই কথা বলা আশ্চর্য কীটপতঙ্গ তারা। পরবর্তীতে এদের সবার সাথেই সেই পীচফলে চেপে বিশ্বব্যাপী দুর্দান্ত দুঃসাহসিক অভিযানে নেমে পড়ে জেমস। চল, James-এর সেই সাতটি বন্ধুর সাথে আমরা পরিচিত হই।


বৃদ্ধ-সবুজ-ঘাসফড়িং (The Old-Green-Grasshopper)
বৃদ্ধ-সবুজ-ঘাসফড়িং এক প্রাচীন জ্ঞানী জীব। বহু অভিজ্ঞতালব্ধ তার জীবন। ছোট্ট জেমসকে সে খুব ভালবাসতগল্পে দেখা যায় সে সর্বদা ছোট্ট জেমসকে পিতৃস্নেহ দিয়েছে এবং সমগ্র অভিযানজুড়ে তার ওপর পিতৃতুল্য নজর রেখেছে। উপরন্তু সে একজন সুদক্ষ গীতবাদ্যকর। পীচের মধ্যে অবস্থানকালে সে জেমসকে নিজের পরিচয় দিয়ে গিয়ে বলেছিল, “আমি কোনওকালেই কীটপতঙ্গ ছিলাম না। আমি একজন সুরকার” তার ভীষণ আক্ষেপ ছিল, এই দৈত্যাকার পীচফলের বাসিন্দা পোকার দল তার এই অসামান্য গুণের মর্ম উপলব্ধি করতে অপারগ।
গল্পের শেষে অবশ্য সে তার গুণের সম্মান পেয়েছিলনিউ ইয়র্ক সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার একজন সদস্য হিসেবে তার বাদ্যযন্ত্র বাজানোর দক্ষতা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।


কেন্নো (The Centipede)
সে ছিল কৌতুক ও গানবাজনা প্রিয় এক পুরুষ কেন্নো। সে সাথে আরেক সহযাত্রী বেচারা কেঁচোর পেছনে লাগতে তার জুড়ি ছিল নাদুষ্টু ও ফুর্তিবাজ হলেও সে ছিল খুব হৃদয়বান প্রাণী। সম্ভবত সে-ই ছিল জেমসের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কেন্নো খুব আশাবাদী ও সাহসী ছিলকিন্তু সে ছিল বড্ড স্পষ্টবাদীকীটপতঙ্গ হলেও নিজেকে নিয়ে সে খুব গর্বিত ছিল। পীচফলের অভ্যন্তরে প্রথম পরিচয়ের দিন সে জেমসের কাছে জানতে চেয়েছিল, “আচ্ছা জেমস, তুমি কি জীবনে কখনও আমার মতো এমন বিস্ময়কর প্রকান্ড শতপদী দেখেছ?” তার গর্বের উৎস ছিল তার ‘একশখানা পা’। সে অবশ্য তাই মনে করতআসলে কিন্তু তার ছিল মোটে বিয়াল্লিশখানা পা। প্রতিটি পায়ে সে জুতো পরত, যদিও জুতোগুলো পরা, খুলে রাখা ও চকচকে করবার জন্য সে অন্যের মুখাপেক্ষী ছিল। পীচফলের ভেতর বহুবার জেমস তাকে এসব কাজে সাহায্য করেছে।
বইটির শেষ অধ্যায়ে পৌঁছে জানা যায়, কেন্নো একটি উচ্চশ্রেণীর বুট-জুতো নির্মাণ সংস্থায় ‘ভাইস-প্রেসিডেণ্ট-ইনচার্জ-অব্-সেলস’ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে।


লেডিবাগ (The Ladybug)
সে ছিল এক দয়ালু মাতৃস্থানীয় লেডিবাগজেমসকে সে ভীষণ স্নেহ করতপীচফলে চেপে অভিযানের শুরু থেকে সে-ই ছিল জেমসের সবচেয়ে বড়ো স্বস্তির কারণ। পরিচয়ের দিনে সে জেমসকে জানিয়েছিল, “একটি লেডিবাগের পিঠের দাগের সংখ্যা বলে দেয় সে কোন পরিবারের সদস্য। যেমন আমায় দেখতে পাচ্ছ, আমি একজন নয় দাগ বিশিষ্ট লেডিবাগ
বইটির শেষ অধ্যায়ে গিয়ে জানা যায়, নিউ ইয়র্ক সিটি ফায়ার ডিপার্টমেন্টের প্রধানকে বিয়ে করে সে এখন সুখে শান্তিতে ঘর-সংসার করছে।


মিস্ মাকড়শা (Miss Spider)
সে একজন ভালোমানুষ মহিলা মাকড়শা। জেমসের খুব ভালো বন্ধু সে। সাধারণত খুব ভদ্র ও বন্ধুত্বপূর্ণ স্বভাবের হলেও, মিস মাকড়শার ছিল একটি অতিকায় কালো ও ভয়াল মাথা যা অপরিচিত আগন্তুকদের মনে সীমাহীন আতঙ্কের উদ্রেক করত পীচফলে চেপে যাত্রা চলাকালীন মিস মাকড়শার তৈরি জালের বিছানায় বাকি সকল অভিযাত্রীদের ঘুমের ব্যবস্থা করা হয়। মিস মাকড়শার মনে খুব দুঃখ ছিল। কেউ তাকে পছন্দ করে না। সে জেমসের কাছে অভিযোগ করেছিল, “আমি সবার উপকার করতে চাই। সারাদিন আমি জাল বুনে মাছি আর মশা ধরিআসল ব্যাপারটা হল, মাকড়শাদের সাথে সঠিক আচরণ কেউ করে না
বইয়ের শেষ অধ্যায়ে পৌঁছে জানা যায়, অভিযান পরবর্তী সময়ে ব্যালেন্সের খেলা দেখাবার শক্ত টাঙানো দড়ি প্রস্তুতকারকরূপে সে বেশ নাম কিনেছে।


কেঁচো (The Earthworm)
সে একটি পুরুষ কেঁচো, যার সাথে পীচফলের আরেক অভিযাত্রী কেন্নোর প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকতসকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও, সে-ই ছিল সবার মধ্যে সবচেয়ে বেশী হতাশাগ্রস্ত। সর্বদাই গোমড়ামুখো সে। লেডিবাগ তার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে জেমসকে বলেছিল, “কেঁচো খুশী থাকতে খুব ঘৃণা করেসে শুধু খুশী হয় যখন সে বিষন্ন হয়! ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক, তাই নয় কি? কিন্তু তারপর আমি ভাবি, কেঁচো জন্মটাই তো একজন ব্যাক্তির পক্ষে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা
পরবর্তী সময়ে নিউ ইয়র্কের মানুষের কাছে কেঁচোর প্রশংসা করতে গিয়ে জেমস বলেছিল, “পাতাল রেলের জন্য সুড়ঙ্গপথ খনন ও নর্দমা তৈরীর কাজে কেঁচো দারুণ কার্যকরী হবে
অভিযান শেষে কেঁচো অবশ্য একটি প্রসাধনী ক্রীম কোম্পানির ম্যাস্কাট হয়ে ওঠে।


জোনাকি (The Glowworm)
সে একজন নিরীহ মহিলা জোনাকি। অভিযান চলাকালীন দৈত্যাকার পীচফলের ছাদের কেন্দ্রস্থলে সে শান্তভাবে ঝুলে থাকত আর সকলকে স্নিগ্ধ আলো প্রদান করত।
কাহিনি শেষে জানা যায়, নিউ ইয়র্ক নগরীর স্ট্যাচু অব্ লিবার্টির মশালটিকে আলোকিত করবার কাজে নিয়োজিত হয়েছে সে!


রেশম গুটিপোকা (The Silkworm)
সে একজন মহিলা রেশম গুটিপোকা, যে মিস মাকড়শাকে সুতো তৈরির কাজে সাহায্য করততাকে কথা বলতে কেউ কোনওদিনও শোনেনি তবুও সে-ই ছিল পীচ-অভিযাত্রীদলের অমূল্য সম্পদতার দ্রুত উৎপাদিত সিল্কের সুতোর সাহায্য ছাড়া সমুদ্রে ভাসমান পীচফল ও তার মধ্যে উপস্থিত অভিযাত্রীদলের সকলকে ভয়ংকর হাঙরমাছের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য জেমসের পরিকল্পনাটি নিঃসন্দেহে ব্যর্থ হত
অভিযান শেষে জানা যায়, রেশম গুটিপোকা নাকি রানি এলিজাবেথের বিয়ের পোশাক সেলাই করবার বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছে!

১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় রুয়াল ডালের আর একটি অসামান্য উপন্যাস ‘Fantastic Mr. Fox’এই উপন্যাসে তিনি আবারও শিশুমনের উপযোগী পশুচরিত্রের চিত্রাঙ্কন করেছিলেন অসাধারণ দক্ষতায়। এই কাহিনির নেপথ্যে রয়েছে একটি শেয়াল পরিবার। বাকিংহ্যামশায়ারের গ্রেট মিশেন্ডেন গ্রামে তাঁর বাড়িটি ছিল বিস্তীর্ণ মাঠ ও জঙ্গল দ্বারা পরিবেষ্টিত। বাড়িটির অনতিদূরে ছিল একটি দেড়শো বছরের পুরনো বিশাল বীচগাছ, যাকে স্থানীয়ভাবে ‘ডাইনি গাছ’ বলে উল্লেখ করা হত। এই গাছটিই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে এই অপূর্ব উপন্যাসটি লিখতে। কারণ, সেই গাছের গোড়ায় ছিল একটি গর্ত আর গর্তটিতে থাকত একটি শেয়াল পরিবার। সেই শেয়াল পরিবারটি তাঁকে উপন্যাসটি লিখবার সকল প্রয়োজনীয় রসদ যুগিয়েছিল।
উপন্যাসের কাহিনি মিস্টার ফক্স নামে এক চতুর ও ফন্দিবাজ শেয়ালের কীর্তিকলাপকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলউপত্যকার উপরে পাহাড়ের গায়ে ছিল এক জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝে ছিল এক বিশাল গাছ। গাছের নীচে ছিল এক গর্ত। সেই গর্তের মধ্যে মাটির নীচে মিস্টার ফক্স তার স্ত্রী ও চার ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে বসবাস করতপরিবারের জন্য খাবার যোগাড় করতে প্রতি রাত্তিরে সে হাজির হত আশেপাশের খামার বাড়িগুলোতে এবং সেখানকার গবাদি পশুপাখি প্রভৃতি চুরি করে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসত। খামার বাড়িগুলোর মালিক ছিল তিনজন দুষ্টু, নিষ্ঠুর ও বোকা চাষি – বগিস, বান্স এবং বিনস্বাভাবিকভাবেই মিষ্টার ফক্স তাদের প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়েছিল। তিন চাষি তাই মিস্টার ফক্সকে পাকড়াও করে উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য নানারকম ফন্দিফিকির আঁটত কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রতিবারই মিস্টার ফক্স তাদের চালাকিতে টেক্কা দিতচল, আমরা মিস্টার ফক্স ও তার পরিবারের সাথে পরিচিত হই।


মিস্টার ফক্স (Mr. Fox)
সে অত্যন্ত চালাক একটি শেয়াল। স্থানীয় কৃষক বগিস, বান্স এবং বিন থেকে সে অনেকগুণ বেশী বুদ্ধিমান ছিলতাইতো সেই তিনজন কৃষক বার বার মিস্টার ফক্সের ধূর্ত বুদ্ধির কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হত। মাঝে মাঝে অবশ্য চাষিদের হাত থেকে বাঁচবার রাস্তাটা মিস্টার ফক্সের জন্য খুব একটা মসৃণ ছিল না। যখন তিন পাজী চাষি তার গর্তের ঠিকানাটা হঠাৎ খুঁজে পেয়ে গেল, মিস্টার ফক্স ও তার পরিবার তখন খুব বড়ো বিপদে পড়েছিল। তবে মিস্টার ফক্সকে পরাস্ত করা এত সহজ কাজ নয়। তাকে এবং তার পরিবারকে গর্তের ভেতর আটকে রেখে ফাঁদে ফেলবার পরিকল্পনা করতে গিয়ে তিন চাষি আসলে নিজেদের জন্যই বিপদ ডেকে এনেছিল। মিস্টার ফক্স তার চতুর বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে সেই তিন চাষির খামারবাড়ির নিচে গিয়ে চাষিদের অজান্তেই আবার শাকসব্জী, গবাদি পশুপাখি চুরি করতে লাগল এবং মনের আনন্দে তার পরিবার ও প্রতিবেশীদের নিয়ে মাটির নিচে বসবাস করতে লাগল।


মিসেস ফক্স (Mrs. Fox)
মিসেস ফক্স একজন আর্দশ স্ত্রী ও চারটি সন্তানের গর্বিত মাতার চোখে তার স্বামী একজন অতি মহান ও চমৎকার ব্যক্তি। তার স্বামী যখন মুরগি চোরাশিকারে বাড়ি থেকে দূরে ব্যস্ত তখন সে ধৈর্য্য সহকারে ঘর-সংসার সামলেছে। স্বামী খাবার যোগাড় করে বাড়ি ফিরলে সে জিভে জল আনা নিত্যনতুন পদ রান্না করে সকলের রসনা তৃপ্ত করেছে।
মাঝেমধ্যে প্রতিবেশীদের হরেকরকম রান্না করে খাওয়ানোতেও তার কোনও আপত্তি ছিল না। সর্বোপরি, মিসেস ফক্স একজন প্রকৃত সমর্থনদায়িনী স্ত্রী।


ছোট্ট চারটি শেয়াল ছানার দল
তারা মিস্টার ও মিসেস ফক্সের আদরের চার সন্তান। সেই গাছের নিচে মা-বাবার সাথে একই গর্তে তারা বাস করততিনজন দুষ্টু চাষীর খামার থেকে খাবার যোগাড় করবার সময় তাদের বাবাকে সর্বপ্রকার সাহায্য করতে তারা সদা সচেষ্ট থাকত

১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় রুয়াল ডালের আর একটি উপন্যাস ‘The Enormous Crocodile’, যেখানে তিনি অনবদ্য সব পশুপাখির চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেনএই উপন্যাসের পটভূমি জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই ১৯৩৪ সালে, যখন থেকে তাঁর বিদেশবাসের সূচনা ঘটে। সে সময় তিনি Shell Petroleum Company-তে যোগদান করেন। চাকরিসূত্রে তাঁকে কেনিয়ার মোম্বাসা এবং তাঙানিকা, বর্তমান তাঞ্জানিয়ার দার-এস-সালামে বহুবছর থাকতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর ১৯৩৯ সালের নভেম্বর মাসে তিনি British Royal Air Force-এ একজন বিমান-সৈনিক (Fighter Ace) হিসেবে নিযুক্ত হন। সে সময় পূর্ব আফ্রিকা ও ইরাকের বিভিন্ন স্থানে থাকবার তাঁর সুযোগ হয়। সেই আমলে এসব অঞ্চলে বিশালাকৃতির বিষাক্ত সাপ প্রায়শই চোখে পড়তসাপের সাথে দেখা সাক্ষাতের সেসব ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা ‘Going Solo’ বইটিতে তিনি লিখে রেখে গেছেন। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত ‘The BFG’ উপন্যাসে যে বিপদজ্জনক ও প্রাণঘাতী বিরাট সাপটিকে আমরা পাই, তার মধ্যে রুয়াল ডালের সে সকল অভিজ্ঞতাই যেন ছায়া ফেলেছিল। আফ্রিকায় বসবাসকালে যুবক রুয়াল ডাল শুধু যে বিষাক্ত প্রাণঘাতী সাপ দেখেছিলেন তা কিন্তু নয়, তিনি দুষ্টু ছিনতাইবাজ বানর ও ক্ষুধার্ত বিরাট কুমির প্রায়শই স্বচক্ষে দেখেছেন। আফ্রিকার জঙ্গলে সেসব প্রাণীগুলোকে তাদের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশে পর্যবেক্ষণ করে তিনি খুব আনন্দ পেতেন। সেই ভয়ংকর সুন্দর অভিজ্ঞতাগুলো তার সাথে রয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি যখন ‘The Enormous Crocodile’ উপন্যাসটি লিখতে বসলেন, তাঁর লেখনীর জাদুতে সেই অভিজ্ঞতাগুলোকে কল্পনার মোড়কে মুড়ে এক অভিনব উপায়ে আমাদের সাথে ভাগ করে নিলেন।
‘The Enormous Crocodile’ উপন্যাসের পটভূমি আফ্রিকার ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের বুক চিরে বয়ে যাচ্ছে এক লম্বা চওড়া কর্দমাক্ত নদী। গল্পের শুরুতেই আমরা জানতে পারি, এক বিরাট লোভী কুমির নদীটিতে ভেসে ভেসে প্রতিবেশী ছোট কুমিরটিকে বলছে, “আমি একটা মানুষের বাচ্চা খাব” আসল কথাটা হল কুমিরেরা খুবই খাদ্যলোভী প্রাণী। একটি বা দু’টি সরস মানবশিশু না হলে যেন তাদের মধ্যাহ্নভোজন সম্পূর্ণ হয় না! তবে সব কুমির কি আর এক প্রকৃতির হয়? সেই ছোট কুমিরটির কথাই ধরা যাক না। সে কিন্তু মানবশিশু খেতে একটুও ইচ্ছুক নয় কারণ, সে ভালো করেই জানে মানবশিশুর স্বাদ অতীব কদর্য ও তিক্ত। সে তাই বিরাট কুমিরটিকে সাধ্যমতো এ কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছিল বড়ো কুমিরটি এসব কথায় একটুও কর্ণপাত না করে নদী ছেড়ে চলে যায়কিন্তু যাবার আগে সে তার কু-অভিপ্রায় জলহস্তী, বাঁদর, হাতি ও পাখিকে জানিয়ে যায় তারা তখন সবাই মিলে ঠিক করল বড়ো কুমিরটিকে যেভাবেই হোক ঠেকাতে হবে। চল, আমরা ভালো-মন্দ সবার সাথে পরিচিত হই।


বিরাট কুমির (Enormous Crocodile)
সে একটি অতি বিশাল আকৃতির বদমাশ কুমির আফ্রিকার গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সবচেয়ে বড়ো ও গাঢ় বাদামী রঙের কর্দমাক্ত নদীটির বাসিন্দা সে। জঙ্গলের সকল বাসিন্দার প্রতি তার লোভী দৃষ্টি। সকলকেই সে খাদ্যরূপে পেতে চায়। কিন্তু তার সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য একটি মুখরোচক সরস মানব শিশু!
বিরাট কুমির চরিত্রের সাথে Crocky-Wock নামে রুয়াল ডাল সৃষ্ট আরেকটি ভয়ানক কুমির চরিত্রের প্রভূত সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত তাঁর Dirty Beasts কবিতা সংকলনে Crocky-Wock নামে কুমির চরিত্রটির আবির্ভাব ঘটে।


তত বড়ো নয় কুমির (Notsobig Crocodile)
সে তুলনামূলকভাবে ছোট একটি কুমির। আফ্রিকার সবচেয়ে বড়ো ও গাঢ় বাদামী রঙের কর্দমাক্ত সেই নদীর সেও বাসিন্দা। তবে বিরাট কুমিরের প্রতিবেশী হলেও তার স্বভাব-চরিত্র কিন্তু একেবারেই আলাদা সে শুধুমাত্র মাছ খেতেই ভালবাসে


হাম্পি রাম্পি জলহস্তী (Humpy Rumpy the Hippopotamus)
সে এক বিপুলায়তন জলহস্তী। আফ্রিকার জঙ্গলের সেই গাঢ় বাদামী রঙের কর্দমাক্ত বড়ো নদীর তীরে সে বাস করে। নদী-তীরবর্তী প্যাঁচপ্যাঁচে কাদায় তাকে প্রায়শই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। নিকটবর্তী মানবশিশুদের যাতে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা না হয় সে ব্যাপারে বিরাট কুমিরকে বোঝাতে সে চেষ্টা করেছিল পরবর্তীতে একটি ছোট নারকেলগাছ সেজে মানবশিশুদের ধরবার যে ফন্দি বিরাট কুমির এঁটেছিল তা হাম্পি রাম্পির চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে যায়


মাগল-ওয়াম্প বাঁদর (Muggle-Wump the Monkey)
আফ্রিকার সেই বড়ো নদী-তীরবর্তী জঙ্গলের বাসিন্দা মাগল-ওয়াম্পবাদাম খেতে সে বড়ো ভালবাসততার মন এতটাই উদার ছিল যে বদমাশ বিরাট কুমিরকেও সে বাদাম খেতে দিত! যদিও বিরাট কুমির মধ্যাহ্নভোজনে একটি সরস মানবশিশু খাবার আগে মাগল-ওয়াম্পকেই একটি চমৎকার সুস্বাদু জলখাবাররূপে কল্পনা করে জিভের জল ফেলত। পরবর্তীকালে যখন বিরাট কুমির একটি স্কুলের খেলার মাঠে ঢেঁকিকলের ছদ্মবেশে বাচ্চা শিকার করতে এসেছিল, মাগল-ওয়াম্পের চেষ্টায় তার সমস্ত দুষ্টু ফন্দিফিকির ফাঁস হয়ে যায়
১৯৮০ সালে প্রকাশিত ‘The Twits’ উপন্যাসে মাগল-ওয়াম্প বাঁদরকে আমরা আবার ফিরে পাই। সেখানে সে একটি অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। উপন্যাসের দুই ভয়ংকর চরিত্র মিস্টার আর মিসেস টুইটস চক্রান্ত করে মাগল-ওয়াম্প ও তার পরিবারকে বন্দি করে রাখে। মিস্টার টুইটসের The Great Upside Down Monkey Circus-এর প্রশিক্ষণ চলাকালীন মাথার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে তাদের বাধ্য করা হয়! কিন্তু মাগল-ওয়াম্পের বুদ্ধির তুলনা নেই। তার পুরনো বন্ধু রলি-পলি পাখির সাথে দেখা হতেই সে পালাবার ফন্দি আঁটে। সেই সাথে তারা টুইটস দম্পতিকেও উচিৎ শিক্ষা দিতে ছাড়ে না।


রলি-পলি পাখি (The Roly-Poly Bird)
সে একটি বিচিত্র প্রজাতির ভ্রমণপিপাসু পাখি, যে সাধারণত আফ্রিকার জঙ্গলে বসবাস করততার বিস্ময়কর রঙিন পালকের কারণে সে ছিল বাকি পাখিদের থেকে আলাদাতার প্রিয় ফল ছিল বেরি। একবার দুষ্টু বিরাট কুমির রলি-পলি পাখিকে দিয়ে মধ্যাহ্নভোজন করবে বলে হুমকি দিয়েছিল কিন্তু রলি-পলি দ্রুততার সাথে উড়ে পালিয়ে গিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে যখন বিরাট কুমির বাচ্চা শিকার করবার উদ্দেশ্যে একটি মেলার মাঠের নাগরদোলায় কাঠের কুমিরের ছদ্মবেশে ঘাপটি মেরে বসেছিল, রলি-পলির প্রচেষ্টায় তার সমস্ত গোপন পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
১৯৮০ সালে প্রকাশিত ‘The Twits’ উপন্যাসে রলি-পলি পাখিকে আমরা আবার ফিরে পাই। সেখানে মাগল-ওয়াম্প ও তার পরিবারকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে সে। মিসেস টুইটস যেসব পাখিদের ‘বার্ড পাইনামে সুস্বাদু রান্নার পদ বানাবার উদ্দেশ্যে বন্দি করেছিল, তাদেরও সে মুক্তি পেতে সাহায্য করে।


ট্রাঙ্কি হাতি (Trunky the Elephant)
আফ্রিকার সেই গাঢ় বাদামী রঙের কর্দমাক্ত বড়ো নদীর পাশে যে ঘন জঙ্গল ছিল, তাতেই থাকত ট্রাঙ্কি নামের হাতিটিবিরাট কুমিরের প্রতিবেশী সে। বিরাট কুমিরের মানবশিশু ভোজনসংক্রান্ত গোপন পরিকল্পনা ও দুষ্টু ফন্দিগুলিকে ব্যর্থ করাবার জন্য সেও জঙ্গলের অন্যান্য বাসিন্দাদের সাথে মিলে সচেষ্ট হয়েছিল। একদিন যখন বিরাট কুমির বনভোজনের স্থানে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ধরবে বলে একটি চারপেয়ে কাঠের বেঞ্চি সেজে বসেছিল, ট্রাঙ্কি তখন বুদ্ধি করে বড়ো কুমিরের সব চক্রান্ত ফাঁস করে দেয়। পরবর্তীকালে ভাগ্যক্রমে ট্রাঙ্কির মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি আসে যার ফলে বিরাট কুমিরের হাত থেকে সকলে চিরতরে পরিত্রাণ পায়। একটি সংক্ষিপ্ত মুখোমুখি সংঘর্ষের পর ট্রাঙ্কি তাকে লেজে পেঁচিয়ে বন বন করে ঘুরিয়ে আকাশে ছুঁড়ে দেয়। বাতাসে উড়ে গিয়ে সূর্যের সাথে বিরাট কুমিরের সংঘর্ষ ঘটেএর ফলে তার যে কী গতি হয় তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

অবসর জীবনে ইংলন্ডের বাকিংহ্যামশায়ারের গ্রেট মিশেন্ডেন গ্রামে স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে বসবাসকালে রুয়াল ডাল দু’টি কচ্ছপ পুষেছিলেন। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে কচ্ছপ দু’টি ছিল দীর্ঘায়ু। ১৯৭৯ সালে একটি বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে তিনি কচ্ছপদু’টি সম্পর্কে জানাতে গিয়ে কৌতুকের ছলে লিখেছিলেন, “এই কচ্ছপদু’টি এত বছর ধরে আমার সাথে আছে যে আমি এখন তাদের নামই আর মনে করে উঠতে পারি না
১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় শিশুদের জন্য লেখা তাঁর শেষ উপন্যাস ‘Esio Trot উপন্যাসটি একটি ক্ষুদ্রাকৃতি কচ্ছপ এলফিকে কেন্দ্র করে লেখা। উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র মিসেস সিলভারের আদরের পোষা কচ্ছপ সে বহুবছর ধরে এলফি রয়েছে মিসেস সিলভারের সাথে। এলফি চরিত্রের মধ্যে যেন রুয়াল ডালের নিজের পোষা কচ্ছপদু’টি বার বার ফিরে এসেছে।


শিশুদের জন্য লেখা রুয়াল ডালের গল্পগুলোতে তাঁর পশুপক্ষী সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার প্রতিফলন আমরা এভাবেই বারংবার খুঁজে পাই। সে সাথে লেখাগুলোর মধ্যে পশু-পাখি-পোকামাকড়ের প্রতি তাঁর তীব্র কৌতূহল ও প্রগাঢ় ভালোবাসার সন্ধান মেলে। সেই ভালোবাসা ও জীবনের অভিজ্ঞতার পুঁজি মিলেমিশে তাঁর কলমের আঁচড়ে সৃষ্টি করেছে শিশুদের মনের মতো অনবদ্য সব প্রাণী চরিত্র। তারা কথা বলে, ফন্দি আঁটে, দুষ্টুমি করে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করে, প্রাপ্তবয়স্ক দুষ্টুলোকেদের শাস্তি দেয় আবার কখনও কখনও সবাই মিলে অভূতপূর্ব লোমহর্ষক অভিযানেও বেরিয়ে পড়েসর্বোপরি, তাদেরও আমাদের মতো মন আছে। ভালো লাগা, দুঃখ, অভাব, অভিযোগের লম্বা ফিরিস্তি আছে। হাতে ধরে তারা আমাদের নিয়ে যায় এক জাদু-ভরা রূপকথার আজব দুনিয়ায়।
১৯৯০ সালের ২৩ নভেম্বর রুয়াল ডালের জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। ইংলন্ডের বাকিংহ্যামশায়ারে গ্রেট মিশেন্ডেন গ্রামের সেন্ট পিটার ও সেন্ট পল গির্জার কবরস্থানে তিনি এখন শান্তিতে শায়িত আছেন। আজও শিশুরা রূপকথার এই নিপুণ কারিগরের পবিত্র সমাধিতে ফুল ও খেলনা রেখে যায়। তাঁর মৃত্যুর পর টাইমস পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ফিলিপ হোয়ার্ড বলেছিলেন, “আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে বহুল পঠিত ও প্রভাবশালী লেখককে মৃত্যু আজ স্তব্ধ করে দিল
১৯৮৩ সালে World Fantasy Award for Life Achievement পুরস্কার গ্রহণ পরবর্তী ভাষণে রুয়াল ডাল তার অগণিত শিশুপাঠকদের কল্পনার রঙিন ডানা মেলে খুশীর আকাশে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়াতে উৎসাহিত করেছিলেনতাঁর কনিষ্ঠ কন্যা লুসি ডাল এক সাক্ষাৎকারে পিতার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, “তিনি এত বড়ো মাপের মানুষ ছিলেন যে আমাদের সকলকে জাদুতে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিলেন
প্রকৃতপক্ষে রুয়াল ডালের মতো শক্তিশালী কলমের অধিকারীরা শুধুমাত্র শিশুকিশোরদের মনেই নয়, বড়োদের মনেও জাদুকাঠির আলতো ছোঁয়ায় ইন্দ্রজালের মোহময় মুগ্ধতা নিয়ে আসেন আর তখনই আমাদের মনের গহিনে রূঢ় বাস্তব আর মায়াময় রূপকথারা যেন মিলেমিশে এক হয়ে যায়।

_____

লেখক পরিচিতিঃ আইন নিয়ে পড়াশোনা। আইনে স্নাতকোত্তর। পেশায় আইনের শিক্ষক। ছোটবড়ো সকলের জন্য গল্প ও প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসেন। অবসর সময় কাটান বই পড়ে, ছবি এঁকে ও সঙ্গীতচর্চা করে। এছাড়া বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানে ভ্রমণ এবং সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ক্যামেরাবন্দি করতে উৎসাহী।

1 comment:

  1. খুব ভাল লাগল । তথ্য সমৃদ্ধ লেখা। রুয়াল ডালের রূপকথার দুনিয়া সম্পর্কে এক বিস্তৃত ধারণা যোগায়।

    ReplyDelete