রাধাচূড়া রঙের
দুপুর
রম্যাণী গোস্বামী
বিন্নিদিদির দিকে অবাক চোখে তাকাল গুনগুন। কী করছে ও
একা এখানে বসে? দুজনেই তো খেয়েদেয়ে পাশাপাশি বিছানায় গেল ঘুমোতে। গুনগুনের
চোখটা বুজে এসেছিল সবে। মামাবাড়ির এদিকটা এমনিতেই চুপচাপ। নীচতলায় পুরনো আমলের
অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে ঘরগুলো। আলো বাতাস বেশি আসে না চারপাশের গায়ে গায়ে লেগে থাকা
গাছপালার ঘন বুনোট ভেদ করে। তারপরই পেছনের উঠোন। আর উঠোন পেরোলেই বিশাল বাগান।
নিঝুম দুপুরে রাধাচূড়াগাছটার ঠিক নীচে ঘাড় গুঁজে বসে বিন্নিদিদি একরাশ রান্নাবাটি নিয়ে
মিছিমিছি রান্না-রান্না খেলছে।
কী
কাণ্ড! একে তো খেলনা রান্নাবাটির বাহারের কোনও সীমা নেই। সাইজেই শুধু কুট্টি
কুট্টি। কিন্তু দেখতে একদম আসলের মতো। নিখুঁত! লোহার উনুন, লোহার কড়াই,
হাতা-খুন্তি, ডেকচি, হাঁড়ি যেদিকে চোখ যায় মনে হচ্ছে যেন লিলিপুট মানুষের কিচেন।
তার উপর বিন্নিদিদি কতগুলো ছোট ছোট থালায় পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছে সত্যিকারের
আলু। চৌকো করে কাটা। ঢাকনা খোলা হাঁড়ির ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে সত্যি সত্যি ননিয়া
চাল আর সোনামুগের ডাল। পাশের ছোট্ট রেকাবিতে অল্প অল্প করে নুন, হলুদ, লঙ্কার
গুঁড়ো, আদা-রসুন কুচি, শিশিতে সর্ষের তেল, আরও কত কী! উফ্, আয়োজনের আর শেষ নেই।
এখন বিন্নিদিদি ছোট্ট বটিতে ডুমো ডুমো করে বেগুন কাটছে। বেগুনভাজার
জন্য। আবার ময়দাও ঢেলে রাখা আছে। ময়দার ঢিপির মাথায় দুই আঙুল ডুবিয়ে ছোট্ট এক ফুটো আর সেই
ফুটোর কানায় কানায় টলটল করছে মামির নিজের হাতে তৈরি ঘি। তার মানে লুচিও হবে। কী
মজা! খুশিতে উছলে উঠল গুনগুন। তারপর থেবড়ে বসে পড়ল বিন্নিদিদির পাশে। আর তো কিছু করারও
নেই। কাঁহাতক ঘুমিয়ে আর গল্পের বই পড়ে সময় কাটানো যায় বলো দেখি?
গুনগুনের মামাবাড়িটা কেন যে
এমন জায়গায় কে জানে। কাছাকাছি কোথাও একটা পার্ক নেই। মাল্টিপ্লেক্স নেই। শপিং
সেন্টার নেই। কিচ্ছু নেই। ধুর, ভাল্লাগে না। থাকার মধ্যে কেবল যতদূর চোখ যায় সবুজ
উঁচু টিলা আর ধানক্ষেত। সন্ধে থেকেই একটানা ঝিঁঝিঁর ডাকে কান
ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। চ্যা চ্যা করে প্যাঁচা ডেকে ওঠে যখন
তখন। একদিন ময়ূরের ডাকও শুনেছিল গুনগুন। মামাই
বলেছিলেন, “ঐ যে দূরে দেখছিস টিলার মাথায় ঘন জঙ্গলটা? ওর নাম টুকুরিয়া ঝাড়। রাতে ওখান
থেকে পালে পালে নেমে আসে বুনো হাতির দল। পাকা ধান খাওয়ার লোভে।
বেচারাদের খাবার কমে গেছে কিনা। ধানক্ষেতের ভেতরে উঁচু উঁচু টংঘর আছে। লোকে সেখানে
বসে ধান পাহারা দেয়। তাদের হাতে থাকে চকোলেট বোম। গহীন রাতে দুমদাম আওয়াজে ঘুম
ভেঙে যায় এলাকার লোকেদের। চাঁদনী রাতে এই বাগানে মাদুর পেতে শুয়ে আকাশের দিকে
তাকালে কেমন একটা ঝিমঝিমে ঘোর লেগে যায়। মনে হয় আলোর চাঁদোয়া বিছানো আছে মাথার
উপরে আর আকাশটা যেন দুম করে অনেকখানি নিচে নেমে এসেছে।”
গুনগুনের কাছে তাই এই
নকশালবাড়ি একটা ভারী রহস্যময় জায়গা। স্কুল, ড্রয়িং ক্লাস, কার্টুন, সুইমিং ক্লাস
এসবের বাইরে একটা অন্য জগত। এখানে ওর সঙ্গী বলতে ওর চাইতে বছর পাঁচেকের বড়ো মামাতো
দিদি বিন্নি। কিন্তু সে তো বেশিরভাগ সময়ই নিজের আনন্দে
মেতে থাকে। কখনও উ উ করে গান গায়। কখনও বাগানে গিয়ে আধো আধো স্বরে আঙুল নাড়িয়ে
নানা ভঙ্গীতে কত গল্প করে গাছেদের সঙ্গে। গুনগুন আদ্ধেকের বেশি বুঝতে পারে না তা। ও যেদিন
মামাবাড়িতে এসে পৌঁছল, বিন্নিদিদি খুব উত্তেজিত হয়ে কী যেন বলার চেষ্টা করছিল। গুনগুন
ওর কাছে গিয়ে মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকেও উদ্ধার করতে পারছিল না কথাগুলো।
মামি ওদের কাছে এসে হেসে বলেছিলেন গুনগুনকে, “বুঝতে পারছিস না? ও তোকে দেখে খুব
খুশি হয়েছে রে! সেটাই বলতে চাইছে।” গুনগুন লক্ষ করেছিল, কথাগুলো বলার সময় মামির
চোখদুটো যেন ছলছল করে উঠেছিল।
বিন্নিদিদি গুনগুনকে দেখে
একগাল হাসল। তারপর ইশারায় দেখাল ছোট্ট শিলনোড়াটা। মশলা বাটতে বলছে। আর ও নিজে
দিব্যি ময়দা মেখে রুটি বেলার ছোট্ট বেলনা চাকিতে খুদে খুদে গোল গোল লুচি বেলছে মন
দিয়ে। বিন্নিদিদির মাথায় একটা দুটো রাধাচূড়া ফুলের হলুদ পাপড়ি টুপটুপ করে ঝরে
পড়ছে। উমনো ঝুমনো চুলের প্রান্তে লেগে রয়েছে হলুদ রেণু। কী যে অন্যরকম লাগছে চেনা বিন্নিদিদিকে
আজ! ডানদিকের শিউলিগাছটা থেকে টুপটাপ ক’টা ফুল খসে পড়তেই গুনগুন তাকাল সেদিকে।
দুটো পাতার মাঝে জমে ওঠা মাকড়সার জালে একটা হলুদপাতার শুকনো ডাল আটকে ঝুলে আছে।
বাতাসে ঘূর্ণির মতো বাঁই বাঁই করে পাক খাচ্ছে পাতাটা। এত জোরে জোরে ঘুরছে যে মাঝে
মাঝে মনে হচ্ছে পাতা-টাতা নেই। বরং একটা হলদেটে আভা শুধু ভেসে আছে শূন্যে। পাক
খেতে খেতে হঠাৎই পাতাটা খসে পড়ল মাটিতে। যেখানে পড়ল সেদিকে তাকিয়েই ভীষণ চমকে গেল গুনগুন। একটা
ছোট্ট কাঠের পুতুলের সাইজের সত্যিকারের গোলাপি মেয়ে তার চাইতেও খুদে আরেকটি
জ্যান্ত মেয়ে পুতুলের হাত ধরে খুটখুট করে এসে হাজির হয়েছে কোথা থেকে আর ড্যাবড্যাব
করে তাকিয়ে আছে এদিকেই।
ওদের দেখেই চমকে যাওয়ার বদলে
প্রথমেই খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল বিন্নিদিদি। কিন্তু তারপরই উচ্ছ্বাস মিলিয়ে এল
ওর। গুনগুন দেখল পুতুল-মানুষদুটো ক্ষীণ স্বরে ‘স্কিকুই স্কিকুই কিচি কিচ’ করে কীসব
যেন বলছে আর বিন্নিদিদি উবু হয়ে বসে তাদের মুখের
কাছে কান নিয়ে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছে সেই অজানা ভাষা। তার মুখে উদ্বেগ ঘনিয়ে আসছে
ক্রমশ। এদিকে গুনগুনের গলা শুকিয়ে এসেছে ভয়ে আর চোখের পলক পড়ছে না বিস্ময়ে। বুক
ঢিবঢিব করছে বড্ড। কিন্তু বিন্নিদিদির কোনও ভয়ডর নেই। হাতের তেলোতে পুতুল-মেয়েদুটোকে
যত্ন করে করে তুলে নিয়ে ও এবার
দৌড় লাগিয়েছে বাগানের আরও গভীরে। অগত্যা পেছন পেছন ছুটল হতভম্ব হয়ে যাওয়া গুনগুনও।
বেশ কিছুটা গিয়ে ময়লা ফেলার
বিশাল বড়ো গর্তটার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়াল বিন্নিদিদি। ঝুঁকে দেখল গর্তের ভেতরে। গুনগুন
স্পষ্ট শুনতে পেল ওর মুখ থেকে ছিটকে এল কয়েকটা আওয়াজ, ঠিক যেমনটি একটু আগেই শুনেছিল
ও ঐ পুতুল-মানুষদের মুখ থেকে। বিন্নিদিদির কথা
শুনেই পুতুল মেয়েদুটোর মধ্যে খুব লাফঝাঁপ বেড়ে গেল। বিন্নিদিদি ওদের উদ্দেশে আবার
কিছু একটা বলে মাটিতে সটান
শুয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল গর্তের ভিতরে। ফণীমনসার ভাঙা ডালগুলোর আড়াল সরিয়ে বের করে আনল
একটা খুদে ছেলে পুতুল-মানুষকে। বেচারি মনে হয় লাফাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল গর্তে। এর
গায়ের রঙ কিন্তু গোলাপি নয়। গাঢ় নীল। গোলাপি পুতুলদুটো আনন্দে লাফাচ্ছিল তুরুং
তুরুং করে। বিন্নিদিদির হাতের মুঠোয় এবার তিনজনই উঠে চেপে বসল আরাম করে। তারপর ওরা
সকলে মিলে ফিরে এল সেই রাধাচূড়াগাছের তলায়।
ততক্ষণে গাছতলা ভরে উঠেছে আরও
ছোট্ট ছোট্ট গোলাপি-নীলে। এছাড়াও উড়ছে রঙবেরঙের প্রজাপতি। উড়ছে টিয়ে, বুলবুল,
দোয়েল, বসন্তবৌরি, এমন কত বাহারে পাখি। কোথা থেকে একজোড়া কাঠবেড়ালি এসে লাফালাফি
আরম্ভ করে দিল। পুতুল-মানুষেরা সবাই মিলে কী চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিল! যেন চিয়ার-আপ
করছে বিন্নিদিদিকে। এরই মধ্যে ওরা কোত্থেকে কাঠকুটো জোগাড় করে এনে উনুন-টুনুন
ধরিয়ে পুরোদস্তুর রান্নাবান্নাও শুরু করে দিয়েছে। লুচি, আলুর দম, ভুনি খিচুড়ি আর
বেগুন ভাজার দিলখুশ করা গন্ধে জিভে জল আসছিল প্রত্যেকেরই। রান্না হয়ে গেলে বিন্নিদিদি
সবাইকে অ্যাত্তটুকু-টুকু থালায় খাবার বেড়ে দিল। সার বেঁধে গাছতলায় বসে
পুতুল-মানুষদের সঙ্গে গুনগুনও পেট পুরে খেল সেই আজব ভোজ।
এদিকে ফুরিয়ে যাওয়া দুপুরটার শেষ রোদ্দুর এসে পড়ছিল রাধাচূড়াগাছের মাথায়। শিরশিরে
হেমন্তের বাতাসে কাঁপন লাগা ফুলেরা সেই রোদ্দুর মেখে খসে খসে পড়ছিল বিন্নিদিদির
মাথার ওপর। ওকে দেখতে ঠিক যেন বনদেবীর মতো লাগছিল।
আজ গুনগুন অনেক বড়ো হয়ে গেছে।
মামাবাড়িটাও বদলে গেছে একদম। পেছনের সেই বাগানে এখন বিশাল পাঁচতলা এক ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। বিন্নিদিদিও আর
নেই। ঐ সত্যিকারের পুতুল-মানুষগুলো কোথায় যে গিয়ে লুকিয়েছে তাই বা কে জানে? কিন্তু
সেই মিষ্টি দুপুরবেলাটা গুনগুনের মনে জলছবির মতো আঁকা আছে। চোখ বুজলেই ভেসে আসে
শিউলি ফুলের সুবাস। রাধাচূড়া ফুলের রঙে ছোপানো সেই ঝিকিমিকি দুপুরটা চিরকালের জন্য
সত্যিকারের রূপকথার মতোই জীবন্ত হয়ে মিশে থাকবে
ওর চেতনায়।
_____
অলঙ্করণঃ সুজাতা ব্যানার্জি
Mishti mayabhora golpo
ReplyDeletekhub sundor
ReplyDelete