মেঘলাপুর
জয়দীপ চক্রবর্তী
মেঘলাপুর মেঘলাপুর
কাছেই, আবার অনেক দূর
গাছপালায় গা ছম ছম
পাখপাখালি একটু কম
রাজামশাই, গোমড়ামুখ
কেউ জানে তাঁর কীসের দুখ?
মেঘলাপুর কোথায় তা কে জানে! পুরনো যারা লোকজন তাঁরা বলেন মেঘলাপুর কাছে, আবার দূরেও। ছোটরা তো সে কথা
শুনে হাঁ মুখ বুজোতেই পারে না। এ আবার কেমন অদ্ভুত কথা! একটা জায়গা একই সঙ্গে কাছে
আবার দূরে! এ আবার হয় নাকি? অথচ বড়োরা বলে, “হয় মানে! আলবাত হয়, একশবার হয়। এই
যেমন ধরো না কেন আকাশের ওই চাঁদটি। সে যেমন দূর আকাশে তেমনি আবার মিত্তিরপুকুরের
জলের মাঝ-মদ্যিখানেও দিব্বি চকচক করে আলো ছড়াচ্ছে।”
ফটিক হো হো করে হেসে বলে, “ধুস,
জলের মাঝখানে চাঁদ কই? ওটা তো চাঁদের ছায়া।”
“ছায়া মনে করলেই ছায়া, বুঝেচো
ভায়া,” একগাল হেসে অমনি বলে ওঠে নেপালদাদু, “ওই মেঘলাপুর জায়গাটাই যে ছায়া ছায়া গো। সেখানে
মেঘ ফুঁড়ে রোদ্দুর উঠতে চায় না, আলিস্যি করে। গাছেরা ফল ফলাতে চায় না, ফুল ফোটাতে
চায় না।”
“কেন কেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস
করে ফটিক।
“সেখেনে যাইনি তো কোনোদিন,”
নেপালদাদু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, “সেই কোন এক কালে আমাদের গ্রামের ভজন বৈরাগী গান গাইতে
গাইতে পথ ভুলে গিয়ে পড়েছিল একবার মেঘলাপুরে।”
“তারপর, তারপর?” চোখ গোল গোল
করে জিজ্ঞেস করে ফটিক।
“সত্যি শুনবি ফটিক?”
“শুনবই তো।”
“সে জায়গার কথা ভরসা করে কেউ
যে শুনতে চায় না রে মানিক!”
“কেন গো নেপালদাদু?”
“মেঘলাপুর ভারী গোলমেলে জায়গা
যে রে ভাই।”
“কীরকম, কীরকম?”
“শোন তবে বলি,” বলে আকাশের
দিকে মুখ তুলে বলতে থাকে নেপালদাদু,
“মেঘলাপুর
আঁধারপুর
অন্ধকারের সমুদ্দুর
আলোর সাথে আড়ি।”
“আলোর সাথে আড়ি কেন?”
নেপালদাদুর কথার মাঝেই বলে ফটিক।
“আহা ওখানকার যিনি রাজা,
তাঁরা যে চিরকাল অন্ধকারের পুজো করে আসছেন গো। অন্ধকারই ওনাদের উপাস্য, ওনাদের
দেবতা। রাজারা আলো সহ্যই করতে পারেন না। চোখে ধাঁধা লেগে যায় তাঁদের আলো দেখলে।
তাছাড়া...”
“তাছাড়া?”
‘‘কত আর বলি তোমায় মানিক,’’
নেপালদাদু বলতে থাকেন,
“অন্ধকারের পুজো করেন যাঁরা
আলো দেখা তাঁদের ভারী পাপ
আলো তো ওই অন্ধকারের যম
আলোয় পুড়ে আঁধার পড়ে মারা
মেঘলাপুরের আঁধারখেকো রাজা
কালোয় মুড়ে রেখে সকল আলো
দুয়ার এঁটে লুকিয়ে সারাদিন
মেঘলাপুরের চেয়েছিলেন ভালো।’’
‘‘যাহ, তা আবার হয় নাকি!’’
প্রতিবাদ করে বলে ওঠে ফটিক, “আলো আটকে দিলে যে গাছপালা খেতেই পাবে না আর। তাদের
পাতায় পাতায় সূর্যের আলো এসে যে রোজ রান্না করে দিয়ে যায়।’’
‘‘সে কথা তুমি আমি বুঝলে তো
হবে না,’’ হতাশ গলায় বলেন নেপালদাদু, “কথাটা তো রাজাকে বুঝতে হবে।’’
‘‘রাজা কি কিছুই বোঝেন না?’’
‘‘উঁহু। বুঝতে ভয় পান হয়তো। হাজার
হোক পুরনো প্রথা... আঁধারের অর্চনা ছেড়ে দুম করে আলোর উপাসনা করা কি আর সহজ কথা!
তা একজন সেই অর্চনা করেছিল। লুকিয়ে। ভেবেছিল গোপনে গোপনে যদি মেঘলাপুরে একবার আলো
ঢুকিয়ে দেওয়া যায় পুরনো ঝুল পড়া অন্ধকারের মস্ত মস্ত আকাশ আড়াল করা চাঁদোয়াগুলোকে
ছিঁড়েকুটে দিয়ে, তাহলে রাজ্যজুড়ে যে মানুষগুলো চোখ বুজিয়ে রাস্তায় হাঁটে তাদের
চোখগুলো খুলে দেওয়া যায়।’’
“ওমা, এ আবার কী কথা
নেপালদাদু?’’ অবাক হয়ে বলে ফটিক, ‘‘মেঘলাপুরের মানুষ চোখ বুজিয়ে রাস্তায় হাঁটে!
তাদের পথ গুলিয়ে যায় না?’’
‘‘তা আবার যায় না! খুবই যায়।
গন্তব্যে তাই বেশিরভাগ মানুষই পৌঁছতে পারে না। পথ গুলিয়ে ফেলে গোলোকধাঁধায় ঘুরপাক
খেতে থাকে রাত্রিদিন।’’
‘‘তবু চোখ খোলে না?’’
‘‘না।”
“কেন?’’
‘‘বারণ যে!’’
‘‘কার বারণ?’’
‘‘রাজার।”
‘‘কেন বারণ, নেপালদাদু?”
নেপালদাদু ফটিকের প্রশ্ন শুনে
ডানদিক বাঁদিক মাথা নাড়ান খানিক। তারপর বলতে থাকেন,
“চোখ খুললেই আলো।
আলোয় আলোয় লেখা থাকে
মন্দ এবং ভালো।
মন্দ ভালো যে মানুষটা জানে
সে কি তখন কারও শাসন মানে?
নিজেই তখন
দিব্বি চিনে নেয় সে নিজের পথ
রাজার কাছে এই চেনাটাই
বড্ড যে বদখত।’’
‘‘তবুও কে যেন একজন সেই
মেঘলাপুরে আলো আনার চেষ্টা করেছিল, বলছিলে যেন তুমি?’’
‘‘হুঁ,’’ বলেই গম্ভীর হয়ে গেল
নেপালদাদু।
‘‘সে কে নেপালদাদু?’’
‘‘সে এক ফকির। তার ঘরদোর ছিল
না। আশা-আকাঙ্ক্ষাও ছিল না কোনও। সে কেবল পথ
চলত। নিত্যনতুন পথ আবিষ্কার করার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত সে। পথ চলত আর চলতি পথে
গাছপালা পশুপক্ষী যাদেরই দেখত থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে কথা কইত তাদের সঙ্গে।”
‘‘ধুস, কী যে বলো!’’ প্রতিবাদ
করে ওঠে ফটিক, ‘‘তা আবার হয় নাকি? গাছপালা কথা কইবে কেমন করে? পশুপাখির সঙ্গেই বা
কথা বলা যাবে কী উপায়ে! এসব বানানো কথা। সত্যি কি এসব হয় নাকি?’’
‘‘হয় গো, হয়। তাদের ভাষা
জানলে ঠিকই হয়। ফকির যে তাদের ভাষা, তাদের ভাব জানত, বুঝত। তারাই তো সেই ফকিরকে
চোখ বুজিয়ে হাঁটতে বারণ করেছিল। তারা তাকে দেখিয়েছিল অন্ধকারে মোড়া পৃথিবীর চেয়ে
আলোয় ছেয়ে থাকা পৃথিবীটা আরও কত সুন্দর।”
‘‘তারপর কী হল?’’
‘‘তারপর?’’ বলে চোখ বুজলেন
নেপালদাদু। মনের মধ্যে উত্তর খুঁজলেন কিছুক্ষণ। তারপর মৃদু স্বরে বলতে শুরু করলেন
আবার,
‘‘হাঁটছে ফকির,
চলছে ফকির,
তুলছে সে হাত ওই আকাশের দিকে
হাত গড়িয়ে নামছে আলো
আলোয় মাখা সকল ভালোয়
আঁধার হল ফিকে
তখন গাছের শাখায় পাখি
করল শুরু ডাকাডাকি
চমকে জেগে উঠল ফুটে ফুল
সোনারঙের নতুন রোদে
ঘাসেরা সব চক্ষু মোদে
ঝিলিক মেরে ওঠে
শিশিরদুল।’’
‘দারুণ ব্যাপার তো!” আনন্দে
হাততালি দিয়ে ওঠে ফটিক, ‘‘তাহলে মেঘলাপুরের আঁধার সেই ফকির ঘুচিয়ে দিল চিরদিনের
জন্যে?’’
‘‘তা আর পারল কই বল,’’
নেপালদাদুর গলায় হতাশার সুর ফুটল, ‘‘সে যে এক্কেবারে একা লড়াইটা শুরু করেছিল দাদু।
কাজেই রাজার পাইক বন্দি করে ফেলল তাকে সহজেই।’’
‘‘ইশ,’’ কপালে হাত দিয়ে বলে
ফটিক, ‘‘এখন তবে কী উপায় হবে?’’
‘‘উপায় একটাই।’’
‘‘কী?’’
‘‘লড়াইটা ছড়িয়ে দিতে হবে।
অনেকের মধ্যে। সকলের মধ্যে। আলোয় ফেরার লড়াই।’’
‘‘কিন্তু মেঘলাপুরে পৌঁছব কী
করে? আমার কি পক্ষিরাজ ঘোড়া আছে?’’
‘‘আছেই তো।’’
‘‘ধুস।’’
‘‘আছে আছে। একলা একলা নিজের
মনের মধ্যে কান পাতিস। দেখবি সে পা ঠুকছে তোকে সওয়ারি করার জন্যে। তার ডাকও শুনতে
পারিস তুই ইচ্ছে করলেই। আর তারপরেই ওই ঘোড়ায় চেপে সোজা সবাই মিলে পাড়ি দিতে হবে
আঁধারপুর মেঘলাপুরে। দু’হাতের আঁজলা ভরে আলো ছড়াতে ছড়াতে। তখন সেই ফকিরকেও রাজার
পাইক বরকন্দাজরা আর বন্দি করে রাখতে সাহস পাবে না। আর আমরা সকলে মিলে সেই আশ্চর্য
ফকিরকে সাথে নিয়ে সেই কুচ্ছিত অন্ধকারের চাঁদোয়াগুলো টান মেরে খুলে দেব। আকাশ
ফুঁড়ে লাফিয়ে নেমে আসবে আলো। মাটির ওপরে। ভেজা ঘাসের ওপরে। গাছের পাতায়, নদীর
ধারে। এমনকি, রাজার মস্ত প্রাসাদের আঁধার আড়ালও হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে তখন। আলোয়
আলোয় অন্ধ হয়ে যাবে সব অন্ধকার।’’
ফটিকের ঘোর লেগে গেল। চোখ
বুজিয়ে ফেলল সে। মন ছুটতে থাকল মনের আরও গভীর গহনে। তখনই ধপধপে সাদা একটা পক্ষিরাজ
ঘোড়া তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পা ঠুকে ঠুকে বার বার বলতে লাগল তাকে,
“আয় ওঠ ওঠ ওঠ
চল ছোট ছোট ছোট
মনের মধ্যে আবারও তুই তাকা
ওই চেয়ে দেখ আলোয় আলোয় মাখা
মেঘলাপুরই, ওটাই মেঘলাপুর
সত্যি সত্যি নয় সে বেশিদূর।’’
একঝাঁক পাখি অমনি হই হই করে
উড়ে এসে ঘুরতে থাকে তার মাথার ওপরে আর চিল্লে চিল্লে বলতে থাকে,
‘‘মেঘলাপুরের মেঘ সরে যাক দূরে
আমরা আবার গাইব নতুন সুরে
আয় মেলে দিই সবার রঙিন ডানা
আলোয় ফেরার আর কোনও নেই মানা।’’
মৌমাছি আর প্রজাপতিরাও মনের
মধ্যে দিয়ে উড়তে উড়তে মেঘলাপুরের দিকে রওনা হয়ে গেল দল বেঁধে। দূরে বাতাস বইছে।
সেই বাতাসে বাতাসে চিঠি পাঠাচ্ছে গাছেরা। রঙিন খামে ভরা সব চিঠি। সূর্যের আলো দিয়ে
সেই চিঠিজুড়ে লেখা,
‘‘ফটিক, লক্ষ্মী সোনামানিক ছেলে
তোদের মতন এমন ছেলে পেলে
মেঘলাপুরের আঁধার কি আর থাকে?
ওই চেয়ে দেখ আঁধারপুরও
তোদের পেয়ে আলোর ছবি আঁকে
আয় সোনা আয় বুকে
সবাই মিলে আলোয় মিশে
জীবন কাটাই সুখে।’’
সেই চিঠিগুলোই আকাশে গোল হয়ে
উড়তে উড়তে, ঘুরপাক খেতে খেতে একটা মানুষের মাথার ওপরে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়তে লাগল।
সে মানুষটার একমাথা উসকোখুসকো চুল। গায়ে রং-বেরঙের তাপ্পি মারা আলখাল্লা, কাঁধে
ঝোলা। সে আকাশের দিকে হাত তুলল। তার দু’হাত বেয়ে নামতে লাগল আলো, আলো, আলো। ফটিক
মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘‘তুমিই কি সেই ফকির?’’
‘‘হুঁ,’’ ফকির হাসতে হাসতে
জবাব দিল।
‘‘তোমায় কে মুক্ত করল?’’
‘‘তোমাদের আনা আলো,’’ বলে
আবার হো হো করে হাসতে লাগল সেই ফকির আর হাতছানি দিয়ে বার বার কাছে ডাকতে লাগল
ফটিককে। বলতে লাগল, “আয় ফটিক, পাখিদের ভাষা শিখবি আয়, গাছেদের ভাষা শিখবি আয়, আলোর
স্রোতকে পৃথিবীর দিকে নামিয়ে আনার মন্ত্র শিখবি আয়।’’
এই ডাক কতক্ষণ আর উপেক্ষা করা
যায় বল? কাজেই আর কোনোদিকে না তাকিয়ে মনের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা পক্ষিরাজের পিঠের
ওপরে লাফিয়ে উঠে পড়ে ফটিক। আর পক্ষিরাজ ঘোড়াটাও পেল্লায় ডানা ঝাপটে উড়ে চলতে থাকে
মেঘলাপুরের দিকে। যেখানে মেঘ ছিঁড়েকুটে গিয়ে আলো চুঁইয়ে নেমেছে বহুদিন পরে।
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জি
Khub bhalo legeche..
ReplyDeleteভালো লাগল।
ReplyDelete