অরণ্যসবুজ রূপকথা
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
দ্বৈতা হাজরা গোস্বামী
সবুজের জ্ঞান ফিরল যখন, দেখল সে কয়েদখানায় মধ্যে। কে বা কারা তাকে বন্দি করেছে মনে করতে পারল না। ঘাড়ে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। সবুজ দেখল অন্ধকার জেলখানার মাথার ওপর একটা জানলা; সেই জানলা দিয়ে একটু আলো এসে পড়ছে। কতক্ষণ এখানে আছে সবুজ জানে না। জ্ঞান ফিরতেই সবুজের আবার জলতেষ্টা পেল খুব। জলের একটা বড়ো জালা দেখতে পেল সবুজ। কিন্তু তাতে একটুও জল নেই। হঠাৎ কিচকিচ একটা শব্দে সবুজের চোখ গেল ছোট্ট পাথরের জানালাটার দিকে। একটা ছোট্ট লাল রঙের পাখি উড়ে এসে সেখানে বসেছে। আর এদিক সেদিক লাফাচ্ছে। কালো পুঁতির মতো চোখ ঘুরিয়ে মনে হল সবুজকেই দেখছে। পাখিটা হঠাৎ ফুড়ুৎ করে কয়েদখানার পাথরের মেঝের ওপরে এসে বসল।
“তোমার কি খুব জল তেষ্টা পেয়েছে? তোমাকে দেখে তো খুব ভালোমানুষ মনে হচ্ছে,” পাখি বলল।
“আজ অব্দি তো কোনও খারাপ কাজ করিনি,” সবুজ তার ছেলেমানুষি ভরা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল।
পাখি তার কালো পুঁতির মতো চোখ ঘুরিয়ে, লেজ নাড়াল, “বা রে, তুমি বুঝি পাখিদের ভাষাও বোঝো?”
“আমি প্রকৃতির সব ভাষাই বুঝি। কিন্তু তোমাদের দেশের অতিথি আপ্যায়নের ভাষা বুঝলাম না। আগন্তুকদের সঙ্গে বুঝি এখানে এমন আচরণ করা হয়?”
পাখি উত্তর না দিয়ে বলল, “আমি কিন্তু এই জায়গা থেকে বেরনোর একটা গোপন রাস্তা জানি। ওই জলের পাত্রটার নিচে একটা বড়ো পাথর আছে। ওটা আগে সরাও।”
পাখিটার কথামতো সবুজ তাই করল। পাথর সরাতেই কী আশ্চর্য, নিচে দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে! ওই সুড়ঙ্গের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকল সবুজ। বেশ লম্বা সুড়ঙ্গ। অনেকদূরে একটা আলো দেখা যাচ্ছে। ওটাই বোধহয় বেরনোর রাস্তা। আলোটাকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেল সবুজ। সুড়ঙ্গটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান দিয়ে একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। উফফ্, এতক্ষণে জলের দেখা মিলল। জলই যে জীবন, সবুজ যেন নতুন করে বুঝল। আঁজলা ভরে খুশিমতো জল পান করল সবুজ। পাখিটা আবার এসে উপস্থিত। কিচকিচ করে সবুজের চারদিকে উড়তে লাগল। তারপর হাতে এসে বসল। সবুজের জামার সঙ্গে বাঁধা একটা থলেতে কিছু ছোলা ছিল। সবুজ সেটা বের করে হাতে নিয়ে পাখিটাকে খেতে দিল। পাখিটা সেটা মহাফুর্তিতে খেয়ে নিয়ে বলল, “তুমি যেখানে বন্দি ছিলে, সেটা কালো রাজার কয়েদখানা।”
“কালো রাজা? সে কে?”
“কালো রাজা একদম ভালো নয় গো। তার মনটা বড়ো কালো। সে কারোর ভালো দেখতে পারে না। আগে এই রাজ্য কত সুন্দর ছিল। শস্যশ্যামলা ছিল, গাছে গাছে কত পাখি ছিল। কালো রাজা সব গাছ কেটে ফেলেছে আর এক বিশাল দুর্গ বানিয়েছে।”
“আমার নাম সবুজ। আমার বাবা খুব অসুস্থ। তার জন্য আমি হৃদয়ফলের খোঁজে এখানে এসেছি। সেটা নাকি একমাত্র দেবী অরণ্যানীর মন্দিরেই আছে। তুমি জান, সেই মন্দির কোথায়?”
“নদীর ওপারে যে ঘন বন দেখছ, ওখানেই রয়েছে দেবী অরণ্যানীর মন্দির। মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে আকাশ সমান উঁচু গাছেরা। তাদের ডালপালা থেকে বিষাক্ত সাপেরা ঝোলে যারা ওই মন্দির পাহারা দেয়। কালো রাজা যতই অত্যাচারী হোক না কেন ওই মন্দিরের কোনও অনিষ্ট করতে ভয় পায়। আগে নদীর এপার ওপার সবটা জুড়েই আমাদের রাজ্য ছিল। তারপর হঠাৎ একদিন অন্ধকার ঘনিয়ে এল। কালো রাজা আর তার অত্যাচারী সৈন্যসামন্ত আমাদের ভালো রাজা সুমন্তকে বন্দি করল। প্রাসাদের সবাই যে যেখানে পারল পালিয়ে গেল,” এতদূর বলে পাখিটা হঠাৎ থামল। তারপর বলল, “ওরে বাবা, পাখিধরাটা আসছে। আমি এখন পালাই।” এই বলে ফুড়ুৎ করে উড়ে পালাল।
সবুজ শুনতে পেল পেছনে জুতোর আওয়াজ। একটা রোগা, লম্বা, টিংটিঙে লোক খুব তাড়াতাড়ি এদিকেই আসছে। সবুজকে দেখেই হেসে বলল, “ভিনদেশের লোক মনে হচ্ছে?”
সবুজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি কে?”
লোকটা নিজের পরিচয় দিল। “আমি হলাম অনমিত্র। ওই জঙ্গলের মধ্যে আমার বাড়ি। জঙ্গলে থাকি পাঁচদিন আর হাটে যাই দু’দিন। তুমি কি কয়েদখানা থেকে পালিয়েছে হে?”
“কেন?”
অনমিত্র চোখ নাচিয়ে বলল, “কালো রাজার চরেরা তোমায় তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। বুঝলে? এবার ধরা পড়লে মুন্ডু নিয়ে নেবে। এই রাজ্যে ভিনদেশিদের একদম প্রবেশ নিষেধ।”
“সে তো বুঝলাম। কিন্তু আমি যে একটা কাজে এসেছি। সেটা না করে তো যাব না।”
“থাকার জায়গা আছে তোমার? আমার বাড়িতে থাকতে পার। আমি একাই থাকি।”
সবুজ রাজি হল।
নদীর ওপর দিয়ে একটা ঝুলন্ত সাঁকো। খুব সাবধানে দড়ি ধরে পার হল দু’জনে। সন্ধে নেমে এসেছে। সবুজ রঙের অন্ধকার বনের পথে ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিকে মিটমিটে জোনাকির জটলা। এক অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ। একটা লাঠি দিয়ে অনমিত্র গাছের ঝাড়গুলো সরিয়ে সরিয়ে এগিয়ে চলেছে। একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরের সামনে অনমিত্র থামল। লাঠিটা রেখে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে একটা কুপির আলো জ্বেলে দিল। একপাশে একটা বিছানা। সেখানে সবুজকে বসতে বলল সে। একটু পরে দুটো রুটি আর গুড় সবুজকে এনে দিল। সবুজের খুব খিদে পেয়েছিল। খেয়ে তার খুব ঘুম পেল। অনমিত্র বলল, “তুমি ঘুমিয়ে নাও ভাই। পাশের ঘরেই আছি আমি।”
রাত তখন বেশ গভীর। সবুজও ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ একটা অদ্ভুত ডাক শুনতে পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল সবুজের। টি টি টি করে ডাকছে সেই লাল পাখিটা। ঘরের জানলায় এসে বসেছে, “সবুজ, তুমি পালাও এখান থেকে এক্ষুনি।”
“কেন?”
“তুমি ওই পাখিধরা অনমিত্রকে বিশ্বাস করলে? ও রংবেরঙের পাখিদের জঙ্গল থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হাটে বিক্রি করে। তোমাকে খোঁজার জন্য কালো রাজা পুরস্কার দেবে, তাই ও খবর দিতে গেছে। আর একটু পরেই রাজার সৈন্যরা এসে হাজির হবে। শুনতে পাচ্ছ না ঘোড়ার খুরের শব্দ? পালাও সবুজ, পালাও।”
সবুজ কান পেতে শুনল। সত্যি মনে হচ্ছে দূর থেকে অনেকগুলো ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে আসছে রাতের অন্ধকারকে ভেদ করে। পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল সবুজ অন্ধকার জঙ্গলের পথে। পাখি বলল, “একটু দূরে একটা উঁচু গাছ আছে সবুজ। তার ওপরে উঠে বাকি রাতটা কোনোরকমভাবে কাটিয়ে নাও। কাল সকালে কোনও নিরাপদ জায়গায় যাওয়া যাবে।”
সকালে উঠে সবুজ গাছ থেকে নেমে পাখিকে অনুসরণ করে আবার চলতে শুরু করল। পথে গাছের কিছু মিষ্টি ফল খেল। ঝর্ণার জলে তেষ্টা মেটাল। গতরাতের কথা মনে করে খুব কষ্ট পেল সবুজ। মানুষ হয়ে মানুষকে বিশ্বাস করতেই তো তার বাবা তাকে শিখিয়েছে।
পাখি বোধহয় সবুজের মনের কথা বুঝতে পারছিল। বলল, “আচ্ছা সবুজ, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ। আমিও তো তোমায় ঠকাতে পারি।”
“কেউ বিশ্বাস ভেঙেছে বলে কি বিশ্বাস করা ছেড়ে দেব? জান পাখি, আমার বাবা বলেন, ভালোবাসা আর বন্ধুতা দিয়ে সবাইকে ভালো করা যায়। হিংসে, ঘৃণা, স্বার্থপরতা আমাদের মনের অসুখ মাত্র।”
“তোমার বাবা ঠিকই বলেন। তা তুমি পাখিদের ভাষা শিখলে কোথা থেকে?”
“আমি ছোটোবেলা থেকেই পারি। আমার জন্ম হয়েছিল প্রকৃতির মধ্যে। আমার বাবা আগে এক কাঠুরে ছিল। একদিন জঙ্গলে গাছ কাটতে গিয়ে বাবার একটা অদ্ভুত
ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়। একটা বড়ো, বহু প্রাচীন গাছ বাবা কাটতে গিয়েছিল। তার গুঁড়িতে কুঠারাঘাত করতেই সেই গাছের বাকল থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করে। তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে আসে বাতাসে। বাবা সেখানে কুঠারটা ফেলে রেখে পালিয়ে আসে। তারপর অনেকদিন বাবা কাঠ কাটতে যায়নি। একদিন হঠাৎ সাহস করে বাবা আবার ওই গাছের কাছে যায়। দেখে তার ক্ষত শুকিয়ে এসেছে কিন্তু রক্তের দাগ তখনও লেগে আছে গায়ে। বাবা গাছটার কাছে গিয়ে গাছের গায়ে হাত বোলাতেই একটা অদ্ভুত জিনিস হয়। গাছের কোটরের ভেতর থেকে একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। শিশুর কান্নার আওয়াজ। সেই শিশুটি ছিলাম আমি। আমার শরীর থেকে হালকা সবুজ আলো বেরোচ্ছিল। তাই বাবা আমার নাম রাখে সবুজ।
“আমাকে পাওয়ার পর থেকে বাবার অদ্ভুত পরিবর্তন হয়। বাবা গাছ কাটা ছেড়ে দেয়। গাছের যত্ন নিতে শুরু করে। আমিও বাবার সঙ্গে ছোটোবেলা থেকে অনেক গাছ লাগিয়েছি। বাবা বোধহয় গাছ কেটে যে পাপ করেছিল তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইত। আমরা গাছের ফল বিক্রি করতাম বাজারে। এমনি করেই আমাদের দিন কাটত।”
পাখি বেশ অবাক হয়ে শুনছিল ঘাড়টা
একদিকে কাত করে। সবুজ বেশ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, "তুমি তো আমাকে দু-দু’বার বিপদ থেকে বাঁচালে। আমিও
দরকার পড়লে তোমাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাব। কথা
দিলাম।”
“সত্যি?”
“আমি কথা দিয়ে কথা রাখি।”
“সবসময়?”
সবুজ বলল, “সবসময়।”
হঠাৎ একটা চিৎকারে সবুজ কথা থামাল। গাছের ওপরে পা বাঁধা অবস্থায় ঝুলছে অনমিত্র। সরু গাছের ডালটা ঝুলে আছে ঠিক নদীর ওপর। কয়েকটা ক্ষুধার্ত
কুমির অপেক্ষায় আছে নিচে।
“সবুজ, সবুজ, ভাই আমাকে বাঁচাও!”
“না সবুজ, ওই শঠ অনমিত্রকে তুমি বাঁচাবে না,” ডানা ঝাপটিয়ে এদিক ওদিক উড়ে নিষেধ করল পাখি। অথচ সবুজ
ততক্ষণে অবলীলায় গাছে উঠে গেছে তরতর করে। অনমিত্রর পায়ের দড়ি খুলে আস্তে আস্তে গাছ থেকে নামিয়ে আনল সবুজ। অনমিত্র মাটিতে পা দিয়েই সবুজের পায়ে লুটিয়ে পড়ল। নাক কান মুলে বলল, “ভাই সবুজ, আমাকে ক্ষমা-ঘেন্না করে দাও ভাই। আমি তোমাকে ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তোমাকে না পেয়ে কালো রাজার চরেরা আমার এই অবস্থা করেছে।”
“তোমাকে ক্ষমা করতে পারি একটা শর্তে। তুমি যদি রংবেরঙের পাখিদের, যাদের তুমি হাটে বিক্রি কর তাদের মুক্তি দাও।”
“সারারাত ওভাবে পা বাঁধা অবস্থায় থেকে আমি বুঝেছি বন্দিদশার কত কষ্ট। আমি সব পাখিদের ছেড়ে দেব। তোমার কাছে আমি ঋণী সবুজ। বল, কীভাবে আমি তোমার সাহায্য করতে পারি।”
“আমি হৃদয়ফলের খোঁজে এসেছি এখানে। আমার বাবা খুব অসুস্থ। তার জন্য হৃদয়ফল নিয়ে যেতে চাই।”
অনমিত্র একটু ভেবে বলল, “হৃদয়ফলের কথা আমিও শুনেছি। গল্পে, উপকথায় পড়েছি। কিন্তু সত্যি সেরকম কোনও ফল আছে কি না বলতে পারব না। তার সন্ধান তোমাকে কেবল একজনই দিতে পারে। জাদুকর কীর্তিবাজ।”
“কোথায় তিনি?” সবুজ জানতে চাইল।
“আমি জানি কীর্তিবাজ কোথায়। কালো
রাজার কারাগারে কীর্তিবাজ নেই। কারণ, কারাগার থেকে বেরনোর সব গোপন রাস্তা কীর্তিবাজের জানা। কালো রাজা তাকে কাল-কঙ্কাল গুহায় বন্দি করে রেখেছে। তার হাত পা শেকল দিয়ে বাঁধা। তাকে রোজ রাজার চর খাবার দিতে আসে। ওকে বাঁচিয়ে রাখার কিছু তো কারণ নিশ্চয় আছে। কীর্তিবাজ এমন কোনও রহস্য জানে যা জানার চেষ্টায় কালো রাজা ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে।”
“কিন্তু কাল-কঙ্কাল গুহার রাস্তা কি তুমি জান?” সবুজ জিজ্ঞাসা করল।
“আমি জানি, আমার সঙ্গে এস।”
কাল-কঙ্কাল গুহা বেশ অনেকটা পথ। খুব প্রাচীন গুহা। পাহাড়ের ওপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে গেছে পথ। সবুজ দেখল, গুহামুখে মশাল জ্বলছে। তার মানে কেউ পাহারায় আছে। অনমিত্র বলল, “সবুজ, তুমি চিন্তা কোরো না। আমি গিয়ে সৈনিকের সঙ্গে একটু আলাপ সেরে আসছি।”
পাখিটা সবুজের কাঁধে এসে বসেছিল। আবার কানে কানে বলল, “পাখিধরা অনমিত্রকে ভরসা নেই।”
সবুজ হাতের ইশারায় পাখিকে চুপ করতে বলল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে অনমিত্র সবুজকে আশ্বস্ত করল, “এবারে সমস্যা নেই, চলে এস।”
সবুজ দেখল, সেই সৈনিক মাটিতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। অনমিত্র হাসল, “মুষ্টিযোগ বন্ধু, এক সাধুবাবার কাছে শিখেছিলাম।”
সবুজও হাসল। বলল, “চল, আর কালবিলম্ব না করে ভেতরে চল।” সবুজ হাতে মশালটা তুলে নিল।
অন্ধকার পরিষ্কার হতেই সবুজ দেখল এক বৃদ্ধ বসে আছে। তাঁর হাতে পায়ে শেকল বাঁধা। মুখে লোহার মুখোশ। সবুজ গিয়ে তাঁর হাতে-পায়ের শেকল, মুখোশ খুলে দিল। কীর্তিবাজ একটু সংশয়ভরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল, “কে তোমরা? কালো রাজার চর? এবার কি বন্দি করে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে? নাকি মৃত্যুদণ্ড?”
“মহান জাদুকর কীর্তিবাজ, আমরা আপনাকে মুক্ত করতে এসেছি,”
সবুজ এগিয়ে এসে কীর্তিবাজের ডানহাত চেপে ধরল। কীর্তিবাজের
বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এতদিন পর গুহার নিশ্ছিদ্র অন্ধকার থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কীর্তিবাজের
চোখে জল এল।
সবুজ আর অনমিত্রের চোখের সামনে অমনি অভাবনীয় এক কান্ড ঘটে গেল। লাল পাখিটা রূপ নিল এক সুন্দরী রাজকন্যের। ঝলমলিয়ে হেসে রাজকন্যে বলল, “কীর্তিবাজ, তুমি আমার সুরক্ষার জন্য আমাকে পাখির রূপ দিয়েছিলে। আর বলেছিলে, তোমার সঙ্গে আবার দেখা হলে আমি আবার নিজের আসল রূপ ফিরে পাব।”
কীর্তিবাজ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল, “রাজকন্যা লালিমা! আজ আমার বড়ো আনন্দের দিন।”
“কেমন আছ তুমি?”
“আমি ভালো কীর্তিবাজ। তোমার জাদুদণ্ড আমি নদীতীরের অশ্বত্থগাছের কোটরে লুকিয়ে রেখেছি,” রাজকন্যা লালিমা বলল।
অনমিত্র অমনি প্রণাম ঠুকল, “সবুজ, এ যে আমাদের রাজ্যের রাজকন্যা লালিমা!”
কীর্তিবাজ বলল, “কালো রাজার হাত থেকে রাজকন্যাকে দূরে রাখার জন্য আমি তাকে পাখি বানিয়ে দিয়েছিলাম। যাও লালিমা, রাজা, রানি এই গুহাতেই বন্দি আছেন। তাদের মুক্ত কর।”
“সবুজ হৃদয়ফলের খোঁজে এসেছে এখানে। তুমি কিছু বলতে পারবে, কীর্তিবাজ?”
“হৃদয়ফলের গল্প আমি শুনেছি। সেটা নাকি আছে দেবী অরণ্যানীর মন্দিরে। কিন্তু সেরকম কোনও ফল সত্যিই আছে কি না নিশ্চিত করে বলতে পারব না। সেই প্রাচীন মন্দিরে বহু রহস্য লুকিয়ে আছে। সেখানে আমার জাদুশক্তিও বিকল হয়ে যায়। কালো রাজা আমাকে সেই অমৃতফলের কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। ওই ফল খেলে মানুষ অসীম শক্তিশালী হয়ে ওঠে এটা কালো রাজার ধারণা। কিন্তু কালো রাজা দেবী অরণ্যানীর মন্দিরে ঢুকতে ভয় পায়। সবুজ, তুমি একদিন একরাত উত্তরে হেঁটে যাবে। দেবী অরণ্যানীর মন্দির প্রকান্ড। দূর থেকেই দেখতে পাবে।”
লালিমা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জবাব
দিল, “চিন্তা কোরো না কীর্তিবাজ, আমি যাব সবুজের সঙ্গে। ছোটোবেলায় তোমার সঙ্গে আর বাবা-মায়ের সঙ্গে সেখানে গিয়েছি, মনে পড়ে? তুমি বাবা-মাকে নিয়ে কোথাও আশ্রয় নাও আমরা যতক্ষণ ফিরে না আসি।”
অনমিত্র বলল, “কোনও চিন্তা কোরো না রাজকুমারী, আমার কুটির নিরাপদ জায়গা। কালো রাজার ধারণা আমার মৃত্যু হয়েছে।”
“না ভাই অনমিত্র, কালো রাজার গুপ্তচরেরা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। কোনও জায়গাই সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। তবে কীর্তিবাজ তার জাদুশক্তি দিয়ে মা-বাবাকে রক্ষা করতে পারবে আশা করি।”
কীর্তিবাজের চোয়াল শক্ত হল। কালো রাজা ছলের আশ্রয় নিয়ে তাকে বন্দি করেছিল। নইলে তার সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব ছিল না।
সবুজ, অনমিত্র ও লালিমা কীর্তিবাজের নির্দেশমতো একদিন একরাত হাঁটতে শুরু করল।
তাদের সঙ্গে তির-ধনুক, দড়ি প্রভৃতি কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস। রাত্রি নেমে এলে ঘন জঙ্গল আর ততটা নিরাপদ নয় এই ভেবে তারা এক জায়গায় শুকনো পাতা জড়ো করে আগুন ধরাল। রাত্রির প্রহরগুলো তারা পালা করে পাহারা দেবে। প্রথম প্রহর রাজকন্যা লালিমা পাহারায়। সবুজ দ্বিতীয় প্রহর ও অনমিত্র তৃতীয় প্রহর।
প্রথম প্রহর পাহারা দেওয়ার সময় রাজকন্যা লালিমা দেখল, অনমিত্র খুব নাক ডাকছে। লালিমার হাসি পেল। প্রথম প্রহরের ঘুমেই এমন নাক ডাকা। সবুজের মুখের দিকে তাকিয়ে লালিমার মনে হল যেন একটি শিশু ঘুমিয়ে আছে। এমন নিশ্চিন্ত একটি মুখ।
দ্বিতীয় প্রহরে অনমিত্রর নাকের গর্জন আরও তীব্র হল। সবুজ দেখল, লালিমা দুই কানে দুটো ফুল গুঁজে ঘুমোনোর চেষ্টা করছে। সবুজের ভারী মজা লাগল। সে একবার চারদিকে সতর্ক দৃষ্টিপাত করল। না, কোনও ভয় নেই। অনমিত্রর নাকডাকার আওয়াজে নিশ্চয় বন্যজন্তুরাও ভয় পেয়েছে। লালচে আগুনের আলোয় লালিমার মুখটা আরও সুন্দর দেখল সবুজ। সেই মুখ থেকে যেন চোখ সরে না।
রাত্রি তিন প্রহর। অনেক ডেকে ডেকেও অনমিত্রর কোনও সাড়া পেল না সবুজ। সবুজের চোখেও ঢুলুনি এসেছে। কয়েক মুহূর্ত পরে সবুজ ধড়মড় করে উঠে বসল। রাজকুমারী কোথায় গেল? সবুজ খুব ভয় পেল। কোনও জন্তু এসে নিয়ে যায়নি তো? সবুজ উঠে এদিক ওদিক দেখতে শুরু করল। দু’একবার ডাকও দিল। কোনও সাড়া নেই। সবুজ একটু হেঁটে সামনে এগোতেই দেখে লালিমা আসছে হেঁটে। সবুজকে দেখে হেসে বলল, “পাশে একটা সুন্দর ঝর্ণা আছে। জল খেতে আর মুখ ধুতে গিয়েছিলাম।”
সবুজ নিশ্চিন্ত হল।
কিন্তু পরক্ষণেই সবুজের দৃষ্টি
স্থির হল রাজকন্যার মাথায়। হাতের
ইশারায় সে রাজকন্যাকে একদম স্থির হয়ে দাঁড়াতে বলল। লালিমা একটু অবাক হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়াল। সবুজ একটা শুকনো পাতা কুড়িয়ে এনে লালিমার খোলা চুল থেকে কিছু একটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। কালো রঙের একটা
মোটা দাঁড়াওলা পোকা ছিটকে পড়ল। সবুজ
বলল, “ওটা একধরনের বিষপোকা, লোহুকি। কামড়ালে
নির্ঘাত মৃত্যু।”
লালিমা আচমকা ভয় পেয়ে সবুজের একটু কাছে সরে এল। তারপর নিজের ভয় লুকোতেই মুখে একটু সাহস ফুটিয়ে বলল, “এই পোকা তো গভীর জঙ্গলে অনেক আছে শুনেছি।”
এরই মধ্যে অনমিত্র ঘুম ভেঙে উঠে, “কী হল? কী হল?” করে মহাহুলুস্থূল বাঁধিয়ে দিল। সবুজ আশ্বস্ত করল, “কিছু হয়নি বন্ধু, সকাল হয়ে গেছে।”
লজ্জা পেয়ে চোখ বুজে জিভ কাটল
অনমিত্র, “ছি ছি, এমন ভয়ানক ঘুমিয়েছি...!”
আরও খানিকটা পথ এখনও বাকি। তাই
তারা আবার রওনা দিল।
অন্যদিকে কালো রাজা রাজপ্রাসাদের অলিন্দে
পায়চারি করছিল ইতস্তত। আকাশ থেকে উড়ে এল তার বিশ্বস্ত শকুন।
“অসীম শক্তিমান কালো রাজাকে প্রণাম।”
“কী খবর এনেছ, বল।”
“কয়েদির সঙ্গে জুটেছে পাখিধরা অনমিত্র আর রাজকন্যা লালিমা। তারা উত্তর দিকে দেবী অরণ্যানীর মন্দিরের দিকে গেছে।”
“আঃ, দেবী অরণ্যানীর মন্দির, হৃদয়ফল - একঢিলে দুই পাখি। আমি আজই সৈন্যবাহিনী নিয়ে সেখানে যাব। আগে ওদের শেষ করে হৃদয়ফল সংগ্রহ করে অসীম শক্তিশালী হব। তারপর ওই ধুরন্ধর কীর্তিবাজ আর বুড়ো রাজা-রানিকে খতম করব।”
“কালো রাজার জয় হোক। অনেকদিন পর আবার নরমাংস খাব,” উচ্ছ্বসিত হয়ে শকুন বলে উঠল।
দেবী অরণ্যানীর হাজার হাজার বছরের প্রাচীন মন্দির বহুদূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল। হাজার বছরের আদিম বৃক্ষ, লতা যেন প্রহরীর মতো ঘিরে আছে সেই মন্দিরকে। গাছ আর পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছিল আশীর্বাদের মতো। সবুজ অবাক হয়ে দেখছিল। পাথরের তৈরি বিশাল মন্দির। তার দেওয়ালে অজস্র জীবজন্তুর মূর্তি খোদাই করা। মন্দির চত্বর ঘুরে ঘুরে প্রবেশের দরজায় পৌঁছল তারা। বিশাল উঁচু পাথরের দরজা। দরজার দু’পাশে দুটো তিনমানুষ লম্বা ডানাওয়ালা পাথরের সিংহের মূর্তি।
লালিমা বলল, “এরা দু’জনে এই মন্দিরের রক্ষক। আমাদের হাজার বছর পুরনো উপকথায় পড়েছি।”
প্রবেশমুখ ছাড়াও মন্দিরের তিনদিকে তিনটে দরজা। দেবী অরণ্যানীর কোনও মূর্তি নেই। তিনি এই অরণ্যের প্রত্যেকটি বৃক্ষ, লতা, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গের মধ্যে আছেন। তাকে কেউ কোনোদিন দেখেনি। কিন্তু তিনি যে পথ দিয়ে যান সেখানে ফুল পড়ে থাকে। তার সবুজ রহস্যময় বিভা জঙ্গলে অনেকেই দেখেছে। ঝুম ঝুম নূপুরের শব্দ অনেকেই শুনেছে। গাছ কাটলে তার ব্যথা লাগে। তাই গাছ কাটার সময় গভীর জঙ্গলে তার আর্তনাদও কেউ কেউ শুনেছে। দেবী মানুষের ভালোমন্দ বিচার করেন। ভালোদের উপহার দেন, মন্দদের শাস্তি দেন। এসব
কথা লালিমার প্রাচীন উপকথায় পড়া।
সবুজ দেবী অরণ্যানীর আশীর্বাদধন্য। সবুজের জন্মবৃত্তান্ত শুনে লালিমার সেটাই মনে হয়েছে।
লালিমা, সবুজ, অনমিত্র সারা মন্দিরচত্বর হেঁটেও অদ্ভুত, আশ্চর্য কোনও গাছ খুঁজে পেল না। লালিমা বলল, “চল আমরা ভেতরে যাই।”
মন্দিরের ভেতরে অপূর্ব এক সুগন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে যা লক্ষ ধূপের গন্ধকেও হার মানায়। অনমিত্র প্রাণভরে সুবাস নিল। সবুজ আশ্চর্য হয়ে এদিক ওদিক দেখল। মন্দিরের ভেতরে তো কোনও ফুলের গাছ নেই!
অনমিত্র মন্দিরের ভেতরের একটা ঘরে দাঁড়িয়ে কী একটা দেখে ডাকল, “দেখে যাও ভাই, ভারী মজার জিনিস মন্দিরের মেঝেতে। রঙিন চারকোণা পাথরগুলো সরানো যাচ্ছে!”
লালিমা আর সবুজ সেখানে এসে দাঁড়াল। সবুজ খুব খুঁটিয়ে পাথরগুলোকে দেখল। পাথরগুলো ঠিকমতো সাজালে একটা ছবি হবে মনে হচ্ছে।
পাথরগুলো ঠিকমতো সাজিয়ে যে ছবিটা তৈরি হল তাতে দেখা গেল, একটা লোক শুয়ে আছে আর তার পেট ফুঁড়ে একটা সাদা গাছ চারদিকে ডালপালা মেলেছে। গাছে লাল লাল ফল ধরেছে। গাছের চারদিকে সবুজ, নীল, বেগুনি – নানারঙের উল্কি। ছবিটা সাজানো মাত্রই পাথরের ফলকগুলো সরে গিয়ে নিচে যাওয়ার একটা পথ করে দিল। ভেতরে সিঁড়ি নেমে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে তিনজন আস্তে আস্তে নিচে নেমে গেল।
সেই গন্ধটা আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। হঠাৎ ওপর থেকে তিনটে সাপ নেমে ওদের তিনজনের গলায় জড়িয়ে গেল। লালিমা বলল, “একদম স্থির হয়ে থাক সবুজ। ওরা ভালোমন্দের পরীক্ষা করছে।”
সাপগুলো ওদের শরীরের ওপর দিয়ে ঘুরে ঘুরে গিয়ে নিচে নেমে গেল। ওরা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে সেই অপূর্ব গন্ধের উৎস, সেই অদ্ভুত সুন্দর গাছটাকে দেখতে পেল। এরকম গাছ ওরা কেউই কোথাও দেখেনি। উজ্বল সাদা রঙের গাছ। তার গা থেকে স্নিগ্ধ আলো বেরোচ্ছে। সেই আলো যেন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
চুনি রঙের ফল ধরেছে তাতে। গাছটার নিচে একটা সমাধি, শ্বেতপাথরের।
লালিমা বলল, “উপকথার গল্প তবে সত্যি! গল্পে আছে কোনও এক ভালোমানুষ গাছেদের খুব ভালোবাসত। কাঠুরের হাত থেকে গাছকে বাঁচাতে নিজের প্রাণ দিয়েছিল। তার শরীরকে রাজ্যের লোকেরা এখানে সমাধি দেয় আর সেই পাথরের সমাধি থেকেই এক অদ্ভুত গাছের জন্ম হয়। সেই গাছের ফল মানুষের হৃদয়ের সমস্ত খারাপ জিনিস নষ্ট করে দেয়। মানুষের সমস্ত রোগ সারিয়ে দেয়। এই সেই গাছ। যাও সবুজ, তাড়াতাড়ি এর ফল সংগ্রহ কর। কালো রাজা আর তার সৈন্যেরা যে কোনও সময় এসে পড়তে পারে।”
সবুজ নিজের ঝুলিতে সেই ফল ভরে নিল। বাইরে বেরিয়ে আসতেই লালিমার চোখে পড়ল কালো রাজার প্রিয় শকুন। সে আকাশে ইতস্তত ঘুরপাক খাচ্ছে।
লালিমা বলল, “সবুজ, আমার মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি কালো রাজা আর সৈন্যরা এসে পড়বে এখানে। আমরা এখন পালিয়ে গেলে দেবী অরণ্যানীর মন্দির এরা তছনছ করে ফেলবে। মন্দিরের চূড়ায় একটা ঘন্টাঘর আছে। সেখানে লুকিয়ে থেকে ওদের আক্রমণ প্রতিরোধ করা যেতে পারে।”
ওরা সেরকমই করল। মন্দিরের প্রবেশদ্বারগুলো বন্ধ করে ঘন্টাঘরে গিয়ে লুকিয়ে থাকল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘোড়ার খুরের আওয়াজে আর লোকজনের কোলাহলে বোঝা গেল কালো রাজা তার সৈন্য দিয়ে মন্দির ঘিরে ফেলেছে। ওপর থেকে তির ছুঁড়তে লাগল সবুজ, লালিমা ও অনমিত্র অব্যর্থ লক্ষ্যে। অনমিত্র বলল, “ভাই, আমাদের রসদ তো ফুরিয়ে এসেছে। আর কতক্ষণ ওদের এভাবে আটকে রাখতে পারব? কালো রাজার সৈন্যরা মন্দিরের দরজা ভাঙতে শুরু করেছে। ওদের মধ্যে কয়েকজন মন্দিরের দেওয়াল বেয়ে ওপরে উঠে আসছে।”
লালিমা বলল, “একটা উপায় আছে। তবে এটা উপকথায় পড়েছিলাম। মন্দিরের যেকোনও বিপদে ঘন্টাঘরের এই ধাতব ঘন্টা বাজানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাতে নাকি জেগে উঠবে বন। জীবন্ত হয়ে উঠবে মন্দির।”
“আচ্ছা! সেইমতো করা যাক না!” সবুজ সম্মত
হল।
অনমিত্র বলল, “পাগল হলে নাকি ভায়া? এই ঘন্টাঘরের ঘণ্টা বাজাতে গেলে গায়ে একশো হাতির জোর লাগবে!”
সবুজ বলল, “আহা, দেখি না চেষ্টা করে।”
ঘন্টার মাঝখানে একটা দড়ি বেঁধে সেটা সবুজ নিজের কোমরের সঙ্গে বাঁধল। তারপর ঘন্টা থেকে ঝুলে পড়ল। কয়েকবার সামনে পেছনে দোল খেতেই বাজতে শুরু করল ঘন্টা। সেই শব্দে সমস্ত বন কেঁপে উঠল। সমস্ত গাছপালা কাঁপিয়ে এক অদ্ভুত ঝড় উঠল জঙ্গলজুড়ে। জঙ্গলের জন্তুরা হঠাৎ যে যেখানে ছিল প্রচন্ড শব্দ করতে করতে দুদ্দাড় করে ছুটে এল। এত জন্তুকে একসঙ্গে ছুটে আসতে দেখে কালো রাজার সৈন্যরা পালতে শুরু করল। হাতি আর বুনো মোষের আক্রমণে অনেকেই প্রাণ হারাল।
হঠাৎ কেঁপে উঠল মন্দির। প্রবেশমুখের দু’দিকে বসে থাকা দুই সিংহ জীবন্ত হয়ে উঠল। চোখ জ্বলে উঠল তাদের। গর্জন করে উঠল তারা।
ভয়ংকর সেই গর্জনে কেঁপে উঠল বন। তারা লাফ দিয়ে নামল নিচে। বিরাট সিংহদের জীবন্ত হতে দেখেই বহু সৈন্য পালিয়ে গেল। দুই সিংহের মুখ থেকে প্রচন্ড আগুন বেরোতে শুরু করল। সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল কালো রাজার চরেরা ও তার পোষা শকুন। মন্দিরকে ঘিরে থাকা আকাশ সমান উঁচু গাছেরা তাদের হাতের মতো ডালপালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগল সৈন্যদের। কালো রাজা তার তরবারি দিয়ে গাছের ডালপালা কাটতে উদ্যত হলে লতাপাতারা পাকে পাকে জড়িয়ে বন্দি করে ফেলল কালো রাজাকে।
একসময় যখন ঝড় থামল, সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। সবুজ, লালিমা আর অনমিত্র বাইরে এসে দেখল কোনও সৈন্য নেই। সবাই পালিয়েছে। শুধু কালো রাজা বাঁধা পড়ে আছে একটা উঁচু গাছের ডালে। সমস্ত জঙ্গলে সন্ধে নেমে এসেছে। আর একটা অদ্ভুত সবুজ রহস্যময় আলো দেখা যাচ্ছে গাছেদের ফাঁকে। সঙ্গে ঝুম ঝুম শব্দ। মনে হচ্ছে কেউ যেন এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। লালিমা বুকের কাছে হাত জড়ো করে বনদেবী অরণ্যানীকে প্রণাম করল। সবুজ ও অনমিত্র বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল। দেখাদেখি তারাও প্রণাম করল। গাছের ডাল থেকে জ্ঞান হারানো কালো রাজাকে নামিয়ে একটা ঘোড়ার পিঠে ভালো করে বাঁধল সবুজ। সবুজ দেখল কালোরাজার ঘাড়ের কাছে ক্ষত। আর সারা শরীর নীল হয়ে গেছে। নির্ঘাত বিষপোকা লোহুকির কামড়। সবুজ তার ঝুলি থেকে একটা হৃদয়ফল বের করল।
রাজপ্রাসাদে আবার শান্তি ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছেন রাজা সুমন্ত ও রানি মধুমন্তী। সবুজ, অনমিত্র ও লালিমার খুব প্রশংসা করল রাজ্যের লোকেরা। সবুজ তার দেশে ফিরে যাবে। তার ঝুলিতে হৃদয়ফল। নিয়ে যাবে অসুস্থ বাবার জন্য। অনমিত্র হেসে বলল, “ভাই সবুজ, আবার ফিরে এস কিন্তু। মুষ্টিযোগটা শিখিয়ে দেব।”
লালিমা সবুজের দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসল। সে জানে সবুজ কথা রাখবে, আবার ফিরে আসবে।
“কালো রাজা, সে কোথায় গেল?” সবুজ জিজ্ঞেস করল।
অনমিত্র চোখ নাচাল, “রাজপ্রাসাদে সে এখন নতুন কাজ পেয়েছে বাগান দেখাশোনার। ওই হৃদয় ফলের প্রভাব ভায়া। তার শরীরে আর মনে এখন কোনও বিষ নেই। ওই দ্যাখো, কোদাল ঝুড়ি নিয়ে গাছ লাগাচ্ছে, গাছে সার দিচ্ছে।”
“গাছে, না তার সুবুদ্ধির গোড়ায়?”
তিনজনেই হেসে উঠল।
_____
অলঙ্করণঃ ঋতম মুখার্জি
khub valo laglo
ReplyDeletetomar bhalo legechhe jene khushi holaam
ReplyDeleteচমৎকার একটি রূপকথা, না কি রূপক?!
ReplyDeleteদুটোই বলতে পারেন। আন্তরিক ধন্যবাদ। অরণ্যানী অরণ্যের দেবী। তাঁর উল্লেখ আমরা বৈদিক যুগে পাই। আমার ইচ্ছে ছিল প্রাচীন বৈদিক চরিত্রগুলিকে রূপকথায় নিয়ে আসা।
ReplyDeletekhub valo laglo. kintu aro ektu deergha hale mane hay aro valo lagto. baddo taratari shesh haye gelo.
ReplyDeleteAnek dhanyobad.. Deergho porisare pare kakhono lekhar icchhe aachhe. Sotyie etoguli choritro chhoto galpe thik bhabe byabohar kora jaay na
ReplyDeleteবাহঃ বেশ পছন্দ হল এই রূপকথা :)
ReplyDeleteAntorik dhanyobad. tomaar matamat jene khub bhalo laaglo :)
ReplyDeleteসুন্দর।
ReplyDeleteসুন্দর।
ReplyDeleteanek dhanyobad :)
Delete