জুনিয়া ও আগুনপাহাড়ের
জাদুকরী
অদিতি
সরকার
রিশিনের শক্তিশালী ডানাজোড়া
হাওয়া কাটছিল শনশন করে। সন্ধে হয়ে আসছে। নিচে পৃথিবীর বুকে ছায়া নেমে এলেও এত
উঁচুতে আকাশের রঙ এখনও বেগুনিতে গোলাপিতে মেশানো।
রিশিনের পিঠে টানটান বসে ছিল জুনিয়া। তার সতর্ক
দৃষ্টি ঘুরছিল চারদিকে, ওপর থেকে নিচে। রাত কাটানোর মতো একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজছিল
সে। এদিকটা তার সম্পূর্ণ অচেনা। নিচে যতদূর চোখ চলে শুধুই দুর্ভেদ্য জঙ্গল। এখানে
নামা মানে বন্যজন্তুদের নিমন্ত্রণ জানানো। একটা গ্রাম বা একটু পরিষ্কার জায়গা খুঁজছিল
জুনিয়া, যেখানে তার ছোট্ট তাঁবুটা খাটানো যায়।
হঠাৎই রিশিন কোনওরকম আগাম
ইঙ্গিত না দিয়েই দ্রুত নামতে শুরু করল। তাড়াতাড়ি তার কেশর মুঠোয় আঁকড়ে টাল
সামলাল জুনিয়া।
“কী হল রিশিন?”
রিশিন মাথা ঝাঁকিয়ে যেদিকে
ইশারা করল, সেদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল জুনিয়া। চারদিক ঘেরা
ঘন সবুজের মধ্যে ওইটুকু এলাকা যেন একটা শুকনো ক্ষত। গাছের ডালে পাতা নেই, মাটির
বুকে একটা ঘাসের ডগা নেই। পোড়া পোড়া মরুভূমির মতো কিছুটা জায়গা। তারই মধ্যে কয়েকটা
কুটির। লোকজনও চলাফেরা করছে। কিছু মানুষ এক জায়গায় জড়ো হয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে
রয়েছে। তাদেরই লক্ষ করছে। সকলেরই হাতে অস্ত্র। যদিও তাদের ভঙ্গি সাবধানি হলেও
হিংস্র নয়। যা থাকে কপালে ভেবে জুনিয়া রিশিনকে নামিয়ে আনে মাটিতে।
ভিড়টা আরও একটু বেড়েছে
এতক্ষণে। বৃদ্ধ, তরুণ সবাই আছে ভিড়ের মধ্যে। আছে নানান বয়েসের মেয়েরাও। শুধু নেই
কোনও শিশু। জুনিয়া একটু অবাক হলেও পরক্ষণেই ভাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আকাশ থেকে
বন্ধু না শত্রু নামছে না জেনে বাচ্চাদের কেনই বা কেউ সামনে আনবে।
“মাওটং গ্রামের গাঁওবুড়া
আমি, আমার নাম খিম। নিজের পরিচয় দাও, বিদেশিনী।”
বৃদ্ধের মুখে অসংখ্য রেখার
আঁকিবুকি। যদিও শরীর যথেষ্ট বলশালী। দু’চোখে গভীর সন্দেহ ও প্রশ্ন নিয়ে সে জুনিয়ার
দিকে চেয়ে ছিল।
“আমি দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া। মাওটং
গ্রামের খিমকে আমার অভিবাদন,” জুনিয়া
মাথা ঝোঁকায়। যদিও তার সাবধানী চোখ পুরো নিচু হয় না।
“দক্ষিণদ্বীপ? সে তো বহুদূর এখান থেকে,” খিমের
মুখে আবার সন্দেহের ছায়া পড়ে।
“হ্যাঁ। আমরা শিকারে
বেরিয়ে পথ ভুল করে ফেলেছিলাম। সমুদ্রের ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে অনেকদূর চলে এসে
বুঝতে পেরেছিলাম ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু ক্লান্ত রিশিনের পক্ষে তখন আর দক্ষিণদ্বীপে
ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই যেদিকে উড়ছিলাম, সেদিকেই এগিয়ে যাওয়া ঠিক করলাম।
রাস্তা খুঁজে পেলেই ফিরে যাব ফেলে আসা দক্ষিণদ্বীপে,” জুনিয়ার
গলা সামান্য কাঁপে। তারপরেই সে নিজেকে সামলে নেয়। মেরুদন্ড শক্ত করে দাঁড়ায় সে,
এক হাত কোমরের তরবারিতে, এক হাত রিশিনের কেশরে।
“আমাদের আজ রাতটুকুর জন্য
আশ্রয় চাই। মহামান্য খিম কি তা আমাদের দিতে পারবেন?”
“মাওটং গ্রাম কখনও
আশ্রয়প্রার্থীকে ফেরায় না। কিন্তু দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া, দেখতেই তো পাচ্ছ আমাদের
গ্রামের চেহারা। আমরা নিজেরাই এই মরুভূমিতে কষ্ট করে বেঁচে আছি। তোমাকে কী দিয়েই
বা আপ্যায়ন করব।”
“আপ্যায়নের প্রয়োজন নেই।
খাদ্য-পানীয় আমার সঙ্গেই আছে। রাত চলে যাবে। রিশিনের জন্য যদি সামান্য ঘাস পাওয়া
যেত...”
“আমরা অত্যন্ত লজ্জিত। কিন্তু
সবুজ কোনওকিছু আমাদের গ্রামে জন্মায় না। শুকনো খড় রয়েছে কিছু, তাই দিয়েই
ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করতে হবে তোমার পক্ষীরাজকে। যদিও অমন তেজস্বী প্রাণীকে এই সামান্য
খাদ্য দিতেও আমাদের বাধছে, তবুও উপায় যে নেই।”
“ওতেই হবে। রিশিন খাবার নিয়ে
বাছবিচার করে না।”
রিশিন ঘাড় বাঁকিয়ে একবার
তাকাল জুনিয়ার দিকে এই কথায়। জুনিয়া তার কেশরে হালকা টান দিয়ে ইঙ্গিত করল চুপ করে
থাকার। তার মনে তখন অসংখ্য প্রশ্ন।
“মহামান্য খিম যদি অপরাধ না
নেন, জুনিয়ার কিছু প্রশ্ন ছিল।”
“জানি কী প্রশ্ন তোমার। চারদিকে
গহন সবুজ জঙ্গল, অথচ আমাদের এই গ্রামটুকুতে সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। এই আশ্চর্যের
কারণ জানতে চাও তো তুমি?”
“হ্যাঁ। জানতে চাই
কেন এখানে সবুজ নেই। কেন সবুজ জন্মায় না, বাঁচে না মাওটং গ্রামে।”
খিম চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।
যখন কথা বলে তখন তার গলা ভারী, বিষণ্ণ।
“মাওটং গ্রাম অভিশপ্ত,
জুনিয়া।”
“অভিশপ্ত! মানে?”
“আগুনপাহাড়ের জাদুকরীর
অভিশাপ আছে আমাদের উপর।”
“আগুনপাহাড়ের জাদুকরী? কে সে? কেনই বা সে অভিশাপ দিল আপনাদের, খিম?”
খিমের মাথা নিচু হয়ে যায়
জুনিয়ার প্রশ্নে। উত্তর দিতে এগিয়ে আসে আর একজন। তার দীর্ঘ দেহ, পিঙ্গল চুল পেশল কাঁধের
নিচ পর্যন্ত নেমেছে। মশালের কাঁপা কাঁপা আলো তার চকচকে তামাটে চামড়ায় পড়ে পিছলে
যাচ্ছে।
“আমি
বলছি, কেন।”
“আহ্,
টর!” খিম তিরস্কার করে ওঠে।
“আমাকে
বলতে দাও খিম। লুকিয়ে রেখে কী হবে? অপরাধ তো আমাদেরই। তার শাস্তি ভোগ করছি আজ এতদিন।”
জুনিয়া
অবাক হয়ে তাকায়।
“অপরাধ,
শাস্তি, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“অপরাধই তো। আগুনপাহাড়ের জাদুকরীর তারামণি চুরি করে পালিয়ে
এসেছিল এই গ্রামেরই একজন। সে জাদুবিদ্যা শিখতে গিয়েছিল। কিন্তু জাদুকর
হওয়ার প্রথম শর্ত অর্থাৎ লোভ জয় করতে পারেনি।”
“তারামণি কী?”
“সঠিক জানি না, তবে শুনেছি
জাদুকরীর শক্তির উৎস নিরাপদে রাখা ছিল তিনটি রত্নপাথরের গভীরে। তারামণি, সবুজমণি
আর আঁধারমণি। জন্ম, ভালোবাসা আর মৃত্যু। তারই একটি পাথর, তারামণি। জাদুকরীর
বিশ্বাস ভেঙে সেই মণি নিয়ে পালায় আমাদেরই গ্রামের এক পাপিষ্ঠ। ক্রুদ্ধ জাদুকরী
অভিশাপ দিয়েছিল আমাদের, যতদিন না সেই মণি ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাকে, একটি ঘাসের
ডগাও গজাবে না এই গ্রামে, একটি ফুলও ফুটবে না। একটি নতুন শিশুও জন্মাবে না,
মৃত্যুও হবে না কারও। জীবন আমাদের থেমে গেছে সেইদিনই, দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া। যে
যেমন ছিলাম তেমনিই রয়ে গেছি যুগের পর যুগ। মুক্তির আশাও আর করি না আজকাল।”
“তা, যার মণি তাকে ফিরিয়ে
দিলেই তো হয়।”
“কী করে ফিরিয়ে দেব? সে পাথর কি আমাদের কাছে আছে নাকি?”
“এই যে বললে গ্রামেরই লোক
চুরি করেছিল।”
“করেছিল তো। কিন্তু
পালিয়ে আসতে আসতে ভয়ের চোটে ফেলেও দিয়েছিল যে! কোথায় ফেলেছিল কে জানে। সে নিজেও তো
পাপের শাস্তি হাতে হাতেই পেয়ে গিয়েছিল। পালাতে গিয়ে পা ফসকে পাহাড়ের খাদে পড়ে
মরণ হয়েছিল তার। আজ এত বছর ধরে কম খোঁজা খুঁজেছি আমরা? কে চায় বল,
এমন করে বেঁচে থাকতে? পাথর ফিরিয়ে দিতে পারলে আমরাও তো ফিরে পাব একটা স্বাভাবিক
জীবন, আর পাঁচটা লোকের মতো। কিন্তু পেলে তবে না!”
জুনিয়া চুপ করে যায়। কী যেন
ভাবে। রিশিন মাথা ঝাঁকায়, খুর ঘষে পাথুরে মাটিতে।
“কোথায় থাকে এই জাদুকরী?” জুনিয়া এবার জানতে চায় খিমের কাছে।
“ওই যে অনেক, অনেকদূরে পশ্চিমের
আকাশের গায়ে দেখছ লালচে আভা, ওইখানেই আগুনপাহাড়। ওরই চূড়ায় জাদুকরী আনাইতের
প্রাসাদ। কিন্তু এ কথা জানতে চাইছ কেন জুনিয়া?”
“ভাবছি। যদি খুঁজে পাই
তারামণি, যদি ফিরিয়ে দিতে পারি যার জিনিস তাকে, তাহলেও কি এই গ্রামে সবুজ ফিরবে না? আপনারা অচেনা অজানা এই জুনিয়াকে আশ্রয় দিয়েছেন। তার
পরিবর্তে এটুকু চেষ্টা কি আমি করতে পারি না?”
“তুমি? তুমি কী করবে! এতদিনেও আমরা যা পারলাম না, তুমি কোন না
জানা দেশের একফোঁটা মেয়ে পারবে সে কাজ?”
“দেখাই যাক না। শুধু বলুন কীভাবে
পৌঁছব ওই আগুনপাহাড়ে।”
খিম অবাক হয়ে তাকায়। জুনিয়ার
চোখেমুখে স্থির সংকল্পের আঁচ তাকে কী জানি কী আভাস দেয়। সে আর আপত্তি করে না।
“যেতে চাইছ যাও, তবে মনে
রেখো, পথ কিন্তু বিষম কঠিন। বিপদ বাঁকে বাঁকে। তবুও যদি পার, মাওটং গ্রাম তোমার
কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে, দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া।”
ভোরের অনেক আগেই জুনিয়ার ঘুম
ভেঙে গিয়েছিল। অপেক্ষা করছিল প্রথম পাখিটির ডাকের। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছে
তার। সে ভুলে গিয়েছিল এই গ্রামের আকাশে কোনও পাখি ওড়ে না আর। রিশিনও অধৈর্য উসখুস
করছিল। এই মরুপ্রায় গ্রাম ছেড়ে উড়ে যেতে পারলে বাঁচে সে। যদিও কিছু এলেবেলে ঘোড়ার
সঙ্গে আলাপ হয়েছে তার কাল রাতে, কিন্তু কোথায় তার মতো কুলীন পক্ষীরাজ আর কোথায়
এরা। ডানার প্রতিটি ঝাপটে তার মাটি ছেড়ে উড়ান দেওয়ার ইচ্ছে ফুটে বেরোচ্ছিল।
পেছনে খুব হালকা পায়ের শব্দে
জুনিয়া ফিরে তাকাল। টর। সঙ্গে সাদা ধবধবে মস্ত একটা ঘোড়া। ভোরের আবছা আলোতেও তার
পিঠে ডানার আভাস স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
রিশিন বিষম অবাক হয়ে ল্যাজ ঝাপটাল। এ গ্রামেও পক্ষীরাজ আছে তাহলে!
“আমি যদি তোমার সঙ্গে যাই,
আপত্তি করবে কি? আগুনপাহাড়ের পথ দুর্গম। কী বিপদ কোথায় লুকিয়ে
আছে কেউ জানে না। দুজনে যাওয়াই ভালো হবে, নাকি?
আর, আমার নোহিতা বোধহয় তোমার রিশিনের তুলনায় এদিকটা একটু বেশিই চিনবে। জোর করব না।
তুমিই ভেবে দেখ, কী করবে।”
জুনিয়ার আদৌ ইচ্ছে ছিল না
সঙ্গে কাউকে নিতে। কিন্তু টর যা বলল সেটাও অগ্রাহ্য করার মতো নয়।
সূর্য তখনও ভালো করে আকাশে
ওঠেনি।
বেরিয়ে পড়ল তারা দুজন। গ্রাম ছেড়ে বেরোতেই ঘন বন। তারই মধ্যে
দিয়ে পথ করে চলল রিশিন আর নোহিতা। ওড়ার মতো জায়গাটুকুও নেই, এতই ঘন বুনোট বন।
চলতে চলতে এপাশ ওপাশ থেকে হিসহিস, ফিসফিস। তারা দাঁড়ায় না। মোটা মোটা গাছের
গুঁড়ির আড়াল থেকে গরগর, খচমচ। তারা গতি কমায় না। চলেছে তো চলেইছে। বন
ফুরিয়ে পাথুরে পাহাড় শুরু হল, তবুও চলা আর ফুরোয় না।
শেষে যখন শরীর আর দেয় না,
রিশিন ঠোক্কর খাচ্ছে বারবার, নোহিতা পড়ছে পিছিয়ে, হঠাৎই সামনে যেন মাটি ফুঁড়েই
উঠে দাঁড়াল এক খুনখুনে ক্ষুদে বুড়ি। তার ধবধবে সাদা চুল, জ্বলজ্বলে নীল চোখ।
“কুশল হোক কন্যে, কুশল হোক
কুমার। চলেছ কোথায়, কীসের খোঁজে?”
নমস্কার করল তাকে জুনিয়া,
নমস্কার করল টর।
“প্রণাম হই বুড়িমা। চলেছি
তারামণির খোঁজে। পেলে তা ফিরিয়ে দেব জাদুকরী আনাইৎকে। জান তার সন্ধান কিছু?”
“তারামণির নাম শুনেছি বাছা,
কিন্তু কোথায় আছে সে মণি আমি তো জানি না। হয়তো আমার বোন জানলেও জানতে পারে। বরং এক
কাজ কর। এই
নাও রুপোর গুটিখানা। যেদিকে গড়িয়ে যায় তোমরাও যেও তার পেছন পেছন। আমার বোনের
বাড়ি পৌঁছে যাবে ঠিক।”
যেমন উদয় হয়েছিল তেমনিই আবার
কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল বুড়ি। জুনিয়া চমকে এদিক তাকায়, ওদিক তাকায়। বুড়ি যেন
মিলিয়ে গেছে হাওয়াতেই। টর ততক্ষণে গুটি ছুঁড়ে দিয়েছে পাথুরে মাটিতে। সোনালি হিলহিলে
এক রেখা হয়ে সে সুতো গড়াতে শুরু করল ঝিলমিল, চিলমিল। টরকে নিয়ে নোহিতাও চলেছে তার
পিছুপিছু। অগত্যা
রিশিনের পিঠে জুনিয়াও।
যেতে যেতে কত দিন কত রাত যে
কাটল কেই বা জানে। রিশিনের কেশরে জট, নোহিতার সাদা রঙ ধুলোয় ধূসর। তবুও থামার নাম
নেই। রেশমি সুতো ঝিলমিলিয়ে আগে আগে চলে, এরা চলে তার পেছন পেছন। কত শিখরচূড়া, কত
খাদের অতল, কত কাঁটাঝোপ যে পেরিয়ে গেল গুটি তার হিসেব কে করে।
হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরতেই সামনে
যেন আকাশ ঢেকে গজিয়ে উঠল এক অতিকায় পাহাড়। তার ঠিক গোড়ায় এক ছোট্ট কুঁড়েঘর।
রেশমি সুতো সটান ঢুকে গেল কুঁড়েঘরের দরজা দিয়ে এক্কেবারে ভেতরে। রিশিনের পিঠ থেকে
নামল জুনিয়া। সুতোর পেছন পেছন সেও ঢুকল কুঁড়ের মধ্যে।
খুনখুনে ক্ষুদে বুড়ি এক রান্না
করছিল কুঁড়ের ভেতরে। বুড়ির ধবধবে সাদা চুল, চকচকে সবুজ চোখ। অবাক হয়ে সে
দেখল জুনিয়াকে।
“কে তুমি কন্যে, কোথা থেকে
এলে? চলেছই বা কোথায়?”
“আমি দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া
বুড়িমা। আর
এ হল মাওটং গ্রামের টর। চলেছি আগুনপাহাড়ের জাদুকরী আনাইতের হারানো তারামণির
খোঁজে। পেলে ফিরিয়ে দেব তাকে। জান বুড়িমা, সে মণির সন্ধান?”
বুড়ি পাকা ভুরুর তলা দিয়ে
তাকাল জুনিয়ার দিকে। তার সবুজ চোখের তারায় আলো ঝিলমিল করে।
“সে যে বড়ো কঠিন পথ কন্যা,
পারবে?”
“পারতেই হবে বুড়িমা, কথা
দিয়েছি যে!”
বুড়ি আর কিছু বলে না। খুন্তি
নাড়তে নাড়তে গুনগুন করে গান গায়। জুনিয়া মন দিয়ে শোনে গানের কথা। বোঝার চেষ্টা
করে।
“তারামণি জ্বলজ্বল জ্বলে,
আধেক জলে আধেক স্থলে,” বুড়ি গায়
আর ফুটতে থাকা ঝোলে জল ঢালে। জল ঢালে আর গায়।
“এ গানের মানে কী বুড়িমা?”
“সে তোমাকেই বুঝতে হবে তো!”
বুড়ি ফিক করে হাসে, “এই নাও
সোনার সুতোর গুটি।
যেদিকে নিয়ে যাবে সেদিকে যেও। ভয় পেও না। আর এই নাও হাড়ের বাঁশি। বলা যায় না,
কাজে লাগতেও পারে।”
“কিন্তু আমি তো বাঁশি বাজাতে
পারি না।”
“আমি পারি,” টর এগিয়ে আসে, “আমি
বাজাতে পারি বাঁশি।”
সোনার গুটি ততক্ষণে গড়াতে
শুরু করেছে। পাহাড়ের পাশ দিয়ে, ঝর্নার ধারা পেরিয়ে, নদীর ধার ধরে ধরে গুটি কেবলই গড়ায়,
গড়াতেই থাকে। গড়াতে গড়াতে একসময় গুটি এসে ঢুকল গভীর অন্ধকার এক পাষাণ অরণ্যের
ভেতরে। গহন গভীর সে বনের ভেতর দিনের বেলাতেও মাঝরাতের মতো অন্ধকার। বিশাল বিশাল
পাথরের স্তূপ আকাশ ছুঁতে চাইছে যেন। নজর চলে না, পথ মেলে না। এগোতে যাবে, পথ আটকে
দাঁড়াল সাক্ষাৎ যম। ভুখা নেকড়ের দল এক। তাদের চোখ জ্বলে কয়লার মতো ধকধক, ধারালো
দাঁত বেয়ে লালা পড়ে টপটপ।
রিশিন মাটি আঁচড়ায় খুর দিয়ে,
ডানা ঝাপটায় নোহিতা। তাদের ঘিরে ফেলেছে নেকড়ের দল। সুযোগ খুঁজছে আক্রমণের। একবার পক্ষীরাজের
পেছনের পায়ের শিরা কেটে দিতে পারলেই শেষ। নেকড়েদের গলা থেকে হিংস্র গর্জন উঠছিল। জুনিয়ার
সারা শরীর শিউরে ওঠে। এতজনের সঙ্গে একা লড়তে পারবে না জেনেও সে খাপ থেকে টেনে বার
করে তলোয়ার।
কী ভাবছিল টর কে জানে। হাড়ের
বাঁশি অজান্তেই কখন যেন হাত থেকে ঠোঁটে উঠে এল তার। কী সুর যে বাজল বাঁশিতে। অমন
সুর আগেও শোনেনি কেউ কোনোদিন আর শুনবেও না কখনও। আকাশঢাকা পাথরের স্তূপ গুঁড়ো
গুঁড়ো হয়ে ভেঙে পড়তে লাগল, রোদ এসে সোনা ঢেলে দিতে লাগল অন্ধকার অরণ্যের কোণায়
কোণায়। নেকড়েরা
ফিরে গেল পায়ে পায়ে, শান্ত, চুপচাপ।
পথ পেয়ে গুটি আবার গড়ায়। গড়াতে
গড়াতে একদিন শেষে এসে পৌঁছল বিশাল
এক পাহাড়ের কাছে। পাহাড়ের নিচে হ্রদ। হ্রদের অতলে ঝকমক করে কী যেন। জ্বলজ্বল আগুনের
মতো কিন্তু আগুনও নয়।
“টর, দেখ দেখ, ভালো করে দেখ। ওই কি
তারামণি?” জুনিয়া হাত ধরে টেনে আনে টরকে।
“তাই যেন মনে হয় জুনিয়া।
পালাতে পালাতে তবে কি ওই হ্রদের জলেই চোরের হাত ফসকে পড়েছিল তারামণি?”
“কিন্তু ওখান থেকে তুলে আনব
কী করে টর? অত গভীরে কি কেউ ডুব দিয়ে বেঁচে ফিরতে পারে?”
“তাও তো কথা। দাঁড়াও, ভালো
করে দেখতে দাও।”
ঘুরে ফিরে অনেকক্ষণ ধরে দেখে
টর।
দেখে জুনিয়া। জুনিয়াই শেষপর্যন্ত রহস্যটা উদ্ধার করে।
“ও মণি জলের তলায় নেই টর।”
“তবে?”
“ওই যে পাহাড়ের শিখর দেখছ,
মণি আছে ওইখানে। এ কেবল মণির ছায়া।”
“তাহলে? ও পাহাড়ে উঠবে কী করে! ওই অগম চূড়ায় যাওয়া তো সহজ হবে
না।”
জুনিয়া হাসে।
“রিশিনের কথা ভুলে গেলে টর? নোহিতা?”
জুনিয়ার ইশারায় সাঁ সাঁ করে
ওপরে ওঠে রিশিন। এতদিন না উড়ে উড়ে ডানায় তার জং ধরে যাচ্ছিল প্রায়।
শিখরের কাছাকাছি পৌঁছতেই চোখ
যেন ঝলসে যায় জুনিয়ার। ওই তো, ওই তো ঝকঝক করছে তারামণি। পায়রার ডিমের মতো স্বচ্ছ
পাথর এক, তার ভেতরে সহস্র আগুনের শিখা, লক্ষ রামধনুর রং। নিচু হয়ে আসে রিশিন আর এক
ছোঁয়ে তারামণি উঠে আসে জুনিয়ার হাতে।
আকাশে বাতাসে ঝংকার দিয়ে বেজে
ওঠে কী যেন অপার্থিব সুর। হ্রদের ধার আলো করে লহমায় ফুটে ওঠে অগুনতি ফুল। ঝাঁকে
ঝাঁকে রঙিন প্রজাপতি উড়ে আসে কে জানে কোথা থেকে। জুনিয়ার মুঠোর মধ্যে শীতল আগুন
হয়ে তারামণি জ্বলতে থাকে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে টর।
“পথ দেখাও টর। জাদুকরীর কাছে
যাব, পথ দেখাও। মণি পেয়েছি, যার মণি তাকে ফেরত দিতে হবে এবার,” জুনিয়ার কথায় ঘোর
ভাঙে টরের।
“পশ্চিম আকাশের ওই আগুন-আলো
ধরে চলতে হবে আমাদের। নোহিতা চেনে আগুনপাহাড়ের পথ। সেই নিয়ে
যাবে। আর চিন্তা নেই।”
সূর্যাস্তের পথ ধরে উড়ে চলে
নোহিতা।
তার পিছু পিছু রিশিন।
তখন জাদুকরী আনাইৎ আগুনপাহাড়ের
লালচে আকাশে তার ঘন কালো চুলের রাশি মেলে দিয়েছে। তার ফাঁকে
ফাঁকে একটি দুটি করে হিরের কুচির মতো তারা সবে ফুটে উঠতে শুরু করেছিল। এমন সময় তার
সামনে এসে ডানা ভাঁজ করে দাঁড়াল নোহিতা আর রিশিন। এতখানি পথ একটানা উড়ে তাদের
কষে ফেনা, গায়ে ঘাম।
টর লাফ দিয়ে নামে ঘোড়ার পিঠ
থেকে।
তার পেছনে পেছনে নামে জুনিয়া। হাঁটু মুড়ে বসে তারা দুজন জাদুকরীর পায়ের কাছে।
“কে তোমরা?” বিস্মিত আনাইৎ প্রশ্ন করে।
“অভিবাদন, জাদুকরী আনাইৎ! আমি
দক্ষিণদ্বীপের জুনিয়া।”
“আমি মাওটং গ্রামের টর।”
“মাওটং গ্রাম?” জাদুকরীর অপরূপ মুখ শক্ত হয় মুহূর্তে, “সেই বিশ্বাসঘাতকের
গ্রাম! আবার এসেছ? সেখান থেকে আবার এসেছ? এবার কোন মিথ্যা নিয়ে এসেছ তস্কর? কী
নিয়ে যাবে লুকিয়ে?”
“নিয়ে যেতে আসিনি জাদুকরী।
ফিরিয়ে দিতে এসেছি,” জুনিয়ার গলায় একটুও কাঁপন নেই। জাদুকরীর চোখে সটান চোখ রাখে
সে।
“ফিরিয়ে দিতে? কী ফেরাতে এসেছ বালিকা? কী
দিতে পার তুমি আনাইৎকে?”
জুনিয়া জবাব না দিয়ে শুধু
হাতটুকু প্রসারিত করে ধরে। তালুতে গনগন করে তারামণি।
“তারামণি! আমার তারামণি? কোথায় পেলে তোমরা একে?”
আনাইৎ ব্যগ্র হাত বাড়ায় এবং স্তম্ভিত হয়ে দেখে জুনিয়া তার হাত সরিয়ে নিয়েছে।
“আগে আপনার কথা রাখুন,
জাদুকরী আনাইৎ।”
“কথা? কী
কথা?”
“ভুলে গেলেন জাদুকরী? অভিশাপ
মনে আছে আর প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলেন?”
আনাইৎ ক্রোধে লাল হয়ে ওঠে।
বড়ো বড়ো শ্বাস পড়ে তার।
“কার সঙ্গে কথা বলছ মনে রেখো
জুনিয়া। এক লহমায় আমি তোমাকে একটা ক্ষুদ্র কীট বানিয়ে দিতে পারি, তা কি তুমি জান
না?”
“জানি জাদুকরী। তবুও বলছি,
নিজের প্রতিজ্ঞা মনে করুন। একজনের অপরাধে একটা গোটা গ্রামকে আপনি জীবন্মৃত করে
রেখেছেন আজ এত বছর। এবার ফিরিয়ে নিন সেই অভিশাপ। ফিরে পান আপনার তারামণি।”
আনাইৎ একবার জুনিয়ার দিকে
তাকায়, একবার তাকায় টরের দিকে। হঠাৎই হেসে ওঠে সে।
“আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তর্ক
করছ, সাহস আছে তোমার কন্যা। ভালো লাগল তোমাকে। বেশ। তাই হবে। আজ থেকে মাওটং গ্রাম
আবার ফিরে পাবে তার সবুজ, তার প্রাণ।”
জুনিয়া আর টরের বিস্মিত
দৃষ্টির সামনে একটা সবুজ আলোর স্ফুলিঙ্গ তিরের মতো ছিটকে বেরোয় জাদুকরীর প্রসারিত
দুই হাতের আঙুলের ডগা থেকে। বাঁক নিতে নিতে সেটা নেমে যায় নিচে, অনেক অনেক নিচে।
হঠাৎই অনেক পাখির কোলাহল ভেসে আসে কোথা থেকে যেন।
জাদুকরী হাসিমুখে হাত বাড়ায়, “এবার দেবে?”
জুনিয়া নীরবে তারামণি তুলে
দেয় আগুনপাহাড়ের জাদুকরীর হাতে। মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানায় আনাইৎকে। তার কাজ
শেষ।
রিশিনকে নিয়ে পেছন ফেরে
জুনিয়া। কিন্তু থামতে হয়। নোহিতার পিঠে টর এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে।
“তুমি ফিরবে না আমার সঙ্গে? তোমার জন্যেই তো মাওটং আবার সবুজ ফিরে পেল। খিম তোমাকে
নিজে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাইবে তো! আমরা সকলেই, মানে, তুমি না এলে তো এসব কিছুই হত
না।”
“না টর। আমাদের রাস্তা এখান
থেকেই আলাদা হল। তুমি ফিরে যাও তোমার নিজের দেশে। সবাইকে আমার ধন্যবাদ দিও। আমার
চলা তো শেষ হয়নি। আমাকে যে দক্ষিণদ্বীপের পথ খুঁজে পেতেই হবে,” বলতে বলতেই রিশিনের
কেশরে টান দেয় জুনিয়া। রিশিন ডানা মেলে দেয় ওপরে, আরও ওপরে।
টর আর জাদুকরীর দু’জোড়া
চোখের সামনে ক্রমশ ছোট থেকে আরও ছোট হতে হতে সুদূরে মিলিয়ে যায় তারা দুজন।
_____
অলঙ্করণঃ ঋতম মুখার্জি
চমৎকার লাগল গল্পটা।
ReplyDeleteদারুণ লাগল।
ReplyDeletekhub bhalo legeche
ReplyDeletedurdanto...bahudin por ek niswas e rupkotha porlam.........
ReplyDelete