গদ্যে পদ্যে রূপকথা:: চুপকথা - প্রকল্প ভট্টাচার্য


চুপকথা
প্রকল্প ভট্টাচার্য

অবাকপুরের অচিন কথা, রাজকন্যে চুপকুমারী
হোক না অলীক কল্পনা তা, তাই কখনও ভুলতে পারি!

তারপর তো চুপকুমারীর দুঃখে সারী কেঁদে কেঁদে চোখদুটোকে এক্কেবারে জবাফুল বানাল তাকে ভোলাতে শুক কত্তো ছড়া কাটে, কত্তো মজার গল্প বলে, কিছুতেই কিছু হয় না!
ফুলপরীদের সঙ্গে যাবি? তুলোট ফুলে রোদ পোয়াবি?”
তবু সারী ফিঁচফিঁচিয়ে কাঁদে
আসবি ভেজা আকাশ ছুঁতে? রঙ মাখাবি রংধনুতে?”
সারী ফুঁপিয়েই চলে, ফুঁপিয়েই চলে শেষে শুক বলে, “দুত্তেরি, কে রে এই চুপকুমারী? কী তার এত্ত দুখ্খু, যে তোর চোখে দুদিন ধরে আষাঢ় শ্রাবণ?”
সারী তখন কোনওমতে হাঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে শুরু করে চুপকুমারীর গল্প

গল্প না রে, গল্প না!
রঙ মেশা এই কল্পনা
আত্তি মেশা সত্যি কিছু,
মূল্য তো তার অল্প না!

আত্তি? আত্তি আবার কী রে!”
আত্তি জানিস নে! আত্তি রে, আত্তি! বিপদে পড়লে আমরা যেমন আত্তি জানাই, ঠাকুর আমার বিপদ কাটিয়ে দাও!”

সে অনেকদিনের নয়কো কথা, এই তো কদিন আগে
অবাকপুরের রাজকুমারী, ভাবতে অবাক লাগে,
গান ছিল তার, গল্প ছিল, পদ্য ছিল সাথী,
রঙ ছিল তার আকাশ জুড়ে, রঙিন দিবা রাতি,
রূপকুমারী নাম ছিল তার ফুলের মতন রূপ,
হঠাৎ কী এক মন্ত্রবলে এক্কেবারেই চুপ!

চুপ তো চুপই কথা বলে না, গান গায় না, কেউ ডাকলে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে শুধু সইরা খেলতে ডাকে, সে যায় না রানি জানতে চান, “কী হয়েছে তোর, সোনা?”
রাজা জানতে চান, “কী চাই তোর, মানিক?”

কন্যা কাড়ে না তো রা-টি কন্যার মুখেতে কুলুপ!
কন্যার আলো মুখও কালো হল, একেবারে চুপ!

ধীরে ধীরে কন্যার মুখের আঁধার সারা রাজ্যকে ঢেকে ফেলে মন খারাপের মেঘ ক্রমে গ্রাস করে নেয় সমস্ত আনন্দ উৎসব গোটা রাজ্য ঝিমিয়ে পড়ে অবাকপুর সত্যিই অ-বাক হয়ে যায়
তারপর? তারপর?
তারপর সারা দেশে বসন্ত আসে, শুধু অবাকপুরে শীত কাটে না সব জায়গায় ফুল ফোটে, কচি পাতায় রোদ্দুর হাসে, শুধু চুপরাজ্যে জুবড়িমাখা কুয়াশাবুড়ি অন্ধকারে হি-হি করে হাড়কাঁপানি হিমোয় আর ঝিমোয়, হিমোয় আর ঝিমোয়...

কার শাপে যে রূপকুমারী চুপকুমারী হল
তোমরা যদি জানতে পারো, শুক সারীকে বোলো!

কিন্তু শুধু কি শুক সারী? কন্যার দুঃখে দুঃখী ছিল সক্কলে ফুলপরীরা, জলপরীরা, চাঁদপরীরা, রাতপরীরা সবাই মিলে বৈঠক করল একদিন কী উপায়ে কন্যার মুখে হাসি ফেরানো যায়
ফুলপরী বলল, সে নিয়ে আসবে মুচকিফুলের রেণু
জলপরী বলল, সে সেই রেণুতে শিশির মিশিয়ে তৈরি করবে আলতা পাতলা রঙ
চাঁদপরী বলল, সে আকাশ থেকে অলিন্দ দিয়ে ঘুমন্ত চুপকুমারীর মুখ পর্যন্ত বানিয়ে দেবে জোছনার সিঁড়ি
রাতপরী বলল, সে সেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে গিয়ে মুচকিফুলের রেণুর রঙে চুপকুমারীর ঠোঁটে এঁকে আসবে আলতো ফিক হাসি
কিন্তু যেমন ভাবা, তেমন হল কইফুলপরী গোটা রাজ্য খুঁজেও মুচকিফুল পেল না, সব নাকি মুষড়ে গেছে কন্যার দুঃখে শিশির জমাতে গিয়ে জলপরী পেল শুধু টলটলে নোনা অশ্রু চাঁদপরীর জোছনার সিঁড়ি এত পেছল হল, তা বেয়ে নামে কার সাধ্যি এখন রাতপরী ফিক হাসি আঁকেই বা কী করে, না এঁকে থাকেই বা কী করে!
সারী কাঁদে সারীর কষ্টে শুকেরও চোখ ছলছল করে

ফুরোসনি রে আমার কথা, মুড়োসনি রে নটে,
হোক না সে রাত যতই কালো, সূর্য আবার ওঠে!

তারপর? তারপর? সূর্য উঠল?”
উঠল রে, উঠল একদিন টগবগিয়ে ঘোড়া চেপে অবাকপুরে এসে হাজির হল এক বণিক
বণিক? সে কীসের বাণিজ্য করে?”
হাসির নানান রকম হাসি আছে তার ঝুলিতে

হা-হা-হা অট্টহাসি,
হো-হো-হো লট্টহাসি,
হি-হি-হি ফিনকি হাসি,
খরিদো জিন কি হাসি!
হ্যাঃ-হ্যাঃ ঠিকরে হাসি,
খুশিতে, ফিকরে হাসি,
এতসব হাসিই এনে
এল সেই হাস্যবেণে!

তো সেই হাস্যবেণে অবাকপুরে ঢুকেই খুলল তার পসরা হাসি চাই গো, হাসি! হাহা, হোহো, হিহি যেমন হাসতে ভালবাসি!”
লোকজন অবাক চোখে দেখল তাকে, মুখ চাওয়াচাওয়ি করল তারপর ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইশারাতে তাকে দেখিয়ে দিল রাজপুরীর রাস্তা

মুখেতে না বলল,
হাস্যবেণে চলল
মেঘলা ঘোলাট দিন ফুরোলে ফ্যাকাশে রোদ ঢলল,
হাস্যবেণে চলল
চলে চলে চলে চলে, মাঝরাতে সে পৌঁছে গেল রাজার পুরীর কাছে
দেখতে পেল, নিঘুম চোখে চুপটি বসে আছে
চুপকুমারী, চোখের নীচে জমেছে তার কালি,
লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে আর ফোঁপায় সে যে খালি!
রূপকুমারী, চুপকুমারী ফিসফিসিয়ে কাঁদে,
হাস্যবেণে, আসলি শেষে এত্ত বছর বাদে!

তারপর? তারপর? হাস্যবেণে তার জাদুর ঝুলি থেকে সোনার রূপোর কাঠি বার করে নিশ্চয়ই...”
ওটাই তো হল না!”
সেকি! সেটা হলও না! তারপর, বল না!”
বলছি রে বলছি হাসির পসরা নিয়ে আজও পথ চলছি!”

বেণে নয় জাদুকর, নেই জাদুদণ্ড!
আছে শুধু ভালোবাসা, আবেগ প্রচণ্ড

কিন্তু অতো রাত্তিরে কে তাকে প্রাসাদে ঢুকতে দেবে? কে দেবে বসতে? উলটে চোরচোট্টা ভেবে কিল চড়টা না মেরে বসে! সকাল অবধি অপেক্ষা করবে? কিন্তু ততক্ষণ চুপকুমারীর কান্নাও তো আর সওয়া যায় না... তাহলে উপায়?
অনেক ভেবেচিন্তে হাস্যবেণে তখন তার সমস্ত হাসির ঝুলি চুপকুমারীর জানলার তলায় রেখে আবার ঘোড়ায় চেপে ফিরতে লাগল কেউ তো সেই ঝুলি খুলবে, আর তাহলেই ভুসভুসিয়ে নানারকম হাসি বেরিয়ে ভরিয়ে দেবে তার প্রাসাদ, ভরিয়ে দেবে গোটা রাজ্য

ফুরোসনি রে আমার কথা, মুড়োসনি রে নটে,
যতক্ষণ না ফুটছে হাসি চুপকুমারীর ঠোঁটে!
যতক্ষণ না বলছে কথা, গাইছে কন্যা গান,
হাস্যবেণের নেইকো ছুটি, নেইকো সমাধান,
সমস্ত তার হাসির পুঁজি চুপকুমারীর কাছে,
ঝোলায় বাঁধা, খোলার ধাঁধা জট পাকিয়ে আছে
খুলবে ঝোলা একদিন ঠিক, হাস্যবেণে জানে,
আকাশ বাতাস ভরবে আবার রূপকুমারীর গানে!

তারপর? তারপর?”
তার তো পর নেই, তার আপন, তার এখন
গল্প কি শেষ? সে শুক সারী? হাসল আবার রূপকুমারী?”
হাসবে আবার, বলবে কথা লিখবে ছড়া, লিখবে গাথা!”

এই শহরেও অনেক মানুষ সে কন্যাকে চেনে,
তাদের কাছে এই অনুরোধ করছে হাস্যবেণে,
কিচ্ছুটি না, পারলে দিও হাসির ঝুলি খুলে,
দেখবে কেমন হাসির তোড়ে কষ্ট যাবে ভুলে!
আর পালাবার পথ পাবে না অসহ্য গোমড়ামি!
বুঝবে, কেন হাল্কা হাসি হীরের চেয়েও দামী!
_____
অলঙ্করণঃ হিমি মিত্র রায়

1 comment: