ইভান আর ভাসিলিসার গল্প
পার্থপ্রতিম মাইতি
চাষার ছেলে ইভান
স্তেপের ঊষর প্রান্তরে শুকনো হাওয়ায় রুখু চুল উড়িয়ে দিশাহীনভাবে ঘুরছিল। তার রাজার
ছেলের মতো লাগাম লাগানো ঘোড়া নেই, রাজার মতো দুধসাদা
পক্ষিরাজ নেই, স্বপ্নরাজ মরফিউসের সিভকা বুরকা
- তা তো ক্ষুদে ইভান ঘুমিয়ে কাটানো শুধু স্বপ্নেই দেখেছে। এমনকি, দেশ-দেশান্তর
টহলিয়া সওদাগরের মোট বওয়া গাধাও একটা নেই ওদের ঘরে। কারণ, ওরা গরিব। বাপ, ওরা তিনভাই, দুটো মুরগী, তিনটে ছাগল আর একটা ভাঙা লাঙল। শীঘ্রই
এক জাঁদরেলি সৎমা আসবে খবর আছে। সারাদিন গ্রামের জমিদারের জমিতে ভাগচাষ করে ইভানের
বাবা, ইভানের দুই ষন্ডা দাদা। ক্ষুদে ইভান একটু কাজ করে আর পারলেই টুক করে একটু ঘুম
মারে। এত খাটাখাটনি সত্ত্বেও সবদিন কেন কে জানে দু’বেলা রুটি জোটে না ঠিকঠাক। তাই
বিকেলের দিকে গ্রাম পার হয়ে স্তেপের মাঠে মাঠে ঘুরে কাটিয়ে দেয় ইভান। মাঝে মাঝে
ঘাসে ঢাকা জংলাতেও ঢুকে পড়ে। সূর্যির আলো নিভে যায়, চাঁদের জ্যোৎস্না ভাসে। খিদেটা অত টের পায় না ক্ষুদে ইভান। বরং বাড়ি ফিরতে
ইচ্ছে করে না। সেই একই ফাইফরমাশ সবদিন। বরং সারারাত স্বপ্ন দেখে। সারাদিন রোমন্থন ওর প্রিয় বিনোদন। যার জন্য ইভানের
রোজকার বরাদ্দ চাঁছা বেতের বাড়ি। সঙ্গে ফাউ হিসেবে অলস, কুঁড়ে, ঘুমকাতুরে এসব
পৌরাণিক বদনাম। এসবে কিছু মনে করতে নেই।
বালিঘাসে ছাওয়া
দিগন্তবিস্তৃত মরুস্থলী। মাঝে চোখজুড়নো এক সরোবর। আর তার কাকচক্ষু জল। তার এককোণে
একটা শ্যাওলা রঙের গাছের গুঁড়ি, ভেতরটা তার ফাঁপা।
তার ভেতর গুটিশুটি মেরে বসে ক্ষুদে ইভান শুধুই ঘুমায়। সে সময় একটু ঘুমিয়ে নেওয়ারই জোগাড়পাতি করছিল সে। যেটা সুযোগ পেলেই ও করে
থাকে। কিন্তু পেটে ছুঁচোর ডন, কেত্তন চলতে থাকলে ঘুম কি আর সহজে আসে! তাই ঘুম এল
না। স্বপ্নও না। মরফিউসের দয়া হল না। কিন্তু হঠাৎ চাঁদের চরাচর বিছানো রুপালি
জ্যোৎস্না হয়ে এল ম্লান। সোনার থালার মতো বিরাট চাঁদ। তার কোলে প্রথমে দেখা গেল
একটা কালো বিন্দু। চারপাশের প্রকৃতি হঠাৎই নিশ্চুপ যেন - যেন রুদ্ধশ্বাস হৃদয়ে
প্রিয়জন কারোর অপেক্ষায়। অনেকদিন পরে দেখা
হবে যার সাথে। চাঁদের কোলে কালো বিন্দু দেখতে দেখতে বড়ো হয়ে এল।
তারপর সোনালি ডানা
মেলে দূর-দিগন্ত দেশ থেকে উড়ে এল রাজকন্যে ভাসিলিসা। প্রতিবছর একবার চাঁদনি রাতে
শুক্লপক্ষে কাকচক্ষু সরোবরে নাইতে আসে রাজকুমারী। কাউকে না জানিয়ে। গোপনে। অনেকদিন
আগে দেখা হয়েছিল তার ডাইনি বাবাবা ইয়াগার বোন বাবা ইয়াগার সাথে। সে বলেছিল, কোনও
একদিন চাঁদনি রাতে শুক্লপক্ষে কাকচক্ষু সরোবরে নাইতে এলে এক সুন্দরপানা কুমারের
সাথে দেখা হবে ভাসিলিসার, যে হবে তার বাকি জীবনের সঙ্গী। আজ সেই দিন।
ভাসিলিসা সরোবরের
তীরে এসে খুলে ফেলল ডানা, ছেড়ে ফেলল পোষাক। তারপর সেগুলো জড়ো করে বালির ওপর রাখল। তারপর কাকচক্ষু
সরোবরের টলটলে জলে নাইতে নামল নিশ্চিন্তে। এবারও সুন্দরপানা কুমারের দেখা পাওয়া
যাবে না ভেবেই হয়তো।
এদিকে ক্ষুদে ইভান
না দেখেছে এমন ডানাওয়ালা রাজকন্যে, না শুনেছে তেমন পরির
মতো অপরূপ রূপের কথা। কিছুক্ষণ সে চোখ ধাঁধিয়েই বসে রইল। তারপর একসময় শ্যাওলাগুঁড়ি
ছেড়ে ভাসিলিসার ডানা আর জামা টুক করে তুলে নিয়ে লুকিয়ে পড়ল।
ভাসিলিসা ততক্ষণ
স্নান করেছে, গা মুছেছে, তারপর ডাঙায় উঠে
দেখে ডানাও নেই, জামাও নেই। দুশ্চিন্তা নয়, তার বদলে আনন্দে নেচে উঠেছে তার হৃদয়। তক্ষুনি হাঁক দিল ভাসিলিসা,
“কে নিলি আমার
সোনালি ডানা?
বল ফেরৎ দিয়ে যাবি
কি না।
কুৎসিত হলে খুব করে
দেব বকে
সুন্দরপানা হলে করব
বিয়ে তাকে।”
অমনি ক্ষুদে ইভান
বেরিয়ে এসে দাঁড়ালে গিয়ে ভাসিলিসার কাছে। চাষির ছেলে হলেও ক্ষুদে ইভান দেখতে
চাষাড়ে ছিল না। ফলে বাবা ইয়াগার কথা সত্যি হল। ভাসিলিসার ক্ষুদে ইভানকে পছন্দ হল। এতটাই সে পছন্দ যে জিজ্ঞাসাও করলে না ইভান
সোনার চামচেতে খায়, নাকি অনাথ - ঘুরে বেড়ায় রাস্তায়
রাস্তায়।
সে রাতে দু’জনের
গল্প হল অনেক। রাজকন্যের সব গল্প ইভানের জানা হয়ে গেল। দুধসাদা মেঘপাহাড়, রুপালি বালুতটে নীল নদী পেরিয়ে অদীক্ষিত ললাটের
রাজ্য। সোনার পুরী, রুপোর খিলান, তামা মোড়া পথ। আর রাজার একমাত্র কন্যে রাজকন্যে
ভাসিলিসা।
রূপ তার ধরে না,
মুখে হাসি তার সরে
না।
কিন্তু দেমাক নেই
এতটুকু। রাত অপেক্ষা করে না কারও জন্যে। ভোরকে জায়গা করে দিতে হয়। ইভানের চিন্তা
নেই এতটুকু। ঘরে ওকে কেউ খুঁজবে না। বরং একপেট খাবার বেঁচে যাবে বলে খুশিই হবে
হয়তো। কিন্তু ভাসিলিসাকে যে এবার উঠতে হয়। জানতে পারলে অদীক্ষিত ললাট ওকে কপাট
বন্ধ করে রেখে দেবে। ভাসিলিসা কাঁধে লাগাল সোনালি ডানা। চুল গুছিয়ে বাঁধলে খোঁপা। তারপর ইভানের হাত ধরে বলে,
“যদি চাও আমাকে –
আমাদের বাড়ি এসো,
সকলের সঙ্গে মেশো।
সকলের মন করো জয়,
রেখো না কারও কোনও
সংশয়।
নইলে পারব না সুখী
হতে।”
বলে ভোরের কমলা আলো
ডানায় মেখে আর ক্ষুদে ইভানের মনে স্বপ্নের রঙ লাগিয়ে ভাসিলিসা উড়ে চলে গেল যেখান
থেকে এসেছিল সে, অদীক্ষিত ললাটের খাস
রাজপ্রাসাদে। আর ইভান ফিরে গেল নিজের কুঁড়েঘরে। গিয়ে বাপ-দাদার কাছে খেল সে কী
ভীষণ বকা!
তারপর কেটে গেল
অনেকদিন। নাকি অল্পদিন? বিরহে
অস্থির হয়ে উঠল ক্ষুদে ইভানের মন। ততদিনে সৎমা এসে গেছে। বাড়িতে বাস করা প্রায় দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে। সেদিনই নিশুতি রাতের শুনশান ঘরকে
বিদায় বলে বেরিয়ে এল সে। রাজকন্যে ভাসিলিসাকে এবার একবার না দেখলেই নয়।
দিন যায়। কত দিন তার হিসেব রাখার প্রয়োজন
পড়ে না।
কতবার সূর্য ওঠে, কতবার অস্ত যায়
চাঁদের জ্যোৎস্না
তখন পথ দেখায়।
তারপর একদিন
শেষবেলায় গহন বনের কোণে মুরগীর একঠেঙে ন্যাড়া কুঁড়ের দেখা মিলল। ক্ষুদে ইভানের
দিকে পিঠ আর গহন বনে দোর খুলে রয়েছে। এখানেই বাস ডাইনি বুড়ি বাবাবা ইয়াগার বোন
বাবা ইয়াগার। ক্ষুদে ইভান হাততালি দিয়ে গলা উঁচু করে বলল,
“কুঁড়ে, ওরে আকুড়ে কুঁড়ে,
ডাইনি কি রয়েছে ঘরে?
আচ্ছা, আপাতত এক
কাজ কর,
বনের দিকে করে পিঠ
আমার জন্য খোল দোর।”
কুঁড়ে ইভানের কথামতো
নড়েচড়ে ধুলো উড়িয়ে পিঠ রাখল গহন বনে আর দোর খুলল ইভানের জন্যে। ইভান ভাবল, এই বুঝি
ডাইনি বেরিয়ে এসে বলে, হাঁও মাঁও খাঁও রুশীর গন্ধ পাঁও। বাবা ইয়াগা কিন্তু সেরকম কিছু করল না। বরং ঠুকঠুক করে লাঠি ঠুকে এসে বলল,
“কী রুশি,
রাজকন্যে ভাসিলিসার
খোঁজে বেরিয়েছিস বুঝি?”
ইভান বলল,
“ছিঃ বুড়ি ডাইনি,
তোর লজ্জাও করে না
নাকি?
কত পথ হয়ে পার
শরীর ক্লান্তিতে
ভার।
দেহ বুঝি হয়ে এল
সারা
আর তুই এখন শুরু
করেছিস জেরা।”
বাবা ইয়াগা তখন
ইভানকে ঘরে বসাল। খাওয়াল, দাওয়াল, বিছানা পেতে ঘুমোতে দিল। তারপর সকাল হতেই জাগিয়ে দিয়ে জেরাতে করলে জেরবার।
ক্ষুদে ইভান সবই বলল। লুকিয়ে গেল নিজের কথা। ভাসিলিসাতেই তার গল্পের শুরু আর
ভাসিলিসার খোঁজেই শেষ। শুনে বাবা ইয়াগা বলে,
“এই দেখছ গহন বন
এর উত্তরে-দখিনে
পুবে-পশ্চিমে যেও না যেন।
সোজা যাবে নাক বরাবর,
পথে কোরো নাকো
গড়বড়।
অদীক্ষিত ললাট, ভদ্রলোক সে নয়
নিপাট রাজকন্যেকে
দেখার আগে
কথা বলো রানির
সাথে।”
আবার অনেক সূর্যির
আলো, অনেক চাঁদের জ্যোৎস্নার পর মেঘপাহাড় নীল নদী পেরিয়ে ইভান পৌঁছল রাজা অদীক্ষিত
ললাটের রাজ্যে। সোনার পুরী, রুপোর খিলান আর
তামায় মোড়া পথ। রাজবাড়িতে ঢুকে ইভান নিল রাঁধুনির জোগানদারের কাজ। তারপর সুযোগ খুঁজতে
লাগল কীভাবে দেখা করা যায় ভাসিলিসার সাথে। কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ল বাবা ইয়াগা বলেছিল
আগে রানির সাথে কথা বলতে। ডাইনির কথা বিশ্বাসযোগ্য কি না ভাবতে ভাবতে গেল আরেকদিন।
তবে ক্ষুদে ইভান বুদ্ধিমানও বড়ো কম ছিল না। দোষের মধ্যে ছিল শুধু একটু বেশি ঘুমকাতুরে।
একদিন করল কী, ইচ্ছে
করেই ভালো আনাজের ভেতর পচা সবজি, মিষ্টান্নর দুধে চোনা মিশিয়ে চালান করে দিল বড়ো
রাঁধুনির জিম্মায়। ফলে সেদিন রান্না যা হল তা কহতব্য নয়। রানির কাছে তলব পড়ল বড়ো
রাঁধুনির। তারপর যথাসময়ে ইভান জোগানদারের।
তাই তো চায় ক্ষুদে ইভান। সোজা গিয়ে রানিকে বাবা ইয়াগার কথা বলল। সে কেন এসেছে তাও বলে দিল।
রানি রেগে লাল হলেন? না। রাজা অদীক্ষিত ললাট পাশের মারকুটে রাজ্যের লড়াকু
রাজার সাথে সন্ধি করার জন্য রাজকন্যে ভাসিলিসার সাথে লড়াকুর বিয়ে দিচ্ছেন খুব
শিগগিরি তা রানির কাছ থেকেই জানা গেল। এদিকে দেশসুদ্ধু সকলেই জানে যে লড়াকু কতটা বদ
চরিত্রের লোক। অদীক্ষিত ললাট চোখ কান বুজিয়ে থাকলেও রানি তো তা পারেন না। তাঁর
পেটে ধরা একমাত্র মেয়ে ভাসিলিসা। এভাবে আমুদরিয়ার জলে ভাসিয়ে তো দিতে পারেন না। রাজাকে
বুঝিয়ে ভাসিলিসার জন্য আয়োজন করেছেন এক স্বয়ম্বর সভা। সেই সভায় যে রাজা ললাটের
শর্ত পূরণ করতে পারবে সেই পাবে রাজকন্যেকে। রানি বলে চলেন,
“সভার দিন নয় তো
দূরে,
কিন্তু তোমায় দেখে
মন যে বলছে
ছেলে তুমি বড্ড
কুঁড়ে।
কুঁড়েমি কর দূর,
সময় যে নিঠুর!
কারও জন্যে অপেক্ষা
করে না।”
সেদিন রাতে রানির খাসমহলে
রাজার চোখ এড়িয়ে ইভানের সাথে ভাসিলিসার পুনর্মিলন। স্পষ্টতই রানিমার গলেছে মন। ভাসিলিসার
মতেই তাঁরও মত। কিন্তু অদীক্ষিত ললাটের মনের গলনাঙ্ক তো জানা নেই। বুদ্ধিতে হয় সব
কাজ। আর চোখ কান রাখতে হয় খোলা। ভাসিলিসা ইভানকে জানায় রাজা ভাসিলিসাকে একটা
দুধসাদা কাকাতুয়া বানিয়ে দেবে স্বয়ম্বর সভায়। তারপরে ছেড়ে দেবে একদল দুধসাদা
কাকাতুয়ার দলে। সব পাখি খুঁটে খুঁটে খাবার খাবে। যে পাখি মুখে তুলবে না একটা দানা
ভাসিলিসা সেই। ইভান বলল,
“ব্যাপারটা তাহলে
এই!
যাই, এখন তাহলে
ঘুমাই।”
পরেরদিন সকাল। হৈ
হৈ কান্ড, রই রই ব্যাপার। রাজকন্যের
স্বয়ম্বর সভা। রাজপ্রাসাদ রাজায় প্রজায় লোকারণ্য। তিলধারণের জায়গা নেই। কিন্তু ইভান
কই? শেষে রান্নাশালা থেকে ধরে আনা হল তাকে। গুটিসুটি মেরে আরামের ঘুম দিচ্ছিল গরম
চুল্লির আঁচে। চোখ মুছতে মুছতে
এসে ইভান কিন্তু ঠিকই বলে দিল ওই পাখিটা ভাসিলিসা। অমনি পাখি উবে গিয়ে ভাসিলিসাকে
দেখা গেল। এদিকে লড়াকুও বলে দিয়েছে যে পাখিটা খাচ্ছে না দানা ওটাই রাজকন্যা। ম্যাচ
ড্র। ঘোষণা করে দেওয়া হল পরের দিন আর পাখিটাখি নয়, ইভান আর লড়াকু দু’জনকেই দুটো বুনো ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে দেওয়া হবে। যে পারবে বশ
করতে, রাজকন্যা যাবে তার জিম্মায়।
ইভান খুশি মনে এল
ফিরে,
ওই কাজটাই তো সে
ভালো করত
যখন থাকত ঘরে।
সেই রাতে ভাসিলিসার
কিন্তু মুখ গোমড়া রইল। বলল,
“লড়াকুটা বললে কী
করে?
বাবা যে ওকে
দিয়েছিল বলে
যে পাখি খাচ্ছে না
দানা,
সেই রাজকন্যা।”
ইভান আত্মবিশ্বাসী।
বলে, “পরের দিনের চিন্তা করো না যেন। বুনো ঘোড়া বশ, ও আমার কড়ে আঙুলের কম্ম।”
ভাসিলিসা বলল, “না,
তোমার মুন্ডু। ব্যাপারটা ঘোরালো।”
লড়াকু রাজাকে দেওয়া
হবে একটা নড়বড়ে বুড়ো ঘোড়া, যে কিনা বুনোও নয়
আর বড়োও নয়। আর ইভানের বেলায় আসবে রাজা অদীক্ষিত ললাট নিজে, লালচে রঙের বিশাল ঘোড়া হয়ে। সিভকা বুরকার মতো তার
চেহারা।
ভীষণ হ্রেষা রবে
চতুর্দিক দিশেহারা। ভাসিলিসা ইভানকে বলে দিল একটা ছোট মুগুর নিয়ে রাখতে আর বারবার
পাঁচ পলক পরপরই যেন ঘোড়ার ঘাড়ে পড়ে মুগুরের ঘা। তবেই ঘোড়া থাকবে ঠান্ডা। এসব অনাসৃষ্টি
কথা শুনেও ক্ষুদে ইভান হেললও না দুললও না। কোনও হেলদোল না দেখিয়েই চুপচাপ ঘুমাতে
গেল।
পরের দিন কিন্তু
ঠিক সময়ে স্বয়ম্বর সভায় এল। দ্বিতীয় পর্ব হল শুরু। সভার মধ্যমণি হয়ে চারদিক আলো করে
বসে আছে রাজকুমারী ভাসিলিসা।
রূপে আর সৌন্দর্যে
সবাই মুগ্ধ যার,
কোথায় লাগে পরির
বাহার?
প্রথমে লড়াকুর পালা
পড়ল। মারকুটে রাজ্যের লড়াকু রাজা যে এভাবে বুড়ো ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে কোমর ভাঙবে তা
কে জানত। ঘোড়া আর রাজা দু’জনকেই ধরে বেঁধে যথাযোগ্য স্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হল।
চারদিক থেকে যেরকম দুচ্ছাই সে শুনল তা আর বলে কাজ নেই।
এরপর এল ইভানের
পালা। ইভান মুখ ঘুরিয়ে দেখল। কিন্তু অদীক্ষিত
ললাটকে দেখল না। যা বাব্বা, ভাসিলিসা তাহলে
ঠিকই বলেছিল। রাজা নিজেই আসছে তবে। আরেক দিকে ঘুরল। ভাসিলিসার উদ্বিগ্ন মুখ। চোখাচোখি হতেই সে হাতটা মুগুর করে দেখাল। ইভান হাতের
ইশারায় জানাল,
কোনও ব্যাপার নেই
বেশ করে ঠুসে দেব
এলেই।
ইভানের ফাঁকা ফাঁকা
বুক। ভয়ে শিরশিরে গা। ভাসিলিসার উদ্বিগ্ন চোখে চোখ পড়তেই একপলকে হাওয়া। মুগুরটা
হাতে করে মাঠে নামল ইভান। বেড়া টপকে যেন উড়ে এল সেই লালচে ঘোড়া। কোনও সহিসের সাধ্য
নয় একে আটকে রাখা। তার বিশাল চেহারার দাপুটে ছোটাছুটিতে চারদিকে উঠল ধুলোর ঝড়। বোঝা
গেল, মরফিউসের ঘোড়া সিভকা বুরকার সাথে পাল্লা দিতে পারে এ ঘোড়া। এটাও বোঝা গেল,
একে বশ মানানো ক্ষুদে ইভানের কড়ে আঙুলের কম্ম নয়। এ তো তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলবে
গোবি মরুভূমির ওপারে। হাড়গোড়গুলো বছরের পর বছর রোদে শুকোবে আর কিছু বাঁচবে না।
সেরকমই হল। লালচে
ঘোড়া তাকে একবার উড়িয়ে নিয়ে গেল নীল আকাশের সুদূর মেঘের রাজ্যে, যে মেঘ পরতে পরতে কেবল ভেসেই বেড়ায়, বৃষ্টি তাতে হয় না। আর একবার সোজা নিয়ে ফেলল কাস্পিয়ান সাগরের দশ বাঁও
জলের তলায়। ইভান কিন্তু ঘোড়ার গলা আঁকড়ে চুপচাপ বসে রইল। নড়ল না, চড়ল না, এমনকি ঘুমোলও না। কেবল পাঁচ পলক পড়তে না পড়তেই সপাটে মুগুরের বাড়ি মারতে লাগল
ঘোড়ার মাথায়। শেষে ক্ষান্ত দিল লালচে ঘোড়া।
পরের দিন রাজসভায়
ডাক পড়ল ইভানের। সিংহাসনে বসেছিলেন রাজা অদীক্ষিত ললাট। মুখটা যেন কেমন কেমন আর
মাথায় ইয়াব্বড়ো একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা। একদিকে বসে ভাসিলিসা। অন্যদিকে রানি। দু’জনকে দেখে ভরসা পেয়ে এগিয়ে গেল ইভান। কথা হল অনেক।
লাজুক হাসি, মুচকি হাসির উষ্ণ প্রস্রবণ। একটা পর্যায়ে রাজা ললাট ইভানকে একপাশে
ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “মুগুরটা কে নিয়ে যেতে বলেছিল শুনি। মুগুরটা কই?”
নটে গাছ মুড়োয়নি।
তার মানে কথাও ফুরোয়নি। চাষার ছেলে ইভান পেল রাজকন্যে ভাসিলিসাকে। সঙ্গে পেল রাজার রাজত্বের... না
না, অর্ধেক নয়, চারভাগের একভাগ। বয়েস তো দু’জনেরই কম। বড়ো রাজত্ব
সামলাবে কী করে! ললাটের মাথায় আর ব্যাথা নেই। জামাই ইভানের সাথে এখন খুব ভাব। দিনের বেলায় পাশা আর
সন্ধেতে দাবা। দান উলটে গেছে। সেদিন রাত্রে ভাসিলিসা
জিজ্ঞেস করে বরকে,
“এই যে ক্ষুদে ইভান,
এখনও কি ঘুমাতে
চান!”
ইভান বললে, “না!”
তারপর থেকে ইভানকে
আর কেউ ঘুমকাতুরে বলে না।
*****
(গল্পটি চরিত্রগতভাবে রাশিয়ান)
** অলঙ্করণঃ পুষ্পেন
মণ্ডল **
লেখক
পরিচিতিঃ বয়স একুশ। রামকৃষ্ণ মিশন রেসিডেন্সিয়াল কলেজে ইংলিশ গ্র্যাজুয়েট। ভালোবাসেন
পড়তে আর সিনেমা দেখতে।
No comments:
Post a Comment