একটু ভাবি
বইমেলার আগেই
শ্রেয়সী চক্রবর্তী
বই পড়ুয়া বইয়ের পোকা
একটা বড় আর-টা খোকা
কুচমুচিয়ে দাঁতে দাঁত
পাতায় পাতায় কুপোকাত!!
আর তো কদিন বাদেই জমজম করে
শুরু হতে চলল ৩৫তম কলকাতা বইমেলা। সেখানে হাজার হাজার বইয়ের স্টল, বইয়ের রাস্তা,
বইয়ের ঘরবাড়ি। তাছাড়াও সঙ্গে সঙ্গে বাগান আলো করে থাকে কত শত ছোট বড় মাঝারি
পত্র-পত্রিকার রকমারি আকর্ষণ। আজকাল আবার বিভিন্ন বায়বীয় অর্থাৎ অনলাইন বই
সংক্রান্ত ওয়েবসাইট বা ই-ম্যাগাজিনের স্টলও বইমেলায় দেদার দেখা যায়। (তেমনি একটা
ই-ম্যাগাজিনে এই লেখাটা বেরোচ্ছে যদিও!) তাছাড়া নানান টেলিভিশন চ্যানেল, বিভিন্ন
বৈদ্যুতিন মাধ্যমের হুড়োহুড়ি আড্ডা, ঝালমুড়ি, কাগজের ভেঁপু, মমার্ত, জিভে জল আনা
একশো রকম সুস্বাদু খাবার, টিভিতে মুখ দেখানোর সহস্র উপায়, অদ্ভুত সব চালের উপর নাম
লেখা, ধানের শিষের মাথায় মুখ আঁকানো, রণপা চড়া মানুষ আর জনস্রোতের উত্তাল ঢেউ – এই
হল বইমেলার অশেষ ঝলমলানি, যা কিনা পাঠক এবং হুজুগে অপাঠকের কাছে রোজনতুন।
বাহ! একদম ঠিক ধরেছ। আমি আসলে
‘পাঠক’ এই শব্দটার কাছে পৌঁছতে চাইছি। পাঠক কাকে বলব? বই কিনলেই বা বচ্ছরকার দিনে
বইমেলায় নিত্যি হানা দিলেই কি পাঠক বলা যায় মানুষকে?! আমরা ছোটবেলায় জানতাম পাঠক
হওয়ার জন্য অফুরান ভালবাসা লাগে আর লাগে ধৈর্য। আর ফুচকার সঙ্গে তেঁতুল জলের মতো
লাগে কয়েক ছটাক পাগলামি। প্রথমে আসি ভালবাসায়। এই ভালবাসা খুব উত্তেজিত, বই হাতে
পেলেই তাকে গিলে নিয়ে ছুঁয়ে-ছেনে, চটকে ঠিক কোলের কাছে পুষি বেড়ালটাকে আদর করার মত
তপতপে উদগ্রীব সোনালী ভালবাসা। যাতে একটুও তর সয় না নতুন বইয়ের গন্ধ বুকের ভিতর
টেনে নিতে। আর শুধু বুঝি নতুন বই? বইমেলায় তো হরেক কিসিমের পুরোনো ধুলিমলিন বা
ধুলোঝাড়া ন্যাপথলিনের গন্ধ লাগা লালচে পাতা বইও পাওয়া যায়। আআহহহ তার যা সুস্বাদ!
তা যা বলছিলাম, এখুনি
অধৈর্যের কথা বলতে বলতে এইবারে আসি বইপাঠক হওয়ার ধৈর্যের কথায়। বইগুলো তো ঠিক একেকটা
মানুষেরই মতো। কেউ দেখতে খুব সুন্দর, কেউ ততটা নয়। কারুর রস কথায় কথায় প্রথম পাতায়
ফোটে তো কেউ তার রসভান্ড উপুড় করে এক এক পৃষ্ঠা সরিয়ে আলতো হাতে কম্পিত মনে বইয়ের
হৃদয়ে প্রবেশ করার পর। কেউ আবার মনে ঝিলমিল লাগিয়েই রেখেছে। কিনতে, খুলতে আর পড়তে
শুধু বাকি ! আর রইল বাকি পাগলামি। তার শুরুও নেই শেষও নেই। সীমা সরহদ্দ ছাড়িয়ে সে
একেবারে বুভুক্ষু পাঠককে বইমাতাল করে ছাড়ে। কিন্তু আজকাল যে শুনি চতুর্দিকে রব
উঠেছে, এই পড়া কাজটাই আর নাকি হয়ে ওঠে না। কেউ আজকাল বই পড়ে না। পুরোনো সব মানুষ,
অভিজ্ঞ মানুষ যারা বই পড়ে পড়ে ঘুণ হয়ে গেছে তাদের কথা ছেড়ে দিলাম; নতুন যে সব শিশু
কিশোর তরুণ যুবা... তারা কি সত্যিই বই পড়ে না?! পড়তে ভালোবাসে না?? কেন? অনেকেই তারা
শুধুই পিডিএফ পড়ে বুঝি বই হিসেবে?? কিম্বা কিণ্ড্ল্ যন্ত্রে বই পড়ে (তাও খুব সরু
চটি বই?! নাকি তাও না?)! আচ্ছা সত্যি করে বলো কিম্বা ভেবে দেখো তো চোখ আর বইয়ের মধ্যে
অন্য কোনও যন্ত্রের নাকগলানো কাঁহাতক সহ্য করা যায়?? তবে অবশ্য বলতেই পারো চশমা
পরে যাঁরা বই পড়েন তাদের বেলায়?? আমার উত্তর চশমা তো চোখকে দেখতে আরও বেশি সাহায্য
করে, তাই চশমার কাঁচ দুটোকে আরও দুটো চোখই বলা যেতে পারে; খামোকা যন্ত্র বলব কেন??
কিন্তু তবু তো সে একরকমের বই পড়া। আর তোমরা যদি বলে ওঠো বই পড়তে বড্ড বেশি সময় খরচ
হয়ে যায়, তবে বলো দেখি ঘুমোতে, খেতে, স্নান সারতে ,মোবাইলে গেম খেলতে, ভিডিও দেখতে
এবং আরো যা যা তোমরা করে থাকো, তার কোনটা করতে সময় লাগে না? আজকাল বেশির ভাগ
বাবা-মা বলে থাকেন, বই পড়ে সময় নষ্ট হবে। স্কুলে কলেজে পড়াশোনার এতো চাপ, এত
কম্পিটিশন যে তার মধ্যে গল্পের বই পড়বে কখন? আর কেনই বা পড়বে? ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার
হতে গেলে, জীবনে অর্থ উপার্জন করতে গেলে কাজের বই পড়তে হবে, মানে সাদা বাংলায় যাকে
বলে পড়ার বই। কিন্তু সিলেবাসের বাইরে পড়া কোনোকালেই খারাপ কাজ
নয়, সে তোমরা পরীক্ষার হলে কঠিন কঠিন প্রশ্নের উত্তর লেখার সময়েই বুঝতে পারো। আবার
ঠিক তেমনই জরুরি জীবনের সিলেবাসের বাইরে যতরকম বই, সেইসব চেখে দেখা।
আমরা বলব তোমাদের (কারণ তোমাদের
বুদ্ধি বাবা মায়েদের চেয়েও ঢের বেশি বলেই আমরা মনে করি) জীবনের অর্থ উপার্জনের
দিকেই মন দেওয়া দরকার; আর ছোটোবেলা থেকে পাঠের অর্থাৎ নিজে নিজে বুঝে বই পড়ার
অভ্যাস তৈরি হলে তবেই জীবনের শ্রেষ্ঠতম, ‘ওয়াও’তম অর্থগুলো নিজেরাই খুব শিগগির
খুঁজে বার করে ফেলতে পারবে, যা শুধু টাকায় কিম্বা ধনে মাপা যায় না। মাপা যায়
সম্পদে। আর এই পাঠাভ্যাস আসে বইয়ের প্রতি
ভালবাসা থেকে। চিরকালই বই বিন্যস্ত হতে (ডিসিপ্লিন) শেখায়। বই
শেখায় সততা, সরলতা আর খুশির মূল্য। অন্য মানুষকে একটু সময় দিতে শেখায় বই, শেখায়
যথোচিত সম্মান দিতে। ভালবাসতে, সবার হাতে হাত রেখে নতুন সাহস বুকে নিয়ে নতুন সমস্ত
আইডিয়া মাথায় নিয়ে বিশাল এই পৃথিবীটা পাড়ি দিতে শেখায় বই। আর সেই সব বইয়ের কীসব
কথা, কী তার ছবি, কী তার অঙ্গসজ্জা আর কীইবা তার মনের ভেতর আলো ছড়ানোর কায়দা! পাতার
পর পাতা শব্দের জ্যান্ত ম্যাজিক।
বইগুলো ঠিক আমাদের দাদু
ঠাকুমা পুরোনো দিনের স্নেহময় আত্মীয়দের মতন। এই সাংঘাতিক গতির যুগে তাল মিলিয়ে
ছুটে চলতে না পারলে তো তোমরা জানোই কেউ ছেড়ে কথা বলবে না। বরং তোমাদের
লক্ষ্যপূরণের ক্লান্তিকর দৌড়টা দৌড়তে সাহায্য করবে এক একটা ভালোবাসার বই, যার
পাতায় পাতায় দৌড় নয়, তোমাকে একেবারে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প। তাই এইবারের
বইমেলায় তোমরা শুধু ঘুরতেই এসো না, একটা করে পছন্দমতো বই কিনে নিয়ে বাড়ি গিয়ে পড়ে
ফেলো তো দেখি!!
_____
ছবি সূত্রঃ ইন্টারনেট
No comments:
Post a Comment