ফিরে এল ‘ফেলুদা’
সৌম্যকান্তি দত্ত
তাকিয়া টেনে কোলের
উপর তুলে তারিণীখুড়ো বললেন, “আজকে শুধু ফেলুদার
গপ্পো!”
“ফেলুদার গপ্পো?” ন্যাপলা খুব উৎসাহের সঙ্গেই
জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, কেন, কোনও সমস্যা আছে কি?”
“না, ইয়ে মানে, ফেলুদার সাথেও আপনার
বুঝি আলাপ আছে?”
“তোর এসব ব্যাপারে বেশি কৌতূহলটা আমার মোটেই পছন্দ হয় না, ন্যাপলা। ওরে পল্টু, যা, চায়ের কথা বল গিয়ে। এই শীতকালে চা-টা না হলে ঠিক জমে
না।”
“আর চায়ের সাথে টা-টা?” ভুরুটা আলতো
কুঁচকে চটপটি বলল।
“আছে,” তারিণীখুড়ো তার ঝুলি থেকে একটা
খবরের কাগজের ঠোঙা বের করে বলল, “নে রে পল্টু, ভেতরে গিয়ে দে, বল গরম শিঙাড়া আছে।”
শিঙাড়ার ঠোঙা হাতে
নিয়ে পল্টু দৌড়ে চলে গেল রান্নাঘরে। নিমেষের মধ্যে শিঙাড়া
ভর্তি প্লেট এনে ধরল, “এটা নিন, চা আসছে।”
“সত্যিই, শীতের বিকেলে গরম গরম শিঙাড়া, আহা!” ভুলু বলল।
তারিণীখুড়ো বললেন, “এসবের তোরা আর সে স্বাদ পেলি কই রে। সেবার আমি, ফেলুবাবু, লালমোহন, ঐ তপেশ একসাথে গিয়েছিলাম শ্যামবাজারে এক অতিথির বাড়ি। আহা, উত্তর কলকাতার বিখ্যাত শিঙাড়া!
এখনও জিভে জল আসে।”
“সে কি! তোপসে তো কোনও গল্পে আপনার কথা কোন ছাড়, নামটাও লেখেনি!” বড়ো বড়ো চোখ করে ন্যাপলা বলল।
“উফ! তুই তো বড়ো ইয়ে রে ছোকরা! পল্টু, ওকে সামলা কিন্তু,” খুড়ো ভারী বিরক্ত
স্বরে বললেন।
পল্টু ইশারায়
ন্যাপলাকে থামতে বলল। ইতিমধ্যে চা হাজির। দুধ-চিনি ছাড়া লিকার চায়ে খুড়ো এক চুমুক দিয়ে শুরু করলেন বলা–
“তোদের তো বলেইছি, আজ বলব ফেলুদার গল্প। এ বছর তার পঞ্চাশ বছর কিনা...”
কথাটা শেষ হতে না
হতেই মাঝখান থেকে ন্যাপলা ফস করে বলে উঠল, “ইয়ে মানে, ওটা প্রকাশনার পঞ্চাশ হবে যে!”
“সে যাই হোক, তোকে আর ভুল শোধরাতে হবে না। আর
কথার মাঝে কথা বলবি না। শেষ সাবধান করলাম কিন্তু!”
“ঠিক আছে, শুরু করুন।”
পাঞ্জাবির পকেট
থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে তার থেকে একটা ধরিয়ে আয়েস করে টান দিলেন তারিণীখুড়ো। তারপর আবার শুরু করলেন, “হ্যাঁ, কী যেন বলছিলাম? ও, মনে পড়েছে। তো সেই ফেলুবাবুর গল্প যখন প্রথম বেরলো
সন্দেশে, সে কী উত্তেজনা! তপেশ ছোকরারও
এলেম আছে বলতে হয়। ন্যাপলার মতন ওস্তাদ নয়। সালটা খুব সম্ভবত ১৯৬৫। ডিসেম্বর মাস। সন্দেশে বেরলো ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’। বিকেলবেলা, সবে বাড়ি ফেরার ট্রামে উঠছি। এমন সময় রাস্তায়
দেখা ফেলুবাবুর সাথে। আমায় বললে, কী, তারিণীবাবু, সন্দেশটা দেখলেন? তোপসে তো এবার সোজা কলম ধরেই বসল!
“আমি বললাম, সে কি! এটা তো জানতুম না! তা, আপনাদের গপ্পো নিশ্চয়ই?
“ফেলুবাবু বললেন, তা তো বটেই।
“উত্তম সংবাদ। দাঁড়ান মশাই, আজই কিনে নেব।
“ব্যস, সেদিনই পাড়ার পত্রিকা স্টল থেকে কিনে নিলুম সন্দেশ পত্রিকা।” খুড়োকে আবার থামতে হল।
পল্টু বলল, “প্রথম লাইন তো ‘রাজেনবাবুকে রোজ বিকেলে ম্যালে আসতে দেখি...’। কী, তাই তো?”
“ঠিক ধরেছিস।” খুড়ো আবার শুরু করল,
“রাত জেগে প্রথম অংশটা পড়ে
ফেললাম। দিব্বি লেখা! ছোকরার লেখার বাঁধুনিখানা চমৎকার। এরপর আবার পরের মাস, মানে ১৯৬৬-এর
জানুয়ারিতে বের হল দ্বিতীয় অংশ। বাকিটুকু পরের মাসে শেষ হল। খাসা লেখা। তারপর
অনেকদিন আর দেখাসাক্ষাৎ হয় না ফেলুবাবুদের সাথে। আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নিজের
কাজে। প্রায় বছর আটেক বাদে হঠাৎ একদিন রাস্তায় দেখা তপেশ ছোকরার সাথে। ও ইস্কুল
থেকে ফিরছিল। আমাকে দেখে ডাক দিল, খুড়ো, আছেন কেমন? আপনার তো কোনও খবরাখবরই নেই!
“আমি বললুম, আরে, লেখক তপেশ যে! আমি
আছি একরকম, তোমাদের খবর বল। দাদার খবর কী?
“ফেলুদা ভালো আছে। জানেন খুড়ো, আমাদের সাথে লেখক লালমোহন গাঙ্গুলীর পরিচয় হয়েছে।
“হ্যাঁ, বল কী! প্রখর রুদ্রের জনকের
সাথে তোমাদের পরিচয় হয়েছে?
“কেন, আপনি ‘সোনার কেল্লা’ পড়েননি?
“না, ইয়ে মানে, সময় সুযোগের অভাব ভাই। সে যাই হোক, তা একদিন পরিচয় করাবে তো আমার
সাথে?
“আলবাত। আপনি আজই আসুন না!
লালমোহনবাবু তো আজ আসবেন।
“চল, অনেক বছর তোমাদের সাথে তো
দেখাসাক্ষাৎই হয় না। আজ একঢিলে দুই পাখি মারা যাবে!
“ব্যস, চললাম রজনী সেন রোডে। সেখানেই জটায়ুর সাথে প্রথম আলাপ হল। ওঁর লেখা ‘দুর্ধর্ষ দুশমন’ বইটা দিলেন,” এতটা বলে খুড়ো থামলেন।
সদর দরজায় টোকা
পড়েছে। পল্টু একছুটে গেল দরজা খুলতে।
“আরে! ফেলুদা যে!” পল্টুর জোর চিৎকার শুনতেই
ন্যাপলা, ভুলু, চটপটি, সুনন্দ দৌড়ে গেল।
“ইয়েস, চলে এলাম। তোপসে, চটপট ওদের খবরটা দে দেখি!” ফেলুদা বলল।
তোপসে বলতে যাওয়ার
আগেই ন্যাপলা বলল, “আমার যে বি-শ-শ-শ-শ্বাসই হচ্ছে
না! ফেলুদা সত্যিই এসেছে!”
ঠোঁটের কোণে মুচকি
হাসি দিয়ে ফেলুদা বলল, “তাই বুঝি!”
হঠাৎ করে সুনন্দ
বলল, “টেলিপ্যাথি! আমরা এতক্ষণ
তোমাদের গল্পই তো করছিলাম।”
“বটে? কীরকম?” ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
ন্যাপলা আবার আগ
বাড়িয়ে বলল, “খুড়ো আজ তোমাদের গপ্পো করছে। তোমাদের সাথে খুড়োর নানান আলাপ পরিচয়ের গপ্পো!”
“কোন খুড়ো?” তোপসে বলল।
“সে কি! তারিণীখুড়ো, তারিণীচরণ ব্যানার্জ্জী! ভুলে গেলে নাকি?” চটপটি বলল বিস্ময়ের সাথে।
ফেলুদা ভ্রু কুঁচকে
বলল, “তারিণীখুড়ো? তিনি কে?”
“তোমরা চেনো না তাকে?” ন্যাপলা বলল।
“কই, না তো! এরকম নামে কাউকে তো ঠিক চিনি না,” ফেলুদা বলল।
ন্যাপলা তার ডানহাতটা
কপালে ঠেকিয়ে বলল, “বোঝো! এইটাই আন্দাজ করেছিলাম। খুড়ো নির্ঘাত গুল মেরেছে আমাদের!”
“তা, কই তোমাদের খুড়ো?” ফেলুদা বলল।
চটপটি আর ভুলু দৌড়ে
গেল খুড়োকে ডাকতে। পলকের মধ্যেই ওরা ফিরে এসে বলল, “খুড়ো নেই। হাওয়া!”
পল্টু দাঁত দিয়ে
ঠোঁট কামড়ানো বন্ধ করে বলল, “পেছনের দরজা দিয়ে
চলে গেছে মনে হয় খুড়ো।”
ফেলুদা গম্ভীর হয়েও
মুচকি হেসে বলল, “হয় এর বদলা নেব, না হয় গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব।”
ওরা পাঁচজন হা হা
করে হেসে উঠল। পল্টু বলল, “যাই হোক, তোপসেদা কী যেন বলছিল?”
তোপসে এতক্ষণে মুখ
খুলল, “ও হ্যাঁ, শোন, আগামী ১৬ই ডিসেম্বর আমরা আসছি সিনেমা হলে।
তোমাদের সবার আমন্ত্রণ।”
ন্যাপলা বলল, “ডবল ফেলুদা তো?”
“একদম,” ফেলুদা বলল।
তোপসে বলল, “তাহলে দেখা হচ্ছে ঐদিন সিনেমা হলে। আর একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“কী!” বলল সুনন্দ।
তোপসের মুখ থেকে
কথা কেড়ে ফেলুদা বলল, “সেটা ক্রমশ প্রকাশ্য।”
_____
haha..besh laglo
ReplyDelete