স্বপ্নমাখা সোভিয়েতের অপরূপকথা
কেয়া মুখোপাধ্যায়
সে অনেককাল আগের কথা। এক-যে ছিল রাজা আর এক রানি। একটি ছেলে হল তাদের। স্নেহে তাকে
ঘিরে রাখে মা-বাপে। দিনে দিনে বড়ো হয় রাজপুত্র - নবনীতে ডুবিয়ে মিহি রুটি খায়,
সোনা-রুপো বসানো পোষাক পরে। একটু হুকুম করতে না করতেই ছুটে আসে দাস-দাসী, আর
মা-বাপে পারলে তো চালুনি করে আকাশের সূর্যই এনে দিতে রাজী। কিন্তু সুখ নেই
রাজপুত্রের। মনমরার মতো ঘুরে বেড়ায় রাজবাড়ির বাগিচায়, নিজের কপাল নিয়ে দুঃখ করে -
‘একটা বোন নেই আমার, ভাই নেই। একটু খেলব, কথা
কইব এমন কেউ নেই। কেন, বল তো মা, আমি এমন একা-একলাটি?’
কিছুই বললে না রানি, শুধু চোখ নামিয়ে নিলে।
এখন সেই রাজ্যে ছিল পাথরের দেয়াল ঘেরা এক পুরী। চল্লিশ হাত উঁচু,
সব সোনায় মোড়া, চুড়োয় হীরে বসানো। তার কাছে যাওয়া মানা ছিল রাজপুত্রের, আর ততই
বেশি করে তার ইচ্ছে হয় জানতে, কী আছে ওর ভেতরে।
একদিন দেয়ালে বসল একটা কালো দাঁড়কাক। সেই-ই
রাজপুত্রকে জানিয়ে গেল তার তিন বোনের খবর। তারপর কেমন করে তামার পুরী, রুপোর পুরী,
সোনার পুরী পেরিয়ে রাজকন্যে সবিতার কাছে পৌঁছল রাজপুত্র আর ড্রাগনের কবল থেকে,
ডাইনির হাত থেকে আরও কত-শত বিপদের হাত থেকে বোনদের উদ্ধার করল রাজপুত্র, তাই নিয়েই
‘রাজকন্যে-সবিতা’র গল্প।
আমাদের ছোটোবেলায় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, লীলা মজুমদার,
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল সোভিয়েত দেশের গল্প।
রুশভাষার বইয়ের বাংলা অনুবাদের সে এক আশ্চর্য স্বপ্নের জগত। সন্ধেবেলায় মায়ের কোল
ঘেঁষে বসে ঠাকুরমার ঝুলির রাক্ষস-খোক্কস, লালকমল নীলকমলদের গল্পের সঙ্গেই শুনতাম
লিথুয়ানিয়ার লোককথা ‘সবিতা রাজকন্যে’। কখনও আবার বেড়াতে যেতাম এক রূপকথার পাহাড়ে। ‘মণির
পাহাড়’, সোভিয়েত দেশের নানা জাতির রূপকথার বই। সূর্যের বোন ইলিয়ানা কসিনজ্যানা কিংবা বুদ্ধিমতী রাখালকন্যা আনাইত,
নির্ভীক শিকারি বরোল্দই-মের্গেন - এদের সকলের রোমাঞ্চকর বা চোখধাঁধানো
বীরত্বের কথা পড়তাম বারবার। প্রতিবারই নতুন করে আবিষ্কার করতাম আবার। পড়তে পড়তে
মনে হত, আহা, ‘সিভকা-বুর্কা’ গল্পের মতো আমারও যদি থাকত একটা আশ্চর্য পঙ্খিরাজ, তাহলে হেঁকে বলতাম তাকে-
‘সিভকা-বুর্কা
যাদু কা লড়কা
চেকনাই ঘোড়া
সামনে এসে দাঁড়া।’
যাদু কা লড়কা
চেকনাই ঘোড়া
সামনে এসে দাঁড়া।’
আর পঙ্খিরাজ এসে
পৌঁছলেই তার পিঠে চড়ে হুশ করে উড়ে যেতাম যেখানে খুশি।
বুড়ো চাষার ছোট ছেলে ইভানকে তো কেউ পাত্তাই দেয়
না। সারাদিনে তার কাজ বলতে শুধু চুল্লির ওপরের তাকে বসে বসে ব্যাঙের ছাতা-সেদ্ধ খাওয়া। অথচ সে-ই কিনা
দিব্যি ঘোড়া হাঁকিয়ে শূন্যে বারো খুঁটি ছাড়িয়ে উঠে রাজকন্যা রূপবতী এলেনার রাঙা
ঠোঁটে চুমু খেয়ে জড়োয়ার আঙটি নিয়ে এল! আবার
কী তার নিঃস্পৃহতা ভাবো,
মুহূর্তেই রাজবাড়ি ছেড়ে ঘোড়াটাকে বিদায় দিয়ে
বাড়ি ফিরল ব্যাঙের ছাতা কুড়োতে কুড়োতে!
অবাক হয়ে যেতাম ‘সিভকা-বুর্কা’র পাতায় পাতায় ধরা ভাষার আশ্চর্য আমেজেঃ
ইভান ঘোড়াটার গলা চাপড়ে দিয়ে তাকে লাগাম পরাল। তারপর তার ডান কান দিয়ে উঠে বাঁ কান দিয়ে বেরিয়ে এল। আর কী
আশ্চর্য! অমনি সে হয়ে উঠল এমন সুপুরুষ যে তার রূপ শোনার
নয়, দেখার নয়, রূপকথাতে বলার নয়, কলম দিয়ে লেখার নয়।
ঘোড়ার পিঠে চড়ে রাজার প্রাসাদের দিকে রওনা হল ইভান।
ছুটল ঘোড়া কদমে,
কাঁপল মাটি সঘনে,
পেরিয়ে গিরি কান্তার,
মস্ত সে কী ঝাঁপ তার!
শেষে রাজকন্যা এলেনাই খুঁজে বার করল ইভানকে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাকে বিয়েও করল।
আবার ‘বুড়ো
শীত আর জোয়ান শীত’
গল্পে লেখার গুণে শীতও যেন এক মানুষের চরিত্র
হয়ে ওঠে। কথা বলে কলকল করে। জমিদারের কাছে উড়ে গিয়ে তার পেছনে লাগলে শীত। একবার গালিচার নিচে গিয়ে ঢোকে, কখনও
আস্তিনের মধ্যে সেঁধোয়,
কিংবা কলারের মধ্যে ঢোকে, আর নাকে গিয়ে কনকনায়। তারপর জোয়ান শীত বড়াই করে তার বাপ বুড়ো শীতের
কাছে -
“দেখেছ আমি কেমন, দেখেছ আমার তেজ! আমার কাছে তুমি কোথায়
লাগো! দ্যাখো, কীরকম
একটা জমিদারকে আমি শীতে জমিয়ে দিলাম!”
কিন্তু তারপর বাপের কথায় এক গরিব চাষিকে ঠাণ্ডায়
কাবু করতে গিয়ে দর্পচূর্ণ হল জোয়ান শীতের। চাষি কুড়ুল দিয়ে বনে কাঠ কাটতে থাকে মহাবিক্রমে, গরমের চোটে দস্তানাও খুলে ফেলে দেয়। কিন্তু শীতে আর কাবু হয় না
কিছুতেই।
আর সেই যে, মণির পাহাড়-এর ‘কন্যা ও চন্দ্রকলা’ গল্পটা?
সেই কন্যাটিকে হরণ করার জন্য ‘দুই বল্গা হরিণের
স্লেজে চেপে’ মাটিতে নেমে আসে চন্দ্রকলা। আর শেষটায় কন্যার হাতেই জব্দ হয়ে চন্দ্রকলা মিনতি করে বলে -
“আমি যদি চিরকালের হা-ঘরে, তবে সেই খোলা আকাশেই ছেড়ে দে আমায়! তোদের মন মাতাব আমি! ছেড়ে
দে আমায়, আমি হব তোদের পথের দিশারী! ছেড়ে
দে আমায়, রাতকে দিন করে দেব! ছেড়ে দে আমায়, তোদের
জন্যে বছর মেপে যাব আমি!
প্রথমে হব বুড়ো ষাঁড়ের চাঁদ, তারপরে বাছুর জন্মের চাঁদ, তারপর
জলের চাঁদ, তারপর পাতা ফোটার চাঁদ, তারপর গরমের চাঁদ, তারপর শিঙ খসার চাঁদ, তারপর বুনো হরিণ যুগলের চাঁদ, তারপর
প্রথম শীতের চাঁদ,
তারপর ছোটো দিনের চাঁদ…”
পড়তে পড়তে মনে হয় না - গল্প নয়, এ যেন ভেজা ভেজা
নরম ভাষায় লেখা এক জ্যোৎস্না-মাখানো কবিতা?
আর একটা প্রিয় বই ‘সোনার পেয়ালা’। সে গল্পের
ছোট্ট ছেলেটা কী বলে জান?
“আকাশের তলে যত পাহাড়ে গাঁ আছে, আমার জন্মের
জায়গাটা তার মধ্যে সবচেয়ে সেরা, সবচেয়ে সুন্দর। আমাদের গাঁ কথা বলে, সবচেয়ে মিষ্টি
আমুদরিয়া নদীর গানে। জীবনে শুধু একবার, এক ঢোঁক তার জল খেলে সে স্বাদ কখনও ভোলা
যাবে না।”
আচ্ছা বল, এমন ক’টা মায়ামাখা লাইন পড়লেই মন
আনচান করে একবার ওই আমুদরিয়ার দেশে যেতে কি ইচ্ছে করবে না?
এরকম কত যে নরম আলো ছড়ানো গল্প ছিল ছোটবেলা
জুড়ে! তাদেরই আর একটা শোনাই তোমাদের, ‘চন্দ্রকন্যা সূর্যপুত্র’।
সারা দিনমান সূর্য বার্চ বাকলের স্লেজে চেপে
পাড়ি দেয় নীল আকাশ,
নিজের রাজ্য দেখে। সকালে তার স্লেজ টানে ভালুক, দুপুরে মর্দা হরিণ, বিকেলে
হরিণী। কত কাজ সূর্যের - যাদের জন্ম হবার কথা, তাদের
প্রাণ দিতে হবে,
ফলাতে হবে গাছপালা, হরিণের খাবার শ্যাওলা আর ঘাস, আলো
দিতে হবে পশু-পাখি আর মানুষকে, যেন পুরুষ্টু হয় তারা, বংশবৃদ্ধি
করে, সূর্যের সম্পদ বাড়ায়।
সন্ধের দিকে হাঁপিয়ে পড়ে সূর্য। নির্জীব হয়ে লুটিয়ে পড়ে সাগরের ওপারে। তার কোথায় একটু জিরনো-ঘুমনোর কথা,
তা না, ছেলে
সূর্যকিরণ-পেইভালকে এসে ঝোঁক ধরে, “বাবা,
আমার এখন বিয়ে করার সময় হয়েছে!”
যা সত্যি, তা
সত্যি – সময় হয়েছে ঠিকই!
“তোর কনে আছে?”
“নেই। আমার সোনার জুতো আমি মর্ত্যের কন্যেদের
পরিয়ে দেখেছি,
কারো মাপসই নয়। পা ওদের ভারী, মাটি থেকে তোলা যায় না। অথচ আমাকে উড়তে হবে আকাশে।”
সূর্য বললে, “ওখানে
পাত্রীর খোঁজ করে লাভ নেই,
পেইভালকে। আমি চাঁদকে বলব। শুনেছি ওর মেয়ে
হয়েছে। চাঁদ আমাদের চেয়ে গরিব বটে, তাহলেও
আমাদের মতোই তো আকাশ পাড়ি দেয়।”
একদিন সকালে চাঁদ যখন আকাশে উঠেছে, সূর্য তার কাছে গিয়ে বললে, “আচ্ছা পড়শি, তোমার একটি সুন্দর বাড়ন্ত মেয়ে আছে না? তার জন্যে একটি বর ঠিক করেছি আমি, আমার ছেলে সূর্যকিরণ পেইভালকে।”
মুখ আঁধার হয়ে উঠল চাঁদ-মায়ের। বললে, “মেয়েটি
আমার এখনও ভারী ছোটো। কোলে তুলে নিই, টেরই
পাই না আছে কি নেই,
শুধু সামান্য চিকচিক করে। কোথায় এখন ওর বিয়ে!”
সূর্য বললে, “ভাবনা
নেই, বাড়ি আমাদের ধনদৌলতে ভরা। খাইয়ে-দাইয়ে ওকে মোটা করে তুলব। আমার পেইভালকেকে একবার ওকে দেখতে দাও।”
“উঁহুঁ, না,” ভয় পেয়ে চাঁদ তার মেয়েটিকে ঢেকে দিল মেঘ দিয়ে, “তোমার পেইভালকের তেজে ও পুড়ে যাবে। আর সত্যি কথাই তোমাকে বলি, আছে ওর বাগদত্ত, মেরুজ্যোতি–নাইনাস।
ঐ এখন সে সমুদ্রের ওপর দিয়ে চলেছে।”
“বটে!”
রেগে উঠল সূর্য, “কী, একটা আলোর ফালির জন্য আমাদের ফেরাচ্ছ! দেখছি পড়শি, তুমি ভুলে গেছ যে আমি সবাইকে প্রাণ দিই, আমার ঘরে ধনদৌলত, আমার গায়ে শক্তি!”
“শক্তি তোমার পড়শি কেবল আধখানা,” বললে চাঁদ, “গোধূলিতে কোথায় তুমি? আর
রাতে? লম্বা শীতকালটায় কোথায় তোমার জোর? আর মেরুজ্যোতি–নাইনাস শীতেও আলো দেয়, রাতেও।”
ব্যস! এইকথায় দারুণ ক্ষেপে গেল সূর্য। খালি আগুনে-তির
ছোঁড়ে, রাগে গনগন করে আর চ্যাঁচায়।
চাঁদ-মা ঠিক করল, সূর্যের চাউনি থেকে তার মেয়েটিকে দূরে সরিয়ে রাখবে।
ওদিকে হ্রদের ভাসমান দ্বীপে থাকে ভারী ভালো মানুষ
বুড়োবুড়ি।
তাদেরই মেয়ের ভার দেবে বলে ঠিক করে সারা অঙ্গে
জ্যোৎস্নার আভা মাখা মেয়েটিকে ফারগাছের ডালের রুপোলি দোলনায় রেখে গেল চাঁদ-মা। আর
বুড়োবুড়ি বনে গিয়ে শুনতে পেল এক ছেলেমানুষী গলা, “নিয়েকিয়া –
নেই আমি, এই
আছি!”
অনেক আদরে বুড়োবুড়ি বড়ো করে তুলতে লাগল তাকে।
নাম রাখলে নিয়েকিয়া। বড়ো হয়ে উঠল নিয়েকিয়া। ‘মুখখানা তার গোল, বেরির মতো লালচে, চুলগুলি রুপোর সুতোর মতো, আর
নিজে তো সে সারা অঙ্গে জ্বলজ্বল করতে থাকে।’
সূর্যের কাছে খবর গেল নিয়েকিয়ার। ছেলে
পেইভালকেকে সূর্য পাঠাল তার কাছে। নিয়েকিয়াকে দেখে ভারী মনে ধরল তার। ভাবল, নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। কিন্তু নিয়েকিয়া চেঁচিয়ে উঠল, “নেই আমি,
নেই আমি, নেই!”
আর মিলিয়ে গেল ঠিক ছায়ার মতো।
‘রাত পর্যন্ত নিয়েকিয়া লুকিয়ে রইল বনে। আর আকাশে
চাঁদ উঠতে সে চাঁদের পথ ধরল বন পেরিয়ে, পাহাড়
পেরিয়ে, তুন্দ্রা পেরিয়ে। চাঁদ-মা তাকে সমুদ্রের কাছে নিয়ে
এসে পৌঁছে দিল তীরের একটিমাত্র খালি বাড়িতে।’
নোংরা, অগোছালো
সেই বাড়িটা ধুয়ে মুছে গুছিয়ে রাখল নিয়েকিয়া। তারপর একটা পুরনো টাকু হয়ে গিয়ে সে
দেয়ালে বিঁধে ঘুমোতে লাগল। অন্ধকারে ভারী ভারী পায়ের শব্দ কানে এল তার। বাড়ি ফিরল
রুপোর বর্ম পরা যোদ্ধা মেরুজ্যোতি-ভাইয়েরা। সবার আগে বড়োভাই আর নেতা মেরুজ্যোতি নাইনাস। খেয়েদেয়ে খেলতে শুরু করল সবাই। একে একে
উড়েও গেল।
জ্বলজ্বলে ছায়া হয়ে ঘরে রইল শুধু নাইনাস। ভোরের
আঁধারে নিয়েকিয়া এসে দাঁড়াল নাইনাসের সামনে। নাইনাস জিজ্ঞেস করলে, “আমায় বিয়ে করবে নিয়েকিয়া?”
“করব নাইনাস,”
নিয়েকিয়ার কথা শোনাই যায় না প্রায়।
রোজ সন্ধেয় নাইনাস আর তার ভাইয়েরা আসত নিজেদের
বাড়িতে। রোজ সন্ধেয় তারা খেলা জমাত আকাশে, আর ভোর হতেই উড়ে যেত। নিয়েকিয়া ভাবতে লাগল, কী করে নাইনাসকে আটকে রাখা যায়। একদিন হরিণের চামড়া দিয়ে সে পর্দা
সেলাই করল। রুপোলি সুতো দিয়ে তাতে তুলল ছায়াপথের নক্সা আর
বড়ো বড়ো তারা। টাঙাল সেটা ঘরের ছাতের নিচে।
রাতে এল নাইনাস। অঘোরে ঘুমোয় নাইনাস, আর থেকে থেকেই চোখ মেলে। দেখে উপরে কালো আকাশ আর ছায়াপথ, তার মানে এখনো রাত, ওঠবার
সময় হয়নি।
‘ঘুম ভেঙে গেল নিয়েকিয়ার। বেরিয়ে এল বাইরে, তবে ভুলে গেল দরজা বন্ধ করতে। নাইনাস চোখ মেলতেই দেখে দরজার বাইরে
জ্বলজ্বলে সকাল,
নীল আকাশে সূর্যকে টেনে আনছে ভালুক। লাফিয়ে
বেরিয়ে এল নাইনাস,
ডাকাডাকি করলে ভাইদের। আর অমনি সূর্যের চোখে পড়ে
গেল সে। তাপ ছড়িয়ে সূর্য তাকে চেপে ধরল মাটিতে। নিয়েকিয়া তখন ছুটে গেল তার বাগদত্তের
কাছে, নিজের শরীর দিয়ে সে তাকে সূর্য থেকে আড়াল করলে।
উঠে দাঁড়িয়ে নাইনাস জ্বলজ্বলে ছায়া হয়ে ওপরে মিলিয়ে গেল। আর সূর্য নিয়েকিয়ার বেণী
ধরে আগুনে চোখে তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে, ডাকতে
লাগল ছেলে পেইভালকেকে।
“মেরে ফেললেও আমি পেইভালকেকে বিয়ে করব না!” কেঁদে ফেলল নিয়েকিয়া। সূর্য তখন নিয়েকিয়াকে ফিরিয়ে দিলে চাঁদ-মায়ের কোলে।
চাঁদ-মা
তাকে সেই যে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল, আজও তা ছাড়েনি। চাঁদের
বুকে নিয়েকিয়ার ছায়া দেখতে পাও না? সমুদ্রের
ওপরে জ্বলজ্বলে একফালি আকাশের দিকে চেয়ে থাকে নিয়েকিয়া। মেরুজ্যোতিদের লড়াই হয় যেখানে, চোখ
আর ফেরাতে পারে না।’
আর একটা গল্প শুনবে? এ গল্পে রাজা-রানি-রাজপুত্তুরের
কথা নেই বটে। তবে যা আছে তা বড়ো কম নয়। ছোট্ট দুই ভাইয়ের গল্প। মায়ের সঙ্গে তাদের
অনেকদূরে পাড়ি দেবার দারুণ এক অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। এরা যে সময়ে জন্মেছে, তখন দেশে রাজা-রানি আর নেই। সাধারণ মানুষই সব। কিন্তু কোনও
ছেলেমেয়েই বা তার বাপ-মায়ের কাছে রাজপুত্তুর নয় শুনি! তাই এও এক রূপকথা। কিংবা বলা ভাল, অপরূপকথা। সোভিয়েত গল্পের খনির এক সেরা রত্ন, যা অনুবাদ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর অন্তত ষাটটি ভাষায় - ‘চুক আর
গেক’।
নীলপাহাড়ের পাশে জঙ্গল। সেই জঙ্গলে বাস করত একজন মানুষ। তার অনেক কাজ, কাজের আর আদি-অন্ত নেই। তাই ছুটিতে
বাড়ি যাবার পর্যন্ত উপায় ছিল না।
শেষমেশ যখন শীত এল তখন বাড়ির জন্যে ওর খুব মন
কেমন করতে লাগল। বৌকে লিখে দিল - ছেলেদের নিয়ে একবার এসে ঘুরে যাও।
ওর দুই ছেলে - চুক আর গেক। মায়ের সঙ্গে ওরা থাকত অনেক অনেকদূরের এক বড়ো শহরে। পৃথিবীতে তার চেয়ে ভালো শহর আর কোথাও নেই।…
ডাকহরকরা যখন চিঠি নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠছিল, তখন
চুক আর গেকের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। দু’জনে দু’জনকে মারছে
আর চেঁচাচ্ছে। কীসের থেকে মারামারি শুরু হয় তা ভুলে গেছি। বোধহয় চুক গেকের খালি
দেশলাইয়ের বাক্স নিয়েছিল কিংবা গেক চুকের জুতোর কালির কৌটোটা মেরে দিয়েছিল।
দু’জনেই দু’জনকে গোটা দুই রদ্দা মেরে আর একবার
মারার জোগাড় করছে,
এমন সময় দরজার কড়া নড়ে উঠল। দু’জনে তো ভয়ে কাঠ,
খালি এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ভাবল, এই রে, নির্ঘাৎ মা। ওদের মা ভারী অদ্ভুত মানুষ। মারামারির জন্য বকত না,
চ্যাঁচাত না। খালি দু'জনকে
ছাড়িয়ে নিয়ে দু’কামরায় পুরে রেখে দিত ঘন্টাদুয়ের মতো, একসাথে খেলতে দিত না। এক ঘন্টায় তো টিক,
টিক, টিক, ষাট-ষাটটা মিনিট। দু’ঘন্টায় আরও বেশি। তাই দু’জনেই চক্ষের পলকে জল
মুছে দরজা খুলতে ছুটে গেল।
খুলে দেখে ও মা, এ তো মা নয়। ডাকহরকরা, চিঠি নিয়ে এসেছে। দু'জনেই
চেঁচিয়ে উঠল, “বাবার চিঠি এসেছে, বাবার চিঠি, তা হলে নিশ্চয়ই শিগগিরই আসবে বাবা।”…
খুশির চোটে লাফালাফি করতে করতে দু’জন টেরও পেল
না কখন মা এসে গেছে। ঘরে ঢুকেই মায়ের চক্ষুস্থির।
দেখে তার দুই সোনার চাঁদ ছেলে সোফায় চিত হয়ে
শুয়ে চ্যাঁচাচ্ছে আর প্রাণপণে জুতোর গোড়ালি দিয়ে দেয়ালে তাল ঠুকছে। তালের চোটে
সোফার ওপরের ছবিগুলো থর থর করে কাঁপছে আর দেয়ালের ঘড়ির স্প্রিং ঝনঝন করছে। এই
উত্কট আনন্দের কারণ জেনে মা আর ওদের বকল না। খালি সোফা থেকে নামিয়ে দিল। কোনওরকমে
লোমের কোটটা ছেড়েই ছোঁ মেরে চিঠিটা ওদের হাত থেকে নিয়ে নিল মা; চুলের বরফের গুঁড়ো ঝাড়ারও তর সইল না - সেগুলো গলে গিয়ে মায়ের কালো ভুরুর ওপর মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করতে
থাকল।
সবাই জানে চিঠিতে ভালো খবরও থাকে, আবার মন্দ
খবরও থাকে। তাই মা যতক্ষণ চিঠি পড়ল চুক আর গেক একদৃষ্টে মা’র মুখের দিকে চেয়ে রইল।
প্রথমে মায়ের ভুরু কুঁচকে গেল। ওরাও ভুরু কোঁচকাল। তারপর মায়ের মুখে হাসি ফুটল।
তার মানে ভালো খবর।
চিঠিটা ভাঁজ করে রাখতে রাখতে মা বলল, “তোমাদের বাবা আসবে না। মেলা কাজ কিনা, তাই বাড়ি আসতে পারছে না।”
কিচ্ছু বুঝতে না পেরে চুক আর গেক এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি
করল। এর থেকেও খারাপ খবর কি আর আছে? দু’জনেই
ঠোঁট ফুলিয়ে ফোঁত ফোঁত করতে করতে রাগ করে মায়ের দিকে চাইল। কেন যে মা হাসছে বুঝতে
পারল না।
মা বলল, “বাবা
আসবে না, কিন্তু আমাদেরকে ডেকে পাঠিয়েছে।”
সোফা থেকে তিড়িং করে লাফিয়ে নামল দু’ভাই।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মা বলল, “অদ্ভুত মানুষ বাপু! চলে
এস! যেন ট্রামে চেপে এ-পাড়া থেকে ও-পাড়ায় যাওয়া আর
কি!”
চুক
বলে উঠল, “তা নয় তো কী?
বাবা যেতে বলেছে, ব্যস, গাড়ি চেপে চলে যাব।”
মা বলল, “হাঁদারাম! সে কি এখানে? রেলগাড়ি করে হাজার
হাজার মাইল যেতে হবে,
তারপর স্লেজে চড়ে তাইগায়। তাইগায় নেকড়ে কিম্বা
ভালুকের মুখে পড়লে টের পাবে মজাখানা। ভাবো দিকি একবার?”
সে যা হোক। বাবার কাছে যেতে তো হবেই। তাই শুরু
হল তোড়জোড়।
“শেষমেশ গোছগাছ হয়ে গেল..., মোটঘাট বাঁধা হল। সদর দরজায় ডবল তালা ঝোলানো হল, যাতে চোর না আসতে পারে। ভাঁড়ারের আলমারি থেকে আটা ময়দার গুঁড়ো,
খুদকুঁড়ো ঝেড়ে ফেলা হল যাতে ইঁদুরের দৌরাত্ম্য
না হয়। তারপর মা গেল স্টেশনে, পরদিন বিকেলের ট্রেনের টিকিট কাটতে।…
চুক লুকোনো জায়গা থেকে তার
মহামূল্যবান কৌটোটা বের করছে, গেক
গান গাইছে। এমন সময় ডাকহরকরা এসে মায়ের নামের এক টেলিগ্রাম দিল চুকের হাতে।”
তারপরের ব্যাপারটা খুব একটা সুবিধের হল না। দু’ভায়ের
ধুন্ধুমার মারামারির মধ্যে টিনের কৌটোটা ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিল গেক। আর ওই কৌটোতেই
চুক পুরে রেখেছিল টেলিগ্রামখানা। নরম বরফের মধ্যে হারিয়েই গেল কৌটোটা - টেলিগ্রাম আর চুকের সব সম্পত্তিসুদ্ধু।
তারপর?
তারপর... উত্তম-মধ্যম এড়াতে দু’ভাই পরামর্শ করে
ঠিক করলে, টেলিগ্রাম কী আর এমন জিনিস? মা যদি তাদের জিজ্ঞেস করে,
টেলিগ্রাম কোথায় - তবেই সবটা বলবে। আগেভাগেই
বা বলবে কেন? বাড়ি ফিরে মা যখন দেখলে তার সোনার চাঁদ ছেলেদের
মুখ ভার, জিজ্ঞেস করলে, “ভালো ছেলেরা, বলে ফেল দেখি আমি চলে যাবার পর কী নিয়ে খুনোখুনি হচ্ছিল?”
চুক বলল, “খুনোখুনি
হয়নি।”
গেকও বলল, “না
হয়নি। প্রথমে ভেবেছিলাম মারামারি করব, তারপর
ভেবেচিন্তে আর করিনি।”
মা বলল, “বাঃ, এমনি ভাবনাচিন্তা আমি খুব ভালোবাসি।”
হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে, সুদূর তাইগায় থাকা
চুক আর গেকের ভূবিজ্ঞানী বাবার কাছে কী করে শেষমেশ ওরা পৌঁছল সে গল্প পড়তে পড়তে
কখন যেন ওদের একটার পর একটা অ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গী হয়ে যাই। অবাক হই, ভয় পাই,
স্বপ্ন দেখি, খুশিতে
ঝলমল করি, ঝুরঝুরে বরফে পা ডুবিয়ে হাঁটি - একসঙ্গে।
শুধু কি চুক আর গেক? আলিওনুশকা নেই বুঝি - যার
এক চোখ ঘুমোয় আর অন্যটা চেয়ে থাকে, একটা কান ঘুমোয় আর অন্যটা শোনে? কিংবা বাচো আর গোচা?
আর ছিল লেভ তলস্তয়ের ‘শিশুকাহিনি’। নীলচে সাদা মলাটজুড়ে মায়াবি চোখের সোনালি চুলের এক ছোট্ট ছেলে। সে
বই থেকে মনে উঁকি দেয় দুই বোন, ভাসিয়া আর কাতিয়া আর
তাদের বেড়ালছানা, খুকি আর তার ব্যাঙের ছাতা। আরও কত গল্প।
আমাদের চেনা গণ্ডি, জানা দেশের থেকে অনেকদূরের এক দেশের গল্প শুরু হত ঝরঝরে ভাষায়।
তারপর কখনও লোককথা, উপকথা, কখনও
বা রূপকথা কি অপরূপকথা হয়ে এগিয়ে চলত তরতরিয়ে।
আইভরি-রঙা পাতায় ঝকঝকে ছাপা মোটা কাগজের মসৃণ
বই। পাতায় পাতায় অবাক করা দুর্দান্ত সব স্কেচ, অসামান্য সব রঙিন ছবি। আশ্চর্য নরম
মায়াময় ভাষা মাথার ভেতর ঢুকে যায়, মনে গেঁথে যায়। পড়তে
পড়তে কিংবা মায়ের কোল ঘেঁষে বসে শুনতে শুনতে চোখের সামনে যেন দেখতে পাই সব, স-ব। একেবারে সিনেমার মতো।
বাড়িতে আসত সোভিয়েত ম্যাগাজিন। ‘সোভিয়েত দেশ’ আর ‘সোভিয়েত নারী’।
বড়োরা পড়তেন। বইমেলায় স্টল থাকত। সেখানে গ্রাহক হলেই প্রতিমাসে ম্যাগাজিন হাজির বাড়িতে। ঝকঝকে
কাগজ, রঙিন ছবি - খুব টানত আমাকে। নেড়েচেড়ে দেখতাম। আর আমাদের জন্যে রঙিন সুন্দর
বইগুলো, যাদের দু’মলাটের ভেতর লুকিয়ে থাকত অ-জানি দেশের না-জানি কী।
আসলে কী জান? ছোটবেলায় আমাদের সব্বার একটা একেবারে নিজের ছোট্ট সোভিয়েত ছিল
মনের ভেতর। বাইরে সন্ধের অন্ধকার ঘনিয়ে এলে সেখানে জল ফুটনো হত সামোভারে,
ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘুরে ঘুরে উঠে যেত ছাদের দিকে। গনগনে চুল্লির গরম আরাম ঘরের
ভেতর। সুরুয়ার মন-ভরানো সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ত চারদিকে। তারপর সসেজ আর গোলরুটি নিয়ে
সবাই মিলে বসা টেবিল ঘিরে। জানলার কাচের শার্সিতে তখন ঝরে পড়ত দুধ-সাদা বরফকুচি। এ
শুধু কল্পনা নয়, এ ছিল আমাদের শৈশবের আশ্চর্য সত্যি। আমাদের অজান্তেই খুব ভালোবাসার
বইগুলোর ম্যাজিকে হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ আর তার মানুষগুলো হয়ে উঠেছিল খুব
চেনা, ভীষণ কাছের। আমাদেরই বাড়ির গালচের ওপর পড়ে পড়ে ঘুমোত সাইবেরিয়ার বেড়াল
ভাসকা, ঝাঁকড়ালোমো গেঁয়ো কুকুর পস্তেইকো। এদিক ওদিক একটু খেয়াল করলেই দেখা মিলত
ফোকর-বাসী ইঁদুরমাসি, বদরাগী মোরগ, মশা-দীর্ঘনাসা, চটপটে চড়ুইবাবু, এমনকি
থাবা-চাটা মিশকা ভালু্কের। ছুটির সকালে ঝকঝকে নীল আকাশের নীচে পাইন আর বার্চের ঘন
পাতার ফাঁক দিয়ে নরম সোনালি রোদ্দুর এসে পড়ত সোজা আমাদেরই ঘরে। সেই
সকালে মিশে যেত লম্বা-ঠোঁটো স্নাইপ পাখির ডাক। কেউ যেতাম
কুড়ুল কাঁধে কাঠ কাটতে, কেউ টুকরি হাতে ব্যাঙের ছাতা কুড়োতে। আমরাই কেউ ইভান, কেউ
আলিওনুশকা। তাদের গল্পগুলোই আমাদের গল্প, তাদের কষ্টগুলো আমাদের কষ্ট, তাদের খুশিতে
আমরা খুশিয়াল।
গল্পের চরিত্র বলে তারা সকলে যে ভারী শান্তশিষ্ট
ভালমানুষটি - তা কিন্তু নয়। কেউ শান্ত তো কেউ তেমনি দস্যি, কেউ মিষ্টি তো কেউ একটু
হিংসুটে বা ঝগড়ুটে, যেমন হয় আর কী। তারা ঠিক আমাদেরই মতো। বাবা-মা, বন্ধু, ভাইবোন,
আদরের পোষ্যটিকে ঘিরে তাদের যে জীবন তার সঙ্গে আমাদের মিল কিছু কম ছিল না। না-মানুষদের নিয়ে গল্পও কম ছিল না কিছু। তারাও যে কতসময় মূল চরিত্র
হয়ে উঠত অনায়াসে! ভারী ভারী শব্দে কোনও উপদেশ থাকত না গল্পের শেষে। কিন্তু গল্প পড়তে পড়তেই অনায়াসে বোঝা যেত কোনটা ভালো আর কী মন্দ।
বাংলার শিশুসাহিত্য তখনও অমন ঝকঝকে রঙিন হয়ে ওঠেনি। কিন্তু
সরকারি দাক্ষিণ্যে সোভিয়েত দেশের রাদুগা, প্রাভদা, প্রগতি, মীর প্রকাশনার
বইগুলো হত দুর্দান্ত, পাওয়াও যেত খুব কম দামে। তাই
বাংলার গল্পের পাশাপাশি অনেকদূরের সেসব দেশের গল্প আমাদের শৈশব ঘিরে ফেলেছিল অনায়াসে। আর, তখন না বুঝলেও এখন বেশ বুঝতে পারি, বাংলা ভাষার প্রতি
আমার যে ভালবাসা, তা তৈরি করে দিতে অসামান্য ভূমিকা নিয়েছিলেন
কয়েকজন মানুষ। ননী ভৌমিক, অরুণ সোম,
শঙ্কর রায়, পূর্ণিমা
মিত্র, রেখা চট্টোপাধ্যায় - এ নামগুলো বইয়ে দেখলেও তখন আলাদা করে দাগ কাটেনি মনে।
এখন বুঝতে পারি, এমন ছুটন্ত, জীবন্ত, মায়াময় বাংলা ভাষার ঐশ্বর্য তাঁরা তুলে
দিয়েছিলেন আমাদের হাতে যা আজও বুকে দোলা দেয়।
১৯৯১-এ ভেঙে গেল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। পাল্টে গেল সবকিছু। সরকারি দাক্ষিণ্যে বিদেশি ভাষায় অনুবাদের কাজ
বন্ধ হল রাদুগা, প্রগতি, মীর, প্রাভদা প্রকাশনায়।
সোভিয়েত বইয়ের বাংলা নতুন নতুন অনুবাদ বই আর এল না। কিন্তু আমার শৈশব নস্টালজিয়ায়
চিরকালের জন্যে বোনা হয়ে গিয়েছিল সোভিয়েত রূপকথা। তাই বড়ো হয়ে লাইব্রেরি খুঁজে
খুঁজে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে আলাপও হয়েছিল সহজ, অনায়াস। ‘পৃথিবীর পথে’ ‘পৃথিবীর
পাঠশালায়’ পেরিয়ে হাতে উঠে এসেছিল ‘ইস্পাত’, ‘আনা কারেনিনা’। জানা-চেনা হয়েছিল গোর্কি, তলস্তয়, চেখভ, পুশকিন, দস্তয়েভস্কি, গোগোল, অস্ত্রোভস্কি, তুর্গেনেভ-এর ক্লাসিক সাহিত্যের সঙ্গে।
একটা ভুল আমরা বড়োরা এখনও করি। ১৯৯১-এ সোভিয়েত ভেঙে দেশগুলো
স্বাধীন হয়ে গেলেও আমরা অনেকেই এসব লোককথা, উপকথা, রূপকথাকে এক লপ্তে রাশিয়ান গল্প
বলে চালিয়ে দিই। বেশিরভাগ বইই তখন ছাপা হত মস্কো থেকে। কিন্তু রুশ গল্পের সঙ্গেই
মিলেমিশে ছিল লিথুয়ানিয়ার লোককথা, উজবেক গল্প, ইউক্রেনের উপকথা, তাজিক গল্প আরও
কতসব। তোমরা ছোটরা যারা পড়ছ এই লেখা, যারা জন্মেছ সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র আলাদা
আলাদা ভাগে ভাগ হয়ে যাবার অনেক পরে - তারা তো জানই এখন এরা আলাদা আলাদা
জাতিসত্ত্বা। নিজেদের দেশ এদের প্রত্যেকের কাছে আলাদা আলাদা গর্বের জায়গা। তাই
সব গল্প একসঙ্গে ‘রাশিয়ান গল্প’ ভালো লাগার ব্ল্যাঙ্কেটে মুড়ে দিলে
তাঁদের অভিমান তীব্র হয়। পড়ার সময় একটু খেয়াল রেখো কোন দেশের গল্প পড়লে, কেমন?
আমরাও বড়োরাও দেখি, রুশ সাহিত্য না বলে সোভিয়েত সাহিত্য বলার অভ্যেস গড়ে তুলতে
পারি কি না!
এখন যারা পুঁচকে, তাদের কেমন লাগবে সোভিয়েতের
এইসব অপরূপকথা? আমি যাকে বড়ো করছি, সেও কি শুনতে চাইবে ছোট্ট চড়ুই পুদিকসোনা কেমন
করে উড়ে পালায় বেড়ালের মুখ থেকে, বালিশের সঙ্গে আড়ি করে দিয়েও জলার ব্যাঙ কি
চিলেকোঠার বাদুড়ের আস্তানার বদলে কেন আবার বালিশের কাছে ফিরে আসে ছোট্ট মাশা, চুক
আর গেকের কেমন লাগে বরফ-সাদা তাইগায়? ভাবতে ভাবতে একদিন খুঁজেপেতে আনি কিছু বই।
পড়ে শোনাই আর অবাক হয়ে দেখি, যেমন অবাক হতাম, ভয় পেতাম, খুশিতে ঝলমল করতাম আমরা - গল্পে
ডুবে গিয়ে ঠিক সেই আনন্দই ওরও মুখেচোখে।
বইগুলো সব নেই। নতুন পাবও না আর। কিন্তু গল্পগুলো যায়নি
কোত্থাও। ছবির বইয়ের পাতায় উঁকি দেওয়া
শহর, তার বাড়িঘর-রাস্তা-ইশকুল-মাঠ, নীল আকাশে ঝকঝকে সোনালি চুড়ো নিয়ে মাথা
উঁচিয়ে থাকা গির্জা, পথের ধারের বার্চগাছের সারি, হঠাৎ উড়াল
দেওয়া পাখি, ঝুরঝুরে সাদা বরফ বৃষ্টি - আর সেই সবকিছুতে মিশে থাকা আমার
স্বপ্নদেখার শৈশব ফিরে আসে এইসব অপরূপকথা ঘিরে। আবার। বারবার।
_____
গল্পের খনিঃ
২। মণির পাহাড়, নানা জাতির রূপকথা,
অনুবাদঃ ননী
ভৌমিক ও সুপ্রিয়া ঘোষ, সম্পাদনাঃ অরুণ সোম।
৩। চন্দ্রকন্যা সূর্যপুত্র, আনাস্তাসিয়া এ. ইলাগিনা, অনুবাদঃ ননী ভৌমিক।
৪। সোনার পেয়ালা, কায়ুম
তাংগ্রিকুলিয়েভ, অনুবাদঃ ননী ভৌমিক।
৫। চুক আর গেক, আর্কাদি
গাইদার, অনুবাদঃ শঙ্কর রায়।
কৃতজ্ঞতাঃ
সৌভাগ্যক্রমে উল্লেখ্য অধিকাংশ বইগুলিই সংগ্রহে রয়েছে সেই শৈশব থেকে সযত্নে। নস্টালজিক হয়ে পড়লাম। অসাধারণ অলঙ্করণ ছিল এই বইগুলোর অন্যতম আকর্ষণ। অনুবাদকদের অদ্ভুত দক্ষতায় কিভাবে যে এই বিদেশী গল্পগুলো একেবারে আপন হয়ে উঠত সেটাও এক ম্যাজিক।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ সপ্তর্ষি। ছোটবেলার নস্ট্যালজিয়ায় চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছে এইসব গল্প।
Deleteআমাদের পাড়ায় একজন ভাণ্ডারীকাকু ছিলেন যাঁর হবি ছিল পাড়ার বাচ্চাদের রাশিয়ান রূপকথার বই উপহার দেওয়া। বইগুলো অবিশ্বাস্য কমদামে পাওয়া যেত বলে তাঁর খুব একটা গায়ে লাগত না, অথচ আমাদের সেগুলো খুবই পছন্দের ছিল। ঠাকুমার মুখে শোনা দক্ষিণারঞ্জনের গল্প আর রাশিয়ান রূপকথা মিলে মিশে এক মনোময় স্বপ্নের জগত তৈরি হয়েছিল আমাদের ছেলেবেলায়, সেই স্মৃতি আর একবার উসকে দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ, কেয়া।
ReplyDeleteআমি ও পড়েছি এই সব সোনায় গাঁথা হীরে মুক্তোর সাহিত্য। কিন্তু আর নেই আমার কাছে। কত যে খুঁজে বেড়াই ঐ শিশু সাহিত্য, ভাসিয়া আর কাতিয়া.....
ReplyDelete