গল্পের ম্যাজিক:: পিটার দ্য কিং - সহেলী চট্টোপাধ্যায়


পিটার দ্য কিং
সহেলী চট্টোপাধ্যায়

পুতুলটা দেখতে তেমন ভালো নয়। দাঁত-মুখ খিঁচানো একটা সৈন্য-পুতুল। মাথায় আবার একটা টুপি। সবথেকে বিশ্রী এর দাঁতগুলো। বিচ্ছিরিভাবে সামনে বেরিয়ে আছে। লম্বা সাদা দাড়িও আছে। বিদেশ থেকে সদ্য এসেছেন মেটারনিখ। মানে আমার পুতুলটা। হ্যাঁ, আমার এক মামার দেওয়া উপহার। তবে আমার মেয়ে-পুতুল বেশি ভালো লাগে। কিন্তু সে কথা কি আর বলা যায়? কাজেই আদর করে তুলে রাখা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আমার মায়ের আর বাবার খুব পছন্দ হয়েছে মেটারনিখকে। মিথ্যে বলব না, আমারও খুব পছন্দ হয়েছে কিন্তু দাঁতগুলো দেখলেই ভয় করে। মেটারনিখ আসলে নাট ক্র্যাকার। বাদাম ভাঙা মানুষ। ওর একটা গুণ হল, দাঁত দিয়ে বাদাম ভাঙতে পারে। তাই দাঁতগুলো অত বড়ো বড়ো
আমার পড়ার ঘরেই একটা কাচের শো-কেস আছে সেখানেই মেটারনিখের স্থান হল। মেটারনিখের পাশেই রয়েছে গোলাপি রঙের কিমোনো পরা একটা জাপানি মেয়ে-পুতুল। গালদুটোও গোলাপি। হাতে আবার একটা ছোট্ট মিষ্টি হাতপাখা। লম্বা চুল খোঁপা বাঁধা, এর নাম বিনি। আমি রেখেছি। পুতুলটা আমার মায়ের ছিল একসময়। এখন আমার হয়ে গেছে। বিনি আমার সবচেয়ে প্রিয় পুতুল।  মেটারনিখকে বিনির পাশে রেখে ঘুমাতে গেলাম। পরের দিন সকালে দেখলাম মেটারনিখ বিনির পাশে নেই। অনেকখানি সরে গেছে। ওদের দুজনের মাঝে বার্বি দাঁড়িয়ে। বার্বির তো এখানে থাকার কথা নয়! বার্বির হাতের গিটার মেটারনিখের কাঁধে ঝুলছে। ও তো একদম নিচের তাকে ছিল! নিশ্চয় মায়ের কাজ। শো-কেসের পাল্লা খুলে আবার সব ঠিকঠাক করে দিলাম। তারপর স্কুল চলে গেছি।
ফিরে এসে ফ্রিজ খুলে চকলেট বার করতে গিয়ে মাথায় হাত! আমার চকলেটে শুধু মোড়কটা পড়ে আছে। ভেতরের মাল ফাঁকা। মা কি আমার লুকিয়ে লুকিয়ে চকলেট খাওয়া ধরেছে? মাকে সেটা জিজ্ঞেস করতেই বেশ বকা খেলাম।
মেটারনিখের দাঁতগুলো যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে। ইস্, কী কাণ্ড! সব পুতুলগুলো শুয়ে পড়েছে। সব ছত্রকার। টেবিল চেয়ার সমেত ডিনারে বসা সাহেব মেমগুলো একে অপরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। ওদের সংসারে মনে হচ্ছে বিশাল ঝড় বয়ে গেছে। অথবা ভূমিকম্প হয়ে গেছে। পাল্লা খুলে আবার সব ঠিকঠাক করে দিলাম। মেটারনিখকে বার করে নিজের পড়ার টেবিলে রাখলাম। এর দাঁতে চকলেট এল কোথা থেকে? এক্ষুনি পিঁপড়ে চলে আসবে লাইন দিয়ে। একটা রুমাল দিয়ে প্রথমে এর মুখটা মোছাতে হবে। কী আশ্চর্য! মেটারনিখের কপালটা কেমন ভিজে ভিজে। ওর ঘাম হয়েছে নাকি? ড্যাবা ড্যাবা চোখ মেলে আমাকেই দেখছে। আরে চোখের পলকও পড়ল মনে হচ্ছে। মেটারনিখ শ্বাস নিচ্ছে। হাত থেকে ওকে ফেলেই দিলাম। একদৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম সোজা রান্নাঘরে। মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা কিছু একটা রান্না করছিল। বলল, কী হয়েছে?
মেটারনিখ শ্বাস নিচ্ছে। চোখের পলকও পড়ছে। আমার চকলেট খেয়ে নিয়েছে
এক মিনিট মেটারনিখ আবার কে? সে তোর চকলেট কী করে খেল?
মামা যে পুতুলটা এনে দিয়েছে, ওর নাম মেটারনিখ।
তা ভালই করেছে। এখন হাতমুখ ধুয়ে ভাত খাবে এস
মা বিশ্বাস করছে না মেটারনিখের জীবন্ত হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু আমি ওকে হাতে নিয়ে দেখেছি।
সন্ধেবেলা পড়তে বসে ঢুলছিলাম মনে হল মেটারনিখ দাঁত বার করে হাসছে। বলল, যতই পড় না কেন কাল স্কুলে তুমি কানমলা খাবে ইতিহাসের ক্লাসে।
মেটারনিখ তাহলে কথাও বলতে পারে! পুতুল কি কখনও কথা বলতে পারে?
আমি তো ভুল শুনিনি! কেমন একটা রোবট রোবট গলা। পরের দিন সত্যি সত্যি ইতিহাস ক্লাসে কানমলা খেলাম। ছোট্ট একটা ভুল করে ফেললাম। ভাস্কো-ডা-গামা কালিকটে এসেছিলেন ১৯৯৮-তে। ১৪৯৮-টা ভুল করে ১৯৯৮ খুব সামান্য ভুল। এর জন্য কানমলা খেতে হল।
মেটারনিখকে আমি পড়ার টেবিলেই রেখে দিয়েছি। শো-কেসে আর তুলিনি। না জানি আবার কী অনিষ্ট করবে! আমার পুতুলগুলোকে ওই পেটাত। সৈনিক-পুতুল কিনা, তাই শান্তি পছন্দ করে না। সবসময় যুদ্ধ করতে চায়।
ভালো করেছ ওই আদুরে পুতুলগুলোর সাথে থাকতে আমার একদম ভালো লাগে না। তাছাড়া গরমে দম বন্ধ হয়ে আসে। তার চেয়ে তোমার পড়ার টেবিল অনেক ভালোআর হ্যাঁ, আমার নাম মেটারনিখ নয়। আমি হলাম পিটার। তুমি আমাকে পিটার বলেই ডেকো।
মেটারনিখ যে কথা বলতে পারে সেটা আর কাউকে বলিনি আমি শুধু তোমাদের বলছি। তোমরা আবার কাউকে বলো না। অবশ্য বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না।
তা পিটার, তুমি আমার অন্য পুতুলদের ধরে ধরে পেটাও কেন?
কী আর করব! যুদ্ধ করে করে অমন মারকুটে স্বভাব হয়ে গেছে। তাছাড়া ওরা এত সাজগোজই বা করে কেন? দেশে যুদ্ধ লেগেছে জানে না?পিটার কথায় কথায় যুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলে ফেলে
তুমি এত ভালো বাংলা কী করে জানলে? তোমার দেশ তো সুইজারল্যান্ডে।
আহা, কতদিন সুইজারল্যান্ড থেকে বিছিন্ন আমি! সে এক আশ্চর্য দেশ। মনে হবে স্বর্গ। আসলে আমি অনেকদিন একটা বাঙালি পরিবারে ছিলাম। তোমার মামার বাড়িতে ছিলাম অনেকদিন। তোমার মামী আমাকে দেখে একদিন ভয় পেল।
কেন? ভয় পেল কেন?
আমি তখন হাই তুলছিলাম তোমার মামী আর ঘরে ঢোকার সময় পেল না! ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল। বললে, এই আপদকে মানে আমাকে দূর করবেই। তাই করল। আমাকে গিফট করে দিল তোমাকে। আমি বেঁচেছি বাবা! ওই বুড়ো বুড়ো লোকদের সঙ্গে থাকতে আমার ভালো লাগত না মোটেই। সংসারে যারা লাভক্ষতির হিসেব কষে সর্বক্ষণ তাদের আমার মোটেই ভালো লাগে না।
এই পর্যন্ত বলে মেটারনিখ, নাহ্ মেটারনিখ নয়, পিটার ঘুমিয়ে পড়ল। কারেন্ট চলে গেলে পিটারের খুব কষ্ট হয় তালপাতার সেপাইয়ের মতো লম্ফঝম্প করে তখন। গরম একদম সহ্য করতে পারে না। আসলে ঠাণ্ডার দেশের পুতুল তো। ওকে একটা ছোট্ট সিলিং ফ্যান কিনে দিতে হবে। ছোটবেলায় আমায় দাদু কিনে দিয়েছিল রথের মেলা থেকে। খাটের বিটে বেঁধে ঝুলিয়ে দাও আর হাওয়া দেবে ফ্যানটা সাঁই সাঁই করে ঘুরবে একদম সত্যিকারের সিলিং ফ্যানের মতোইস্, কোথায় যে হারিয়ে ফেলেছি!
পিটার সুইজারল্যান্ডের গল্প করতে ভালোবাসে। আর যুদ্ধের গল্প। আমি ওকে সত্যজিত রায়ে ফ্রিৎস গল্পটা পড়ে শুনিয়েছি। ওর খুব ভালো লেগেছে। ও গল্প শুনতে খুব ভালোবাসে।
পিটার একদিন বলল, আজ তোমার স্কুলে একটা ঘটনা হবে।
কী হবে? কানমলা না পিটুনি, কোনটা হবে?
পিটার শব্দ করে হেসে উঠল, ওসব কিছু নয় তোমাদের স্কুল ম্যাগাজিন বেরুচ্ছে তাতে তোমার একটা গল্প থাকছে। গল্পটা খুব ভালো লিখেছ।
পিটারের গালদুটো টেনে দিলাম আনন্দের চোটে আমার আঙুলে ব্যথা লাগল। খুব শক্ত এর গালদুটো।
টিফিনের সময় আমাদের স্কুল ম্যাগাজিন বেরুল। ক্লাস টিচার এক এক করে ডেকে ম্যাগাজিন ধরিয়ে দিলেন। আমার নাম ডাকলেন যখন বললেন, আমার খুব অবাক লাগে তোমাকে দেখে। মাথার মধ্যে পুরো গোবর ঠাসা অথচ তাই নিয়েও দিব্যি সুন্দর সুন্দর গল্প লিখে চলেছ! সত্যি কি তুমি লেখ? না অন্য কেউ লিখে দেয়?
আমি উত্তর দিলাম না।
যাই হোক, খুব সুন্দর লিখেছ। পড়াশোনাতেও একটু মন দিও।
বাড়ি ফিরে রোজকার মতো আজও গেলাম পিটারের কাছে, পত্রিকাটা হাতে করে ঝোলাতে ঝোলাতে। কিন্তু পিটার আমার পড়ার টেবিলে নেই। আমার শো-কেসেও নেই। খাটের তলা দেখলাম, টেবিলের তলা দেখলাম। কোথাও পিটার নেই। আমার হাত থেকে পত্রিকাটা পড়ে গেল। মাকে ডাকলাম চিৎকার করে।
পিটার কোথায়?
ওহ্, তোর সেই পুতুলটা! আর বলিস না তোর ছোটোপিসি আর পিউ এসেছিল। পিউ খুব ভালো লেগেছে পুতুলটা দেখে। বলল, মামীমণি, আমি এটা নেব?
আর তুমি অমনি দিয়ে দিলে পিটারকে?
ছিঃ ছিঃ! পিউ তোমার ছোটোবোন না! আর ক্লাস সিক্সের মেয়ে কি পুতুল খেলে?
আমি হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসলাম যা আমি কখনও করিনি। মা এর আগেও আমার অনেক খেলনা অনেককে দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এরকম কান্নাকাটি আমি আগে কখনও করিনি। দুচোখ দিয়ে আরব সাগর আর বে অফ বেঙ্গল বইছে। পিটারকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না ও আমার সবকথা বোঝে।
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তোমায় সুন্দর একটা বার্বি ডল কিনে দেব। ওই দাড়িওলা সৈন্য-পুতুলের চেয়ে অনেক সুন্দর দেখতে হবে।
নাআআআআআআআ! আমার সৈন্য-পুতুলই ভালো! আমি নিজের ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে ফোঁপাতে শুরু করলাম
আচ্ছা দেখি, তোমার বাবা আসুক।
আমি হাতমুখ ধুলাম না, স্কুলের ড্রেস ছাড়লাম না, খেলাম না, ছাদে ঘুরতে গেলাম না, গল্পের বই খুললাম না। একভাবে কেঁদেই চললাম।
বাবা এসে সব শুনে বলল, কী সমস্যায় পড়লাম! পিউ তো অনেক ছোটো! ওর কাছে চাওয়াটা খারাপ লাগে। তুমি দিলে কেন?
আমি কী করব! বাচ্চা মেয়ে, চাইল, না দিয়ে থাকতে পারলাম না। বাবি তো এর আগেও নিজের অনেক খেলনা একে ওকে দিয়ে দিয়েছে।
দুজনে আরও কিছু বলছিল হয়তো। আমি মন দিয়ে শুনিনি। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমিয়ে পড়ার আগে শুনতে পেয়েছিলাম ল্যান্ড লাইনে ফোন এসেছে।
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি পিটার দাঁত বের করে হাসছে। বসে আছে আমার পড়ার টেবিলেবলল, যদি তুমি মনেপ্রাণে কোনও কিছু চাও তাহলে সমস্ত বিশ্ব-সংসার সেই জিনিস...
থাক থাক, আর তোমাকে শাহরুখ খানের ওম শান্তি ওম-এর ওই খটমট ডায়ালগ বলতে হবে না। আমি বুঝে গেছি তুমি কী বলতে চাইছ।
পিটার আসলে বলতে চাইছে মন থেকে কোনও কিছু চাইলে সত্যি সত্যি তা পাওয়া যায় পুরো জগত তাকে সাহায্য করে সেই জিনিসটা পাওয়ার জন্য।
এটা আসলে অ্যালকেমিস্ট উপন্যাসের সংলাপ। তোমাদের শাহরুখ খান ওখান থেকেই ঝেঁপে দিয়েছেন।
তাই নাকি! কিন্তু তুমি কী করে এলে? তোমাকে তো পিউ নিয়ে গেছিল!”
পিউ আমার দাঁত দেখে ভয় পেয়ে গেছে। একটুখানি হেসেছি শুধু। আর দুবার চোখের পলক ফেলেছি। একবার হাততালি দিয়ে মশা মেরেছিতাতেই পিউ কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। তোমার পিসি তখন তোমার মাকে ফোন করে। কাল রাতেই তোমার পিসে এসে আমাকে দিয়ে যায়,” পিটার আবার দাঁত বার করে হাসল।
ইস্, তোমার দাঁতগুলো খুব ময়লা হয়ে গেছে। একবার মাজিয়ে দিতে হবে।
কার দাঁত ময়লা হয়েছে রে? মাকে ঘরে ঢুকতে দেখে পিটার চুপ করে গেল।
পিটারের, মা।
সত্যি তো! ওকে একটা ব্রাশ কিনে দিতে হবে। জানিস, পিউ তোর পিটারকে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেছে।
তাই নাকি!
মা আমাকে পিউ ভয় পাওয়ার গল্প শোনাতে শুরু করল। আমি সবটাই জানি, তবু আবার শুনছি চোখ গোল গোল করে অবাক হবার ভান করছি। পিটারে মুখে রহস্যময় একটা হাসি খেলে যায়। ওর এই দাঁত বার করা হাসি দেখে আমার মনে হল পিটার কোনও সৈনিক নয় ও রাজা। পিটার দ্য কিং।

_____
অলঙ্করণঃ সুজাতা ব্যানার্জি

8 comments:

  1. বাহ, আমার শৈলেন ঘোষের বাহাদুর সিং এর কথা মনে পড়ে গেল।

    ReplyDelete
  2. onek dhonyobad...Arnab babu ebong Banasari :)

    ReplyDelete
  3. galpo ta khub bhalo hoyechhe, Sujatar chhobi duto o khub sundor hoyechhe. darun.

    ReplyDelete
  4. ভালো লাগল।

    ReplyDelete