হারকিউলিস
সহেলী চট্টোপাধ্যায়
গ্রিক পুরাণে হারকিউলিস একজন
অত্যন্ত শক্তিশালী চরিত্র।
হেরাক্লেসের আরেক নাম হারকিউলিস। হারকিউলিস নামের উৎপত্তি হয়েছে হেরাক্লেস থেকে। হেরাক্লেস
থেকে হারকুলেস এবং তার থেকে হারকিউলিস। গদাযুদ্ধে বা মল্লযুদ্ধে
তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না। শক্তিশালী হলেও তিনি খুব দয়ালু ছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন
দেবরাজ জিউস। আর মা আক্লমিনা ছিলেন পৃথিবীর এক
রাজকন্যা। হারকিউলিসের জন্ম থিবসে। থিবসের অন্ধ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা
টাইরেসিয়াস আক্লমিনাকে বলেছিলেন, হারকিউলিস হবেন মানবজাতির গর্ব। গ্রিকরা তাঁকে
মর্ত্যের বীর এবং দেবতা এই দুই পরিচয়েই পুজো করত।
হারকিউলিসের জন্মের খবর
পেয়ে বিমাতা জুনো হিংসেয় ছটফট করতে লাগলেন। দুটো বিষধর সাপকে পাঠালেন হারকিউলিসকে
মেরে ফেলার জন্য। সাপদুটোর ভয়ানক মূর্তি দেখে সবাই খুব ভয়
পেয়ে গেল। কেউ ছোট্ট হারকিউলিসকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টাই করল না। সবাই নিজের প্রাণ
বাঁচাতে ব্যস্ত। হারকিউলিস নিজের ছোট্ট দু’হাত দিয়ে
সাপদুটোর মাথা চেপে ধরলেন। জীবনের শুরু থেকেই এই যে লড়াই শুরু হল, চলেছিল একদম শেষপর্যন্ত। জুনো’র সব চক্রান্ত ব্যর্থ হল।
গ্রিক পুরাণে এক
ধরনের জীবের অস্তিত্ব দেখা যায় যারা অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক ঘোড়া।
মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত মানুষের মতো কিন্তু কোমর থেকে শরীরের বাকি অংশ ঘোড়ার মতো। এদের বলে সেন্টর। এরকমই একজন সেন্টর হলেন
চীরণ। চীরণ অস্ত্রবিদ্যার শিক্ষা দিতেন। হারকিউলিসকে চীরণের কাছে পাঠানো হল
অস্ত্রবিদ্যার শিক্ষার জন্য। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি অসাধারণ যোদ্ধা হয়ে উঠলেন। হারকিউলিস
সারা পৃথিবী ঘুরতে বেরোলেন নিজের উপযুক্ত কাজ খোঁজার
জন্য।
মিনিয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধে
অসামান্য অবদানের জন্য থিবসের রাজা ক্রেয়ন নিজের কন্যা মেগারার সাথে হারকিউলিসের
বিয়ে দিলেন। কিন্তু হারকিউলিস জীবনে সুখী হতে পারেননি। জুনো সবসময় হারকিউলিসের
ক্ষতি করার চেষ্টা করতেন। তাঁর চক্রান্তে হারকিউলিস একদিন উন্মাদ হয়ে গেলেন। নিজের
স্ত্রী-পুত্র সবাইকে মেরে ফেলেন। তারপর
যখন সুস্থ হলেন, বুঝতে পারলেন কী করেছেন! লজ্জায়
রাগে ভেবেছিলেন আত্মহত্যা করবেন। এক নির্জন বনে গিয়ে বসে রইলেন। এদিকে জুনো দেবতাদের
কুমন্ত্রণা দিতে লাগলেন। দেবতারা ঠিক করলেন একবছর হারকিউলিস আর্গসের রাজা ইউরিসথিউসের
ক্রীতদাস হয়ে থাকবে। ইউরিসথিউসের আদেশে তাঁকে বার বার অসম্ভব কাজ করতে হয়। এই কাজগুলোকেই
হারকিউলিসের শ্রম বলে। এগুলো ছিল নিমিয়ার এক দুর্দান্ত সিংহকে হত্যা করা। সিংহটি এতই ভয়াবহ ছিল যে এর সামনে কেউ পড়লে সে
আর কোনওভাবেই প্রাণ নিয়ে পালাতে পারত না।
বাস করত গ্রিসের নেমিয় উপত্যকায়। এলাকার মানুষকে বাঁচাতে হারকিউলিস সিংহটিকে মারার
পরিকল্পনা করেন। তিনি ওকগাছের কাঠ দিয়ে বিশাল বড়ো একটি মুগুর তৈরি করেন। মুগুরের আঘাতে সিংহটি ক্লান্ত হয়ে পড়লে হারকিউলিস
গলা টিপে সিংহটিকে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর নানাস্থানে তাঁর বীরত্বের কাহিনি ছড়িয়ে
পড়ে।
লের্নার জলাভূমিতে
হাইড্রাকে হত্যা করাঃ হাইড্রা ছিল বিরাটাকায় একটি সাপ।
যার মাথা ছিল ন’টি। তার মধ্যে আটটি মাথা ছিল
মরণশীল, একটি ছিল অমর। হারকিউলিস দেখলেন সাপের মাথাগুলো কেটে ফেললে আবার সেই
জায়গায় দুটো মাথা জন্ম নিচ্ছে। শেষে আর উপায় না দেখে তিনি সাপের মাথা কেটে সেই
কাটা মাথা আগুনে পুড়িয়ে দেন। হাইড্রার রক্তে তীব্র বিষ ছিল এবং হারকিউলিস নিজের তিরগুলোতে হাইড্রার রক্ত মাখিয়ে নিয়েছিলেন।
এছাড়া এরিম্যান্থাসের রাক্ষস বরাহকে হত্যা করা, সেরিনিয়ার
আশ্চর্য হরিণকে ধরে আনা, রাজা আগিয়াসের আস্তাবল পরিষ্কার করা, হেস্পিরিডিস থেকে
সোনার আপেল নিয়ে আসা, স্টিমফ্যালিন পাখিদের তাড়ানো ও অন্যান্য ভয়ংকর সব কাজ। এগুলো তিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেন এবং স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যার
পূর্ণ প্রায়শ্চিত্ত করেন।
এরিম্যান্থাসের রাক্ষস
বরাহকে মারার সময় একটা খারাপ ঘটনা ঘটে যায়। এই সময় একদল সেন্টর এসে তাঁর সঙ্গে
তুমুল ঝগড়া বাধিয়ে ফেলে। হারকিউলিস তখন হাইড্রার রক্তে মাখানো বিষবাণ ছুঁড়ে তাদের
মারতে লাগলেন। চীরণ এসে এই যুদ্ধ থামাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু হারকিউলিসের ছোঁড়া তির এসে তাঁর গায়ে লাগে। চীরণের
মৃত্যু হল। এভাবে হারকিউলিসের হাতে নিজের গুরুর মৃত্যু হয়। যদিও এর জন্য হারকিউলিসকে
দায়ী করা ঠিক হবে না। তবু হত্যা তো হত্যাই। এই ঘটনায় তিনি অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে
পড়েন।
হারকিউলিসের বিভিন্ন
অভিযান নিয়ে রয়েছে নানান গল্প। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে তিনি বিভিন্নরকম কাজ করেছিলেন।
ভয়ংকর দানব অ্যান্টিউসের বিরুদ্ধে, নদীর দেবতা অ্যাকিলাসের
বিরুদ্ধে লড়াই করেন। অ্যাডমিটাসের মৃত স্ত্রী
অ্যালসেস্টিসকে মৃত্যুদেবতার হাত থেকে লড়াই করে ফিরিয়ে আনেন।
হারকিউলিস পরে ডেয়ানিরাকে
বিয়ে করেন। এক সেন্টর নেসাস ডেয়ানিরাকে অপহরণ করে নিয়ে যাবার সময় হারকিউলিসের হাতে
ধরা পড়ে যায়। হারকিউলিস তাকে সেই বিষাক্ত তির দিয়ে
আঘাত করেন। মারা যাবার আগে নেসাস ডেয়ানিরার কাছে
ক্ষমা চায়। বলে, ‘আমার এই জামা তুমি খুলে রাখো। যদি কোনওদিন দেখো হারকিউলিস আর তোমাকে আগের মতো ভালোবাসছে না, তাহলে তুমি এই জামাটা
হারকিউলিসকে পরিয়ে দিও। এই জামা যতদিন তোমার কাছে থাকবে হারকিউলিসও ততদিন তোমার
থাকবে।’
কিন্তু এসব ছিল নেসাসের
চালাকি। ডিয়ানিরা আর হারকিউলিস বেশ ভালোই দিন
কাটাচ্ছিলেন। একবার একটা কাজের জন্য হারকিউলিসকে অনেক দূরে যেতে হয়েছিল। তিনি
ফিরছেন না দেখে ডেয়ানিরা ছটফট করতে লাগল। ভাবতে থাকে, হারকিউলিস হয়তো আমাকে আর
আগের মতো ভালবাসেন না। এক দূতের হাত দিয়ে সেই জামাটা ডেয়ানিরা হারকিউলিসের কাছে
পাঠিয়ে দিল। সোনার মতো ঝকঝকে জামা। ডেয়ানিরা খুব যত্ন
করে তুলে রেখেছিল এতদিন। জামার গল্প হারকিউলিস কিছুই জানতেন না। দূতের পাঠানো জামা
দেখে ভাবলেন ডেয়ানিরা কত ভালোবেসে
তাঁকে জামা পাঠিয়েছে! জামা পরার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সমস্ত শরীর জ্বলে যেতে লাগল।
জামাটা খুলতে গিয়ে দেখলেন জামা তাঁর শরীরের সাথে আটকে গেছে। গায়ের চামড়া উঠে আসছে
কিন্তু জামা ছিঁড়ল না। হাইড্রার রক্ত মাখানো বিষাক্ত তিরে নেসাসের মৃত্যু হয়েছিল।
সেই বিষ নেসাসের জামায় মিশে গিয়েছিল। নিজের হাতে নিজের চিতা তৈরি করলেন হারকিউলিস।
এক বন্ধুকে বলেন, ‘তুমি যদি আমার সত্যিকারের বন্ধু হও তাহলে চিতায় আগুন দাও।’ নিজের সেই বিষাক্ত তিরগুলো
বন্ধুকে দিয়ে দিলেন। স্বর্গের দেবতারা তাঁকে নিজেদের মধ্যে ডেকে নিলেন। সেখানে
তাঁর বিয়ে হয় দেবী হিবির সাথে।
হারকিউলিসের কাহিনি কাল্পনিক হলেও সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হারকিউলিসকে নিয়ে
অনেক সিনেমা এবং টেলিভিশন সিরিজ হয়েছে। লেখা হয়েছে অনেক গল্প, অনেক বইও। বিভিন্ন দেশে হারকিউলিসের বীরত্ব নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেকগুলো সিনেমা এবং টিভি সিরিয়াল যেগুলো খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
_____
তথ্যসূত্র ও ছবিঃ আন্তর্জাল
ছোটবেলা থেকে গ্রীক পুরাণের গল্পে হারকিউলিসের গল্প পড়ে এসেছি, কিন্তু এই কাহিনী গুলোতে যে হিংসা এবং নিষ্ঠুরতার রাজনীতি লুকিয়ে আছে টা আরেকটু বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি, ছোটবেলায় আকর্ষণ করত ঐ সেন্টর বা হাইড্রার বিবরণ। ভাল লাগল পুরনো স্মৃতি নতুন ভাবে রোমন্থনের সুযোগ পেয়ে।
ReplyDeleteonek dhonyobad Saptarshi :)
ReplyDelete