মার্টিন ডেভিড ক্রুস্কাল |
ক্রুস্কাল
কাউন্ট
সূর্যনাথ
ভট্টাচার্য
পল্টু
স্কুলে ম্যাজিক দেখে এসেছে। একটা ম্যাজিকে সে অংকের গন্ধ পেয়েছে, তাই আমাকে
উৎসাহিত হয়ে সেই গল্প শোনাচ্ছিল। ম্যাজিকটা এই -
জাদুকর
এক প্যাকেট তাস ভালো করে সাফল করে নিয়ে বললেন, আমি একটা করে তাস আপনাদের দেখাব।
প্রথম দশটা তাসের মধ্যে যে কোনও একটা তাস আপনাদের প্রথম তাস, সেই থেকে
আপনারা গুণতি শুরু করবেন। ঐ প্রথম তাসে যত ফোঁটা সেই তাসের পর থেকে তত নম্বর তাসটা
হবে আপনাদের দ্বিতীয় তাস। ফের ঐ দ্বিতীয় তাসে যত ফোঁটা সেই তাসের পর থেকে তত নম্বর
তাসটা হবে আপনাদের তৃতীয় তাস। এইভাবে গুণে চলুন যতক্ষণ না আমার হাতের সব তাস শেষ
হয়। আপনাদের শেষ মনোনীত তাসটা কী আমি বলে দেব। এই খেলার জন্য টেক্কা এক ফোঁটা আর
সাহেব, বিবি
আর গোলামকে পাঁচ-পাঁচ ফোঁটা ধরবেন। বাকি সব তাসে তো ফোঁটা দেওয়াই আছে।
এই
বলে জাদুকর একটা করে তাস দেখাতে লাগল। পল্টু পছন্দ
করল তিন নম্বর তাসটা,
সেটা ছিল রুইতনের তিন। তারপর থেকে তিনটে তাস পরে এল ইস্কাবনের বিবি, মানে পাঁচ
ফোঁটা। তারপর পাঁচটা তাস পরে এল রুইতনের নয়। তারপর নয়টা তাস পরে এল চিড়েতনের দুই।
তার দু'টো
তাস পরে এল হরতনের আট,
তার আটটা তাস পরে--।
হিসেবগুলো
পল্টু মনে মনে করছিল,
কোনওটাই জাদুকরকে জানিয়ে নয়। এইভাবে চলতে চলতে একবার এল ইস্কাবনের গোলাম। পাঁচ
ফোঁটা। কিন্তু তার পরে আর মাত্র দুটো তাস ছিল। সে দু'টো দেখিয়ে
ফেলে দেবার পরেই জাদুকর বললেন, আপনার শেষ পছন্দ করা তাসটা ইস্কাবনের গোলাম, তাই না? *
পল্টু
অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তাসগুলো আমিই সাফল করে দিয়েছিলাম মামা, মোটেই
জাদুকরের জানা কোনও অর্ডারে সাজানো ছিল না। আর আমি প্রথম কোথা থেকে শুরু করেছিলাম
তাও জানাইনি। তাহলে কী করে বলল বলো তো?
আমি
পুরো ক্রমটা আর একবার শুনেও ঠিক ধরতে পারলাম না। ভাবছি আকাশ পাতাল। টেবিলের ওপাশে মাষ্টারমশাই
কি একটা পড়ছিলেন। বইটা মুখ থেকে নামিয়ে বললেন, ক্রুস্কাল কাউন্ট।
-
ক্রুস্কাল। প্রিন্সটনের প্রফেসর
মার্টিন ক্রুস্কাল-এর নামে। উনিই প্রথম ব্যাপারটা নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। উনি
দেখেছিলেন, যেখান
থেকেই শুরু হোক না কেন,
অনেকবার গুণে গেলে একটা নির্দিষ্ট জায়গাতেই গণনা শেষ হয়।
প্রথমটা
শুনে ঠিক বিশ্বাস হল না। কী ক্রমে ফোঁটা আসবে তা জানা না থাকলে কি এটা বলা সম্ভব? কিন্তু
মাষ্টারমশাই বলছেন, কাজেই
তাতে ভুল হবে না। জানতে চাইলাম, ব্যাপারটা কী করে হচ্ছে?
-
তাসের প্যাকেটে ক্রুস্কাল কাউন্ট
জাদুকরও একটা জায়গা থেকে শুরু করেছে। পল্টু যেখান থেকেই শুরু করুক না কেন, কোনও একটা
তাসে গিয়ে দুজনের কাউন্ট ম্যাচ করবে। মানে তার একটা প্রবল সম্ভাবনা আছে। তারপর
থেকে তো গণনা সিংক্রোনাইজড হয়ে গেল। অতএব শেষ তাসটা জাদুকরও জানবে। এখানে মাঝে
কোথায় সিংক্রোনাইজেশনটা হল,
সেটা জানার দরকার নেই। সেটা যে হবে এটাই বড় কথা।
-
মানে? হবেই যে তার কি কোনও নিশ্চয়তা আছে? নাও তো হতে
পারে?
-
তা পারে। তবে ফোঁটার সংখ্যা যদি খুব
বেশি না হয় এবং অনেকগুলো তাস থাকে তাহলে সেই সম্ভাবনাটা খুব বেশি। গড় ফোঁটার মান
আর মোট কাউন্টের সংখ্যার অপর নির্ভর করে ক্রুস্কাল সাহেব সেই প্রব্যাবিলিটির একটা
ফর্মুলাও বার করেছিলেন। পল্টু যে খেলা দেখেছে তাতে ফোঁটা আছে এক থেকে দশ আর তিনটে
পাঁচ। অর্থাৎ গড় হল ৫.৩৮৪৬। মোট কাউন্ট ৫২। ক্রুস্কালের ফর্মুলা অনুযায়ী কাউন্ট
সিঙ্ক্রোনাইজ করার প্রোব্যাবিলিটি হয় শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ। অর্থাৎ সঠিক
ভবিষ্যৎবাণীর বেশ ভালো সম্ভাবনা, তাই না?
-
তার মানে একেবারে নিশ্চিত নয়।
-
না, তা নয় বৈকি। দশবার খেলাটা দেখালে দু'-একবার ভুল
হবার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। সেইজন্যেই সাহেব-বিবি-গোলামের পাঁচ-পাঁচ ফোঁটা ধরেছে।
ওগুলো যদি ১৩, ১২
আর ১১ ধরা হয় তাহলে ফোঁটার গড় হয়ে যাচ্ছে ৭। আর সেক্ষেত্রে সাফল্যের সম্ভাবনা কমে
গিয়ে হবে শতকরা ৬৬ ভাগের মত।
আমার
মন খুঁতখুঁত করতে লাগল। তাহলে এ ম্যাজিক তো খুব নিরাপদ নয়। মাষ্টারমশাই আবার বললেন, এই সম্ভাবনা
অনেকটাই বাড়ানো যায় যদি ফোঁটার সংখ্যার জায়গায় তার ইংরেজি শব্দের বর্ণসংখ্যা ধরা
যায়। যেমন টেক্কার জন্য ওয়ান, মানে তিন। টু মানেও তিন। থ্রী মানে পাঁচ। ফোর মানে চার।
এইরকম আর কি। এক্ষেত্রে ক্রুস্কাল কাউন্ট সিংক্রোনাইজ হবার সম্ভাবনা প্রায় ৯৭
পারসেন্ট। প্রায় নিশ্চিত।
পল্টুর
মুখ হাঁ। আমিও একটু হতভম্ব। তবে মনে হচ্ছে একটা সংখ্যাতাত্ত্বিক সম্পর্কের আভাস
পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের অসহায় মুখগুলো দেখে মাষ্টারমশাই হাতের বইটা টেবিলে মেলে ধরে
বললেন, এই
গল্পগুচ্ছের একটা প্যারাগ্রাফের শব্দ নিয়েও ক্রুস্কাল কাউন্ট করা যায়। ধরা যাক 'ক্ষুধিত
পাষাণ' গল্পের
এই প্যারাগ্রাফটা-- 'প্রায়
আড়াই শত বৎসর পূর্বে...'। মনে
হয় পঞ্চাশ-ষাট শব্দ আছে এবং কোনওটাই খুব বড় নয়। গড় অক্ষরসংখ্যা চারের কাছাকাছিই
হবে। সুতরাং সাক্সেস রেট ভালোই হবে। তোমরা দুজনেই প্রথম লাইনের যে কোনও শব্দ থেকে
শুরু করে অক্ষরসংখ্যা অনুযায়ী ক্রুস্কাল কাউন্ট করে দেখো তো কোথায় গিয়ে শেষ হয়?
অক্ষরসংখ্যা
অনুযায়ী ক্রুস্কাল কাউন্ট মানে কোনও একটা শব্দ থেকে শুরু করে সেই শব্দে যতগুলো
অক্ষর পরবর্তী তত সংখ্যক শব্দে চলে যাওয়া। তারপর সেই শব্দে যতগুলো অক্ষর, তার পরবর্তী
তত সংখ্যক শব্দে চলে যাওয়া। এইভাবে প্যারাগ্রাফের শেষে পৌঁছে দেখলাম আমার শেষ
শব্দটা হল 'গজল'। আশ্চর্যভাবে
পল্টুরও তাই এল! মাষ্টারমশাই বললেন, 'গজল' এসেছে তো? আমারও তাই
এসেছে। সুতরাং ক্রুস্কালের থিওরিতে ভুল নেই।
পল্টু
একেবারে হতবাক হয়ে গেছে। তাকে উদ্দেশ্য করে মাষ্টারমশাই বললেন, কি
পল্টুবাবু খুব অবাক হলে?
আরও টেস্ট করে দেখো না হয়। প্রথম লাইনের যে কোনও শব্দ থেকে শুরু করে?
আমি
জিজ্ঞেস করলাম, প্রথম
লাইন থেকেই কেন মাষ্টারমশাই?
-
সেটা যথেষ্ট সংখ্যক কাউন্ট পাবার
জন্যে। প্যারাগ্রাফ যথেষ্ট বড় হলে যে কোনও জায়গা থেকেই শুরু করা যায়। মূল উদ্দেশ্য
যথেষ্ট সংখ্যক কাউন্ট দেওয়া। তাতে ঐ প্রোব্যাবিলিটি বেড়ে যাবে। কাউন্ট কম হলে
সিংক্রোনাইজেশনের আগেই তা শেষ হয়ে যেতে পারে, তাই না?
তারপর
মুচকি হাসি হেসে মাষ্টারমশাই পল্টুকে বললেন, টুইংকল টুইংকল লিটল ষ্টার —
ছড়াটা জানো
তো পল্টুবাবু? এইখানে
লেখো দিকিনি। বলে একটা খাতা এগিয়ে দিলেন তিনি। পল্টু গড়গড় করে তাতে লিখে দিল
ছড়াটা। মাষ্টারমশাই তার নিচে শুরুর দুটো লাইন জুড়ে দিলেন। ছড়াটা দাঁড়াল -
Twinkle twinkle little star
How I wonder what you are
Up above the world so high
Like a diamond in the sky
Twinkle twinkle little star
How I wonder what you are.
তারপর
মাষ্টারমশাই বললেন, এই ছড়াটা
ছোট্ট। তবু এর প্রথম দু'লাইনের
যে কোনও শব্দ থেকে যদি অক্ষর অনুযায়ী ক্রুস্কাল কাউন্ট করে যাও, কি পাবে জান? তুমি, পল্টুবাবু--
'তুমি'। 'you'!
এই
বলে তিনি পল্টুর মাথায় একটা ছোট্ট টোকা দিয়ে দিলেন। পল্টু ততক্ষণে লেগে গেছে ছড়ার
ক্রুস্কাল গণনা করতে।
_____
ছবিঃ উইকিপিডিয়া
* উৎসাহী
পাঠক ম্যাজিকের ডিমন্সট্রেশন দেখতে পারো এইখানে –
বেশ মজার একটা ম্যাজিক শেখা হল, তার সাথে স্ট্যাতিস্টিক্সও।
ReplyDelete