খাদের
ধারের বাড়ি
বাবিন
সমুদ্রতল
থেকে ছ’হাজার
চারশো ফুট উঁচুতে মেঘের খুব কাছাকাছি একটা গ্রাম আছে - ‘রিকিসুম’৷ গল্প
লেখার তাগিদে বেশ কিছুদিন ধরেই আমি এমনই একটি অজানা জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম৷
যেখানে পাহাড়, খাদ
আর ভূতুড়ে বাংলো থাকবে৷ সেটা পেলাম এই রিকিসুমে এসে৷ আমার স্বপ্নের গ্রাম৷
প্রতি
মঙ্গলবার নিউ জলপাইগুড়ি এসি এক্সপ্রেসের চেয়ার কারে তিন-চারশো সিট সম্পূর্ণ খালি
যায়৷ যাত্রীরা টানা তিনটি আসনে আরাম করে শুয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই আসতে পারেন৷ সেই
ট্রেনে চেপে মঙ্গলবার রাতে রওনা দিলাম৷ সামান্য লেট করে ট্রেন সকাল দশটায় পৌঁছাল
নিউ জলপাইগুড়ি৷ সেখান থেকে কুড়ি টাকা অটো ভাড়া দিয়ে চলে এলাম পানি ট্যাঙ্কি মোড়৷
তারপর চাপলাম কালিম্পংগামী শেয়ার গাড়িতে৷ দক্ষিণা একশো তিরিশ৷ এর আগে আমার দৌড় ছিল
শিলিগুড়ি পর্যন্ত৷ আমাদের দপ্তরের একটি শাখা আছে এই শিলিগুড়ি শহরে, কাজের
সূত্রে এসেছি বারকয়েক৷ কিন্তু তার আগে যাবার সুযোগ হয়নি কখনও৷ তাই উত্তেজনায় ভেতরে
ভেতরে ফুটছিলাম টগবগ করে৷
পাহাড়ি নদী তিস্তা |
তিস্তার সেতু থেকে |
পাহাড়ি নদী (ভিডিও)
সেবক বাজার
পার হতেই নজরে পড়ল অভূতপূর্ব এক দৃশ্য৷ বাঁদিকে পাহাড় আর ডানদিকে তিস্তা৷ এই প্রথম
এমন এক পাহাড়ি নদী চাক্ষুষ করলাম যার জলের রং সবুজ! খাদের গভীরে বইছে নদী৷ সবুজ
তার জল৷ যেন কোনও শিল্পী রাঙিয়ে দিয়েছে তাকে কল্পনার রঙে! প্রায় ঘন্টা খানেক
তিস্তার সাথে লুকোচুরির পর একটা সেতু পার হয়ে নদীকে বাঁয়ে ফেলে আমরা আরও উঁচু
পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম৷ রাস্তার ধারের বোর্ড দেখে বুঝতে পারলাম, কালিম্পং আর
বেশি দূরে নেই৷ পাহাড়ের গায়ে পাক খেতে খেতে বিপজ্জনক অনেক বাঁক পেরিয়ে আড়াই ঘন্টা
পর পৌঁছলাম জনবহুল কালিম্পং শহরে৷ এখান থেকে আবার চড়ে বসলাম আলাগাড়াগামী শেয়ার
জীপে৷ চল্লিশ টাকা ভাড়া৷ রিকিসুমের ‘স্বর্ণশিখর হোমস্টে’র কর্ণধার
রোজেন রাইয়ের সঙ্গে মাঝে মধ্যেই ফোনালাপ চলছিল৷ উনি আমাকে ঠিকঠাক রাস্তা বাতলে না
দিলে হয়তো যাতায়াত খরচা কিঞ্চিৎ বেশিই পড়ে যেত৷ কেউ যদি রিকিসুম যেতে চান তাহলে
অতি অবিশ্যি রোজেন রাইকে ৯৪৩৪১৪২৭১৯ নম্বরে ফোন করে নিতে পারেন৷ ফেরার সময় সরাসরি
রিকিসুম থেকে কালিম্পং পর্যন্ত শেয়ার জীপ পেয়েছিলাম পঞ্চাশ টাকায়৷ আবার কালিম্পং
থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত আরামদায়ক সরকারি বাস মিলেছিল পঁচানব্বই টাকায়৷ সব মিলিয়ে
সাড়ে তিন ঘন্টার রাস্তা৷
আমাদের ডানদিকে বয়ে চলেছে সবুজ জলের নদী তিস্তা
(ভিডিও)
তিস্তার এই সেতু পার করেই
আমরা উঠব পাহাড়ে, কালিম্পং যাবার জন্য (ভিডিও)
আলাগাড়ার
পাহাড়ি রাস্তা এতই চমত্কার যে বারে বারে মোহিত হয়ে যাচ্ছিলাম৷ এ পথে আমার মতো
ভ্রমণার্থী আর কেউই নেই৷ সহযাত্রী সবাই স্থানীয় নেপালি৷ কেউ দপ্তর থেকে ফিরছেন, কেউ বা
ক্ষেতের সবজি বিকিকিনি করে মনে মনে সারাদিনের লাভ লোকসান কষছেন। আবার কেউ স্কুল
থেকে বন্ধুদের সঙ্গে বকরবকর করতে করতে ফিরছে৷ সকলেই নিজের মাতৃভাষায় কথা বলছেন, কিন্তু
আন্দাজ করতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না৷ ওই তো কপালে বলিরেখা সর্বস্ব
মানুষটি বিড়বিড় করে বলছেন,
“উফ্, আর
পারা যায় না। এত খেটে ফসল ফলিয়ে এইটুকু মুনাফা? কাল মেয়ের স্কুলে ফিস জমা দিতে হবে!
কী যে করি!”
গলায়
কম্ফর্টার জড়ানো সুখী ভদ্রমহিলা পাশের মহিলাটিকে বলছেন, “হ্যাঁ রে, কাল যে
মুরগির মাংসটা রান্না করে দিয়েছিলুম, কেমন হয়েছিল? ধনেপাতা
দিয়ে এই প্রথম রেসিপিটা শিখেছি, হে হে, ভালো হয়েছে তো?”
সঙ্গী
মহিলাটি ছোট্ট আয়নায় দেখে ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষতে ঘষতে বলছেন, “হুম। মন্দ
হয়নি, আমার
কর্তার তো ভালই লেগেছিল৷ শুধু নুনটা একটু...”
স্কুল ফেরত
দুটো ফুলের মতো মিষ্টি মেয়ে হেসে হেসে আলোচনা করছে যে, আজ স্কুলে
মাস্টারজীকে কীরকমভাবে পঢ়েশান করেছে ওরা৷
কলকাতার
বাইরে বেরোলে আমি কথা খুব কম বলি। শুধু কানদুটো খাড়া করে রাখি৷ প্রকৃতির অনেক না
বলা কথা শুনতে পাওয়া যায়৷ এই মানুষগুলোও তো প্রকৃতিরই অংশ বিশেষ!
আলাগাড়া
থেকে একটা টাটা ইন্ডিকা গাড়ি আমাকে নিয়ে চলল রিকিসুম৷ এঁকে একশো টাকা দিতে হবে৷
সম্পূর্ণ নির্জন পাহাড়ি পথে গাড়ি এগিয়ে চলল৷ পাহাড়ের গা কেটে তৈরি করা পথের দিকে
চেয়ে ভাবছিলাম, না
জানি কত মানুষের কত বছরের খাটুনির ফসল এই পিচ ঢালা মসৃণ রাস্তা!
এইখানে একটা
কথা বলে রাখি, আমি
আগে আরাকু গিয়েছি, মুসৌরী
পাহাড়েও চড়েছি৷ পাহাড়ি পথে গাড়ি যখনই ওঠে বিপজ্জনক বাঁক নিয়ে, আমি ইষ্টনাম
জপ করতে থাকি৷ কিন্তু এই সাড়ে তিনঘন্টার যাত্রায় আমার বিন্দুমাত্রও ভয় লাগেনি৷
কারণ, যথেষ্ট
চওড়া এই রাস্তায় খাদের দিকে গার্ড রেলিং দেওয়া, যেটা আমার সাহসকে অনেকটা বাড়িয়ে
দিয়েছিল৷ সমস্ত রাস্তাটাই উপভোগ করতে করতে গিয়েছি৷
আমার হোম স্টে |
বাড়ির পিছনের পাইন বন |
প্রায় ছয়
কিলোমিটার চড়াই উতরাই পার করে পৌছে গেলাম স্বর্ণশিখর - রিকিসুম৷ গাড়ি থেকে নেমে
হাঁ করে চেয়ে রইলাম রোজেনের কুটিরের দিকে৷ ঠিক যেন গুগলে সার্চ করে পাওয়া নাম না
জানা কোনও বিদেশি শিল্পীর আঁকা ছবি! পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধাপ কাটা পথে প্রায় তিরিশ
ফুট উপরে সুদৃশ্য বাড়িটি যেন ঝুলে আছে৷ সামান্য এইটুকু হেঁটে উঠতেই হাঁপ ধরে গেল৷
বুঝলাম, এখন
আমি মাটি থেকে অনেক অনেক উপরে আছি৷ অক্সিজেনের অভাব একটু তো বোধ হবেই!
সাদরে আমাকে
অভ্যর্থনা করলেন রোজেন এবং তাঁর স্ত্রী৷ সবচেয়ে উপরের চমত্কার বারান্দা ঘেরা বাড়ির
সেরা ঘরটি আমাকে খুলে দিলেন৷ সমস্ত কিছুই কাঠের তৈরি৷ দেয়াল, মেঝে, আসবাব সবই, মায় সংলগ্ন
চানঘরটি পর্যন্ত কাঠের৷ চানঘরের মেঝে অবিশ্যি মার্বেল দেওয়া৷ ঘরের মেঝেতে কার্পেট
পাতা৷ এখানে খাওয়া থাকা নিয়ে অন্তত দু’জন গেলে প্রতিদিন দেড় হাজার করে লাগে
আর একজন হলে দু’হাজার৷
তবে আমার বুকিং এজেন্ট মারফত হয়েছিল৷ পরের বার যাবার সময় সরাসরি রোজেন রাইয়ের
সঙ্গে কথা বলে নেব, খরচা
কিছু কম পড়বে৷
রিকিসুমের রাস্তা |
হোম স্টের বারান্দা থেকে |
বাড়ির উল্টোদিকের মেঘে ঢাকা পাহাড় |
এই
গ্রামটিতে দুটো মাত্র হোমস্টে আছে৷ সামান্য কিছু নেপালি পরিবারের বাস৷ তাঁরা মূলত
চাষাবাদ করেন৷ তাঁদেরই অন্যতম রোজেন রাই৷ একটি হোমস্টে’র মালিক৷
নিজের বাড়ির সবচেয়ে ভালো আর আরামদায়ক ঘরগুলো অতিথিদের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন৷ বাড়ির
সংলগ্ন খানিকটা জমিতে রোজেনের এলাচ বাগিচা ছিল আগে, এখন বড়ো গাছ লাগিয়েছেন৷ দীর্ঘমেয়াদী
লাভের আশায়৷
বারান্দায়
টেবিল চেয়ার পাতা৷ এক কাপ গ্রিন টি আর গোটা ছয়েক পকোড়া নিয়ে বসলাম৷ বাড়ির সামনে যে
রাস্তাটি দিয়ে এসেছি তার পরই খাদ৷ গভীর খাদ৷ তার ওপারে সুউচ্চ পাহাড়৷ মনে হল, আমাদেরটির
চেয়ে আরও একটু বেশি উঁচু৷ সেখানে কোনও লোকবসতি নেই৷ পাইন-ধুপির গহন জঙ্গল৷ শুনলাম, ওটি
সংরক্ষিত অরণ্য৷ আশেপাশে অবিশ্যি যেদিকেই তাকানো যাক না কেন শুধুই পাহাড় আর পাহাড়৷
কোথাও মানুষের সামান্য চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, কোথাও নেই৷ হঠাৎ একরাশ মেঘ উড়তে উড়তে
চলে এল সামনের পাহাড়টিতে৷ এলোমেলোভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে৷ ভয় লাগল, যদি ওই
মেঘটা খেয়াল হলে এদিকে চলে আসে তাহলে কী হবে?
|
| ||||
|
|
অনেকক্ষণ
ধরেই একটু অস্বস্তি হচ্ছিল৷ কেউ যেন আমাকে আড়াল থেকে লক্ষ করছে৷ কিন্তু ঠিক আন্দাজ
করতে পারছিলাম না৷ চকিতে পেছন দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখি একটি ছোট্ট ফর্সা মুখ
বারান্দার কিনারে দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে আছে৷ কৌতূহল, ভয় আর
সন্দেহ মেশানো দুটি স্বপ্ন ঘেরা চোখ আমার দিকে চেয়ে৷ রোজেনের শিশুপুত্র নির্ঘাত৷
হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলাম৷ নাম জিজ্ঞেস করলাম৷ উত্তর না দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আমাকে
দেখতে লাগল সে৷ বুঝলাম,
সামনের টেবিলে যেসব ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী - ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, গোটা তিনেক
ফোন - আইফোন, ব্ল্যাকবেরি
- ওয়াইফাই ডিভাইস মেলে রেখেছি, সেসব দেখে বেচারা ঘাবড়ে গেছে৷ না জানি আমি কীরকম মানুষ হব
সে বিষয়েই ও সন্দিহান৷ আমার সঙ্গে সবসময়ই কিছু চকোলেট থাকে৷ কারণ, রাস্তায়
সবসময় স্বাস্থ্যকর খাবারদাবার পাওয়া যায় না৷ আর আমি এই ব্যাপারে একটু সচেতন৷ তাই
খিদে পেলে, ঠিকঠাক
খাবারদাবার না জুটলে খানিকটা করে চকোলেট খেয়ে পেটকে সান্ত্বনা দিয়ে থাকি৷ সেই রসদ
থেকেই একটি লম্বা চকলেট বের করে ওকে দিলাম৷ চকোলেট বড়ো ভালো জিনিস, অন্তত
বন্ধুত্বের হাত বাড়াবার জন্য এর জুড়ি নেই৷ আমাদেরও চটপট বন্ধ্বুত্ব হয়ে গেল৷ আমার
নতুন বন্ধুটির নামটিও চমত্কার — আকাশ৷ আকাশের এত কাছাকাছি এসে যদি আকাশের সঙ্গেই বন্ধুত্ব
হয়ে যায় তবে আর চাই কী?
নেপালি ছাড়া আকাশ আর কোনও ভাষা জানে না। আমিও নেপালিতে দিগগজ! তাই কথোপকথনের
আদিম মাধ্যমেই আমাদের আলাপন চলছিল৷ ইশারা-ইঙ্গিতে৷ আমার খেলার জিনিসগুলো, বৈদ্যুতিন
যন্ত্রগুলি নেড়েচেড়ে দেখার পর আমাকে হাত নাড়িয়ে ইশারা করে এখানেই অপেক্ষা করতে বলে
আমার ছোট্ট বন্ধুটি চলে গেল৷ খানিক পরে ফিরে এল একটা অদ্ভুত সুন্দর জিনিস নিয়ে -
পাইনগাছের ফল৷ বাদামী রঙের অনেকটা শঙ্কু আকৃতির ফলটির গায়ে অসংখ্য বীজ আটকে রয়েছে৷
প্রতিটি বীজের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ভবিষ্যতের একটি গগনভেদী বৃক্ষ৷ সম্ভাবনায়
উজ্জ্বল সেই চমত্কার ফলটি আকাশকে ফিরিয়ে দিতে গেলে ও বাধা দিল৷ ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল, এটা আমাদের
বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে রেখে দাও তুমি৷ নিজেকে বড়োই দীন বলে মনে হল৷ আমার কাছে
ওকে দেবার মতো আর কিছুই ছিল না - ভালোবাসা ছাড়া৷
রোজেন বলল, কাল ভোরবেলা
আমাকে ব্রিটিশদের একটা বাংলো দেখাতে নিয়ে যাবে৷ ১৯০২ সালে তৈরি এই বাংলো পরে ভারত
সরকারের হাতে চলে আসে৷ দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, গোর্খা আন্দোলনের সময় এটি ভেঙে দেওয়া
হয়৷ কপাল ভালো থাকলে ওখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার চমত্কার ভিউ পাওয়া যাবে৷ তবে কুয়াশার
কথা কিছুই বলা যায় না৷
রাতের মেনু
গরম গরম রুটি, ডাল, ফুলকপির
তরকারি আর মুরগির মাংস৷ আহা, রোজেনের স্ত্রীর রান্নার হাতটি চমত্কার! ভোজন সমাপ্ত করে
নরম উষ্ণ দুটি কম্বলের সান্নিধ্যে শুয়ে শুয়ে শুনতে লাগলাম নিচ থেকে ভেসে আসা
রোজেনের শিশুপুত্রের কন্ঠের মন উদাস করা নেপালি গান৷ স্বপ্ন দেখতে লাগলাম, একফালি মেঘ
এসে আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে আর আমি নিজেকে সেই দুষ্টু মেঘের হাত থেকে
বাঁচাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাটিও না করে আপাদমস্তক সিক্ত হয়ে গেলাম৷ অনির্বচনীয় এক
আনন্দে আমি আপ্লুত হয়ে যাচ্ছি!
|
|
||||
|
|
ভোর সাড়ে
পাঁচটায় উঠে রোজেনের সঙ্গে পথ চলা শুরু৷ বাড়ির ঠিক পেছনেই পাইন সারির ফাঁক দিয়ে
উঠে গেছে পায়ে চলা পথ৷ এটাই শর্টকাট রাস্তা৷ গাড়ি যাবার মতো একটা ঢালু পথ আছে বৈকি, কিন্তু সে
পথে অনেকটা বেশি হাঁটতে হবে৷ তার ওপর খানিকটা পথ ধসেও গেছে গত বর্ষায়৷ ইংরেজদের
বাংলো ধ্বংস করে দেবার পর সেখানে যাবার রাস্তা আর কেই বা সারাবে!
হাঁপাতে
হাঁপাতে আন্দাজ তিন-চারশো ফুট ওঠার পর চওড়া ঢালু একটা হাঁটা পথ পাওয়া গেল, যে পথে
একসময় ঘোড়ার পিঠে চড়ে সাহেবরা টহলে বেরোতেন৷ এককালে এই রাস্তা হয়তো নুড়ি-পাথরে
ঢাকা ছিল৷ কিন্তু দীর্ঘকালের অযত্নে আজ তা ঘাসে ঢেকে গেছে৷ দু’দিকে উঁচু
উঁচু আদিমগাছের জঙ্গল৷ সূর্যের আলো কোনওদিন হয়তো স্পর্শ করেনি এই অরণ্যকে৷ পাখির
আওয়াজ আর ঝিঁঝিঁপোকার ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই৷ এই যাত্রাপথে আমি কিন্তু রোজেন
ছাড়া আর কোনও মানুষকে দেখতে পাইনি৷ আমার মতো পাগল পর্যটকও নেই কেউ এখানে৷ রোজেন
সঙ্গে না থাকলে নির্ঘাত আমি পথ হারিয়ে ফেলতাম৷ কপালকুণ্ডলা কি আসত আমাকে পথ দেখাতে? কে জানে, তাহলে তো
একটিবারের জন্য হলেও পথ হারিয়ে দেখতে হয়! কিন্তু সেইটুকু সময় কেউ দেয়নি আমায়৷ যে
গল্পের সন্ধানে এসেছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেটা শেষ করতে হবে যে!
সব মিলিয়ে ন’শো ফুট
এভাবে হেঁটে সমুদ্রতল থেকে সাত হাজার তিনশো ফুট উপরে পাহাড়ের একদম শিখরে পৌঁছে
গেলাম৷ এখানে রয়েছে সেই বাংলোটির ধ্বংসাবশেষ। আহা রে! নির্জনে স্ত্রীকে নিয়ে বসে
কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য সাধ করে কোন সাহেব যে এই বাংলো বানিয়েছিলেন কে জানে! আজ
তার জরাজীর্ণ স্মৃতিটুকু পড়ে রয়েছে৷
|
|
নিচে
রোজেনের বাড়িতে রিলায়েন্স আর বিএসএনএল ছাড়া আর কোনও নেটওয়ার্কই কাজ করে না৷ কিন্তু
পর্বতশিখরে উঠে দেখি আমার ভোডাফোন চমত্কার টাওয়ার পাচ্ছে৷ সম্ভবত আলাগাড়া থেকে
ভেসে আসা তথ্যজাল ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার মুঠিফোনকে৷
বাংলোর
ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে যেদিকে তাকাই শুধুই পর্বতমালা! খাদের ধারে দাঁড়িয়ে রোজেন
আমাকে চেনাল দার্জিলিং-ডেলো-কালিম্পং-রিশপ-লোলেগাঁও৷ ভুটান-সিকিমের জনপদও
পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান৷ আলাগাড়ার দিকে দুটি পাহাড় দেখিয়ে বলল, “ওই দুই
পাহাড়ের মাঝে সূর্য উঠলেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাবেন৷ দৃশ্যমানতা ঠিকঠাক থাকলে কখনও
কখনও মাউন্ট এভারেস্টও দেখতে পাওয়া সম্ভব!”
আইফোনে
কম্পাস চালু করে দেখলাম ওটা আমার উত্তর-পশ্চিমদিক হচ্ছে৷ ঠিক উল্টোদিকের যে
পাহাড়টা গতকাল থেকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল, ওটা আছে পূর্বদিকে৷ এখন আমরা ওর
চূড়ার সমান্তরালে এসে গেছি৷ ঠিক ছ’টা নাগাদ তার ফাঁক দিয়ে লাল ছটা নিয়ে
টপ করে উঠে পড়ল একটা গোল বল৷ সুয্যি মামা৷ পেছন ফিরে তাকালাম হাতির পিঠের মতো
দেখতে সেই দুই পাহাড়ের মাঝখানে৷ কই? কোথায় কাঞ্চনজঙ্ঘা? শুধু
পাহাড়ের বেশ কিছুটা ওপরে এক খাবলা মেঘে লালচে রঙ লেগে৷ রোজেনের দিকে চাইলাম৷ রোজেন
ওর ছোট ছোট চোখে কৌতুক নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী, কেমন লাগছে?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, বেশ ভালো
জায়গা৷ তা কাঞ্চনজঙ্ঘা কি আর দেখতে পাবার সম্ভাবনা আছে?”
“কেন? ওই তো! আজ
কুয়াশা রয়েছে৷ না হলে আরও ভালোভাবে দেখতে পেতেন৷”
আমি
হতবুদ্ধি হয়ে বলি, “কোথায়? আমি তো
দেখতে পাচ্ছি না!”
“আরে দাদা, ওই যে
সোনালি চুড়োটা দেখছেন,
ওটাই তো কাঞ্চন!”
হাঁ হয়ে
যাই! আমি এতক্ষণ যেটাকে মেঘ বলে ভুল করছিলাম, সেটাই ‘বরফের
পঞ্চমৈশ্বর্য’ — কাঞ্চনজঙ্ঘা!
মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো,
“কাঞ্চনজঙ্ঘা এত্তো উঁচু? আমি যে ভাবতেই পারছি না!”
রোজেন আমার
অজ্ঞানতায় মজা পায়,
“দাদা আমরা তো মাত্র সাত হাজার ফুট উঁচুতে আছি। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা প্রায় আঠাশ
হাজার ফুট যে!”
|
|
||||
|
|
দেরি না করে
ফটাফট যতগুলো সম্ভব ফটো আর ভিডিও নিয়ে নিলাম৷ তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপটি করে
দাঁড়িয়ে থেকে সেই স্বর্গীয় সৃষ্টিকে উপভোগ করতে লাগলাম৷ কে যেন বলেছিল, ট্রাভেলার
আর ট্যুরিস্টের মধ্যে বেশ কয়েকটি ফারাক আছে। তার মধ্যে অন্যতম হল, ট্যুরিস্ট
ঘরে ফেরে আর ট্রাভেলারের সে তাড়া থাকে না৷ পাহাড়ের দিব্যি বলছি, আমি
ট্রাভেলার হতে চাই!
একগুচ্ছ
মুগ্ধতাকে সঙ্গী করে আবার ঢালু পথে নেমে এলাম ন’শো ফুট নিচে, রোজেন
রাইয়ের আস্তানায়৷ গল্পটা এবার লিখে ফেলতে হবে৷
কাঞ্চনজঙ্ঘা, সেদিন যেমন দেখেছি (ভিডিও)
_____
ছবি
ও ভিডিওঃ লেখক
লেখক
পরিচিতিঃ রবীন্দ্রভারতী থেকে স্নাতক। ২১ বছর বয়সে কিশোর ভারতী পত্রিকার সঙ্গে
যুক্ত। সেখানে ‘হরেকরকম’ বিভাগের
পরিচালনা দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে। বেশ কয়েকটি প্রচ্ছদ কাহিনী সহ গল্প লেখা। সন্দেশ, প্রতিদিন, রাজপথ, কিশোর জ্ঞান
বিজ্ঞান সহ বেশ কয়েকটি কিশোর পত্রিকাতে লেখালিখি। পরবর্তীকালে কাজের সূত্রে
দিল্লিতে প্রবাস যাপন। তারপর পুনে, মুম্বই, পাটনা ঘুরে
ফের কলকাতা ফিরে আসা। বর্তমানে একটি সর্বভারতীয় প্রথম শ্রেনীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। সফটওয়্যার সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত। দীর্ঘ পনের বছর পর
আবার অল্প কিছুদিন হল ফেসবুকে ফের লেখালিখির শুরু।
No comments:
Post a Comment