আমার ছেলেবেলা - কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়


আমার ছেলেবেলা
কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়

আমার ছোটবেলা থেকে কিশোরবেলা কেটেছে উত্তর চব্বিশ পরগনার শ্যামনগরে এক কলোনিয়াল কালচারের মধ্যে। আমরা থাকতাম মূলজোড় জেনারেটিং স্টেশন রেসিডেন্সিয়াল কম্পাউন্ডেকলোনিয়াল কালচার আর পাঁচটা পাড়া-সংস্কৃতি থেকে একটু আলাদা। তার প্রধান কারণ, এখানে কারোর নিজস্ব বাড়ি নেই, বংশ পরম্পরায় কেউ থাকেন নাসবাই চাকরিসূত্রে কোয়াটার্সে থাকতে আসেন, আবার চলে যান।
তবে কলোনিয়াল কালচার বলছি বটে, কিন্তু একদম গঙ্গার ধারে বিশাল এক কম্পাউন্ডের মধ্যে ব্রিটিশদের তৈরি বাংলো, লন টেনিস কোর্ট থেকে আরম্ভ করে সুইমিং পুল সব থাকলেও, সময়ের প্রবাহে কলোনিয়াল কালচারের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির একটা মিশেল হয়েছিল। সেই আবহেই কেটেছে আমার ছেলেবেলা। তাই ছেলেবেলায় আমরা ক্রিসমাস ট্রি আর সান্তাক্লজ সাজিয়ে যেরকম আনন্দ পেতাম, সেরকমই আনন্দ পেতাম ঝুলন পূর্ণিমায় পুতুল দিয়ে সাজাতে।
একবছরের প্রি-প্রাইমারি স্কুল বাদ দিয়ে আমি দুটো স্কুলে পড়েছি। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত ব্যারাকপুর সেন্ট জেভিয়ার্সে (এই স্কুলটা এখন আর অবশ্য নেই) তারপরে ইচ্ছাপুর নর্থল্যান্ড হাই স্কুলে। আমাদের ছিল যৌথ পরিবার। দাদু, ঠাকুমা, কাকা, পিসি সবাই মিলে বাড়িটা গমগম করত। মামার বাড়িও ছিল যৌথ পরিবার। তিন মামা আর মা একমাত্র বোন। মাকে নিয়ে মামার বাড়িতে তাই খুব আহ্লাদ ছিল।
বাড়ি, স্কুল, কোয়াটার্স, মামার বাড়ি সব মিলিয়ে স্মৃতির কোলাজ থেকে কিছু টুকরো টুকরো ঘটনা বলি।

আমার তিন কাকা সবাই শিবপুর বি.. কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন। হস্টেলে থাকতেন। শনিবার বাড়িতে আসতেন। সোমবার সকালে আবার ফিরে যেতেন। আমার বড়কাকা বাড়ি আসার সময় শিয়ালদা স্টেশন থেকে আমার জন্য ইন্দ্রজাল কমিকস কিনে আনতেন। তখন ইন্দ্রজাল কমিকস মানে বেতাল আর ম্যানড্রেক। যখন ছোটকাকা বি.. কলেজে ভর্তি হয়নি, হায়ার সেকেন্ডারি পড়ছে তখন শনিবার ছোটকাকা ওঁত পেতে থাকত কখন বড়কাকা ইন্দ্রজাল কমিকসটা নিয়ে আসবে। হাতে পেলেই নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে যেত না হয় নিজের প্র্যাকটিকাল খাতার মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে পড়ত। জানতে পারলেই আমি চিলচিৎকার জুড়তাম। কিছুদিন পর বড়কাকা আমেরিকা চলে গেলেন। ছোটকাকা বি.. কলেজে ভর্তি হল। তারপর থেকে কিন্তু ছোটকাকাই আমাকে ইন্দ্রজাল কমিকস এনে দিত যখন পঁচিশ তিরিশটা কমিকস হয়ে যেত, বাঁধিয়ে নিতাম। সময়ের সঙ্গে সে-সব যে কোথায় হারিয়ে গিয়েছে
কাকাদের কাছ থেকে আরও কয়েকটা নেশা পেয়েছিলাম। তার একটা ছিল দেশবিদেশের ডাকটিকিট জমানো। বড়কাকার কাছ থেকে ছোটকাকা ডাকটিকিটের অ্যালবামটা পেয়েছিল। একটা দুর্লভ ডাকটিকিট ছোটকাকা আমাকে ছুঁতে দিত না। তার পেছনে অদ্ভুত একটা ইতিহাস ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অল্প কিছুদিনের জন্য কিছু দেশের জন্ম হয়েছিল, তারপরে তাদের দ্রুত পতনও হয়ে গিয়েছিল মধ্যের সেই স্বাধীন সময়টায় তারা নিজেদের ডাকটিকিট ছাপিয়ে ওঠার ব্যবস্থা না করতে পেরে ডেনমার্কের ডাকটিকিট কিনে নিজেদের স্ট্যাম্প লাগিয়ে নিত। সেরকমই একটা ডাকটিকিট ছিল ছোটকাকার কাছে। পরে অবশ্য হস্টেলে যাওয়ার সময় পুরো অ্যালবামটাই দিয়ে গিয়েছিল আমাকে। বড়কাকা আমেরিকা থেকে চিঠি পাঠানোর সময় সবসময় নিত্যনতুন ডাকটিকিট খামে লাগিয়ে পাঠাত। আর এই নেশাটা খুব প্রশ্রয় দিতেন আমার ছোটপিসেমশাই। নাগপুরে থাকতেন। আমার জন্য প্রচুর ফার্স্ট-ডে কভার কিনে পাঠাতেন।

আমরা দুই ভাই। ভাই আমার থেকে ছ‘বছরের ছোট। আমি খুব ছোটবেলা থেকে সরোদ শিখতাম। ভাই সেতার। আমাদের গুরু শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় বাবা আলাউদ্দীন খাঁ সাহেবের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন। খুব যত্ন করে কড়া অনুশাসনে আমাদের শেখাতেন। বছরে একটামাত্র রাগ বা রাগিণী সেটা নববর্ষের দিন পেতাম। যেমন প্রথম বছর সরগম রেওয়াজ করে দ্বিতীয় বছর পেয়েছিলাম সব শুদ্ধ পর্দার রাগ বিলাবল। তার পরের বছর শুদ্ধ মা‘টা কড়ির মা হল, ইমন পেলামএইভাবে শিখতামপড়াশোনা আর বাজনার চর্চাকে মা সমান গুরুত্ব দিত। আমাদের আরেক গুরু ছিলেন পণ্ডিত কালাচাঁদ লাহিড়ী আমরা লাহিড়ীকাকু বলতাম  বড়ো বড়ো শিল্পীদের সঙ্গে ওনার দারুণ যোগাযোগ ছিল কলকাতায় পণ্ডিত রবিশঙ্কর বা আলী আকবর খাঁ সাহেব এলে যেখানে থাকতেন আমাদের নিয়ে গিয়ে প্রণাম করিয়ে আনতেন, একদম সামনে বসিয়ে ডোভারলেনের মতো কনফারেন্স শুনিয়ে আনতেন অবশ্য সারারাত্রির কনফারেন্স দেখতে গেলে ভোরের দিকে চোখ ঢুলে আসত
ভাইকে আমি সবচেয়ে সমঝে চলতাম। কারণ, আমার যাবতীয় দুষ্কর্ম আলোর গতিতে মায়ের কানে পৌঁছে দিতে ওর জুড়ি ছিল নাএকটা উদাহরণ দিই। এত গুণীজনের সান্নিধ্য পেয়েও ওই কম বয়সে ঘন্টার পর ঘন্টা একই বন্দিশ রেওয়াজ করতে আর কতক্ষণ ভালো লাগে? কোনদিন হয়ত দেখলাম মা স্নান করতে গিয়েছে, খুব আস্তে আস্তে হয়ত সরোদে দুকলি হিন্দি গান বাজানোর চেষ্টা করলাম। ব্যস, ওমনি ভাই সেতার ফেলে ধাঁই করে দৌড়ে গিয়ে বাথরুমের দরজা পিটিয়ে মাকে নালিশ করতে আরম্ভ করল, ‘মা, দাদা হিন্দি গান বাজাচ্ছে।

ডিসেম্বর মাসটা ছিল বছরের মধ্যে সবচেয়ে স্পেশালআমাদের স্কুলের সেশন ছিল জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর। অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরনোর বাঁধা দিন ছিল ২৪শে ডিসেম্বর। বছরের সবচেয়ে টেনশনের দিন। আর তারপর নতুন ক্লাস শুরু হত জানুয়ারির ১০ তারিখ নাগাদ। তখন বুকলিস্ট পাওয়া যেত। তাই মধ্যের ওই সময়টা দেদার মজা করার জন্য একেবারে ছুটি। ইডেনে ক্রিকেট থাকলে একটা দিন হয়ত বাবা বা কাকাদের সঙ্গে খেলা দেখতে যেতাম। শীতকালে পার্ক সার্কাস ময়দানে একদিন সার্কাস দেখতে আসা বাঁধা ছিল। তখন তিন-চারদিন ধরে যাত্রা হত। আমাদের দেখার মতো যাত্রা হলে বড়োদের সঙ্গে যেতাম।
আগেই বলেছি আমাদের কম্পাউন্ডটা ছিল বিশাল, তবে শ্যামনগরের মূল জনজীবন থেকে একটু বিচ্ছিন্নঅল্প কয়েকটা পরিবার মিলেমিশে এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলির মতো থাকত। ছোটদের জন্য প্রচুর খেলার জায়গা ছাড়া ছিল দারুণ বাগান, গঙ্গার ধারে ওয়াক-ওয়েডিসেম্বরে ডালিয়া থেকে আরম্ভ করে নানান রঙের মরশুমি ফুলে ভরে থাকত। তার মধ্যে একটা জলের মধ্যে ফোয়ারা আমাদের বিশেষ প্রিয় ছিল। আমরা নাম দিয়েছিলাম ফিস পন্ডওখানে আমরা ছিপ দিয়ে মাছ ধরতাম। ছোট ছোট মাছ। তবে একটা কড়া নিয়ম ছিল। মাছ ধরার পরই বঁড়শি থেকে ছাড়িয়ে সেটা জলে ছেড়ে দিতে হত। তাছাড়া বাগানে আসত প্রচুর প্রজাপতি আর ফড়িং। ফুলে বসলেই চুপিচুপি গিয়ে ধরতে হত। নিয়ম ছিল সেই একটাই। ধরেই ছেড়ে দিতে হবে।

বাবার এক সহকর্মী ছিলেন, নরেন্দ্রনাথ বাগচী। আমরা বাগচীকাকু বলতাম। উনি আমাদের নিয়ে খুব হুল্লোড় করতেন। তার মধ্যে শীতকালে আর নববর্ষে নাটক করা ছিল বাঁধা। আমাদের পরীক্ষার পর রিহার্সাল আরম্ভ হত আর স্টেজ হত ক্রিসমাসের সময় আর পয়লা বৈশাখেবাগচীকাকুর নাটক নির্বাচনটা অভিনব ছিল। আমাদের কোনও টেক্সট বই থেকে নাটকটা বাছা হতআর নাটকের দিন মজার মজার কান্ড হত। পাট ভুলে যাওয়া তো ছিলই, আরও সব মজার ব্যাপার-স্যাপার হত। যেমন, একবার একটা খোঁড়ার চরিত্র ছিল। আমাদের মধ্যেই একজন চরিত্রটা করছেলম্বা সিন। অভিনেতা বন্ধু এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে তার পা‘টা ধরে গিয়ে গোটানো পা‘টা নামিয়ে অন্য পা‘টা তুলে নিল। অডিয়েন্সে তুমুল হাসির রোল। তার কিন্তু কোনও হুঁশ নেই।
       আরেকবার আরেকটা নাটকে দুটো দৃশ্য। প্রথম দৃশ্যে কম বয়স আর দ্বিতীয় দৃশ্যে বেশি বয়স। দুটো দৃশ্যের মধ্যে মেকআপ করার সময়টা গানের একটা ফিলার ছিল। তা, যে কাকিমা মেকআপ করাচ্ছিলেন তিনিও নাটক দেখতে এসেছেন। এবার ওই বিরতির সময় বয়স্কর মেকআপ করাতে গিয়ে দেখলেন ভুল করে ফ্ল্যাটের চাবিটা ভেতরে রেখে দরজাটা লক করে দিয়েছেন। সে মহা বিপত্তি। মিস্ত্রী না পেলে দরজা খোলা যাবে না। আমাদের এক বন্ধু মুশকিল আসান করতে দৌড়ে ওর বাড়ি গিয়ে একটা পাউডারের কৌটো নিয়ে এসে চুল সাদা করতে সবার মাথায় গুচ্ছ গুচ্ছ পাউডার ঢেলে দিল। সবাই একেবারে সাদা ভূত হয়ে গেল

শ্যামনগরে দুটো বিখ্যাত ক্লাব হল যুগের প্রতীক আর সবুজ সংঘ। কেষ্ট মিত্র থেকে অশোকলাল ব্যানার্জ্জী, সুব্রত ভট্টাচার্য অনেক বড়ো বড়ো ফুবল প্লেয়াররা শ্যামনগরের। মোহনবাগানের একসময়ের গোলকিপার সুমিত মুখার্জ্জী তো আমার ক্লাসমেট ছিল। প্রত্যেকবার শীতকালে সবুজ সংঘর সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান একটা প্রীতি ম্যাচ খেলতে শ্যামনগরে আসত। প্লেয়ারদের ভিড় থেকে একটু আলাদা রাখতে খেলার দিন ওদের আমাদের কম্পাউন্ডের মধ্যে নিয়ে এসে রাখা হত। আমাদের তখন স্কুলের বন্ধুরা হিংসে করত। অত কাছ থেকে বড়ো বড়ো প্লেয়ারদের দেখার সুযোগ পাচ্ছি, হ্যান্ডসেক করে আসছি
আমার কাকা একবার আমাকে একটা খাতা দিয়ে বলেছিল অটোগ্রাফ নিয়ে রাখতেআমি সেইমতো ঘুরে ঘুরে বেশ কয়েকজনের অটোগ্রাফ নিলাম। পরে বাবাকে যখন অটোগ্রাফের খাতাটা দেখালাম, বাবা কারোর সই-ই চিনতে পারলেন না। সেদিন রাত্রিবেলায় অশোকলাল ব্যানার্জ্জী আমাদের বাড়িতে এসেছেন উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে ধন্যবাদ দিতে। আমি ওঁকে খাতাটা দেখিয়ে বললাম, ‘কাকু, এগুলো কাদের সই একটু বলে দাও তো। কাল স্কুলে বন্ধুদের বলতে হবে।
অশোককাকু কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে খাতাটার পাতাগুলো উল্টে উল্টে দেখলেন তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন। ওগুলো সব সাপোর্ট স্টাফদের সই ছিল। একজনও প্লেয়ারের সই ছিল না। পরে অবশ্য অশোককাকু আমাকে একখাতা ভর্তি আসল সই এনে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে আমার হিরো সুরজিৎ সেনগুপ্তর সইটাও ছিল।

বাবা বা বাবার সহকর্মীরা যারা ওই কম্পাউন্ডে ছিলেন, তারা সবাই জীবনের বেশ কয়েকটা বছর ইংল্যান্ডে বা জার্মানিতে কাটিয়েছিলেন। সেই সুবাদে প্রত্যেকের বাড়িতে কিছু না কিছু খুব চিত্তাকর্ষক বিদেশি জিনিস থাকত। যেমন, একজন কাকুর বাড়িতে ছিল একটা আট মিলিমিটার ফিল্মের প্রজেক্টর। রিল ছিল মাত্র তিনটে। একটা চার্লি চ্যাপলিন, একটা লরেল হার্ডি আরেকটা ওয়ার উলফের। প্রত্যেকটা ফিল্মই সাইলেন্ট, সাত-আট মিনিটের। শনিবার আমরা সেগুলো দেখার খুব বায়না করতাম। ধুতি দিয়ে স্ক্রি টাঙাতাম। বাবার দেখা ফিল্মগুলো তবু যতবার দেখতাম একই রকম মজা বা ভয় পেতাম।
সেরকমই বাবার কাছে ছিল একটা স্পুল রেকর্ডার। সেটা নিয়ে যে কত এক্সপেরিমেন্ট করেছি। পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ইংল্যান্ডে একসঙ্গে দুবছর ছিলেন। ওনার কত এক্সক্লুসিভ সরোদের রেকর্ড করা স্পুল যে ছোটবেলায় না বুঝে নষ্ট করেছি, এখন ভাবলে ভীষণ আপসোস হয়। পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত ম্যাট্রিক পরীক্ষায় সেকেন্ড এবং ইঞ্জিনিয়ারিং-এ টপার হয়েছিলেন।

আমাদের বাড়িতে সবার বই পড়ার খুব নেশা ছিল। ঠাকুমার এক অসাধারণ প্রতিভা ছিল মনে রাখার। রামায়ণ, মহাভারত থেকে চাঁদের পাহাড় সব ঠাকুমার মুখে শুনেছি। ছোটবেলায় আমার জন্মদিনে সবচেয়ে বেশি উপহার পেয়েছি বই। ইন্দ্রজাল কমিকসের পর আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল চাঁদমামা। আরেকটু বড়ো হয়ে শুকতারা। বাঁটুল দ্য গ্রেট থেকে শুকতারার সব পাতা চেটেপুটে পড়তাম। এত ব্যালান্সড একটা ছোটদের পত্রিকা! সুধীন্দ্রনাথ রাহা নানান রকম বিদেশি গল্পের অনুবাদ করে ছোট ছোট গল্প লিখতেন। অসাধারণ সব ছোট গল্প ছাড়া শিকারের গল্প, ভূতের গল্প থাকত। অনবদ্য ধারাবাহিক থাকত। মধ্যের পাতায় হাঁদা ভোঁদা। আর শেষের পাতায় দারুণ দারুণ ধাঁধা। আর থাকত সাহিত্য প্রতিযোগিতা। কতবার ভেবেছি গল্প লিখে প্রাইজ পাব। কিন্তু শেষপর্যন্ত আর লিখে ওঠার সাহসে কুলোয়নি।
মা ছোটবেলায় মৌচাক বলে একটা ছোটদের পত্রিকা নিত। মামার বাড়িতে মায়ের বইয়ের আলমারিতে বইগুলো ছিল। মামারবাড়ি গেলেই পড়তামআমাদের বাড়িতে দেশ আর রিডার্স ডাইজেস্ট নিয়মিত নেওয়া হত। আনন্দমেলা একটা সময়ে সাইজে ছোট বেরোত। সেটাই ছিল আমার রিডার্স ডাইজেস্ট। রয় কমিক্সটা দারুণ লাগত। সন্দেশ মাঝে মাঝে কিনতাম, বিশেষ করে সত্যজিত রায়ের লেখা থাকলে।
 দেশে একপাতা অরণ্যদেব বেরোত। দেশের ওইটুকু পড়াই অনুমতি ছিল আমার। মায়ের একটা প্যাশন ছিল দেশের ধারাবাহিকগুলো কেটে বাঁধিয়ে রাখা। ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা, যাও পাখি থেকে আরম্ভ করে রাগ-অনুরাগ অনেক বই এভাবে আমাদের বাড়িতে বাঁধানো আছে। আমিও মায়ের সঙ্গে বসে অরণ্যদেবের পাতাগুলো কেটে পুরনো খাতায় আঠা দিয়ে আটকে বই তৈরি করতাম। দেশে আমার লেখা ধারাবাহিক ‘আয় ঘুম যখন শেষ হল, এক রবিবার দুপুরে পাতাগুলো একা একা বসে কাটতে মায়ের জন্য ভীষণ মনখারাপ করেছিল।
আরেকটু বড়ো বয়সে কিশোর ভারতী পড়তে শুরু করেছিলাম। শারদীয়ায় ময়ূখ চৌধুরীর কমিক্স পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। একটা কমিক্স এখনও মনে আছে, ব্ল্যাক ডায়মন্ড। আর ঘোর লেগে গিয়েছিল দুরন্ত ঈগল পড়ে।
পুজোর আগে দাদু-ঠাকুমার কাছ থেকে একটা বই পেতামই। সেটা হল দেব সাহিত্য কুটির থেকে হার্ড বাউন্ড যে বইগুলো পুজোর আগে বেরোত। যেমন, আগমনী। ছোট ছোট দারুণ গল্প বেরোত। শারদীয়া আনন্দমেলা আর কিশোর ভারতী কাকারা কিনে দিত। প্রফেসর শঙ্কু আমার কাছে ফেলুদার চেয়েও প্রিয়। আনন্দমেলায় প্রফেসর শঙ্কু বেরোত। দেশে ফেলুদা। দেশের বাকি বড়োদের গল্পগুলোয় যাতে চোখ বোলাতে না পারি, তাই মা বাকি পাতাগুলো স্টেপল করে দেশটা পড়তে দিত। শারদীয়া দেশ হাতে নিয়ে পড়তে বেশ বড়ো বড়ো ভাব হত। 

আমাদের দুটো ফ্যামিলি সিক্রেট আছে, যেটা আজও জানতে পারিনি। এক, তুবড়ির মশলা মেশানোর ফরমুলা আর দুই, ঘুড়ির মাঞ্জা দেওয়ার ফরমুলা। বাবা আর ছোটকাকা কালীপুজোর আগে ফরমুলা মাফিক মশলা মিশিয়ে বসন্ত তুবড়ি বানাত কম্পিটিশনের জন্য। খোলায় ঠেসে ঠেসে মশলা পুরে বুড়ো আঙুলের ডগায় ফোস্কা পড়ে যেত। আর বিশ্বকর্মা পুজোর আগে ঘুড়ির সুতোতে ছোটকাকার ফরমুলায় তৈরি মাঞ্জা লাগাতে লাগাতে আঙুল ফালাফালা হয়ে যেত।

ছোটবেলায় শীতকালে আরেকটা ভীষণ আকর্ষণ ছিল, মূলাজোড়ের পৌষমেলা। মায়ের সঙ্গে মেলা হয়তো দুএকদিন যেতাম। বরাদ্দ ছিল একটা করে জিনিস কেনার। কিন্তু দাদু-ঠাকুমার সঙ্গে যেদিন যেতাম বায়না করে হাবজি-গাবজি একগাদা জিনিস কিনে আনতাম। আর ছিল ১৯ পয়সা টিকিটের কিছু বিশেষ শো একটা মাত্র খেলা, মাটিতে বসে দেখতে হত। সেগুলোতে অবশ্য কাকারা নিয়ে যেত। একবার সেরকম একটা শোয়ে গিয়ে দেখলাম ভয়ংকর এক ম্যাজিশিয়ান। জং ধরা একটা তরোয়াল বার করে দর্শকদের মধ্যে থেকে একজনকে ডাকলেন, ফালা ফালা করে কাটবেন বলে। কেউ আর উঠে যায় না। শেষকালে ম্যাজিশিয়ান বললেন, কেউ না এলে নিজেই একজনকে ধরে নিয়ে আসবেন। তারপর ম্যাজিশিয়ান স্টেজ থেকে নেমে এলেন। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তো, ম্যাজিশিয়ান দর্শকদের মধ্যে থেকে একজনকে কলার ধরে হিড়হিড় করে স্টেজে নিয়ে গেলেন। তারপর গোটা স্টেজ অন্ধকার, আর্ত চিৎকার, ম্যাজিশিয়ানের অট্টহাসি। তারপর আলো যখন জ্বলল গোটা স্টেজ ভর্তি রক্ত, মুণ্ডু, কাটা হাত পা ছড়িয়ে আছে সবাই পালিয়ে বাঁচল। কয়েকদিন পরে আরেকবার মেলায় গিয়ে দেখলাম, সেই লোকটাই ১৯ পয়সার টিকিট বিক্রি করছে।

আমাদের দেশের বাড়ি বর্ধমান জেলায়, রামচন্দ্রপুর গ্রামে। দাদু-ঠাকুমা মাঝেমাঝে গিয়ে ওখানে থাকতেন। তখন আমরাও দুএকদিনের জন্য যেতাম। ওখানে সাইকেল নিয়ে গ্রামের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতাটা খুব উপভোগ করতাম। আমাদের যে চাষের জমি ছিল সেখানে চাষীরা নিয়ে যেত। তবে গ্রামের বাইরে আরেকটা জায়গা আমার খুব পছন্দের ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তৈরি একটা এমারজেন্সি রানওয়ে। পতিত হয়েও অনেকদিন রানওয়েটা ছিল। ওখানে বাবার কোলে বসে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ প্রথম হাত দিয়েছি। 

আমার মামার বাড়ি বাঁকুড়ার সোনামুখীতে। সবচেয়ে বড়োনাতি ছিলাম বলে দিদিমা অসম্ভব ভালোবাসতেন। মামার বাড়িও যৌথ পরিবার। আমার এক মামাতো ভাই প্রায় আমার সমবয়সী। তার সঙ্গে সাইকেলে সোনামুখী চষে বেড়াতাম। সোনামুখীতে আমার দাদুর অনেক ব্যবসার মধ্যে ছিল একটা সিনেমা হল, বিজয়া টকিজ। সেখানে প্রোজেকশন রুমে যাওয়ায় দারুণ উত্তেজনা ছিল। অবশ্য বড়োদের অর্থাৎ ‘এ মার্কা সিনেমা হলে, সিনেমা হলের ধারে কাছে যেত দিত না মামারা। দাদু নিয়ম করেছিলেন, পেছনের একটা রোয়ের টিকিট হাউসফুল হলেও বিক্রি করা হত না। ওটা বাড়ির লোকেদের জন্য বরাদ্দ ছিল। ওখানে গিয়ে বসলেই হাফ টাইমের পর শালপাতায় গরম রসগোল্লা পাঠিয়ে দিতেন হলের ম্যানেজার। কতবার যে আমি আর আমার মামাতো ভাই সময় হিসেব করে ঠিক হাফ টাইমের সময় গিয়েছি শুধু ওই রসগোল্লা খাওয়ার জন্য। খাওয়া হয়ে গেলেই আবার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়া।
 সেরকমই আমার বাবার মামারবাড়ি পুরুলিয়ায়। সেখানেও মাঝেমাঝে যেতাম। ছোট বয়স থেকেই বুঝতে পারতাম বর্ধমান, পুরুলিয়ায় আর বাঁকুড়ার গ্রামের ভাষা আর সংস্কৃতিতে তফাত কোথায়। আমার মেজকাকা খড়্গপুর আই.আই.টি.-র প্রফেসর ছিলেন। বাবা আই.আই.টি.-র সেকেন্ড ব্যাচের এম.টেক.তাই খড়্গপুরে যাওয়ার বাবার কাছে ডবল আকর্ষণ ছিল। আই.আই.টি.-র ক্যাম্পাসে ঘুরতেও ছোটবেলায় দারুণ লাগত।

বাবার আরেকটা নেশা ছিল, সুযোগ আর ছুটিছাটা পেলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া। বাবার অ্যাম্বাসাডারটা নিয়ে বাবা কোথায় না গিয়েছে। পুরী, বেনারস থেকে আরও দূরে দূরে অখ্যাত সব জায়গাউইক-এন্ডে অনেক সময় বেরিয়ে পড়ার পর ঠিক হত কোথায় যাওয়া হবেআমার একটা ক্লিক থ্রি ক্যামেরা ছিল। একটা রিলে বারোটা ছবি উঠত। বছরে দুটো রিল বরাদ্দ ছিল। বেড়াতে গেলে খুব হিসেব করে ছবি তুলতাম।

আইস পাইস থেকে ক্যারাম বোর্ড, দু‘হাত ছেড়ে সাইকেল চালানো থেকে সুইমিং পুলের ডাইভিং বোর্ড থেকে লাফিয়ে বা মামার বাড়িতে পুকুরে সাঁতার কাটা, টেনিস খেলে কব্জি ফুলিয়ে বা ডিউস বলে গোড়ালি ফুলিয়ে চুন হলুদ লাগানো, গানবাজনা, নাটক, বেড়ানো হৈ হৈ করে কেটেছে ছোটবেলাটা। জীবনটা এখন একদম বদলে গেছে। আজকের শহরের চাকরির ব্যস্ত জীবন, সাংসারিক কর্তব্য, লেখালিখির দায়বদ্ধতা সব সামলিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার আগে যদি কখনও ছেলেবেলাটা ভাবি, আমার ঠাকুমার প্রায়ই বলা একটা কথা কানের কাছে ভেসে ওঠে - সে তো আজ হল কতকাল, তবু যেন মনে হয় সেদিন সকাল।
_____

4 comments:

  1. খুব সুন্দর।

    ReplyDelete
  2. অনেক মিল আছে আমার ছেলেবেলার সঙ্গে। স্মৃতিভারাক্রান্ত হয়ে পডলুম।

    ReplyDelete
  3. ছেলেবেলা থাকে বলেই বোধহয় বড়বেলাটাকে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়...

    ReplyDelete