ভ্রমণ:: টো টো কাহিনি (দ্বিতীয় পর্ব) - তাপস মৌলিক


টো টো কাহিনি
(দ্বিতীয় পর্ব)
তাপস মৌলিক

তিরিশ বছর আগের কথা। কলেজে পড়ি, হোস্টেলে থাকি। পড়াশুনো তো ঘন্টা করি! খালি আড্ডা, সিনেমা আর দু’দিন ছুটি পেলেই ক’জন বন্ধু মিলে যেখানে সেখানে বেরিয়ে পড়া, ঘুরতে। কিন্তু ঘুরব যে, পকেট তো ঢু ঢু! প্রধান ভরসা তাই এগারো নম্বর, শোওয়ার জন্য হট্টমন্দির খুঁজি, খাওয়ার জন্য ‘যত্রতত্র’ নামের কোনও হোটেল। সদ্য লায়েক হয়েছি, দুনিয়ার কাউক্কে পরোয়া করি না, যদি কেউ উলটো গায় তো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই তখন ভাবতাম হুজুগ, নেশা। এখন বুঝি, নিজেদের অজান্তেই কখন যেন কলেজ ছাড়িয়ে আদি ও অকৃত্রিম এই পৃথিবীর পাঠশালার ছাত্র হয়ে গেছিলাম
গত সংখ্যায় বলেছিলাম পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে পৌঁছনোর গল্প। পৌঁছে তো গেলাম, তারপর কী হল? সে গল্প নয় আরেকদিন হবে, আজ অন্য গল্প বলি...

আউসগ্রাম

       “বর্ধমান জেলায় জঙ্গল? বলিস কী? তোদের বাড়ির পেছনের কলাবাগানটার কথা বলছিস?” শঙ্কর বলল।
       “যা জানিস না তাই নিয়ে কথা বলিস না। বর্ধমান জেলা তুই কতটুকু দেখেছিস? বল্লভপুরের অভয়ারণ্য জঙ্গল হতে পারে, ইলমবাজারের ওই কয়েকটা গাছ জঙ্গল হতে পারে, আর আউসগ্রাম জঙ্গল নয়? আলবাত জঙ্গল, বেশ ঘন জঙ্গল,” ভাস্কর ঠকাস করে চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে বলল।
       “বাঘ ভালুক আছে নাকি সেখানে?”
       “বাঘ ভালুক থাকলেই কি জঙ্গল হল নাকি? তাহলে তো চিড়িয়াখানাও জঙ্গল! জঙ্গল হয় গাছ দিয়ে।”
       “তাহলে তো যেতে হয় একদিন। এত বড়ো জঙ্গল যখন!”
       “চল, আজকেই চল, এক্ষুনিজঙ্গল কাকে বলে দেখিয়ে দিচ্ছি।”
       “এখন? আউসগ্রামটা কোথায়?”
       “বর্ধমান থেকে মাত্র চল্লিশ কিলোমিটার, গুসকরা হয়ে যেতে হয়। যাবি তো চল।”
       “এখন তো সন্ধে হয়ে গেছে। যাবি কী করে?”
       “ওই ত্তো! হয়ে গেল! যেই বললাম চল দেখিয়ে দিচ্ছি অমনি অজুহাত আরম্ভ হয়ে গেল। মুখে বড়ো বড়ো কথা, আর কাজের বেলা বড়ো বড়ো অজুহাত। সন্ধে হয়েছে তো কী হয়েছে? সন্ধেবেলা কি লোকজন রাস্তায় বেরোয় না?”

       ভাস্করকে বর্ধমান নিয়ে কিছু বলা যাবে না। বর্ধমানের ছেলে বলে কথা! শুধু এক বর্ধমান জেলাই নাকি বাঙালিকে খাইয়ে পরিয়ে রেখেছে। চাষবাসে সেরা, খনিজ সম্পদে সেরা, শিল্পে সেরা, শিক্ষায় সেরা। সে সব হয়তো মানা যায়, তাই বলে জঙ্গল? আর, বর্ধমান সব কিছুতে সেরা হতে পারে, তাই বলে ভাস্করের পেছনে লাগা যাবে না তা তো হয় না!
       শনিবার কলেজ বেলা একটা পর্যন্ত। তারপর হোস্টেলে ফিরে, খেয়েদেয়ে, দুপুরে একটা ভাতঘুম দিয়ে, বিকেলে একটু ঘুরেফিরে তরুণদার চায়ের দোকানে এসে বসেছি। চা আর আড্ডার তোড়ে সন্ধে হয়ে গেছে
       শঙ্কর বলল, “অজুহাত কেন হবে? প্র্যাক্টিকাল-ইমপ্র্যাক্টিকাল বলে একটা ব্যাপার আছে তো! হুট বলতে বেরিয়ে পড়লেই হয় নাকি?”
       “অফ কোর্স হয়। এর মধ্যে ইমপ্র্যাক্টিকালের কী আছে? তুই কি তিব্বত যাবি নাকি? কাল রোববার। কলেজ কামাইয়ের অজুহাতটাও দিতে পারবি না। কাল রাতের মধ্যে ফিরলেই তো হল। ধক্ নেই তাই বল।”
       “শোন শোন, ওসব ধক্-টক্ আমায় শোনাস না। যেতে হয় চল। দেখি কত বড়ো জঙ্গল আছে তোর বর্ধমানে। চল, হোস্টেলে ফিরে গিয়েই বেরিয়ে পড়ব।”
       “আবার হোস্টেলে ফিরব কেন? তুই কি সাজুগুজু করে জঙ্গলে যাবি নাকি? কে দেখবে তোকে ওখানে?”
       “আরে পয়সাকড়ি কিছু নিতে হবে তো! নাকি পুরো ট্রিপটা তুই স্পনসর করছিস?”
       “আবার অজুহাত! আউসগ্রামে পয়সাকড়ি কোন কাজে লাগবে? ওখানে বিরিয়ানি-মাংসও পাবি না, চিকেন-স্টুও পাবি না। খরচা করবি কোথায়? পকেটে যা আছে তাই এনাফ।”
       “ট্রেনে টিকিট কাটতে হবে না? আউসগ্রামে থাকবি কোথায়?”
       “ট্রেনের টিকিটের ভার আমার। আর আউসগ্রামে ফরেস্ট বাংলো আছে।”

       ভাস্কর আর শঙ্করের এই তরজা অবিরাম চলবে। সেটা পুরোপুরি লিপিবদ্ধ করতে হলে অন্যকিছু বলার চান্সই পাব না। তাই তরজাটা একটু মিউট করে গল্পটা ফাস্ট-ফরওয়ার্ড করে নিই
       তর্কে যা সাব্যস্ত হল, বর্ধমানে জঙ্গল আছে কি নেই, আউসগ্রামটা আদৌ জঙ্গল কি না, সেটা আজই এখুনি গিয়ে দেখা ভীষণ দরকার। নইলে জঙ্গল যদি পালিয়ে যায়? তরুণদার চায়ের দোকানটা শিবপুরে আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসের সামনেই। দোকান থেকে বেরিয়ে তিনজন সটান একটা হাওড়ার বাসে উঠে পড়লাম – শঙ্কর, ভাস্কর আর আমি। হাওড়া পৌঁছে দেখি একটা বর্ধমান লোকাল ছাড়ব ছাড়ব করছে। উঠে পড়লাম সেটায়।
       ভাস্কর সঙ্গে থাকলে ট্রেনের টিকিটের চিন্তা আমরা করি না। তার ওপর বর্ধমান যাচ্ছি, ভাস্কর যেখানে শাহেনশা।
একবার নাকি ওকে টিকিট চেকার টিকিট দেখাতে বলেছিলেন ভাস্কর গম্ভীরভাবে উত্তর দিয়েছিল, “টিকিট নেই।”
চেকার বললেন, “টিকিট কাটোনি কেন?”
“পয়সা নেই।”
“ফাইন দিতে হবে।”
“পয়সা থাকলে তো টিকিটই কাটতাম, সস্তা পড়ত ফাইন দেব কোত্থেকে?”
“ফাজলামি হচ্ছে? জেলে পুরে দেব।”
ভাস্কর সটান দাঁড়িয়ে উঠে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বলে, “চলুন।”
“কোথায়?”
“জেলে নিয়ে যাবেন বললেন!”
“ডেঁপো ছোঁড়া কোথাকার! নামবে কোথায় তুমি?”
“বর্ধমান।”
“ঠিক আছে, বর্ধমান আসুক, দেখছি।”
চেকার ভদ্রলোক তো চলে গেলেন। বর্ধমান এসে গেল, তাও তাঁর দেখা নেই। ভাস্কর স্টেশনে নামল, এদিক ওদিক দেখল, কোথাও তাঁর পাত্তা নেই। শেষে খুঁজতে খুঁজতে দেখে গার্ডের কামরায় গার্ডসাহেব আর টিটিই ভদ্রলোক একসঙ্গে বসে চা খাচ্ছেন।
“এই যে দাদা, আপনি এখানে বসে দিব্যি চা খাচ্ছেন? আর আমি কখন থেকে আপনাকে গরুখোঁজা খুঁজে যাচ্ছি!”
“কী ব্যাপার?”
“বাঃ, এর মধ্যে ভুলে গেলেন? টিকিট কাটিনি বলে বললেন না জেলে নিয়ে যাবেন!”
“ও, তুমি সেই। যাও এখন বিরক্ত কোরো না।”
“বা রে! গেট দিয়ে বেরোব কী করে? টিকিট নেই তো! আপনি তাহলে পার করে দিন।”
শেষমেশ সেই চেকার ভদ্রলোকই ভাস্করকে সঙ্গে করে স্টেশনের গেট পার করিয়ে দেন।

বর্ধমান অবধি নির্ঝঞ্ঝাটেই পৌঁছে গেলাম। স্টেশনে যখন নামলাম তখন রাত সাড়ে দশটা নেমেই দেখি উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে কী এক এক্সপ্রেস ট্রেন দাঁড়িয়ে। একটা কামরার সামনে একজন টিটিই দাঁড়িয়ে আছেন কিছু লোক তাঁকে ঘিরে তদবির করছে। ভাস্কর গিয়ে তাঁকে জিগ্যেস করল, “দাদা, এই ট্রেন কি গুসকরা দাঁড়াবে?” ভদ্রলোক হ্যাঁ বলায় তাড়াতাড়ি কামরাটায় উঠতে যাচ্ছিলাম, ভাস্কর হাঁ হাঁ করে উঠল। বেশ চেঁচিয়েই বলল, “আরে বুদ্ধু, এটায় না, পাশেরটায় ওঠ। এটায় তো ওই টিটিই ভদ্রলোক উঠবেন।” পাশের কামরায় উঠলাম। ভেতরে বেশ ফাঁকা ফাঁকা। বসার জায়গার খোঁজে খুপরিগুলো দেখতে দেখতে এগোচ্ছি, ফের ভাস্করের গলা, “এখনই বসে পড়িস না কোথাও, ওদিকের দরজায় দাঁড়াই চল।” কারণটা একটু পরেই বুঝলাম। টিটিই ভদ্রলোক নিশ্চয়ই কিছু সন্দেহ করেছিলেন ট্রেন ছাড়ার সিগন্যাল হতে আমাদের কামরাতেই এসে উঠলেন। ভাস্করের ইশারায় আমরাও টুক করে নেমে তার পরের কামরায় উঠে পড়লাম। ট্রেন তখন ছেড়ে দিয়েছে দুই পাশাপাশি কামরার মধ্যে যাতায়াতের জন্য কোনও ভেস্টিবিউল নেই, পরের স্টেশনই গুসকরা, তাই আর চিন্তা নেই কোনও।
গুসকরায় পৌঁছলাম রাত প্রায় সাড়ে এগারোটায়। সেপ্টেম্বরের শেষ। গরম কমে গেছে, বরং একটু শিরশিরে হাওয়া দিচ্ছে। স্টেশনে আমরা ছাড়া আর কাউকে নামতে দেখলাম না। প্ল্যাটফর্মে এক চা-ওয়ালা ছাড়া আর কোনও জনপ্রাণীও চোখে পড়ল না। ভাস্কর বলল, “চল, আগে চা খাই।”
চা খেতে খেতে শঙ্কর জিগ্যেস করল, “এরপর? এখান থেকে আউসগ্রাম যায় কী করে? বাস আছে?”
ভাস্কর বলল, “তা আছে, তবে সে কাল সকালে। এখন এই সাড়ে এগারোটার সময় বাস কোথায় পাবি?”
“রাতটা কি তবে এই স্টেশনেই কাটাতে হবে? এই জন্য বলেছিলাম এরকমভাবে দুম করে বেরোনোর কোনও মানে হয় না।”
“স্টেশনে কাটাব কেন? বললাম তো আউসগ্রামে ফরেস্ট বাংলো আছে। এখান থেকে আউসগ্রাম আট-ন’কিলোমিটার মাত্র। হাঁটলে বড়জোর দেড় ঘন্টা লাগবে। এখানে সকাল অবধি কাঠের বেঞ্চে শুয়ে থাকার চেয়ে দেড় ঘন্টা হেঁটে ফরেস্ট বাংলোর সাদা নরম বিছানা বেটার নয় কি?”
সেটা তো অবশ্যই ভালো। তার ওপর ভাগ্যে থাকলে কিছু খাবারদাবারও জুটে যেতে পারে ফরেস্ট বাংলোয়। রাতে কিছু খাওয়া হয়নি কারও। তাই ঠিক হল, মিছিমিছি সময় নষ্ট না করে হাঁটা দেওয়া যাক।

স্টেশন ছেড়ে রাস্তায় নেমে মিনিট দশেক হাঁটতেই গুসকরার ঘরবাড়ি শেষ হয়ে দু’পাশে ফাঁকা ধানক্ষেত শুরু হল। আজ মনে হয় অমাবস্যা বা কাছাকাছি। চারদিকে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে কালো পিচের রাস্তাটা মিশে গিয়ে মনে হচ্ছে কেমন যেন আমরা মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছি। পথে লোকজনের কোনও প্রশ্নই নেই, অসম্ভব চুপচাপ সব। রাস্তার পাশে মাঝেসাঝে দু’একটা গাছ আর কিছু ঝোপঝাড় ছাড়া চারদিক বেশ ফাঁকা ফাঁকা, তাই ঝিঁঝিঁর ডাক-টাকও নেই। আমাদের তিনজনের মুখ বন্ধ করে একটানা হেঁটে চলার আওয়াজ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই।
শঙ্কর বলল, “এই অন্ধকারে এভাবে হেঁটে যাচ্ছি, জায়গাটা সেফ তো?”
ভাস্কর বলল, “এককালে এই আউসগ্রামের রাস্তা ঠগিদের জন্য বিখ্যাত ছিল। সিউড়ি কিম্বা উত্তরের দিকে যারা এই পথ ধরে দলবেঁধে হেঁটে যেত, ঠগিরা ভোলেভালা পথিকের মতো প্রথমে তাদের সঙ্গে মিশে যেত। তারপর জায়গা আর সুযোগ বুঝে সবাইকে মেরে জিনিসপত্র লুটে নিয়ে কবর দিয়ে দিত। ঠগিরা খুন করত অদ্ভুতভাবে। একটা বড়ো রুমাল কিম্বা গামছার এককোণে একটা ভারী ঢিল বাঁধা থাকত। পেছন থেকে কায়দা করে এমনভাবে গামছার ঢিলবাঁধা প্রান্তটা ছুঁড়ত যে সেটা গলায় পেঁচিয়ে যেত, তারপর অন্যপ্রান্ত ধরে একটা হ্যাঁচকা টানেই মৃত্যু। মরার আগে লোকটা কিছু বুঝতে পর্যন্ত পারত না।”
“সে তো সেই ইংরেজ আমলের কথা। ঠগিরা এখন আর কোথায়! ডাকাত-টাকাত আছে নাকি?”
“ঠগিরা নেই, কিন্তু তাদের বংশধরেরা আছে। তাদের খুন করার কায়দাটাও অদ্ভুত, অনেক আধুনিক।”
“কীরকম?”
“এদের টার্গেট হচ্ছে মোটরবাইক বা স্কুটার। এই গুসকরা সিউড়ি এসব অঞ্চলে লোকের প্রাইভেট গাড়ি-টাড়ি বিশেষ নেই। যাদের একটু পয়সা আছে, ব্যবসায়ী কিম্বা আড়তদাররা, তারা মোটরবাইক বা স্কুটার চড়ে। এই আধুনিক ঠগিরা করে কী, সন্ধের পর রাস্তার দু’পাশের দুটো বড়ো গাছের মাঝে একটা সরু গুনো তার টান করে বেঁধে রাখে। অন্ধকারে সেই তার কারও চোখেই পড়বে না। যে লোকটা জোরে বাইক চালিয়ে আসছে তার পক্ষে তো ওই তার দেখা একদম অসম্ভব ব্যাপার। তারের হাইটটা থাকে বাইকচালকের গলা বরাবর। বাইক স্পিডের মাথায় চলে যায়, চালকের মুন্ডুটা কুচ করে কেটে গিয়ে পড়ে থাকে পেছনে। কিছুক্ষণ বাইকটা ওই গলাকাটা লোকটাকে নিয়েই চলতে থাকে, ভেবে দ্যাখ দৃশ্যটা কেমন হবে। তারপর বাইক টাল খেয়ে পড়ে গেলে ডাকাতগুলো এসে লুটপাট করে। টাকাপয়সা চলে যায় পকেটে, বাইকটা যায় পানাগড়ের সেকেন্ডহ্যান্ড মার্কেটে। সেজন্য সন্ধের পর এ রাস্তায় কেউ খুব একটা আসে না, গাড়িঘোড়া চলে না, বাসও বন্ধ থাকে।”
“বাঃ, বেশ ভালো রাস্তাতেই নিয়ে এসেছিস দেখছি! এই রাত্তিরবেলা এই রাস্তায় আসার দরকারটা কী ছিল তাহলে?”
“বোঝো! কথা তো ছিল জঙ্গল দেখাবার। রাস্তা ভালো হতে হবে, দু’পাশে বড়ো বড়ো দোকানপাট, আলো, হোটেল থাকতে হবে, সেসব কথা তো হয়নি! এখানে এইরকমই ব্যবস্থা, জোর যার মুলুক তার। জঙ্গলরাজ কথাটা তো আর এমনি এমনি হয়নি। তাছাড়া আমরা যাচ্ছি হেঁটে, বাইকে নয়। পকেটেও কিছু নেই। ডাকাতরা লোক চেনে। খামোখা পরিশ্রম করার বান্দা ওরা নয়।”
রাস্তাটা একেবারে সোজা নাক বরাবর এগিয়ে চলেছিল। এইসময় নিকষ অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ দূরে একটা ক্ষীণ আলো দেখা গেল। কোনও গ্রাম-ট্রাম আছে সামনে? একটু এগোতেই বোঝা গেল, গ্রাম নয়, রাস্তা ধরে আমাদের দিকেই কারা যেন আসছে। আলোটা মনে হল লন্ঠনের।
ভাস্কর বলল, “দাঁড়া, কারা যেন আসছে। একটু গা-ঢাকা দিতে হবে।”
শঙ্কর বলল, “গা-ঢাকা দেব কেন? ডাকাত হলে কি এরকম লন্ঠন জ্বেলে আসবে নাকি?”
আরও একটু এগোতে বোঝা গেল, আসছে কয়েকটা গরুর গাড়ি। তাদের ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ কানে এল। তিন-চারটে গাড়ি হবে বোধহয় প্রতিটার পাটাতনের নিচে একটা করে লন্ঠন ঝুলছে। সওয়ারিদের কথাবার্তার আওয়াজও অস্পষ্ট কানে এল। ভাস্কর বলল, “বেকার ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই, চল ওই ঝোপটার পেছনে গা ঢাকা দিই
রাস্তা থেকে নেমে পাশের কিছু ঝোপঝাড়ের পেছনে উবু হয়ে বসে পড়লাম। রাস্তার ওপর থেকে আর দেখার উপায় নেই আমাদের। গরুর গাড়িগুলো প্রায় কাছেই চলে এসেছিল। দেখলাম ওদের কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল। আগেই বোধহয় লক্ষ করেছিল আমাদেরঝোপগুলোর দিকে খুব সন্দিগ্ধ চোখে তাকাতে তাকাতে পেরিয়ে গেল ওরা। একটু দূরে গিয়ে ফের কথাবার্তা শুরু হল তাদের। ঝোপ থেকে বেরিয়ে আবার রাস্তায় উঠলাম আমরা। ভাস্কর বলল, “আমরা ভাবছি ওরা ডাকাত, ওরা ভাবছে আমরা। কীরকম ভয়ে ভয়ে ক্রস করল দেখলি?”
একঘন্টা প্রায় হাঁটার পর একটা ছোটো পাড়ামতো পড়ল। রাস্তার দু’পাশে কিছু ছোটো ছোটো দোকানপাট। মেইন রাস্তা থেকে নেমে একটা কাঁচা রাস্তা ডানদিকে চলে গেছে বোধহয় কোনও গ্রামের দিকে। আউসগ্রাম চলে এল নাকি? দোকানগুলোর সাইনবোর্ডে যদি জায়গার নাম লেখা থাকে এই ভেবে একটা দোকানের সামনে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু এত অন্ধকার যে কাছে গিয়েও কিছু পড়া গেল না। শেষে একটা দেশলাই জ্বেলে সাইনবোর্ড দেখতে হল। না, আউসগ্রাম এখনও আসেনি। ভাস্কর বলল, “আসার কথাও নয়, ঘন্টাখানেক তো হেঁটেছি সবে।”
আবার হাঁটো। এবারে রাস্তার পাশে কিছু কিছু গাছপালা আরম্ভ হয়েছে। বেশ বড়ো বড়ো লম্বা লম্বা গাছ। অন্ধকারটা তাতে আরও গাঢ় লাগছে। এতক্ষণ হাঁটার ফলে বেশ গরমই লাগছে এখন। জামা ঘামে ভিজে গেছে। জলতেষ্টাও পেয়েছে খুব। কিন্তু জল আর এই অসময়ে পাই কোথায়? ফরেস্ট বাংলোর নরম সাদা বিছানার কথা চিন্তা করতে করতেই ক্ষুধাতৃষ্ণা নিবারণ করতে হচ্ছে।
অবশেষে আউসগ্রামে যখন পৌঁছলাম তখন রাত দু’টো বাজে, চোখের কাছে ঘড়ি নিয়ে এসে দেখতে হল। বেশ বড়ো জায়গা। কাউকে বলে দিতে হল না এটাই আউসগ্রাম। দোকানপাট, ঘরবাড়ি, বাসস্ট্যান্ড দেখেই মালুম হল। ভাস্করের তবু থামার কোনও লক্ষণ নেই। বলল, “এগিয়ে চল। ফরেস্ট বাংলোটা একটু দূরেই, ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে যেতে হবে।”
শঙ্কর বলল, “সেটাই স্বাভাবিক। ফরেস্ট বাংলো জঙ্গলের মধ্যে হয় বলেই শুনেছি, বাজারে নয়। তবে আমরা ফরেস্ট দেখতে এসেছি, বাংলো নয়।”
বলতে বলতেই রাস্তাটা এবার সত্যিই একটা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দু’পাশে লম্বা লম্বা শালগাছের জঙ্গল, ঘন অন্ধকারে ঝুপসি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট পনেরো এগোনোর পর ভাস্কর বলে উঠল, “এসে গেছি। ফরেস্ট বাংলো।”
দেখি রাস্তার বাঁদিকে একটা বিশাল লোহার শিক দেওয়া গেট, গেটের দু’পাশে কাঁটাতারের বেড়া, ভেতরে একটা লাল সুরকির রাস্তা অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেছে। ফরেস্ট বাংলোর ইমারতটা অন্ধকারে চোখে পড়ল না, অনেকটা ভেতরে বোধহয়। গেটের সামনে এসে দেখি শেকল দিয়ে বাঁধা একটা বিশাল তালা তাতে ঝুলছে। শঙ্কর বলল, “সেরেছে, গেট তো তালাবন্ধ! ঢুকব কী করে?”
ভাস্কর বলল, “রাতদুপুরে তোর জন্য গেট খোলা রাখবে নাকি? চৌকিদারকে ডাকতে হবে।”
শুরু হল ডাকাডাকি। ভাস্কর প্রথমে খুব মোলায়েমভাবে ‘কেয়ারটেকারকাকু’ দিয়ে আরম্ভ করল। কোনও সাড়াশব্দ না পাওয়ায় ধীরে ধীরে আমাদের গলা চড়তে লাগল, আর সম্বোধনটাও বদলে যেতে যেতে ‘চৌকিদার ভাইয়া’ হয়ে শেষে ‘আরে এ চৌকিদার, শুনতা নেহি কেয়া’-তে এসে দাঁড়াল।
কিন্তু কোথায় চৌকিদার, কোথায় কী! ভেতরে আদৌ যে ফরেস্ট বাংলোটা আছে সেই নিয়েই আমাদের মনে ঘোরতর সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল। ভাস্কর বলল, “চল, গেটটা টপকাতে হবে।”
টপকানোটা খুব সহজ হল না। গেটটা যথেষ্ট উঁচু। ওপরে আবার খাড়া খাড়া কতগুলো ছুঁচলো শিক লাগানো। সেসব এড়িয়ে এক এক করে তিনজনই ভেতরে লাফিয়ে নামলাম। সুরকির রাস্তাটা ধরে একটু এগোতেই গাছপালার ভেতর বাংলোটা দেখা গেল। কাছে গিয়ে আবার শুরু হল হাঁকাহাঁকি, “চৌকিদার কাঁহা হ্যায়? এ চৌকিদার, দরওয়াজা খোলো।”
এবার একটা ঘরের ভেতর একটা লন্ঠন জ্বলে উঠতে দেখা গেল। কাচের একটা জানালা দিয়ে লন্ঠনের ক্ষীণ আলোটা বাইরে এসে পড়ল। আমরা দ্বিগুণ উৎসাহে ডাকাডাকি আরম্ভ করলাম, “দরওয়াজা খোলো ভাইয়া, বহুৎ ভুখ লগ গিয়া। মুর্গ-মুসল্লম কেয়া হ্যায় জলদি খানা লগা দো।”
কাচের জানালাটা একটু ফাঁক হল, তারপর হঠাৎ আবার দুম করে বন্ধ হয়ে গেল। লন্ঠনের আলোটাও তৎক্ষণাৎ নিভে গেলভাস্কর বলল, “এই মরেচে, এ তো ভয় পেয়ে আবার সব বন্ধ করে দিল রে!”
মরিয়া হয়ে আমরা ফের হাঁকডাক শুরু করলাম, “আরে চৌকিদার ভাইয়া, হমলোগ কলকাত্তা সে আয়ে হ্যায়, শরিফ আদমি হ্যায়। ডরো মৎ, দরওয়াজা খোলো।”
কিছুতেই কিছু হল না আর। বন্ধ জানালা সেই বন্ধই রইল।
শঙ্কর হতাশ হয়ে বলল,      “হায় রে ফরেস্ট বাংলো!
                            ভেতরে তোমার শুভ্র-শীতল বিছানা
                            বাইরে আমরা হতভাগা এই ক’জনা!”
ফরেস্ট বাংলো নিয়ে এরকম অসাধারণ রোমান্টিক কবিতা আমি আর কোনওদিন শুনিনি।
ভাস্কর আশেপাশে একটু ঘুরেফিরে এসে বলল, “একটা গ্যারেজ পাওয়া গেছে। মন্দ নয়, রাতটা কেটে যাবে
বাংলোবাড়িটার একপাশে দেখি একটা গ্যারেজ আছে, সামনেটা খোলা, কোনও শাটার-ফাটার নেই। ঢুকে দেখলাম ভালোই, মেঝেটা পাকা, পরিস্কারই বলা যায়। অগত্যা, এ ছাড়া যখন কিছু করার নেই, গ্যারেজে ঢুকে চপ্পল-টপ্পল খুলে আরাম করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম। একটু পরেই ঘুমে তিনজনের চোখ জুড়িয়ে এল। যার যার চপ্পল বালিশ করে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম, দু’মিনিটে ঘুম।

পরদিন ভোরবেলা পিঁপড়ের কামড়ে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে বসে দেখি গ্যারেজটার মধ্যে অজস্র লাল পিঁপড়ে, আমাদের প্রায় ছেঁকে ধরেছে। গা-হাত-পা পিঁপড়ের কামড়ে লাল হয়ে গেছে। এমনই ঘুমিয়েছি যে তাও কিছু বুঝতে পারিনি। তিনজনে জামাকাপড় থেকে পিঁপড়ে ছাড়াচ্ছি, এমন সময় দেখি একটি ছোটোখাটো লোক লুঙ্গি পরে গায়ে চাদর জড়িয়ে দাঁতন করতে করতে গ্যারেজের সামনে এসে দাঁড়াল। আমাদের দেখেই লোকটা একদম স্ট্যাচু হয়ে গেল, তার দাঁতন করা থেমে গেল। বুঝলাম এই হল সেই চৌকিদার।
আমাদের নরম সাদা বিছানার আপসোসটা রাগ হয়ে লোকটির ওপর ফেটে পড়ল, “খাড়া হো কে কেয়া দেখ রহা হ্যায়? কাল ইতনেবার বুলায়া, দরওয়াজা খোলনে কে লিয়ে বোলা, ফিরভি বাহার নেহি নিকলা। ডরপুক কাঁহাকা। হমলোগ কেয়া ডাকু হ্যায়?”
কালোকোলো লোকটির বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশ হবে। হতভম্ব ভাবটা কেটে যেতে দাঁতন হাতেই হাতজোড় করে বলল, “বাবু, হিন্দি বলতে হবে না, আমি বাঙালি। আমার বাড়ি দুবরাজপুরে। আমার সত্যি ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দেবেন। আপনারা যখন গেটের বাইরে থেকে ডাকাডাকি করছিলেন তখন সত্যি ডাকাতই ভেবেছিলাম। তাই বেরোইনি। তারপর যখন ভেতরে এসে হাঁকডাক করলেন, লন্ঠনটা জ্বেলে ভাবলাম একবার দেখি। আপনারা তো হিন্দিতে মুর্গ-মুসল্লম কীসব বলছিলেন। তাই ভাবলাম অবাঙালি বোধহয়। আসলে, দোষ নেবেন না বাবুরা, এখানে অনেকেই মাঝে মাঝে নেশা-টেশা করে ফুর্তি করতে আসে কিনা, তাই আর দরজা খুলিনি। তারপর সব চুপচাপ হয়ে গেল, ভাবলাম সবাই চলে গেছে। আপনারা যে এভাবে গ্যারেজের ভেতরে শুয়ে থাকবেন – ঈশশ্, ছি ছি ছি!”
কাল রাতে রাষ্ট্রভাষা ব্যবহারের জন্য যারপরনাই লজ্জিত হলাম। মুখে অবশ্য বললাম, “থাক, আর ন্যাকামি করতে হবে না। আবার ক্ষমা চাইছেন! ব্রেকফাস্টে কী পাওয়া যাবে বলো, কাল রাতে কিছু খাওয়া হয়নি, প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে।”
“বাবু, এখানে তো কিছু পাওয়া যায় না। আমাকে কিনে এনে দিলে রান্না করে দিইপয়সা দিলে বাজারও করে আনি। বাজার থেকে ডিম-পাউরুটি কিনে আনব?”
ভাস্কর বলল, “সেরেছে, এখন যাবে বাজারে ডিম-পাউরুটি আনতে! ঠিক আছে, আগে তো চা খাওয়াও, তারপর দেখা যাবে।”
“বাবু, চা-পাতা তো নেই, দুধও নেই। চা-পাতা এনে দিলে র’ চা বানিয়ে দিতে পারি। আসলে কেউ তো তেমন আসে না এখানে!”
“ধুত্তোর, নিকুচি করেছে তোর চা। কিছুই নেই তো ফরেস্ট বাংলোটা সাজিয়ে রেখেছ কেন এখানে? চা না পাওয়া যাক, গরম জল পাওয়া যাবে তো? একটু গরম জলই করে দাও তাহলে, গার্গল করে নিই রাত্রে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল।”
গার্গল করাটা ভাস্করের একটা নেশার মতো। যখন তখন ওর গার্গল করার দরকার হয়। গলার এরকম যত্ন বোধহয় কিশোরকুমারও নিতেন না! যাই হোক, চৌকিদারকে দিয়ে ভাস্কর গরম জলই করিয়ে ছাড়ল। তারপর গার্গল-টার্গল সেরে বলল, “চল, এবার বাজারের দিকে যাইসেখানেই চা-ব্রেকফাস্ট খাওয়া যাবে।”
সকালবেলা ফরেস্ট বাংলোর ভেতরের কম্পাউন্ডটা দেখে একদম চোখ জুড়িয়ে গেল। শুধু গাছ আর গাছ চারদিকে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ভোরের নরম রোদ এসে পড়েছে ঝরাপাতার কার্পেটের ওপর। পাখিদের কনসার্ট বাজছে চারপাশে। আর, বাংলোর গেটের সামনে এসে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। আমরা কিনা কাল রাতে এই বিশাল উঁচু গেটটা টপকে, ওপরের শিক-টিক এড়িয়ে, লাফিয়ে ভেতরে নেমেছি! এখন দেখি গেটের দু’পাশে কাঁটাতারের বেড়াটা বড়জোর ফিট বিশেক করে লম্বা, তারপরে বেমালুম ফাঁকা। গেট না টপকে মাত্র কুড়ি ফিট ঘুরে বেড়ার পাশ দিয়েই অনায়াসে ভেতরে ঢোকা যায়। সেদিক দিয়ে পায়ে চলা পথও আছে একটা। গেটটা শুধু গাড়ি ঢোকার সময় খুলতে হয়, তাও কতদিন খোলা হয় না কে জানে। শেকল আর তালায় প্রায় জং ধরে গেছে। রাতের বেলা অন্ধকারে কিছুই বুঝতে পারিনি। শঙ্কর বলল, “এ তো মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সমাধির মতো ব্যবস্থা!”
“কীরকম?”
“মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সমাধির সামনে একটা বিশাল লোহার গেট আছে শুনেছি তাতে একটা মস্ত তালা ঝুলছে, অথচ চারপাশে কোনও দেওয়াল-টেওয়াল নেই।”

হাঁটতে হাঁটতে ফের আউসগ্রাম বাসস্ট্যান্ডের কাছে এলাম। কাল রাতে এখান দিয়েই হেঁটে গেছি। একটা দোকানে প্রথমে জমিয়ে চা খাওয়া গেল, তারপর পেটভরে কচুরি আর আলুর তরকারি। খেয়েদেয়ে ঢেঁকুর তুলতে তুলতে ভাস্করকে জিগ্যেস করলাম, “এবার কী? ফরেস্ট বাংলোর নরম সাদা বিছানা?”
“এখন এই ফটফটে সকালবেলায় বিছানা কী হবে? জঙ্গল দেখবি না?”
“জঙ্গল তো দেখলাম বাংলোয়। আবার জঙ্গল?”
“দূর, ওটা কি জঙ্গল হল নাকি? এবারে আসল জঙ্গলের ভেতর ঢুকব।”
ভাস্কর আর শঙ্করের জঙ্গল-বিতর্কের পাল্লায় পড়ে বুঝলাম নরম সাদা বিছানার আশা এ যাত্রা ত্যাগ করাই ভালো। হাঁটা দিলাম রাস্তা ধরে। ফরেস্ট বাংলো ছাড়িয়ে এগিয়ে চললাম আরও। রাস্তার দু’পাশে ফের বড়ো বড়ো গাছ শুরু হয়েছে। জঙ্গলই বলা যায়, তবে ঘন জঙ্গল নয়। একজনকে জিগ্যেস করে জানা গেল রাস্তাটা গেছে বন নবগ্রামের দিকে। আউসগ্রাম থেকে বন নবগ্রাম ছ’সাত কিলোমিটার দূর। রাস্তার পাশের জঙ্গল যত ঘন হয়, ভাস্করের উৎসাহ তত বাড়ে।
“কী রে, হয়েছে? বলে বর্ধমান জেলায় আবার জঙ্গল কোথায়! এটা কোনও যেমন-তেমন জঙ্গল নয়, রমনাবাগান ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঞ্চুয়ারির ভেতরে।”
দু’কিলোমিটার মতো এগিয়ে একটা জায়গায় এসে দাঁড়াতে হল। দেখলাম রাস্তার বাঁদিকের জঙ্গলের গাছগুলো কে বা কারা গুঁড়ির একফুট ওপর থেকে বেমালুম কেটে ফেলেছে। যতদূর চোখ যায়, মাইলের পর মাইল শুধু কাটা গাছের গুঁড়ি। দেখতে বীভৎস লাগছিল
“এভাবে গাছগুলো কেটেছে কেন?” জিগ্যেস করলাম ভাস্করকে, “রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতরে এভাবে গাছ কাটা যায় নাকি?”
“সেটাই তো ভাবছি! কোনও ডেভেলাপমেন্ট প্রোগ্রাম আছে নিশ্চয়ই। ডেভেলাপমেন্ট প্রোগ্রাম বলতেই তো মানুষ বোঝে প্রথমেই সমস্ত গাছ কেটে ফেলো।”
শঙ্কর বলল, “আধুনিক ঠগিদের কাজ নয় তো? ওরা তো জানে এখন মোটরবাইক বা তার সওয়ারের চেয়ে এসব গাছের দাম ঢের বেশি। তাই মানুষের গলা কাটা ছেড়ে এখন গাছেদের গলা কাটা ধরেছে।”
“না। ঠগিদের কাজ হলে মাঝে মাঝে একটা-দুটো গাছ কাটা পড়ত, এরকম মাইল কে মাইল একটানা কাটা পড়ত না।”
প্রায় দু’তিন কিলোমিটার রাস্তার বাঁদিকে এই নারকীয় হত্যালীলা দেখতে দেখতে আমরা হাঁটতে থাকলাম। মনটা খুব দমে গেল। যা দেখছি তাতে ক’দিন পরে জঙ্গল সত্যিই ভ্যানিশ হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি এসে ভালোই করেছি।
বন নবগ্রাম পৌঁছনোর আগে একটা কাঁচা রাস্তা বাঁদিকে চলে গেছে সেদিকটা আবার ঘন জঙ্গল। পিচ রাস্তা ছেড়ে নেমে পড়লাম সে রাস্তায়। পাকা রাস্তায় তবু কিছু লোকজন, সাইকেল, বাইকের দেখা পাওয়া গেছিল এই রাস্তা একদম নির্জন। শুধু জঙ্গল আর আমরা। একটু হাঁটার পর ভাস্কর বলল, “রাস্তা ধরে অনেক হাঁটলাম, এবার চল জঙ্গলের ভেতরে ঢুকি।” সবই বড়ো বড়ো গাছ, আন্ডারগ্রোথ খুব কম। তাই হাঁটার কোনও অসুবিধে নেই। কাঁচা রাস্তার ডানদিকে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বীরভূমের মাটির মতো উঁচুনিচু লাল মাটি। প্রচুর পাখি জঙ্গলে। জন্তুজানোয়ার কিছু থাকার কথা নয়, শেয়াল-টেয়াল ছাড়া।
গাছের ছায়ায় ছায়ায় হাঁটতে মন্দ লাগছিল না। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। তার মানে প্রায় ঘন্টা চারেক হেঁটে ফেলেছি। শঙ্কর বলল, “খেয়ালখুশিমতো হেঁটে তো যাচ্ছি, এরপর রাস্তা খুঁজে পাব তো?”
ভাস্কর বলল, “আমরা মোটামুটি একই ডিরেকশনে হাঁটছি, উত্তরদিকে। জঙ্গলটা কতদূর আছে দেখা যাক।”
আরও প্রায় আধঘন্টা হাঁটার পর একটা খালের ধারে এসে পৌঁছলাম। জল দেখেই আমাদের তিনজনের মনে স্নান করার ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। নেমে পড়লাম খালের জলে। কিছুক্ষণ দাপাদাপি করার পর খালের পাড়ে বসে খালি গায়ে জামাকাপড় শুকোচ্ছি, এমনসময় এক বুড়োদাদু এসে উপস্থিত। বোধহয় কাছেই কোনও গ্রামে থাকে, জঙ্গলে কাঠকুটো সংগ্রহে বেরিয়েছে। ভাস্কর দাদুকে জিগ্যেস করল, “দাদু, উত্তরদিকে জঙ্গলটা কদ্দূর গেছে?”
“ওদিকে তো কেবলই জঙ্গল গো! সেই অজয় নদী অবধি চলে গেছে। নদীর ওপারে আবার ইলমবাজারের জঙ্গল। আপনারা যাবেন কোথায়?”
শঙ্কর বলল, “বোঝো! উত্তরদিকে হেঁটে গেলে সেই অজয় নদী অবধি পৌঁছে যেতাম।”
ভাস্কর দাদুকে জিগ্যেস করল, “বাসরাস্তাটা কোনদিকে গেলে পাব?”
“এই খাল ধরে ধরে পশ্চিমদিকে চলে যান, পেয়ে যাবেন।”
খাল ধরে আরও প্রায় আধঘন্টা হাঁটার পরে একটা পিচ রাস্তায় এসে উঠলাম। মসৃণ ঘন কালো পিচের রাস্তা জঙ্গলকে দু’ভাগে চিরে চলে গেছে। রাস্তায় উঠে একটা ভ্যানরিক্সার দেখা মিলল। ভাস্কর তার চালককে জিগ্যেস করল, “ভাই, এই রাস্তাটা কোথায় গেছে?”
“এটা মানকরের রাস্তা। আপনারা কোথায় যাবেন?”
“মানকর যাবার বাস পাওয়া যাবে এখান থেকে?”
“চারটের সময় একটা বাস আছে, মানকর হয়ে পানাগড় অবধি যাবে। ওটাই লাস্ট বাস। এখানে তো বাস দাঁড়ায় না, তবে হাত দেখালে দাঁড়াতে পারে। নইলে আপনারা এই ডানদিকে (মানে উত্তরদিকে) একটু হেঁটে বিষ্টুপুর চলে যান, সেখানে বাসস্ট্যান্ড আছে।”
“বিষ্টুপুর কতদূর এখান থেকে?”
“কত আর? দু’তিন কিলোমিটার হবে।”
“বিষ্টুপুরে হোটেল-ফোটেল আছে? খাবার-দাবার পাওয়া যাবে?”
“হোটেল আছে। তবে এখন কি আর খোলা পাবেন? বেলা হয়ে গেছে।”
আমি আর শঙ্কর ততক্ষণে রাস্তার ওপরেই বসে পড়েছি। ঘড়িতে দেখলাম আড়াইটে বাজে। খিদে পেয়েছে ভালোই, কিন্তু এই দুপুর রোদে ফের দু’তিন কিলোমিটার হাঁটার কোনও ইচ্ছেই আমাদের নেই। ভ্যানওয়ালা চলে গেল। জায়গাটা নিঝুম হয়ে গেল। এ রাস্তায় গাড়িঘোড়া মনে হয় প্রায় চলেই না, তার ওপর এখন ভরদুপুর। ভাস্করও রাস্তায় বসে পড়ে বলল, “ভ্যানওয়ালা ঠিকই বলেছে। এখন আর বিষ্টুপুরে গিয়ে কোনও খাবার দোকান খোলা পাব না। তার চেয়ে পানাগড়ে গিয়ে সন্ধেবেলা খাওয়াদাওয়া করলেই হবে।”
বললাম, “বাসস্ট্যান্ডটা তো আবার বিষ্টুপুরে। বাস এখানে দাঁড়ালে হয়!”
ভাস্কর বলল, “দাঁড়াবে না মানে? হাত দেখালে নিশ্চয়ই দাঁড়াবে।”
“না দাঁড়ালেই হয়েছে! ওটাই তো লাস্ট বাস বলল।”
শঙ্কর বলল, “স্নান-টান করে আমার তো এখন ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমিয়ে নিলে হত। বাস তো সেই চারটের সময়।”
ঘুমে আমারও চোখ জুড়িয়ে আসছে। কাল রাতে গ্যারেজের ভেতর ঘুমটা ঠিক জুতের হয়নি বোঝা যাচ্ছে। রাস্তার পাশে একটা মোটা ছায়াঘন গাছের গুঁড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবছি ওটাতে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে কেমন হয় ভাস্কর বলল, “ঘুমটা আমারও পাচ্ছে। আবার এখন তিনজনেই ঘুমিয়ে পড়লে বাস মিস করার ভালো চান্স আছে। নাকের ডগা দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে বাস চলে যাবে, আর আমরা ঘুম থেকে উঠে দেখব সন্ধে হয়ে গেছে। তার চেয়ে এক কাজ করি চল, রাস্তাটা তো ঝকঝকে পরিস্কার, রাস্তার ওপরই তিনজন পাশাপাশি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আমাদের শুয়ে থাকতে দেখে বাসটা নিশ্চয়ই থামবে, ঘুমটাও ভেঙে যাবে। বাস মিস হবার কোনও চান্স নেই।”
প্রস্তাবটা মন্দ নয়, শুধু বিছানাটা নরম সাদার বদলে শক্ত কালো, এই যা! রাস্তা জুড়ে তিনজন পাশাপাশি শুয়ে পড়লাম। খিদে আর হাঁটার ক্লান্তিতে অবসন্ন শরীরে ঘুমটা এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল, তৎক্ষণাৎ চোখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তিনজনেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
বাসটা নিশ্চয়ই থেমেছিল, নইলে আর এ লেখা লিখছি কী করে?

_______
ছবিঃ লেখক
(এরপর আগামী সংখ্যায়)

10 comments:

  1. মিছিমিছি সময় নষ্ট না করে হাঁটা দেওয়া যাক।এই ফিলোসোফিটা দারুণ।আমিও এই নিয়েই ঘুরে বেড়াই।অসম্ভব ভালো লাগলো এই অভিজ্ঞতাটা পড়তে।দারুণ !!

    ReplyDelete
    Replies
    1. এর মধ্যে পড়া হয়ে গেল? বাঃ। দারুণ। অনেক ধন্যবাদ। :-)

      Delete
    2. আরে ম্যাজিক ল্যাম্প প্রকাশিত হলেই টোটো কাহিনী পড়তে ঝাঁপিয়ে পড়ি :-)

      Delete
  2. আহা বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে যাচ্ছে যে! ধুত্তোর কাজকম্মো। নিকুচি হোক রুটিনের। চল তাপস , ফের একবার--

    ReplyDelete
  3. একেই বোধহয় বলে বোহেমিয়ানা। কিন্তু বোহেমিয়া জায়গাটা কোথায়? সুযোগ পেলে সেখান থেকেই একবার ঘুরে আসি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ দাদা। :-)

      Delete
  4. দুর্দান্ত লিখেছেন| একটি প্রশ্ন ছিল, বর্ধমান স্টেশন থেকেই তো গুসকরার ট্রেন ধরবেন, তাহলে টিটিকে অনুরোধ করে স্টেশনের বাইরে যাবার দরকার পড়ল কেন?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। প্রশ্নের উত্তরে জানাই, ওটা আউসগ্রাম ভ্রমনের আগের ঘটনা, 'একবার নাকি ওকে টিকিট চেকার টিকিট দেখাতে বলেছিলেন...' :-)

      Delete
    2. আচ্ছা, বুঝতে পারলাম| ধন্যবাদ

      Delete