দেবজ্যোতি
ভট্টাচার্য
তামিয়া থেকে ফিরছিলাম। আগের
দু’দিন
দু’রাত
বেজায় বৃষ্টি হয়েছে। ফেরবার দিন সকালেও তার কমতি ছিল না। দুপুর দুপুর হোসঙ্গাবাদের
কাছাকাছি এসে বৃষ্টিটা ধরেছে। বুদনির ঘাটি পেরিয়ে ভোপালের দিকে চলেছি। পথের পাশে
হালকা বনে ছাওয়া মাঠের ভেতর দিয়ে বৃষ্টির জলে সদ্য সতেজ বুদনি ছলছল করে ছুটে
চলেছে। সেইদিকে তাকিয়ে বাঘা আবদেরে গলায় বলল, “বাবা, চান করবে না?”
গম্ভীর গলায় জানালাম, “নো। নতুন
বর্ষার জল। ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”
বাঘা অবশ্য অত সহজে ছেড়ে
দেবার পাত্র নয়। খানিক বাদে ঘোষণা করল, “বাবা, টয়লেট।”
সে ভালো করেই জানে এই আবদারের
কোনও কাটান নেই।
অতএব গাড়ি থামাতে হল। গাড়ি
থেকে নেমে নিতান্ত ভালোমানুষের মতো পথ থেকে সরে সেই মাঠের প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল সে, আর তারপর
হঠাৎ এক ঝটিতি দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে ছিটকে গেল ঝরঝরিয়ে ছুটে যাওয়া বুদনির দিকে। পলকের
মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে আমিও ধেয়ে গেলাম তার পেছন পেছন। তবে সাতে আর পঁয়তাল্লিশে
ফারাক তো কিছুটা থাকেই। অবিলম্বে বুদনির খরস্রোতা, অগভীর জলের ভেতর একটা পাথরের ওপর
আধডোবা হয়ে বসে বিজয়ীর হাসি হাসতে দেখা গেল বাঘাকে।
ভারি রাগ হয়ে গেল আমার। এক ছুটে
তার কাছে পৌঁছে গিয়ে নিচু হয়ে তাকে টেনে তুলতে যাব, তা সে হঠাৎ চিৎকার করে বলল, “বাবা, তোমার
মোবাইল!”
সশঙ্কে জলের দিকে তাকিয়ে
আবিষ্কার করলাম, আমার
সাধের মোবাইল ফোন বুক পকেট থেকে খসে পড়ে জলের ঠেলায় ভেসে যাচ্ছে প্রায় ছ’-সাত ফুট
দূরে। অতএব নিতান্তই নিরুপায় হয়ে জলের বুকে সটান হলাম। বুদনি দয়াময়ী। পরাজয় মানতেই
হাতের মুঠোয় এগিয়ে দিল রহস্য করে ছিনিয়ে নেয়া মোবাইলটিকে। আমি ততক্ষণে ভিজে
চুপ্পুর।
খানিক বাদে বাঘার মাতৃদেবীর
আবির্ভাব। হাতে তোয়ালে। বাঘাকে টেনে তুলে তার গা মোছাতে মোছাতে আক্ষেপবাণী, “হবে না? যেমন বাপ, তেমন তার
ছেলের অভ্যেস বানিয়েছে। জলখ্যাপা। যেখানে সেখানে ঘাটে আঘাটায় — জল দেখলেই
হল! উহ্, আর
পারি না এদের নিয়ে!”
কথাটা অবশ্য তিনি নিতান্ত ভুল
বলেননি। নেশাটা ওকে আমিই ধরিয়েছি। তবে সে গল্প বলবার আগে আমার নিজের নেশা ধরবার
গল্পটা বলে নেওয়া যাক প্রথমে।
নেশাটা প্রথম ধরিয়েছিল ছোড়দি
আর বেলাদি মিলে। তখন আমি বেজায় ছোটো। আমার মাথায়
তারকেশ্বরের মানতের জটা ছিল তখনও। বয়স বোধহয় চার-পাঁচ হবে। সেই সময় আমাদের এলাকায়
বিখ্যাত পুকুর ছিল যামিনী-বুড়োর পুকুর। সার সার পানের লতা বেয়ে ওঠা সুপুরিগাছের
ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে পৌঁছোতে হত সেই পুকুরে। তার বিস্তীর্ণ জল ছিল কালো কাচের
মতো। চারপাশে অনেক গাছের ভিড়। গ্রীষ্মের
দুপুরে সেইখানে আমাকে নিয়ে গিয়ে ছোড়দি আর বেলাদি মিলে সাঁতার শেখাবার চেষ্টা করত
খুব করে। এ-পুকুরের জলের নিচের বালি-মেশা মাটি হালকা নতিতে এগিয়ে গিয়েছে সামনে।
ফলে সহজে ডুবে মরবার ভয়টা ছিল না। কেউ কলাগাছের ডুমো ধরে, কেউ বুকের
তলায় মাটি বা পেতলের ফাঁকা কলসি চেপে নিয়ে, আবার উত্তর-আধুনিক কেউ কেউ গাড়ির বাতিল
টায়ার নিয়ে জলে ভেসে ভেসে উদ্দাম হাত-পা ছোড়বার ধুম লাগাত সেখানে।
আমার ভাসবার উপকরণ ছিল বিরাট
একখানা পিঁড়ি। অত বড়ো পিঁড়িতে বাড়ির কে যে বসতেন তা মনে নেই এখন আর, কিন্তু এটা
মনে আছে, আমার
আকারের তুলনায় সেটা ছোটোখাটো চৌকিই ছিল একখানা। তার তলায় দুই প্রান্তে আড়াআড়ি
লাগানো বড়ো বড়ো দু’খানা পায়া জলে ভাসমান অবস্থায় সুন্দর ভারসাম্য জোগাত তাকে। সেই
পিঁড়িতে আমায় উপুড় করে শুইয়ে জলের মধ্যে ঠেলে দেয়া হত। উদ্দেশ্য, তাতে ভাসমান
অবস্থায় আমি জলে হাত-পা ছোড়বার প্রথম পাঠটি নিয়ে নেব। খোলা
আকাশের নিচে হালকা সবজেটে সোঁদা সোঁদা পানার গন্ধভরা জলের মধ্যে দিয়ে পিঁড়ি-নৌকোয়
চেপে সেই যে দিনের পর দিন ভেসে গিয়ে খানিক বাদেই কাত হয়ে জলে উলটে পড়া, নেশাটা আমার
সেই থেকেই লেগে গেছে।
সামাজিক জীব। অতএব আরও অনেক
বাধ্যতামূলক কাজের মতোই নিরুপায় হয়ে রোজ ঝরনা কলে স্নান করে অফিস যাই। কিন্তু ওতে
মন ভরে কই। দিদিদের হাতে সেই যে জলখেলার প্রথম পাঠ নেওয়া, তারপর থেকে
এই আধবুড়ো বয়সে এসেও স্নানযাত্রা চলেছে আমার। খোলা আকাশের নিচে জলাশয় দেখলেই বুকের
ভেতরটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে। হাত-পা আর নিজের বশে থাকে না। শরীর দিয়ে তাকে
ছুঁয়ে না দেখে আমার শান্তি হয় না। সে স্নানযাত্রা আমাকে টেনে নিয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গ–আসাম
সীমান্তের নিতান্তই অচেনা অজানা নদী-বালিকা ধওলা থেকে শুরু করে নম কুলেনের কবাল
স্পিয়ান নামের দেবময় নদীতে।
সুবর্ণরেখার কথাই সবার আগে
বলি। সেবার শেষ বসন্তে ঘাটশিলা গিয়েছি। ঝাড়গ্রামে
ট্রেন বদলে গন্তব্যে পৌঁছে সবকিছু ঠিকঠাক করতে করতে দেখি দুপুর গড়িয়ে গেছে। সব
সেরে-সুরে বেলা তিনটে নাগাদ সুবর্ণরেখায় গিয়ে পৌঁছলাম আমরা ক’জন মিলে। বাপিদা একটু
শীতকাতুরে আছে। জল কতটা ঠাণ্ডা সেটা তার নামবার আগে পরীক্ষা করা চাই। অতএব আগে আগে
এগিয়ে গিয়ে জলে হাত দিয়েই সে বলল, “অ্যাই, এ তো গিজারের জল বলে মনে হচ্ছে!”
নিচু হয়ে হাত দিয়ে দেখি কথাটা
মিথ্যে নয়। দিব্যি কুসুম কুসুম গরম জল! জলের মধ্যে সাবধানে খানিক এগিয়ে গিয়ে
একেকটা জুতমতো ডুবো-পাথর বাগিয়ে তার ওপর চেপে বসা গেল গলা অবধি ডুবিয়ে। আমাদের
পরিশ্রান্ত শরীরের সব ক্লান্তি মুছিয়ে দিল মালভূমির নদীর সেই ঈষদুষ্ণ খনিজসমৃদ্ধ
জল।
সুখের অবশ্য সবে পনেরো কলা
পূরেছে তখন। এক কলা আরও বাকি ছিল। মিনিট দশেক যেতে সেটাও পূরে গেল। মাথার ওপরে
হঠাৎ কোত্থেকে একদল মেঘ এসে জমল, আর তারপর বড়ো বড়ো ফোঁটায় নেমে আসতে শুরু করল বৃষ্টি। এ লেখা
অডিও ভিসুয়াল বস্তু নয়। অতএব নির্জন বনপাহাড়ের বুকে এক নীল রঙের নদীতে দেহ ডুবিয়ে
বসে মাথায় বৃষ্টির জল মাখতে মাখতে, বৃষ্টির ঘায়ে তার ফুটন্ত জলরাশিকে আই
লেভেল থেকে দেখার মজাটা আমি আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারব না।
এই পুণ্যস্নানটি নিঃসন্দেহে
একটা দুষ্প্রাপ্য কোনও তিথিতে ঘটেছিল, বহু বছরের মধ্যে যার ফের আসবার
সম্ভাবনা নেই সম্ভবত। কাজে-কাজেই, ইচ্ছে করলেই টিকেট কেটে ঘাটশিলায় গিয়ে সুবর্ণরেখায় স্নান
তুমি করতেই পার, কিন্তু
সেই ঈষদুষ্ণ ধাতুগন্ধী নীলবর্ণ জলে গলা ডুবিয়ে বসে নদীর জলের গায়ে চোখ ঠেকিয়ে তার
বুকে বৃষ্টি দেখা — উঁহু, সে আর পাবে
না। দুটো কারণে। প্রথমত রাকা মাইনস বন্ধ হয়ে গেছে। গরম জল ছাড়বে কে? আর দ্বিতীয়ত
বৃষ্টি তো আর তোমার কথা শুনে যখনই চাইবে তখনি এসে নামবে না!
অথবা ধরো গিয়ে কংসাবতীর
পুকুরে স্নানের গল্প। নদীর পুকুর শুনে আবার সোনার পাথরবাটির মতো আজগুবি কোনও বস্তু
ভেবে নিও না যেন। ও-নদীতে সত্যিই কখনও কখনও পুকুর গজায়। বলি শোনো।
কংসাবতীর ব্রিজ পেরিয়ে ডাইনে
ঘুরে খানিক এগোলেই সে নদীর পারে দক্ষিণ বেঙাই গ্রাম। সেখানে বিশ্বশুক সেবাশ্রম সংঘ
নামে একটি সংস্থার একটা আশ্রম আছে। স্থানীয় ছেলেদের জন্য একটা স্কুলও চালানো হয়
আশ্রমে। রথযাত্রার দিন ভারি উৎসব হয় সেখানে। ছেলেরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে। তাছাড়া
সারাদিন স্থানীয় গ্রামবাসীদের জন্য লঙ্গরও চালানো হয়।
কয়েক বছর আগে (যে বছর সেই
মেদিনীপুরের আমলাশোলের ক্ষিদের গল্প বের হল কাগজে, সেই বছর) আশ্রমের স্কুলের লাইব্রেরির
জন্য কিছু বই জোগাড় করে নিয়ে গিয়ে উঠেছিলাম সেখানে, রথযাত্রার দিনে। বইপত্র সব মহারাজের
হাতে পৌঁছে দিয়ে নদীর দিকে গেলাম একবার। গিয়ে দেখি সে ভারি মজার চেহারা ধরেছে। শুকনো
নদীর বুকে যেদিকে তাকাই ছোটোবড়ো পুকুর গজিয়ে রয়েছে।
আসলে এমনিতে তো সারা বছর
প্রায় শুকনোই থাকে তার বালি-পাথরে ভরা বুক। তার থেকে ট্রাক ভরে ভরে বালি খুঁড়ে
তুলে নিয়ে যায় ব্যবসায়ীরা। ফলে নদীর শুকনো বুকে ঝোপঝাড়, আগাছা আর
পাথরের বোল্ডারের ফাঁকে ফাঁকে গড়ে ওঠে উলটো পিরামিড আকারের বড়ো বড়ো গর্ত। বর্ষার
শুরুতে প্রথমে
বৃষ্টির জল জমা হয়ে হয়ে এই গর্তগুলো ভরে ওঠে। তারপর একসময় তারা উপচে গিয়ে একে
অন্যের শরীরে জুড়ে গিয়ে গিয়ে নদীর শরীরটা গড়ে তোলে।
তা সে-বছর
বর্ষা তখনও জোরদার হয়ে নামেনি। ফলে রথযাত্রার সময়েও নদী তার পুকুর চেহারাতেই রয়ে
গিয়েছিল। বেড থেকে বেশ খানিকটা উঁচু পাড়ের ওপর
দাঁড়িয়ে নদীর বুকের অনেকখানি জুড়ে ছড়ানো সেইসব পুকুর চোখে পড়ছিল আমাদের। আষাঢ়ের
হঠাৎ পাওয়া মেঘমুক্ত আকাশ তার নীল প্রতিফলন ফেলেছে তাদের বুকে। বালি-পাথরে ভরা
ধূসর নদীবক্ষে যেন ছড়িয়ে রয়েছে খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙে যাওয়া কোনও বিরাট আয়নার একরাশ
টুকরো!
সঙ্গীরা সকলেই উত্তর কলকাতার
লোক। সেখানে একটা পুকুরের খোঁজ পেলেই প্রমোটারে রে রে করে তেড়ে গিয়ে রাবিশ ফেলতে
শুরু করে। সেটাই নিয়ম। এহেন মুল্লুকের লোক হঠাৎ একসঙ্গে এত পুকুর দেখে বলাই
বাহুল্য, মহা
উত্তেজিত হয়ে পড়েছে দেখলাম।
ঈষৎ খাড়াই পাড় বেয়ে নদীর বুকে
নেমে এসে যার যার পছন্দমতো একেকটা ছোটোবড়ো পুকুর বেছে নিয়ে জলে গিয়ে সেঁধোলাম
আমরা। বহুদূরে আশ্রমের থেকে রথের উৎসবের গুঞ্জন ভেসে আসছিল। আকাশে ঝুলে থাকা
সূর্যের প্রখর আলোর নিচে আমার পুকুরটার জলে গলা অবধি ডুবিয়ে বসেছিলাম আমি। হাত-পা
ছুড়ে ছেলেমানুষী করতে একেবারে ইচ্ছে করছিল না। দুপুরবেলার মৃদু হাওয়া আমার
চারপাশের জলে হালকা দোলা দিয়ে যাচ্ছিল মাঝে মাঝে। বালিমেশা জল আমার সারা গায়ে আঙুল
বুলিয়ে ইশারার ভাষায় অনেক কথা বলছিল। সে ভাষার
মানে বুঝতে পারিনি। অবশ্য তাতে কী যায় আসে?
মাঝে মাঝে দূরের কোনও পুকুর
থেকে ভেসে আসছিল কোনও সঙ্গীর হঠাৎ ফূর্তির চিৎকার কিংবা বেসুরো গানের কলি। সব
মিলিয়ে কংসাবতীর বুকে তখন এক জমজমাট আসর বসেছে।
অবশ্য সুখ চিরকাল থাকে না। অচিরেই
দূর থেকে নাম ধরে ধরে আহ্বান শোনা যেতে লাগল। গলা বাড়িয়ে দেখি একজন তরুণ
ব্রহ্মচারী। বকের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে ফেলে এক পুকুর থেকে অন্য পুকুরের ধারে
গিয়ে খুঁজছেন আমাদের,
আর সঙ্গে সঙ্গে হাঁকডাক চলেছে। বড়ো মহারাজ ডেকে পাঠিয়েছেন দুপুরের খাওয়া সেরে
নেবার জন্য। লঙ্গরে ভারি ভিড় হয়েছে নাকি। এরপর গেলে আর কিছু জুটবে না।
মেদিনীপুরে সে-বছর সত্যিই যে
খাবারের বেশ অনটন চলেছে সেকথা টের পেয়েছিলাম সেদিন লঙ্গরের আসরে গিয়ে। দূরদূরান্ত
থেকে মানুষ এসে জড়ো হয়েছে সেখানে পেটভরে দুটি খিচুড়ি আর লাবড়া খাবার
লোভে। মহারাজ জানালেন,
হিসেবের থেকে অন্তত দু’গুণ বেশি লোক চলে এসেছে সেদিন আশ্রমে খাবার জন্য। অনেকে
আবার দেখি সঙ্গে করে কৌটো নিয়ে এসেছে রাতের আহার্যটুকুও সংগ্রহ করে নিয়ে যাবে বলে।
ফেরবার পথে প্রবল বৃষ্টি
নেমেছিল সেদিন। আমাদের গাড়ির চাকা ডুবে গিয়েছিল জলে। বন্ধ কাচের গায়ে আছড়ে পড়া
বৃষ্টিধারা দেখতে দেখতে স্পষ্ট টের পেয়েছিলাম, রাতের অন্ধকারে বৃষ্টির জল খেয়ে উপচে
যাচ্ছে সেইসব পুকুরগুলো,
দেখতে দেখতে একে অন্যের সঙ্গে মিশে গিয়ে জাগিয়ে তুলছে নদীর স্রোতকে। তাদের একক
জলধ্বনিগুলো জুড়ে জুড়ে তৈরি করছে উন্মাদিনীর গর্জনধ্বনি।
এই স্নানটার চেষ্টা করে দেখতে
পার তোমরা। তবে আগেই একটা ডিসক্লেইমার দিয়ে রাখব। মালভূমির নদীর জলের বাড়া-কমা
কিন্তু পাঁজির তিথি মেনে চলে না! যেমন ধরো, ক’বছর আগে রথযাত্রার দিন ফের আশ্রমে
গিয়ে প্রথমেই কংসাবতীর কাছে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি দুকূলনাশিনী মহানন্দে ধাইছে তার
খাত বরাবর। মাথার বেশ অনেকটা ওপরে ঝুঁকে পড়া গাছের ডালে ডালে শুকনো পাতা-লতার
স্তূপ ঝুলছিল। সেইদিকে দেখিয়ে স্থানীয় এক স্নানার্থী জানাল, “ক’দিন আগে
হঠাৎ বান ডেকে নদী একেবারে ভরে গিয়ে হুই ওখান অবধি জল উঠেছিল। এখন
ফের খানিক নেমেছে।”
নদীস্নান হলেও এ-যাত্রা তাই
আর কংসাবতীর পুকুরে স্নান করা হল না আমার। আগামীবার ফের যাব রথের দিনে। দেখা যাক
কপাল খোলে কি না!
বাঘার এই স্নানের নেশাও আমিই
ধরিয়েছিলাম। চার বছর পুরেছে ওর তখন সবে। মাণ্ডলা হয়ে জব্বলপুর ফিরছিলাম আমরা
কানহার জঙ্গল দেখে। মাণ্ডলায় ঢুকে পাহাড়ি জমির গা বেয়ে অনেকটা উঁচু দিয়ে পথ চলল
বসতির গা ঘেঁষে। সেই পথ ধরে খানিক এগিয়ে হঠাৎ নিচের
দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল আমার। পথের একপাশে পায়ের অনেক নিচে বুকের মধ্যে
ছোটো ছোটো ঘাসে ভরা চর নিয়ে বয়ে যাচ্ছে ফিরোজা রঙের নর্মদা। তার পাশে স্নানার্থী
মানুষের ভিড়। একটা সরু সিঁড়িপথ ওপর থেকে সোজা নেমে গেছে নদীর দিকে। তার ওপরে লেখা
রাপ্তাঘাট — নর্মদা
দর্শন। ডিসেম্বরের শেষ চলছে তখন। সময় বেলা সাড়ে ন’টা-মতো হবে। গাড়ি থামিয়ে তার
দরজা খুলতেই একরাশ ঠাণ্ডা হাওয়া ঝাঁপিয়ে এল ভেতরে। ছেলের হাত ধরে আমি চললাম নদী
সন্দর্শনে।
নদীর ধারে দীর্ঘ বাঁধানো ঘাট।
একেবারেই বাহুল্যবর্জিত,
নিরাভরণ। একপাশে কুম্ভীরবাহিনী দেবী নর্মদার মন্দির। শ্বেতবর্ণা চতুর্ভূজা
রক্তাম্বরা দেবী। ভারি গোলগাল মিষ্টি মুখখানি। মন্দিরের সামনে সিঁদুরওয়ালি তার
পসরা সাজিয়ে বসেছে। তার ডালিতে সামান্য কিছু ধূপকাঠি, নকুলদানা আর
গেরিমাটির পাশে সাজানো রয়েছে স্তূপ স্তূপ লাল ও খয়েরি সিঁদুর। দেবীর পুজোর প্রধান
উপকরণ।
সঙ্গে সর্ষের তেল ছিল এক
ডাবা। ঘুরতে গেলে ওটা আমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। তাই থেকে এক খাবলা তেল নিয়ে
মন্দিরের ঠিক মুখোমুখি ঘাটের ধাপে বসে বাপ-ছেলেয় মিলে ডলে ডলে মাখতেই শীত উধাও।
নদীর জল বিশেষ গভীর ছিল না। তবে তীব্র স্রোত ছিল তাতে। সেই সঙ্গে বেজায় ঠাণ্ডা।
জলের নিচের পিচ্ছিল পাথরে সাবধানে ভারসাম্য রেখে দাঁড়াতে হয়। অতশত ঝামেলায় না গিয়ে
তাই ঘাটের রানায় বসেই স্নান সারছেন অধিকাংশ মানুষ। জলের মধ্যে খুব বেশি লোক
নামেনি। সাবধানে জলে হাত ডোবালাম। বরফ-ঠাণ্ডা জলের ছোঁয়ায় সারা শরীরে একটা কাঁপুনি
ছড়িয়ে গেল। সে কাঁপুনির সঙ্গে অন্য শিহরণও মিশে ছিল একটা; এদেশের
প্রাচীন বিশ্বাস হল,
বছরে একবার নাকি কলুষনাশিনী গঙ্গা এসে নর্মদায় ডুব দিয়ে তাঁর সারা বছরের
সঞ্চিত পাপ ও ক্লেদের ভার মোচন করে যান। আর বিজ্ঞানীদের কথা হল, ভারতে
মানুষের আদি আশ্রয়দাত্রী গঙ্গা নন। এই নর্মদার কোলে মধ্য প্লিস্টোসিন যুগে হোমো
ইরেক্টাস মানুষ প্রথম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। সাড়ে চার লক্ষ বছর আগেকার সেই
আদিমানবীর খুলিটি পাওয়া গেছে হোসঙ্গাবাদের কাছে নর্মদার উত্তর পাড়ে হাথনোরা নামের
জায়গায়। সে তুলনায় গঙ্গাপাড়ে মানুষের আনাগোনা তো মাত্রই সেদিনকার ইতিহাস। হাতে করে
সেই পবিত্র জল তুলে মাথায় ঠেকালাম।
খরস্রোতা নদীর সেই ঠাণ্ডা জলে
সেদিন আমার ছেলেটাকে বেশ একটু জোর করেই নামাতে হয়েছিল প্রথমে। কিন্তু খানিক পরেই
যেই ছুটন্ত জলের সঙ্গে খেলবার মজাটা পেয়ে গেল সে তখন তাকে জল থেকে তোলে কার সাধ্য।
জলের তলার পিচ্ছিল পাথরে ছোট্ট শরীরের ভর অক্লেশে রেখে প্রায় গলা অবধি জলে দাঁড়িয়ে
আকাশে দু’হাত তুলে হাস্যরত মুখটা একটা নিটোল ছবি তৈরি করেছিল। শিশুটিকে
কোলে পেয়ে প্রাচীনাটিও নিশ্চয় তৃপ্তই হয়েছিলেন সেদিন। তাঁর ছুটন্ত জলের কল-গুঞ্জনে
সেই খুশির স্পর্শ ছিল।
আরেকবার অমরকন্টকে গিয়ে ঘুরতে
ঘুরতে গিয়ে পড়েছিলাম মধ্যপ্রদেশ আর ছত্তিশগড়ের সঙ্গমস্থলে, অনুপপুর - দিন্দোরি আর
বিলাসপুর এই তিন জেলার মিলন-বিন্দুতে এক প্রাচীন বনস্থলীর মধ্যে দাঁড়ানো ‘কবীর চবুতরা’য়। এই
এলাকার বাসিন্দা পানিকা উপজাতীয় মানুষজনের বিশ্বাস, সন্ত কবীর এই জায়গাটিতেই দীর্ঘকাল
তপস্যা করে সিদ্ধিলাভ করেন। পানিকাদের অধিকাংশই তাঁর মতাবলম্বনে ‘কবীরপন্থী’।
একটা সরু রাস্তা ধরে এগোতে
এগোতে হঠাৎ বাঁক নিতেই সামনে ছড়িয়ে যায় প্রশস্ত বনময় শৈলমালা। তার মধ্যে সাদা রঙে
ছোপানো খোলার চালের ছোট্ট আশ্রমটিতে শ্বেতাম্বর কবীরপন্থী সন্ন্যাসীদের বাস।
মৃদুভাষী, শান্ত
মানুষগুলি। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন একটি কক্ষে রক্ষিত তাঁদের পূজ্যবস্তুটির কাছে।
সন্ত কবীরের স্মৃতিবিজরিত একজোড়া খড়ম। সন্ত কবীর বাস্তবে কোনোদিন সে খড়মজোড়া
ব্যবহার করেছেন কিনা কে জানে! কিন্তু নির্জন অরণ্যময় পর্বতের কন্দরের বাসিন্দা সেই
মৃদুভাষী অনাড়ম্বর সন্ন্যাসীদের গভীর বিশ্বাসের বলে সে খড়মজোড়া পবিত্র হয়ে উঠেছে।
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু...
খড়মজোড়াকে প্রণাম করে বের হয়ে
এলাম বাইরে। আশ্রমের একপাশে একটি ছোট্ট জলাশয়। তাতে মৃদু বুদবুদ উঠে চলে ক্রমাগত।
সঙ্গী সন্ন্যাসী জানালেন,
ইনিও মাতা নর্মদার আরেক অংশ। এখান থেকে বহে গিয়ে ইনিও পুষ্ট করেন তাঁকে। এঁর
জল বড়ো পবিত্র। চোখে লাগালে নাকি সমস্ত চোখের ব্যাধির উপশম হয়।
সে-উৎস থেকে বের হয়ে বয়ে
চলেছে একটা রোগাটে জলধারা। তার অন্যপাড়ে পাহাড় উঠে গিয়েছে অনেকটা উঁচুতে। পাহাড়ের
গায়ের অরণ্যে রঙিন ঝরাপাতার বর্ষণের মতোই ভেসে চলা অগুনতি প্রজাপতির বাহার। সেখানে
এক অতিকায় বটগাছ বাকি অরণ্যটার রাজা। সঙ্গী সন্ন্যাসী জানালেন, ওই বটগাছের নিচেই
নাকি ধ্যানমগ্ন হয়েছিলেন সন্ত কবীর।
পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে তার নিচে
গিয়ে বসলাম। তার পত্রমুকুটের ফাঁক দিয়ে ছুটে আসা অসংখ্য রোদকাঠি এসে বিঁধছিল আমার
শরীরে, আর
আমার চারপাশে। মৃদু শিরশিরে হাওয়ায় আমার দেহ-মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে আর
কতক্ষণ। অচিরেই নিচ থেকে ভেসে এল বাঘার খিলখিল হাসি আর তার উদ্দেশ্যে তার মায়ের
উদ্বিগ্ন শাসন-শাসানি। অজানা পাহাড়ে-অরণ্যে তার স্বাধীনচেতা
দস্যিপনায় তিনি স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন।
নেমে এলাম সেই বটগাছের আশ্রয়
থেকে। পায়ের নিচে জলস্রোত একটা ছোট্ট পাথর-বাঁধানো চত্বরে এসে ধারা হয়ে ঝরে পড়ছে। বাঘাকে
সঙ্গে নিয়ে নেমে দাঁড়ালাম তার নিচে। মৃদু খনিজগন্ধী শীতল জলস্রোত দেবতার স্পর্শের
মতো ছড়িয়ে পড়ল আমাদের দু’জনের শরীরে। সে স্পর্শে জলপ্রপাতের অহংকারী আঘাত নেই। আছে
শুধু সব জুড়োন ছোঁয়া। সেই অনাড়ম্বর স্নানের স্পর্শ আজও স্মৃতিতে লেগে আছে।
অমরকন্টক যদি যাও তাহলে কপিলধারা, দুগ্ধধারা ইত্যাদি প্রপাতদের পাশাপাশি এই জায়গাটিতেও একবার
স্নানে আসতে পার। বেজায় ভালো লাগবে। গ্যারান্টি।
মধ্যপ্রদেশ থেকে ফিরে আসা যাক
বাংলায়। বেশ কিছুকাল আগের কথা। শিলংয়ে চাকরি
করি তখন। সেখান থেকে কলকাতায় ফিরছিলাম গুয়াহাটি হয়ে, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে। তাড়াহুড়োয়
রিজার্ভেশন না পেয়ে জেনারেল কামরায় চেপেই রওনা দিয়েছি। যাত্রার শুরুটা ভালোই হল।
প্রাক-বর্ষার ভ্যাপসা গরম থাকলেও জানালার ধারে সিট পাওয়ায় ফুরফুরে হাওয়া মিলছিল। গাদাগাদি
হয়ে বসে থাকবার কষ্টটা টের পাচ্ছিলাম না।
রাত আড়াইটে নাগাদ কোকরাঝার
স্টেশন ছাড়তে গাড়ির গতি হঠাৎ ঢিমে হয়ে এল। যেখানে
সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে যখন চলে তখন তার গতি শামুকের মতন। কোকরাঝার থেকে
ফকিরাগ্রাম মাত্রই পনেরো মিনিটের পথ। সে রাস্তা পেরোতে সূর্য উঠে গেল। ফকিরাগ্রামে
যখন গাড়ি এসে খুঁটি গেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল তখন একবার ভেবেছিলাম নেমে পড়ে বিলাসিপাড়ায়
ধনমাসিমার বাড়িতে চলে যাই। ট্রেনটা বোধহয় আমার মন পড়তে পারল। যেমন ভাবা, অমনি দেখি
সে আবার গুটি গুটি চলতে শুরু করেছে। খানিক বাদে একটা ছোট্ট অনামা স্টেশনে এসে সেই
যে দাঁড়াল, আর
নড়বার নাম করে না। আকাশ মেঘলা করে ছিল। জেনারেল কামরায় ছুটকো যাত্রীর ভিড়ে, ভ্যাপসা
গরমে তখন আমাদের ওষ্ঠাগত অবস্থা। পাশে বসা ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করে খানিক সময়
কাটানো গেল। ভদ্রলোকের নাম অনুপ বসু। ভূগোলের মাস্টার। আলিপুরদুয়ারের ওদিকে ইশকুলে
পড়ান। ডিব্রুগড়ে মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরছেন। বেজায় ভালোমানুষ লোক। পড়াশোনাও আছে। শুধু
কথা বলতে বড্ড বেশি ভালোবাসেন এই যা দোষ। বাড়িতে সম্ভবত শ্রোতা পান না ভদ্রলোক।
কাজেই গাড়ির কামরায় একজন ক্যাপটিভ শ্রোতা পেয়ে মনের আনন্দে কথার ঝুড়ি খুলে বসেছেন।
খানিক বাদে গল্পের গুঁতো আর
সইতে না পেরে, “দাঁড়ান,
চা খুঁজে আনি” বলে
উঠে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম।
স্টেশনের নাম শ্রীরামপুর।
আদিগন্ত ধানের ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট একফালি স্টেশন। একটি শেডবিহীন
প্ল্যাটফর্ম ও একটা ছোটো টিকিটঘর ছাড়া তার তখনও আর কোনও স্থাবর সম্পত্তি জুটে
ওঠেনি। চারপাশের বাহারী সবুজে চোখ জুড়োয়। দিনে বড়োজোর দুটি বা তিনটি গাড়ি ক্ষণিকের
জন্য সেখানে এসে থামে মাত্র। কাজেই কাঞ্চনজঙ্ঘা হেন দূরপাল্লার গাড়ি যখন
এসে সারাদিনের জন্য তার অতিথি হয় তখন অতিথি সৎকারের জন্য প্রয়োজনীয় জোগাড়যন্ত্র, সহায়সম্বল
তার না থাকবারই কথা।
গার্ডের কাছ থেকে জানা গেল, আগেরদিন চা-বাগানে
কী এক গোল বাধতে উত্তরবঙ্গ জুড়ে সেদিন বারো ঘন্টার বন্ধ ডেকেছে। সন্ধের আগে গাড়ি
নড়বে না। তার মানে হাতে বেশ কয়েকঘন্টা সময়। কামরায় ফেরবার কোনও ইচ্ছেই ছিল না
আমার। ন্যাড়া প্ল্যাটফর্মে খানিক ঘোরাঘুরি করে শেষমেশ রেললাইন ধরে বেশ খানিক এগিয়ে
গিয়ে নিচের দিকে নেমে গেলাম।
এদিকটায় বোধহয় খানিক বৃষ্টি
হয়ে গিয়েছে এর মধ্যে। আশেপাশে অনেক জমির টুকরোতেই ঘন সবুজ বীজতলার বাহার। তারই
ফাঁক দিয়ে দিয়ে কাঁচা রাস্তা চলেছে সরু একটা নাম না জানা নদীর পাশ দিয়ে। চওড়ায় খুব
বেশি নয়। নদী না বলে তাকে নালা বলাই শ্রেয়। উত্তরে ভুটানের অরণ্যঘেরা পর্বতশ্রেণী
থেকে নেমে ডুয়ার্স পেরিয়ে আসামে ঢুকে আসা যে অসংখ্য নামী-অনামী ছোটো বড়ো জলধারা এই
অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে জালের মতো নেমে এসে পুষ্ট করছে ব্রহ্মপুত্রকে, এ তাদেরই
একজন হবে। সেইসব পাহাড়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে ভুটান এবং ভারতের অন্যতম সেরা কিছু
অভয়ারণ্য, যথাক্রমে পশ্চিম থেকে পুবে — মানস, ফিপসু, বক্সা। আমাদের অবস্থান থেকে আন্দাজ
করছিলাম সম্ভবত ফিপসু এলাকার পাহাড়ি অরণ্য থেকে জন্ম নেওয়া কোনও নদীর শাখা হবে সে।
পাহাড়ে বর্ষা এসে যাবার প্রমাণ তার মন্থরগতি ভরাভর্তি শরীরে।
কাছেই ডানদিকে জমি খানিক উঁচু
হয়ে গেছে। নদীটাকে একটু উঁচু থেকে দেখবার জন্য মোড় বেঁকে তার ওপর চড়তে শুরু করেছি
তখন হঠাৎ শুনি পেছন থেকে কে ডাকছে, “ও মশাই, শুনছেন?”
ঘুরে দেখি, আমার
বাক্যবাগীশ সহযাত্রীটি। আমায় দাঁড়াতে দেখে দু’পা এগিয়ে এসে বললেন, “আরে, ওদিকে আবার
চললেন কোথায়?”
“না মানে...”
“আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই! চা আনতে
গিয়ে একেবারে বিলকুল উধাও?
খানিক বাদে প্ল্যাটফর্মে নেমে আর দেখতে পাই না, শেষে নজর করে দেখি মাঠের ওপর আপনার
লাল জামাটা দেখা যাচ্ছে।”
মনে মনে আমার লাল জামাটাকে
অভিশাপ দিয়ে হেসে বললাম,
“আপনার তো সাংঘাতিক চোখ!”
“চোখটা আছে বলে এ-যাত্রা মুশকিলের হাত
থেকে বেঁচে গেলেন মশাই। যেদিকে রওনা দিয়েছেন ওদিকে অন্তত মাইলদুয়েক হাঁটলে তবে
শিমুলতাপু গ্রামের দেখা পেতেন। এই পচা গরমে খালি পেটে অদ্দূর...”
হেসে বললাম, “তা হরিমটর
ছাড়া আজকে আর তো কোনও উপায় দেখছি না। তা সে
স্টেশনেই বসে থাকি কি মাঠেঘাটে হেঁটেই বেড়াই।”
“আরে না না, হরিমটর করে
থাকতে হবে কে বলল? এই
নালার ধার ধরে আর অল্প একটু গেলেই শ্রীরামপুর গ্রাম। একেবারে সামনে। ওখানে গেলে
ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে ঠিক। আসুন, আসুন।”
“আপনি এদিকটা ভালো চেনেন মনে হচ্ছে?”
“হ্যাঁ। পাশেই হাতিদুরাতে একটা ইশকুলে
ছিলাম বছর ছয়েক। এদিককার অন্ধিসন্ধি আমার জানা।”
অতএব তাঁর সঙ্গে চললাম।
অনুপবাবু বাড়িয়ে বলেননি। এ অঞ্চলটা ভালোই চেনা আছে তাঁর। গ্রামে গিয়ে পৌঁছোবার পর
আধঘন্টার মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। পুরোনো এক ছাত্রের বাড়িতে ব্যবস্থা হল। ছেলেটি
সদ্য বিয়ে করেছে। তার গিন্নি, কর্তার মাস্টারমশাইয়ের খাতিরদারীতে ঘাটতি রাখছিল না। তাদের বাড়িতে
উত্তর আর দক্ষিণের ভিটেয় দুটি ঘর। মাটির ভিতের ওপর টিনের চাল দেয়া ছাঁচিবেড়ার ঘর।
উত্তরের ভিটেয় থাকেন ছেলেটির বিধবা মা। দক্ষিণের ভিটেয় সেই নদীটির
একেবারে ধার ঘেঁষে ছেলেটার ঘর। তার বারান্দাতে বসে নদীর জলের ছল ছল শব্দ পাওয়া
যায়। বাড়ি থেকে বের হয়েই তাদের একেবারে নিজস্ব স্নানের ঘাট একটি।
খানিক বাদে অপরিচিতির আড়
ভাঙলে দেখা গেল, বাক্যবাগীশ
সে মেয়েও কম নয়। অনুপবাবুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কথা চলেছে তার। ডিব্রুগড়ে নিজের
মেয়েকে সদ্য ছেড়ে আসা অনুপবাবুও তাকে পেয়ে বেজায় খুশ। আমাকে আর তাঁর প্রয়োজন নেই
তখন। ওদিকে অর্জুন গিয়েছে দোকানে। আমি অতএব একা। তাতে অবশ্য আপত্তি ছিল না আমার।
বাড়ি পেরিয়ে নদী, নদী
পেরিয়ে বিস্তীর্ণ সুতীব্র সবুজ প্রান্তরের ওপর মেঘরৌদ্রের খেলা দেখছিলাম বারান্দার
একটা খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে।
চমক ভাঙল অর্জুন ছাঁচতলায় এসে
দাঁড়াতে। কখন যেন ফিরে এসেছে সে। কাঁধে গামছাটা রেখে হাত বাড়িয়ে লতার কাছে তেল
চাইছে। এখন নদীতে স্নানে যাবে সে। ব্যাগ থেকে গামছাটা বের করে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে
আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম।
দক্ষিণ থেকে ঘন নীল ইস্পাত
রঙের মেঘের দল উঠে এসেছিল সেদিন। নদীর ঘোলা জলে তার ছায়া পড়েছিল। নদীর
তুলতুলে নরম মাটিতে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে বুক জলে গিয়ে দাঁড়িয়ে আঁজলা আঁজলা জল তুলে
প্রথমে ঘেমো শরীরকে ধুয়ে নিয়ে তারপর তার জলে দেহ ভাসিয়েছিলাম। ভালো সাঁতার জানি না
আমি। অচেনা নদী, কিন্তু তার জন্য আমায় একটুও ভয় দেখায়নি সেই প্রথম আলাপের দিনেও। পায়ের
খানিক নিচেই তার মাটির নিশ্চিত আশ্রয় ছিল। আর পাশে ছিল
অর্জুন। তারই ভরসায় খানিক বাদে অগভীর জলের নিরাপদ গণ্ডি ছেড়ে গা ভাসালাম গভীরতর
এলাকার দিকে। আর সময় স্থির হয়ে গেল। ইস্পাতবর্ণ আকাশ থেকে তখন নেমে আসছে
পুষ্পবৃষ্টির মতো মৃদু ইলশেগুঁড়ির ধারা। তাইতে চারদিক ধূসর হয়ে এসেছে। সেই
চরাচরচিহ্নবিহীন ধূসরতার মধ্যে জেগে ছিলাম শুধু আমি, সেই নদী আর অর্জুন নামের তমালতরুর
মতন কালো, ঋজু
এক চাষি।
স্নান করতে করতেই মাঝে মাঝে
টুকটাক দুয়েকটি কথা চলছিল আমাদের। প্রায় দুটি ভিন্নগ্রহের সমভাষাভাষী বাসিন্দার
সুখ-দুঃখের সংবাদ বিনিময়। সে পেশায় কৃষক। ক্লাশ এইট অবধি পড়াশোনা। ছ’বিঘা জমি, একটি হাতজাল
ও একটি নদীর কল্যাণে দুটি মাছভাতের অভাব ঘটে না তার। এদের ভরসাতেই কিছুদিন হল
মা-ব্যাটার সংসার বেড়ে দুই থেকে তিন হয়েছে।
তবে কিনা, সকল সুখেরই
অন্ত আছে। সেই নিয়ম মেনে খানিক বাদেই পাড়ের কাছ থেকে উচ্চকন্ঠের হাঁক এল, “হাঁ রে
অর্জুন, বাড়ির
মেয়েদের চান করতে দিবি,
নাকি সারাদিন পড়ে পড়ে মোষের মতো জল ধামসাবি?”
অমনি অর্জুনের সব ফুর্তি
উধাও। পাড়ের দিকে মুখ করে জবাব দিল সে, “যাই মা।”
আরেকবার ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে
পড়েছিলাম এক বিচিত্র নদীতে। সেখানে বহমান স্বচ্ছ জলধারার তলায় শান্তিতে শুয়ে থাকেন
সহস্রাধিক শিবলিঙ্গ,
শুয়ে থাকেন অনন্তশয়ানে বিষ্ণু ও পদ্মযোনী ব্রহ্মারা। সেখানে নিঃশব্দ দুপুরে
রৌদ্রছায়ার মায়ায় ভরা নদীর ধারের পান্নাসবুজ অরণ্য থেকে নদীর ওপর ভেসে আসে রঙিন
প্রজাপতির ঝাঁক। ছুটন্ত জলে, দেবমূর্তিদের বুকের ওপর ঝাঁপাই খেলে উলঙ্গ শিশুর দল।
জায়গাটা কম্বোডিয়ার মন্দির শহর সিয়েম রিপ থেকে মাত্রই ত্রিশ কিলোমিটার দূরে, বনে ঢাকা
কুলেন পর্বতমালার ওপরে।
এই নদীতে অবগাহনের আগে চলুন
ইতিহাসের পথে দু’পা হাঁটা যাক। প্রায় দুই সহস্রাব্দ আগে, দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ায় হিন্দুধর্মের প্রসারের যুগে কম্বোডিয়াতে হিন্দুধর্মের প্রথম পা রাখা। তারপর ৮০২ সালে সে
দেশের কুলেন পর্বতের শীর্ষে হিরণ্যদাম নামে এক ভারতীয় ব্রাহ্মণ বিরাট এক যজ্ঞ করে
দ্বিতীয় জয়বর্মন নামে এক খেমের রাজাকে রাজচক্রবর্তী উপাধি দিলেন। শুরু হল খেমের
রাজবংশের জয়যাত্রা। নম কুলেনের শীর্ষ থেকে এইভাবেই শুরু হয়েছিল সে-দেশের দীর্ঘ চার
শতাব্দীব্যাপী সুশাসন ও শিল্পস্থাপত্যের স্বর্ণযুগ। নম কুলেনের বেলেপাথরে গড়ে
উঠেছিল আংকোরের অনুপম স্থাপত্যমালা। তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী
পৃথিবীর বৃহত্তম নাগরিক কেন্দ্র যশোধরপুর। কুলেন পর্বতের শরীরেও অন্তত ত্রিশটি
মন্দিরের অবশেষ পাওয়া গেছে।
এই নম কুলেন থেকে বের হয়ে
কাম্বোডিয়ার প্রধান নদী সিয়েম রিপ আংকোর মন্দিরমালার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে টনলে
সাপের হ্রদে গিয়ে মেশে। নম কবাল স্পিয়ান নামে কুলেন পর্বতমালার এক অরণ্যময় পাহাড়ের
বুক থেকে স্তুং কবাল স্পিয়ান নামের এক নদী নেমে এসে সিয়েম রিপের সঙ্গে মিশেছে।
দ্বিতীয় জয়বর্মনের অভিষেকের আড়াইশো বছর পরে তাঁর বংশধর মহারাজ প্রথম সূর্যবর্মনের
এক মন্ত্রী সেই জলধারাটির বুকে এক আশ্চর্য শিল্পসৃষ্টির পরিকল্পনা করলেন। ততদিনে
সিয়েম রিপ নদীর ধারে ধারে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে আংকোরের মন্দিরমালা - প্রেহ কো, বাখেং, কোহ কের, প্রে রূপ, বান্তে
শ্রেই, খেলং-এর
মতো অনুপম মন্দির স্থাপত্যের সব নিদর্শন। মন্দিরনগরী দিয়ে প্রবাহিত হবার আগেই
সিয়েম রিপের জলকে ঈশ্বরসংস্পর্শে পবিত্র করে তোলবার উদ্দেশ্যে তার উপনদী কবাল
স্পিয়ানের বুকে গড়ে তুললেন এক বিচিত্র ভাস্কর্যমালা। রাজাদেশে নদীর ধারাকে
কিছুদিনের জন্য ঘুরিয়ে দেওয়া হল অন্যদিকে। তারপর বেলেপাথরের নদীবক্ষে প্রায় দেড়শো
মিটার এলাকা জুড়ে সহস্রাধিক ছোটো ছোটো শিবলিঙ্গ তক্ষণ করে ফের নদীকে ফিরিয়ে আনা হল
তার পুরোনো পথে। সেই পবিত্র দেবমূর্তিদের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া পুণ্য বারিধারা ঝরনা হয়ে
নেমে যায় সিয়েম রিপের বুকে। নদী পবিত্র হয়। এর পরপরই মহারাজ দ্বিতীয়
উদয়াদিত্যবর্মনের আমলে এই নদীর বুকে গড়ে তোলা হয়, অনন্তশয্যায় বিষ্ণু, পদ্মযোনী
ব্রহ্মাসহ আরও বেশ কিছু জলশায়ী দেবমূর্তি। পৃথিবীতে নদীভাস্কর্যের এমন উদাহরণ আর
দুটি নেই।
তারপর একের পর এক শতাব্দী
কেটে গেল। খেমেরদের গৌরবসূর্য অস্ত গেল। মোঙ্গল, থাই, স্পেনীয়, ভিয়েতনামী, মালয় যে
যেভাবে পারল লুটেপুটে শেষ করে দিল ঐশ্বর্যশালী দেশটাকে। নম কুলেনের
সহস্রলিঙ্গশোভিত নদীভাস্কর্যটির কথা ভুলে গেল সকলে। ১৯৬৮ সালে এসে সেটি ফের
আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু তারপর কিছুদিন যেতে না যেতে ফের বিপদ ঘনাল তার ভাগ্যে। এইবারে
হিংস্র খেমের রুজ (লাল খেমের)-এর ঘাতকবাহিনীর শক্ত আস্তানা হয়ে উঠল নম কুলেন। জলশায়ী
দেবতারা বহু হিংস্রতার সাক্ষী হয়েছেন এই পাহাড়ের বুকে।
একুশ শতকের মানুষ আমি, এক প্রখর
গ্রীষ্মের দুপুরে এসে দাঁড়িয়েছিলাম সেই দেবময় নদীর সামনে। নদীতে তখন জল কম। মাঝে
মাঝে কিছু অগভীর জলকুণ্ড ছাড়া বাকি নদীবক্ষে জলস্রোতের গভীরতা কোথাও পায়ের চেটো
ডোবানো, কোথাও
বা হাঁটুভর। ওপরে ঝুঁকে পড়া অরণ্যের ফাঁক গলে তার সবজেটে বুকে দলা দলা সূর্যের আলো
ছড়িয়ে এক অনুপম আলোছায়ার খেলা গড়ে তুলেছে। সেই আলোতে চলমান জলের নিচে শান্তিতে
শয়ান সেই সহস্র শিবলিঙ্গেরা ছড়িয়ে আছেন জলধারার দু’পাশে যতদূর চোখ চলে। তাঁদের
ঘিরে ঝাঁপাই জুড়েছে ফুলের মতো সুন্দর উলঙ্গ শিশুর দল। তাদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে
আছে চারপাশ। হয়তো ও-ই তাঁদের পূজার মন্ত্র। এই পূজাতেই হয়তো তৃপ্ত হন, জন্মভূমি
থেকে বহুদূরে জলশয়ানে বন্দি ভারতবর্ষের দেবতারা।
যাবার সময় হয়ে আসছিল আমার।
টাকার হিসেবে নিক্তিমাপা ভ্রমণ শেষ হবার মুখে। কিন্তু তাই বলে দেবতার পাশাপাশি
একসঙ্গে এক নদীতে স্নানের সুযোগ আমি ছাড়তে রাজি ছিলাম না। ধীরে ধীরে সাবধানে
তাঁদের গায়ে পাদস্পর্শ এড়িয়ে এগিয়ে গেলাম সেই বনগন্ধী জলধারার বুকে। তারপর একটা
ছোটো কুণ্ডি বেছে শরীর ছড়িয়ে দিলাম তার ভেতরে। শিশুদের ছেটানো জল এসে লাগল আমার
চোখেমুখে। আমার চারপাশে তাঁদের সহস্রাব্দব্যাপী
অবগাহনে মৌন হয়ে রইলেন দেবমূর্তির দল এবং স্বর্গ নেমে এল সেই অরণ্যময় প্রস্রবণগিরিতে।
_____
ছবিঃ সংগৃহীত