বিল্টু
অংশু প্রতিম দে
।।
১ ।।
ব্যাট হাতে ক্রিজে দাঁড়িয়ে
বোলারের রান-আপের দিকে তাকিয়ে মনঃসংযোগ করছে ঋক। দুম করে আউট হয়ে নতুন পাড়ায় ব্যাট
হাতে ওর ক্যারিশমা দেখানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ সে। ঋক জানে, বুড়োদা কোচিং সেন্টারে
যেভাবে শিখিয়েছেন সেটার সফল প্রয়োগ করে দেখাতে পারলে এই পাড়াতেও ওর কদর বেড়ে যাবে।
বেশি দিন হয়নি ওরা নতুন পাড়ায়
এসেছে। এর আগে ঋকদের নিজস্ব বাড়ি ছিল না। ব্যারাকপুর ষ্টেশনের কাছাকাছি ওল্ড
ক্যালকাটা রোডের ওপরে যে স্টেট ব্যাঙ্কের শাখা, তার উলটোদিকের গলিতে একটা বাড়িতে ভাড়া
থাকত। ঋকের বাবা গৌতমবাবু এই নতুন পাড়াতে একটা জমি আগে থেকে কিনে রেখেছিলেন।
জায়গাটা স্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার ভেতরে। এ বছরের
গোড়াতে বাড়ি করায় হাত দিলেন গৌতমবাবু। ওঁর
অক্লান্ত পরিশ্রম আর উদ্যমে ছ’মাসের মধ্যে একতলাটা দাঁড়িয়ে গেল। জুলাইয়ে বাবা, মা,
আর বোন টুসির সঙ্গে নতুন বাড়িতে পদার্পণ ঋকের।
“বাহ! পারফেক্ট কভার ড্রাইভ,”
উইকেটের পেছনে কিপারের পজিশন থেকে পার্থদার সপ্রশংস উক্তি। অফ স্টাম্পের লাইনে বিল্টুর
নিখুঁত লেংথের বলটা মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে ঋক। “তুই বুড়োদার সেন্টারে যাস, তাই
না?”
পার্থদার প্রশ্নের উত্তরে সম্মতিসূচক
মাথা হেলিয়ে ক্রিজে পজিশন নিল ঋক। দীপের হাত থেকে বল নিয়ে রান-আপে দৌড় শুরু করেছে
বিল্টু। নতুন পাড়ায় আসা ইস্তক ঋক ছোটো বড়ো সবার মুখে বিল্টুর প্রশংসা শুনছে। সাঁতারে
বিল্টু পাড়ার এক নম্বর, স্কুল স্পোর্টসে দৌড়ের ফার্স্ট প্রাইজটা বিল্টুর বাঁধা, ক্রিকেট
খেলাতে বিল্টুর অবিশ্বাস্য দক্ষতা, ধুনুচি নাচে পাড়ার পুজোমণ্ডপ বিল্টুই মাত করে রাখে
ইত্যাদি। এত সব কথার মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে কথাটাই
ঋককে সবচেয়ে বেশি টেনেছিল। কী এমন ক্রিকেট খেলে বিল্টু, দেখতে হবে তো!
“তুই একদম সৌরভের স্টাইলে
খেলিস দেখছি,” বিল্টু এগিয়ে এসেছে ঋকের কাছে। ওভারের শেষ দুটো বলেও চার খেয়েছে
ঋকের হাতে। আশপাশ থেকে স্তুতি ভেসে এলেও বিল্টুর কথাটাই ঋকের কানে ঢুকেছে। খুশি
হল সে। যদিও কথাটা নতুন নয়, অনেকবারই শুনেছে সে। বাঁ-হাতি
আর অফের দিকে স্ট্রং বলে বুড়োদার কোচিং সেন্টারে ঋকের নামই হয়ে গেছে সৌরভ।
“খেলতে আসিস না কেন?” দীপের
কথায় ঋক মৃদু হাসল।
“কাল থেকে রোজ আসবি,”
পার্থদার আন্তরিক আহ্বান।
“আসব,” কথাটা বললেও ঋক জানে,
রোজ আসা হবে না। বিকেলে কোনও কোনোদিন ও পড়তে যায়। সিবিএসসি বোর্ডে পড়াশোনার খুব চাপ। ক্লাস সেভেনে
উঠতেই ঋককে দুটো প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে ভর্তি করে দিয়েছেন ওর বাবা। দীপ,
বিল্টুদের অত চাপ নেই। ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের ছাত্র, বাংলা মিডিয়ামে সরকারি স্কুলে
পড়ে। খেলা শেষ করে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে ঋক ভাবছিল, বাবা যদি জানতে পারেন ও বাংলা
মিডিয়ামে পড়া ছেলেগুলোর সঙ্গে সারাটা বিকেল খেলে কাটিয়েছে, ওকে আর আস্ত রাখবেন না।
।।
২ ।।
রাখির দিন সকাল থেকেই বিল্টুর
মনমেজাজ ভালো নেই। ছোটোবেলায় ও মাকে প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে তুলত, “আমার হাতে
রাখি নেই কেন?”
“বন্যার কাছে যা না! রাখি পরে
আসবি।”
বন্যা বিল্টুর পিসতুতো দিদি।
পিসির বাড়ি শিয়ালদায়। বন্যা প্রতিবছরই রাখির দিনে বিল্টুকে ওদের বাড়ি যাওয়ার জন্য অনেক
করে বলে।
“না। আমার নিজের কোনও বোন নেই
কেন?” ও প্রশ্ন করে। মায়ের
প্রস্তাব কখনোই ভালো লাগে না বিল্টুর। রাখি পরতে কে যাবে শিয়ালদা পর্যন্ত
ঠেঙ্গিয়ে? দীপ, পার্থদা, টুবাই বাড়ি থেকেই কেমন হাত সাজিয়ে রাখি পড়ে স্কুলে যায়। ও
যদি তেমনটা করতে পারত তবেই না আসল মজা হত!
বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাখির
দিনে কষ্ট হলেও বাস্তবটা একপ্রকার মেনেই নিয়েছিল সে। আজ সকালে জগিং সেরে ঋকদের বাড়ির
সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় টুসি আর ঋককে একসঙ্গে দেখে নিজের বোন না থাকার ব্যাথাটা বুকে
ফের মোচড় দিয়ে উঠল বিল্টুর।
“কী রে? ঘুমোচ্ছিলি?” গত এক মাসে
ঋক বিল্টুদের খুব বন্ধু হয়ে উঠেছে। শহরের নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রথম
সারির ছাত্র হলেও ঋকের মধ্যে কোনও অহংবোধ নেই। বিল্টুর যেটা ভালো লাগে, পড়াশোনার সঙ্গে
সঙ্গে শরীরচর্চাতেও খুব আগ্রহ আছে ছেলেটার। সকালে বিল্টুদের সঙ্গে জগিংয়ে যায়। সপ্তাহের
মধ্যে তিন-চারদিন বিকেলে ক্রিকেট খেলতে আসে। ছুটির দিনে পাড়ার পুকুরের ধারে
দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে ঋক বিল্টুর সাঁতারের কেরামতি দেখে। ওরও নিশ্চয়ই জলে নামতে
ইচ্ছে করে! বিল্টু জানে, ঋক নিরুপায়। ওর বাবার কড়া নির্দেশ, পুকুরের পচা জলে নামা
যাবে না।
“আজ স্কুলে ইউনিট টেস্ট আছে
রে!” বিল্টুর প্রশ্নের উত্তরে জগিং মিস করার জন্য একটা অজুহাত দিতে চাইল ঋক।
“দাদা, কেন বাজে কথা বলছিস
বিল্টুদাকে? ভোরে তোর ঘুম ভাঙ্গেনি, সেটা বল।” ঋকের পাশে দাঁড়ানো টুসি টরটর করে
বলে উঠল। ঋকের থেকে বছর দুয়েকের ছোটো টুসি। ভাইবোনে ভাবও যেমন, ঝগড়াও লেগেই থাকে
মাঝেমধ্যেই। ঋকের সঙ্গে ওর বাড়ি কয়েকবার গিয়েছে বিল্টু। বাড়ির সবাইকে ভালো লাগলেও বিল্টু
বুঝেছে ঋকের বাবা গৌতমকাকু বেশ কড়া ধাতের লোক। আর উনি বিল্টুকে একদমই পছন্দ করেন
না।
“বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি
রাখিটা পরিয়ে দে। স্কুলে যাওয়ার দেরি হয়ে যাচ্ছে।” ঋক এক ধমক দিল টুসিকে।
“পরাব না যা! তুই কিচ্ছু গিফট
দিস না। জানিস, দীপদা শ্রেষ্ঠাকে কী সুন্দর একটা টেডি কিনে দিয়েছে...।” বিল্টু
আর দাঁড়াল না। বাড়ির দিকে এগোল। ওর যদি এত মিষ্টি
একটা বোন থাকত, তাহলে প্রতিদিন টিফিনের আলুকাবলির খরচ বাঁচিয়ে সেই টাকা দিয়ে
বিল্টু একটা ইয়াব্বড় টেডি কিনে দিত ওর বোনকে।
।।
৩ ।।
“ইশ! খুব লেগেছে তোর, তাই না
রে?” বিছানায় গোঁজ হয়ে বসে থাকা ঋকের পাশে দাঁড়িয়ে টুসি। কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে যখন তাণ্ডব
চলছিল, তখন বাবার ভয়ে লুকিয়েছিল কোথাও। সামনে আসেনি।
“তুই চলে যা এখান থেকে,” ঋক
জোরে চেঁচিয়ে উঠল। গালটা খুব জ্বালা করছে।
“দাদা, আস্তে কথা বল। বাবা
শুনতে পেলে আবার...”
“কী করবে? মারবে? মেরেই ফেলুক
না একেবারে।” অভিমানে, কষ্টে ঋকের গলা বুজে আসে। কী এমন অন্যায় সে করেছে যে এভাবে
শাস্তি পেতে হবে। শুধু খেলতেই তো গিয়েছিল সে!
আজ বিকেলে ঋক গত কয়েকদিনের মতোই
বইপত্র ঘাঁটছিল। বাবা বলে দিয়েছেন, বিল্টুর সঙ্গে যেন না খেলে। ডিসেম্বরে
ওদের স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষার সময় হলে বিল্টু নাকি পাশের ছেলের খাতা দেখে প্রশ্নের
উত্তর টুকছিল। সেটা দেখতে পেয়ে যান পরীক্ষার গার্ড। তিনি
হেডমাষ্টারমশায়কে বিল্টুর নামে রিপোর্ট করেন। পড়াশোনার
প্রতি বিল্টুর অনীহা নিয়ে হেডমাষ্টারমশায়ের অনেকদিন থেকেই রাগ ছিল বিল্টুর ওপর। ওকে
স্কুলছাড়া করার জন্য একটা অজুহাতের অপেক্ষায় ছিলেন। এই ঘটনাতে যেন হাতে চাঁদ পেলেন। পরীক্ষার
হলে নিয়ম বহির্ভূত কাজ করার অপরাধে সরকারি স্কুল থেকে নাম কাটা গেল বিল্টুর।
“বাজে ছেলেদের সঙ্গে মিশে রাজ্যের
বাজে দোষগুলো আয়ত্ত করবি, তবু বাবার কথা শুনবি না? তাই তো?” ঋককে এলোপাথাড়ি মারতে
মারতে চিৎকার করছিল বাবা। একটা গালে এখনও পাঁচ আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে।
আজ বিকেলে দীপ যখন খেলার জন্য
ডাকতে এল, ঋক দোনোমনো করছিল।
“খেলতে যাবি না, ঋক? আজ তো আনন্দপুরীর
সঙ্গে আমাদের ম্যাচ! বলেছিলাম না?” ঋককে রেডি হতে না দেখে দীপ বেশ অবাক। এদিকে আনন্দপুরীর
সঙ্গে ম্যাচের কথা মনে পড়তেই ঋকের মনের সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হাওয়া। আনন্দপুরী
ঋকের পুরোনো পাড়া। এতদিন যাদের সঙ্গে খেলেছে, আজ তাদেরই বিপরীতে খেলতে হবে।
উত্তেজনায় ঋক অস্থির তখন। বাবার রাগী মুখটা চোখের সামনে যে ভেসে ওঠেনি, তা নয়।
কিন্তু ঋক মনস্থির করে ফেলেছে। বাবা অফিস থেকে ফেরার আগেই বাড়ি ঢুকে যাবে। এরপর ঋক
খেলেইনি শুধু, দুরন্ত ব্যাটিং করে টিমকে জিতিয়েছে। বাড়ি ঢোকার সময়ে ঋকের বাঁ চোখের
পাতা কাঁপছিল। বিপদের সঙ্কেত।
বাবা অন্যান্য দিনের তুলনায়
অফিস থেকে আগে ফিরেছেন আজ। ঘরে ঢুকে বাবাকে দেখেই হাত পা অসাড় হওয়ার জোগাড় ঋকের।
পিঠ বাঁচাতে খেলতে যাওয়ার কথা অস্বীকার করছিল প্রথমে। ফল
হল মারাত্মক!
“বেয়াদপ ছেলে। বাবার কথা
অমান্য করেছিস! দোষ ঢাকতে আবার মিথ্যা কথা বলছিস। তুই যে খেলছিলি, মাঠের পাশে
দাঁড়িয়ে আমি সেটা নিজের চোখে দেখেছি।” মুখের সঙ্গে
সঙ্গে বাবার হাতও পুরোদমে চলছিল ঋকের ওপরে। “ফের যদি ওই ফালতু ছেলেটাকে তোর
আশেপাশে দেখেছি, তাহলে তোর হস্টেল যাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।”
।।
৪ ।।
নতুন স্কুলে মন টিকছে না বিল্টুর। কোনও
বন্ধুই হয়নি এ স্কুলে। আগের স্কুলের এতদিনের সব বন্ধুদের ছেড়েছুড়ে চলে আসতে হল। কী
যে দুর্মতি হয়েছিল অঙ্ক পরীক্ষার দিন!
“তুই তো আশেপাশে একদমই
তাকাচ্ছিস না রে,” ফিসফিস করে বলেছিল অরিত্র। ক্লাস সেভেনের ফাইনাল পরীক্ষায়
বিল্টু আর অরিত্র এক বেঞ্চে বসেছে। “চার নম্বর প্রশ্নের অঙ্কটা কিছুতেই পারছি না!
তুই পেরেছিস?” আবার অরিত্র। ছেলেটা তো অঙ্কে বরাবরের ভালো। আজ কী
কিছু সমস্যা হচ্ছে ওর?
“হ্যাঁ,” ছোট্ট উত্তর
বিল্টুর।
“প্লিজ দেখা না!”
“চুপ কর! বিবি স্যারকে তুই
চিনিস না?” বিরূপাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংক্ষেপে বিবি। বিল্টুদের অঙ্কের শিক্ষক।
উনি বিল্টুদের ঘরে গার্ড দিচ্ছেন। প্রচণ্ড রাগী স্যার। ওঁর
ভয়ে সব ক্লাসের ছাত্ররা তটস্থ হয়ে থাকে। তবে যে সব ছাত্র অঙ্কে ভালো, তাদের বিবি
স্যার খুব ভালোবাসেন।
“স্যার এখন পিছন দিকে ফিরে
রয়েছেন। দেখতে পাবেন না।” অরিত্র নাছোড়বান্দা। অগত্যা
বন্ধুকর্তব্য পালন করতে বিল্টু ওর উত্তরপত্র দেখিয়েছিল অরিত্রকে।
“কী বাছাধন! এসব চলছে, অ্যাঁ?”
বিবি স্যার এসে দাঁড়িয়েছেন অরিত্রর পাশে। বিল্টু আর অরিত্রর খাতা দুটো খুব
কাছাকাছি ছিল। স্যারের অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ে গেল
ব্যাপারটা।
“আমি কিছু করিনি স্যার। বিল্টু
বার বার বলছিল ওকে একটু হেল্প করতে,” বিপদ বুঝে পালটি খেয়ে গেল অরিত্র। অরিত্রর
অঙ্কে ভালো বলে একটা সুনাম আছে, তাই বিবি স্যার ধরেই নিলেন বিল্টুই অরিত্রর খাতা দেখে
উত্তর লিখছিল। বিল্টুর কোনও কথাই তিনি শুনলেন না।
স্কুল থেকে নাম কেটে যাওয়াতে
বাড়িতে, পাড়াতে, আত্মীয়স্বজনের কাছে, অনেক কথা শুনতে হয়েছে বিল্টুকে। অপমানে
লজ্জায় বিল্টুর মাথা হেঁট হয়ে গেছে। চেষ্টা চরিত্র করে বাবা এই নতুন স্কুলে ভর্তি
না করে দিলে যে কী হত, ভাবতেই পারছে না বিল্টু।
জগিং সেরে খবরের কাগজে খেলার
পাতায় চোখ রাখতেই মনটা উদাস হয়ে গেল বিল্টুর। ইডেনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচে
ইণ্ডিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের খেলা আগামীকাল। বিল্টুর কতদিনের ইচ্ছে মাঠে গিয়ে এরকম
একটা ধুন্ধুমার ম্যাচ দেখে! কথায় কথায় ঋক একবার জানিয়েছিল, ইডেনে খেলা হলে ওরা
টিকিট পায়। এও বলেছিল, ইডেনে এরপর খেলা হলে ওরা একসঙ্গে খেলা দেখতে যাবে।
এখন ঋক দেখা হলেও আর কথা বলে
না বিল্টুর সঙ্গে। ও শুনেছে গৌতমকাকু ঋককে খুব
মেরেছিলেন, বিল্টুদের সঙ্গে খেলেছিল বলে। সেইদিনের পর থেকেই ঋক দূরে সরে গিয়েছে।
।।
৫ ।।
ষষ্ঠীতলায় এক বান্ধবীর বাড়িতে
জন্মদিনের পার্টি ছিল টুসির। খেয়েদেয়ে বেরোতে বেরোতে রাত ন’টা বেজে গেল। ইশশ, অনেক
দেরি হয়ে গেছে। মা খুব রাগ করবে। হীরা আর পূর্বার সঙ্গে বাড়ির দিকে তাড়াতাড়ি পা
চালাচ্ছিল টুসি। সময় বাঁচাতে ঘুরপথে লেভেল ক্রশিং অবধি না গিয়ে সোজাসুজি রেললাইনটা
পার হয়ে টুসিদের গার্লস স্কুলের সামনের রাস্তাটা ধরবে ঠিক করল ওরা।
ঘটাং...
হীরা আর পূর্বা নির্বিঘ্নে
রেললাইন পার হয়ে গেলেও টুসি লাইন ক্রশ করতে যাওয়ার সময় ঘটল বিপদটা। ট্রেন আসবে বলে
লাইন চেঞ্জ করা হচ্ছিল, সেইসময় দু’লাইনের ফাঁকে আটকে গেছে টুসির বাঁ পা। লাইনের
ওপার থেকে দুই বান্ধবী চিৎকার করে ওকে পা ছাড়াতে বলছে। কিন্তু কিছুতেই ছাড়াতে
পারছে না টুসি। টেনশনে, ভয়ে টুসির কান্না পাচ্ছে। এভাবে লাইন পারাপার করতে মা,
দাদা পই পই করে নিষেধ করেছিল।
ভোঁওওওওও... ট্রেনের হুইসেল।
এই লাইন ধরে এগিয়ে আসছে ট্রেনটা। সাহায্য করার মতো ত্রিসীমানায় কোনও মানুষকে দেখা
যাচ্ছে না। চিন্তাতে দিশাহারা হয়ে হীরা আর পূর্বা কান্না জুড়ে দিয়েছে। টুসি অনেক
টানাহেঁচড়া করেও লাইন থেকে পা ছাড়াতে পারেনি। চোখে ট্রেনের হেডলাইট এসে পড়ার সঙ্গে
সঙ্গে টুসির মনে হল ওর শরীরটা অসাড় হয়ে আসছে, মাথা টলছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে
টুসি দেখল ওর গায়ে একটা লম্বাচওড়া মানুষের ছায়া এসে পড়ল। পরমূহুর্তে টুসির ডান হাত
ধরে শক্ত হাতের হ্যাঁচকা টান।
“আউচ......” বাঁ পা যেন মুচকে
গেল টুসির। হাই হিল খুলে গেছে পা থেকে। প্রচন্ড ব্যথা করছে পায়ে। তবে বাঁচোয়া এই
যে লাইনের ধারে চলে এসেছে টুসি। ঝমঝম শব্দে
ট্রেনটা ওর পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। প্রচণ্ড বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে টুসি এবারে ওর
পরিত্রাতার দিকে তাকাল। চুল উসকোখুসকো, কোমরে দু’হাত দিয়ে
রীতিমতো রেগে ওর দিকে চেয়ে রয়েছে বিল্টুদা।
অতঃপর
“তাড়াতাড়ি পা চালা ঋক।”
“আরে, অস্থির হচ্ছিস কেন? ম্যাচ
শুরু হতে এখনও ঢের দেরি।”
“ম্যাচের আগে প্লেয়ারদের
প্রাকটিস দেখতে হবে না?”
“আচ্ছা, বাবা চল চল।”
ইডেনের গেট দিয়ে ঢুকছে ঋক আর
বিল্টু। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হবে ভারত পাকিস্তানের মহাযুদ্ধ।
কাল রাতে টুসি যখন বাড়ি ফিরল,
ওর সঙ্গে বিল্টুকে দেখে খুব অবাক হয়েছিল ঋক। বিল্টু টুসিকে বাড়ি অবধি ছাড়তে
এসেছিল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা বাবার থমথমে মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না ঋক। ঝড়ের
পূর্বাভাস ভেবে ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে ছিল সে। তবে টুসি বাড়িতে ঢুকেই সব কিছু জানিয়ে
দেয়। নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে বিল্টু ওর ছোটো বোনকে এত বড়ো বিপদের হাত থেকে
বাঁচিয়েছে। বিল্টুর মতো বন্ধুর জন্য খুব গর্ব হল ঋকের।
সাহসিকতার প্রাইজ হিসেবে আজ
সকাল থেকেই বিল্টু ওদের বাড়িতে। সারাদিন প্রচুর ভালোমন্দ খেয়ে দুই বন্ধু এখন
ইডেনের গ্যালারিতে বসে। খেলা চলছে।
“ওয়াও, কী ডাইভ দিল রে কোহলি!
দেখলি, শিওর চারটা বাঁচিয়ে দিল। আহা, আমিও যদি
পারতাম এরকম,” উত্তেজনায় বিল্টু সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেছে।
“তুই কি জানিস না, তুই ওর
থেকেও ভালো পারিস?”
ছবিঃ পার্থ মুখার্জী
No comments:
Post a Comment