[মূল কাহিনি: পিকম্যান’স মডেল - এইচ পি লাভক্র্যাফট, প্রথম প্রকাশ ‘উইয়ার্ড
টেলস’ পত্রিকা, অক্টোবর ১৯২৭]
ভাবানুবাদঃ ঋজু গাঙ্গুলী
দ্যাখো ইলিয়ট! এটা ইয়ারকি মারার ব্যাপার নয়। অনেকেরই নিজস্ব
পছন্দ-অপছন্দ থাকে। কই, সেগুলোকে তো বাতিক বলা হয় না? অলিভারের বাবা কখনও গাড়িতে
চড়ে না। কই, তার পেছনে তো লাগো না তুমি! তাহলে আমি সাবওয়ে ব্যবহার করি না বলে এত
খোঁচাচ্ছ কেন? তাছাড়া... আমরা কত তাড়াতাড়ি এলাম, সেটা ভাব। সাবওয়েতে এলে অনেক বেশি
সময় লাগত, পার্ক স্ট্রিট ধরে অনেকটা ঠ্যাঙাতে হত, এসব তো বলছ না?
হ্যাঁ, আমি আগের চেয়ে বেশি নার্ভাস হয়ে গেছি। কিন্তু
তার কারণ জানার জন্য তোমাকে তদন্ত কমিশন বসাতে হবে না। ইন ফ্যাক্ট তোমাকে এত
ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে আমাকে জিজ্ঞেসও করতে হবে না। আমি বলছি। নিজে থেকেই বলছি। স্রেফ
চুপচাপ শোনো। তাছাড়া তোমারই তো এ-সব শোনা উচিত। আর্ট ক্লাব আর পিকম্যান-এর সঙ্গে
আমি যোগাযোগ রাখিনি বলে তুমি আমাকে যে লম্বা-লম্বা চিঠিগুলো লিখেছ, সেগুলোর একটা
উত্তর দিতে হবে না?
পিকম্যান কোথায়? আমি কী করে জানব? পুলিশ কত
চেষ্টাচরিত্র করছে সে তো তুমিও জান। আমি আর কী বলব?
তবে হ্যাঁ, পিকম্যান কোথায় গেছে, সে সম্বন্ধে
যৎসামান্য ধারণা আমার আছে।
পুলিশকে সে কথা বলব?!? তুমি কি নেশাভাঙ করেছ নাকি হে?
পুলিশ এখনও নর্থ এন্ডে ‘পিটার’ ছদ্মনামে পিকম্যান যে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিল, তার
খবরই জোগাড় করে উঠতে পারল না, আর তাদের আমি আমার ধারণা নিয়ে বলব! হুঁহ্!
কী? না, ওই বাড়িটার রাস্তা এখন আমি আর চিনতে পারব না।
যদি চিনতে পারিও, আমি পুলিশকে ওখানে নিয়ে যাব না। আমি জানি পিকম্যান কেন ওই বাড়িটা
ভাড়া নিয়েছিল। ওই বাড়ির বেসমেন্টে ও যা করত...! মোদ্দা কথা হল, আমি বেসমেন্টে,
সাবওয়েতে, আর্ট ক্লাবে, মানে পিকম্যানের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন কোনও জায়গার
ত্রিসীমানায় আর যেতে আগ্রহী নই। কেন নই সেটা যদি শুনতে চাও তাহলে মুখটা একদম টাইট
করে বন্ধ রাখো।
আগেই বলে রাখি, ডক্টর রিড-এর মতো শুচিবায়ুগ্রস্ত, বা বসওয়ার্থ-এর মতো জীবন্ত জীবাশ্ম যে কারণে
পিকম্যানের থেকে দূরে থাকত, আমি অন্তত সেই জন্য ওর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করিনি। মর্বিড
আর্ট দেখে মূর্ছা যাওয়ার মতো লোক আমি নই। রিচার্ড আপটন পিকম্যান একটি জিনিয়াস। তার
সঙ্গে পরিচিত হওয়া, তার কাজ সামনে থেকে দেখা, এগুলো আমার কাছে সম্মানের আর গর্বের
বিষয়। ওর আঁকা ‘পিশাচের ভোজ’, যেটা দেখে জো মিনে পিকম্যান-কে মারতে এসেছিল, সেটা
দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।
ছবি ব্যাপারটা তুমি অনেকের চেয়ে ভালো বোঝ। একগাদা রঙ ছিটিয়ে,
তার মধ্যে রক্ত, কাটামুন্ডু, বা হাড় ছড়িয়ে দিলেই সেটা যে মাকাবর বা মর্বিড আর্ট হয়
না, এটা তোমার জানা আছে। পিকম্যানের মধ্যে সেই বিরল, অতি দুর্লভ প্রতিভা ছিল যা
আতঙ্কের নিজস্ব অবয়ব, মাত্রা, গভীরতা বুঝতে পারত, আর ছবিতে সেটা ফুটিয়ে তুলত। যেটা
অন্যের হাতে হাসিঠাট্টার বিষয় হত, সেটাই ওর হাতে হয়ে উঠত একেবারে স্পেশাল।
পিকম্যানের বিশেষত্ব ছিল মুখ। গোয়া ছাড়া অন্য কোনও
শিল্পীর আঁকা মুখের ছবিতে এত যন্ত্রণা, এত হাহাকার, বা এত... লালসা ফুটে উঠতে
দেখিনি আমি।
মধ্যযুগে? হ্যাঁ, মধ্যযুগে নোতরদামের ফ্রেস্কোয় বা
সেন্ট মাইকেলের ছবিতে ওরকম দেখা যায়। তার কারণটাও সহজবোধ্য। তখন লোকে ওইসবে, মানে
দৈত্য-দানব-পিশাচে বিশ্বাস করত! বিশ্বাস থাকলে ওরকম আঁকা যায়। কিন্তু আজকের যুগে
ওইরকম ভাবনা? তার জন্য দম লাগে।
তোমার মনে আছে, তুমি একবার ওকে জিজ্ঞেস করেছিলে, ও
এইসব ছবির আইডিয়া পায় কোত্থেকে? ও উত্তরে কীরকম বিশ্রীভাবে হেসেছিল, সেটা খেয়াল
আছে তো? ওই হাসিটা শোনার পর থেকেই রিড পিকম্যানকে এড়িয়ে চলত। তখন ও কম্প্যারেটিভ
প্যাথলজি নিয়ে পড়াশোনা করছে। সুযোগ পেলেই মানুষের ভেতরের ভাব কীভাবে বাইরে বেরিয়ে
আসে, তাই নিয়ে নানা ফান্ডা আমাদের শোনাত ও। পিকম্যানের ওই হাসি শোনার পর থেকেই রিড
পিকম্যান আর তার কাজ, দুই থেকেই যথাসাধ্য দূরে থাকত। ও বলত, পিকম্যানের মধ্যে
‘গোলমাল’ আছে।
আর্ট ক্লাব ‘পিশাচের ভোজ’ একজিবিট করেনি, তাই ছবিটা
বিক্রি হয়নি। এমনকি ফাইন আর্টস মিউজিয়ামও ছবিটা নেয়নি। ইদানীং ছবিটা সালেমে ওদের
পুরোনো বাড়িতেই শোভা পাচ্ছে। তবে পিকম্যান নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে ছবিটা ওর বাড়িতে
রাখা থাকত। আমি সেখানে ওর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি ইলিয়ট! ওই
বাড়িতে রাখা ওর স্কেচ আর অন্য ছবির সম্ভার দেখলে আর্ট ক্লাবের ফুলের ঘায়ে মূর্ছা
যাওয়া লোকজন হয় পাগল হয়ে যেত, নয় পিকম্যানকে ক্লাব থেকে বের করে দিত।
তখন আমি শিল্পের প্রেরণা নিয়ে নানা তত্ত্ব, তাদের
পক্ষে-বিপক্ষে নানা মতামত, এসব নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখছিলাম। পিকম্যান যে জিনিয়াস,
সেটা নিয়ে আমার কোনও সংশয় ছিল না, এখনও নেই। তবে শিল্প নিয়ে পিকম্যানের ভাবনা শুনে
আমি শুধু হুঁ-হাঁ করতাম। সেগুলো কাগজে-কলমে লেখা যেত না। ওগুলো ছাপা হলে পিকম্যান-এর
সঙ্গে আমাকেও পাগলা গারদের বাসিন্দা হতে হত।
তুমি জান, আমি ছাড়া আর বিশেষ কেউ পিকম্যানের সঙ্গে
মিশত না, ওর কাজের প্রশংসা করা তো দূরের কথা। হয়তো সেজন্যই একদিন পিকম্যান আমার কাছে
মুখ খুলেছিল।
“যদি শিল্পকে ছকে বাঁধা
সমালোচকদের বদলে খোলা চোখে দেখা যায়,” চিবিয়ে-চিবিয়ে বলছিল পিকম্যান, “তাহলে মানতে
হবে যে আমরা ভূত, প্রেত এ-সব বলতে যাদের কথা ভাবি, তারা আমাদের মতোই। আধুনিক,
অসার, তুচ্ছ!”
আমি প্রতিবাদ করিনি। তবে
আমার নীরবতার মধ্যেও বোধহয় একটা অবিশ্বাসের ভাব ছিল। উত্তেজিত হয়ে পিকম্যান আরও
অনেক কিছু বলেছিল এরপর, যেগুলো এমনিতে ওর কাছ থেকে বার করা বেশ শক্ত ছিল।
“নিউবারি স্ট্রিটে বসে এসব মানতে পারবেন না আপনি।
কিন্তু সত্যিকারের পুরোনো জায়গায় যদি কখনও যান, বুঝতে পারবেন আমি কী বলছি। ভাবুন,
অন্তত ভাবার চেষ্টা করুন।
“কপ’স হিল বা ব্ল্যাক বে-তে এমন বাড়ি আছে, এমন সব
রাস্তাঘাট আছে, যেগুলো সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বানানো। পুরোনো এলাকায় কী থাকে
জানেন তো? সুড়ঙ্গ! লুকোনো রাস্তা! খাঁড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার গোপন ব্যবস্থা!
কারণটা আন্দাজ করতে পারছেন তো? আরে বাবা, তখন আইনসম্মত পথে রোজগার করার মতো পথ
ক’টা ছিল বলুন? তাই দস্যুবৃত্তি, চোরাচালান, এসব চলত দেদার। তার জন্য ওইরকম
যাতায়াতের ব্যবস্থা লাগবে না?
“যখন ডাইনি নিধনের নামে নর্থ হিল এলাকায় ধরপাকড় চলেছে,
তখন শয়তান বা অশুভ শক্তির উপাসকেরা কি আর ওপরে ধরা দেওয়ার জন্য বসে ছিল? তারা
মাটির তলায় চলে গেছিল! এই তো সেদিন, হেঞ্চম্যান স্ট্রিটে জলের লাইন টানতে গিয়ে
কারিগররা একটা দেওয়াল ধ্বসিয়ে ফেলল। সেখান থেকে গোপন পথঘাট, ঘর, এমনকি আস্ত দালান
বেরিয়ে আসা নিয়ে হইচই হল, পড়েননি?
“এইসব জায়গায় কী হত জানেন? সমুদ্র থেকে কি শুধুই
সোনাদানা বা অন্য চোরাই মাল আসত ওখানে? সমুদ্র থেকে ওখানে অন্য কেউ... অন্য কিছুও
আসত। আমি জানি। সুযোগ পেলে আপনিও জানবেন।
“এখন, এখানে বসে সেই সময়ের কথা, ব্যথা, বিশেষত
আতঙ্কের নাগাল পাওয়া অসম্ভব। এমনকি নর্থ এন্ডেও সে সব কথা বলতে পারে, বুঝতে পারে,
এমন লোক গুটিকয়েকই আছে। আমি একজনকে পেয়েছি। তার কাছ থেকে কিছুটা জেনেছি, বুঝেছি।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেছিল পিকম্যান। আমি ওর ওই
নিস্তব্ধতার সঙ্গে বিলক্ষণ পরিচিত ছিলাম। জানতাম, আমি আগ্রহ না দেখালে ওর কাছ থেকে
আর কিছু জানা যাবে না। নর্থ এন্ডের কোনও বাসিন্দার সঙ্গে পিকম্যানের কোথায় দেখাসাক্ষাৎ
হয়, সেটা নিয়ে একটু কৌতূহলও হচ্ছিল। তাই জানতে চাইলাম, “সে কি এখানে এসে আপনার
সঙ্গে কথা বলে?”
“না,” অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল পিকম্যান। আমার মনে
হল, ও কিছু একটা ভেবে নিল। তারপর আমাকে বলল, “কথাটা আপনাকে গোপন রাখতে হবে।
ব্যাপার হল, আমি নর্থ এন্ডে একটা বহু পুরোনো, একেবারে জরাজীর্ণ বাড়ি ভাড়া নিয়েছি।
‘পিটার’ নামটা নিতে হয়েছে, কারণ আমার ওখানে থাকার কথাটা জানাজানি হলে সমস্যা হবে।
“বাড়িটা আদতে এক সিসিলিয়ানের। সে ক’হাত ঘুরে ওটা
পেয়েছিল, কে জানে। বাড়িটার ভাড়া নগণ্য। এলাকাটা খারাপ বলে জানালাগুলোও সব তক্তা
দিয়ে বন্ধ করা। তাতে আমার অবশ্য কিছু যায় আসে না। আমি ছবি আঁকি বেসমেন্টে, ওখানেই
সবচেয়ে ভালো আইডিয়াগুলো আসে মাথায়।
“আপনি যদি চান, তাহলে আজ রাতে আপনাকে বাড়িটা দেখাতে
নিয়ে যাব। শাটল নিয়ে ব্যাটারি স্ট্রিট, তারপর কিছুটা হাঁটাপথ। যাবেন?”
বুঝতেই পারছ ইলিয়ট, মুখে কিছু না বললেও আমি কতটা
আগ্রহী ছিলাম ব্যাপারটার তল পেতে। একে তো ওই এলাকাটা নিয়ে একটা নিষিদ্ধ আকর্ষণ
আমার মনে বরাবর ছিল। তার ওপর পিকম্যানের কোনও ছবি একটু-একটু করে তৈরি হচ্ছে,
এ-জিনিস দেখা মানে আমার কাছে বিশাল ব্যাপার! সেদিন রাত বারোটায় আমরা যখন ব্যাটারি
স্ট্রিটে নামলাম, তখন আমি ভেতরে-ভেতরে প্রায় ফুটছিলাম।
হাঁটাপথে এ-গলি সে-গলি হয়ে আমরা যে রাস্তাটায়
পৌঁছলাম, সেটা নোংরায় ভরা। কিন্তু চাঁদের আলোয় বাড়িগুলোর ঘন কালো সিল্যুয়েট দেখে
বুঝলাম, এগুলোর বয়স প্রায় তিনশো বছর! আমাদের হেরিটেজ সোসাইটিগুলো খবর পেলে হয়তো
ঝাঁপিয়ে পড়বে। আবার নাও পড়তে পারে, কারণ বাড়িগুলোর চেহারার মধ্যে এমন একটা ভাব ছিল
যেটা... যাক গে। আসল কথায় ফিরি।
শেষ অবধি একটা অন্ধকার গলির মধ্যে একটা টেরচা হয়ে
দাঁড়ানো বাড়ির সামনে পৌঁছলাম। বাড়িটার দরজা দেখে চমকে উঠতে হল। বিশ্বাস করো, ভাঙা চাঁদের আলোতেও
তাতে ময়লা আর অযত্নের নিচ থেকে যে সব নকশা মুখ বার করে মুচকি হাসছিল সেগুলো
ডাকিনীবিদ্যা নিয়ে আমাদের যা-কিছু পড়াশোনা, তার অনেক-অনেক দূরের কিছুর আভাস
দিচ্ছিল। ততক্ষণে পিকম্যান দরজা খুলে ফেলেছে। বাড়িতে ঢুকে, একটা লন্ঠন জ্বালিয়ে ও
আমাকে রাস্তা দেখাল। আমি ওর পিছু-পিছু এগোলাম। বাড়ির ভেতরে পিকম্যানের সেইসব ছবি
ছিল, যেগুলো ও শুধু আর্ট ক্লাবে নয়, কোথাও দেখাতে পারবে না। কেন পারবে না? বলছি,
আগে একটু...
আহ্! ওরকমভাবে ঠোঁট
কুচকোচ্ছ কেন হে? আমি মাতাল হব না, মদে আমার তেমন আসক্তিও নেই। ব্যাপার হল, পিকম্যানের
সেই ছবিগুলোর কথা ভাবলে আমার কেমন যেন রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়। তাই শিরা-ধমনীতে একটু
তরল আগুনের ব্যবস্থা করতে হয়।
যাক গে, আসল কথায় আসি।
পিকম্যানের ছবির মধ্যে এমন
একটা ভয়ংকর, নিষিদ্ধ ভয় জড়িয়ে ছিল যেটার দিকে তাকালে চোখ নয়, মন কুঁকড়ে যায়। সেই
ভয়টা আর পাঁচ জন শিল্পীর ছবি দেখে মনে তৈরি হওয়া অনুভূতির চেয়ে আলাদা। যেমন ধরো...
সিডনি-র ছবিতে কিছু বিচিত্র টেকনিক ব্যবহার করা হয়। অ্যাশটন স্মিথের ছবির পশ্চাৎপটে
শনির বলয়ের পেছনের আকাশ বা চাঁদের বুকে তৈরি হওয়া কিছু ফাংগাস দেখা যায়। এগুলো
দেখলে গা শিউরে ওঠে। কিন্তু পিকম্যানের আঁকা ছবির পটভূমিতে ওসব অপ্রাকৃত কিছু নেই।
পুরোনো চার্চ ইয়ার্ড, ঘন জঙ্গল, সমুদ্রের ধারে একটা খাড়া টিলা, কাঠের প্যানেল
বসানো সেকেলে ঘর, ইটের সুড়ঙ্গ, পাথর দিয়ে বানানো ভল্ট... অর্থাৎ চেনাজানা
জায়গাগুলোই পিকম্যান পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছিল। আমরা যেখানে বসে আছি সেখান
থেকে কিছুটা গেলেই কপ’স হিল কবরখানা; সেটাও ওর অনেক ছবিতে এসেছে।
পিকম্যানের ছবিতে ভয়
জাগানিয়া জিনিস হল তার ফোকাসে থাকা জিনিসগুলোই। যেসব দৈত্য, দানব, বা পিশাচের ছবি
ও আঁকত, তাদের চেহারা অনেকটা মানুষের মতোই। দু’পেয়ে, সামনে ঝুঁকে থাকা, অথচ মুখের
গড়ন কুকুরের মতো! তাদের দু’চোখে অন্ধকার নেই, তার বদলে আছে একটা নিঃসীম ক্ষুধার
লাল ভাব। ছবিগুলোতে ও এমন একটা রবারের মতো নরম ভাব এনে দিত... ভাবলেই গা গুলিয়ে
ওঠে!
তারা কী করত? মাফ করো। ওটি
আমি গুছিয়ে বলতে পারব না। অধিকাংশ ছবিতে তারা দলবদ্ধভাবে হয় খেত, নইলে কিছু একটা
আগলাত, নইলে খাবার নিয়ে মারামারি করত। কয়েকটা ছবিতে দেখেছিলাম, চাঁদনি রাতে সেই
অদ্ভুত... প্রাণীরা লাফিয়ে টপকাচ্ছে কবরখানার দেওয়াল। কোথাও তারা কোনও ঘুমন্ত
মানুষের বুকের ওপর বসে তাদের গলায় জিভ...! একটা ছবিতে দেখেছিলাম, গ্যালো’জ হিলে
ফাঁসিতে ঝোলানো এক ডাইনির চারদিকে তারা বৈঠকের মতো বসে আছে। সেই ডাইনির মুখ অনেকটা
ওদেরই মতো!
আবারও বলছি, আমি দুগ্ধপোষ্য
শিশু নই যে এ সব দেখে ভয় পাব। আমি পিকম্যানের আঁকা মুখগুলো দেখে ভয় পেয়েছিলাম
ইলিয়ট! ওই বীভৎস, বিকৃত, জীবন্ত মুখগুলোতে যে ও কীভাবে এত খিদে, এত হিংস্রতা, এত
যন্ত্রণা ফুটিয়ে তুলেছিল, তা ওই জানে। কাউকে যদি ও এই টেকনিকটা শিখিয়ে যেতে
পারত...!
শেখানোর কথায় মনে পড়ল।
পিকম্যান ‘দ্য লেসন’ নামে একটা ছবি এঁকেছিল। ছবিতে ছিল, কবরখানায় একঝাঁক ওই... কুকুরের
মতো প্রাণীরা গোল হয়ে বসে আছে একটা ছোট্ট ছেলেকে ঘিরে। তারা বাচ্চাটাকে শেখাচ্ছে,
কীভাবে তাদের মতো করে খেতে হয়! ছবিটা দেখে আমার ‘চেঞ্জলিং’ কিংবদন্তির কথা মনে
পড়ল। জান নিশ্চয়, অনেকেই বিশ্বাস করে, না-মানুষ প্রাণীরা অনেক সময় মানব শিশু চুরি
করে, আর তার জায়গায় নিজেদের কোনও সন্তান রেখে যায়। ছবিটা দেখে আমার মনে হয়েছিল,
পিকম্যান কি তাহলে বলতে চাইছে, আজকের এই কুকুরের মতো প্রাণীরা একসময় মানুষ ছিল?
তাজ্জব ব্যাপার কী জান? ছবিটা খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে বুঝলাম, সত্যিই ওই প্রাণীদের
চেহারার সঙ্গে মানুষের গড়নের সাদৃশ্যটা বড্ড বেশি!
স্বাভাবিকভাবেই আমার মাথায়
একটা প্রশ্ন মাথা তুলল। ওই প্রাণীরা যাকে এই শিশুটির পরিবর্তে রেখে এল, তার কী হল?
উত্তরটা আমি পেলাম পরের ছবিতেই। মোটা-মোটা বিম, ল্যাটিস জানালা, সপ্তদশ শতাব্দীর
আসবাব, এসব দিয়ে সাজানো একটা ঘরের ছবি সেটা। তাতে সেই সময়ের পোশাক পরে এক ভারিক্কি
পিউরিটান বাইবেল পড়ে শোনাচ্ছেন। ভক্তিভরে সেগুলো শুনছে বাড়ির অন্য সবাই। একটি
বাচ্চা ছেলেও শুনছে, কিন্তু তার মুখে ভক্তি নেই। বরং আছে তীব্র ব্যঙ্গ, আর অদ্ভুত
এক লালসা। বুঝতে পারলাম, এই হল ওই না-মানুষদের সন্তান। তবে তার চেয়েও ইন্টারস্টিং
জিনিস কী জান? পিকম্যান, ওই বাচ্চাটার মুখের আদল করেছিল ওর নিজের মতো!
পিকম্যান পাশের ঘরের দরজাটা
খুলে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি ওর দিকে ঘুরলে ও মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে
বলল, “ওগুলো পুরোনো। আপনি যদি কিছু ‘মডার্ন স্টাডিজ’ দেখতে চান তাহলে...।” আমি
বুঝতে পারছিলাম ইলিয়ট, ওটা শুধুই ছবি দেখার আহ্বান ছিল না। ওটা একটা চ্যালেঞ্জও
ছিল। আমার মতো এক মাঝবয়সী, ফ্ল্যান্ডার্সে কানের গোড়ায় শেল ফাটার আওয়াজ শোনা
মক্কেল কি পিকম্যানের ছবি হজম করতে পারবে? অন্য সময় আমি ‘না’ বলে দিতাম, কিন্তু
তখন ওই চ্যালেঞ্জটা আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারিনি। আমি সোৎসাহে এগিয়ে গেছিলাম। সেই
ঘরের ছবিগুলো...!
‘সাবওয়ে অ্যাক্সিডেন্ট’
নামের একটা ছবির বর্ণনা দিলে হয়তো তুমি বুঝতে পারবে, আমি ঠিক কী বলতে চাইছি। বয়লস্টন
স্ট্রিট সাবওয়ের মেঝের একটা ফাটল দিয়ে উঠে এসে যাত্রীদের আক্রমণ করছে একদল ওই
প্রাণী, এটাই ছবিটার বিষয়বস্তু। কিন্তু যে পরিমাণ বীভৎসতা, হিংস্রতা, আর এক
বিচিত্র উল্লাস প্রকাশ পেয়েছে ওই ছবিতে, সেটা আমি কথা বলে কিছুতেই বোঝাতে পারব না।
এভাবেই, কোনও ছবিতে দেখা
যাচ্ছে কবরখানা থেকে উঠে আসা ওইরকম প্রাণীদের ঝাঁক। কোনও ছবিতে আবার দেখা যাচ্ছে,
গ্যালো’জ হিল থেকে শুরু করে গোটা শহর জুড়ে মৌমাছির চাকের মতো ছড়িয়ে আছে অজস্র
সুড়ঙ্গ, যা দিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে ওই প্রাণীরা। রাস্তা, মেঝে, দেওয়ালের ফাটল
দিয়ে ওই প্রাণীদের উঠে আসার ছবি তো আছেই, কিন্তু তাতে ফুটে ওঠা জান্তব উল্লাস আর
হিংস্রতার সেই ভাব... নাহ্, আমার ভাষায় কুলোবে না। পুরোনো বাড়ির বেসমেন্ট বা
সেলারে পুরোনো আলমারি, বাক্স, পিপে, সিন্দুক, এ-সবের পেছনে লুকিয়ে, অন্ধকারে মিশে
শিকারের জন্য ওই প্রাণীদের অপেক্ষা করার বহু ছবি বা স্কেচও এঁকেছিল পিকম্যান।
আমি খুব সহজভাবেই বলি ইলিয়ট।
পিকম্যানকে ফ্যান্টাসিস্ট বা রোমান্টিক ভেবে আমরা প্রকাণ্ড ভুল করেছিলাম। ও ওসব
কিচ্ছু নয়। যদি হত, তাহলে ওর ছবিতে অন্তত কিছু ঝাপসা, আবছা, আউট-অফ-ফোকাস জিনিস
থাকত। সে-সব নেই ওর ছবিতে। তাতে প্রতিটি রেখা, প্রতিটি জিনিস ফুটে উঠেছে স্পষ্ট ও
নিখুঁতভাবে। একেবারে স্কেল অনুযায়ী! এর থেকে এটা পরিষ্কার যে পিকম্যান শিল্পী
হিসেবে কঠোরভাবে রিয়্যালিস্ট। ওর আঁকার পেছনে একটা পর্যবেক্ষণভিত্তিক, নির্মোহ,
অনুসন্ধিৎসু, এবং ক্রূর মানসিকতা কাজ করছে। শুধু কল্পনা করে, বা ভাবের ঘোরে ওই-সব
ছবি আঁকা যায় না। তাছাড়া এমন নয় যে ছবিগুলো নৈর্ব্যক্তিক। ওগুলোতে মানুষদের... মানবজাতির
সম্বন্ধে এমন একটা নির্বিকার নৃশংসতা প্রকাশ পেয়েছে, যেটা সাধারণ দর্শক তো বটেই,
আমাদের পক্ষেও হজম করা অসম্ভব।
আমি যখন এই ছবিগুলোর ধাক্কা
সামলে মুখে সপ্রশংস ভাবটা ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম, ততক্ষণে পিকম্যান সেলারের
দরজা খুলে ফেলেছে। বুঝলাম, ওর স্টুডিওতে যাওয়ার যোগ্যতা আমি অর্জন করেছি। মুখে
কিচ্ছু না ফুটিয়েও আমি আরও কিছু বীভৎস জিনিস দেখার জন্য তৈরি হলাম। আমার সেই
অবস্থাটা তোমাকে বোঝানো আমার কম্ম নয় ইলিয়ট। তাই যা দেখলাম, সেই কথাতেই আসি।
স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে
নামলাম আমরা। পিকম্যান ওর হাতের ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালিয়ে এক কোণে তাক করল। দেখলাম,
মাটির মেঝেতে রয়েছে একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি কুয়ো। কুয়োটা প্রায় পাঁচ ফুট ব্যাসের।
মাটি থেকে ইঞ্চিখানেক ওপরে উঠে থাকা কুয়োর ধারটাও একেবারে সলিড, প্রায় একফুট চওড়া।
বুঝতে পারলাম, পিকম্যানের বলা সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্কেরই কোনও একটার মুখ দেখছি আমি।
সপ্তদশ শতাব্দীর জিনিস। যেটা দেখে আমার অবাক লাগল সেটা হল, কুয়োটা সিল্ করা হয়নি।
কাঠের একটা ভারী তক্তা দিয়ে তার মুখটা ঢেকে রাখা হয়েছে শুধু।
ওই কুয়ো দিয়ে কোথায় যাওয়া
যায়, সেখানে কী হত... এ-সব ভেবে আমি কেঁপে উঠছিলাম। পিকম্যান ততক্ষণে অন্য একটা
দরজা খুলে ফেলেছিল। দরজাটা সরু, কিন্তু তার
ওপাশের ঘরটা বেশ বড়ো। মেঝেটা কাঠের। অ্যাসিটিলিন ল্যাম্পের চোখ-ধাঁধানো দ্যূতিতে
ঘরটা আলোকিত হয়ে আছে। আশেপাশে ইজেলে রাখা অজস্র ক্যানভাস, কাগজে অসম্পূর্ণ খসড়া,
নানা স্কেচ আর মডেল দেখে বুঝতে পারলাম, আমরা পিকম্যানের স্টুডিওতে ঢুকেছি।
ছবিগুলোর বিষয়বস্তু তোমাকে
নতুন করে বলার দরকার নেই। ওপরের ঘরে সারিবদ্ধভাবে প্রদর্শিত জিনিসগুলোতে যা ছিল,
এখানেও সেই জিনিসই, মানে সেই প্রাণীদেরই রাজত্ব চলেছে। তবে একটা কথা স্কেচগুলো
দেখে আমি আবারও বলছি। পিকম্যানের মতো শিল্পী সত্যিই ক্ষণজন্মা ইলিয়ট! কী
নিখুঁতভাবে ওই স্কেচগুলো করা হয়েছে, কতটা যত্নের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক জিনিসগুলোকে
ঢেকে আসল ব্যাপারে ফোকাস করা হয়েছে... না দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না। পাশের টেবিলে
একটা ক্যামেরা দেখলাম। আমাকে সেদিকে তাকাতে দেখে পিকম্যান নিজেই বলল, “ইজেল আর
কাগজ বা ক্যানভাস নিয়ে শহরের এখানে-ওখানে দৌড়নোর বদলে এটাই আমার সঙ্গে থাকে।
ডিটেইলস ধরায় এর জুড়ি নেই।”
ওই অসমাপ্ত ছবি, কয়েকটা
আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা কিছু চেহারা বা তাদের আচরণ, এ-সবের ধাক্কা আমি তাও সামলে
নিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর...!
তীব্র আলোর বলয়ের বাইরে রাখা
একটা বিশাল ক্যানভাসের ওপর থেকে পর্দা সরিয়ে নিল পিকম্যান। অস্বীকার করব না ইলিয়ট,
আমি একটি শিশুর মতোই আর্তনাদ করে উঠেছিলাম ছবিটা দেখে! সেই চিৎকার ওই বিশাল ঘরের মধ্যে
ঘুরপাক খেতে-খেতে শেষে আমার কানেই ফেরত এসেছিল।
ছবিটায় কী ছিল?
কখনও তোমার মনে হয়েছে, যে
দুঃস্বপ্নে আমরা কী দেখি, বা কী কল্পনা করতে পারি, তারও কোনো সীমা আছে কিনা? মানে
আমরা অবচেতনে, এমনকি সচেতন হয়েও কতটা ভয়োৎপাদক দৃশ্যের কথা ভাবতে পারি? ছবিটা সে সব
ছাপিয়ে গেছিল। ওতে একটা প্রাণী ছিল, যার আকার... না, আমি তার বিশালত্বের বর্ণনা
দিতে অক্ষম। সেই প্রাণীটি হাঁটু মুড়ে কিছু একটা খাচ্ছে। কী খাচ্ছে? খাবারটা কোনও
এক সময়ে একটা মানুষের শরীর ছিল, তবে তখন সেটা আধখাওয়া এবং বিকৃত। প্রাণীটির গুঁড়ি
মেরে বসার ভঙ্গিটা দেখলেই মনে হয়, এই বুঝি সেটা আরও হৃষ্টপুষ্ট কোনও শিকারের
সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়বে!
তাও বলব, প্রাণীটির কুকুরের
মতো মুখ, খাড়া কান, রক্তলাল চোখ, চ্যাপটা নাক, লালাঝরা ঠোঁট, নখ, শ্যাওলা-মাখা
শরীর... এদের কোনোটা নিয়েই আমার অতটা ভয় পাওয়ার কথা নয়। পাইওনি। কিন্তু পিকম্যান
যেভাবে ছবিটা এঁকেছিল, সেটাই আমার স্নায়ু, অনুভূতি, এমনকি চেতনা পার হয়ে বোধহয়
আত্মাকেও ভয় পাইয়ে দিয়েছিল! স্রেফ কল্পনা থেকে ওই জিনিস আঁকতে গেলে প্রতিভা-টতিভা
যথেষ্ট নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু দরকার।
ক্যানভাসের পেছনে একটা কাগজ
কখনও হয়তো পিন করে রাখা ছিল। সেটা কুঁকড়ে গিয়ে নিচে পড়ে ছিল। আমি ক্যানভাস থেকে
একরকম জোর করে অন্য দিকে তাকাতে গিয়ে কাগজটা দেখি। একটা ফটো। ওই ক্যানভাসে যার ছবি
আঁকা হচ্ছে তার পশ্চাৎপট যাতে বাস্তবের মতো হয়, সেজন্যই হয়তো তোলা হয়েছিল। সেটা
খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে একটা জিনিস খেয়াল করলাম।
পিকম্যান ভয় পেয়েছে। না,
আমার মতো নয়। কিন্তু আতঙ্কের আভাস ওর মুখে স্পষ্ট। হাত নেড়ে আমাকে চুপ করতে বলে ও
খুব মন দিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করল। আমিও ততক্ষণে বুঝতে পারছিলাম, আমার চিৎকার বেসমেন্টের নিস্তব্ধতা চুরমার করে
দেওয়ার পর কিছু একটা ঘটছে। কিন্তু সেটা কী? ভয়টা কল্পনা থেকে বাস্তবের দিকে বাঁক
নিল, যখন দেখলাম পিকম্যান একটা রিভলভার বের করল। আমাকে ওই স্টুডিওতেই রেখে ও
সেলারে পা রাখল, আর পেছনে দরজাটা টেনে দিল।
দারুণ ভয় আমাকে এক মুহূর্তের
জন্য অসাড় করে দিয়েছিল। কীসের ভয়? বলতে পারব না। তবে পিকম্যানের মতো করে আমিও কান
পেতে শোনার চেষ্টা করেছিলাম তারপর। বুঝতে পেরেছিলাম, কোত্থেকে যেন একটা আওয়াজ
আসছে। কিছু একটা সরানো হচ্ছে। ভারী কাঠের তক্তাটা কি সরিয়ে ইটের ওপর ফেলা হল? আর
কিছু একটা... না, কারা যেন চলাফেরা করছে। তাদের আওয়াজগুলো শুনে মনে হচ্ছিল, যেন
বিশাল কিছু ইঁদুর নড়েচড়ে কোথাও উঠে আসার চেষ্টা করছে। আমার সারা গায়ে কাঁটা দিল।
ভারী কাঠের তক্তাটা আবার
পড়ার শব্দ পেলাম। এবার আর ইটের ওপর নয়। ওটা কি মাটিতে পড়ল? একটা আঁচড়ের মতো
শব্দ... যেন ধারালো নখ বের করা থাবা দিয়ে কিছু একটা ধরে কেউ উঠে আসার চেষ্টা করছে!
পরমুহূর্তেই আমি পিকম্যানের মুখে দুর্বোধ্য একটা চিৎকার আর গর্জন শুনলাম। তারপর রিভলভারের
ছ’টা গুলিই ফায়ার করা হল! একটা ভোঁতা আর্তনাদ, অনেকটা ইঁদুরের কিঁচকিঁচ আর বড়ো
কিছুর হুংকারের মাঝামাঝি, শুনতে পেলাম। তারপর ধপ্ করে কিছু একটা যেন পড়ল অনেক নিচে।
তারপর আবার ভারী কাঠ সরানো হল মাটি আর ইটের ওপর দিয়ে ঘষটে-ঘষটে। তারপর কিছুক্ষণ সব
চুপ থেকে দরজাটা ধীরে-ধীরে খুলে গেল।
“আর বলবেন না!” কপালের ঘাম
মুছে বলল পিকম্যান, “কুয়োটাতে বিশাল বিশাল ইঁদুর আছে। ওরা যে কী খায় কে জানে! এক
সময় কবরখানা, সমুদ্রের ধারের পুরোনো গুহা, এ-সবের সঙ্গে এই কুয়োটার যোগাযোগ ছিল। এদের
খাদ্যাভ্যাসটা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে তার ফলে। আপনার চিৎকার শুনে উৎসাহিত হয়ে
উঠেছিল। বোঝেনই তো, এসব পুরোনো জায়গা মানেই... একটু সাবধানে থাকতে হয়, আর কি।”
এই ছিল আমার সেই রাতের
অ্যাডভেঞ্চার, ইলিয়ট। ও যে আমাকে কোন রাস্তা, কোন গলি দিয়ে এরপর নিয়ে এসেছিল, জানি
না। চোখ, মাথা, মন সবই তখন ভোঁতা হয়ে ছিল, তাই আমি কিছুই খেয়াল করিনি। চেনাজানা
পাড়ার এককোণে আমাকে পৌঁছে দিয়ে পিকম্যান চলে গেল। তারপর থেকে ওর সঙ্গে আমার আর কথা
হয়নি।
কেন?
বলছি, আগে একটু কফির
ব্যবস্থা করি। সোমরস সেবন বেশি হলে আবার...
যখন পিকম্যান আমাকে
স্টুডিওতে রেখে বেসমেন্টে পা দিয়েছিল, তখন নিজের অজান্তেই আমি সেই কাগজটা মুড়ে
আমার পকেটে ভরে ফেলেছিলাম। বাড়িতে ফিরে, হাত-পা কাঁপা বন্ধ হলে আমি যখন পোশাক
বদলাই, তখন কাগজটা হাতে নিয়ে দেখেই আমি সিদ্ধান্ত নিই যে পিকম্যানের সঙ্গে আর কোনও
যোগাযোগ রাখব না।
হ্যাঁ। আমার জ্ঞানত
শ্রেষ্ঠতম, এবং চিত্রকলার ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী রিচার্ড আপটন পিকম্যান-কে
এরপর থেকে আমি বিষবৎ এড়িয়ে চলতাম। কেন জান? কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ওর সম্বন্ধে
রিড-এর ধারণাটা ঠিক। পিকম্যানের জন্ম হয়েছে অন্ধকারে। এই অন্ধকারের ছায়া বুকে নিয়েই
ও বেড়ে উঠেছে। আর এখন যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে। ওই অন্ধকার ওকে টেনে নিয়েছে। কুয়ো
থেকে উঠে আসতে চাওয়া যে সব... প্রাণীদের ও ইঁদুর বলেছিল, তাদের মতো কিছু হওয়াই ওর
ভবিতব্য।
কাগজটা আমি পুড়িয়ে ফেলেছি।
তাই তোমাকে ওটা দেখাতে পারব না। দুঃখিত। তবে ওতে যা ছিল সেটা আমার মাথায় একেবারে
গেঁথে গেছে।
না। ওটা কোনও নিসর্গ দৃশ্য
বা অন্য কিছুর ফটোগ্রাফ ছিল না। ওটা এক লহমায় আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, কেন
পিকম্যানের ছবিতে মুখগুলো এত বাস্তব, এত নিখুঁত লাগে। কারণ ওগুলো ও কল্পনা করে
আঁকে না!!!
ক্যানভাসে যার ছবি আঁকা
হচ্ছিল, সেই বিশালকায় প্রাণীটিই ফটোতে ছিল ইলিয়ট! আর ফটোটা কোথায় তোলা হয়েছিল জান?
যে ঘরের কাঠের মেঝেতে আমি
দাঁড়িয়েছিলাম, সেই স্টুডিওতে!
আপনার সাবলীল অনুবাদের ভক্ত হয়ে পড়েছি। লাভক্র্যাফটের ঘন সন্নিবদ্ধ ভাষার অনুবাদ করা অত্যন্ত কঠিন, কিন্তু সেই কঠিন কাজও আপনি করেছেন অনায়াসদক্ষতায়। আপনার ভাষার সহজ গতি ব্রেজিলের কালো বাঘের সত্যজিৎ রায়ের কথা মনে করায়। মুগ্ধতা রইল একরাশ।
ReplyDelete