অ্যাঞ্জেলা সোমার-বোডেনবার্গ
অনুবাদঃ অনন্যা দাশ
।।
১ ।।
বারবারা
ফ্রেডির শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছিল
দু’সপ্তাহ ধরে। ওর পায়ের একটা ফোঁড়াতে ইনফেকশন হয়ে ঘা হয়ে গিয়েছিল, তাই ওকে
বিছানায় শুয়ে থাকতে হচ্ছিল। ঘা-টায় বেশ ব্যথা, আর মা যখন ব্যান্ডেজ বদল করেন তখন
তো কথাই নেই। কিন্তু ব্যথার চেয়েও বেশি বোর হওয়ার কষ্টটা ফ্রেডিকে ভোগাচ্ছিল। সারা
দিন ধরে একা একা থাকতে হয় তাকে। মা আর বাবা দু’জনেই কাজে যান।
সারা দিন শুয়ে শুয়ে হয় সে
দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে নয়তো মনে মনে গল্প বানায়। গল্পগুলো একটা ছেলে আর তার
কুকুরকে নিয়ে, সারা দিন ধরে খুব মজা করে তারা।
ওর মা দুপুর বেলা যখন বাড়ি
ফেরেন তখন এতটাই ক্লান্ত থাকেন যে ফ্রেডির সঙ্গে মোটেই খেলতে চান না। সেদিনও তাই
হল।
দুপুরের খাবারের পর ফ্রেডি
মাকে জিজ্ঞেস করল, “মা তুমি আমার সঙ্গে খেলা করবে?”
মা মাথা নাড়লেন।
ফ্রেডির মুখ কালো হয়ে গেল, সে
বলল, “অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকার মতন বাজে জিনিস আর কিছু নেই!” মা শুনে বললেন,
“আহা, আমি যদি এক সপ্তা বিছানায় শুয়ে থেকে আরাম করতে পারতাম তাহলে কী মজাই না হত!”
“মজা?” ফ্রেডি মুখ বেঁকিয়ে
বলল, “সারাটা দিন আমি একা একা বাড়িতে শুয়ে থাকি। দুপুরবেলা তুমি বাড়ি এলে, কিন্তু
আমার সঙ্গে খেলতে চাইছ না! আমাকেও তো তোমার একটু সময় দেওয়া উচিত!”
“সারাদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম,
তাই এখন খুব ক্লান্ত!” মা বললেন।
ফ্রেডি ঠোঁট কামড়ে বলল,
“তাও!”
“আচ্ছা আমি যদি একটু পরে
তোমার বিছানায় বসে তোমাকে একটা গল্প বলি তাহলে চলবে?”
“মোটে একটা গল্প?”
“হ্যাঁ, তবে ভয়ের গল্প!”
“অ্যাঁ! তুমি ভয়ের গল্প জানো
নাকি!” ফ্রেডি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“শুধু জানি যে তা নয়। এটা
আমার জীবনে ঘটেছে!”
“ও তাই নাকি, বলো বলো!”
“পরে। আগে একটু কফি খেয়ে
কাগজটায় চোখ বুলিয়ে নিই, তারপর।”
# # #
“ভয়ের ঘটনাটা কী সত্যি তোমার
জীবনে ঘটেছিল?” মা যখন ওর বিছানার কাছে এসে বসলেন তখন ফ্রেডি জিজ্ঞেস করল। ওর চোখ
দুটো উত্তেজনায় চক চক করছিল।
“হ্যাঁ!”
“আমি ছিলাম তখন?”
“হ্যাঁ, এটা দু’বছর আগের
ঘটনা, আমরা যখন বাড়ি খুঁজছিলাম তখনকার। এই বাড়িটা খুঁজে পাওয়ার আগে আমরা একটা চারটে
বেডরুমওয়ালা পুরোনো বাড়ি প্রায় ভাড়া নিয়েই ফেলছিলাম। একটা বিশাল বাড়ি আর বাগানটা
আগাছায় ভর্তি!”
“তাহলে সেটা নিলাম না কেন?”
“সেই গল্পটাই তো তোমাকে বলব! তোমার
বাবা বিজ্ঞাপনটা দেখতে পান খবরের কাগজে। ভাড়াটাও দেখা গেল আমাদের বাজেটের মধ্যে, তাই
আমরা বাড়িটা দেখব ঠিক করলাম।
তোমার বাবার অফিসে কাজ পড়ে
গেল, তাই আমি একাই গেলাম বাড়ি দেখতে। বাড়িটা যেন
একটা ছোটোখাটো ক্যাসেল! আমার তো খুব পছন্দ হয়ে গেল। এমনিতেই আমার পুরোনো বাড়ি ঘর
বেশ ভালো লাগে। বাগানটাও আমার খুব পছন্দ হল। আগাছা রয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে বেশ
বড়ো বড়ো গাছও রয়েছে দেখলাম। আমি দোতলায় উঠে গিয়ে বেল দিলাম।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর
পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম, আর একটা বাচ্চা মেয়ে এসে দরজা খুলে দিল। তার কোমর পর্যন্ত
লম্বা কালো, ঘন কোঁকড়া চুল। একটা পা অবধি সাদা লেসের জামা পরে ছিল সে। মুখটা একটু
ফ্যাকাসে মতন।
‘আপনি কী অ্যাপার্টমেন্টটা দেখতে
এসেছেন?’ মেয়েটা ভদ্রভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ,’ আমি বললাম, ‘তোমার
মা-বাবা বাড়ি আছেন?’
‘ওঁরা এখুনি চলে আসবেন,’
মেয়েটা বলল, ‘আপনি চাইলে আমি আপনাকে ঘরগুলো দেখাতে পারি। আসুন, ভিতরে আসুন।’
আমি ভিতরে ঢুকলাম।
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আপনার ছেলে-মেয়ে আছে?’
‘হ্যাঁ, একটা ছেলে।’
‘তার নাম কী?’
‘ফ্রেডি।’
সেটা শুনে মেয়েটা সেই প্রথম
অল্প একটু হাসল।
‘আমার নাম বারবারা,’ সে বলল, ‘আসুন
আমি আপনাকে ফ্রেডির ঘরটা দেখাই!’
‘আমি আগে অন্য ঘরগুলো দেখতে
চাই,’ আমি আপত্তি করে বললাম।
‘না, না, আপনাকে ফ্রেডির
ঘরটাই আগে দেখতে হবে!’ মেয়েটা জেদ করে বলল।
এমন জোর করছিল সে, যে আমি
রাজি হয়ে ওর পিছন পিছন গেলাম। সে আমাকে করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা বড়োসড়ো ঘরে
নিয়ে গেল। ঘরটা খালি, কিন্তু রঙচঙে দেওয়াল দেখে আমার মনে হল ওখানে নির্ঘাৎ কোনও
ছোটো বাচ্চা কেউ থাকত।
ঘরে ঢুকেই বারবারা ছুটে
জানালার কাছে গিয়ে হাজির হল।
‘এই খানে আমার টেবিলটা ছিল,’
সে বলল, ‘আমি দূরের ওই চেস্টনাট গাছটাকে দেখতে পেতাম এখানে বসলেই। আপনার
ছেলেকেও কিন্তু এই জানালার ধারে বসতে হবে, কেমন? আপনি কথা দিচ্ছেন তো?’
“আমি কেমন ঘাবড়ে গিয়ে বোকার
মতো হেসে বললাম, ‘ঠিক জানি না!’
‘প্লিজ!’ মেয়েটা বড়ো বড়ো চোখ
করে আমার দিকে তাকিয়ে কেমন যেন কাকুতি মিনতি করতে লাগল।
‘ঠিক আছে তুমি বলছ যখন!’ আমি
ওর মন রাখার জন্য বললাম। আমরা কেমন করে আসবাবপত্র সাজাব সেটা তো আমাদের ইচ্ছে, তাই
না?
‘আর ওই দিকে আমার খাটটা ছিল,’
জানালার পাশের দেওয়ালটার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে মেয়েটা বলল, ‘সকালবেলা ঘুম থেকে
উঠেই আমি আকাশটাকে দেখতে পেতাম। তখন বুঝতে পারতাম দিনটা ঝকঝকে না মেঘলা।’
‘কিন্তু ওই জায়গাটা তো বিছানা
রাখার জন্য ঠিক ভালো নয়!’
মেয়েটা বেশ অবাক হয়ে আমার
দিকে তাকাল, ‘কেন?’
‘জানালা দিয়ে হাওয়া আসতে পারে
তো, তখন ঠান্ডা লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে!’
‘ঠান্ডা লাগা! আপনি কী বলতে
চান যে আমার মা আমার যত্ন নেননি ঠিক করে?’
‘না, না, আমি তা বলিনি!’ আমি
তাড়াতাড়ি বললাম যাতে ও কিছু মনে না করে।
‘কিন্তু এই যে আপনি বললেন যে
ওই জায়গাটা খাট রাখার পক্ষে ঠিক নয়!’
‘আমি এমনি কথার কথা বলছিলাম।’
‘আমার মা’র সম্পর্কে কোনও
বাজে কথা আমি শুনতে চাই না!’ ওর গলাটা কেমন যেন শোনাল!
‘কিন্তু আমি তো তোমার মাকে
নিয়ে কিছুই বলিনি!’ আমি বললাম – আর ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরের বাইরে থেকে কাদের যেন গলার
স্বর শুনতে পেলাম আমি।
‘ও, তোমার মা-বাবা মনে হয়
ফিরে এসেছেন!’ বলে আমি তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। জানি কথাটা বোকা বোকা শোনাবে,
কিন্তু মেয়েটাকে আমার ভারি অদ্ভুত লাগছিল!
বাইরে বেরিয়ে দেখলাম, একজন
মহিলা আর একজন ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। একটু অদ্ভুত লাগছিল ওঁদের, কারণ ওরা
আপাদমস্তক কালো পোশাক পরে ছিলেন। ভদ্রলোকের চুল কিছুটা বারবারার মতন, কুচকুচে কালো
আর মহিলার চোখগুলো অবিকল মেয়েটার মতন।
‘ও, আপনি চলে এসেছেন!’ মহিলা
আমাকে বললেন অবাক হয়ে।
‘আপনি ভিতরে ঢুকলেন কী করে?
আমি তো দরজাটা বন্ধ করে গিয়েছিলাম!’ ভদ্রলোক বললেন।
আমি বলার চেষ্টা করলাম যে
ওঁদের মেয়ে বারবারা আমাকে দরজা খুলে ঢুকতে দিয়েছে, কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই ওঁরা
দু’জনে আমাকে বাড়িটা দেখাতে শুরু করলেন। দুটো বসবার ঘর, শোওয়ার ঘর আর বাথরুমটা
দেখালেন। তারপর রান্নাঘরে নিয়ে গেলেন আমাকে। খুব সুন্দর টাইল দেওয়া রান্নাঘর। এবার
ভদ্রলোক আমার দিকে ফিরে তাকালেন। ওঁর মুখটাও বারবারার মতন ফ্যাকাসে! আমাকে জিজ্ঞেস
করলেন, ‘ফ্ল্যাটটা আপনার পছন্দ হয়েছে?’
আমি খুশি হয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ!
একটু পুরোনো ধাঁচের, ঠিক যেমনটা আমার পছন্দ! খুব খোলামেলাও বটে!’
‘আরেকটা ঘর আছে,’ ভদ্রলোক
বললেন, ‘ওই দিকটায়, করিডোরের একদম শেষে, কিন্তু আমরা ইদানীং আর ওই ঘরটায় যাই না।’
‘ওটা আমাদের মেয়ের ঘর ছিল,’
মহিলা ধরা গলায় বললেন।
‘হ্যাঁ, আমি জানি তো!’ আমি
বললাম, আমার একটু অদ্ভুত লাগছিল যে ওঁরা ওই রকম করে ওই খালি ঘরটার কথা বলছে কেন?
‘কী?’ মহিলা আমতা আমতা করে
বললেন, ‘আপনি ওই ঘরটা দেখেছেন?’
‘হ্যাঁ, আপনাদের মেয়েই তো
আমাকে ওই ঘরটা দেখাল!’
মহিলা অদ্ভুতভাবে আমার দিকে
তাকালেন, ‘আমাদের মেয়ে?’
‘হ্যাঁ,’ আমি মাথা নাড়লাম, ‘ওই
তো আমাকে বলছিল ঘরটা্কে কীভাবে সাজাতে হবে!’
‘কী রকম দেখতে ছিল তাকে?’
ভদ্রলোক ধরা গলায় বললেন।
আমি খুব আশ্চর্য হলাম ওই
প্রশ্ন শুনে।
‘লম্বা কালো চুল ছিল তার, আর
সাদা লেসের একটা জামা পরে ছিল!’
‘বারবারা!’ বলে ডুকরে কেঁদে
উঠলেন মহিলা। এত কষ্ট ছিল ওনার স্বরে যে আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম।
এরপর ওঁরা দু’জন রান্নাঘর
থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে ওই খালি ঘরটার দিকে চলে গেলেন বারবারার নাম ধরে চিৎকার
করতে করতে!
আমার বেশ অস্বস্তি লাগছিল। ওঁরা
কেন এত উত্তেজিত হয়ে পড়লেন বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম যে আমার
বারবারার কথা বলাটাই ওঁদের উত্তেজনার কারণ।
ধীরে ধীরে আমিও সেদিকেই গেলাম।
বারবারার ঘরের দরজার সামনে
দাঁড়িয়ে ছিলেন ওঁরা দু’জন।
‘নাহ, ও তো নেই এখানে,’
ভদ্রলোক হতাশ স্বরে বললেন।
‘আমি কিন্তু সত্যিই ওকে
দেখেছি!’ আমি বললাম, ‘ও ওইখানে জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, ওই চেস্টনাট গাছটার
কথা বলছিল।’
‘আপনি কিছু ভুল করছেন,’ মহিলা
মাথা নেড়ে বললেন।
‘না, না আমি শিওর, আমার ভুল
হয়নি!’
‘আপনি ভুল করছেন, কারণ আপনি
যা বলছেন সেটা হতে পারে না! অসম্ভব!’
‘কিন্তু কেন?’
‘বারবারা মারা গেছে!’ ভদ্রলোক
দুম করে বললেন।
‘মারা গেছে?’ আমি ভীষণ অবাক
হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘হ্যাঁ, চার সপ্তা হল,’
ভদ্রলোক আমাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘এখানেই, এই ঘরেই তার মৃত্যু হয়েছিল, নিমোনিয়া হয়ে
গিয়েছিল তার!’
‘না!’ আমি ভয়ে চিৎকার করে
উঠলাম!
ওঁরা দু’জন আমার দিকে তাকিয়ে ‘হ্যাঁ’
বলে মাথা নাড়লেন।
আমি পিছন ফিরে দৌড় দিলাম!”
এতটা বলে ফ্রেডির মা থামলেন।
তারপর বললেন, “ওই ঘটনাটার এক সপ্তাহ
পর আমরা এই অ্যাপার্টমেন্টটা পেয়ে গেলাম। আর ভাগ্য ভালো বেল বাজাতে এখানে কোনও ভূত
এসে আমাদের জন্য দরজা খুলে দেয়নি!”
“বারবারাকে কী ভূতের মতন দেখতে
ছিল?” ফ্রেডি জিজ্ঞেস করল।
“খুব ফ্যাকাসে আর রুগ্ন দেখতে
লেগেছিল ওকে, যেন সে অনেক দিন ধরে অসুখে ভুগছে, সেই রকম।”
“আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওনি
কেন?”
“তুমি স্কুলে ছিলে সেই জন্যে।
এবার আমাকে যেতে হবে। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে,” বলে ওর মা উঠে দাঁড়ালেন।
ফ্রেডির মুখ কালো, কিন্তু
কিছু বলল না।
মা রান্নাঘরে গিয়ে খুটুর-খাটুর
করে কাজ করছিলেন সে শুনতে পাচ্ছিল।
“মা!” ফ্রেডি ডেকে বলল।
“আবার কী হল?”
“বারবারার খাটটা জানালার খুব
কাছে ছিল বলেই কী ওর নিমোনিয়া হয়ে গিয়েছিল?”
“জানি না!”
“এটা কী সত্যি যে ওর মা ওর
ঠিক মতন দেখাশোনা করেনি?”
“আমি জানি না!”
ফ্রেডি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমারও নিমোনিয়া হয়ে যেতে পারে যদি তোমরা ঠিক মতন আমার দেখাশোনা না করো!”
ওর মা কোনও উত্তর দিলেন না।
ফ্রেডি চোখ বন্ধ করে আবার
দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
।।
২ ।।
হ্যারি
সন্ধে ছ’টার সময় ফ্রেডির বাবা
অফিস থেকে ফিরলেন রোজকার মতন।
ফ্রেডি বাবাকে জিজ্ঞেস করল,
“বাবা, তুমি কোনও ভয়ের গল্প জানো?”
“কী জানি?”
“আরে বাবা ভয়ের গল্প,” ফ্রেডি
বলল, “তোমার জীবনে কোনও ভয়ের ঘটনা ঘটেছে?”
“সে তো রোজই ঘটে!” ওর বাবা
উত্তর দিলেন, “একটা লোক ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফেরে আর তাকে গল্প বলতে হয়!”
“তুমি খুব দুষ্টু লোক! তোমার
কী মনে হয় আমার সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে ভালো লাগে?”
“না, সেটা মনে হয় না,” বলে
বাবা কাছে এসে ফ্রেডির পা-টা দেখতে লাগলেন, “এখন কেমন আছে পা-টা? ঠিক হয়েছে?”
“পা-টা অনেকটাই ভালো আছে,”
ফ্রেডি বলল, “তবে মনটা খারাপ, আরও বেশি করে বোর হচ্ছি!”
“ঠিক আছে, রাতের খাবার পর না
হয় তোমাকে একটা গল্প বলব।”
“বেশ ভয়ের গল্প তো?”
“ঠিক আছে, যদি ভয় পেতে চাও
তাহলে হ্যারির গল্পটা বলব তোমাকে!”
রাতের ডিনারের পর বাবা
ফ্রেডির বিছানার পাশে বসে গল্পটা বলতে শুরু করলেন, “আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমি
অঙ্কে খুবই কাঁচা ছিলাম। এতটাই কাঁচা যে ফেল করে একই ক্লাসে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা
ছিল! তারপর একদিন আমাদের ক্লাসে একটা নতুন ছেলে এল। সে একটু অন্যরকম ছিল।”
“অন্যরকম মানে?” ফ্রেডি
জিজ্ঞেস করল।
“কী করে বোঝাব! হ্যারিকে কেমন
দেখতে লাগছে সে নিয়ে ও পরোয়া করত না। ওর একটাই সেট জামাকাপড় ছিল মনে হয়, সেটাই রোজ
পরে আসত সে স্কুলে। সেকেলে মতন ফ্যাশানের কালো শার্ট আর প্যান্ট! ঘাড় পর্যন্ত
লম্বা চুল, কোনোদিন চুলে শ্যাম্পু করেছে বলে মনে হত না। মুখটাও কেমন যেন একটা
ফ্যাকাসে গোছের। এছাড়া ওর গা দিয়ে অদ্ভুত একটা গন্ধ বেরোত, যে জন্য ক্লাসের কেউ ওর
পাশে বসতে চাইত না, শুধুমাত্র অঙ্ক টেস্টের দিন ছাড়া। তার কারণটা হল হ্যারি অঙ্কে
দুর্দান্ত ভালো ছিল। আমার টিচারও মাঝে মাঝে ওর প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতেন!
এবার যেটা হল, হ্যারি অল্প
দিনের মধ্যেই টের পেয়ে গেল যে আমি অঙ্কে ভীষণ রকম কাঁচা। সে আমাকে বলতে লাগল যে সে
আমাকে অঙ্ক শিখিয়ে দেবে। এটাও বলল যে ওকে কোনও পয়সা দিতে হবে না!
ও অনেকবার ওই কথাটা বলত, আর আমি
প্রতিবারই না করে দিতাম। আমার মনের ভিতর থেকে কেউ যেন একটা আমাকে না বলতে বলত।
কিন্তু তারপর একদিন খুব শক্ত শক্ত কয়েকটা অঙ্ক দিলেন টিচার হোমওয়ার্কে, তখন আমি বাধ্য
হয়ে ওর কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
‘তোর প্রচুর উপকার হবে দেখবি!’
হ্যারি তার খসখসে গলায় বলল।
‘কোথায় শেখাবি অঙ্ক? তোর
বাড়িতে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘না!’ হ্যারি যেন একটু
তাড়াতাড়িই বলল, ‘আমার বাড়িটা ঠিক সুবিধার নয়! তোর বাড়িতে গেলে কেমন হয়? তোর নিজের
আলাদা ঘর আছে?’
আমি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম।
‘তোর মা-বাবা তোকে বাড়িতে একা
রেখে যায়?’
‘হ্যাঁ, মা দুপুরের দিকে কাজে
যান, তাই বাড়িতে থাকেন না। কিন্তু তুই আমাদের একা থাকতে বলছিস কেন?’
‘আরে বাবা, তাহলে কেউ বিরক্ত
করার থাকবে না, আবার কেন!’ হ্যারি হেসে বলল।
তখন আমি ওর কথায় বিশ্বাস
করেছিলাম। যদিও হ্যারির সঙ্গে একা বাড়িতে থাকার ব্যাপারটা খুব একটা সুবিধার মনে
হচ্ছিল না আমার।
তারপর আমার মনে হল, ও তো
আমারই বয়সেরই একটা ছেলে, কীই বা করতে পারে? তাই আমি ওকে বিকেল চারটে নাগাদ আমাদের
বাড়িতে আসতে বললাম। মা চারটে বাজার একটু আগেই কাজে বেরিয়ে যান বলে।
মা বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক পরেই
হ্যারি এসে দরজায় বেল দিল। চারটের বেশ আগেই চলে এসেছিল সে। আমার
মনে হল, সে আমাদের বাড়ির ওপর নজর রাখছিল। মাকে বেরিয়ে যেতে দেখেই এসে হাজির হয়েছে।
কিন্তু আমি মুখে কিছু বললাম না।
আমি ওকে আমার পড়ার ঘরে নিয়ে
গেলাম। ওর গায়ের ওই উৎকট গন্ধটা সেদিন যেন আরও প্রবল মনে হচ্ছিল। আমার হঠাৎ মনে হল
আমার দম আটকে আসছে, তাই আমি দুম করে ঘরের একটা জানালা খুলে ফেললাম।
হ্যারি একদৃষ্টে আমার দিকে
চেয়ে ছিল।
‘কী ব্যাপার? কিছু ঝামেলা
হচ্ছে?’ সে জিজ্ঞেস করল।
‘না, না!’ বলে আমি তাড়াতাড়ি
ওর কাছে গিয়ে বসলাম।
বই খুলে হ্যারি আমাকে অঙ্ক
শেখাতে লাগল। এক ঘন্টা পর হ্যারি বলল সেদিনকার মতন পড়া হয়ে গেছে। আমারও তাই মনে
হল। এত ক্লান্ত লাগছিল আমার যে কী বলব। আমি বইয়ের ওপরেই ঘুমিয়ে পড়ছিলাম প্রায়!
আমার যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন
দেখলাম ছ’টা বেজে গেছে। হ্যারি নেই, কিন্তু মা ফিরছেন। দরজা খোলার শব্দ পেলাম।
পরের দিন স্কুলেও আমার
ক্লান্ত লাগছিল, কিন্তু টিচার আমাকে ব্ল্যাকবোর্ডে ডেকে যে অঙ্কটা করতে বললেন সেটা
আমি পেরে গেলাম, আগের দিনই হ্যারি সেটা আমাকে শিখিয়েছিল বলে।
সেদিন দুপুরেও হ্যারি আমাকে
অঙ্ক শেখাল।
আমার ঘরের বড়ো পড়ার টেবিলটায়
আমরা পাশাপাশি বসে বসে অঙ্ক করলাম। সেদিন আমি ওর গায়ের দুর্গন্ধটাকে প্রায় খেয়ালই
করলাম না। ওর অদ্ভুত খসখসে গলার স্বরটাও আমার গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল।
হ্যারি ভাল পড়াতে পারত সে
বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সেই প্রথম আমার মনে হতে লাগল যে আমি অঙ্ক বিষয়টা কিছুটা
বুঝতে পারছি!
আমরা বেশ অনেকগুলো অঙ্কই করে
ফেললাম, কিন্তু আগের দিনের মতনই আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন হ্যারির
পাত্তা নেই। আমি আমার অঙ্কের খাতাটা বন্ধ করে তুলে রাখতে গিয়ে দেখলাম শেষ অঙ্কটার
তলায় দু’ফোঁটা রক্ত! আমি আমার হাতে খুঁজে দেখলাম, নাহ, কোথাও কাটা-টাটা নেই তো!
পরের দিন ক্লাসে অঙ্কের কুইজ
ছিল। আমি অর্ধেকের বেশি অঙ্ক করে ফেললাম।
আমি সি পেলাম। অনেক দিন পর
অঙ্কে পাশ করলাম আমি!
হ্যারি আমার প্রশংসা করল, তবে
এটাও বলল যে ওর কাছে অঙ্ক শেখা বন্ধ করলে চলবে না, তাহলে আমি সব ভুলে খেয়ে ফেলব।
তাই প্রতি দুপুরবেলা আমার
অঙ্ক শেখা চলল।
আর প্রতিদিন আমি ঘুমিয়ে
পড়তাম। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব লজ্জার হচ্ছিল, কিন্তু হ্যারি কখনোই সেটা নিয়ে
কিছু বলত না।
এদিকে অঙ্কে আমি ক্রমে বেশ ভালো
হয়ে উঠছিলাম। আমাদের অঙ্কের স্যার, যিনি ভাবতেন আমি অঙ্কে ফেল করব, তিনিও বেশ আশ্চর্য
হলেন। তিনি অবশ্য জানতেন না যে হ্যারি আমাকে পড়াচ্ছে। আমাদের ক্লাসের অন্যরাও কেউ
জানত না। আমি কাউকেই কথাটা বলিনি, মাকেও না। মা জানতেন না যে রোজ দুপুরে হ্যারি
আমাদের বাড়িতে আসে। মা শুধু দেখতেন যে আমি অঙ্কে ভালো করছি আর সব সময় খুব ক্লান্ত
থাকি।
কয়েকদিন পর থেকে আমি রাতের
খাবার টেবিলেও ঘুমিয়ে পড়তে লাগলাম। আমার মাথাটা সামনের দিকে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ত
আর মা যখন আমাকে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করতেন আমার শরীর খারাপ লাগছে কিনা তখন আমার ঘুম
ভাঙত।
শেষমেশ মা আমাকে একজন
ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা করে বললেন যে আমার ভয়ঙ্কর রকম অ্যানিমিয়া
হয়েছে আর বেশ কিছু ওষুধ খেতে দিলেন। দিনে তিনটে করে বড়ি খেতে হত আমাকে।
তাও আমার ক্লান্তি যাচ্ছিল
না! একবার তো এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম যে এক সপ্তাহ স্কুলেই যেতে পারলাম না।
বিছানায় শুয়ে থাকতে হল বাড়িতে।
সেই সপ্তাহ কিন্তু হ্যারি এল
না। সে হয়তো জানতে পেরেছিল যে মা-ও সেই সপ্তাহটা কাজ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে রয়েছেন
আমার সঙ্গে।
এক সপ্তাহর মধ্যে আমার শরীর
এতটাই চাঙ্গা হয়ে উঠল যে ডাক্তারবাবুও অবাক হয়ে গেলেন!
আমি যখন স্কুলে ফিরে গেলাম
তখন শুনলাম যে হ্যারিও দু’দিন স্কুলে আসেনি। তার শরীর খারাপ হয়েছে কিনা কেউ জানে
না। আমি ঠিক করলাম সেদিন দুপুরবেলা ওর বাড়ি গিয়ে ওকে দেখে আসব।
টিচারের কাছ থেকে ওর ঠিকানাটা
নিয়ে নিলাম আমি।
হ্যারির বাড়ি শহরের আরেক
প্রান্তে। সেখানে যেতে যেতে আমার মনে হল হ্যারি যদি অত দূরেই থাকে তাহলে আমাদের
স্কুলে পড়তে আসছে কেন? ওর তো পাড়ার স্কুলেই যাওয়া উচিত। এখানে তো পাড়া ধরে স্কুলে
যায় ছেলেমেয়েরা! অনেক কষ্টে আমি হ্যারিদের পাড়াতে গিয়ে পৌঁছলাম।
একটা সরু অন্ধকার মতন রাস্তা।
দু’পাশে ধূসর উঁচু অ্যাপার্টমেন্টের সারি! জায়গাটাকে এতটাই ভয়াবহ দেখতে যে আমার
পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল।
হ্যারির বাড়ি গলির একদম শেষের
বাড়ির আগেরটা। একটা বড়ো বিল্ডিং বটে, কিন্তু সেটার দশা বেশ খারাপ। বাইরের
প্লাস্টার খসে পড়ছে, জানালাগুলো থেকে রঙ চটে গেছে। সামনের দরজাটার অবস্থাও বেশ
খারাপ। কারা কারা থাকে তাদের নামগুলো পড়তেই পারা যাচ্ছে না।
বুঝলাম যে হ্যারি কোন বাড়িতে
থাকে সেটা জানতে হলে আমাকে প্রতিটা দরজায় গিয়ে গিয়ে কড়া নাড়তে হবে! দরজা খুলে আমি
দেখলাম ভিতরে একটা লম্বা অন্ধকার মতন করিডোর। সেই অন্ধকারের মধ্যে দেখলাম একটা মস্ত
কালো মতন কী পড়ে রয়েছে। আমার বুকটা ধুকপুক করতে শুরু করল। তারপর বুঝতে পারলাম ওটা
একটা মোপেড! আমি হেঁটে হেঁটে চারিদিকে দেখতে লাগলাম কিন্তু অ্যাকারম্যান
(হ্যারিদের পদবি) নামটা কোথাও দেখতে পেলাম না। সব থেকে ওপরের তলাটায় গিয়ে দেখলাম
একটা দরজায় লেখা ওয়াইল্যান্ড আর অন্যটায় স্টাইন। আমি এক মিনিট ভেবে স্টাইন লেখা
দরজাটায় বেল দিলাম। একজন অল্পবয়সি মহিলা একটা ছোটো বাচ্চাকে কোলে
নিয়ে দরজাটা খুললেন। আমাকে দেখে তাঁর ভ্রু কুঁচকে গেল, ‘কাকে চাই?’
‘আমি আমার এক সহপাঠীর বাড়ি
খুঁজছি!’ আমি লজ্জা পেয়ে বললাম।
‘তো?’ মহিলা রুক্ষভাবে বললেন।
‘ওর নাম হ্যারি, হ্যারি
অ্যাকারম্যান।’
‘নাহ, আমি চিনি না।’
‘কিন্তু ও এই বিল্ডিংটাতেই
থাকে!’
মহিলা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘ওই
সামনের ওয়াইল্যান্ডদের গিয়ে জিজ্ঞেস করো। ওরা এখানে তিরিশ বছর ধরে রয়েছে। আমরা তো
মোটে ছ’মাস হল এসেছি এখানে!’ বলে মহিলা দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
অগত্যা আমি ওয়াইল্যান্ডদের
দরজার বেল টিপলাম। কিছুক্ষণ পর পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম।
‘কী চাই?’ ভিতর থেকে একজন
জিজ্ঞেস করল।
‘আমি আমার এক সহপাঠীকে
খুঁজছি!’ আমি উত্তর দিলাম, ‘তার নাম হ্যারি অ্যাকারম্যান।’
এবার দরজাটা খুলে গেল। একজন
বয়স্ক ভদ্রলোককে দেখতে পেলাম আমি। সঙ্গে একটা বিশাল মোটাসোটা কালো বেড়াল। ‘ওরা আর
থাকে না এখানে।’
‘কিন্তু আমাদের টিচার তো এই
ঠিকানাটাই দিলেন,’ আমি উত্তর দিলাম।
‘হ্যারি অ্যাকারম্যান!’ লোকটা
এক দলা থুতু ফেলে যে ভাবে হ্যারির নামটা বলল তাতে বোঝা যাচ্ছিল যে সে হ্যারিকে
মোটেই পছন্দ করে না!
‘ওর বেচারি মা, বেচারি বোন!’
আমার গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে
গেল।
‘কী হয়েছিল ওর মা আর বোনের?’
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘চলে গেল, সবাই চলে গেল!’ লোকটা
বলল।
‘মানে?’
‘মানে দু’জনেই অসুস্থ হয়ে
মারা গেল, ক্লোরোসিস!’
‘ক্লোরোসিস?...’ আমি কিছুই
বুঝছিলাম না।
‘প্রথমে ওর মা’র হল। দিন কে
দিন দুর্বল হয়ে পড়ছিল, তারপর তো মারাই গেল। ওর বোনেরও হল একই অসুখ। সেও দু’সপ্তার
মধ্যেই মারা গেল!’
‘মারা গেল?’
‘হ্যাঁ!’
আমার খুব মায়া হচ্ছিল হ্যারির
জন্য। আমি তো জানতামই না যে বেচারার বাড়িতে এত সমস্যা!
‘হ্যারিরও কি শরীর খারাপ
হয়েছিল নাকি?’
লোকটা শুকনো হাসি হাসল, ‘নাহ,
ওর কিছুই হয়নি, বরং আরও বেশি হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠছিল দিন কে দিন! আমরা কয়েকজন তো মনে
করতাম...’ বলে গলা নামিয়ে লোকটা বলল, ‘আমরা মনে করতাম যে ওই ওর মা আর বোনের অসুখের
জন্যে দায়ী!’
‘ও কী করে...’
‘যাই হোক, ওর বোন মারা যাওয়ার
পরের দিন থেকেই হ্যারি হাওয়া।’
‘হাওয়া?’ আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম।
‘হ্যাঁ, তারপর থেকে আমি আর
ওকে দেখিনি।’
‘কিন্তু ও যে আমার ক্লাসে
পড়ে...’
বয়স্ক লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে
হেসে বলল, ‘তোমার বয়স কত?’
‘পনেরো!’
‘তাই নাকি? হ্যারির বয়স এখন
কম করে চল্লিশ তো হবেই! আমি তোমাকে যা যা বললাম সব পঁচিশ বছর আগে ঘটেছিল!’
‘অসম্ভব!’ আমি চিৎকার করে
উঠলাম, তারপর কী জানি ভেবে থেমে গেলাম। হঠাৎ জিগ স পাজলের টুকরোগুলো খাপে খাপে বসে
যাচ্ছিল যেন। হ্যারির পুরোনো ধাঁচের জামাকাপড়, ওর গায়ের বোঁটকা গন্ধ, প্রথম দিকে
আমার ওকে বিশ্বাস না করতে পারা, প্রতি বার ওর সঙ্গে পড়তে বসে আমার ঘুমিয়ে পড়া,
প্রবল ক্লান্তি, অঙ্কের খাতায় রক্তের ফোঁটা, ডাক্তারের কথাগুলো...
‘ক্লোরোসিস অসুখটা কী রকম?’
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘ওটা অ্যানিমিয়ার আরেক নাম!’
লোকটা বলল।
আমার মনে হচ্ছিল আমার
চারিদিকটা যেন কুয়াশাতে ছেয়ে গেছে! আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছিল। মনে হচ্ছিল আমি বুঝি
বা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব! আমি আর কোনও কথা না বলে পিছন ফিরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে
গেলাম, আমার পা কাঁপছিল!
কোনও রকমে বাড়ি ফিরেছিলাম
আমি। মা আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। বলতে লাগলেন, ‘কেন যে আমি তোকে বাইরে যেতে
দিলাম এই অবস্থায়!’
এরপর আর আমি কোনোদিন হ্যারিকে
দেখিনি – আর আমার অ্যানিমিয়াও হয়নি আর কোনোদিন!”
ফ্রেডির বাবা গল্পটা শেষ করে
থামলেন।
“কী? ভালো লাগল গল্পটা?” উনি
জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ!” ফ্রেডি জবাব দিল,
“কিন্তু এটা কি সত্যি ঘটনা?”
ওর বাবা হাসলেন, “তুমি ভয়ের
গল্প শুনতে চেয়েছিলে, তাই আমি তোমাকে একটা ভয়ের গল্প শুনিয়ে দিলাম।”
ফ্রেডি ভাববার চেষ্টা করতে
লাগল কী করে বাবার কাছ থেকে সত্যি কথাটা বার করবে!
“তুমি কী সত্যিই অঙ্কে ফেল
করছিলে? মা তো বলে যে তুমি অঙ্কে খুব ভালো!”
“সে তো হ্যারি আমাকে সব
শিখিয়ে দিয়েছিল বলে!” বাবা হাসলেন।
“তার মানে হ্যারি সত্যি
সত্যিই ছিল!”
“নিশ্চয়ই!”
“আর ও কী ভ্যাম্পায়ার ছিল?”
“জানি না, হয়তো! যাই হোক আমি
অঙ্কে সে যাত্রা পাশ করে গিয়েছিলাম, সেটাই তখন আমার লক্ষ্য ছিল!” ফ্রেডির বাবা এতটা
বলে উঠে দাঁড়ালেন।
“আরেকটা ভয়ের গল্প বলো!” ফ্রেডি
বায়না ধরল, “শুধু আরেকটা!”
“এবার তুমি নিজে থেকে নিজের
পছন্দ মতো গল্প বানাও!”
“অতই যদি সোজা হত...”
_____
লেখক পরিচিতিঃ অ্যাঞ্জেলা
সোমার-বোডেনবার্গের (ডিসেম্বর ১৮, ১৯৪৮) জন্ম রেইনবেক বেই হ্যানবার্গ, পশ্চিম
জার্মানিতে। বারো বছর স্কুলে শিক্ষকতা করে ছোটোদের জন্য প্রচুর ভূতের গল্প লিখেছেন
অ্যাঞ্জেলা। ‘দা লিটিল ভ্যাম্পায়ার’ নামের একটি টেলিভিশন সিরিজের কনসালটেন্ট
হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। সেই সিরিজটা প্রচুর খ্যাতি অর্জন করে এবং সেই সুবাদে ১৯৯২
সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। অ্যাঞ্জেলা সিলভার সিটি, নিউ মেক্সিকোতে
থাকেন স্বামী আর কন্যার সঙ্গে।
_____
ছবিঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment