গল্পের ম্যাজিক:: রহস্যময় ইরেজার - অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়


রহস্যময় ইরেজার
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

পেনসিল বক্সের ভিতর একটা সুন্দর ইরেজার যে কোথা থেকে এল, গত দুদিন ধরে ক্রমাগত ভেবে চলেছে শ্রেয়া হালকা সবুজ রঙের ইরেজারটা কিন্তু ওর নিজের নয় তবে কি দময়ন্তীর বক্স থেকে ওর কাছে চলে এসেছে? মাঝে মাঝেই শ্রেয়ার মনে হচ্ছে, ইরেজারটার থেকে কেমন যেন হালকা নীলাভ একটা আলো দেখা যাচ্ছে কে জানে, মনের ভুলও হতে পারে কিন্তু পড়তে পড়তে এক-আধবার আড়চোখে না দেখেও থাকা যাচ্ছে না কেমন যেন চুম্বকের আকর্ষণ আছে ছোট্ট ইরেজারটায় হাতে তুলে নাড়াচাড়াও করে দেখেছে কয়েকবার খাতার উপর পেনসিল দিয়ে কিছু আঁকিবুকি কাটল শ্রেয়া তারপর দাগগুলো ইরেজার দিয়ে মুছে দিতে গিয়ে বোঝা গেল, উঁহু, এটা সাধারণ ইরেজারের মতো নরম নয় পেনসিলের দাগ তো গেলই না, জিনিসটা বেশ শক্ত হওয়ায় মাঝখান থেকে খাতার পাতাটাই গেল ছিঁড়ে
দময়ন্তী শ্রেয়ার সবচাইতে কাছের বন্ধু পড়াশুনোতেও ওর চাইতে অনেক অনেক বেশি ভালো প্রতি বছর ক্লাসে ফার্স্ট হয় আবার খেলাধুলোতেও তেমনই ভালো স্পোর্টসের মাঠে সবকটা বিভাগে দময়ন্তী নাম দেয়, আর সব বিভাগে ফার্স্ট প্রাইজ ভোজবাজির মতো কেমন করে যেন ওর হাতে এসে যায় দময়ন্তীকে নিয়ে শ্রেয়ার দারুণ গর্ব ক্লাসের টিচাররাও দময়ন্তীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ অঙ্কের টিচার দীপিকা-ম্যাম বলেন, “বন্ধুকে দেখে শেখো পড়াশুনো কী করে করতে হয় ওর পাশে বসে বসে অঙ্কটাও তো শিখে নিতে পার! এভাবে পাশ করবে কী করে? সামনের বছর বোর্ডের পরীক্ষা, সে খেয়াল আছে?”
শ্রেয়া আগে এমন কথায় বিব্রত বোধ করত এখন কেমন যেন গায়ে সয়ে গেছে আসলে বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রায়ই এমন কথা, কী স্কুলে, কী বাড়িতে তাকে শুনে থাকতে হয় আর শুনতে শুনতে প্রথম প্রথম নিজের উপর রাগ ধরেছে, তারপর একদিন অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে তবে এসব ব্যাপার কিন্তু শ্রেয়া আর দময়ন্তীর বন্ধুত্বে এতটুকু চিড় ধরাতে পারেনি
শ্রেয়ার ভালো লাগে গান গাইতে বাড়িতে একজন গান শেখানোর মাস্টারমশাই আসেন সপ্তাহে দু’দিন সেই দুটো দিন ওর সবচাইতে প্রিয় পড়াশুনো থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মুক্তি বাকি দিনগুলো সে নিজে গানের রেওয়াজ করে মা বলে, ভোরবেলা উঠে গলা সাধলে নাকি লতা মঙ্গেশকরের মতো গায়িকা হওয়া যায় কিন্তু শ্রেয়ার সকালে উঠতে বেজায় আলসেমি চোখ থেকে ঘুম যেন যেতেই চায় না দুয়েকবার চেষ্টা করে দেখেছে কিন্তু হারমোনিয়ামের রিডের উপর মাথা রেখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, টেরই পায়নি তাই দিনের যে কোনও সময় গান দরিয়ায় ভেসে যেতে ওর বাধা নেই
আগামীকাল শ্রেয়ার স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা তাও আবার অঙ্ক পরীক্ষা ভাবতেই শ্রেয়ার মুখটা তেতো খাওয়ার মতো বিস্বাদ হয়ে উঠল কাল থেকে কিছুতেই ট্রিগনোমেট্রির একটা ফর্মুলাও মনে থাকছে না রাগের চোটে দু’বার দেওয়ালে মাথা ঠুকে দেখেছে, তাতেও কোনও লাভ হচ্ছে না লিখে লিখে মুখস্থ করবার চেষ্টা করছে, কিছুতেই মনের পর্দায় ফর্মুলাদের স্থায়ী করা যাচ্ছে না
হঠাৎ শ্রেয়ার মনে হল, ইরেজারটা থেকে নীল আলো যেন ওর চোখে এসে পড়ল কিন্তু চৌকো ইরেজারের ভিতরে তো আর কোনও ব্যাটারি লাগানো নেই তবে আলো কী করে বেরোবে? সোজাসুজি তাকালেই কিন্তু কোনও আলো দেখা যাচ্ছে না অথচ যেই সে অঙ্কের বইখাতার দিকে মন দেওয়ার চেষ্টা করছে, অমনি মনে হচ্ছে যেন ইরেজারটা আলো ছড়াচ্ছে, যদিও খুব হালকাভাবে শ্রেয়া ভাবে, অঙ্ক পরীক্ষার ভয়ে তার মাথাটাই বুঝি খারাপ হয়ে গেছে
একবার ভাবল ইরেজারের ব্যাপারটা বাবার সঙ্গে আলোচনা করলে কেমন হয়! তারপর মনে হল, পরীক্ষার আগের দিন যদি বাবা দুয়েকটা অঙ্ক কষতে দেয়, তাহলেই চিত্তির মাকে বললে, তিনি পাগল বলে হেসে উড়িয়ে দেবেন বন্ধুদের কাউকে ফোন করে জানাতে ইচ্ছে করছে কিন্তু ওরাও অঙ্ক পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে সবার দময়ন্তী হয়তো খানিকটা বোঝে ওকে পড়াশুনোই হোক বা অন্য কোনও বিষয়, সবেতেই ওর মনোযোগ দেখে বিস্মিত হতে হয়
মোবাইল ফোনটা হাতে তুলে নিতে গিয়েও কী মনে করে আবার রেখে দেয় শ্রেয়া ইরেজারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ নিজস্ব রাখাই বোধহয় শ্রেয় হয়তো বা পুরো ব্যাপারটাই মনগড়া শ্রেয়া পড়েছে, প্রচণ্ড মানসিক চাপে নাকি মানুষ অনেক ভুলভাল দৃশ্য চোখের সামনে দেখে একে বলে ইলিউশন বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা নাকি ছোটোবেলা থেকে চোখের সামনে অনেক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেতেন সেই সময়টা তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠত
ইরেজারের ভাবনাটা মাথা থেকে জোর করে তাড়িয়ে দিল শ্রেয়া কাল পরীক্ষা, মাথায় দুশ্চিন্তা, কিন্তু ঘুম যেন ঝাঁপিয়ে এল দু’চোখ ভাসিয়ে শ্রেয়া জানতেও পারল না, কিউবয়েডের আকৃতির হালকা সবুজ রঙের ইরেজারটা থেকে নীল রঙের আলো গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠে আস্তে আস্তে ঢেকে ফেলল শ্রেয়ার গোটা শরীর
সকালবেলা শ্রেয়ার মা এসে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিলেন শ্রেয়াকেওঠ ওঠ, আজ না তোর অঙ্ক পরীক্ষা? তাড়াতাড়ি কর, এখুনি স্কুলের বাস এসে যাবে তো! বাস মিস করলে আবার তোর বাবাকে ছুটতে হবে একবার চোখ বুলিয়ে নিলে পারতিস শেষবারের মতো
চোখ বোলালেও সব ধোঁয়া কিচ্ছু মনে পড়ছে না আজ একেবারে গোল্লা, বুঝেছ?”
শ্রেয়ার কথায় ওর মায়ের মুখে কালবৈশাখীর মেঘ নেমে আসে শ্রেয়ার রেজাল্ট নিয়ে তাঁর চিন্তার শেষ নেই যে কোনও বাবা-মায়ের পক্ষে যা স্বাভাবিক, উনিও সেইভাবেই ভেবে থাকেন, শ্রেয়ার জানা আছে তাই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে নিজের উপর কেমন যেন রাগ হতে থাকে কিন্তু নিজের উপর রাগ হলে কোথা থেকে গানের সুর মনে ভেসে আসে কে জানে! আজও তার ব্যতিক্রম হল না গলা ছেড়ে শ্রেয়া গেয়ে উঠল, ‘গানে গানে, মোর বন্ধন যাক ঘুচে...
রান্নাঘর থেকে শ্রেয়ার মা চেঁচিয়ে উঠলেন, “দেখিস, গানের তোড়ে অঙ্ক না যায় ভেসে!”

অঙ্কের প্রশ্নপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রেয়ার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে চিরকাল, বুকের মধ্যে কাঁপুনি আর জল তেষ্টা পেয়ে যায় যে টিচার প্রশ্নপত্র বিলি করেন তাঁকে দেখে ভ্যাম্পায়ার ছাড়া কিছুই মাথায় আসে না আর সামনের একটা বছর বই তো নয়, তারপর তাকে আর পায় কে? অঙ্ক-টঙ্ক ছেড়ে দিব্যি তার পছন্দের সাবজেক্ট ইতিহাস আর দর্শন নিয়ে পড়াশুনো করবে, এমনটাই ভাবে শ্রেয়া
প্রথম প্রশ্ন দেখেই মনে হল, অনেক দিনের চেনা কোনও অঙ্ক খাতার পাতায় পেন চলতে থাকে অনায়াসে অঙ্কটা সুন্দরভাবে পরিণতি পায় সবগুলো স্টেপে পরের অঙ্কটাও তাই, তারপরেরটাওএইভাবেই কী করে যেন জাদুমন্ত্রের মতো একের পর এক অঙ্ক কষে যায় শ্রেয়া পরীক্ষার খাতার পাতায় মনের পর্দায় সিনেমার দৃশ্যের মতো একটা একটা দরজা খুলে অঙ্কের ফর্মুলারা দিশা দেয় প্রশ্নের উত্তরের
সব ক’টা অঙ্ক শেষ করে ফেলার পর শ্রেয়া হঠাৎ আবিষ্কার করে, এবার ওর অঙ্কে একশোয় একশো কেউ আটকাতে পারবে না এতকাল সে শুধু টায়েটুয়ে পাশ করেছে আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উত্তরপত্র দেখে নেয়, কোথাও ভুল আছে কিনা নাহ্‌, ভুল আছে বলে তো মনে হচ্ছে না
হাতঘড়িতে দেখা যাচ্ছে এখনও প্রায় আধঘণ্টা বাকি আছে পরীক্ষা শেষের ঘণ্টা বাজতে এমন কী জাদু ঘটে গেল, মাথার মধ্যে সেই চিন্তা ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভিতরে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়াটা বেশ টের পাচ্ছে শ্রেয়া উত্তরপত্র হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, দময়ন্তী তখনও লিখে চলেছে খাতার পাতায় ও কি তাহলে দময়ন্তীকে পিছনে ফেলে দেবে পরীক্ষার রেজাল্টে? পরক্ষণেই মনে হয়, ছি ছি, এমন ভাবাটাই বড়ো অন্যায় বন্ধুত্বে প্রতিযোগিতা থাকাটা একটুও শ্রেয় নয়
ঘণ্টা বেজে যাওয়ার আগেই খাতা জমা দিয়ে দেয় শ্রেয়া ডেস্কে পাহারায় বসে থাকা অঙ্কের টিচারের ভুরু কুঁচকে ওঠে মুখের কোণে একটা হাসি ফুটিয়ে শ্লেষ মেশানো সুরে জিজ্ঞেস করেন, “কী ব্যাপার শ্রেয়া, সব উত্তর করেছ, নাকি অর্ধেক ছেড়ে দিয়েছ?”
ঘাড় নেড়ে ক্লাস থেকে বাইরে পা বাড়ায় শ্রেয়া আহ্‌, আজ বাইরেটা বড়ো সুন্দর পৃথিবী কত মনোরম! গুনগুন সুরে ওর গলায় গানের সুর উঠে ছড়িয়ে পড়ে, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা, মনে মনে... মেলে দিলেম গানের সুরে এই ডানা, মনে মনে...

স্কুল থেকে ফিরে আসবার পর অনেকক্ষণ ধরে কানের ভিতরে শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে পাচ্ছিল শ্রেয়া কানে জল ঢুকে গেলে যেমন হয় বার কয়েক কান খুঁচিয়েও খুব একটা লাভ হয়নি থেকে থেকে অদ্ভুত সব আওয়াজ আসছে কানে সকাল থেকে কী সব হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না বালিশে কান চেপে, চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে শ্রেয়া নাহ্‌, হঠাৎ হুম হুম করে আওয়াজ ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে শ্রেয়া কে যেন যান্ত্রিক আওয়াজে ফিসফিস করে বলে ওঠে, “ভয় পেয়ো না শ্রেয়া, আমি তোমার কাছেই আছি
এদিক ওদিক তাকিয়ে শ্রেয়া দেখে ঘরের ভিতর কেউ নেই তবে কি তাকে ভূতে ধরেছে, নাকি সে পাগল হয়ে যাচ্ছে? উঠে পড়ে ঘরের ভিতরেই পায়চারি করতে থাকে শ্রেয়া আবার সেই কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “তুমি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছ, শ্রেয়া? আমি তোমার পেনসিল বক্সের ইরেজারের ভিতর থেকে বলছি আমি পৃথিবীর মানুষ নই প্ল্যানেট থিটা থেকে এসেছি শুনতে পাচ্ছ, শ্রেয়া?”
এবার শ্রেয়া অবাক হয়ে টেবিলে পড়ে থাকা পেনসিল বক্সের ভিতর থেকে ইরেজারটা বার করে দেখে ইরেজারের ভিতর থেকে হালকা বেগুনি আলো বেরিয়ে আসছে স্বচ্ছ জিনিসটার ভিতরে কী আছে দেখা যাচ্ছে না শ্রেয়া কথা বলতে গিয়ে দেখে বিস্ময়ে তার গলা থেকে যে আওয়াজ বেরোচ্ছে তা যেন অনেকটা বেড়ালের মিউ মিউ করার মতো গলাটা ঝেড়ে নিয়ে সেও প্রতিপ্রশ্ন করে, “তোমার নাম কী? এখানে এলে কী করে?”
আমার নাম নোরা আমি পৃথিবীতে একটা মিশনে এসেছি তোমাদের ভাষা ডিকোড করতে আর সংযোগ স্থাপন করতে কিছুটা সময় লেগে গেছে আমি যা বলছি, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে তো?”
একদম ঠিক আছে বড্ড ভালো বলছ আচ্ছা একটা কথা বলো, এত লোক থাকতে আমি কেন? আমাকেই তোমার পছন্দ হল কেন? নাকি হঠাৎ করে এসে পড়েছ?”
না পৃথিবীর সময় অনুযায়ী চোদ্দ থেকে ষোল বছরের বাচ্চাদের একটা সার্ভে করেছে আমাদের দল বাছা হয়েছে এমন মানুষদের, যাদের মনে হিংসে নেই, মনের পথ জটিল নয় আমার টাস্ক তোমার ব্রেনের উপর আমাদের প্রযুক্তি কতটা কার্যকরী সেটা অনুসন্ধান করা আজ যখন পরীক্ষা দিলে, তখন কিছু অনুভব করেছ? পারদর্শিতা বৃদ্ধি পেয়েছে কি?”
শ্রেয়া বোঝে, গ্রহান্তরের মেয়ে নোরা ল্যাঙ্গুয়েজ ডিকোড করে কেবল শুদ্ধ বাংলাটাই শিখেছে সে যাই হোক গে, শ্রেয়ার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না, কারণ শ্রেয়া ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়লেও বাংলায় ভালো সে উৎসাহী হয়ে বলে ওঠে, “তুমি অতটুকু ইরেজারের ভিতরে ঢুকলে কী করে? আর আমি তোমাকে দেখতেই বা কেন পাচ্ছি না?”
তোমার সামনের দেওয়ালে তাকিয়ে থাক আমি হলোগ্রামে নিজেকে দেখানোর চেষ্টা করছি আমার আকৃতি তোমার তুলনায় অনেক ছোটো দেখতেও তোমাদের মতো নয় আকৃতি একটা আপেক্ষিক ব্যাপার মাত্র সেটাতে কিছু আসে যায় না দেখো।
শ্রেয়ার শোবার ঘরের হালকা হলুদ রঙের দেওয়ালে প্রথমে ফুটে ওঠে একটা লাল গোল আলো আরও গাঢ় হতে হতে লাল ফুটবলের মতো গোলাকার আলো দেওয়ালের কাছ ঘেঁষে ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হতে থাকে শ্রেয়া অবাক হয়ে দেখে নোরাকে দেখতে যেন অনেকটা পিঁপড়ের মতো মাথায় দুটো অ্যান্টেনা লাগানো সেটা থেকে নীল আলো জ্বলছে নিভছে মাথাটা পিঁপড়ের মতো হলেও নোরার শরীরটা অন্যরকম, অনেকটা মাছের মতো শ্রেয়া বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে
কী শ্রেয়া, আমাকে ভালো লাগছে না? তুমি কি ক্রুদ্ধ হলে?”
নোরার কথায় হেসে ফেলে শ্রেয়া বলে, “রাগব কেন? পিঁপড়ের মতো মানুষ দেখে হাসি পাবে না!”
মানুষ তো নই আমরা মানুষ আমাদের থেকে পৃথিবীর হিসাব অনুযায়ী লক্ষ বছর পিছিয়ে ওই যে ইরেজারটার মধ্যে আমি আছি, ওটা তোমাদের ভাষায় ইরেজার, কিন্তু আসলে ওটা একটা চার মাত্রার কিউবয়েড। পৃথিবীতে পাওয়া যায় এমন উপাদান দিয়ে তৈরি নয় এর বাইরে আসার ক্ষমতা আমার নেই আর যদি চলেও আসতে পারি, পৃথিবীর আবহাওয়া আর মাধ্যাকর্ষণে ধ্বংস হয়ে যাব
সেটা বোঝা গেল কিন্তু আমাকে বলো, আমার ব্রেন নিয়ে তুমি কী করেছ?”
কিচ্ছু না শুধু একটু নার্ভগুলোয় সামান্য অদলবদল... তোমার সুবিধা হবে এবার থেকে তুমি যে কারণে অঙ্কের ফর্মুলা মনে রাখতে পারতে না, তার প্রধান কারণ হল প্রকৃত প্রশিক্ষণের অভাব মানে পড়াশুনোর যে পদ্ধতি তোমাদের আছে, তাতে মুখস্থ করে ফেলার চেষ্টা দেখা গেছে ধরো তুমি একটা সিনেমা দেখছ একের পর এক দৃশ্য দেখে মনের পর্দায় একটা আস্ত গল্প ফুটে উঠছে আস্তে আস্তে এর একটা পর্যায়ক্রম আছে পড়াশুনোর অনুশীলন ঠিক সেইরকম হলে কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না যেই আমি তোমার স্মৃতির পর্দায় ছবিগুলো সাজিয়ে রেখেছি, অমনি তুমি সব ক’টা অঙ্ক কেমন সহজভাবে সমাধান করে দিলে
নোরাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে শ্রেয়া উৎসাহী হয়ে বলে ওঠে, “তাহলে এবার থেকে আমি অঙ্কে একশোয় একশো পাবই? আহা, বাবামা যা খুশি হবে না! তুমি খুব ভালো নোরা
শুধু অঙ্ক কেন, সব বিষয়েই ঠিক এমনটাই ঘটবে আগেই বলেছি যে, তোমার মনে ঈর্ষা নেই বলেই শুধু তোমাকে বেছে নেওয়া হয়েছিল পরীক্ষা করার জন্য দেখা গেল, তোমাদের উপর করা আমাদের পরীক্ষা সফল আমরা আয়ত্ত্বে আনতে পেরেছি পৃথিবীর মানুষের মন
কিন্তু তুমি চলে গেলেই যদি আমার এই নব অর্জিত গুণ নষ্ট হয়ে যায়, যদি আমি আবার আগের মতো হয়ে যাই?”
না। আমি তোমার ব্রেন স্ক্যান করে দেখেছি, এটার স্থায়িত্ব দীর্ঘ হবে আসলে কী জানো, আমাদের মিশন হল অতীতের পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা কমানো যত প্রাণীদের মধ্যে প্রশিক্ষণের অভাবে সমান সমান বিকাশ না ঘটবে, ততই বাড়বে পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব, হতাশা আমি কি ঠিকভাবে তোমাকে বোঝাতে পারলাম, শ্রেয়া?”
শ্রেয়া মাথা নেড়ে জানায় সে বুঝতে পেরেছে কিন্তু এই মুহূর্তে নোরাকে হারাবার ভয় তাকে গ্রাস করে সে প্রশ্ন করে, “নোরা, তুমি কীভাবে ফিরে যাবে তোমার পৃথিবীতে? আর কোনোদিন কি আসবে না?”
আমি ও আমরা সবাই ফিরে যাব ওয়ার্ম হোল বেয়ে আমাদের গ্রহে, যা তোমাদের কাছে ভবিষ্যৎ ফিরে আসা হয়তো যাবে, কিন্তু তুমি ততদিনে বৃদ্ধা হয়ে যাবে
ওয়ার্ম হোল মানে, স্থান-কাল বেঁকিয়ে দিয়ে যে পথ সৃষ্টি করে মানুষ ভবিষ্যতের পৃথিবীতে পা বাড়ানোর স্বপ্ন দেখে, তার কথা বলছ?”
ঠিক তাই বিদায় বন্ধু ভালো থেকো। আমার যাওয়ার সময় এসেছে অনেক শেখা গেল পৃথিবীর মানুষের কাছে; আমাদের মিশন সম্পূর্ণ হল টি-ট্যাঁ-টক-টক-ক্যাও-ক্যাও, গ্রহ্রা-গ্রহ্রা, ঘাউ-ঘাউ, ধিচাং...
শেষের দিকের শব্দগুলো খুব সম্ভব নোরার গ্রহের ভাষা দেওয়ালের কাছে দুলতে থাকা আলো আবার লাল, গাঢ় লাল হয়ে উঠল তারপর হঠাৎ নিভে গেল শ্রেয়ার পড়ার টেবিলের কাছে একটা ঘূর্ণি হাওয়া উঠল টেবিল থেকে খাতা-বই সব মাটিতে পড়ে গেল পেনসিল বক্সটাও মাটিতে পড়ে গেল শ্রেয়া ছুটে গেল তার পেনসিল বক্সের কাছে বাক্সে ইরেজারটা কখন কীভাবে উধাও হয়ে গেছে, শ্রেয়া বুঝতেই সময় পেল না
_____
ছবিঃ মৈনাক দাশ

4 comments:

  1. বাহ! ভালো লাগলো পড়ে।

    ReplyDelete
  2. বেশ লাগল গল্পটা

    ReplyDelete
  3. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ রক্তিম, বিভাবসু

      Delete