একটি লম্বা সফরের কাহিনি
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
।। পর্ব সাত ।।
২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর ১৮৩৫
দ্বীপ থেকে খুঁজে-পেতে গাছপালা, পোকামাকড়, সরীসৃপের নমুনা জোগাড় করেছি মন
দিয়ে। এই দ্বীপমালার বিচিত্র জীবজগতের উৎস ঠিক কোন এলাকার জীবমণ্ডলে রয়েছে সেটা
পরে তুলনা করে দেখতে হবে। ব্যাপারটা বেশ আকর্ষণীয় কাজ হবে একটা।
দ্বীপটার সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টা প্রায় ২০০০
ফিট খাড়াই। তার মাথার দিকটা ঘাস আর গুল্মে ছাওয়া। জায়গাটার চেহারা দেখলেই মালুম
পড়ে একসময় ওখানে একটা জ্বালামুখ ছিল। দ্বীপটা বেজায় ছোটো, কিন্তু তাও খুঁজে-পেতে
দেখেছি এতে উনচল্লিশটা শঙ্কু আকারের টিলা রয়েছে। প্রত্যেকটার মাথাতেই মোটামুটি
গোলাকার একটা ঢালু গর্ত। যে লাভাস্রোতে এই দ্বীপের নীচের এলাকাটা তৈরি, তা এইসব
জ্বালামুখ থেকে বহুকাল আগেই বয়ে গেছে।
দীর্ঘ সময় ধরে তা মসৃণ হয়েছে, গড়ে উঠেছে উর্বর মাটি, সৃষ্টি করেছে
গাছগাছালির। এ লাভাদের বেশির ভাগটাই সমুদ্রের তলা থেকে উঠে আসা বলে আমার অনুমান।
এইখানটায় ডারউইনের ডায়েরি থামিয়ে একটা অন্য প্রসঙ্গে খানিক বলে নেয়া যাকঃ
গ্যালাপাগোস ছাড়বার চার মাস পরে সিডনি থেকে হেন্স্লোকে লেখা এক চিঠিতে
ডারউইন বলেছিলেন, গ্যালাপগোস দ্বীপপুঞ্জে খুব খেটেছি আমি। যে যে গাছে ফুল দেখতে
পেয়েছি তার সবগুলোর নমুনা সংগ্রহ করেছি। সে সময়টা ওখানে ফুল ফোটবার ঋতু, কাজেই মনে
হয় বেশির ভাগ উদ্ভিদেরই নমুনা জোগাড় করা গিয়েছে। আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে যে এই
উদ্ভিদদের আদি বাসস্থান আমেরিকাই, নাকি অন্য কোথাও। এখানকার পাখপাখালিদেরও আমি বেশ
গভীরভাবেই পর্যবেক্ষণ করেছি। আমার সন্দেহ ওখানেও কিছু অদ্ভুত ব্যাপার রয়েছে।
এর পরবর্তীকালে ১৮৩৬ এর মাঝামাঝি নাগাদ ডারউইন যখন পাখিদের ওপরে তাঁর নোটগুলো
তৈরি করছেন তখন তিনি লিখছেনঃ
থেনকা (মাইমাস থেনকা) - এই পাখিগুলোর সঙ্গে চিলির থেনকা-দের গভীর মিল।
ছটফটে, কৌতূহলী, দারুণ জোরে ছোটে, লোকজনের ঘরবাড়িতে ঢুকে ঝুলিয়ে রাখা কচ্ছপের মাংস
ঠুকরে খেয়ে পালায়, মোটামুটি ভালো গান গায়, সাদাসিধে খোলামেলা বাসা বাঁধে, ভারী পোষ
মানা জাতের। তবে আমার কেমন যেন মনে হয়েছে এদের ডাক চিলির থেনকাদের চাইতে খানিক
আলাদা। চারটে বড়ো দ্বীপ থেকে আমি এদের নমুনা জোগাড় করেছি। চ্যাথাম আর আলবেমার্ল
থেকে যে নমুনা পেয়েছি সেগুলো মোটামুটি একইরকম, কিন্তু অন্য দুটো দ্বীপের
নমুনাগুলোতে বেশ কিছু তফাৎ রয়েছে। একেকটা জাতের নমুনা কেবল এক একটা দ্বীপেই মেলে।
অন্যত্র নয়।
একটা আকর্ষণীয় উদাহরণ দিই,
স্প্যানিয়ার্ডরা কিন্তু কোনও কাছিমের আকৃতি, আঁশ, আকার এইসব দেখেই বলে দিতে পারে
সেটা কোন দ্বীপ থেকে আনা। পাখিদের ক্ষেত্রেও তাই। যে দ্বীপগুলো থেকে পাখিদের নমুনা
আমি নিয়েছি সেগুলো সব কাছাকাছি ছড়ানো। প্রত্যেকটাতেই জীবজন্তুর সংখ্যা সীমিত। অথচ
সেই কাছাকাছি দ্বীপগুলোতেই প্রায় সদৃশ পাখিদের চেহারায় এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে
সামান্য বদল দেখা যাচ্ছে। এর একটাই অর্থ হতে পারেঃ এরা আলাদা আলাদা প্রজাতি নয়।
এরা আসলে একটাই প্রজাতির পাখি, শুধু তাদের মধ্যে এলাকাভিত্তিক কিছু আলাদা আলাদা
শারীরিক বিশিষ্টতা দেখা দিচ্ছে। মূল ভূখণ্ডে এমন উদাহরণ এই মুহূর্তে একটাই মনে
পড়ছে আমার, সেটা হল, পূর্ব আর পশ্চিম ফকল্যান্ড দ্বীপে নেকড়ের মতো দেখতে খ্যাঁকশেয়াল।
যদি আমার এই অনুমানটায় একটুও সত্যতা থাকে তাহলে কিন্তু এই দ্বীপপুঞ্জের জীবজগতকে
আরও খুঁটিয়ে পরীক্ষা করাটা জরুরি হয়ে পড়বে।
সে সময় অবধি প্রচলিত ধ্যানধারণায় যে
তত্ত্বটা স্বতঃসিদ্ধ ছিল তা হল ঈশ্বর যে প্রাণীদের বানিয়ে পাঠিয়েছেন তার কোনও
প্রজাতি বা উপপ্রজাতি যেখানেই থাকুক না কেন তার আর বদল ঘটে না। দুনিয়ার প্রথম
সাতদিনেই সে-সব পাট চুকে গেছে। এই যে আলাদা আলাদা দ্বীপে একই প্রজাতির জীবের
সামান্য সামান্য বদলে যাওয়া, এইখানটাতেই তাঁর, শারীরিক বদলের মাধ্যমে উদ্বর্তনের
চার্চবিরোধী তত্ত্বের বীজটা প্রথম দেখা দিচ্ছিল।
ফিরে যাওয়া যাক ডায়েরিতে -
২৮ সেপ্টেম্বর
আলবেমার্ল (বর্তমান নাম ইসাবেলা — অনুঃ) দ্বীপের দক্ষিণদিকটার সমীক্ষা হল
আজ।
২৯ সেপ্টেম্বর
আজ দুপুরে নোঙর করা হয়েছিল একটা ছোট্ট প্রবাল ঝিল-এ। আলবেমার্ল দ্বীপটা যে
অগ্ন্যুৎপাতের ফলে জন্মেছে সেটা এখান থেকে একেবারে পরিষ্কার বোঝা যায়। একটা এলাকায়
যেতে যেতে দেখি ছোটো ছোটো ক্রেটার ভরে রয়েছে। ক্রেটারগুলোর ভেতরটা লালচে রঙের।
জায়গাটাকে দেখতে লাগছিল যেন কোনও কারখানার একটা বিরাট ওয়ার্কশপ। চ্যাথামের
ওয়ার্কশপটার চাইতেও অনেক বড়ো এটা।
পরদিন নারবোরো (এখনকার নাম আইলা
ফার্নান্দিনা) আর আলবেমার্ল-এর মধ্যেকার শান্ত সমুদ্রে জাহাজ ভাসল। দূর থেকে
আলবেমার্লের পাহাড়চুড়োয় জ্বালামুখ থেকে বাষ্প উদগীরণ হতে দেখা যাচ্ছিল। নারবোরো
দ্বীপটা বেশ রুক্ষ। রূপটাও বেশ ভয়ানক। এ দ্বীপে লাভার ওপর মাটির স্তর সৃষ্টি হয়নি।
যখন তা বের হয়ে এসে জমে গিয়েছিল, এখনও তেমন ভাবেই ছড়িয়ে রয়েছে তারা দ্বীপ জুড়ে।
কিছুকাল আগে এইচএমএস ব্লন্ড নামের এক জাহাজ এইখানে এসে এই দ্বীপে লাভা উদগীরণ দেখে
গিয়েছে। সূর্যাস্তের পর ফের আলবেমার্ল-এর ব্যাঙ্কস নামের প্রবাল ঝিল-এ এসে নোঙর
করা হল। দেখা গেল সেটাও একটা আগ্নেয়গিরির মৃত জ্বালামুখ।
অ্যালবেমার্ল ও চার্লস দ্বীপ
অক্টোবর ১
আলবেমার্ল দ্বীপকে বলা যায় গ্যালাপাগোস-এর মেইনল্যান্ড। পঁচাত্তর মাইল
লম্বা আর কয়েক মাইল চওড়া দ্বীপটা তৈরি হয়েছে ছ-সাতখানা আগ্নেয়গিরি মিলে। তাদের
একেকটা দুই থেকে তিন হাজার ফিট উঁচু। এদের মধ্যে মধ্যে রয়েছে লাভা দিয়ে গড়া সব
উপত্যকা। এখানে আসবার আগে জাহাজে জলের ভাঁড়ারে টান পড়েছিল। ফলে মাথাপিছু দিনে আধ
গ্যালনের বেশি জল পাওয়া যাচ্ছিল না। একে ওই ভয়ানক রোদ, তার ওপর জলে এহেন টান, সব
মিলিয়ে আমাদের বেশ আতান্তরেই পড়তে হয়েছিল এই সময়টা। তবে আগেকার অন্যান্য লোকজনের
লেখাপত্র পড়ে আমাদের আশা ছিল আলবেমার্ল-এ এলে জলের খোঁজ মিলবে। কিন্তু দ্বীপে নেমে
খোঁজখবর করে দেখা গেল ছোটো ছোটো বেলেপাথরের খোঁদলের মধ্যে একেকটায় গ্যালনখানেকের
বেশি জল নেই। সে জলও আবার বেশ খারাপ। তবে ঐ ছোটো ছোটো জলের কুণ্ডির চারপাশে এলাকার
পাখপাখালিদের বেজায় ভিড়। ঘুঘু আর ফিঞ্চ তো দলে দলে ঘুরছে জলের ধারে। দেখে আমার
চার্ল আইল্যাণ্ডের এক ছোকরার শিকার করবার কায়দার কথা মনে পড়ে গেল। সে এমনই একটা
জলের কুণ্ডির পাশে লম্বা একটা ডাণ্ডা হাতে বসে থাকত। আর ঘুঘুর দল জল খেতে এলেই
এলোপাথারি ডান্ডা চালিয়ে তাদের কয়েকটা করে নিকেশ করে দিত। আধ ঘন্টার ভেতরেই মরা
ঘুঘুর স্তূপ নিয়ে সে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে যেত।
প্রবাল ঝিলের দক্ষিণে একটা ভারী চমৎকার
দেখতে পুরোনো জ্বালামুখের খোঁজ পেয়ে গেলাম আমি। ক্রেটারটার চেহারা ডিমের মত। মাইলখানেকের একটু কম লম্বা। প্রায় শ-পাঁচেক
ফিট খাড়াই। তার একেবারে নীচে একটা ঝিল। ঝিলের মাঝখানে একটা ছোটো জ্বালামুখ দ্বীপের
মতো মাথা উঁচিয়ে রয়েছে।
দিনটা ছিল বেজায় গরম। তার ওপর আবার ঝিলটা
দূর থেকে নীল টুকটুকে আয়নার মতো দেখাচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি ক্রেটারের ভেতরের
ঝামাপাথরের ঢালু দেয়াল ধরে তার কাছে নেমে গেলাম। ধুলো মেখে, এক গলা তেষ্টা নিয়ে
তার পাশে পৌঁছে জলে মুখ দিতেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। কষা আর নোনতা জল।
এই ক্রেটার আর তার আশপাশের অন্যান্য
ক্রেটার এককালে কেবল কাদা আর আগ্নেয় পাথরের টুকরো মেশানো বেলেপাথর উগড়েছে। কিন্তু
এদের পেছনে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ানো পাহাড়গুলো থেকে বয়ে আসত জলের ধারা। তাদের ঘষায় আর
ধাক্কায় এ দ্বীপের লাভা মসৃণ উপত্যকাগুলোর সৃষ্টি।
এ দ্বীপের যেটুকু এখন অবধি চোখে পড়েছে
তাতে একে অন্যান্য দ্বীপগুলোর তুলনায় একটু বেশি শুকনো, একটু বেশি নিষ্প্রাণ বলেই
ঠেকে। এখানে আর এক জাতের অতিকায় সরীসৃপের বাস। এক জাতের অতিকায় গিরগিটি। দুই থেকে
চার ফিট লম্বা। ওজনে দশ থেকে পনেরো পাউন্ড। মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায় আর ভয়
পেলেই সর সর করে সেখানে গিয়ে সেঁধোয়। পিঠ জুড়ে কাঁটার সার। গায়ের রঙ কমলা-ঘেঁষা
হলদে। পেছনদিকটা ইটের মত লাল। বেশ ভয়াবহ দেখতে হয় এরা। তবে খেতে ভালো। প্রথম দিনেই
প্রায় গোটা চল্লিশকে শিকার করেছি আমরা।
ফের একটু অন্য কথা -
ডারউইন-এর ডায়েরি বা তাঁর পকেটবুকে কিন্তু ফিঞ্চদের এই চেহারাগত তফাতের উল্লেখ ওই
একটিবারই রয়েছে। অথচ অদূর ভবিষ্যতে ডারউইনের মতবাদ গড়ে ওঠবার ধাপগুলোর সঙ্গে এদেরই
গভীর যোগাযোগ গড়ে উঠতে চলেছিল, যদিও ডারউইন তখন নিজেও সে বিষয়ে বিশেষ জানেন না। ১৮৩৭
সালের শুরুর দিকে জন গুল্ড-এর হাতে সমস্ত সংগৃহীত নমুনার তালিকা আর শ্রেণীবিন্যাস
তৈরি হবার পর এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে একই জাতের প্রাণীর চেহারার এই সূক্ষ্ম
তফাতের তাৎপর্যটা ডারউইন বুঝতে শুরু করেন।
ওদিকে জাহাজের ক্যাপ্টেন ফিটজরয় তখন
এ-বিষয়ে একেবারে উলটো সুর গাইছিলেন। তখন সদ্য বিয়ে-থা করে তিনি বেজায় ধার্মিক বনে
গেছেন। বাইবেল ছাড়া চোখে অন্ধকার দেখেন। বিগ্ল্-এ যাত্রার কাহিনি যখন তিনি
লিখলেন তাতে তিনি ফিঞ্চদের বিষয়ে একরকম সত্যের বিরুদ্ধে গিয়েই বললেন, লাভাছাওয়া
দ্বীপগুলোর বাসিন্দা এই পাখিদের ঠোঁট বুল-ফিঞ্চের মতো একইরকম বেঁটে মোটা আর শক্ত।
কোনও তফাৎ নেই। তবেই বুঝুন, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কী অসীম বুদ্ধি! যে জীব যেরকম
জায়গায় থাকবে বলে ঠিক করেছেন তাদের সর্বত্র একেবারে এক চেহারা দিয়েছেন।
ডারউইনের ভাগ্য ভালো যে তিনি এদের
নমুনাগুলো জোগাড় করে এনেছিলেন। নইলে ফিটজরয়ের এহেন কথাবার্তায় হয়তো তাঁর তত্ত্বটার
জন্মই হত না কখনও।
যাই হোক, ১৮৪৫ সালের “জার্নাল অব
রিসার্চেস”-এর একটা প্রবন্ধে দেখা যাচ্ছে, ডারউইন তাঁর মতবাদটাকে আরেকটু গুছিয়ে
এনেছেন। তিনি বললেন, “খুব ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত, ছোটো একদল পাখির চেহারার গঠনে
এতরকম বৈচিত্র্য থেকে একটাই আন্দাজ করা যেতে পারে। তা হল, শুরুতে এই দ্বীপমালায়
পাখির সংখ্যা খুব সীমিত ছিল। প্রকৃতিকে তাই ওই একটা প্রজাতির সামান্য ক’টি পাখিকে
নিয়ে একেক দ্বীপে একেকভাবে তাদের গড়নে বদল আনতে হয়েছে বিভিন্নভাবে তাদের টিকিয়ে
রাখবার জন্য।
(এরপর আগামী সংখ্যায়)
_____
No comments:
Post a Comment