গল্পের ম্যাজিক:: কালো বেড়াল - বিভাবসু দে


কালো বেড়াল
বিভাবসু দে

।।  ।।

মিত্র ভিলার তেতলার ছাদ থেকেই একবার ঝুঁকে তাকালেন ইন্সপেক্টর রশিদ খান। নিচে বাগানের পাশে পাথর-বাঁধানো জায়গাটায় পড়ে আছে নীলাঞ্জনের লাশটা। চিত হয়েই পড়েছিল, মাথার পেছনটা থেঁতলে গিয়ে অনেকটাই রক্ত বেরিয়েছে। একেবারে স্পট ডেড!
“তা শুভ্রনীলবাবু, আপনি তো ছেলেটির কাকা? মুখ না ফিরিয়েই জিজ্ঞেস করলেন খান।
“হ্যাঁ,” পেছন থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে এল।
এবার পেছন ফিরলেন ইন্সপেক্টর খান। “আপনিই কি প্রথম দেখেছিলেন?
“না, স্যার। আমি কাল রাতে বাড়ি ছিলাম না, একটা বিজনেস পার্টি ছিল। আজ সকালে স্বাতীর ফোন পেয়েই একটু আগে এসেছি।”
“স্বাতী? চোখ কুঁচকে তাকালেন খান।
“আমার স্ত্রী।”
“হুম।” চোখদুটো আরেকটু সরু হয়ে এল খানের। “আচ্ছা, এই ছেলেটি, মানে নীলাঞ্জন, ওর বাবা-মা দু’জনেই তো মারা গেছেন?
“হ্যাঁ। বৌদি অনেক আগেই চলে গেছেন নীলাঞ্জনের তখন দুই কি তিন হবে। তবে দাদা মারা গেছেন মাত্র দু’মাস হল। একটা কার অ্যাকসিডেন্টেঅনেক চেষ্টা করেও...” গলাটা যেন একটু ভারী শোনাল শুভ্রনীলবাবুর। “তারপরেই নীলাঞ্জনের দেখাশোনার জন্য আর ব্যাবসার খাতিরে আমরা এখানে চলে আসি।”
“এখানে চলে আসেন মানে? আগে কোথায় থাকতেন?
“আগে জার্মানিতে ছিলাম, সফটওয়্যার কোম্পানি ওমেগাতে।”
“হুম!” নিজের টিকালো নাকে বার দুয়েক আঙুল চালিয়ে খান বললেন, “আরেকটা কথা বলুন তো শুভ্রনীলবাবু, নীলাঞ্জন যে সুইসাইড করেছে সেটা বুঝলেন কীভাবে?
“মানে, ওর খাতায় ও একটা সুইসাইড নোট লিখে গেছে। ওটা দেখেই...”
“সুইসাইড নোট! চলুন, একবার নীলাঞ্জনের ঘরটা আর নোটটা দেখাবেন।”
বগলে চেপে রাখা পুলিশি টুপিটা মাথায় পরে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে লাগলেন ইন্সপেক্টর খান। পেছন পেছন শুভ্রনীলবাবু।
দোতলার করিডোর বরাবর ডানদিকের দ্বিতীয় ঘরটাই নীলাঞ্জনের। দরজার সামনেই মিসেস স্বাতী মিত্র দাঁড়িয়ে ছিলেনসকাল থেকে যে বেশ অনেকটাই কেঁদেছেন তা চোখমুখের অবস্থায় স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।
“আপনিই নীলাঞ্জনের কাকিমা? মিসেস মিত্রের দিকে একটু ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলেন খান।
“হ্যাঁ।”
“আপনিই বডিটা প্রথম দেখেছিলেন?
“না।” ধরা গলায় কাঁপা কাঁপা সুরে জবাব দিলেন মিসেস মিত্র। “পৃথাই প্রথম দেখতে পায়। ও-ই ডেকে তুলেছিল আমাকে।”
“পৃথা কে?
খানের প্রশ্নের উত্তরটা পেছন থেকে শুভ্রনীলবাবু দিলেন, “নীলুর গভর্নেস। বৌদি মারা যাবার পর থেকে নীলুকে ও-ই মানুষ করেছে। নিজের ছেলের মতো ভালোবাসত। বেচারি খুব ভেঙে পড়েছে এই ঘটনায়।”
“হুম।” খান আবার মিসেস মিত্রের দিকে ফিরলেন। “আচ্ছা, আপনার ঘরটা কোনটা?
“ওই যে ওটা।” আঙুলের ইশারায় বাঁদিকের শেষ ঘরটা দেখালেন মিসেস মিত্র।
“আপনি তো কাল বাড়িতেই ছিলেন পার্টিতে তো যাননি?
“হ্যাঁ। আসলে আমার শরীরটা কাল খুব একটা ভালো লাগছিল না।”
“ওহ্‌। তা ছাদ থেকে যখন নীলাঞ্জন পড়ে গেল কোনও শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন? মানে আস্ত একটা মানুষ এত ওপর থেকে পড়ে গেলে আওয়াজটা নেহাত কম হয় না, তাই বলছিলাম।” খানের চোখে যেন একটা ধারালো চাউনি।
“না, স্যার। আমার ঘুম এমনিতে খুবই পাতলা, কিন্তু কাল যেন একেবারে বেঘোরে ঘুমিয়েছি, কিছুই শুনতে পাইনি।”
একটু সময় চুপ থেকে খান বললেন, “আচ্ছা। চলুন আগে নীলাঞ্জনের ঘরটা একটু দেখান।”
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন তিন জনেই। বেশ সুন্দর সাজানো-গোছানো রঙিন একটা ঘর। দেয়ালে দেয়ালে হাল্ক, স্পাইডারম্যান, টম অ্যান্ড জেরি ও আরও বেশ কিছু কার্টুন চরিত্রের ছবি আঁকা। এক কথায় দশ-এগারো বছরের বাচ্চার পক্ষে একেবারে আদর্শ ঘর। ডান পাশে নীলাঞ্জনের বিছানা, ওদিকে দুটো দেয়াল-আলমারি আর তার উলটোদিকে ওর পড়ার টেবিল-চেয়ার। টেবিলে পড়ার বইখাতা, কিছু গল্পের বই, আর একপাশে একটা ছোট্ট টেবিল ল্যাম্প। ল্যাম্পটা জ্বলছে, হয়তো রাত থেকেই।
চারপাশটা বেশ করে একবার চোখে মেপে নিলেন খান। স্টাডি টেবিলের বাঁ পাশের দেয়ালে ওপরদিকে একটা এসি লাগানো এছাড়া মাথার ওপর সিলিং ফ্যানও রয়েছে। আর তার দু’পাশে বেশ জোরালো দুটো চার কোনা এল.ই.ডি লাইট।
আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে একবার আলমারি দুটো খুললেন খান। সব নীলাঞ্জনেরই জিনিসপত্র – স্কুল ড্রেস, জামাকাপড় আর কিছু কমিকস বই।
“আচ্ছা, একটা সুইসাইড নোট আছে বলছিলেন না? শুভ্রনীলবাবুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন খান।
“হ্যাঁ। এই তো নীলুর টেবিলে। ওর এই খাতাটাতে লিখেছে।”
“উঁহু, হাত দেবেন না। আমি দেখছি।”
টেবিলের কাছে গিয়ে খাতাটার ওপর ঝুঁকে দাঁড়ালেন খান। খোলা খাতার ওপর নীল কালিতে লেখাঃ আমার একা একা ভালো লাগে না। আমি মা-বাবার কাছে চলে যাচ্ছি।
“ও কি ডিপ্রেশনে ভুগছিল? মানে, মা-বাবার জন্য মনমরা হয়ে থাকত, এমন কিছু? চোখে পড়েছে কখনও? পেছন ফিরে খান জিজ্ঞেস করলেন।
“না, স্যার। দাদা মারা যাবার পর ও কিছুদিন খুব কেঁদেছিল, যেটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা মোটামুটি ওকে যতটা সম্ভব খুশি রাখার চেষ্টাই করতাম। আর এই দুই মাসে দাদার যাওয়াটা অনেকটাই সামলেও উঠেছিল নীলু।”
“হুম। আপনারা শিওর এটা ওরই হাতের লেখা?
শুভ্রনীলবাবু টেবিলের একটু কাছে এগিয়ে এলেন, যেন আরেকবার লেখাটা দেখবার চেষ্টা করছেন। “মানে তেমনভাবে তো দেখিনি, কারণ ওর লেখাপড়া সবই পৃথা দেখত। তবে আপনি চাইলে নীলুর অন্য কোনও হোমওয়ার্ক খাতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারেন।”
একটু মাথা নাড়লেন খান, কোনও উত্তর দিলেন না। টেবিলের ওপর ল্যাম্পের হলদে আলোয় এলিয়ে আছে সুইসাইড নোট লেখা সেই খাতাটা। কী এত কষ্ট থাকতে পারে একটা এগারো বছরের বাচ্চার যে এমন সাংঘাতিক কাজ করতেও বুক কাঁপে না?
ছোট্ট দুই লাইনের নোটটার দিকে আবার তাকালেন খান। আর তখনই হঠাৎ জিনিসটা চোখে পড়ল। কিছু যেন লেগে আছে নোটটার গায়ে। খান আরেকটু কাছে গিয়ে চোখ সরু করে দেখার চেষ্টা করলেন।
“আপনাদের বাড়িতে বেড়াল বা খরগোশ জাতীয় পোষা কিছু আছে?
“না তো।” ওপাশ থেকে নিচু গলায় মিসেস মিত্রই উত্তরটা দিলেন। “পোষা কোনও কিছুই নেই আমাদের বাড়িতে। কুকুরও না।”
খান আর কিছু বললেন না পকেট থেকে একটা স্যাম্পল প্যাক আর ছোটো চিমটে বের করে নোটের ওপর থেকে খুব সাবধানে কিছু একটা সেই প্যাকে ভরে নিলেন।
“আপাতত এই ঘরে কোনও কিছুতে হাত দেবেন না, ফরেনসিকে পাঠানো হবে। চলুন এখন নিচে যাওয়া যাক। আর মিসেস মিত্র, কাইন্ডলি একটু নীলাঞ্জনের সেই গভর্নেসকে ডেকে দিন তো।”
“পৃথা? হ্যাঁ, আমি ডেকে আনছি ওকে।”
মিসেস মিত্র বেরিয়ে গেলেন। পেছন পেছন শুভ্রনীলবাবু ও ইন্সপেক্টর খানও সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলেন নিচের তলায়।
নিচের তলার সামনের দিকটায় বেশ বড়ো একটা বসার জায়গা রয়েছে। দামি শ্বেতপাথরের কাজ করা একটা টেবিল আর তার তিনদিকে গোল করে সাজানো বেশ বনেদি ধাঁচের সোফা সেট। এই বসার জায়গাটার ঠিক সামনে বেশ চওড়া জমকালো একটা কাঠের সদর দরজা আর পেছনে দু’পাশ দিয়ে দুটো বাঁকানো সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে সোজা দোতলার করিডোর অবধি। তারই একটা দিয়ে নেমে এলেন শুভ্রনীলবাবু ও ইন্সপেক্টর খান।
একটু পরেই পৃথাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে এসে দাঁড়ালেন মিসেস মিত্র। সত্যিই বেচারির দু’চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না কাঁদতে কাঁদতে কালশিটে পড়ে গেছে চোখের নিচে। এখনও ভিজে আছে দু’চোখের কোল। আস্তে আস্তে ওকে ধরে সোফায় বসিয়ে দিলেন মিসেস মিত্র।
খান একটু আলতো গলায়ই জিজ্ঞেস করলেন, “আপনিই তো নীলাঞ্জনের গভর্নেস?
মাথা নাড়ল পৃথা।
“ছেলেটি হঠাৎ এমনটা কেন করল কিছু বলতে পারেন? মানে কোনও ডিপ্রেশন বা অন্য কিছু?
“না, স্যার।” পৃথার গলায় এখনও কান্নার কাঁপন।
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি যেতে পারেন। পরে দরকার হলে কথা বলে নেব।”
উঠে পড়লেন খান। “শুভ্রনীলবাবু, আপাতত আমি যাচ্ছি, পরে কিছু জানার থাকলে আপনাকে আবার বিরক্ত করব।”
“ঠিক আছে, স্যার। আর নীলুকে কখন...”
“ওহ্‌ হ্যাঁ, সন্ধের মধ্যেই পোস্টমর্টেম হয়ে যাওয়ার কথা। আশা করি কালই পেয়ে যাবেন।”
কথাগুলো বলতে বলতে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন খান, তখনই বাড়ির দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন সাব-ইন্সপেক্টর অরিন্দম দত্ত। “স্যার, এই যে, এ-ই কাল রাতে গেটে ছিল।”
হোমগার্ডের নীল উর্দি পরা বছর চল্লিশের একটা মোটাসোটা লোক। গোলপানা মুখ আর ভোঁতা নাকের তলায় একটা পুরুষ্টু গোঁফ। লোকটা বেশ লম্বা একটা সেলাম ঠুকে এসে দাঁড়াল খানের সামনে।
“নাম কী তোমার?
“আজ্ঞে স্যার, হরিচরণ সাহু।”
“কাল তুমিই তো ছিলে ডিউটিতে? তা কিছু শুনেছ বা কাউকে ঢুকতে দেখেছ?
“না, স্যার। অচেনা কেউ তো আসেনি
“কেন? রাতে যখন চেয়ারে বসে ঝিমোও তখন তো কেউ ঢুকতেই পারে!”
“মা কালীর দিব্যি স্যার, জিভ কেটে বলল লোকটা, “ডিউটিতে কোনওদিন ঘুমোইনি। জিজ্ঞেস করে দেখুন বাবুকে।” তারপর একটু কী যেন ভেবে আবার বলল, “তবে স্যার, কাল রাত দশটার দিকে প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিটের মতো আমি গেটে ছিলাম না।”
“কেন? কোথায় গেছিলে? কপাল কুঁচকে তাকালেন খান।
কিন্তু উত্তরটা এল পেছন থেকে। মিসেস মিত্র বললেন, “আমিই পাঠিয়েছিলাম। আমার প্রেশারের ওষুধটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তাই ওকে ফোন করে বলেছিলাম ওষুধটা নিয়ে আসতে। আসলে আমার প্রেশারটা খুব হাই, তাই ওটা মিস করতে পারি না।”
“কিন্তু ওকেই কেন? অন্য কাউকেও তো পাঠাতে পারতেন!” খানের গলায় ঝলকে ওঠা সন্দেহের সুরটা বুঝতে কারও অসুবিধে হচ্ছিল না।
“রাত সাড়ে ন’টার পর মেইন বিল্ডিংয়ে কাজের লোকেরা কেউ থাকে না ভিলার পেছনে ওদের থাকার ঘরে চলে যায়। তাই অগত্যা গেটেই ফোন করতে হয়েছিল আমাকে।” মিসেস মিত্র যতটা সম্ভব স্থির গলায়ই জবাব দেবার চেষ্টা করলেন।
“বেশ। তা ওষুধটা খেয়েছিলেন তো?
প্রশ্নটা বোধহয় ঠিক প্রত্যাশিত ছিল না মিসেস মিত্রের কাছে। একটু আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে মানে, হ্যাঁ, খেয়েছি তো। দুটো ট্যাবলেট। রোজই খেতে হয়।”
“যদি কিছু মনে না করেন শিশিটা একটু দেখতে পারি?
“নিশ্চয়ই।” মিসেস মিত্র নিজের ঘর থেকে একটা ছোটো ওষুধের শিশি নিয়ে এলেন। কাচের। তারপর ইন্সপেক্টর খানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এই যে, এটাই।”
শিশিটা হাতে নিয়ে বেশ একটু নেড়েচেড়ে দেখলেন খান। ব্লাড প্রেশারের ওষুধ।
“আমি আপাতত শিশিটা রাখছি। কষ্ট করে আরেকটা আনিয়ে নেবেন।”
ওষুধের শিশিটা পকেটে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর খান, সঙ্গে সাব-ইন্সপেক্টর দত্তও।

।।  ।।

“কী বুঝছেন, স্যার? সুইসাইড? টেবিলের ওপর খানিকটা ঝুঁকেই জিজ্ঞেস করলেন দত্ত।
টেবিলের ওপাশে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে কিছু একটা ভাবছিলেন ইন্সপেক্টর খান। দত্তের প্রশ্নে চোখ না খুলেই বললেন, “সুইসাইড মানতে কোনও আপত্তি ছিল না দত্ত, কিন্তু মনটা ঠিক যেন সায় দিচ্ছে না, বুঝলে।”
“প্রপার্টি?
“হুম, সেটা তো একটা স্ট্রং ফ্যাকটর বটেই। পাঁচশো কোটির ব্যাবসা। একমাত্র উত্তরাধিকারী নাবালক, আর ট্রাস্টি হলেন কাকা-কাকিমা। অতএব ছেলেটিকে সরিয়ে দিলে সবচেয়ে বড়ো লাভ তো তাঁদেরই। এক ঝটকায় নিষ্কণ্টক সাম্রাজ্যের মালিকানা! কিন্তু আমার খটকাটা অন্য জায়গায়।”
যে প্রশ্নটা এরপর খুব স্বাভাবিকভাবেই আসে সেটাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন দত্ত, কিন্তু তখনই তিনটে খাম হাতে খানের কেবিনে ঢুকল হাবিলদার রামতনু। “স্যার, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট।” খামগুলো খানের টেবিলে রেখে বেরিয়ে গেল সে।
“দেখো তো দত্ত, এতে কী লিখেছে।” একটা খাম সাব-ইন্সপেক্টর দত্তের দিকে এগিয়ে দিয়ে আর দুটো নিজেই খুলে দেখতে লাগলেন খান।
হাতের খামটা খুলে একবার চোখ বুলিয়ে দত্ত বললেন, “এটা তো স্যার ওই প্রেশারের ওষুধের রিপোর্ট। ঠিকই তো লিখেছে, ওটা সত্যিই প্রেশারের ওষুধ ছিল।”
নীলাঞ্জনের পোস্টমর্টেম রিপোর্টের পাতাগুলো দুয়েকবার উলটেপালটে রেখে দিলেন খান। তারপর হঠাৎ দত্তের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করেলন, “আচ্ছা, তিরিশ থেকে দুই গেলে কত থাকে হে? তাঁর ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি।
“আটাশকেন স্যার? পোস্টমর্টেমে কিছু পেলেন?
“সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু। আর কিসস্যু নেই। কিন্তু ওই যে বললাম কিছু খটকা লেগে আছে মনের ভেতর, তারই প্রথমটা হল তিরিশে, আর এবার দ্বিতীয়টা দেখা যাক।” বলতে বলতে টেবিলে পড়ে থাকা তৃতীয় খামটা খুললেন ইন্সপেক্টর খান। এক পাতার একটা রিপোর্ট। কিন্তু লাইনগুলো পড়তে পড়তে খানের মুখে একটা শিকারি হাসি যেন ঝিলিক দিয়ে উঠছিল এই হাসি দত্তের মোটেই অচেনা নয়।
“কী হল, স্যার?
“বলছি, আগে রামতনুকে একটু ডাকো তো।”
দত্ত হাঁক পাড়তেই রামতনু এসে সেলাম ঠুকে দাঁড়াল।
“শোনো রামতনু, তুমি এক্ষুনি ফরেনসিকের একজন লোক নিয়ে মিত্র ভিলায় যাও, সঙ্গে একটা পরিষ্কার ভ্যাকিউম ক্লিনার নিওসোজা গিয়ে উঠবে ওদের ছাদে আর সেখান থেকে চেঁছে-পুছে যত ধুলো পাও ক্লিনারে ভরে ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়ে দেবে। বাকিটা ডাঃ বসাককে আমি ফোনে বলে দেব।”
“জি স্যার।” আগের মতোই সেলাম ঠুকে বেরিয়ে গেল রামতনু।
এবার খান সাব-ইন্সপেক্টর দত্তের অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বললেন, “কী, দত্ত? বুঝতে পারলে না তো? অন্ধকারে একটা তির ছুড়লাম, নিশানায় লাগলে অর্ধেক কিস্তিমাত এখানেই হয়ে যাবে।”
“কীরকম, স্যার? একটু খোলসা করে বলুন না।” চেয়ারটা টেবিলের আরও কাছে টেনে বসলেন দত্ত।
“তিরিশ থেকে দুই গেলে তো আটাশ থাকে বললে কিন্তু এখানে তিরিশটেই রয়েছে। বুঝলে না তো? খানের চোখের কোণে একটা ছুঁচোলো হাসি খেলে গেল। “ওষুধের শিশিটা মনে আছে, দত্ত? কী জানি কী মনে হল, থানায় ফিরেই একবার গুনলাম ট্যাবলেটগুলো। ঠিক তিরিশটা। আর শিশির পেছনের লেবেলেও লেখা যে এতে তিরিশটে ট্যাবলেট আছে।”
“কিন্তু মিসেস মিত্র যে বললেন উনি ঘুমোবার আগে দুটো ট্যাবলেট খেয়েছিলেন? ভুরু কুঁচকে তাকালেন দত্ত।
“সেটাই তো খটকা। তাহলে দুটো ট্যাবলেট গেল কই?
“আর দ্বিতীয় খটকাটা?
“লোম!”
“লোম? দত্ত যে ভালোই অবাক হয়েছেন, তাঁর চোখেমুখেই বোঝা যাচ্ছে।
“হ্যাঁ। যে বাড়িতে বেড়াল নেই, যে ছেলের অ্যাইল্যুরোফোবিয়া আছে তার লেখা সুইসাইড নোটে কালো বেড়ালের লোম আসে কোত্থেকে? সেদিন সুইসাইড নোটটা দেখতে গিয়েই চোখে পড়েছিল। তখনই আন্দাজ করেছিলাম, এগুলো বেড়াল বা খরগোশ জাতীয় কিছুর লোম। ফরেনসিক রিপোর্টেও তাই লিখেছে, কুচকুচে কালো বেড়ালের লোম ওগুলো।”
সেই এক পাতার রিপোর্টটা তুলে নিয়ে বললেন ইন্সপেক্টর খান।
“বলেন কী!” একটু থেমে দত্ত আবার বললেন, “কিন্তু ওই কী একটা ফোবিয়া যে বললেন, ওটা কী বস্তু?
“ওটাই মোক্ষম বস্তু, ভায়া। অ্যাইল্যুরোফোবিয়া। সোজা বাংলায় বললে বেড়াল-আতঙ্ক।” পিঠটা সোজা করে একটু এগিয়ে বসলেন খান। “খুলেই বলছি ব্যাপারটা। লোমগুলো তো সেদিনই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ফরেনসিকে, কিন্তু তখন কি জানতাম যে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরোবে! আজ একবার দুপুরে গেছিলাম নীলাঞ্জনের স্কুলে, ওর কাছের কিছু বন্ধুবান্ধব আর টিচারদের সঙ্গে কথা বলতে। সেখানেই হঠাৎ কথা প্রসঙ্গে একটা বাচ্চা, নীলাঞ্জনেরই বন্ধু, বলল যে নীলাঞ্জন নাকি বেড়ালকে খুব ভয় পেত। এতটাই যে একবার ওরা মজা করে নীলাঞ্জনের সামনে একটা বেড়ালছানা ছেড়ে দিয়েছিল আর সেটাকে দেখে ও রীতিমতো কাঁপতে কাঁপতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। ওরাও খুব ঘাবড়ে যায় ব্যাপারটা দেখে, তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজেরাই ওর চোখেমুখে জলটল দিয়ে হুঁশ ফেরায়।
“আর সেখানেই আমার টনকটা নড়ে স্কুল থেকে বেরিয়েই সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলাম সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ সেনগুপ্তকে, পুরো ব্যাপারটা খুলে বললামসব শুনে উনিই বললেন যে এই কেস অ্যাইল্যুরোফোবিয়া না হয়ে যেতেই পারে না।”
“কিন্তু তাই বলে বেড়ালছানা দেখে অজ্ঞান হয়ে যাবে!”
“এখানেই তো সবাই ভুলটা করে, দত্ত। ভয় আর ফোবিয়া এক জিনিস নয়। কুকুর-বেড়ালকে অনেকেই ভয় পায়, আমার মাও বেড়াল ভয় পান। কিন্তু সেটা ফোবিয়া নয়। ফোবিয়া একটা মানসিক সমস্যা। একটা অকারণ অযৌক্তিক ভয়। অনেক রকমের ফোবিয়া হয় - অন্ধকার থেকে, টিকটিকি থেকে, রক্ত থেকে, আরও কত কী থেকে। যার যেই জিনিসে ফোবিয়া সে সেই জিনিস, এমনকি সেই জিনিসের ছবি দেখলেও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আর এই আতঙ্ক কতটা তীব্র হবে তা একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম হতেই পারে।”
“আরিব্বাস! এই কেসটা যত সোজাসাপটা ভেবেছিলাম তা তো মোটেই নয়।”
“হুম।” গম্ভীরভাবে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন ইন্সপেক্টর খান।

।।  ।।

ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ন’টা। নিজের টেবিলে কয়েকটা কেসের ফাইলগুলো একটু ঘাঁটছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর দত্ত। হঠাৎ হাতে একটা খাম নিয়ে প্রায় ঝড়ের মতো থানায় এসে ঢুকলেন খান। সোজা গিয়ে দত্তের টেবিলে একটা চাপড় মেরে বললেন, “এই দেখো দত্ত, বলেছিলাম না এই কেসে বেড়াল আছে! এই দেখো, ফরেনসিকের রিপোর্ট। তির এক্কেবারে নিশানায় গেঁথেছে।”
খামটা খুলে এক পাতার একটা রিপোর্ট বার করলেন দত্ত। কিন্তু শেষ লাইনটা অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে চোখ দুটো গোল হয়ে উঠল তাঁর। “স্যার, এ যে দেখছি পুরো বেড়ালের ছড়াছড়ি!”
“সে আর বলতে! রিপোর্ট বলছে, মিত্র ভিলার ছাদের ধুলোয় কম করে হলেও বারোটা আলাদা আলাদা বেড়ালের লোম পাওয়া গেছে, আর তাও যে-সে বেড়াল নয়, একেবারে পুরো কুচকুচে কালো বেড়াল। ওই ভূতের সিনেমা-টিনেমায় যেমনটা দেখায়।”
“তাহলে কি নীলাঞ্জন বেড়ালের ভয়েই মারা গেছে? দত্ত সরু চোখে খানের দিকে তাকালেন।
একটু সময় কী যেন ভাবলেন খান। “উমমম, হ্যাঁও বটে আবার নাও বটে আসলে সরাসরি যদি বেড়ালের ভয়ে হার্টফেল-টেল করে মারা যেত তাহলে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে তা ঠিক ধরা পড়ত। কিন্তু সেরকম তো কিছু নেই।”
“তাহলে?
“তাহলে? সেখানেই তো খুনির খেল! খুনি নীলাঞ্জনের খুব কাছের কেউ, বুঝলে? এমন কেউ যে খুব ভালোভাবেই জানত যে নীলাঞ্জনের অ্যাইল্যুরোফোবিয়া আছে। আর সেটাকেই সে খুব বুদ্ধি করে কাজে লাগিয়েছে। নীলাঞ্জন যে রোজ রাতে ঘুমোবার আগে কিছুক্ষণ ছাদে পায়চারি করে সেটাও সে জানত। আর তখনই খুনি কোনওভাবে সেই বেড়ালগুলোকে ছাদে চালান করে ছাদের দরজা আটকে দেয়। ব্যস, বেড়াল দেখেই নীলাঞ্জনের ফোবিয়া ট্রিগার করে, সে ভয়ে পিছোতে পিছোতে ছাদের দেয়াল-লাগোয়া একটা পাকা বসার জায়গায় উঠে পড়ে আর তারপর হঠাৎ পা হড়কে নিচে পড়ে যায়। অথবা আরেকটা সম্ভাবনা হল, নীলাঞ্জন অজ্ঞান হয়ে যায় আর কিছুক্ষণ পর খুনি এসে তাকে ওপর থেকে এমনভাবে নিচে ফেলে দেয় যাতে পুরো ব্যাপারটা আত্মহত্যা বলেই মনে হয়।” একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলেন ইন্সপেক্টর খান।
“বাপ রে! কিন্তু খুন করতে বেড়াল দিয়ে এত কসরত করার কী দরকার ছিল?
“সেটাই তো মাথায় ঢুকছে না, দত্ত। শুধুই কি একটা ক্রিয়েটিভ মার্ডার প্ল্যানের জন্যে এত কিছু, না পেছনে অন্য কোনও গল্প রয়েছে?
“হুম আপনার কী মনে হয়, খুনি কে হতে পারে? ওর কাকিমা, স্বাতী মিত্র?
“হতেই পারেন। তবে সন্দেহের বাইরে কেউই নেই। শুভ্রনীলবাবুর একটা স্ট্রং অ্যালিবাই আছে, উনি সারা রাত পার্টিতে ছিলেন, আর সেটা যে ঠিক আমি নিজে খোঁজ নিয়ে দেখেছি। তাহলে ভিলার মেইন বিল্ডিংয়ে রাত সাড়ে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে রইলেন দু’জন, মিসেস মিত্র আর পৃথা। পৃথার খুন করবার আপাতত কোনও মোটিভ চোখে পড়ছে না, তাই এই মুহূর্তে বলতে গেলে মিসেস মিত্রই প্রাইম সাসপেক্ট।”
হালকা মাথা নাড়লেন দত্ত। “কিন্তু স্যার আরেকটা কথা, এতগুলো বেড়ালকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাওয়া হল, কেউ কিছুই দেখতে পেল না, শুনতেও পেল না! বেড়াল তো আর চুপ করে বসে থাকবার বস্তু নয় বারোটা বেড়াল মিলে ম্যাও ম্যাও করে তো কানের পোকা নাড়িয়ে দেবার কথা!”
“হ্যাঁ, এটা একটা পয়েন্ট। কিন্তু আরও এমন বেশ কিছু জায়গা আছে দত্ত যেখানে হিসেব মেলাতে পারছি না।” গলাটা বেশ গম্ভীর শোনাল খানের। “খুনি বড্ড চালাক।”
“আচ্ছা স্যার, একটা জিনিস ভেবে দেখেছেন? কুচকুচে কালো বেড়াল জিনিসটা কিন্তু অত কমন নয়, হয়তো শয়ে একটা চোখে পড়ে। তার ওপর একসঙ্গে বারোটা বা তারও বেশি কালো বেড়াল!” খসখসে গলায় টেনে টেনে কথাগুলো বললেন দত্ত।
খানের চোখদুটো যেন হঠাৎ দপ করে উঠল। “কথাটা জব্বর বলেছ তো, দত্ত। এটা তো আমার মাথাতেই আসেনি। একসঙ্গে এতগুলো কালো বেড়াল কেউ রাস্তা থেকে জোগাড় করতে পারে না, পেলে শুধু এক জায়গা থেকেই পাওয়া যেতে পারে।”
“কোথায়? পোষা জীবজন্তুর দোকানে?
“উঁহু। না হে ভায়া, অধিকাংশ ভারতবাসী এখনও বড্ড কুসংস্কারী কালো বেড়াল আজও অনেকের চোখেই অপয়া। তাই সাধারণ পোষা জন্তুজানোয়ারের দোকানে এই বস্তু পাবার চান্স কম।”
“তবে?
“ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি! সিনেমা-সিরিয়ালে অনেক সময় অনেক জন্তুজানোয়ারের দরকার পড়ে, আর ভূতের কাহিনিতে তো কালো বেড়াল হামেশাই গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স দিয়ে বেড়ায়। তাই এই শহরে যারা যারা এসব সিনেমা কোম্পানিকে জন্তু-টন্তু সাপ্লাই করে তাদের একটা লিস্ট বের করো। খুনিকে গেলে এদের কাছেই যেতে হবে কালো বেড়ালের খোঁজে।”
দত্তের চোখেও যেন একটা তীক্ষ্ন হাসি ঝলসে উঠল।

।।  ।।

ফরেনসিক ল্যাবের বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন ইন্সপেক্টর খান। দত্তের এখানেই আসবার কথা ফোনে তো বলল, সৈনিক স্কুলের মোড়টায় আছে। ঘড়ির দিকে একবার তাকালেন খান। এগারোটা পাঁচ।
মিনিট দুয়েক পরেই পুলিশের জীপটা এসে থামল ল্যাবের সামনের রাস্তায়। খান এগিয়ে গেলেন। ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে নেমে একটা ছোট্ট স্যালুট করে দাঁড়ালেন সাব-ইন্সপেক্টর দত্ত।
“কিছু পেলে? মাথার কাঁচাপাকা চুলগুলোতে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন খান।
“পেয়েছি স্যার, তবে একটু গোলমেলে।”
“কীরকম?
“শহরের আর আশেপাশের যত ওরকম জন্তুজানোয়ার সাপ্লাই করা লোক আছে, তাদের সবার কাছেই গেছিলাম। তা গত এক-দেড় সপ্তাহের মধ্যে কেউ কালো বেড়াল ভাড়া নিয়েছে বা কিনেছে কিনা খোঁজ করতে শুধু পাঁচটা লোকের কাছে পজিটিভ জবাব পেলাম।”
“কারা নিয়েছে ডিটেইল এনেছ?
“হ্যাঁ, স্যার। ওই পাঁচটা লোকের কাছ থেকে মোট সাতটি ফিল্ম কোম্পানি এই ক’দিনের মধ্যে কালো বেড়াল ভাড়া নিয়েছে। আর সেখানেই গোলমালটা আমি ওদের কাছ থেকে সেই ফিল্ম কোম্পানিগুলোর অফিসিয়াল কার্ড নিয়ে এসেছি।”
“দেখি কার্ডগুলো কোম্পানিগুলোর খোঁজ নিয়েছিলে?
এক পকেট থেকে পাঁচটা আর আরেক পকেট থেকে দুটো কার্ড বার করলেন দত্ত। “হ্যাঁ, স্যার। কিন্তু সেখানেই তো গেরোটা! এই যে এই দুটো, বাঁ হাতের দুটো কার্ড এগিয়ে দিতে দিতে দত্ত বললেন, “এগুলোতে খোঁজ নিয়েছি। এগুলো আসল, নাম নম্বর সবই ঠিকঠাক। কিন্তু এই পাঁচটা,” এবার ডান হাতের বাকি কার্ডগুলো খানের দিকে এগিয়ে দিলেন দত্ত। “এগুলো পুরো ভাঁওতা! ফোন নম্বরও ভুল আর ঠিকানাও। আমি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও খোঁজ করেছি, এই নামে কোনও কোম্পানি নেই।”
“বাহ্! দাও দেখি কার্ডগুলো একবার নেড়ে দেখি।”
দত্তের এগিয়ে দেওয়া সেই পাঁচটা কার্ড হাতে নিয়ে দেখতে লাগলেন ইন্সপেক্টর খান। বেশ কিছুক্ষণ উলটেপালটে দেখার পর হঠাৎ খানের হাসিটা যেন চওড়া হয়ে উঠল। চোখেও সেই ধারালো হাসির ঝলকানি“এহ্‌-হে-হে! এত চালাক খুনি এমন একটা গবেট মার্কা ভুল করে ফেলল!”
“কেন স্যার? কিছু পেলেন?
“এই দেখো।” একটা কার্ডের উলটো দিকটা দত্তের দিকে এগিয়ে দিলেন খান।
“যেখান থেকে কার্ডগুলো ছেপেছে সেখানকার ছোট্ট একটা ওয়াটারমার্ক দেওয়া আছে পেছনে। আর মজার ব্যাপারটা কী জানো, সবগুলো কার্ড একই জায়গা থেকে ছাপা। জুবিন প্রিন্টার্স।”
“জুবিন প্রিন্টার্স? সেটা তো এদিকেই, ওই ও.এন.জি.সি-র কাছাকাছি।”
“দারুণ! চলো তাহলে একটু জুবিন ভায়ার সঙ্গে আড্ডা মেরে আসি।” বলতে বলতে জীপে উঠে বসলেন খান।

আধঘন্টার বেশি লাগল না ও.এন.জি.সি অফিসের সামনে পৌঁছতে। তার উলটোদিকেই বেশ বড়োসড়ো একটা সাইনবোর্ডে লেখা ‘জুবিন প্রিন্টার্স’, নিচে একটা কাচের স্লাইডিং দরজা। বেশ ঝকঝকে তকতকে ভেতরটা, রাস্তার এপার থেকেই সাফ দেখা যাচ্ছে।
ইন্সপেক্টর খান আর দত্তকে ভেতরে ঢুকতে দেখেই হঠাৎ একটু যেন অপ্রস্তুত হয়েই উঠে দাঁড়াল সামনের ডেস্কে বসা ছেলেটা। “হ্যাঁ স্যার, বলুন।”
দোকানের চারপাশে বেশ ভালো করে একবার চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে খান জিজ্ঞেস করলেন, “দোকানটা তোমার?
“হ্যাঁ, মানে কাগজপত্র বাবার নামে, তবে আমিই চালাই। কেন স্যার? কিছু হয়েছে?
“না। আচ্ছা, এই কার্ডগুলো একটু দেখো তো চিনতে পার কি না পকেট থেকে সেই পাঁচটা কার্ড বার করে ডেস্কে রাখলেন খান।
ছেলেটি একবার কার্ডগুলোর পেছনে ওয়াটার মার্কটা দেখে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ। এগুলো আমাদেরই করা।”
“কে বা কারা করতে দিয়েছিল কিছু খেয়াল আছে? কোনও রেকর্ড?
“কারা নয় স্যার, একজনই এসেছিলেন। এক ভদ্রলোক।”
ভদ্রলোক!” দত্তের দিকে একবার তাকালেন খান।
ছেলেটি আবার বলতে লাগল, “এই প্রায় তিন সপ্তাহ আগে হবে। একসঙ্গে এতগুলো আলাদা আলাদা ফিল্ম কোম্পানির কার্ডের অর্ডার দিচ্ছে দেখে আমিও একটু অবাক হয়েছিলাম পরে ভাবলাম হয়তো এটাই ওঁর পেশা।”
“লোকটাকে কেমন দেখতে খেয়াল আছে?
“হুডি পরা ছিল স্যার, হাইট পাঁচ-আট হবে। শরীর-স্বাস্থ্য ভালোই।”
“এমন দেখতে? দত্ত নিজের মোবাইলে শুভ্রনীলবাবুর একটা ছবি এগিয়ে দিলেন ছেলেটির দিকে।
“না, স্যার। ইনি নন।” একটু কী যেন ভেবে হঠাৎ ছেলেটি বলল, “তবে স্যার, লোকটা একবার সোজা আমার মাথার ওপর ওই দেয়ালের দিকে তাকিয়েছিল।”
“তাতে লাভ? ভুরু কুঁচকে তাকালেন দত্ত।
“ওখানে একটা ছোট্ট সি. সি ক্যামেরা বসানো আছে, বাইরে থেকে চোখে পড়ে না। ওটাতে নিশ্চয়ই ছবি উঠেছে।”
“সাবাশ!” নিজের হাতের তালুতেই একটা হালকা চাপড় মেরে খান বললেন। “দেখাও তো, বাছাধনের শ্রীমুখটা একটু দেখি।”
ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে সামনে ডেস্কটপে সি. সি ক্যামেরার তিন সপ্তাহ আগের ফুটেজগুলো বের করে দেখাতে লাগল। “এই যে, এই লোকটাই।”
“বাহ্, বেশ হিরোমার্কা চেহারা তো। একেবারে সোজা ক্যামেরার দিকেই তাকিয়েছে চাঁদু!” খানের গলায় বেশ একটা উচ্ছ্বাসের সুর। “ছবি যখন পাওয়া গেছে, তখন খুনি আর বেশি দূরে নেই। দত্ত, এই ছবিটা পরিষ্কারভাবে প্রিন্ট করাও, দরকারে আর্টিস্ট দিয়ে আরেকবার আঁকিয়েও নিতে পারএই ব্যাটাকে আমার চাই। আমাদের যত ইনফর্মার, খবরি আছে সবাইকে কাজে লাগাও। যদি রাজ্য ছেড়ে না পালিয়ে থাকে তবে এটাকে ধরতে বেশি বেগ পেতে হবে না।”

।।  ।।

সকালবেলা। চায়ের কাপ নিয়ে সবে মিত্র ভিলার সামনের লনে এসে বসেছিলেন শুভ্রনীলবাবু আর মিসেস মিত্র হঠাৎ গেটের কাছে পুলিশের গাড়ির শব্দে চমকে উঠলেন দু’জনেই।
সামনে একটা জীপ আর পেছনে সাইরেন লাগানো একটা বড়ো পুলিশি ভ্যান। গাড়ি দুটো এসে থামল লনের সামনেই। জীপ থেকে ইন্সপেক্টর খান আর সাব-ইন্সপেক্টর দত্তের সঙ্গে দু’জন মহিলা পুলিশও নামলেন।
হঠাৎ মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেল মিসেস মিত্রের। শুভ্রনীলবাবুর দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “কী গো, লেডি কনস্টেবল কেন এনেছে?
“মহিলা খুনিকে অ্যারেস্ট করতে হলে যে মহিলা পুলিশই আনতে হয়, মিসেস মিত্র।” ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে খানই উত্তরটা দিলেনওঁর ঠোঁটের কোণে একটা বিদ্রূপের আলগা হাসি যেন ঝুলে আছে। “কী হল, মিসেস মিত্র? ঘাবড়ে গেলেন মনে হচ্ছে
“না ইয়ে... আমি... কিন্তু...”
মিসেস মিত্রকে ছেড়ে এবার খান শুভ্রনীলবাবুর দিকে ফিরে তাকালেন। “বাড়ির সবাইকে একটু ডাকুন তো।”
“কী হয়েছে, ইন্সপেক্টর? নীলাঞ্জন কি তবে...”
কিছু বললেন না খান শুধু সেই শিকারি বাঘের মতো ক্রূর হাসিটা আবার ওঁর ঠোঁটে ভেসে উঠল।
ততক্ষণে বাড়ির সবাই এসে জড়ো হয়েছে লনে। খান পেছনে দাঁড়ানো ভ্যানটার দিকে ইশারা করতেই রামতনু একটা হাতকড়া পরানো লোককে ধরে নামাল। আর সঙ্গে সঙ্গে লনে জড়ো হওয়া ভিড়ের মধ্যে একজনের মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। ব্যাপারটা চোখ এড়াল না খানের।
“কে এ? শুভ্রনীলবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“আমাকে কেন? হালকা হাসলেন খান। “আপনাদের মিস পৃথাকে জিজ্ঞেস করুন না।”
“পৃথা!” একেবারে বাজ পড়ার মতো চমকে উঠলেন শুভ্রনীলবাবু। বাড়ির বাকিদেরও প্রায় একই অবস্থা।
খান এবার পৃথার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী পৃথাদেবী, চেনেন তো একে? দেখবেন আবার নিজের ভাইকে যেন অস্বীকার করে বসবেন না।”
খানের শেষ কথাগুলোতে একটা তীক্ষ্ন ব্যঙ্গ যেন ছলকে পড়ছিলএকটু থেমে খান আবার বলতে লাগলেন, “মিস পৃথা, আপনাদের প্ল্যানটা দুর্ধর্ষ ছিল। ঠিকমতো যদি এগজিকিউট করতে পারতেন, তাহলে জানি না ধরতে পারতাম কিনা। কিন্তু কয়েকটি জায়গায় আপনারা দু’জনেই বড্ড বোকার মতো কিছু ভুল করে এমন সুন্দর প্ল্যানটা একেবারে ধেড়িয়ে ফেলেছেন।
“তাহলে এবার পুরো গল্পটা গোড়া থেকেই বলি। মিত্র ভিলায় রাত সাড়ে ন’টার পর কাজের লোকেরা কেউ থাকে না, ওরা পেছনে নিজেদের কোয়ার্টারে চলে যায়। তাহলে রাতে মেইন বিল্ডিংয়ে শুধু চারজন থাকেন, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস মিত্র, নীলাঞ্জন আর মিস পৃথা। কিন্তু ঘটনার রাতে শুভ্রনীলবাবু পার্টিতে ছিলেন, তাহলে বাকি রইলেন তিনজন।
“মিসেস মিত্র যে রাতে ঘুমোবার আগে রোজ দুটো করে ব্লাড প্রেশারের ট্যাবলেট খান সেটা পৃথা জানতেন। তাই উনি আগেই ওষুধের শিশিটা গায়েব করে দেন, ফলে বাধ্য হয়ে মিসেস মিত্রকে নতুন শিশি আনতে দারোয়ানকে পাঠাতে হয়। মানে প্রায় মিনিট পনেরো গেট ফাঁকা, আর এটাই পৃথা চাইছিলেনসেই পনেরো মিনিটের মধ্যে মিস পৃথার এই গুণধর ভগিনী-পরায়ণ ভাই বাক্সভর্তি করে প্রায় বারো-তেরোটা কালো বেড়াল নিয়ে বাড়িতে ঢুকে কোথাও লুকিয়ে পড়ল। ওহ্‌, বলা হয়নি, ইনি কিন্তু আবার সরকারি পশু হাসপাতালে অ্যাসিস্ট্যান্টের চাকরি করতেন, তাই বেড়ালদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অজ্ঞান করা খুব একটা চাপের কাজ ছিল না এঁর পক্ষে।”
“কালো বেড়াল!” অবাক চোখে তাকালেন শুভ্রনীলবাবু।
“হ্যাঁ স্যার, কুচকুচে কালো বেড়াল। মন দিয়ে শুনুন গল্পটা, খুব ইন্টারেস্টিংঅবশ্য শুধু কালো বেড়ালই কেন সেটা আশা করি পরে মিস পৃথাই বলবেন।” খান একটু থেমে আবার শুরু করলেন, “এদিকে দারোয়ান ফিরে এসে যখন ওষুধের শিশিটা দিল তখন মিস পৃথা নিজের কাজটা সারলেন। সুযোগ বুঝে প্রেশারের ওষুধের শিশিটা সরিয়ে একইরকম দেখতে কড়া ডোজের একটা ঘুমের ওষুধের শিশি রেখে দিলেন। ব্যস, মিসেস মিত্র ওটাই খেলেন আর সেদিন বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়লেন। তাহলে এবার রাস্তা ফাঁকা, বাড়িতে এখন শুধু শিকারি আর শিকার।”
“তাহলে ওই শিশিতে ঘুমের ওষুধ ছিল!” উত্তেজনায় গলাটা কেঁপে উঠল মিসেস মিত্রের।
“না। আপনি যেই শিশি আমাদের দিয়েছিলেন তাতে প্রেশারের ওষুধই ছিল। সকালে হয়তো পৃথাদেবী সেটা আবার পালটে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেই একটা ভুল করে বসলেন। প্রেশারের ওষুধটা রাখার সময় খেয়াল করলেন না যে ওটা আস্ত রয়ে গেছে। শুধু মুখের সিলটা ভেঙে রেখে দিলেন। ভেতরে যে তিরিশটা ট্যাবলেটই রয়ে গেছে, দুটো যে সরাতে হবে সেটা মাথায় আসেনি। আর এখানেই আমার প্রথম খটকাটা লাগল।”
পৃথার চোখ দুটো আগুনের মতো লাল হয়ে আছে।
খান তখনও বলে চলেছেন, “এবার প্ল্যানের দ্বিতীয় ধাপ। বাড়ির ভেতর লুকিয়ে থাকা ভাইকে ঘরে নিয়ে এলেন মিস পৃথা। ঘড়িতে তখন প্রায় সাড়ে দশটার একটু বেশি হবে। মিসেস মিত্র গভীর ঘুমে, চাকরবাকর সবাই বাড়ির অনেকটা পেছনে নিজেদের ঘরে আর ভিলার গেটটা মেইন বিল্ডিং থেকে অনেকটা সামনে, তাই দারোয়ানের কিছু শুনতে পাবার কথা নয়। নীলাঞ্জন তখন ছাদে পায়চারি করছে, ওর রোজকার অভ্যেস মতন। এবার পৃথাদেবী আর ওঁর এই ভাই মিলে বাক্স থেকে অজ্ঞান বেড়ালগুলোকে ছাদে চালান করে দিয়ে দরজা আটকে দিলেন। বেড়ালদের তখন জ্ঞান ফেরার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সেগুলো জেগে উঠে ছাদে ঘুরে বেড়াতে লাগল। ডাকাডাকিও নিশ্চয়ই করেছে, কিন্তু সেই শব্দ শোনার লোক কই!
“নীলাঞ্জনের একটা রোগ ছিল। অ্যাইল্যুরোফোবিয়া, মানে সোজা বাংলায় অস্বাভাবিক ধরনের বেড়াল-আতঙ্ক। আর সেটা মিস পৃথা ভালোভাবেই জানতেন। স্বভাবিকভাবেই যে নীলাঞ্জন বেড়ালছানা দেখেই জ্ঞান হারায় সে এতগুলো কালো বেড়াল দেখে ভয়ানক ট্রমায় চলে গেল, চিৎকারও হয়তো বেরোয়নি ওর গলা দিয়ে। ভয়ে পিছোতে পিছোতে সে গিয়ে উঠে পড়ল ছাদের দেয়ালের পাশে বসার জায়গাটায়, আর তারপর একসময় হঠাৎ পা হড়কে সোজা নিচে। মিসেস মিত্র ওষুধ খেয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছেন, কোনও শব্দ শুনতে পাননি আর গেট অনেকটা দূরে হওয়ায় দারোয়ানও কিছু বুঝতে পারেনি।
“এবার ফাইনাল ধাপ। আপনার ভাই ছাদে গিয়ে আবার বেড়ালদের অজ্ঞান করে বাক্সে পুরতে লাগল আর আপনি নীলাঞ্জনের ঘরে গিয়ে সুইসাইড নোট লিখতে বসলেনআর সেখানেই আরেকটা ভুল করলেন। আপনার গায়ে যে বেড়ালের লোম লেগেছিল সেটা বোধহয় খেয়াল করেননি ব্যস, সেই লোম লেগে গেল নোটেও। আর সেখানেই আমার সন্দেহটা চাগাড় দিয়ে উঠল।”
“কিন্তু স্যার, এই লোকটা এতগুলো বেড়াল নিয়ে রাতে বেরোল কীভাবে? আমি তো গেটেই ছিলাম।” দারোয়ান হরিচরণ জিজ্ঞেস করল।
“কে বলল রাতে বেরিয়েছে? ও পুরো রাত মিত্র ভিলাতেই ছিল। সকালে যখন নীলাঞ্জনের বডি দেখে বাড়িতে শোরগোল শুরু হয়, তুমিও ছুটে আসো, তখনই সুযোগ বুঝে এ বেড়ালসহ চম্পট দিয়েছিল।”
খান এবার পৃথার দিকে ফিরে বললেন, “মিস পৃথা, আপনি দুটো ভুল করেছেন আর আপনার ভাই আরও দুটো। ভুয়ো ফিল্ম কোম্পানির নামে কালো বেড়াল ভাড়া করবার জন্য জালি কার্ড তো বানাল, কিন্তু এটা খেয়াল করল না যে কার্ডের পেছনে ছাপাখানার ওয়াটার মার্ক দেওয়া আছে। ব্যস, আমরা সোজা চলে গেলাম জুবিন প্রিন্টার্সে। সেখানে গিয়ে বুঝলাম, আপনার ভাই আরেকখানা ভুল করে এসেছে। সেই দোকানে বেশ কায়দা করে লুকোনো একটা সি.সি ক্যামেরা আছে, ঠিক দোকানের ডেস্কের ওপরে। সেটা তো আর আপনার ভাই জানতেন না, তাই নিজের চাঁদবদনটা সুন্দর করে ক্যামেরায় দেখিয়ে দিলেন। তারপর আর কী, পুলিশের নেটওয়ার্ক তো আপনি জানেনই! দু’দিনের বেশি লাগেনি আপনার ভাইটিকে ধরতে। থানায় নিয়ে আচ্ছা করে একটু রামপ্যাঁদানি দিতেই হড়হড় করে সব স্বীকার করে নিল।”
একটানা কথাগুলো বলে একটু থামলেন ইন্সপেক্টর খান।
“আচ্ছা, এবার আসল প্রশ্ন। নীলাঞ্জনকে মারলেন কেন? বেচারা কী ক্ষতি করেছিল আপনার? খানের গলাটা বেশ কড়া শোনাল।
আস্তে আস্তে চোখ তুলে তাকাল পৃথা। অবিশ্বাস, রাগ আর ঘেন্না জড়ানো একগাদা চোখ চারপাশ থেকে ওর দিকেই চেয়ে আছে এখন।
হঠাৎ খানের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত গলায় পৃথা চিৎকার করে উঠল, “বেশ করেছি। ওই শয়তানটার জন্যই তো আমার কৃষ্ণা মারা গেছিল।”
“কৃষ্ণা? চোখ সরু করে তাকালেন খান।
“আমার পোষা কালো বেড়াল। বড়ো ভালোবাসতাম ওটাকে, নিজের মেয়ের মতো। রড দিয়ে পিটিয়ে মেরেছিল আমার কৃষ্ণাকে।”
একটু থেমে পৃথা আবার বলল, “নীলু বরাবর বেড়াল ভয় পেত। আমি তখন নতুন এসেছি এই বাড়িতে, ব্যাপারটা জানতাম না। তাই একদিন কৃষ্ণাকেও সঙ্গে নিয়ে আসি। আর সেটাই কাল হল।
“কৃষ্ণাকে লনে ছেড়ে দিয়ে আমি একটু বেরিয়েছিলাম। তখন কি জানতাম যে ফিরে এসে আমার মেয়েটাকে আর দেখতে পাব না!” চোখদুটো যেন আরও লাল হয়ে উঠল পৃথার। “কৃষ্ণা হঠাৎ বোধহয় নীলুর সামনে গিয়ে পড়ে আর সঙ্গে সঙ্গে পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করে নীলু। ওর চিৎকার শুনে বড়োবাবু, মানে ওর বাবা ছুটে আসেন। বড়োলোকের মেজাজ তো জানেনই, ছেলের ভয় দূর করবার জন্য লোহার রড তুলে পেটাতে শুরু করল আমার কৃষ্ণাকে। মারতে মারতে মাথাটা থেঁতলে দিয়েছিল ওরা। ফিরে এসে যখন সব জানতে পারলাম, কান্নায় বুকটা ফেটে গেছিল আমার। পাগলের মতো হয়ে গেছিলাম কিছুদিন, কী করব কিছুই মাথায় আসছিল না।
“তখনই ঠিক করেছিলাম, এক এক করে শেষ করে দেব ওই শয়তানগুলোকে। বাপটাকে মেরেছিলাম গাড়ির ব্রেক কেটে দিয়ে আর এবার ছেলেটাকেও... শেষ করে দিয়েছি সবগুলোকে।”
কথাগুলো বলতে বলতে রাগে ফুঁসতে লাগল পৃথা ঠিক একটা কালো বেড়ালের মতো।
_____
ছবিঃ সুমিত রায়

4 comments:

  1. খুনের মোটিভেই আসল চমক ছিল। দারুণ লাগল।

    ReplyDelete
  2. ভালো লাগল বিভাবসু। বিস্তার খুব সুন্দর।

    ReplyDelete
  3. বেশ ভালো লাগলো

    ReplyDelete