ক্যাবলাপুরের ভূতুড়ে কাণ্ড
বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
।। ১ ।।
বলাইবাবু
আর মলয়বাবুর বেজায় ভাব। যাকে বলে একেবারে গলায় গলায় গলাগলি। দু’জনেই এককালে শহরে
চাকরি করেছেন। তারপর রিটায়ার করে গ্রামে এসেছেন। রিটায়ারমেন্টের পরে দু’জনে একসঙ্গে
প্রাতঃভ্রমণে বের হন। সেই প্রাতঃভ্রমণে গিয়েই দু’জনের মধ্যে ক্যাবলাপুর গ্রামের
সমস্ত সমস্যা আলোচনা হয়। যেমন একদিনের কথা ধরা যাক। বলাইবাবু চলতে চলতে বলতে শুরু করলেন,
“বুঝলে হে, গ্রামের বাজারে আমাদের নিত্যানন্দ মুড়ি তেলেভাজার দোকান দিয়ে কী লাভই
না করছে! টাকার বস্তা জমতে জমতে তালগাছের সমান লম্বা হয়ে গেছে। সেই আনন্দে সে
বাড়ির পোষা কুকুরের নাম দিয়েছে ‘ভেজিটেবল’ আর বেড়ালের নাম দিয়েছে ‘চপ’। এখন রোজ দোকান থেকে বাড়ি ফিরে
নিত্য ‘ভেজিটেবল চপ’ বলে হাঁক পাড়লেই কুকুর-বেড়াল দু’দিক থেকে ছুটে এসে তাঁর পায়ের
ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কিন্তু তুমিই বলো, ব্যাপারখানা কি ঠিক হল?”
মলয়বাবু
মাথা নাড়িয়ে বললেন, “উঁহু, একেবারেই ঠিক হয়নি। কুকুর খায় মাংসের ছাঁট, তার নাম
ভেজিটেবল? বেড়াল
চপের চ-ও বোঝে না, মাছের দিকে তার নজর, অথচ তার নাম চপ। এই নামকরণের কোনও সার্থকতা
নেই। তার চেয়ে ভাবছি যে নিত্যকে একদিন ডেকে বলেই দেব যে নাম দুটো বদলে ‘ঘেউ’
আর ‘মিঁউ’ করে দিতে।”
বলাইবাবু
বিরক্তির গলায় বললেন, “সে চেষ্টা কি আর আমি করিনি ভেবেছ? গতকালই বিকেলে তার সঙ্গে দেখা
করে তাকে বলেছি। নিত্যানন্দকে বললাম যে পশু দুটির নাম তো আর ভোটার-কার্ড-আধার-কার্ডে
ওঠেনি। যখন-তখন পরিবর্তন করলেই হয়। এবং নামকরণে একটা সামঞ্জস্য বা সার্থকতা থাকা
উচিত। জলহস্তীর নাম কখনও লজ্জাবতী হতে পারে!”
“হুম,
তা, নিত্য শুনে কী বলল?”
“বলল,
সে সম্ভব নয়।”
“কী?
তোমার কথা অগ্রাহ্য করা? এত বড়ো সাহস! সে নাম পরিবর্তন করবে না কেন?”
“কারণ
হিসেবে বলছে যে প্রাণী দুটোর নাকি ঐ পুরোনো নামেই অভ্যেস হয়ে গেছে। আবার নতুন নাম
দিলে সেই নামের ট্রেনিং দিতে হবে। অত হ্যাপা পোষাবে না।”
“বড়োই
চিন্তার কথা… বড়োই চিন্তার কথা। এই বুড়ো বয়সে এইসব চিন্তাও ঘাড়ে নিতে হবে!”
বলাইবাবু
ও মলয়বাবু যখন এই আলোচনা করছেন, তখন পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল, “চিন্তা কি আমারও
কিছু কম?” দু’জনেই অবাক হয়ে বক্তার দিকে তাকালেন। তাঁদের সামনে জগাই পাগলা দাঁড়িয়ে
আছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে যে সে বেশ উদ্বিগ্ন।
মলয়বাবু
তাচ্ছিল্যভরে বললেন, “তোর আবার চিন্তা কীসের? হাবিজাবি বিষয় নিয়ে ভাবিস আর চিন্তা
করিস।”
জগাই
কথাটা গায়ে মাখল না। বলল, “না গো, হাবিজাবি নয়। আমি ভূত দেখেছি!”
বলাইবাবু
সামান্য হাসলেন। বললেন, “তুই ভূত দেখেছিস? এ আবার বিশেষ কথা কী? ক্যাবলাপুরের কে
আবার ভূত দেখেনি? যে ভূত দেখেনি, সে নিজেই ভূত! তা, দেখলি কোথায়? এদিককার কোনও
ঝোপঝাড়ে?”
জগাই
তার লম্বা দাড়ি দুলিয়ে বলল, “সামনে থেকে ডানদিকের রাস্তাটা গেছে বোসেদের মাঠের
দিকে। ঐ বোসেদের মাঠেতেই ভূত দেখেছি।”
বলাইবাবু
রসিকতার ভঙ্গিতে বললেন, “তা কী দেখলি? ভূত ও বাঁদর গাছে বসে কলা খাচ্ছে?”
জগাই
সিরিয়াস হয়ে বলল, “হেসো না। ভূত আমি সত্যি দেখেছি। সে ভারী অদ্ভুত ভূত।”
মলয়বাবু
ভুরু কুঁচকে বললেন, “কীরকম?”
জগাই
বলল, “বোসেদের মাঠে আমি বহুদিন যাইনি। কাল যখন গেলাম, দেখি গম্বুজের মতো একটা বড়ো বাড়ি।
তাতে জানালা আছে, কিন্তু বড়ো দরজা নেই। সেই জানালা দিয়ে দেখি কি, কতকগুলো ভূত
লাফিয়ে জমিতে নামছে আর গড়াচ্ছে।”
মলয়বাবু
বললেন, “গড়াচ্ছে মানে?”
জগাই
খস খস করে মাথা চুলকে নিল। তারপর বলল, “ভূতগুলো যখন মাটিতে নামল তখন তাদের দুটো
করে হাত, তিনটে করে পা। এর পরে তাদের হাত-পাগুলো সব শরীরের ভেতর ঢুকে গেল। ছিল
চৌকোনা-চৌকোনা দেখতে, হঠাৎ করে পুরো গোল ফুটবল হয়ে গেল। তারপর সব মাটিতে গড়াতে
লাগল। গড়াতে গড়াতে মাঝে মাঝে থামছে। তাদের পেটের কাছে বড়ো গর্ত হয়ে যাচ্ছে। একটা
হাত বেরিয়ে আসছে। হাত দিয়ে ঘাস-ফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে গর্তের ভেতর ঢোকাচ্ছে। তারপর গর্ত
বন্ধ হচ্ছে এবং তারা আবার গড়াচ্ছে।”
বলাইবাবু
বিস্ময়ে বললেন, “ঘাস-ফুল ছিঁড়ছে? ছিঁড়ে খাচ্ছে? গরু-ছাগলের ভূত নয়তো!”
জগাই
অন্যমনস্কভাবে বলল, “কে জানে! আমি তো অনেকক্ষণ ধরে দেখেও তাদের হাম্বা-ডাক,
ম্যা-ম্যা-ডাক শুনলাম না।”
মলয়বাবু
বললেন, “তারপর কী হল?”
জগাই
বলল, “বেশ কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে খেলবার পরে ভূতগুলো ক্লান্ত হয়ে গেল। আবার তারা গোল
থেকে চারকোনা হয়ে গেল। তাদের হাত-পাগুলো সব বেরিয়ে এল। তারা মাটি থেকে পটাপট লাফ
মেরে আবার জানালা দিয়ে গম্বুজ বাড়িতে ঢুকে গেল।”
মলয়বাবু
কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “তোর কথায় বিশ্বাস আছে? যত্ত সব পাগলের প্রলাপ। সকাল সকাল আমাদের বোকা বানাতে
এসেছিস? যা, পালা এখান থেকে।”
জগাই
কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “আমি জানতাম যে আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।”
দুঃখী
মনে জগাই পাগলা আবার ঝোপঝাড়ের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
।। ২ ।।
নিত্যানন্দের
তেলেভাজার দোকানে আড্ডা বসেছে। আড্ডা দিতে উপস্থিত আছেন বলাইবাবু, মলয়বাবু, অঙ্কের
শিক্ষক পরাণমাস্টার, কাপড়ের ব্যবসায়ী গড়গড়িবাবু, সাইকেল সারানোর দোকানের মালিক
নরহরিবাবু ও আরও কয়েকজন। বলাইবাবু ও মলয়বাবু ইতিমধ্যেই সকালবেলায় শোনা জগাই পাগলার
গল্পটা সবাইকে বলে দিয়েছেন। তাইতে ভূত নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে।
গড়গড়িবাবু
বললেন, “ভূত নিয়ে গ্রামে কম ঘটনা তো ঘটেনি! সে সব দেখে দেখে চোখ পচে গেল। এই নর, তোমার
দাদুর ঘটনাটাই বলো না সবাইকে।”
নরহরিবাবু
বেশ একটু খুশি হলেন বলে মনে হল। বললেন, “কী আর বলব? আমার ঠাকুর্দার শ্মশানযাত্রার
সময়, তাঁর শবদেহ নিয়ে যখন শ্মশানযাত্রীরা চলেছে, তখন মাঝপথে তিনি হঠাৎ উঠে বসলেন।
তারপর বললেন, ‘ওরে তোরা আমায় কোথায় নিয়ে চলেছিস রে?’ এমন ভূতুড়ে ঘটনায় কেউ ভয়ে পেল
না। কোনও একজন শববাহক উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে, আপনি আর জীবিত নেই। তাই আমরা সবাই চলেছি
আপনাকে দাহ করতে।’ ঠাকুর্দা
উদাস হয়ে বললেন, ‘যাহ, মাত্র পঁচাশি বছর বয়স হয়েছিল গো। অকালে প্রাণটা গেল। ওরে,
এই দুঃখ রাখি কোথায়? এত দুঃখ! দুঃখে দুঃখে আমার আবার খিদে পেয়ে গেল যে। আজ সকালে
গরম এক গ্লাস দুধ আর দুটি বিস্কুট যে খাওয়া হল না। বেলায় যদি স্বর্গে যাত্রা করি,
সেখানে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে। যাত্রাপথে টিফিন দেবে কিনা সন্দেহ। বলি, তোরা
আমাকে খানকতক লুচি আর একটু মিহিদানার ব্যবস্থা করে দে।’ শববাহক মৃদু বকুনির ঢঙে
বলল, ‘ভূতের জন্যে লুচি-মিহিদানা দোকানে নিতে এসেছি শুনলে গাঁয়ের পাঁচ জন পাঁচ কথা
বলবে। তার চেয়ে একটা দিন খিদে চেপে রাখুন। খিদে
একটু চাপলে খিদে বেশি হবে। তখন
একটার জায়গায় দশটা রসগোল্লা খেতে পারবেন।’ অন্তিমযাত্রা চলতে লাগল। ঠাকুর্দা, থুড়ি
ওনার ভূত বিরসবদনে চুপ করে খাটে শুয়ে পড়লেন।”
গল্প
শেষ করে নরহরিবাবু আড্ডায় বাকি সকলের দিকে তাকালেন। উপস্থিত সকলে তাঁকে বাহবা
দিলেন। কেবল চুপ করে রইলেন, পরাণমাস্টার। বলাইবাবু তাঁকে বললেন, “কী হে পরাণ। চুপ
করে কেন? কিছু তো বল। তোমার ভূত দেখার অভিজ্ঞতা কেমন?”
পরাণমাস্টার
বললেন, “কী আর বলব বলুন? ভূতে বিশ্বাস করতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে
যে ভূত আমি তেমন দেখিনি।”
বলাইবাবু
অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বললেন, “কোনোদিন দেখনি?”
পরাণমাস্টার
বললেন, “উঁহু।”
উপস্থিত
সকলে হাঁ-হাঁ করে উঠলেন। ভূত দেখেনি, এমন লোকের দেখা মেলা দুষ্কর। মানুষ তো কোন
ছাড়, ক্যাবলাপুরের ভূতেরাও এমন লোকের কথা শোনেনি বোধহয়! না, পরাণমাস্টার একজন
ব্যতিক্রমী লোক বটে।
পরাণমাস্টার
কিছু না বলায় এরপর বলাইবাবু, মলয়বাবু, গড়গড়িবাবু নিজেদের ভূত দেখার অভিজ্ঞতা
বললেন। তারপর আড্ডা শেষ হল।
।। ৩ ।।
টুবলুর
কিচ্ছু ভালো লাগছে না। একে তো অঙ্ক মাথায় ঢোকে না বলে তাকে বাবা সবসময়ই বকুনি দিয়ে
চলেছে। মাথা কাজ করছে না। এদিকে ছোটো বোন তিন্নি যখন-তখন তাকে এসে ডাকবে, “দাদা,
আজ আমার পুতুলের বিয়ে। আমি বউটাকে সাজাব। তুই বরটাকে সাজাবি, কেমন? আর কড়াতে তুই
পোউটা রান্না করে দিবি।” তিন্নি পোলাউ বলতে পারে না। সে পোলাউকে পোউ বলে।
টুবলু
ব্যাজারমুখে বলে, “সে সব পরে হবে’খন। এখন যা তো। অঙ্ক পারছি না আমি!” রাগে দুঃখে
তার কান্না আসে। এর মধ্যে আবার ইশকুলে শুনছিল যে গ্রামের প্রান্তে বোসেদের মাঠে
নাকি ভূত দেখা গিয়েছে। অঙ্কের ঝামেলার জন্যে সে ঠিক সেদিকটা যাওয়ার সময় পাচ্ছে না।
কিন্তু আজ রবিবার। ইশকুল
নেই। অঙ্কগুলো শেষ করে তাড়াতাড়ি বোসেদের মাঠের দিকে যেতে হবে। ব্যাপারটা কী একটু
দেখতেই হচ্ছে। ভূতেদের ব্যপারে বহুদিনের কৌতুহল টুবলুর।
বোসেদের
মাঠে যাবার সুযোগটা যে এমনি করে পেয়ে যাবে তা টুবলু ভাবতে পারেনি। বাবা হঠাৎ
টুবলুর ঘরে এসে বলল, “আমি এখন একটু বেরোচ্ছি। ফিরতে রাত হবে। তুমি অঙ্ক বইয়ের ৪ নং
প্রশ্নমালা শেষ করে রাখবে। বুঝেছ?”
টুবলু
ঘাড় নাড়ল। এই শক্ত শক্ত অঙ্কগুলো সে একটাও পারবে না। তার চেয়ে বোসেদের মাঠ থেকে ঘুরে
আসাই ভালো। এই ভেবে যেই না সে ঘরের বাইরে পা বাড়িয়েছে তখনই শুনল যে বাবা মাকে
বলছে, “ভূত দেখেনি বলে লোকে পরাণমাস্টারকে দূরছাই করছে। যাই বোসেদের মাঠ থেকে ঘুরে
আসি। আজ ভূতেদেরই একদিন কি আমারই একদিন।” এই বলে টুবলুর বাবা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে
গেল।
টুবলু
ভাবল, সর্বনাশ! তার বাবাও যে ভূত দেখতে গেল। তাকে দেখে ফেললে মুশকিল। সাবধানে
ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। ভূতগুলোকে টুক করে দূর থেকে দেখে নিতে
হবে। তারপর বাবা ফিরে আসবার আগেই তাকে ফিরে আসতে হবে। এর অন্যথা হলে বাড়িতে ভয়ানক
শাস্তি অপেক্ষা করছে।
সব
কিছু চিন্তাভাবনা করে টুবলু বেরোল। তার বাড়ি থেকে হাঁটাপথে বোসেদের মাঠ আধ ঘণ্টা। টুবলু
পা চালাল। হাট-বাজার, পুকুড় পাড়, সর্ষে ক্ষেত – সব পেরিয়ে সে পৌঁছেও গেল বোসেদের
মাঠে। ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে মাঠের দিকে তাকাতেই তার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। তার
বাবা মাঠের ঠিক মাঝখানে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সারা মাঠ জুড়ে বেশ বড়ো বড়ো ফুটবল
গড়াতে গড়াতে ধেয়ে আসছে তার বাবার দিকে। তার
মানে এগুলো সাধারণ ভূত নয়। নির্ঘাত ফুটবলের ভূত!
টুবলুর
বাবা সাইকেলটা ঘুরিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তার আগেই তাঁকে ঘিরে ধরল
সেই ফুটবলগুলো। নিমেষে ফুটবলগুলোর শরীর থেকে বেরিয়ে এল হাত-পা। সেই হাত দিয়ে তারা পরাণমাস্টারকে
চেপে ধরল। তারপর একজন ফুটবল ভূতের হাত থেকে বেরিয়ে এল একটা অদ্ভুত বেগুনি আলো। দিনের
বেলা বলে আলোটা একটু হালকা দেখাচ্ছিল, রাতে হলে বেশ জোরালো দেখাত। আলোর ভূতটা আলোর
রেখাটাকে আস্তে আস্তে পরাণমাস্টারের শরীরের পা থেকে মাথার দিকে নিয়ে যেতে লাগল। তারপর মাথার কাছে এসে আলোকে আর
সরাল না।
এই
ভূতগুলো তার বাবার সঙ্গে নির্ঘাৎ খারাপ কিছু করবে। রাগে-উত্তেজনায় টুবলু চেঁচিয়ে
উঠতে গেল। এমন সময়, কে যেন পেছন থেকে তার মুখে হাত চাপা দিল। টুবলু চমকে উঠে
সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল জগাই পাগলা। জগাই পাগলা বলল, “চুপ করে থাক। কথা বলিস না। দেখে
মনে হচ্ছে, ওরা তোর বাবাকে পটলভাজার মতো করে ভাজছে। আমরা কাছে গেলে আমাদেরকেও
ভাজবে!”
টুবলু
জগাইয়ের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য হাত-পা ছুঁড়তে লাগল, কিন্তু জগাই শক্ত করে ধরে
রইল।
।। ৪ ।।
পরাণমাস্টারের
শরীর কেমন যেন অবশ হয়ে গেছে। ভূতেদের
সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটিয়ে মনে হল তিনি বোধহয় হার্টফেল করবেন। তাঁর সারা শরীরের ওপর
দিয়ে একটা হালকা আলো চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তাঁর শরীর থেকে কিছু যেন বেরিয়ে যাচ্ছে,
কিন্তু সেটা যে ঠিক কী, তা তিনি ধরতে পারছিলেন না। একসময় আলোটা নিভে গেল। যেসব
ভূতগুলো তাঁর হাত ধরে ছিল, তারা সব হাত ছেড়ে দিল। আর, যে ভূতটা তাঁর ওপর আলো
ফেলছিল, সে পরিষ্কার বাংলায় কঠিন স্বরে বলে উঠল, “মানুষ... আপনি কি মানুষ?”
পরাণমাস্টার
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তাঁর মুখের কথাটুকু বার করবার সাহস হচ্ছে না।
তারপর ঢোঁক গিলে বললেন, “হ্যাঁ।” তারপর আরও একটু সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনারা? ভূত নিশ্চয়ই?”
একটা যান্ত্রিক স্বরে
পরিষ্কার বাংলায় উত্তর এল, “আমরা ভিনগ্রহী। আপনারা নিজেদের মানুষ বলেন, তাই না?”
পরাণমাস্টারের
কথা আটকে যাচ্ছিল। তিনি থতোমতো খেয়ে বললেন, “হ্যাঁ। ইয়ে মানে, আপনারা বাংলা ভাষায়
কথা...”
“আপনার
মাথা থেকে থিটা-স্ক্যান করে আমরা আপনার জ্ঞান ও ভাষা নিয়ে নিয়েছি।”
“সে
নিন গে যান। কিন্তু আমাকে নিয়ে আপনারা কী করতে চাইছেন? আগেই বলে দিচ্ছি যে আমার
মাংস কিন্তু একেবারেই সুস্বাদু নয়। তাছাড়া খেলে আপনাদের বমি-পেটখারাপও হতে পারে।
আগেই সতর্ক করে দিলাম।”
“আপনার
শরীর আমাদের দরকার নেই। আমরা টিউবোলেব্রাস গ্রহ থেকে আসছি। আমরা এমন একটা জিনিস
খেয়ে বেঁচে থাকি যেটাকে আপনাদের ভাষায় সুতো বলা যেতে পারে।”
“সুতো!
সঙ্গে ছুঁচও খান নাকি? গলায় ফোটে না? ওহ, আপনাদের তো গলাও দেখছি না।”
“না,
আমরা শুধু সুতো খাই। ধাতব
সুতো। আপনাদের গ্রহে এসে আমরা এই জমির ওপর থাকা এই সবুজ রঙের জীবকেও সুতো ভেবে খাওয়ার
চেষ্টা করেছিলাম। না, এই খাবারও আমাদের উপযুক্ত নয়।”
“ইয়ে,
বুঝলাম। তা, আমাকে নিয়ে আপনাদের তো বিশেষ দরকার নেই। এখন দুপুর হয়ে গেছে, সুতরাং
আপনারাও সুতো খান, আমিও বাড়ি গিয়ে মাছ-ভাত খাই। কেমন? তাহলে ছেড়ে দিন আমাকে।”
“না,
আপনাকে আমাদের দরকার। আমাদের বিজ্ঞান পুরোটাই শব্দতরঙ্গ নির্ভর। কিন্তু মানুষের
বিজ্ঞান দেখছি অঙ্ক নির্ভর। আপনাকে আমাদের গ্রহে নিয়ে যাব। আপনি ব্যাখ্যা করবেন যে
অঙ্ককে ব্যবহার করে কীভাবে আমরা উন্নতি করতে পারি।”
পরাণমাস্টার
যখন ভিনগ্রহীদের হাত থেকে রক্ষা পাবার আশা ত্যাগ করেছেন, সেই সময়েই ঘটনাটা ঘটল। তিনি
দেখলেন যে তাঁর ছেলে টুবলু ছুটতে ছুটতে আসছে আর তার পেছন পেছন টুবলুকে আটকাতে দৌড়ে
আসছে জগাই পাগলা। নিজের ছেলেকে এই বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে দেখে এই বেঠিক সময়েও
পরাণমাস্টার বেশ রেগে গেলেন। তিনি বললেন, “হতচ্ছাড়া, অঙ্ক ফেলে বোসেদের মাঠে আসা
হয়েছে! দাঁড়া, বাড়ি ফিরে দেখাচ্ছি মজা।”
টুবলু
আর জগাই পাগলাকে মুহূর্তের মধ্যে ভিনগ্রহীরা ঘিরে ধরল। জগাই আর টুবলুর হাত চেপে
ধরে তাদের ওপরেও থিটা-রশ্মি প্রয়োগ করা হল।
তিনটে
মানুষের জ্ঞান শোষণ সম্পূর্ণ হলে পরে হঠাৎ ভিনগ্রহীদের মূল বক্তার ভেতর থেকে একটা
বিপ-বিপ শব্দ হতে থাকল। তার সঙ্গে সে যান্ত্রিক গলায় চিৎকার করে উঠল, “সর্বনাশ,
সর্বনাশ! তিন জন মানুষ তিন রকম অঙ্ক জানে!”
পরাণমাস্টার
ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “মানে?”
ভিনগ্রহী
উত্তর দিল, “তোমার মাথা থেকে পাচ্ছি পাটিগণিত, জ্যামিতি, পরিমিতির বিভিন্ন সূত্র।
তোমার সূত্র থেকে পাওয়া একটা গুণফল হচ্ছে ৩ X ১৪ = ৪২। এই গুণফল আমরা দ্বিতীয় ও
তৃতীয় মানুষটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। দ্বিতীয়
মানুষটার মাথায় তথ্য থেকে পাচ্ছি যে ৩ X ১৪ = ৫৪ । তৃতীয় মানুষটার মাথা থেকে
পাচ্ছি ৩ X ১৪ = পুঁইশাকের চচ্চড়ি! ব্যাপারটা চরম বিভ্রান্তিকর।”
পরাণমাস্টার
একটু চিন্তা করলেন। হাসি ফুটল তাঁর মুখে। তিনি বললেন, “দেখ, এইটাই আমি তোমাদের আসলে
বোঝাতে চাইছিলাম। এক একজন মানুষের অঙ্কের প্যাটার্ন এক এক রকমের। কারও সঙ্গে কারও অঙ্ক
মেলে না। সুতরাং আমার কাছ থেকে অঙ্ক শিখে তোমরা অন্য কোনও মানুষের ওপর প্রয়োগ করতে
পারবে না। এই জ্ঞান তোমাদের কোনও কাজেও লাগবে না। সুতরাং তোমরা তোমাদের বিদ্যে
কাজে লাগাও, আমরা আমাদের। কেমন?”
কয়েক
মিনিট নিস্তব্ধতা। তারপর পরাণমাস্টার, টুবলু আর জগাই পাগলার থেকে ভিনগ্রহীরা দূরে
সরে গেল। ভিনগ্রহীদের মূল বক্তা বলল, “তোমাদের থেকে বা এই গ্রহ থেকে আমাদের কিছু
পাওয়ার আছে বলে তো মনে হয় না! সুতরাং আমরা ফিরে যাচ্ছি আমাদের টিউবোলেব্রাস
গ্রহে।”
জগাই
পাগলা চেঁচিয়ে বলল, “সাবধানে যাবেন। টুথব্রাশ গ্রহে পৌঁছে একটা চিঠি দিয়ে জানাবেন
যে ঠিকঠাক পৌঁছলেন কিনা। নইলে চিন্তায় থাকব।”
।। ৫ ।।
পরাণমাস্টারের
ঘরে জোর আড্ডা বসেছে। একজন অঙ্কের মাস্টারমশাই, অঙ্কে কাঁচা ছাত্র এবং এক পাগলের
অঙ্কের হিসেব যে এক হবে না, সে তো বলাই বাহুল্য। সেই সামান্য ব্যাপারকে ভুলভালভাবে
বুঝিয়ে পরাণমাস্টার যে কীভাবে ভিনগ্রহীদের ঘোল খাইয়ে দিয়েছেন, সে কথা জানতে পেরে
গ্রামের লোকেদের প্রশংসা আর ধরে না।
বোসেদের
মাঠে পরাণমাস্টার, টুবলু আর জগাই পাগলার আবক্ষ মূর্তির উদ্বোধন হবে বলে ঠিক হল। জগাই পাগলাকে দু’বেলা দু’মুঠো
গ্রামের মন্দিরে খেতে দেওয়া হবে স্থির হল। বলাইবাবু বললেন, “ক্যাবলাপুর এতদিন ভূতেদের
জন্য বিখ্যাত ছিল। আজ থেকে ভিনগ্রহীদের জন্যও বিখ্যাত হল।”
মলয়বাবু বললেন, “বিশ্বের
মানচিত্রে শিগগিরই ক্যাবলাপুরের নাম উঠে যাবে।”
টুবলু
খুব খুশি। জীবনে প্রথমবার চোদ্দর ঘরের নামতা ভুল জানার জন্য সে বাবার কাছে প্রশংসা
পেয়েছে। খুশি মনে সে বড়োদের আড্ডার মাঝে একটু আমপোড়ার সরবত খাচ্ছিল। এমন সময়
তিন্নি এসে তার হাত টানতে টানতে বলল, “আমার পুতুলের আজ বৌভাত। চল তুই খাবার রান্না
করবি চল।”
টুবলু
কিছু বলবার আগেই ঘরে উপস্থিত নিত্যানন্দবাবু বললেন, “ওমা খুকি, তোমার পুতুলের
বৌভাতে টুবলুবাবু কী রান্না-বাজার করবে গো? ওটা যে আমার কাজ। আমিই তো তোমার পুতুলের
বিয়ের ক্যাটারার!”
নিত্যানন্দবাবুর
কথায় ঘরে উপস্থিত সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
_____
ছবিঃ সপ্তর্ষি চ্যটার্জী
No comments:
Post a Comment