পূর্বা মুখোপাধ্যায়
স্কুলটার
নাম সত্যনারায়ণ মেমোরিয়াল। শহরতলির এই অঞ্চলে সব চেয়ে
নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম কোএডুকেশনাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর এই স্কুলের নাইন ডি এবারের সবচেয়ে কুখ্যাত ব্যাচ। যেসব টিচারেরা এই ক্লাসটিকে পড়ান তারা সবাই পাড়ার করুণাময়ী মন্দিরে
কালীমায়ের কাছে মানত করেছেন পরের বার যেন আর এই খপ্পরে না পড়তে হয়।
এই নাইন
ডি-র সব কেলেংকারির মাথা হল দ্রোণাচার্য। হাইটে সে মাত্র পাঁচ ফুট। কিন্তু ওই – ‘এতটুকু
যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়!’ কথাটি তার ক্ষেত্রে একেবারে খাপে খাপ। যেমন আজ সকালে, নভেম্বরের শেষে বাতাসে সবে বেশ একটা হালকা শীতের আমেজ, তার ওপরে আবার মেঘ করেছে। বৃষ্টি হলেই ঠান্ডাটা পড়বে
জাঁকিয়ে - ভাবতে ভাবতে বেশ প্রসন্ন মনে ফার্স্ট
পিরিয়ডে বাংলা ক্লাস নিতে ঢুকলেন সমীর স্যর। “আজ বাগধারা,
সবাই খাতা বের কর,” বলে চকটা তুলে নিয়ে বোর্ডের দিকে ফিরেই দেখেন গোটা
গোটা অক্ষরে লেখা –
‘এই মেঘলা দিনে
বগলা ক্লাসে বসে না তো মন
মাঠে যাব, কবে পাব, ওগো তোমার পারমিশন!’
এ হাতের
লেখা তাঁর চেনা। খাতায় কতবার দেখেছেন। জ্যান্তর বিপরীত শব্দ অজ্যান্ত, ‘আমরা’ ব্যাসবাক্য হল আম ও রা, এসব দেখে দেখে হত্যার ইচ্ছে দমন করে খাতা লাল কালিতে পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রের
চেহারা নিয়েছে।
“কবতে হচ্ছে? রবীন্দ্রনাথ, না কি
সুকুমার রায়? দ্রোণাচার্য নামের কলঙ্ক! পেকে আঁটি একেবারে! ঐ জন্যেই হাইট বাড়ছে না। চাবকে তোমায় লম্বা…” সুপ্রীম কোর্টের আইন মনে করে সেখানেই ব্রেক কষেন অতঃপর। হাই ব্লাড প্রেশার, হাই ব্লাড সুগার তাঁর। একটা কিছু হয়ে না যায় - চিৎকার শুনে পাশের ক্লাস থেকে ছুটে আসে অমিতাভ,
নির্মাল্য, দীপাণ্বিতা। বোর্ডের দিকে চেয়ে হেসে ফেলতে গিয়েও সামলে নেয়। সামলে নেয় স্যরকেও।
আসলে
সমীর স্যর জানেন যে আড়ালে তাঁকে বগলা বলে ছেলেরা। আসলে পড়াতে পড়াতে মুড এসে গেলে দু-হাত মাথার পেছনে উঠে যায় ওঁর, অনেকটা বিহু নাচের স্টাইলে। দ্রোণাচার্য ফিসফিস করে প্রদ্যুম্নকে
বলেছিল - “ভদ্রলোক এভাবে বগল দেখান কেন বল তো?
ওনার ডাকনাম আসলে বগলা।” সেই থেকেই। বগলা থুড়ি সমীর স্যরকে খবরটা চুপিচুপি দিয়েছিল ভালো ছেলে আর্যশংকর; তবে তার উদ্দেশ্য নিয়ে একটা ফিচেল হাসি মার্কা
সংশয় আছে ছেলেদের দলে। অন্যান্য শিক্ষকেরাও যে এ
নাম জানেন তা আন্দাজে টের পান সমীর প্রামাণিক। একবার স্টাফরুমে ঢুকতে গিয়ে শুনেছিলেন তাকে বগলা স্যর বলছেন
সহকর্মী একজন, তাঁকে দেখে চেপে গেলেন
সবাই। সেদিন গুম মেরে ছিলেন, কারও সঙ্গে বাক্যালাপ করেননি। “এরা কি শিক্ষক!” স্ত্রীর
কাছে দুঃখ করেছিলেন বাড়ি ফিরে।
শুধু
কি এই? সমীর প্রামাণিক স্যর ক্লাসে সেদিন দুই
বিঘা জমি পড়াচ্ছেন। সবে মুড এসেছে, স্যর কাঁপা কাঁপা গলায় শুরু করেছেন
– “নম নম নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি/ গঙ্গার
তীর স্নিগ্ধ সমীর জীবন জুড়ালে তুমি…।” ভাবে
চোখ বুজে আসে স্যরের আর নিজের অজান্তেই হাত দুটো চলে যায় মাথার পেছনে। কয়েক সেকেন্ডেই সচেতন হয়ে যান স্যর; চোখ দুটো পটাং করে খুলে যায়; আর পড়বি তো পড় দৃষ্টি গিয়ে পড়ে দ্রোণাচার্যের মুখে। ‘ছেলেটা হাসি মুছে নিল যেন’ - ভাবতে না ভাবতেই উঠে দাঁড়িয়েছে
দ্রোণাচার্য, নিরীহ মুখে বলে
– “এই জায়গাটা ঠিক বুঝলাম না স্যর।”
গম্ভীর
হন স্যরও, “কোন জায়গাটা?”
“ঐ যে স্যর, গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর।”
“মানে বঙ্গভূমির প্রাণস্বরূপা গঙ্গা বয়ে চলেছে, এই প্রকৃতি
স্নিগ্ধ সুন্দর...”
“কিন্তু স্যর, স্নিগ্ধ সমীর - মানেটা…”
ব্যাপারটা
নিমেষে স্পষ্ট হয়ে যায়। আবার ধৈর্য হারান স্যর। ভাগ্যে ঘন্টা পড়ে গেল। বেরিয়ে যাবার আগে মনে হল স্নিগ্ধ বগলা বলল যেন কেউ। ব্লাড প্রেসারের কথা মাথায় রেখে বেরিয়ে গেলেন। খাবার জলের ঠান্ডা মেশিনটা থেকে আঁজলায় জল নিয়ে ঘাড়ে–মাথায় থাবড়ে ক্যান্টিনে চা খেতে গেলেন,
একাই।
দিন কয়েক
পরে ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাস। পত্রলিখন। ব্যক্তিগত পত্র। পত্রের গঠন বোর্ডে লিখে বোঝাচ্ছেন
স্যর। সবাই বোর্ড দেখে টুকছে। সন্দেহ হয়েছে ঠিকই, তবে বুঝতে না দিয়ে ধীরে ধীরে সেকেন্ড লাস্ট বেঞ্চের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ছোঁ
মেরে দ্রোণাচার্যের খাতাটা তুলে নিলেন। সন্দেহ অমূলক নয়, তা বলে এতটা? এই সব? খাতায় সে লিখেছে
– ‘প্রিয় বগলা, কেমন আছ গুরু?’ সেদিনও নাইন
এ, বি ও সি থেকে যথাক্রমে নীলাঞ্জনা, সুপ্রিয়া
আর সুতনু এসে স্যরকে পিঠে হাত-টাত বুলিয়ে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে স্টাফ রুমে নিয়ে গেল।
মানুষটার
একটা ভালোমন্দ না হয়ে যায়, ছেলেগুলোও হয়েছে এমন
বাঁদর। অনেক টিচারই পরোক্ষে বোঝানোর
চেষ্টা করেন নাইন ডি-কে, কিন্তু ভবী ভোলে না।
সাংঘাতিক
ঘটনাটা ঘটে গেল এর কয়েক সপ্তাহ পরেই। সেটা উইকলি টেস্টের দিন। কিন্তু ফার্স্ট পিরিয়ডে পরীক্ষা না হয়ে হবে সেকেন্ড পিরিয়ডে, এই মর্মে একটা নোটিস এসেছিল ক্লাস শুরুর আগেই। বগলা, থুড়ি সমীর
স্যর ভোলাভালা অন্যমনস্ক মানুষ। নোটিস যখন এসেছিল তখন বাথরুমে
গিয়েছিলেন। তারপর স্টাফরুমে ফিরেই কোশ্চেন
পেপারের তাড়াটা তুলে নিয়ে সোজা নাইন ডি। খেয়ালই করলেন না যে অন্য
টিচারদের বান্ডিলটা তাদের টেবিলেই পড়ে রয়েছে। কোশ্চেন পেপার বিলি করার সময় ছেলে-মেয়েদের অবাক দৃষ্টিপাতও খেয়াল করলেন না। অনুত্তমা একবার কী একটা জানি বলতে শুরু করেছিল, এক ধমক দিয়ে তাকে বসিয়ে দিলেন। দ্রোণাচার্যও ভাজা মাছটি উলটে খেতে না জানার মতন গলা করে বলল,
“আবার স্যরকে বিরক্ত কচ্ছিস ক্যানো রে অনুত্তমা,
চুপচাপ পরীক্ষা দে।”
অঙ্ক
পরীক্ষা যখন প্রায় শেষের মুখে, তখন স্যরের খেয়াল হল অন্য সময়ের পরীক্ষাকালীন নিস্তব্ধতার
যেন আজ অভাব। কান পেতে শুনলেন যে পাশের
নাইন সি থেকে শুভ্রা ম্যাডামের বায়োলজি পড়ানোর আওয়াজ ভেসে আসছে। এবার চিন্তায় পড়ে ক্লাস থেকে মুখটা বাড়ালেন। পিওন সুভাষ ঠিক সেই সময়েই সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। স্যর তাকেই জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে, অন্য ক্লাসে পরীক্ষা হচ্ছে না?” সুভাষ তো হাঁ। “সে কী স্যর, আপনি জানেন
না? সকালেই তো নোটিস এসে গেছে, কেলাস শুরুর
আগেই।” বলেই বেঁড়ে ওস্তাদের মতন পাশে নাইন এ-তে গিয়ে স্যরের ভুলটা
বিস্তারিত বলে এল। ব্যস, ক্লাসে ক্লাসে, করিডোরে
করিডোরে, ফ্লোরে ফ্লোরে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। “সে কী!”, “এখন কী হবে?”, “কোশ্চেন পেপার তো আউট হয়ে গেল, এবার অন্য ক্লাসে পরীক্ষা হবে কী করে?” - এসব প্রশ্নে
ভরে উঠল চারিধার। “এ আপনি কী করলেন স্যর?” “সকালে নোটিস এল দেখেননি?” – এসব
কথার হুলুস্থুলুর মধ্যে ডাকসাইটে প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম এসে হাজির। সক্কলের সামনে সে কী বকাটাই না খেলেন সমীর প্রামাণিক স্যর। অন্য শিক্ষকদের মধ্যে কেউ একজন স্যরকে বাঁচাতে মিনমিন করে বলতে
শুরু করেছিল, “স্টুডেন্টরাও তো একবার
বলতে পারত ম্যাডাম!” আরও তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন প্রিন্সিপ্যাল্
ম্যাডাম, “স্টুডেন্টরা বলবে মানে? লজ্জা
করে না তোমাদের? আর্ন্ট ইউ সাপোসড টু নো? বলার কাজটা কাদের? তোমাদের না তাদের? তা ছাড়া স্টুডেন্টস আর পেট্রিফায়েড অফ মিস্টার প্রামাণিক, ডোন্ট ইউ নো দ্যাট?”
এরপর
পরীক্ষা ক্যানসেলড হল। পরে আবার হবে। গার্জেনদের কাছে নোটিস গেল ক্ষমা চেয়ে - ‘ডিউ টু আনঅ্যাভয়ডেবল
সারকামস্টেন্সেস উই আর সরি টু ইনফর্ম …।’
সেদিন
স্কুল ছুটি হবার অনেক পরে স্কুল থেকে বেরোলেন সমীর প্রামাণিক স্যর। দারোয়ান দেখল – উলটো দিকে লজেন্স-বিস্কুটের দোকানটায় ‘একঠো ইস্টুডেন্ট বসিয়ে আছে’। স্যর বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে
কাছে এল। স্যর জড়িয়ে ধরলেন তাকে। তারপর সে হাত ধরে স্যরকে রাস্তা পার করে দিল।
দারোয়ান
যেটা শুনতে পায়নি, যেটা বুঝতে পারেনি...
স্যর
বেরোতেই এগিয়ে এল দ্রোণাচার্য। বাড়ি যায়নি সে। দোকানের মালিকের ফোন থেকে বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছে স্পেশাল ক্লাস
আছে আজ, হঠাৎই ঠিক হয়েছে। তারপর স্যরের জন্য অপেক্ষা। তিনি বেরোতেই কাছে আসে। “মন খারাপ করবেন না
স্যর, আরে স্টুডেন্টদের কত সুবিধে হল বলুন তো! এক্সট্রা টাইম পেয়ে গেল পড়ার, ম্যাথস বলে কথা,
আমি বলছি সবাই হেভি খুশি!”
ভাষার
জন্য আজ আর কিছু বলেন না, চোখের জল মুছতে মুছতে
বিচ্ছুটাকে জড়িয়ে ধরেন স্যর। সেও এক গাল হেসে বলে, “ঝুটমুট মাথা গরম করেন কেন বলুন তো? সব কিছু অত দিলপে নিলে চলে? আপনার না শরীর অসুস্থ?
আসুন হাতটা ধরুন, চলুন রিকশায়
তুলে দিই...”
বগলা
স্যর আর দ্রোণাচার্যের গল্পের ভবিষ্যতের পাতাগুলো যা বলে তা হল, দ্রোনাচার্য বর্তমানে
ব্রিটেনবাসী। সেখানে চাকরি পেয়েছে বছর
দুয়েক। বিয়েও করেছে। হাইট এখনও বাড়েনি তার। স্যরের রিটায়ারমেন্টের আর এক বছর বাকি। মাসে এক-দু’বার স্যরের
সঙ্গে ভিডিও চ্যাট হয়। দ্রোণাচার্যদের একটা হোয়াটস্যাপ
গ্রুপ আছে। নাম – বগলা ব্যাচ। এটা স্যর জানেন না, বলাই বাহুল্য।
_____
ছবিঃ পার্থ মুখার্জী
ছবিঃ পার্থ মুখার্জী
'বগলা ব্যাচ'
ReplyDelete