নলেন গুড়
অমিতাভ
প্রামাণিক
ভবা পাগলা
গেয়ে গেছেন – খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন।
এ গান আমি
শুনেছি অনেক বড়ো হয়ে। তার অনেক আগে থেকেই – ইশকুলে ভর্তি
হওয়ার আগে থেকেই - খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধা হতে দেখেছি আমাদের পাড়ার আশেপাশে।
মাজদিয়ার খেজুর গুড় বিখ্যাত ছিল। শীতকালে
সপ্তাহে দু’দিন করে শুধু খেজুর গুড়ের হাট বসত, রবিবারে আর বুধবারে।
সেই হাটে ব্যাপারীদের বেজায় ভিড়, হাটের সময় রাস্তা দিয়ে চলাই দায়।
আমাদের ইশকুলের সামনের রাস্তাটা আর তার পাশের মাঠ, যার একদিকে
কালী ডাক্তারের হোমিওপ্যাথি ডিসপেনসারি ছিল, ভরে থাকত গাঁ-গঞ্জ
থেকে আসা গুড়ের ভাঁড়ে। সাইকেলে
ঝুলন্ত আর ভ্যান-রিক্সা বোঝাই হয়ে দূর দূরান্ত থেকে গুড় এনে প্রস্তুতকারকরা ভিড়াত
এই হাটে। সাধারণ লোক তো কিনতই, বেশিরভাগটাই কিনত গুড়ের ব্যাপারীরা, তাদের হাতে
থাকত লম্বা ধাতব কাঠি। গুড়ের
লম্বা ভাঁড়ে সেই কাঠিটা সুড়সুড় করে ঢুকিয়ে দিয়ে সুড়ুৎ করে তুলে এনে তারা পরখ করে
দেখত ভেতরে ভেজাল ‘পাইল’ করা আছে কিনা।
কাঠিতে লম্বালম্বিভাবে লেগে থাকত ভেতরের গুড়ের ডেপ্থ্ প্রোফাইল।
জহুরির চোখে সেটা দেখে তার গুণমান অনুযায়ী দর ঠিক হত।
ভাঁড়ের মুখের কাছটা সুবাসিত সোনালি ভালো গুড় আর ভেতরে বাদামি কমা গুড় বুঝতে পারলেই
তার দাম কমে যেত হু হু করে। ব্যাপারীদের
কিনে-নেওয়া এই গুড় উঠে যেত লরিতে। লরির পর
লরি বিকেলের পড়ন্ত আলোয় মাজদিয়া ছেড়ে চলা শুরু করত পশ্চিমে।
আমরা ভাবতাম, আমাদের গাঁয়ের জিনিস বিদেশে যাচ্ছে।
কেষ্টনগর হয়ে প্রথমে যাবে কলকাতা, সেখান থেকে হয়তো দিল্লি-বোম্বাই, এমনকি আমেরিকাতেও। শহরের
লোকদের আমরা ভালো ভালো জিনিস না খাওয়ালে ওরা পাবে কোত্থেকে, ওরা কি নলেন গুড় বানাতে পারে?
নলেন গুড়ের
সন্দেশ শহুরে বাবুরা এখন নিশ্চয় সবাই খেয়েছেন।
কলকাতা ও অন্যত্র জনপ্রিয় বড়ো বড়ো মিষ্টির দোকানগুলো এখন অনেকেই তাদের মতো করে
নলেন গুড়ের সন্দেশ, কেউ কেউ নলেন গুড়ের রসগোল্লাও বিক্রি করে
বই-কি! তবে অনেকে হয়তো নলেন গুড় জিনিসটা এখনও চোখেই দেখেননি।
অথবা ভুল জিনিসকে নলেন গুড় বলে জানেন।
দোষটা বোধহয়
সুকুমার রায়ের। ঐ যে উনি লিখে গেলেন – কিন্তু সবার চাইতে ভালো
পাঁউরুটি আর ঝোলা গুড়! নলেন গুড় আর ঝোলা গুড় এক নয় মোটেই।
সমস্ত ট্রান্সপারেন্ট ঘন তরল গুড়ই ঝোলা গুড়, কিন্তু সমস্ত ঝোলা গুড়
আদৌ নলেন গুড় নহে। বস্তুত নলেন গুড় যদিও স্বচ্ছ হতেই
পারে, তবে স্বচ্ছতা তার বৈশিষ্ট্য নয়, বরং
স্বাদ-গন্ধ ও এই দুয়ের মিলনের অভিজ্ঞতা।
নলেন
শব্দটার ব্যুৎপত্তি আমার জানা নেই। নতুন গুড়ই
কি নলেন গুড়? সে যাই হোক, নলেন গুড়
তৈরি হয় একমাত্র জিরেন-কাটের খেজুর রস থেকে, এবং
রামা-শ্যামা-যদু-মদুদের কাম নয় নলেন গুড় বানানো।
সমস্ত কাজই শিল্প, নলেন গুড় বানানো তো বটেই।
তার অভিজ্ঞ শিল্পীরা জানেন কীভাবে কতক্ষণ জ্বাল দিলে এই রস ঘন হতে হতে নলেন গুড়ে
পরিণত হয়। তার চেয়ে কম বা বেশি জ্বাল পড়লেই সে আর যাই হোক
নলেন গুড় হবে না।
জিরেন-কাট
কী জিনিস? বলছি মশাই, দাঁড়ান।
শীত পড়তে শুরু করলেই খেজুর গাছের মাথা সাফ করে দিতে হয়।
তলার দিকের কতগুলো পুরোনো পাতা কেটে ফেলে তার নিচের দিকটা পরিষ্কার করে রাখতে হয়।
সেই পরিষ্কার জায়গাটা দাড়ি কামানোর মতো ধারালো হেঁসো দিয়ে চেঁছে কাণ্ডের ভেতরের
সাদা অংশ উন্মুক্ত করে তার মধ্যে লম্বালম্বি-চিরে-রাখা একটা কঞ্চি তেরছাভাবে
ঢুকিয়ে দেয়, যাতে কঞ্চির চেরা অবতল দিকটা আকাশের দিকে থাকে
আর কঞ্চির খোলা মুখটা থাকে নিচের দিকে।
কঞ্চির চেরা খোঁদল বেয়ে ড্রপ ড্রপ করে ঝরতে থাকে খেজুরের রস।
তার নিচে হাঁড়ি বেঁধে দিলেই হল।
আজ্ঞে না।
দিলেই হল না। এই দেওয়াটা সারতে হয় একদিন গোধূলি বেলায়, সূর্য যখন আকাশ লাল করে পশ্চিমে ঢলে পড়ছে।
সারা সন্ধে আর রাত্তির জুড়ে ভাঁড়ে জমা হয় খেজুরের রস।
ভোর বেলা যখন সূয্যিদেব আবার পুব আকাশ লাল করে উদয় হচ্ছেন, সুদূর কোনও গঙ্গাতীরে টিকিধারী পণ্ডিতেরা যখন ‘ওঁ
জবাকুসুমসঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্’ মন্ত্র পড়ে
অন্তঃকরণকে বিশুদ্ধ করে নিচ্ছেন, তখন এই আনপড় লোকগুলো আবার
তরতরিয়ে গাছে উঠে নামিয়ে আনে রসভর্তি ভাঁড়গুলো।
ও হ্যাঁ, তাহলে জিরেন-কাট কী? এই যে ভাঁড় নামিয়ে আনা হল, কঞ্চি বেয়ে রস পড়া কি বন্ধ হয়ে গেল? না। সে
তো টুপ টুপ করে পড়বেই। রসটা অন্য পাত্রে ঢেলে ভাঁড়টা আবার
পেতে দিলেই হল। কিন্তু এই যে রসটা এবার পাওয়া যাবে, সেটা আর এতক্ষণ যেটা সংগৃহীত হয়েছে, এটার রকম বেশ
কিছুটা আলাদা।
মোটামুটি পর
পর তিন দিন বা ক্ষেত্রবিশেষে চার দিন এইভাবে রস সংগ্রহ করে তারপর গাছকে বিশ্রাম
দিতে হয়। এই বিশ্রামই জিরেন।
গড়পড়তায় দিন তিনেক জিরেন দেওয়ার পর আবার মাথার কাছে চেঁছে কঞ্চি ঢুকিয়ে দিলে আবার
টুপটাপ রস ঝরবে। জিরেনের পর মাথা চেঁছে প্রথম রাতে যে রসটা পাওয়া
যায়, তাই জিরেন-কাটের রস। এর
মাহাত্ম্য আলাদা। বাকি দিনগুলোর রস হচ্ছে ঝরা রস, তাতে মিষ্টতা কম।
তার মানে কি
জিরেন-কাটের রস জ্বাল দিলেই নলেন গুড়? এজ্ঞে না। এই
জিরেন-কাটের রস যে রাতে ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ে, সেই রাতে যদি খুব
ঠান্ডা পড়ে, যদি পরদিন সকালে কুয়াশা না হয়, তবেই এই জিরেন-কাটের রস নলেন গুড় প্রস্তুতির যোগ্য।
তবে যা বললাম, যাকে তাকে দিয়ে হয় না। এর
জন্যে চাই এই শাস্ত্রে বংশানুক্রমিক শিক্ষা। অভিজ্ঞতা। ‘বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের আছে অধিকার ব্রহ্মবিদ্যালাভে।’ নলেন গুড় তৈরির যে ব্রহ্মবিদ্যা, তা কেবলমাত্র তার
পরিবারের মধ্যেই সীমিত থাকে সাধারণভাবে, যদি না কোনও সত্যকাম
ব্যাকুল হয়ে সেই বিদ্যালাভে সচেষ্ট হয়।
আজকাল তাই নলেন গুড়ের দেখা পাওয়া ভগবান দর্শনের মতোই দুর্লভ।
আরও কারণ
আছে। বিশ্ব-উষ্ণায়নের প্রভাবে শীতকালের দফারফা হয়ে
গেছে। রাতে ব্যাপক শীত পড়ল তো পরের দিন কুয়াশামুক্ত
ভোর হল না! দুটোই হল তো সেই রাত জিরেন-কাটের পরের রাত হল না! এই সব
স্ট্যাটিস্টিক্যাল প্রবাবিলিটির ধাপ পেরিয়েও যদি বা সেই দুর্লভ রসটি পাওয়া গেল তো
তাকে জ্বাল দিয়ে মানিক ঘরে তোলার শিল্পী নেই!
কী করে
থাকবে? পড়াশুনা করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে।
পড়াশুনা মানে তো মিড-ডে মিল, হাফিয়ার্লি-অ্যানুয়াল পরীক্ষা, মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ মুখস্থ করা। এর
মধ্যে নলেন গুড় প্রস্তুত করার বিধি তো ঠাঁই পায় না।
সেই জাতশিল্পীদের ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনিরা আজ আর নলেন গুড় তৈরিতে উৎসাহী নয়।
তারাও নিশ্চিন্ত জীবন চায়, দু’পাতা পড়াশুনা শিখে
যদি চাকরি পাওয়া যায়, দরকারে ঝান্ডাবাজি করে প্রাইমারি
ইস্কুলের কেরানিগিরি, মন্দ কী!
আমার
সৌভাগ্যই বলা চলে, আমার ছোটোবেলায় সে রকম শিল্পীরা আমাদের
বাড়ির কাছেপিঠেই থাকত, তাদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা আমার বাবার
কাছে টিউশন পড়তে আসত। আমি
চিররুগ্ন হলেও কখনও কখনও, বিশেষ করে শীতকালে সকালে তুষের চাদর গায়ে
চাপিয়ে মাথা-টাথা ঢেকে মর্নিং ওয়াকে বেরোতাম, ফিরে এসে শোভা
দাঁতের মাজন বাঁ হাতের তালুতে নিয়ে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে দাঁতে ঘষতে ঘষতে রোদ
পোয়ানোও যেত খানিকটা। এক এক দিন
ভোরে হাঁটার সময় বাতাস বেয়ে তীব্র সুগন্ধ এসে নাকে ঝাপটা মারত, বুঝে যেতাম খেজুর রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছে কোথাও।
গন্ধে গন্ধে হাজির হয়ে যেতাম তার উৎসে। উঠোনে মাটির
উনুনে বিশাল সাইজের লোহার কড়াইতে জ্বাল দেওয়া হচ্ছে আগের রাতের জিরেন-কাটের রস, ঘন হয়ে আসছে সেই পবিত্র সুগন্ধী বস্তুটা।
তার চার পাশ ঘিরে উবু হয়ে বসে আছে উন্মুখ কয়েকটা শিশু, তাদের হাতে – বাটি-ফাটি নয়, ওসব কোথায় পাবে – ছিঁড়ে
আনা রাতের-শিশিরে-ধোয়া সবুজ কচুর পাতা।
আমিও একটা কচুর পাতা জোগাড় করে বসে যেতাম তার পাশে।
কড়াইয়ের ঘন দ্রবণ নাড়া হচ্ছে বিশাল সাইজের এক কাঠের ডান্ডা দিয়ে, তার মাথায় এফোঁড়-ওফোঁড় করে আটকানো একটা আধখানা নারকেলের মালা।
সেটা দিয়েই ঘন হয়ে আসা রস একটু তুলে আলতো করে কড়াইতে ফেলার সময় ক্রমে ক্রমে যে
চিটচিটে ব্যাপারটা আসে, তা অনুভব করেই ঐ ব্রহ্মজ্ঞানীরা বুঝে যান
আর কতক্ষণ নাড়াতে হবে, বা তুলে ফেলতে হবে।
সেই অনুযায়ী কড়াইয়ের কানায় ‘বিচ মারতে’
হয়, রসায়নে আমরা যাকে নিউক্লিয়েশন বলি,
যা ক্রিস্টালাইজেশন বা কেলাসীভবনে (তরল থেকে কঠিন হতে) সাহায্য করে।
এই যে রস
জ্বাল দেওয়া, এখানেও অলিখিত নিয়ম,
সেই পাখি-না-জাগা ভোরে যারাই গুড় খেতে আসুক, একটু না খাইয়ে
কাউকে ফিরিয়ে দেওয়ার নিয়ম নেই। সময় হলেই
তাই বাড়িয়ে-ধরা কচুপত্রে পড়তে থাকে নারকেলের সেই মালা থেকে ঢেলে দেওয়া অল্প কিছুটা
করে অমৃতসুধা। এই বস্তু এইভাবে যে প্রথমে আঙুল দিয়ে ও পরে
সরাসরি কচুর পাতা থেকে জিভ দিয়ে চেটে চেটে না খেয়েছে, সে এর মর্ম কিছুই বুঝবে না। আমার
ক্ষমতা নেই, শব্দে তার মাহাত্ম্য বর্ণনা করি।
ও হ্যাঁ, এই নলেন গুড়ই আরও জ্বাল দিয়ে ঘন করে আস্তে আস্তে ঠান্ডা করলে তৈরি হয়
নলেন গুড়ের পাটালি। তার
কথা বলে আর দুঃখ বাড়িয়ে লাভ কী!
কল্যাণীতে
পড়তে চলে যাওয়ার পর মাজদিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক আলগা হয়ে গেলেও মায়ের দৌলতে
আমার নলেন গুড় খাওয়া চলেছিল অনেক বছর। শীতের সময়
বাড়ি গেলে মাকে আগে থেকে জানিয়ে দিলে মা, বাবার যে সমস্ত ছাত্রদের বাবা-কাকারা
নলেন গুড় তৈরি করত, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অনুরোধ করে আসত, আমার ছেলেটার জন্যে একটু বানিয়ে দিও।
শেষদিকে অবশ্য হত্যা দিলেও তা আর পাওয়া যেত না। এখন
প্রায় সবই চিনি-মেশানো কৃত্রিম গন্ধ-দেওয়া ঝরা রসের গুড়।
হ্যাঁ, কলকাতা ও অন্যত্র নলেন গুড়ের সন্দেশ যা আপনারা খেয়ে এখন আহা
উহু করেন, তাও মোস্টলি এই আর্টিফিশিয়ালি সেন্টেড বস্তু দিয়েই
বানানো।
সে দিন, সে সংস্কৃতি চলেই গেছে বোধহয়, আর আসবে না। এখন শুধু
স্মৃতি-রোমন্থন। যে গুড় রুটিতে মাখিয়ে পাটিসাপটার মতো রোল করে
মুখে ভরে দিলে মস্তিষ্কের সমস্ত স্নায়ুকোষ অবশ হয়ে যেত, এখন শুধু মেনে নেওয়া যে তারা হয়তো কোনোকালেই ছিল না। আমি
বোকার মতো অন্ধকারে জেগে উঠে স্বপ্ন দেখছি, ছাতার মতন বড়ো
পাতাটির নিচে বসে-থাকা ভোরের দোয়েল পাখিটার মতো।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
নলেন গুড়ের খুঁটিনাটি জানা গেল।
ReplyDelete