প্রবন্ধ:: ১৫০ বছরে শিশুসাহিত্যের প্রাণপুরুষ: যোগীন্দ্রনাথ সরকার - সমুদ্র বসু

১৫০ বছরে শিশুসাহিত্যের প্রাণপুরুষ যোগীন্দ্রনাথ সরকার
সমুদ্র বসু

‘অ-য়ে অজগর আসছে তেড়ে
আমটি আমি খাবো পেড়ে
ইঁদুরছানা ভয়ে মরে
ঈগল পাখি পাছে ধরে’

আজও বাংলার শিশুরা মা-বাবা বলতে শেখার পর শিক্ষা শুরু করে ‘হাসিখুশি’ পড়ে। শিশুসাহিত্যে শুধু নয়, শিশুশিক্ষার প্রথম পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ‘হাসিখুশি’ শিশুদের কাছে সবথেকে প্রাঞ্জল আজও, সবথেকে আপন আজও। সেখানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সহজ পাঠ’ কালজয়ী পাঠ্যপুস্তক হলেও শিশুদের কাছে ‘হাসিখুশি’র ছড়াগুলো যেন সবথেকে বেশি সহজবোধ্য হয় দেখা গেছেযেখানে ‘বর্ণপরিচয়’-এর ভাষার গাম্ভীর্যে শিশুরা ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে সেখানে ‘হাসিখুশি’ যেন সত্যিই তাদের হাসিখুশি রাখতে সক্ষম হয় আজও।
ঈশ্বরচন্দ্র বা রবীন্দ্রনাথ যেমন শুধু ‘বর্ণপরিচয়’ বা ‘সহজ পাঠে’র জন্যেই পরিচিত নন তেমনই ‘হাসিখুশি’র স্রষ্টা যোগীন্দ্রনাথ সরকারও কিন্তু ‘হাসিখুশি’র জন্যেই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নন। শিশুসাহিত্যের গম্ভীর আকাশে তিনি সত্যি যেন চাঁদের হাসি ঢেলে দিতে পেরেছিলেন প্রথম। আর তাই তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরও তিনি আজও সমানভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
১৮৬৬ সালে ২৮শে অক্টোবর চব্বিশ পরগণার জয়নগরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন তাঁর আদি নিবাস যশোর তাঁর পিতার নাম নন্দলাল দেব সরকার ও মাতা থাকমণি দেবী নন্দলাল দেব যশোরের একটি দরিদ্র কায়স্থ পরিবারের মানুষ ছিলেন এবং তাদের পদবি ছিল দেবযশোর থেকে এদের পরিবারের বিভিন্ন শাখা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে ও প্রতিপত্তি লাভ করে শোনা যায় যে প্রসিদ্ধ শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীও এই একই দেব বংশোদ্ভুত তবে এ বিষয়ে সঠিক কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি যশোর থেকে দেববংশের একটি শাখা পঞ্চগ্রামে আসেন এবং সেই বংশের রামচরণ দেবের পুত্র নবকৃষ্ণ দেব (১৭৩৩ - ১৭৯৭) ছিলেন বিখ্যাত শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা তিনি তাঁর নিরলস পরিশ্রম, বুদ্ধি ও অধ্যবসায়ের জন্য বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হন এই নবকৃষ্ণ দেবের পৌত্র রাধাকান্ত দেব ((১৭৮৩ - ১৮৬৭) পরবর্তীকালে তাঁর বিপুল পান্ডিত্যের জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে বাংলা শিশুসাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম পুস্তকরূপে চিহ্নিত ‘নীতিকথা’-র অন্যতম লেখক ছিলেন রাধাকান্ততখন থেকেই সেই বংশের উত্তরসূরিদের ধমনীতে শিশুসাহিত্যের গুণ-রস যেন পূর্ণ বেগে বইছিল পঞ্চগ্রামের এই দেববংশের কোনও এক উত্তরপুরুষ এরপর চব্বিশ পরগনার নেত্রায় বসতি স্থাপন করেন এবং সেই বংশের সীতানাথ দেবের পুত্র শ্যামসুন্দর প্রথম ‘সরকার’ পদবি গ্রহণ করেন এদের অধস্তন চতুর্থ পুরুষ নন্দলাল দেব সরকারের পুত্রই হলেন স্বনামধন্য যোগীন্দ্রনাথ সরকার
নন্দলালের আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না ১৮৬৪ সালে প্রবল ঝড়-জলে তাঁর নেত্রার বাস্তুভিটা ধূলিসাৎ হয়ে যায় তাঁর মাতুলালয় ও শ্বশুরালয় ছিল জয়নগরে তখন থেকে তিনি জয়নগরে এসে সপরিবারে বসবাস শুরু করলেন এখানেই জন্ম হয় যোগীন্দ্রনাথের তিনি ছিলেন পিতামাতার অষ্ঠম গর্ভের সন্তান আর তাই তিনি যে ভবিষ্যতে একজন মহান পুরুষ হবেন প্রাচীন এই মতবাদ মেনে বহুকাল তাঁকে নিরামিষ আহার দেওয়া হয়েছিল বাল্যকালে প্রবল চঞ্চল ও দুরন্ত ছিলেন যোগীন্দ্রনাথ আত্মীয়-অনাত্মীয় সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতেন তিনি আর এই কারণেই বোধহয় সেই চাঞ্চল্যের ছাপ পড়েছিল তাঁর লেখা কিছু কবিতায় যেমন দুষ্টু তিনু, পেটুক দামু, সাধে বাদ ইত্যাদিতে তাঁর ছাত্রজীবনের একাংশ কাটে জয়নগরের পাঠশালায়কিন্তু পরে ১৮৮৩ সালে সপরিবারে তাঁরা জয়নগর ত্যাগ করে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন পরে দেওঘর উচ্চ ইংরাজি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যোগীন্দ্রনাথ বসু তাঁকে দেওঘর নিয়ে যান ও ওনার ইস্কুলে ভর্তি করে দেন সেখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যোগীন্দ্রনাথ কলকাতার সিটি কলেজে এফ.এ. পড়া আরম্ভ করেন কিন্তু আর্থিক অনটনের জন্য পড়া অসম্পূর্ণ রেখেই সিটি কলেজিয়েট ইস্কুলে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন তিনি এ সময়ে এক মজার ঘটনা শোনা যায় যে যোগীন্দ্রনাথকে নাকি রেঙ্গুনে পাঠাবার কথা হয়েছিল, কিন্তু তাতে তাঁর ঘোরতর অমত ছিল অবশেষে অনুরোধে পড়ে যখন জাহাজঘাটায় আসেন তিনি তখন জাহাজ কূল ছেড়ে দিয়েছিল আর তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যোগ দেন সিটি কলেজিয়েট ইস্কুলে শিক্ষকতার কাজে বিখ্যাত চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ নীলরতন সরকার যোগীন্দ্রনাথ সরকারের দাদা
যোগীন্দ্রনাথ সরকার ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ছিলেন সিটি কলেজিয়েট স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করতে আরম্ভ করেন মাত্র পনেরো টাকা বেতনে এ সময় থেকেই তিনি শিশুসাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হন এবং শিশুসাহিত্য রচনা আরম্ভ করেন আজগুবি ছড়া রচনায় তিনি খুব দক্ষ ছিলেন তাঁর সংকলিত বই ‘হাসি ও খেলা’ ১৮৯১ সালে প্রকাশিত হয় ‘জ্ঞানমুকুল’ নামক স্কুলপাঠ্য গ্রন্থটিও এ সময় প্রকাশিত হয় শোনা যায়, যোগীন্দ্রনাথ সরকারদের দেব-সরকার বংশের ও উপেন্দ্রকিশোর (দেব) রায়বংশের পূর্বপুরুষ নাকি একই। আর সেই কারণেই হয়তো আদর্শের এত মিল। দুজনেই শিশুসাহিত্যে নিজেদের প্রাণকে নিবেদন করে দিয়ে গেছেন। তাঁরা ছোটোদের জগতের বাইরে কিছু ভাবেনওনি আর করেনওনি। বয়সে তিন বছরের বড়ো হলেও উপেন্দ্রকিশোরের কর্মজীবনের প্রথমদিকটা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে কেটেছিল। যোগীন্দ্রনাথ তরুণ বয়স থেকেই শিশুসাহিত্য রচনা ও প্রকাশনার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।
পড়ার বইয়ের বাইরেও ছোটদের জন্যে বই লেখা যেতে পারে, ছাপা যেতে পারে, একসময় তা ভাবাই হত না। সব ছিল নীরস পাঠ্যপুস্তক। এই ভাবনাকে চুরমার করে ভেঙে দিতে পেরেছিলেন যোগীন্দ্রনাথ, আর তাই তিনি আজও শিশুসাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় নাম। সত্তরের বেশি বই লিখেছিলেন, সম্পাদনাও করেছিলেন। একটি বই ‘হাসিখুশি’র কথা আমরা মনে রেখেছি। তাঁর লেখা বিপুল সংখ্যক বইয়ের কথা অনেকেই ভুলতে বসেছে।
যোগীন্দ্রনাথের কালজয়ী বই ‘হাসিখুশি’। যদিও মনে রাখা প্রয়োজন যে এটাই ওনার প্রথম বই নয়। ১৮৯১ সালে তাঁর সংকলিত ‘হাসি ও খেলা’ বাংলায় প্রকাশিত প্রথম সচিত্র শিশুপাঠ্য বই। ‘হাসি ও খেলা’ বইটার নিবেদন অংশটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে এখনও। যোগীন্দ্রনাথ সেখানে লিখেছেন, “আমাদের দেশে বালক বালিকাদের উপযোগী স্কুলপাঠ্য পুস্তকের নিতান্ত অভাব না থাকিলেও গৃহপাঠ্য ও পুরস্কার-প্রসাদযোগ্য সচিত্র পুস্তক একখানিও দেখা যায় না। এই অভাব কিঞ্চিৎ পরিমাণে দূর করিবার জন্যে হাসি ও খেলা প্রকাশিত হইল।”
‘হাসি ও খেলা’ প্রকাশের আগে যে এরকম বইয়ের সত্যি অভাব ছিল তা বোঝা যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্তব্যে, যা প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাধনা’ পত্রের ১৩০১-এর ফাল্গুন সংখ্যায় “...ছোট ছেলেদের জন্যে যে সকল বই আছে তাহা স্কুলে পড়িবার বই; তাহাতে স্নেহের বা সৌন্দর্যের লেশমাত্র নাই, তাহাতে যে পরিমাণ উৎপীড়ন হয় সে পরিমাণ উপকার হয় না।”
১৮৯২-এ যোগীন্দ্রনাথের বিবাহ হয়েছিল বৈকুন্ঠ রায়ের আঠারো বছরের মেয়ে গিরিবালা দেবীর সাথে এই বিবাহে আচার্য্যের কর্তব্য পালন করেছিলেন স্বনামধন্য পন্ডিত শ্রী শিবনাথ শাস্ত্রী ক্রমে তিনি ছয়টি সন্তানের পিতা হন

শিক্ষক যোগীন্দ্রনাথ ছিলেন ছাত্রসমাজে বিপুল জনপ্রিয় শিক্ষকতার সাথে সাথে ছাত্রদের জন্য সঙ্গীতাভিনয়ের ব্যবস্থা করা, ‘মুকুলপত্রিকার কার্য্যাধ্যক্ষ পদে আসীন থাকার দায়িত্ব নির্বাহ করা ইত্যাদি নানারকম কাজে ব্যস্ত থাকতেন তিনিমুকুল’-এর ছবির জন্য তাঁকে সে সময়ের একমাত্র উড ব্লক প্রস্তুতকারক প্রিয়গোপাল দাসের কাছে প্রায়ই যেতে হত এসব কারণে নিয়মিত সময়ে প্রতিদিন তিনি স্কুলে পৌঁছোতে পারতেন না, আর যার ফলে তাঁর একমাত্র রোজগার পনেরো টাকার বড়ো অংশটাই কাটা যেত আর তাই তিনি নিজে স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নেমেছিলেন বই প্রকাশনার জগতে। ১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজস্ব প্রকাশনালয় ‘সিটি বুক সোসাইটি’ সেই একই সালে প্রকাশিত হয় শিশুগদ্য পাঠের সচিত্র বই ‘রাঙাছবি’। ছোটোদের বইয়ের প্রকাশক হিসেবে তিনি অতুলনীয় ছিলেন সেই যোগীন্দ্রনাথ তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর সহায়তায়সখাপত্রিকার সমস্ত ব্লকগুলো কিনে নিয়েছিলেন যা তাঁকে পুস্তক প্রকাশনা ব্যবসায়ে বিশেষ প্রেরণা দিয়েছিল পরের বছর ১৮৯৭-এ ওই প্রকাশনা সংস্থা থেকেই প্রকাশিত হল যুগান্তকারী ওই প্রাইমার ‘হাসিখুশি’। ‘হাসিখুশি’ প্রকাশিত হল দুটি ভাগে। প্রথম ভাগ ১৮৯৭ সালে ও দ্বিতীয় ভাগ ১৯০৪ সালে। বলা বাহুল্য, প্রথম ভাগটির জনপ্রিয়তা ছিল অনেক বেশি। পরবর্তীকালে ‘হাসিখুশি’র জনপ্রিয়তা অনেকটাই পেছনে ফেলে দিয়েছিল বিয়াল্লিশ বছর আগে প্রকাশিত বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’কে। ‘হাসিখুশি’র শুরু হয়েছে ছড়া দিয়ে তাই ছোটোদের কোমল মনে রেখাপাত করতে অসুবিধা হয়নি। তাছাড়া প্রত্যেকটা ছড়ার শুরুতেই সেই বর্ণটি দেওয়া আছেসহজবোধ্য ছবির মাধ্যমে বর্ণটিকে সহজে চিনিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলা বর্ণমালার কিছু কিছু বর্ণের শব্দের প্রথমে না আসার অসুবিধার জন্যে কয়েকটি ক্ষেত্রে বর্ণটিকে ছবির মধ্যে আলগাভাবে বসানো হয়েছে। যেমন ণ, ড়, ঢ়, ৎ, য় ইত্যাদি। তাতে অবশ্য পড়ার বা বোঝার কোনও অসুবিধা হয় না। কয়েকটা বর্ণ আবার নিজের ছবির প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে যেমন, লৃ-কারের ছবির বালকটার শরীরটাকে অক্ষরটার মতন করেই আঁকা হয়েছে, কিংবা বলা যায় ‘ৎ’ হল বেড়ালের লেজ! এছাড়া ‘হাসিখুশি’ বর্ণমালায় ছড়ায় ব্যবহৃত শব্দগুলো শিশুদের কাছে অনেক বেশি শ্রুতিমধুর ও কাছের। মনে হয় সবসময় ওই শব্দগুলো পালটে দিলে যেন কোনও মানানসইতাই থাকবে না, হয়ে যাবে এলোমেলো। তৎকালীন অন্যান্য শিশুশিক্ষার বইয়ে ব্যবহৃত কিছু শব্দ যেমন ঊষা, একতারা, ঐরাবত, থানা ইত্যাদি শব্দ অক্ষরজ্ঞানহীন সাধারণ ঘরের শিশুদের কাছে সহজবোধ্য নয় বলেই ‘হাসিখুশি’তে সেগুলোর জায়গায় অনেক বেশি প্রচলিত ও চলতি শব্দ ব্যবহার করেছেন যোগীন্দ্রনাথ। থানার সাহায্যে ‘থ’ চেনানোর চাইতে ‘থালা ভরা আছে মিঠাই’ অনেক মনোগ্রাহী।
‘হাসিখুশি’র আরেক উল্লেখযোগ্য দিক হল ‘বর্ণপরিচয়’-এর মতো সাধুভাষা ব্যবহারের পরিবর্তে একদম মুখের চলতি ভাষা ব্যবহার, যা কিনা শিশুরা অনেক সহজে বুঝবে ও পড়তে উৎসাহ পাবে। অবশ্য ‘বর্ণপরিচয়’-এ বিদ্যাসাগরের সাধুভাষা ব্যবহার সমর্থনে অবশ্যই বলতে হয় যে সে সময় তা ছিল বাংলা গদ্যসাহিত্যে এক বিবর্তনের যুগ এবং বিদ্যাসাগর তার পথিকৃৎবাংলার শিশুদের কাছে ‘হাসিখুশি’ যে প্রথম প্রাইমার হয়ে উঠেছে তার কারণ এর ভাষা, ছবি ও ছন্দবদ্ধ ছড়া। সহজভাষায় শিশুদের গণনা শিখিয়েছে এই বই। হারাধনের দশটি ছেলের এক এক করে হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে বিয়োগের অঙ্ক শেখানোটা খুবই আকর্ষণীয় করে তুলেছেন যোগীন্দ্রনাথআইরিশ কবিতা টেন লিটিল ইন্ডিয়ান বয়েজ নামক একটি নার্সারি রাইমের অনুকরণে লেখা এই ছড়াতার থেকেই বোঝা যায় যে যোগীন্দ্রনাথ বিদেশি সাহিত্যও ঘেঁটেছিলেন ‘হাসিখুশি’ লেখার আগে। শিশুদের মুখে আধো আধো বুলি ‘হাসিখুশি’র নিজস্ব ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন, গরু হয়েছে গউ, কাকাতুয়া তাতাতুয়া, ছাগল হয়েছে থাগল। যোগীন্দ্রনাথ কখনও শিশুদের মনে দুঃখ দিতে চাননি। তার আরেক কারণ, ‘হাসিখুশি’ প্রথম ভাগে হারাধনের দশটি ছেলে এক এক করে হারিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে যেমন বিয়োগের অঙ্ক শেখানো হয়েছে তেমনই তার সঙ্গে এসেছে এক করুণ পরিণতি। সন্তান হারানোর শোকে পিতার মন যেমন আক্রান্ত হয় তেমনই হয়েছিল যোগীন্দ্রনাথের। আর তাই ‘হাসিখুশি’র দ্বিতীয় ভাগে তিনি মুন্সিয়ানার সঙ্গে এক এক করে আবার ফিরিয়ে আনলেন হারাধনের দশ ছেলেকে আর তার সঙ্গে সঙ্গে সহজেই যোগ অঙ্কের কাজটাও শিখিয়ে দিলেন ছোটদের।
সিটি বুক সোসাইটি থেকে যোগীন্দ্রনাথ নিজের বই ছাড়াও উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, দ্বিজেন্দ্রলাল বসু, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, চন্ডীচরণ বন্দোপাধ্যায়, কুলদারঞ্জন রায়, অমৃতলাল গুপ্ত প্রভৃতি সমসাময়িক শক্তিশালী শিশুসাহিত্যিকের বহু গ্রন্থ প্রকাশ করে তত্কালীন বাংলা শিশুসাহিত্যকে ঐশ্বর্য্যশালিনী করে তোলেন সিটি বুক সোসাইটি নিয়ে প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কালজয়ী বই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ ও ‘মহাভারতের গল্প’ প্রথম এখান থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল, যা পরে ইউ রে অ্যাণ্ড সন্স থেকে পুনর্মুদ্রণ করেন উপেন্দ্রকিশোর। নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যরটুকটুকে রামায়ণ’ এবং কুলদারঞ্জন রায়েরইলিয়াডএখান থেকেই প্রকাশিত হয়  ‘টুকটুকে রামায়ণবইটির নামকরণ করেছিলেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার ১৮৯৮-এ প্রকাশিত হয়খেলার সাথীও ১৮৯৯-এ যোগীন্দ্রনাথ সরকার সম্পাদিত ‘খুকুমণির ছড়া’ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে অনেক পুরনো প্রচলিত ছড়ার সঙ্গে অন্যান্য লেখকদের রচনা, বিদেশি সাহিত্য থেকে অনুবাদ ও ওনার নিজের কবিতাও ছিল। তাঁর লেখা একটা ছড়ার নমুনা দিলে বোঝা যাবে ছোটোদের জগতটাকে এবং ননসেন্স দুনিয়ার অবাস্তবকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে শুরু করেছিলেন তিনি –
ঘোড়ায় নাকি পাড়ে না ডিম
ওই দ্যাখো তার বাসা
ডিমের ওপর বসে ঘোড়া
তা দিচ্ছে খাসা

১৮৯৯-এ স্নিগ্ধ কৌতুক হাস্যরসে ভরপুরহাসিরাশিগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯০০-তে প্রকাশিত হয়আষাঢ়ে স্বপ্নএবং ১৯০১-এলঙ্কাকান্ড ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদের সংকলন গ্রন্থবন্দেমাতরমযা বাঙালিকে স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এই বইটি যোগীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এ বই প্রসঙ্গে বলেছেন,আমরা তাঁর এই কাজকে প্রবুদ্ধ ভারতের চরণে এক মোহনীয় অর্ঘ্য বলে দেশমাতার প্রসাদ বলে মাথা পেতে নিলাম এ বই তার নিজস্ব ক্ষেত্রে আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে সমস্ত বাঙালির মনে দেশাত্মবোধ জাগাতে আর আগ্রহ এনে দিতে বিশেষভাবে সহায় হয়েছিল এই কাজে যোগীন্দ্রনাথ ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ
বন্দেমাতরম’-এর পর দেখা যায় তাঁর রচনাগুলোর ঝোঁক মূলত পৌরাণিক কাহিনীর দিকে শিশুদের মতো করে প্রাচীন ভারতের রূপ, পৌরাণিক কাহিনীর উপস্থাপনা এর আগে অন্য কেউ করে যেতে পারেননিকুরুক্ষেত্র’ (১৯০৯),  ‘শকুন্তলা’, ‘সাবিত্রী সত্যবান’, ‘সীতা’ (১৯১০), ‘ধ্রুব’ (১৯১৫), ‘ছোটদের রামায়ণ’ (১৯১৮), ‘ছোটদের মহাভারত’ (১৯১৯), ‘দৈত্য ও দানব’ (১৯২০) প্রভৃতি পুরাণাশ্রিত শিশুপাঠ্য বইগুলো এ সময় প্রকাশিত হয় এর পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তক বা সাধারণ আনন্দদায়ক কিছু বই সে সময় তিনি লিখেছেন – ‘মজার গল্প’ (১৯০৫), ‘পশুপক্ষী’ (১৯১১), ‘ছেলেদের কবিতা’ (১৯১২), ‘সাথী’, ‘হিজিবিজি’ (১৯১৬), ‘শিশুসাথী’, ‘হাসির গল্প’ (১৯২০), ‘ছড়া ও কবিতা’ (১৯২১), ‘নূতন পাঠ’ (১৯২২) ইত্যাদি
সে সময় তাঁর জীবন ছিল প্রবলভাবে কর্মব্যস্তময় আর তার ফলে উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে ১৯২৩ সালে সকলের অজান্তে মস্তিষ্কের শিরা ছিঁড়ে জ্ঞান হারান তিনি বহু চিকিত্সার পর প্রাণরক্ষা পেলেও শরীরের ডান ভাগে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন তিনি তা সত্ত্বেও শিশুসাহিত্য থেকে সরে আসেননি তিনি অনেক সময় মুখে মুখে তিনি বলতেন আর স্ত্রী গিরীবালা দেবী কাগজে তা লিখতেন যোগীন্দ্রনাথের বয়স তখন সাতান্ন আর এরপর আরও চোদ্দো বছর বেঁচেছিলেন তিনি এই চোদ্দো বছরে খুব দ্রুততায় বামহাত হয়ে পড়ে সজীব এবং সমস্ত প্রুফ সংশোধনের কাজই তিনি অনায়াসে করে ফেলতেন বামহাত দিয়ে শরীর তাঁর রোগগ্রস্ত, কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনওদিন তাঁর লেখায় মুদ্রণ প্রমাদ চোখে পড়ে না একে একে ১৯২৪-এপঞ্চরত্ন’, ১২২৫-এআদর্শপাঠ’, ‘উশীনর’, ‘সুভদ্রা’, ‘প্রহ্লাদ’, ‘রত্নাকর’, ১৯২৬-এলবকুশ’, ‘সুশিক্ষা’, ১৯২৮-এঅন্ধমুনি’, ‘অভিমন্যু’, ‘গান্ধারীর দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯২৯-এছোটদের চিড়িয়াখানা’, ‘বনে জঙ্গলে’, ‘জ্ঞানপ্রবেশ’, ‘শিক্ষাপ্রবেশ’, ‘সপ্তকান্ড রামায়ণ’ এরকম কত রচনা, সংকলন, সম্পাদনা করে গেছেন তিনি
১৯৩৭-এ জীবনের শেষবেলায় রবীন্দ্রনাথের ভূমিকায় সমৃদ্ধগল্প সঞ্চয়নসংকলনটি প্রকাশিত হয় এছাড়াও প্রকাশিত হয় আরও দুটি শিশুপাঠ্য সংকলন – ‘ছোটদের উপকথাএবংআগমনী জীবন পশ্চিমের পটে চলে আসার সময় যোগীন্দ্রনাথের জীবনে ঘটে যায় আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা তাঁকে জীবদ্দশায় দেখে যেতে হল নিজের মেয়ের মৃত্যু এর একমাসের মধ্যেই দুরারোগ্য নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে একাত্তর বছর বয়সে ১৯৩৭-এর ২৬শে জুন ইহলোক ত্যাগ করেন শিশুসাহিত্যের এই প্রাণপুরুষ যোগীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন স্নেহবৎসল কোমল মানুষ, যিনি সারাজীবন শিশুসাহিত্যকে পরিপুষ্ট করে তুলতে নিয়োজিত ছিলেন। অনেক শিশুসাহিত্যিক পাওয়া যাবে, কিন্তু যোগীন্দ্রনাথ সরকারের অবদান বাংলা শিশুসাহিত্য কোনওদিন ভুলবে না। আজ থেকে ১০০ বছর পরও হয়তো দেখা যাবে একটি চার বছরের শিশু দুলে দুলে ইন্টারনেট খুলে পাঠ করছে –
কাকাতুয়ার মাথায় ঝুঁটি
খেঁকশেয়ালি পালায় ছুটি
গরু বাছুর দাঁড়িয়ে আছে
ঘুঘু পাখি ডাকছে গাছে

______
তথ্যসূত্রঃ শিশুকিশোর একাডেমি প্রকাশিত ‘সবুজপাতা’ গ্রন্থের লীলা মজুমদারের নিবন্ধ, পাতাবাহার পত্রিকার যোগীন্দ্রাথ সরকার সংখ্যা

1 comment: