ইকবাল
মাসিহ – একগুচ্ছ স্বাধীনতার নাম
রাখি
পুরকায়স্থ
ছোটো বন্ধুরা, আজ তোমাদের যার কথা বলব, সে তোমাদের মতোই একটি ছোট্ট ছেলে।
জীবনের সকল প্রতিকূলতাকে জয় করে প্রচন্ড সাহস, মেধা ও বাগ্মিতার জোরে বিগত বিংশ
শতাব্দীর নব্বই দশকের মাঝামাঝি সে হয়ে উঠেছিল বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা শিশুশ্রম বিরোধী
আন্দোলনের এক অন্যতম সেনানী। তার কান্ডকারখানা দেখে স্তম্ভিত হয়েছিল বিশ্ববাসী।
ছেলেটির নাম ইকবাল মাসিহ। ইকবাল একটি ফরাসী শব্দ, যার অর্থ ‘ভাগ্য’। নিজের
নামকরণকে সার্থক করে সে প্রায় তিন হাজার শিশুশ্রমিককে ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্ত করে
তাদের ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছিল। বিশ্বের কাছে এ এক বিশাল নজির।
পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর শহরের অদূরে একটি বাণিজ্যিক শহর মুরিদকে। সেখানেই
১৯৮৩ সালে একটি অতি দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয় ইকবাল মাসিহ। আর্থিক অনটনের কারণে
ইকবালের পরিবার স্থানীয় এক কার্পেট কারখানার মালিক এরসাদের কাছ থেকে ছয়শো টাকা ঋণ
করে। শর্তানুযায়ী ঋণ পরিশোধ না হওয়া অবধি ইকবালকে কার্পেট কারখানাতে শ্রমিক হিসেবে
নিযুক্ত থাকতে হবে। তাই সেই কার্পেট কারখানার মালিকের কাছে ইকবালকে তার পরিবার প্রকৃতপক্ষে
ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। ইকবালের বয়স তখন মাত্র চার বছর। কার্পেট শিল্পে
নিযুক্ত লক্ষাধিক শিশুশ্রমিকের নামের সাথে এভাবে ইকবালের নামও যুক্ত হয়ে যায়।
তাকে দৈনিক প্রায় ১৪ ঘন্টা কাজ করতে হত। মাঝে মিলত শুধুমাত্র ৩০ মিনিটের একটি
কর্মবিরতি। কিন্তু সপ্তাহে সাতদিন উদয়াস্ত অমানুষিক পরিশ্রম করা সত্ত্বেও তাদের
পারিবারিক ঋণ ক্রমশ বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হতে থাকে। ইকবালের বয়স যখন দশ, তাদের
পারিবারিক ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৩০০০ টাকায়! অন্যান্য চুক্তিভুক্ত শিশুশ্রমিকের মতো
ইকবালেরও এই চিরদাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার আশা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসতে থাকে। কিন্তু
ইকবাল ছিল খুব সাহসী ছেলে। সে তার স্বাধীনতার আশা এত সহজে জলাঞ্জলি দিতে রাজি
ছিল না।
কারখানার কাজের পরিবেশ একটুও শিশুবান্ধব বা কিশোর উপযোগী ছিল না। তীব্র গরমের
মধ্যে একটি বদ্ধ ঘরে শিশুদের কাজ করতে বাধ্য করা হত। শিশুরা একে অপরের সাথে কথা
বললে, তাদের হাতের কাজের গতি কমে গেলে অথবা তারা অসুস্থ বোধ করলে তাদের ভাগ্যে
জুটত কঠিন শাস্তি। সেসব ভয়াবহ শাস্তির বর্ণনা শুনলে যে কোনও সহৃদয় মানুষ আতঙ্কে
কেঁপে উঠবে। দিনের পর দিন তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে দেওয়া হত না। দীর্ঘ পরিশ্রম
ও অপুষ্টির ফলে ইকবালের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছিল। সে
তার বয়সের তুলনায় ছিল অতি খর্বাকৃতি। দীর্ঘ সময় ধরে একজায়গায় বসে কার্পেট বুননের
ফলে তার মেরুদন্ড বেঁকে গিয়েছিল। তার হাতের তালু ছিল রুক্ষ ও অসংখ্য কাটাছেঁড়ায় ভর্তি। আর
পাঁচটা সুস্থ স্বাভাবিক ছেলের মতো ইকবালও চাইত বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করতে ও ইস্কুলে
যেতে। সে স্বপ্ন দেখত একদিন লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হবে।
কিন্তু অনাদর, অবহেলা ও অত্যাচার ছাড়া এই ছোটো শিশুটির ভাগ্যে যেন আর কিছুই ছিল না।
ইকবালের বয়স যখন দশ বছর, সে এই নির্মম দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভের আশায় পালিয়ে
যায়। স্থানীয় পুলিশের কাছে সে কার্পেট কারখানার মালিক এরসাদের সব
অন্যায় অত্যাচারের কথা নালিশ করে এবং সাহায্য চায়। দুর্ভাগ্যবশত আইনের রক্ষক পুলিশ
অফিসার সামান্য কিছু অর্থের লোভে ইকবালকে তার মালিকের হাতে পুনরায় তুলে দেয়। এ
ঘটনার পর ইকবালের প্রতি এরসাদের অত্যাচারের মাত্রা আরও তীব্র আকার ধারণ করে।
ছোট্ট বন্ধুরা, সেই সাহসী ছেলেটি
কিন্তু তবুও হাল ছেড়ে দেয়নি। ১৯৯২ সালে ইকবালের জীবনে এল এক নাটকীয় পরিবর্তন। সে এবং তারই মতো আরও কয়েকজন
শিশুশ্রমিক কারখানা থেকে পালিয়ে Bonded Labour
Liberation Front (BLLF) নামক সংস্থা দ্বারা আয়োজিত স্বাধীনতা
দিবস অনুষ্ঠানে যোগদান করে। BLLF একটি পাকিস্তানি সংস্থা
যারা ইকবালের মতো বঞ্চিত ও নিপীড়িত শিশুশ্রমিকদের স্বাধীনতার অধিকারের জন্য লড়াই
করে থাকে। সেই অনুষ্ঠানে
এসে ইকবাল প্রথমবার শিশুশ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে জানতে পারে। সে জানতে পারে পাকিস্তানের
সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে শিশুশ্রম পাকিস্তানে নিষিদ্ধ। সে আরও জানতে পারে, বেশ কয়েক
বছর আগেই পাকিস্তান সরকার চুক্তিবদ্ধ শ্রমদানের প্রথাকে বেআইনি
ঘোষণা করেছে। এর ফলে তার মনে স্বাধীনতা পাবার আশা পুনরায় জেগে উঠল। জমায়েতের অসংখ্য মানুষের সামনে
দাঁড়িয়ে সে নির্ভীক চিত্তে সকল অত্যাচারিত শিশুশ্রমিকদের দুঃখভোগের কাহিনি ও অসহায়ত্বের
কথা জনসমক্ষে তুলে ধরল। স্থানীয়
পত্রপত্রিকায় তার সেই অত্যাশ্চর্য বক্তৃতা ছেপে বেরোলো। মানুষ প্রথমবার তার অসাধারণ
বাগ্মিতার পরিচয় পেল।
এদিকে ইকবাল তখন ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে
মরিয়া। কারখানায় ফিরে যেতে সে
আর রাজি ছিল না। সে BLLF সংস্থার
সাথে যোগ দিল। ইকবালের কাহিনি
শুনে BLLF সংস্থার সভাপতি আহসান-উল্লা খান তাঁর সাহায্যের
হাত বাড়িয়ে দেন। অবশেষে BLLF, সর্বোপরি আহসান-উল্লা খানের আন্তরিক প্রচেষ্টায়
ইকবাল দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভ করে। ইকবালের মালিক এরসাদ বাধ্য হয়ে ইকবালের
মুক্তির চুক্তিপত্রে সই করে। ইকবাল কিন্তু শুধুমাত্র নিজে মুক্তি পেয়েই সন্তুষ্ট
ছিল না। BLLF সংস্থার সহযোগিতায়
সে তার সহকর্মী শিশুদের ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তিদানের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে
থাকে। অবশেষে, চাপের মুখে এরসাদ কারখানার অন্যান্য শিশুশ্রমিকদের ক্রীতদাসত্ব থেকে
মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
মুক্ত ইকবাল তখন পড়াশোনা করতে খুব আগ্রহী। সে তাই লাহোরে অবস্থিত BLLF সংস্থা দ্বারা পরিচালিত প্রাক্তন
শিশুশ্রমিকদের জন্য গড়া ইস্কুলে ভর্তি হয়। সে খুব মন
দিয়ে পড়াশোনা করে এবং চার বছরের পাঠ্যক্রম মাত্র দুই বছরে সম্পূর্ণ করে! সে বলত, ‘শিশুদের
হাতে শুধু কলম মানায়, যন্ত্র নয়।’
ইস্কুলে পঠনপাঠনের সময়েই ইকবালের সহজাত নেতৃত্বদানের ক্ষমতা ক্রমশ প্রকাশ পেতে
থাকে। BLLF সংস্থার পক্ষ থেকে
সে পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সভা, ধর্ণা ও প্রদর্শনীতে শিশুশ্রম এবং
চুক্তিভুক্ত শ্রমের নামে ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দিতে থাকে। সময়ের
সাথে শ্রম আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে তার জ্ঞানের পরিধি যত সম্প্রসারিত হতে থাকে,
শিশুশ্রম এবং শিশুশ্রমিকদের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সে আরও সোচ্চার হয়ে ওঠে।
মাঝে মধ্যে ইকবাল জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন কারখানায় লুকিয়ে ঢুকে পড়ত এবং
শিশুশ্রমিকদের কাছ থেকে তাদের প্রতি হওয়া অন্যায় অবিচারের কাহিনি গোপনে জেনে নিত। সেসব
ভয়ঙ্কর অভিযানের মাধ্যমে ইকবাল যেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছিল, তার দ্বারা
পাকিস্তানের বহু কুখ্যাত কারখানা বন্ধ করা সম্ভবপর হয় এবং শতাধিক শিশুশ্রমিক
দাসত্বের শৃঙ্খল মুক্ত হয়। মাফিয়াদের দেওয়া মৃত্যুর হুমকি অগ্রাহ্য করে সে দৃঢ়
প্রত্যয় নিয়ে এই সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। অসাধারণ
বাগ্মিতা ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব দ্বারা সে শিশুশ্রমিক ও ক্রীতদাসদের পালিয়ে যেতে
উৎসাহিত করতে থাকে। আনুমানিক তিন হাজার পাকিস্তানি শিশুশ্রমিক ইকবাল দ্বারা
প্রভাবিত হয়ে তাদের মালিকের হাত থেকে পালাবার সাহস অর্জন করে এবং পালাতে সক্ষম হয়!
ছোট্ট বন্ধুরা, ইকবাল কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি। সারা পৃথিবীর বুকে সে তার
সক্রিয়তার চিহ্ন রেখেছে। শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃ্দ্ধি ও শিশুশ্রমিকদের
স্বাধীনতা সংগ্রামের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছে। সে যেখানেই
গেছে সেখানকার মানুষ, বিশেষত শিশুরা, তার দ্বারা উদ্বু্দ্ধ হয়ে শিশুশ্রম বিরোধী
আন্দোলনে এক জোট হয়েছে। ১৯৯৪ সালে আমেরিকার বষ্টন শহরে Reebok Youth in Action Award দ্বারা তাকে সম্মানিত
করা হয়। পুরষ্কার গ্রহণ
পরবর্তী ভাষণে সে বলেছিল, “আব্রাহাম লিঙ্কনের মতই ক্রীতদাস প্রথা অবসানের
উদ্দেশ্যে আমি লড়াই করতে চাই।”
১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকা সফর শেষে ইকবাল স্বদেশে ফিরে পড়াশোনায়
মনোনিবেশ করে। সে আইন নিয়ে পড়াশোনা করার স্বপ্ন দেখত। কারণ, সে মনে
করত আইনজ্ঞ হতে পারলে বেআইনিভাবে ক্রীতদাসে পরিণত শিশুশ্রমিকদের জন্য তার লড়াই আরও
জোরদার ও সাফল্যমন্ডিত হবে। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ Reebok সংস্থার পক্ষ থেকে তাকে Brandeis University-তে আইন পাঠের জন্য বৃত্তি প্রদান করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত
তার সেই স্বপ্ন সফল হয়নি। তার আগেই সে এই পৃথিবীর বুক ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়!
১৯৯৫ সালের ১৬ই এপ্রিল, রবিবা্র, পৃথিবীর ইতিহাসে একটি কালিমালিপ্ত দিন। ইকবাল
সেদিন বন্ধুদের সাথে সাইকেল চড়ে বাড়ি ফিরছিল। সেসময় একটি
বন্দুকের গুলি তার পিঠে এসে লাগে। এমন একটি দামাল ছেলের হৃদস্পন্দন হঠাৎ স্তব্ধ
হয়ে যায়! সে পৃথিবী থেকে অনেক অনেক আলোকবর্ষ দূরে মহাকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র
হয়ে যায়। পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, ইকবালের চলে যাওয়া নিতান্তই একটি দুর্ঘটনা।
স্থানীয় এক চাষী, আসরাফ হিরো, নাকি অসাবধানতাবশত ঘটনাটা ঘটিয়েছে! পাকিস্তানের
মানবাধিকার কমিশনও পুলিশের সাথে একমত হয়। বেশিরভাগ মানুষ কিন্তু এ কথা বিশ্বাস
করতে রাজি হননি। তাঁরা মনে করেন, ইকবাল যেহেতু স্থানীয় কার্পেট মাফিয়ার
প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়েছিল, তাই পরিকল্পনা করে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হল।
ইকবালের এই মর্মান্তিক পরিণতি সকল বিশ্ববাসীর মনে গভীর রেখাপাত করে।
শোনা যায়, তার শেষকৃত্যে আটশো শোকস্তদ্ধ অনুগামী অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯৯৪ সালে আমেরিকা সফরকালে কুইন্সি, ম্যাসাচুসেটস-এ অবস্থিত Broad Meadows Middle School-এর ছাত্রছাত্রীদের
সামনে ইকবাল তার জীবন সংগ্রামের কাহিনি তুলে ধরেছিল। তার অকাল প্রয়াণের দুঃসংবাদ পেয়ে সেই ইস্কুলের ছাত্রছাত্রীরা
অনুদান সংগ্রহ করে এবং পাকিস্তানের কাসুর শহরে ইকবালের সম্মানে একটি ইস্কুল প্রতিষ্ঠা
করার পরিকল্পনা করে। ইকবালের
কর্মকান্ড দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দুই ভাই ক্রেগ কেইলবার্গার ও মার্ক কেইলবার্গার
১৯৯৫ সালে কানাডায় Free the children নামক একটি সংস্থা গঠন করেন। ১৯৯৬ সালে স্পেন ও দক্ষিণ আমেরিকায় ইকবালের
মৃত্যুদিন, ১৬ই এপ্রিল, আন্তর্জাতিক শিশুশ্রম বিরোধী দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৯৮
সালে ইতালীর ট্রিয়েস্তে শহরে Istituto Comprensivo Iqbal Masih নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়, যার অধীনে অনেক বিদ্যালয় স্থাপিত
হয়। ২০০০ সালে ইকবালকে মরণোত্তর World’s Children Prize for the Rights of
the Child সম্মানে ভূষিত করা হয়। ২০০১ সালে প্রকাশিত হয় ইকবালের
জীবনের ওপর ভিত্তি করে ইতালীয় লেখক ফ্রান্সিসকো ডি’আডামোর লেখা উপন্যাস ‘Iqbal’।
ইকবালের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০০৩ সালে পাকিস্তানে গঠিত হয় Iqbal Masih Shaheed Children Foundation নামক
একটি বেসরকারি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যারা বর্তমানে পাকিস্তানে কুড়িটি বিদ্যালয়
স্থাপন করেছে। ২০০৬ সালে ব্রিটিশ লেখক অ্যান্ড্রু ক্রোফ্টের লেখা ইকবালের
জীবন-কাহিনী ‘The Little Hero: One Boy’s Fight for Freedom -
Iqbal Masih’s Story’ প্রকাশ পায়। ২০০৯ সালে আমেরিকান কংগ্রেস
শিশুশ্রম বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে Iqbal
Masih Award for the Elimination of Child Labor নামক একটি বার্ষিক পুরষ্কার প্রদান
কর্মসূচির সূচনা করেন। ২০১২
সালের ১৬ই এপিল, স্পেনের সান্তিয়াগো শহরে একটি চকের নামকরণ করা হয় Iqbal Masih Square। ২০১৪ সালে ভারতের শ্রী কৈলাশ সত্যার্থী শিশুশ্রম প্রতিরোধ
ও স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের জন্য নোবেল শান্তি পুরষ্কার গ্রহণ করেন। পুরষ্কার গ্রহণ
পরবর্তী ভাষণে তিনি এই পুরষ্কার ইকবাল মাসিহ ও বিশ্বের অন্যান্য শিশুশ্রম বিরোধী
আন্দোলনের শহীদদের নামে উৎসর্গ করেন। ২০১৬ সালের ২৩ ও ২৪ এপ্রিল, ইতালীর সিসিলি
দ্বীপে অবস্থিত কাতানিয়া শহরে অনুষ্ঠিত হয় ‘X Iqbal Masih Rugby Tournament’।
ইকবাল মাসিহ আসলে একটি আদর্শের নাম। পাকিস্তান তথা সারা
বিশ্বে শিশুশ্রম ও চুক্তিভুক্ত শ্রমের বিরুদ্ধে তার নির্ভীক সংগ্রাম এক আশ্চর্য
দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মাত্র বারো বছরের সংক্ষিপ্ত জীবৎকালে তার শিশুশ্রম বিরোধী
শক্তিশালী বার্তা ও দৃঢ়সঙ্কল্প বিদ্রোহ হাজার হাজার শিশুশ্রমিককে স্বাধীনতা চাইতে
সাহস যুগিয়েছে এবং পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য মানুষ তার এই শুভ প্রচেষ্ঠায় সামিল হয়েছে। দুঃখের কথা, ইকবালের স্বপ্ন কিন্তু এখনও
অধরা। The United Nations Children's Emergency
Fund (UNICEF) ও International Labour Organisation (ILO)-এর
সমীক্ষা অনু্যায়ী, পৃথিবী জুড়ে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ক্রমশ নিম্নগামী হলেও, ২০১৩
সালে সারা বিশ্বে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৬৮ মিলিয়ন। এর
মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক শিশু, অর্থাৎ প্রায় ৮৫ মিলিয়ন শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত!
বিশ্বের মধ্যে সাব-সাহারান আফ্রিকায় শিশুশ্রমিকের সংখ্যা সর্বাধিক - প্রায় ৫৯
মিলিয়ন! ILO ও UNICEF-এর মতে, ২০১২
সালে পাকিস্তানে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ১২ মিলিয়ন অতিক্রম করেছে। আমাদের দেশ
ভারতবর্ষের ছবিটাও কিন্তু খুব ভালো নয়। ২০১১ সালের জনসমীক্ষা অনুযায়ী ভারতে ৫ থেকে
১৪ বছর বয়সী শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১০.১ মিলিয়ন!
আজকের শিশুই আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। শিশুদের মানুষের মতো মানুষ
হবার জন্য ভালোবাসা চাই, আনন্দের আয়োজন চাই। প্রতিটি শিশুরই এই সুন্দর পৃথিবীতে
সুস্থ-সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার অধিকার আছে। দৈহিক ও মানসিক বিকাশ তথা খাদ্য-পানীয়-পুষ্টি,
চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা-বিনোদন, নিরাপত্তা ও সুরক্ষার অধিকার নিয়েই সে
ভূমিষ্ঠ হয়। শিশুর এই মৌলিক অধিকারগুলো সুনিশ্চিত করার দায়-দায়িত্ব মা-বাবা,
পরিবার-পরিজন, সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের। তাই সকলের সম্মিলিত প্রয়াসেই বিশ্বের সকল
শিশুর জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করা সম্ভব।
ছোট্ট বন্ধুরা, বন্দুকের একটি ক্ষুদ্র গুলি কি পারে একটি অসামান্য ছেলের বৃহৎ
স্বপ্নকে অচিরে বিনষ্ট করতে? কখনোই না, তাই না? আমরা তা কখনও হতে দিতে পারি না।
চলো, আমরা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইকবালের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করি। এসো, আমরা
শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হই। সেই সাথে তোমাদের মতো কোনও শিশু-কিশোর যেন
নির্যাতিত না হয় সেদিকেও তোমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে। শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
করে তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে। দরিদ্র, অবহেলিত শিশুদের শিশুশ্রমের দিকে
ঠেলে না দিয়ে তাদের পড়াশোনার সুযোগ করে দিতে হবে। এভাবেই ইকবাল বেঁচে থাকবে আমাদের
সকলের মাঝে। তার স্বপ্ন বেঁচে থাকবে তোমাদের মতো ছোটো ছোটো শিশু-কিশোরদের মনে। এসো, আজ আমরা সবাই মিলে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে যথাসম্ভব
আন্তরিকতা, বিবেকবোধ, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সাথে প্রতিটি শিশুর সুন্দরভাবে
বাঁচার ও মানুষ হবার অধিকারকে সুনিশ্চিত করতে এ কথাগুলো বলে অঙ্গীকার করি -
“চলে যাব -
তবুও আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে
পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ
শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি -
নবজাতকের
কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
-----
লেখক পরিচিতিঃ আইন নিয়ে পড়াশোনা। আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। পেশায়
আইনের শিক্ষক। ছোটবড়ো সকলের জন্য গল্প ও প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসেন। অবসর সময় কাটান
বই পড়ে, ছবি এঁকে ও সঙ্গীতচর্চা করে। এছাড়া বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থানে ভ্রমণ এবং
সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ক্যামেরাবন্দি করতে উৎসাহী।
No comments:
Post a Comment