নিশ্চিন্তপুরের রূপকথা
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
সেদিন সকাল থেকে বৃষ্টি। আকাশ
যেন ভেঙে পড়েছে। সঙ্গে তেমন এলোপাথাড়ি ঝোড়ো হাওয়া। গাছের
সঙ্গে ল্যাম্প-পোস্টের জায়গা নিয়ে ঝগড়াটা যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেছে।
শুরুতে বলাইয়ের বেশ ভালোই
লাগছিল। গাড়ি কম চলছে। রাস্তায়
লোকের ভিড় উধাও। সারা শহর যেন হঠাৎ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। হার
মেনে নিয়েছে এই বিরামহীন বৃষ্টির কাছে। সামনের রাস্তাটা এখন বলাইয়ের বাড়ির উঠোন। বলাইয়ের
বাড়ি বলতে অবশ্য স্টেশনারি দোকানের সামনের আট ফুট চওড়া ফুটপাথটা। বেশ
খানিকটা জায়গা। হাত-পা ছড়িয়ে শোওয়ার পরও দু’হাত জায়গা
থাকে। আজ রাস্তা-ফুটপাথ সব জলে একাকার। সব
দোকান বন্ধ। আজকে ও রাজা। যা ইচ্ছে করতে
পারে। কারও কাছে কোনও বকাঝকা খাওয়ার ভয়
নেই। কেউ আড়চোখে তাকানোর নেই।
চায়ের দোকানের সামনে যে
বেদীটা আছে, সেখানে পা ঝুলিয়ে বেশ খানিকক্ষণ বসে ছিল। কিন্তু চারদিকটা যেভাবে পুকুরের
মতো হয়ে উঠেছে, জল যেভাবে বাড়ছে, তাতে আর জলে নামার লোভ সামলাতে পারল না বলাই। ও ওর
ছোটোবোন বুনুকে নিয়ে জলে নামল। মাঝে
মধ্যে গাড়ি যাচ্ছে। তার পিছনে পিছনে জলের মধ্যে দিয়ে ছুটে
চলার মজাই আলাদা। ঢেউ এসে ধাক্কা মারে, উঁচুনিচু আন্দাজ
করতে না পেরে ও জলের মধ্যে পড়ে যায়। হাবুডুবু
খেয়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। আবার খানিকটা ছুটে, খানিকটা জলে
সাঁতরানোর চেষ্টা করে, আবার থামে। লক্ষ করে, বুনু অবাক হয়ে দূর থেকে ওকে দেখছে আর
হাসছে।
সামনের কচুরির দোকানের শালপাতাগুলো
চারদিকে ভাসছে। ওরা দু’জনে মিলে শালপাতার রেস করে। কারটা
কত দূর যায়। এসব করতে করতে কখন যে জল কোমর ছাড়িয়েছে
বলাই খেয়াল করেনি। ভাগ্যিস, শ্যামদের বাড়িটা ছিল। ওদের
বাড়ির বাইরের রকটা ফুটপাথ থেকে বেশ খানিকটা উঁচুতে। ওরা
সেই রকে গিয়ে বসল। অন্যদিন হলে ওরা তাড়িয়ে দিত। আজকে কেউ
কিছু বলল না। বাবা-মার এখনও দেখা নেই। বাবা
যায় দমদম স্টেশনের কাছে তরকারি বিক্রি করতে। মা কয়েকটা
বাড়িতে রান্নার কাজ করতে যায়। আজ হয়তো
বৃষ্টি-জলে কোথাও আটকা পড়েছে। ট্রাম-বাস
তো আর চলছে না।
কিন্তু পেটের খিদেটাকে তো আর বৃষ্টি
আটকাতে পারেনি। বুনুটা বোকা। খিদে
পেলে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ও রকে শুয়ে ঘুমিয়ে
পড়েছে কে জানে। বলাইয়ের কান্না আসে না। ও রাস্তার
উলটোদিকের কোণে যে রেস্টুরেন্টটা আছে, তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রেস্টুরেন্টের
আলো আধভেজা দরজার ফাঁক দিয়ে তেরছাভাবে জলে এসে পড়েছে। রোজকারমতো
আজও দরজার কাছে পাগড়ি পরা দারোয়ান। লোকজন
নেই, তবুও দাঁড়িয়ে আছে। কী ভালো হত যদি রেস্টুরেন্টে
কাস্টমার নেই বলে ওদের আজ ডেকে খেতে দিত।
রাস্তা ইতিমধ্যে ফাঁকা হয়ে গেছে। আরও
বেশ কয়েকদিন লেগে যাবে এ জল সরতে। এ সময়
অন্যদিন পাশের দোকানে মিষ্টির লাইন, উল্টোদিকের দোকানে কচুরি-সিঙ্গাড়ার লাইন
পড়ে যায়। পাড়ার বেশ কিছু ছেলে ওইদিকের চ্যাটার্জিদের
রকে বসে আড্ডা মারে। আজ আশেপাশের
সব দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তার
আলোগুলো মিটমিট করে চোখ খুলে ঝিমোচ্ছে। বলাইয়েরও
ঝিমুনি আসছে। গত দু’দিন থেকেই গায়ে জ্বর। তার
ওপর আজ বৃষ্টিতে কাকভেজা। শরীর তাই একদম
ভালো লাগছে না। সিঁড়িতে একটু জায়গা করে শুতে গেল বলাই। আর তখনই
ও খেয়াল করল, একটা
ছোট্ট সাদা কুকুর পাশে এসে বসেছে। এ তো
রাস্তার কুকুর নয়। ভারি সুন্দর দেখতে। এরকম
কুকুর ও আগেও দেখেছে। বড়লোকদের বাড়িতে
থাকে। কিন্তু এখানে কী করছে? কোত্থেকে
এল? এ বাড়ির দরজা তো বন্ধ।
“খিদে পেয়েছে?”
কে বলল? ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বলাই। না,
পাশে শুধু বুনুই আছে। তা সেও ঘুমিয়ে
পড়েছে।
“কী, খিদে পেয়েছে?” আবার সেই কণ্ঠস্বর।
এবার বলাই বুঝতে পেরেছে। কথা বলছে সাদা
কুকুরটাই।
“তুমি কথা বলতে পার? আশ্চর্য তো!”
“দেখছই তো পারি। দরকার হলেই বলি।” একটু
থেমে ফের কুকুরটা বলে উঠল, “এস আমার সঙ্গে। যেখানে
নিয়ে যাব, সেখানে
কত খাবার! কিন্তু খাওয়ার লোক নেই। ওই রাস্তা
পেরিয়ে যেতে হবে।”
“কিন্তু এত জলের মধ্যে
দিয়ে যাব কী করে? ডুবে
যাব যে!”
“জলের উপর দিয়ে হাঁটার
চেষ্টা করেছ কোনওদিন? পারব মনে করলেই পারা যায়। পা ফেলেই
দেখো না। বুনুকে কি নিয়ে যাবে? নাহ্, ও তো ঘুমিয়ে
পড়েছে। ওর জন্য খাবার নিয়ে এলেই হবে।”
কুকুরটার কথামতো বলাই জলের উপর
পা ফেলল। সত্যিই তাই! অদ্ভুত ব্যাপার। বলাই
ডুবল না। কাগজের নৌকোগুলোর মতো ভেসে রইল। দারুণ
মজার ব্যাপার এই জলের উপর পা ফেলে ফেলে হাঁটা। কুকুরটা
আগে আগে তরতরিয়ে যাচ্ছে। বাবা-মা, বুনু যদি
এই অদ্ভুত কান্ডটা দেখত! কেউ জানেই না যে জলের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়। কিন্তু
এখন বুনুকে ডেকে দেখানোর সময় নেই। খাবার
নিয়ে এসেই কায়দাটা দেখানো যাবে। বলাই
কুকুরটার পিছন পিছন হেঁটে চলল। ছুটে
চললই বলা যায়।
বেশ খানিকটা যাওয়ার পর একটা
পুরনো গাড়িবারান্দাওয়ালা বাড়ির লাগোয়া গলিতে গিয়ে ঢুকল। ঢুকেই
যা দেখল বলাই, তা বলে
বোঝানো শক্ত। এত কাছেই যে এরকম আজব জায়গা থাকতে পারে,
তা সে কস্মিনকালেও কল্পনা করেনি। হঠাৎ
করে সন্ধে কেটে চারদিকে আলো-ঝলমলে সকাল। পায়ের
তলার জলও হঠাৎ করে উধাও। চারদিক সবুজ
আর সবুজ। যতদূর দেখা যায় শুধু চাষের ক্ষেত। ওরা
একটা ক্ষেতের আলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
বলাইকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে
দেখে কুকুরটা ধমকে উঠল, “বাহ্! তুমি তো আচ্ছা হাঁ-করা ছেলে দেখছি। যেখানে
খুশি দাঁড়িয়ে পড়। চলো, চলো, তাড়া আছে।”
“আচ্ছা, আমি এখন কোথায়? হাতিবাগানে?”
“না না, হাতি-টাতি নয়। নিশ্চিন্তপুরে, নিশ্চিন্তপুর
রাজ্যে।”
“যাহ্, সেরকম আবার
কোনও জায়গা আছে নাকি?
তুমি দেখছি ভারি বোকা। এটা
দিল্লি হতে পারে, বোম্বে
হতে পারে, হাওড়া
হতে পারে, বেলতলা
হতে পারে, সোনারপুরও হতে পারে। কিন্তু
নিশ্চিন্তপুর নয়। এরকম নাম আমি জীবনেও শুনিনি।”
“কেন, নিশ্চিন্তপুর নয়
কেন? আমি
কুকুর বলে আমাকে হেলার চোখে দেখ, না? এই যে তোমাকে যেখান থেকে ধরে আনলাম, এখন বলবে সেটাও
জগদ্দলপুর নয়।”
“জগদ্দলপুর তো নয়ই। ওটা
তো কলকাতা। তুমি দেখছি কিছুই জান না।” বলাই
ফের বিড়বিড় করে বলে ওঠে, “তা
কুকুরের মাথায় আর কতই বা বুদ্ধি হবে!”
“এই যে, বারবার কুকুর কুকুর
বোলো না তো। আমার নাম সুবোধ। সুবোধ
বলে ডাকবে।”
নাহ্, তর্কাতর্কি করা ঠিক হচ্ছে
না। একে তো জায়গাটা অচেনা, তারপর কুকুরটাও
বদমেজাজি মনে হয়। তারপরে যে কুকুর কলকাতাকে জগদ্দলপুর বলে, সে যে
পাগল কুকুর নয় তাই বা কে বলতে পারে!
খানিক দূরে কয়েকটা মাটির ঘর দেখা
যাচ্ছে। উপরে খড়ের চাল। চারধারে
আম-জাম, কাঁঠাল, বট আরও কত নাম
না জানা গাছ। গাছে থোকা থোকা ফল ঝুলছে। দেখলেই
খেতে লোভ হয়।
“কী, খাবে নাকি?”
কুকুরটার বুদ্ধি আছে বলতে হবে। তাকানো দেখেই
বুঝতে পেরেছে।
“কেউ বকবে না?”
“আরে, বকার কী আছে? যত ইচ্ছে তত
খাও।”
“কিন্তু যার গাছ, সে যদি...”
“ধুর, গাছ আবার
কারও হয় নাকি? নিশ্চিন্তপুরে
কোনওকিছুই কারও নিজস্ব নয়। এখানে
তাই আমার বাড়ি, আমার
জমি, আমার
আকাশ – এরকম কথা কেউ বলে না। সবকিছুই
সবার।” বলে একটু থামল কুকুরটা। তারপরে চেঁচিয়ে ডেকে
উঠল, “এই অঙ্কে পাঁচ,
অঙ্কে পাঁচ, দশটা
আম দে তো।”
বলতে না বলতে কোত্থেকে এক হনুমান
এসে হাজির। হাতে আটটা পাকা পাকা আম।
“আর লাগবে?”
“না, আর লাগবে না। তবে
ফের যোগে ভুল। তুই যে কবে শিখবি!”
“ও, তাই বুঝি! বলো
তো আরও চারটে নিয়ে আসি। আট আর চারে দশ হয়ে যাবে।” হনুমানটার কালো মুখটা লজ্জায় লাল
হয়ে উঠল।
“না না, আর লাগবে না,”
বলাই বলে উঠল।
হনুমানটা বলাইয়ের দিকে তাকিয়ে
বলে উঠল, “তা
তুমিই কি আমাদের ভাড়াটে রাজপুত্র?”
বলাইকে বলার সুযোগ না দিয়ে সুবোধ
সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল। সঙ্গে সঙ্গে
হনুমানটাও ওকে সেলাম ঠুকে ফের গাছে ফিরে গেল।
“আচ্ছা, ওর নাম অঙ্কে
পাঁচ হল কেন?”
“আর বোলো না। সামনে
বললে লজ্জা পাবে। রাজামশাইয়ের ইচ্ছে এখানকার সবাই লেখাপড়া
শিখে কুকুর হোক, স্যরি,
মানুষ হোক। কিন্তু সবার মাথায় কি সবকিছু ঢোকে? ওরও তাই। সবকিছুতেই
ভালো। পরিশ্রমী। কিন্তু
ওই অঙ্ক। দিনরাত অঙ্ক কষছে, কিন্তু একশোয়
পাঁচের বেশি কখনও পেল না। সেই থেকে ওই
নাম।”
“তা তোমাদের স্কুলে কুকুর, বেড়াল, গরু, ছাগল সবাই পড়ে? এ তো ভারি মজার
ব্যাপার। হে হে হে, গরুর গোয়াল।”
“হে হে...” কুকুরটা ভেংচিয়ে
বলে উঠল, “তুমি
তো ভারি রেসিস্ট। কেন, আমরা কি তোমাদের থেকে কম কিছুতে?” একটু থেমে
দূরে ঘাসে যে গরুটা চরছিল, তাকে
দেখিয়ে বলে উঠল, “ওই
যে গণেশপন্ডিত। আমাদের স্কুলে বিজ্ঞান পড়ান। ঘাস, লতা, পাতা সবেতে
অগাধ পান্ডিত্য। গন্ধ শুঁকে বলে দেন কোনটা কেমন। ভারি
রাগী। রেগে গেলে গুঁতিয়ে দিতেও ছাড়েন না। অমন
তোমাদের গ্রামে আছে একজন?”
“গ্রাম নয়, গ্রাম নয়। আমি
থাকি শহরে। মস্ত বড়ো শহরে।”
বলাই বলে উঠল।
কুকুরটা তর্ক করতে গিয়ে থেমে
গেল। সামনের ক্ষেতে একটা শোলার টুপি পরা লোক
কোদাল দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে। তাকে
দেখে সুবোধ দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “রাজামশাই, এই যে নিয়ে এসেছি।”
“রাজামশাই? ইনি হলেন
রাজামশাই! তুমি হাসাতে পার বটে। মাথায়
টাক, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। লুঙ্গি
পরা, ছেঁড়া গেঞ্জি, তিনি
হলেন তোমাদের রাজা?”
“কেন, তোমাদের রাজারা কিছুই
পরেন না নাকি?”
“পরবে না কেন? ঝলমলে পোশাক
পরে। বিশাল বিশাল বাড়িতে থাকে। হাজার
হাজার দাসদাসী তাদের। নিজেরা তারা
কোনও কাজই করে না। ভালো ভালো খাবার খায়। একে
ওকে আদেশ করে। তাদের তো এরকম রাস্তায় দেখাই যায় না। চাষবাস
তো বাদই দাও।”
“নাহ্, তোমার কথা সত্যিই
অদ্ভুত। এরকম আবার হয় নাকি? আমাদের মধ্যে
যে সবথেকে গরীব, যার স্বভাব সবথেকে ভালো, সেই তো রাজা হয়। এই যে
তোমাকে বেছে নিয়ে এলাম, এ তো একই কারণে। চলো, আমাদের রাজামশাইয়ের
সঙ্গে তোমার আলাপ করাই। দেখবে একদম মাটির
মানুষ।”
সুবোধ লোকটার কাছে গিয়ে বলে
উঠল, “রাজামশাই, এই যে পাওয়া
গেছে রাজপুত্র।”
লোকটা মাটি কোপানো ছেড়ে বলাইয়ের দিকে
খানিকক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর
লাফিয়ে উঠে বলাইকে জড়িয়ে ধরল। বলে
উঠল, “বাহ্, একে তুমি কোথায়
পেলে? এ তো
বেশ ভালো ছেলে।”
“জগদ্দলপুরে একটা বাড়ির
রকে বসে ছিল; খিদেতে ছটফট করছিল। দেখে
বেশ গরিব আর সৎ মনে হল। তাই ধরে আনলাম।
কী, একে রাজপুত্র করা যাবে না?”
“আরে, ছেলে যখন সৎ, করা যাবে আলবৎ।”
রাজামশাই এবার বলাইয়ের দিকে তাকালেন। “তা যুদ্ধ তোমার জানা আছে?”
বলাই ‘না’ বলে মুখ চাওয়াচাওয়ি
করছে দেখে রাজা ফের বলে উঠলেন, “আরে, ঠিক আছে। ঠিক
আছে। শিখে যাবে। এমনকি আর শক্ত হবে! যাও সুবোধ, নিয়ে
যাও। খেতে দাও, খেতে দাও।”
কুকুরটা রাজামশাইকে প্রণাম করে
কান নাড়িয়ে বলাইকে ওর পিছু নিতে বলল। “বুঝলে, এ রাজামশাইয়ের
এক আজব শখ। শুধু ছড়া করে বলেন। মেলাতে
না পারলে মনখারাপ করে বসে থাকেন। কথাই
বলেন না।”
“তা উনি যুদ্ধের কথা
কী বলছিলেন? কিছুই
বুঝলাম না।”
“দাঁড়াও, তোমাকে পুরো ঘটনাটা
বুঝিয়ে বলছি। আগে একটু লাঞ্চ
করে নাও।”
সুবোধ বলাইকে নিয়ে একটা দোতলা
বাড়ির মধ্যে এসে ঢুকল। দরজা ভেজানো
ছিল। ঠেলতেই খুলে গেল। ঢুকেই
প্রায় লাফিয়ে বেরিয়ে এল বলাই। বেরোবে
না কেন? দরজার
এক ধারে বসে আছে একটা বিশাল কালো ভালুক, অন্য ধারে বেশ বড়োসড়ো চেহারার একটা বাঘ।
ভালুকটা একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে
বসে ঝিমোচ্ছে। বাঘটা মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর থাবা
দিয়ে ভুঁড়ি চুলকোচ্ছে। সুবোধ বলাইয়ের
ভয় দেখে ‘খ্যা খ্যা’ করে বেশ খানিকক্ষণ দরজার কাছে গড়াগড়ি খেয়ে হাসল।
“তুমি ভোম্বল আর কম্বলকে দেখে
ভয় পেয়েছ? হে হে
হে...” সুবোধ ফের মাটিতে পড়ে হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল।
“ভোম্বল? কম্বল?”
“ভোম্বল হল বাঘটা। আর কম্বল
হল ভালুকটা। তবে ওদের আর বাঘ, ভালুক বললে ওরা
নিজেরাও এখন লজ্জা পায়। এই তো সেদিন
একটা ছুঁচো ভোম্বলের লেজে কামড় দিয়ে চলে গেছিল। সেই
থেকে ভোম্বল ছুঁচো দেখলে ঠকঠক করে কাঁপে। আর কম্বলের
কথা কী বলব! শাকাহারী। সূর্য ডুবলেই
দুধভাত খেয়ে শুয়ে পড়ে।”
“তা ওরা এখানে কেন?”
“আরে, এত বড়ো রাজপ্রাসাদে
পাহারাদার থাকবে না?
বলি, আমাদেরও তো প্রেস্টিজ আছে,তাই না?”
এবার বলাইয়ের হাসির পালা।
“এটা তোমাদের রাজপ্রাসাদ! এরকম বাড়ি তো
আমাদের শহরের অলিগলিতে। রাজপ্রাসাদে
রাজসিংহাসন কোথায়? মন্ত্রী-সেনাপতিরা কোথায়? আমাদের দেশে
রাজপ্রাসাদ সোনা-মণিমুক্তো
দিয়ে সাজানো থাকে। বিশাল বিশাল ঝাড়বাতি ঝোলানো হলঘর থাকে। কত দাসদাসী,
কত প্রহরী, আমরা কাছেই ঘেঁষতে পারি না। এ সত্যি
নিশ্চিন্তপুর বলে নিশ্চিন্তপুর। অজ গাঁ।”
কুকুরটা এবার বেজায় খেপে গেল।
“আহা, তুমি বুঝি অনেক
রাজপ্রাসাদ দেখেছ? ওসব
তো শোনা কথা। আর আমাদের ভোম্বল-কম্বলও তোমাদের সেনাপতিদের
থেকে কম কিছু? নেহাত
চোখে ছানি পড়েছে, আর
দুধভাত খেয়ে খেয়ে দাঁতের জোর একটু কমে গেছে। কিন্তু তাহলেই
বা কী? এখনও
লাফিয়ে পড়লে তোমার মতো দশজনকে চিৎপটাং করে ফেলতে পারে।
“তা তোমাদের রাজবাড়িতে
ক’টা ঘর?”
“আগে বলব না। বল, তোমাদের রাজবাড়িতে
কত ঘর থাকে?”
“তা একশোটা তো হবেই।”
“তাহলে আমাদের এখানে খান
দুশো ঘর আছে। তিনশোও হতে পারে।”
“বাহ্, তুমি তো দিব্যি
গুল মারতে পার। বাড়ি দেখেই বোঝা যায় বড়জোর খান দশেক ঘর
হবে। যেমন প্রাসাদ, তেমন রাজা।
তেমন প্রজা।”
কুকুরটা এবার বেজায় রেগে প্রচন্ড
জোরে ঝগড়া করতে শুরু করল। পারলে আঁচড়ে
দেয়। এসব গোলমালে এতক্ষণে কম্বলের ঘুমের ঘোর
কেটেছে। ও চশমা কপালে তুলে, “কে? কে রে?” বলে চেঁচিয়ে
উঠল।
“এই যে আমরা। আমার সঙ্গে ভাড়া
করা রাজপুত্র।”
বাঘটা এসব চিৎকারে ভয় পেয়ে লেজ
খাড়া করে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ফের ছুঁচোর উৎপাত
নয় তো? পরে ব্যাপারটা বুঝে সেও দাঁড়িয়ে উঠে বেশ বনেদি কায়দায় মাথা ঝুঁকিয়ে অভ্যর্থনা
করল। ভালুকটা চোখে প্রায় কিছুই দেখে না। সুবোধকে
দেখেই প্রণাম ঠুকে বলল, “পেন্নাম,
রাজপুত্র।”
“আরে, আমি নই। আমি
সুবোধ। রাজপুত্র ইনি। আমার
পাশে।”
ভালুকটা লজ্জা পেয়ে এবার বলাইকে
ঘাড় ঝুঁকিয়ে প্রণাম জানাল। বলাইয়ের এসব
অবশ্য ভালো লাগছিল।
বড়ো হলঘরটা পেরিয়ে সুবোধ ওকে নিয়ে
আরেকটা বড়ো ঘরে ঢুকল। রাজার বিশেষ
অতিথিরা এ ঘরেই থাকে। ঘরে খাট নেই। মাটিতে
চাটাই পেতে শোয়ার ব্যবস্থা। রাজা
নাকি প্রায়ই স্বপ্ন দেখে খাট থেকে পড়ে যেতেন। তাই
এ বাড়িতে সবার জন্যে খাট বাতিল। মাঝে
একটা টেবিলে কাঁচের পাত্রে নানানরকমের ফল। বলাইয়ের আর
তর সইল না। সে ওখান থেকে ফল তুলে খেতে শুরু করল। কেন
জানে না, ঠিক এইসময় ওর বুনুর কথা খুব মনে পড়ল।
খাবার সময় রাজা, রানি, রাজকন্যা পল্লবী
– সবার সঙ্গে আলাপ হল বলাইয়ের। প্রত্যেকেই
খুব ভালো। একটা বড়ো টেবিলে সাজিয়ে রাখা রকমারি খাবার। এত
খাবার বলাই কখনও চোখের সামনে দেখেনি। আর
কী সুন্দর আস্বাদ। কোনও কথা না বলে বলাই গোগ্রাসে খেতে লাগল। ওর খাওয়া
দেখে পল্লবী খুব হাসছিল। হাসুক গে। বলাইয়ের
এ ব্যাপারে কোনও লজ্জা নেই।
পল্লবী ওর থেকে বয়সে খানিকটা ছোটো। কথা
বলে না, খালি হাসে। খেতে খেতে রাজা কী একটা খবর পেয়ে খাওয়া
শেষ না করেই উঠে গেলেন। পরে শোনা গেল
গ্রামে কোনও একটা ছেলের ভারি শক্ত একটা অসুখ হয়েছে। তার
চিকিৎসা ঠিকঠাক হচ্ছে কি না রাজা তাই দেখতে গেলেন। বলাইয়ের
কাছে এটা ভারি নতুন খবর। এরকম কথা বলাই
জীবনে শোনেনি। কোথায় কার কী হল আর রাজা ছুটলেন
তার খবর নিতে। এই তো সেদিন ওদের পাড়ার অনু মারা গেল। ওর থেকে
একটু বড়ো। কী হয়েছিল কে জানে। বেশ
কয়েকদিন জ্বরের ঘোরে পড়ে ছিল। কেউ
খোঁজও নিতে আসেনি। আসল রাজারা এসব ছোটো ছোটো কাজ করে নিজেকে
ছোটো করে নাকি?
খাওয়ার পরে বলাই ফের সুবোধকে ধরল, “আচ্ছা, যুদ্ধের
ব্যাপারটা কী বল তো?
আমাকে এত যত্নআত্তি করছ, রাজপুত্র-রাজপুত্র বলছ। খোলসা
করে বল না।”
বলাই কী বলল তাতে অবশ্য সুবোধের
কোনও হুঁশ নেই। রাজার রাঁধুনির কাজে একটা মোটাসোটা সাদা
বেড়াল বহাল আছে। তার সঙ্গে সুবোধের ভালো বনে না। তার
দিকে মুখ ভেংচে সুবোধ বলে উঠল, “এই একটা প্রাণী যাকে আমি একদম সহ্য করতে পারি না। চেহারাটা
দেখেছ? কী গোলগাল
হয়েছে! রান্নার
সময় টেস্ট করতে গিয়েই অর্ধেক সাবড়ে দেয়। আর স্বভাবটাও
সেরকম। একদম আনকালচারড।” একটু
থেমে ফের বলে উঠল, “কী
জিজ্ঞেস করছিলে? যুদ্ধের
কথা? বলছি
শোনো। নিশ্চিন্তপুর বেশ বড়ো জায়গা। প্রায়
গোটা তিরিশ বড়ো বড়ো গ্রাম নিয়ে এই নিশ্চিন্তপুর। এখানকার
মাটিতে সোনা ফলে। কোনও কিছুরই অভাব নেই এখানে। আর পাঁচটা
জায়গার মতো লোকেরা এখানে না খেয়ে মরে না। সবাই
মিলে এক সঙ্গে সুখে শান্তিতে বাস করে। কারও
সঙ্গে ঝগড়া নেই। মনের সুখে যে যার ইচ্ছেমতো কাজ করে যায়। তা নিশ্চিন্তপুরের
মতো জায়গার প্রতি সবারই লোভ। আগে
আমাদেরও সৈন্যসামন্ত ছিল। কিন্তু বেশ কয়েক
বছর ধরে সেসব কিছুই নেই। তারা কেউ এখন
স্কুলে পড়ায়, কেউ
গবেষণা, কেউ চাষবাস। এমনকি, অস্ত্রগুলো
পড়ে থেকে থেকে মরচে পড়ে গেছে। মিউজিয়ামে
রাখা আছে।
“আমাদের পাশেই আছে পরাক্রমপুর
রাজ্য। সেখানে সারাবছর যুদ্ধবিগ্রহ চলে কে রাজা
হবে তা নিয়ে। মাস বদলাতে না বদলাতে রাজা বদলায়। তা বর্তমানে
যিনি রাজা হয়েছেন তিনি প্রথমদিনেই ঠিক করেছেন যে নিশ্চিন্তপুর আক্রমণ করবেন। এই শস্যশ্যামলা
ঝকঝকে নিশ্চিন্তপুরের ওপর তার বহুদিনের লোভ। কবে
যে উনি আক্রমণ করে বসবেন তা কে জানে। আমাদের
রাজা তো ভয়ে আধমরা হয়ে রয়েছেন। তিনি
যুদ্ধের বিন্দুবিসর্গ বোঝেন না। রক্ত
দেখলে অজ্ঞান হয়ে যান। কবিতা-সাহিত্য-বিজ্ঞানচর্চা
নিয়ে মেতে থাকেন। নিশ্চিন্তপুরের সব বাসিন্দারই এক দশা। যুদ্ধের
কথা শুনে অনেকে যুদ্ধের উপর কবিতা লিখছে। অনেকে
যুদ্ধবিরোধী ভাষণ দিচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধে
যেতে বললেই তারা খাটের তলায় লুকোবে। তা আমরা
ভেবে দেখলাম, তোমাদের জগদ্দলপুরে তো মারপিট-খুনোখুনি লেগেই থাকে। কারণে
অকারণে তোমরা একে অন্যের ক্ষতি কর। তাই ওখান থেকে
কাউকে নিয়ে এসে রাজপুত্র করলে বিপক্ষ ভয় পেয়ে যাবে। তাই
তোমাকে নিয়ে আসা।”
“কিন্তু একা একা কি যুদ্ধ জেতা
যায়? সৈন্য
কোথায়? তোমাদের
দেশে গুন্ডা, ডাকাত, মাস্তান কেউ
আছে তো? ওরা
অন্তত মারপিট করতে পারবে।”
“না, সেটাই তো মুশকিল। যে দু-একটা
গুন্ডা ছিল, তারাই তো এদেশে টিঁকতে পারল না। লোকে
চাইলেই দিয়ে দেয়। চড় মারলেও রা কাড়ে না। ছিনিয়ে
নেওয়ার পরে আর কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করে। সাহায্য
করতে পেরেছে বলে ধন্যবাদ জানায়। এরকম দেশে গুন্ডামি করে লাভ কী? এই তো শেষ গুন্ডা
মণীশ পান্ডা দুঃখ করতে করতে দেশ ছাড়ল। রাজামশাই
তাকে রাখার কত চেষ্টা করলেন। গুন্ডা-টুন্ডা
থাকলে দুষ্টু বাচ্চাদের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতে সুবিধে হয়। গুন্ডামি
কাকে বলে তা বোঝানো যায়। কিন্তু তবুও
সে থাকল না।”
খানিক থেমে সুবোধ ফের বলে উঠল, “তবে চাইলে
দু-একটা ভূত জোগাড় করে দিতে পারি। রাতের
দিকে এখানকার বাঁশঝাড়ে এখনও তাদের দেখা পাওয়া যায়।”
“তাই নাকি! তাহলে আমার সঙ্গে অবিলম্বে
আলাপ করাও। যুদ্ধের প্রস্তুতি এক্ষুনি শুরু করা দরকার।”
আসলে বলাইয়ের বহুদিনের ইচ্ছে ভূত
দেখার। এরকম সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় না।
সেদিন বিকেলের দিকে বলাইয়ের সঙ্গে
সুবোধ সেনাপতির আলাপ করাল। সুবোধ
আগেই বলেছিল, এখন রাজার সেনাবাহিনী ছোটো হতে হতে একজনে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি
হলেন সেনাপতি। তার নাম গোপাল।
খড়ের চাল দেওয়া ছোট্ট একটা মাটির
বাড়ির সামনে সুবোধ হাঁকাহাঁকি শুরু করল, “এই যে, সেনাপতিমশাই! সেনাপতিমশাই!”
খানিক বাদে হন্তদন্ত হয়ে একজন
মোটাসোটা বয়স্ক লোক বেরিয়ে এল। সরস্বতী
মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে যে লোকটা মিষ্টি বানায়, অনেকটা তার মতো চেহারা।
“কী ব্যাপার? কী ব্যাপার? যুদ্ধ শুরু হল
নাকি?”
“আরে না না, সেরকম কিছু নয়। আমাদের নতুন
রাজপুত্রের সঙ্গে আপনার আলাপ করাতে এলাম।”
“আচ্ছা, আমাদের রাজ্যে
যুদ্ধ করতে পারে এমন কারও নাম জানেন আপনি?” বলাই গোপালকে জিজ্ঞেস করে উঠল।
লোকটা বেশ খানিকক্ষণ ভুঁড়ির ওপর
হাত বুলিয়ে একটা ঢেঁকুর তুলে বলল, “নাহ্, সেরকম কারুর কথা তো আমার জানা নেই। আমার
ঠাকুর্দা যুদ্ধ করতে জানতেন। তখনও
লোকে তলোয়ার চালাতে,
ঘোড়া চড়তে, গুলি
ছুড়তে জানত। ব্যস, ওই শেষ। এই আমার
কথাই ধর। গত কুড়ি বছর সেনাপতি হয়েছি। কিন্তু
যুদ্ধ কোথায়? বাবার
কাছ থেকে পাওয়া বন্দুকটা ভেঙে খাটের পায়া বানিয়েছি।”
সুবোধ বিরক্ত হয়ে বলাইকে নিয়ে
ওখান থেকে বিদায় নিল।
“চল, তোমাকে ভূতেদের সঙ্গে আলাপ
করাই। তাদের মধ্যে দু-একটা কাজের লোক থাকলেও
থাকতে পারে।”
সুবোধ বলাইকে নিয়ে কচুয়ার বাঁশবনে
এল। তারপর একটা শিমুলগাছের তলায় বসে সূর্য
ডোবার অপেক্ষা করতে লাগল। খানিক বাদে সূর্য
বাঁশঝাড়ে ঢাকা পড়ে গেল। তারও খানিক পরে
একটা রোগা-পাতলা চাঁদকে উল্টোদিকের বাঁশঝাড়ে দু-একটা পাতা ধরে ঝুলতে দেখা গেল। বেশ
খানিকক্ষণ কেটে গেল। পর পর কয়েকটা
প্যাঁচার ডাক শোনা গেল। সুবোধের সবেতে
ওস্তাদি।
“বল তো, কী বলল প্যাঁচাটা?”
“কী আবার বলবে? প্যাঁচা আবার
কিছু বলে নাকি?”
“না, প্যাঁচারা কিছু বলে না। যা বলার
তোমরাই বল। কী বলল শোনো। প্যাঁচাটা
ঘুম থেকে উঠে খুব আলসেমি করে ওখানেই বসেছিল। তা দেখে
প্যাঁচানি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কী
ব্যাপার? বাজার-টাজার
না করে গাছে বসে ঝিমোলেই চলবে? একমাস ধরে একটা ভালো ইঁদুর ধরে আনবে বলছ’।”
“যত তোমার গুলগল্প।” মশার
কামড়ে বিরক্ত হয়ে বলাই বলে উঠল, “তোমার ভূত বাছাধনেরা গেল কোথায়? নাকি ভূতও
নেই তোমাদের এখানে?”
বলতে না বলতে সামনের ঝোপে ধপাস
করে আওয়াজ হল। সুবোধ ‘ভৌ ভৌ’ করে চেঁচিয়ে উঠল। “কে? কে?”
“এই যে আমি, অহেতুক।”
“অহেতুক? অদ্ভুত নাম
তো!” বলাই
সুবোধকে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল।
“ভূতেদের নাম ওরকমই হয়। আমাদের
মতো নাম হলে ওদের চলে না। বাজে বাজে শব্দ
দিয়ে ওদের নাম হতে হয়। যেমন ধর ‘হতচ্ছাড়ি’, ‘বিদঘুটে’, ‘লক্ষ্মীছাড়া’
– এইরকম আর কী।”
এতক্ষণে অহেতুক লম্বা লম্বা পা
ফেলে ওদের অনেক কাছে এসে গেছে।
সুবোধ বলে ওঠে, “গাছ থেকে পড়লে
কী করে?”
“আর বোলো না। গাছের ডালে বসে
টপ্পা গাইতে গাইতে একটু পা দোলাচ্ছিলাম, হঠাৎ কোন ব্যাটা ‘ভূত’ বলে উঠল। ভয়ে
আঁতকে উঠে নিচে পড়লাম।”
“তা তুমি তো নিজেই ভূত। তোমার
আবার ভূতের ভয় কী?”
বলাই বলে উঠল।
“বাহ্, বেশ বলেছ তো। ভূতেদের
বুঝি ভূতের ভয় থাকে না?
মানুষেরা তো মানুষকেই সবথেকে বেশি ভয় পায়।”
এবার সুবোধ বলাইয়ের দিকে তাকিয়ে
বলল, “নাও,
জিজ্ঞেস কর যা জিজ্ঞেস করার আছে।” তারপর অহেতুকের
দিকে তাকিয়ে বলল, “ও,
পরিচয় করিয়ে দিই। ও হল আমাদের রাজপুত্র। এখানে
যুদ্ধ বাধতে পারে শুনেছ নিশ্চয়ই? তা সে ব্যাপারেই ও তোমার সঙ্গে কথা বলবে। তোমার
মতো সাহসী লোকদের আমাদের খুব দরকার।”
অহেতুকের মুখে গর্বের হাসি ফুটে
ওঠে, “হ্যাঁ,
তা আর বলতে। আর তাছাড়া দেশের জন্য আমরা যতবার ইচ্ছে
প্রাণ দিতে পারি। ভয় দেখানোর নানান কায়দা আমার জানা আছে। এক মাইল
দূর থেকে গাছের ডাল, ফল, ইট-পাথর ছুড়ে
মারতে পারি। ফুঁ দিয়ে ঝড় তুলতে পারি। হাত
লম্বা করে কান মুলতে পারি। দরকারমতো
আমাদের জানালেই হল। দলবল নিয়ে হাজির হব। আর কাঁহাতক
ভালো লাগে গাছে বসে বসে শুধু পা দোলাতে। এরকম
একটা যুদ্ধটুদ্ধ হলে বেশ ভালো হয়। আমাদেরও
একটু মানসম্মান বাড়ে। আর এ-পক্ষ ও-পক্ষ যে পক্ষই হোক
না কেন, যুদ্ধে
মরলে তো আমাদেরই লাভ। আমাদের দল বাড়ে।”
অহেতুকের সঙ্গে কথা বলে বেশ একটু
ভরসা পেল বলাই। এরকম সাহসী, দেশপ্রেমী ভূত
পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
বলাই পরের দু-তিনদিনে আরও বেশ
কিছু নতুন নতুন জিনিস দেখল। স্কুলে
সে যদিও কোনওদিন যায়নি, কিন্তু স্কুল সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল অন্যরকম। মোটা
মোটা বই নিয়ে পড়তে যেতে হবে। রাগী
রাগী স্যারেরা চোখে চশমা পরে পড়াবেন। কিন্তু
সুবোধ ওকে যেখানে স্কুল দেখাতে নিয়ে গেল, সেখানে কোনও বাড়িঘর নেই। খোলা
মাঠ। পর পর অনেকগুলো কমবয়সী ছেলে মাঠে গাছ
লাগাচ্ছে। আরেকজন বয়স্ক লোক একটা আলু হাতে কীসব
বলে যাচ্ছে। এটাও নাকি স্কুলের ক্লাস।
এ ব্যাপারে বলাই সুবোধকে বিশ্বাস
করেনি। কী দেখাতে কী দেখিয়েছে কে জানে।
সেদিন দুপুরের দিকে বলাই হাঁটতে
হাঁটতে বেশ খানিকটা দূরেই এসে পড়েছিল। ছবির
মতো গ্রাম, ছবির
মতো লোকজন। সবসময় সবাই আনন্দে কাটায়। কোনও
চিন্তা নেই, ভাবনা
নেই।
একটা পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে শালুক
আর কচুরিপানা দেখছিল বলাই। হঠাৎ
বিশাল চেহারার তিনটে লোক কাঁটাঝোপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল।
“এই যে খোকা, কী করছ এখানে?” ওদের মধ্যে
যার গোঁফটা সবথেকে বড়ো, সে বলে উঠল।
বলাই থতমত খেয়ে গেলেও সামলে উঠে
বলল, “তা
আপনারা কী করছেন ঝোপের মধ্যে?”
“এই যে ঝোপ দেখছিলাম আর ঝোপের
মধ্যে লুকোচুরি খেলছিলাম। তা তুমি কি নিশ্চিন্তপুরের
বাসিন্দা?”
“না না, নিশ্চিন্তপুরে
থাকব কেন? থাকি
জগদ্দলপুরে। শুনলাম, এখানে নাকি যুদ্ধ হতে চলেছে। তাই
দেখতে এলাম। যুদ্ধ তো আর সহজে দেখা যায় না।”
“হ্যাঁ, তা বটে, তা বটে। তা যুদ্ধের
কথাটা শুনলে কোত্থেকে?”
“সেটা কেই বা না জানে। এই তো
কাল বাদে পরশুই নিশ্চিন্তপুরের রাজা পরাক্রমপুর আক্রমণ করবে। সেখানে
নাকি লোকে যুদ্ধ করতেই জানে না।”
“অ্যাঁ! কী? কী বললে? নিশ্চিন্তপুর
পরাক্রমপুরকে আক্রমণ করবে?
ঠিক শুনেছ?”
“ঠিক শুনেছি মানে? চোখের সামনে
দেখতে পাচ্ছি সারাক্ষণ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। কত সৈন্য, কত অস্ত্রশস্ত্র!
জগদ্দলপুরও তো সৈন্যসামন্ত দিয়ে সাহায্য করছে। শুনেছি
ওখান থেকে বাঘা বাঘা সৈন্য এখানকার আর্মিতে এসে ঢুকেছে।”
লোক তিনটে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি
করল। পাশের থ্যাবড়া নাকওয়ালা লোকটা বলে উঠল, “কিন্তু শুনেছিলাম
যে নিশ্চিন্তপুরে সৈন্যই নেই, রাজা নাকি যুদ্ধই করতে জানে না।”
“আরে, ওসব রটনা। রাজা
তো খেতেও বসে তরবারি নিয়ে। রান্না
খারাপ হলে ঘ্যাচাং করে রাঁধুনির মাথা কেটে নেয়। তবে
হ্যাঁ, সৈন্য
মানে সব সৈন্য তো আর সাধারণ সৈন্য নয়।”
“মানে?”
“মানে আর কী? নিশ্চিন্তপুরের
লোকে মরার পর সৈন্যদলে নাম লেখায়। ভূতপ্রেত
নিয়ে তৈরি সৈন্যদল। মানুষেরা সেনাবাহিনীতে ভালো র্যাঙ্কে
চান্সই পায় না। কোনও গোলাগুলিও চলে না। রাজা
একবার চোখের ইশারা করলেই হল। গ্রাম
কে গ্রাম ভূতের দল ফিনিশ করে দেবে।”
“এ তো বড়ো সাংঘাতিক কান্ড!” লোকগুলোর কপালে
ভাঁজ পড়ে। একজন আবার ধুতির খুঁটে কপালের ঘাম মোছে।
“তা শোনো ভাই, এই টাকাগুলো
তোমার কাছে রাখ। তোমাকে দেখে বেশ কাজের ছেলে মনে হয়। আমাদের
একটু খবর জোগাড় করে দিতে হবে। এই ধর, কী কী ধরনের
ভূত আছে, সংখ্যায়
কত, কীভাবে
আক্রমণ করে, কামড়ে
দেয়, না ঘাড় মটকায় ইত্যাদি। ভূতেদের
কোনও দুর্বলতা আছে কি না। মানে, ঘুষ খায়
কি না। আমরা হলাম পরাক্রমপুরের গুপ্তচর। আমাদের
রাজাকে গিয়ে এসব জানাতে হবে।”
বলাই একগাল হেসে নেয়। তারপর
আবার বলে ওঠে, “নাহ্, আজ সকাল থেকে আমার ভাগ্যটা বেশ ভালোই যাচ্ছে। সকালে
ওরাও একগাদা টাকা দিল।”
“কারা আবার টাকা দিল?”
“কেন, ওই ভূতগুলো। নিশ্চিন্তপুরে
খাবারের খুব আকাল পড়েছে না? সাধে ওরা পরাক্রমপুর আক্রমণ করছে? তাই
ওরাই তো পাঠাল খাবার জন্য লোক জোগাড় করতে। আপনাদের
গাঁট্টাগোট্টা চেহারা দেখে বড়োই খুশি হবে। জমিয়ে রেখে
বেশ কয়েকদিন ধরে আয়েশ করে খেতে পারবে।”
“কী?” লোকগুলো ছিটকে
বলাইয়ের থেকে দূরে সরে আসে। ছুটতে
শুরু করে উলটোদিকে, পরাক্রমপুরের
দিকে। আর অমনি বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ঝড় ওঠে। বাতাসে
ওদের লক্ষ করে ঝুনো নারকোল ভেসে আসে। কে যেন
ওদের ওপর টিপ প্র্যাকটিস করছে। এ নির্ঘাত
অহেতুকের কাজ। চোখের নিমেষে লোক তিনটে কোথায় উধাও হয়ে
যায়।
অহেতুক অবশ্য ওদের বেশি আহত করেনি। ওরাই
তো পরাক্রমপুরে গিয়ে সব খবর জানাবে, তাই না? তবে ওদের মুখে এসব কথা শুনলে পরাক্রমপুরের
রাজা আর নিশ্চিন্তপুরের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাবে না।
সুবোধ এর মধ্যে কখন হাজির হয়েছে
কে জানে। এসব দেখে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে হাসছিল। সুবোধ
হাসি সামলে বলে ওঠে, “নাহ্, তোমার বুদ্ধি
আছে বটে! দেখে
যতটা বোকা মনে হয় ততটা নও। ওরা
আর কোনওদিন ভয়ে এদিকে পা বাড়াবে না।”
“তা এটা তো খালি আমার কৃতিত্ব
নয়। ভাগ্যিস অহেতুক ঠিক সময়ে হাজির হয়ে নারকেল
ছুড়তে পেরেছিল।”
“অহেতুক! ওর কথা আর বোলো না। ও এখানে
এসে হাজির হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু
যেই তুমি ভূতের কথা বললে,
ভয়ে ডাল ভেঙে নিচে এসে পড়ল। এখনও
চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে। দেখি, কানের
কাছে রামনাম করে যদি জ্ঞান ফেরানো যায়।”
“তাহলে নারকেল ছুড়ল কে?”
“কেন, আমাদের বাঁদর-হনুমানের
দল। তারা এসব ব্যাপারে এক্সপার্ট। তুমি
চল, তোমার
ভাগ্য খুলে গেছে। রাজামশাই আগেই বলেছিলেন যে, যে এরকম বিপদ
থেকে নিশ্চিন্তপুরকে বাঁচাতে পারবে সে পাবে রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব।”
“এহ্, রাজকন্যা! ওই তো পুঁচকে
মেয়ে পল্লবী। যা দেখতে, কেউ বিয়েই করবে
না। আর অর্ধেক রাজত্ব! আছে তো খালি
বাঁশবন, পচা
ডোবা আর ঝোপঝাড়। অজ গাঁ।”
“এই, অজ গাঁ বলবে
না। আছে তোমাদের এরকম টলমলে দীঘির জল, গণেশের মতো
পণ্ডিত, আমাদের
রাজার মতো রাজা?”
তর্কাতর্কি করতে করতে ওরা ফিরে
চলল রাজবাড়ির দিকে।
*
* *
সকাল আটটা। বৃষ্টি
থেমে গেছে। এখনও মেঘলা। আরও
দু-এক পশলা বৃষ্টি হতে পারে। শ্যামেদের
বাড়ির সিঁড়ি ঘিরে বেজায় ভিড়। হাঁটুজল
অগ্রাহ্য করে কোত্থেকে যেন জনাতিরিশ লোক হঠাৎ করে জড়ো হয়েছে। মহাদেবের
দোকানে সিঙ্গাড়া কিনতে এসে লোকে এদিকে ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছে। একটা
চাপা গুঞ্জন। ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ। এরই
মধ্যে মাঝে মধ্যে হঠাৎ সবার কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে এক মহিলার কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। “বাবু,
একবারটি কথা বল। চোখ খোল। এই যে আমি তোর মা এসে গেছি, একবারটি কথা
বল!”
বলাই সাড়া দেয় না। বলাইয়ের
মুখে হাসির ছোঁয়া। এরা তো জানে না যে সে এখন নিশ্চিন্তপুরের
রাজপুত্র। সে এক রূপকথার রাজ্যের সন্ধান পেয়ে
গেছে। অতসব ছেড়ে আর কি সে এই অভাবের রাজ্যে ফিরে আসে!
_____