ভালো টিয়া
জলি
নন্দী ঘোষ
সে
এক হিংসুটে, বজ্জাত, কুৎসিত মেয়ে আর এক ভালো, উপকারী টিয়াপাখির গল্প। অনেকদিন আগে
তারা থাকত এক গ্রামে। সে গ্রামের নাম ‘সবুজ গ্রাম’। চারদিক তার সবুজে সবুজ -
হরেকরকমের গাছগাছালি, ধানক্ষেত, গমক্ষেত, বাঁশঝাড়। সে গ্রামে ছিল না কোনও হাজা-মজা
ডোবা। গ্রামের দক্ষিণে বয়ে যেত স্বচ্ছতোয়া ‘সবজে’ নদী। কুলকুল করে। সারাবছর তাতে
থাকত ডুবজল। গ্রামের লোকেরা নৌকা বেয়ে ওপারে যেত গঞ্জের হাটে, বদ্যি ডাকতে, আরও কত
কী কাজে। অলস সময়ে পানকৌড়ি ডুবত-ভাসত টুপ টুপ। আর ওই দূরে, যেদিকে নৌকা-ডিঙি কিংবা
মেছোজালের ছায়াও পড়ে না, সেখানে আলো হয়ে ফুটে থাকত দুধসাদা পদ্মফুল।
সবজে
নদীতে খেয়া বায় পানুমাঝি। নদী-পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরে বিষ্টুজেলে। গোবর কুড়িয়ে
ঘুঁটে দেয়, ন্যাড়া বানায় ঘুঁটেপিসি। খেতখামারে ফসল ফলায় মদনচাষা। দিন আসে দিন যায়। সবুজ
গ্রামের লোকেরা ভালোয়-মন্দয়, অভাবে- অভিযোগে, আলোয়-কালোয় দিন কাটায়। মনে সুখ আর
শান্তি অটুট তাদের।
গ্রামের
একপ্রান্তে টলটলে এক পুকুরের ধারে বিশাল এক নিমগাছ। যেমন উঁচু তেমনই ঝাঁকড়া।
গ্রামের লোকে বলে মহানিমগাছ। তারই তলায় যে একচালা খড়-ছাওয়া মাটির বাড়িখানা, সেখানেই
থাকে ওই হিংসুটে মেয়ে। আর মহানিমের খুব উঁচু এক মোটা ডালের কোটরে ওই বুড়ো টিয়ার
বাস। অনেক বছর ধরে। তার ছানাপোনারা সব উড়ে গেছে। অন্য গাছে সংসার পেতেছে। ওই বুড়ো
টিয়া তার এত কালের বসত-গাছের মায়া কাটিয়ে কোত্থাও নড়তে পারেনি।
হিংসুটে
মেয়েটির নাম ময়না। বয়স বছর দশেক। বাবা-মা কেউ ছিল না তার। এক ঝড়বাদলের রাতে ঘরের
চাল ফুঁড়ে বাজ পড়ে মারা যায় তার বাবা-মা দু’জনেই। দৈবক্রমে বেঁচে যায় মেয়েটি।
মায়ের বোন মাসি তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। তার নিজের কোনও ছেলেপুলে ছিল না। দুঃখের কথা
হল, ময়নার মাসি ছিল বেজায় বদ স্বভাবের এক মহিলা। কারও সঙ্গে সে মিশত না। কারও ভালো
চাইত না। গ্রামের একটেরে ওই বাড়িতে সে থাকত একঘরের মতন। সে ময়নাকে শেখাল, “আমি আর
মেসো ছাড়া তোর আর কেউ আপন নেই জানবি।”
ময়না
বলল, “তাই জানলাম।”
মাসি
বলল, “এও জেনে রাখ, আমি আর মেসো ছাড়া পৃথিবীতে তোর ভালো কেউ চায় না। সবাই তোর
ক্ষতি করতে এক-পা বাড়িয়েই আছে সর্বদা।”
ময়না
বলল, “ও, তাই বুঝি!”
মাসি
বলল, “হুম। আমি আর মেসো ছাড়া সবাই তোর শত্রু। মনে রাখবি, লোকে তোর ক্ষতি করতে চায়।
তাই তুই কখনও কারও ভালো করবি না; কাউকে বন্ধু ভাববি না।”
মেয়েটি
মাথা নেড়ে বলল, “বাবা রে, কী ভয়ংকর! আমি সাবধান থাকব। যেমনটি বললে, ঠিক তেমনটিই
চলব।”
এমনি
করে মাসির কুশিক্ষা পেয়ে দিনে দিনে ময়না হয়ে উঠল সেরা হিংসুটে আর কুৎসিত মনের
মেয়ে। মেসো লোকটা মন্দ নয়। তবে বউয়ের বদ বুদ্ধির সঙ্গে সে এঁটে উঠত না কোনওমতেই।
মহানিমগাছের
বুড়ো টিয়ার বয়স হয়েছে। আজকাল আর তেমন উড়তে-ফিরতে পারে না সে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা,
আর ডানার জোরও আসছিল কমে। গাছের কোটরে নিজের বাসায় শুয়ে-ঘুমিয়ে কাটত তার বেশিরভাগ সময়। শুধু খিদে
পেলেই সে বেরিয়ে আসত; গাছের গা জড়িয়ে লতিয়ে ওঠা তেলাকুচোর লাল টুকটুকে ফল ঠুকরে খেত।
তার ওপর চোখের সামনে ময়না আর তার মাসির হিংসুটে কান্ডকারখানা দেখতে দেখতে তার মনটা
দুঃখে ভারী হয়ে আসত। সে ভাবত, ‘হা ঈশ্বর, মানুষ এমন কুৎসিত আর ভয়ংকর হয়! এই মানুষই
নাকি ভগবানের গড়া শ্রেষ্ঠ জীব!’
বুড়ো
টিয়ার মন খুব ভালো। জ্ঞানবুদ্ধিও ভালো। সে ভাবত, যদি সে কোনওভাবে দুটো ভালো বুদ্ধির কথা ওদের কানে তুলতে
পারত, বেশ হত। কিন্তু সামান্য এক পাখি সে। কী সাধ্য তার!
শুধুই
কি ভালো বুদ্ধি? বুড়ো টিয়ার আরও এক গুণ ছিল। মানুষের ভাষায় অবিকল মানুষের গলায় সে
কথা বলতে পারত। গাছের ওপর বসে এ-বাড়ির লোকজনের কথা শুনতে শুনতে তাদের মতো কথা বলার
কায়দা সে রপ্ত করে ফেলেছিল। একথা অবশ্য কেউ জানত না। মাঝে মাঝে যখন মাসি-বোনঝি
মিলে হিংসে-কথার ফুলঝুরি ফোটাত, মাথার উপর বসে সেকথা শুনে অসহ্য লাগত বুড়ো টিয়ার।
ডালের উপর বসেই সে মানুষের গলায় বলে উঠত, “ক্রিঁ ক্রিঁ—একি একি–ছিঃ ছিঃ!”
চমকে
উঠে ময়না আর তার মাসি এদিক ওদিক তাকাত। “কে রে? কে?” করে ছুট্টে যেত উঠোনের দিকে। তারপর কাউকে
দেখতে না পেয়ে অদৃশ্য আর কাল্পনিক এক শত্রুর প্রতি ঝুড়ি ঝুড়ি গালমন্দ আর শাপশাপান্ত
করে তবে থামত। বেশ মজা পেত বুড়ো টিয়া তখন। হাসত, “ক্র্যাঁ ক্র্যাঁ—হ্যাঃ হ্যাঃ–আচ্ছা
বোকা।”
দিন
যায়, মাস যায়। বছর যায়। ময়না আরও হিংসুটে হয়ে ওঠে। আর তা দেখেশুনে বুড়ো টিয়ার মন
আরও ভারী হয়ে ওঠে।
গ্রামের
সব ছেলেমেয়েরাই কোঁচড়ে মুড়ি-বাতাসা বেঁধে বই-শেলেট বগলে নিয়ে পাঠশালায় যায়। ময়না
পাঠশালা যাবার বায়না ধরলে তার মাসি বলল, “পাঠশালায় গিয়ে কাজ নেই। সেখানে
পণ্ডিতমশাই লেখাপড়া শেখাবার ছল করে ছেলেমেয়েদের মাথায় চাট্টি ভেড়া হবার বুদ্ধি
গুঁজে দেয়। যে একবার ওই বুদ্ধির খপ্পরে পড়বে, সারাজীবন সে ম্যাঁ-ম্যাঁ করে ঘুরে
বেড়াবে।”
ময়না
ভাবল, ‘তাই তো! ভেড়া হয়ে কাজ কী? দিব্যি দু’হাত-পাওয়ালা মানুষ আছি।’
লেখাপড়ার
পথ বন্ধ হল তার। বুড়ো টিয়ার মনে ভারি দুঃখ হল ময়নার জন্য।
বয়স
বাড়ছিল বুড়ো টিয়ার। কিছুটি খেলে তা হজম হতে চাইত না চট করে আজকাল। তাই সে খাবার
খেত খুব অল্প।
এক
গরমের দুপুরে বুড়ো টিয়ার শরীরটা ভালো লাগছিল না মোটেই। কোটরে বন্দি হয়ে থাকতেও
ভালো লাগছিল না। রোদ একটু পড়তে বাসা থেকে
বেরিয়ে সে বসেছিল পুকুরধারে মহানিমের ঝোলা ডালে। ফুরফুর করে বেশ হাওয়া
দিচ্ছিল। আর তির তির করে কাঁপছিল পুকুরের জল। বিষ্টুজেলে এক পাশে কোমর
জলে নেমে মাছধরার জোংরাখানা পেতে রাখছিল জায়গা বুঝে। এদিকে গাছের ছায়ায় উঠোনে খোপ কেটে কিৎ কিৎ খেলছিল ময়না, একলাই।
ঠাণ্ডা
হাওয়া গায়ে এসে লাগতেই হঠাৎ মন ভালো হয়ে গেল বুড়োটিয়ার। মনের সঙ্গে খিদের নিবিড়
সম্পর্ক। মন ভালো লাগতেই তার পেটের খিদে চনমন করে উঠল। ঘাড় বেঁকিয়ে
এদিক ওদিক তাকিয়ে ‘কী খাই, কী খাই’ ভাবল সে দু’বার। হঠাৎই চোখে পড়ল, ময়নাদের উঠোনের
এক ধারে এক কুলোভর্তি লঙ্কা শুকোতে দেওয়া আছে। অমন লাল টুকটুকে টোপা লঙ্কা দেখে
একটু লোভই হল বুড়ো টিয়ার। তাছাড়া সে সকাল থেকে উপোসীও। ভাবল, একটা
লঙ্কা বৈ তো নয়। ওদের অনেক আছে। এই না ভেবে সে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল নিচে। উঠোনে একটা
সরেস লাল লঙ্কা ঠোঁটে নিয়েছে কি নেয়নি, হুশ হুশ করে তেড়ে এল ময়না। আসলে কিৎ কিৎ খেলার
বাহানায় সে লঙ্কা পাহারা দিচ্ছিল। মাসির আদেশে।
বুড়ো
টিয়া ঠোঁটের ফাঁকে লঙ্কাটা চেপে ধরে সুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে বসল নিমগাছের ডালে। খেয়াল
করেনি। সে আসলে বসেছিল তেলাকুচো লতার ওপর। লঙ্কাটা ডালের ওপর রেখে আয়েশি একখানা
ঠোক্কর দিয়েছে কি দেয়নি হঠাৎ সড়সড়... খচখচ...হ্যাঁচোড়...প্যাঁচোড়। কিছু বোঝার আগেই
সে ঝুপ করে গিয়ে পড়ল পাশে ঝোপের ওপর। চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখতে পেল, লতাগাছটাকে
টেনে হাতের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছে ময়না। তারপর বিষ্টুজেলের জাল গোটানোর
কায়দায় মেরেছে হ্যাঁচকা টান। বুড়ো টিয়াসুদ্ধু উপড়ে এসেছে লতাগাছ আর ডিগবাজি খেয়ে
বুড়ো টিয়া পড়েছে ঝোপের ওপর। মুহূর্তের জন্য চোখে অন্ধকার দেখল সে। তারপরই ঝট করে
উড়ে গিয়ে বসল মহানিমের ডালে। ময়না কোমরে হাত দিয়ে গাছের তলায়। বুড়ো টিয়া ভাবল,
ময়না তো আর ময়না পাখি নয় যে গাছে উড়ে এসে তাকে ধরবে। লম্বা শ্বাস টেনে দম নেয় সে।
কিন্তু কী কাণ্ড! ময়না তরতর করে উঠতে লাগল গাছ বেয়ে। অত সোজা নাকি! বুড়ো হলেও টিয়া
হল পাখির জাত। বিপদ বুঝে এক-দুই–তিন লাফে উঠে যায় আরও উঁচুডালে। কিছুদূর উঠে মোটা
একটা ডালে বসে পড়ে ময়না। নিষ্ফল আক্রোশে হাত বাড়ায়, হাঁপাতে থাকে। তা দেখে রাগ হয়
না বুড়ো টিয়ার। মায়া হয়। মানুষের গলায় বলে ওঠে, “ক্র্যাঁ ক্র্যাঁ, আহা রে, অমন
হাঁপাচ্ছ কেন! কষ্ট হচ্ছে বুঝি?”
“ক্কে,
কে বলল একথা!” এদিক ওদিক তাকায় ময়না।
“আমি
গো ময়নারানি। ওপরে তাকাও, দেখতে পাবে।”
“ক্কী,
ক্কী!” ময়নার তো গাছ থেকে পড়ে যাবার জোগাড়, “তুই! হতচ্ছাড়া টিয়া, তাহলে তুইই ফোড়ন
কাটিস রোজ মানুষের গলায় কথা বলে! দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা তোর! আর ওসব রানি-ফানিও বলবি
না আমাকে, বুঝলি?”
টিয়া
বলল, “ছিঃ ময়না, বড়োদের সঙ্গে তুই করে কথা বলতে হয় না, সামান্য এইটুকু তুমি
শেখোনি? আমার বয়স কত জান? তোমার মেসোকে আমি জন্মাতে দেখেছি গো!”
“চুপ
কর, ঝিংগুটে টিয়া কোথাকার! ধরতে পারি একবার, আছড়ে মারব তোকে আজ।”
দুঃখ
হয় বুড়ো টিয়ার। কেন যে এত হিংসা মেয়েটার! সে বলে, “এত হিংসে কেন তোমার মনে? অন্যের
ক্ষতি করায় কোনও সুখ নেই জেনো। অন্যকে ভালোবাসাই হল মানুষের আসল ধর্ম।”
“যা যা,
জ্ঞানের হরির লুট অন্য কোথাও দে গে, যা।” দাঁত খিঁচিয়ে বলল ময়না।
বুড়ো
টিয়া বলে চলে, “বাচ্চা মেয়ে তুমি। এমন কুৎসিত দেখতে কেন তোমায়? মনের খারাপ ভাবনা
ছাপ ফেলেছে তোমার চেহারায়। দেখেছ কখনও নিজের মুখখানা আরশিতে?”
“মোটেই
না। বিচ্ছিরি তুই, আমি নই।” ঠোঁট ভেংচে বলল ময়না।
হাসল
বুড়ো টিয়া, “সে তো আমি বুড়ো হয়েছি বলে। গা থেকে পালক ঝরে গেছে, গায়ের ঘন সবুজ রং
হয়েছে ফিকে। আমি তো সত্যিই বিচ্ছিরি।”
থমকে
যায় ময়না। নিজের খারাপ গুণের কথা এই প্রথম সে কাউকে বলতে শুনল! তবে সে দমবার
পাত্রী নয়। জুতসই কোনও কথা খুঁজে না পেয়ে তেড়েফুঁড়ে বলল, “ওসব ছাড়। বল এখন, কেন তুই
লঙ্কা চুরি করে খেলি?”
টিয়া
ভাবল, তা ঠিক, না বলে অন্যর জিনিস নেওয়াটাকে চুরি বলে বটে। বলল, “অন্যায় হয়েছে
আমার। তবে কি জানো, লঙ্কার গাদা থেকে একটিমাত্র লঙ্কাই নিয়েছিলাম। হঠাৎ খুব খিদে
পেয়েছিল তাই। ভাবলাম, আমিও তো এ-বাড়ির একজন হই। তা-আ, দু’কুড়ি বছরেরও বেশি হয়ে গেল
এই গাছে আমার বাস।”
ময়না
বলল, “থাম তো! কেউ না তুই আমাদের। কোনও লোক, কোনও পশু কি পক্ষী কেউ আমাদের আপন নয়। সব শত্তুর।”
বুড়ো
টিয়া বলল, “এ সবই তোমার মাসির কুশিক্ষার ফল। শোনো তবে। তুমি যে মদনচাষার ক্ষেতের বেড়া টপকে ভোরবেলা কচি
শশাটা, মুলোটা, বেগুনটা ছিঁড়ে আনো, বিষ্টু জেলের জোংরা ঘেঁটে এই যে সেদিন মস্ত বড়ো
কালবোস মাছ তুলে আনলে, মায় গরিব মানুষ ঘুঁটেপিসির ঝুড়ি থেকে খাবলা মেরে ঘুঁটে চুরি
করে এনে মাসির রান্নাঘরে ডাঁই কর – এইসব কথা আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি। ওই
মগডালে থাকি, সব দেখতে পাই। তোমার শত্তুরই যদি আমি হতাম, এইসব কথা কবেই ওদের কানে
তুলে দিতাম। বুঝলে? ক্রেঁ ক্রেঁ।”
হাঁ
করে শুনছিল ময়না। বলে কি বুড়ো টিয়া? সব জানে সে, তাও বলেনি কাউকে! “ত...
ত...” করে সে বলল, “তা-তা, দিসনি কেন তুলে ওদের কানে?”
“তোমায়
ভালোবাসি বলে। ভেবেছি ছোটোটি আছ, বুদ্ধি হয়নি, ভুল করছ, বড়ো হলে ভুল শুধরে নেবে
ঠিক।”
“চুপ,
চুপ। কেউ আমায় ভালোবাসে না। কেউ না।” ঝুপ করে গাছ থেকে
লাফিয়ে নেমে পুকুরপাড়ের দিকে দৌড় লাগায় ময়না।
তারপর
ময়নার একদিন খুব জ্বর হল। রাতদিন জ্বরে তার গা পুড়ে যায়। মাসি তার পায়ের তলায়
রসুন-তেল গরম করে মালিশ করল, কপালে জলপটি লাগাল, তবুও জ্বর কিছুতেই ছাড়ে না।
সেদিন
সকাল থেকেই ময়না জ্বরে প্রায় বেহুঁশ। মেসো গেছে দূর খামারে, ধান মারাইয়ের কাজে।
দুপুরবেলা মাসি ঘরের দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে বাড়ি থেকে বেরোল নদীর ওপারে গঞ্জে
বদ্যি ডাকতে যাবার জন্য। পুকুরের দিক থেকে বয়ে আসা কনকনে ঠাণ্ডা শীতের হাওয়া
কোটরের মধ্যে ঢুকে বুড়ো টিয়ার পাঁজরে বিঁধছিল যেন। বেরিয়ে এসে ডালের ওপর বসে রোদ
পোয়াচ্ছিল সে। ময়নার জন্য খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তার। মনে মনে ঠাকুরকে ডাকল সে। হঠাৎই
তার নাকে এসে ঝাপটা মারল কেমন একটা পোড়া পোড়া গন্ধ। যেদিকে গন্ধ
সেদিকে চোখ ঘোরাতেই সে দেখতে পেল, ময়নাদের চালাঘরের ওপরটা ধোঁয়ায় সাদাটে হয়ে গেছে। গব গব করে ধোঁয়া উঠছে চাল ফুঁড়ে। নিমেষে বুড়ো টিয়া বুঝে যায় ঘটনা কী। আগুন লেগেছে ময়নাদের বাড়িতে। কালচে জমাট ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে; ছড়িয়ে যাচ্ছে আকাশে, জমছে ধোঁয়ার মেঘ। সম্ভবত দাওয়ার উনুন থেকেই ছড়িয়েছে আগুন। শীতের শুকনো হাওয়ায় দাউ দাউ করে জ্বলছিল আগুনের লেলিহান শিখা। ময়না ঘরের মধ্যেই শুয়ে আছে। হয়তো জ্বরে বেহুঁশ। কথাটা খেয়াল হতেই বুকটা ধক
করে উঠল বুড়ো টিয়ার। কী করবে সে এখন! কী উপায়ে বাঁচাবে সে ময়নাকে? দিশেহারা বুড়ো
টিয়া উড়ে গেল বেশ উঁচুতে। উড়তে লাগল আর প্রাণপণ চিৎকার করতে লাগল। “ক্রাঁও ক্রাঁও, বাঁচাও, বাঁচাও... আগুন লেগেছে ময়নাদের
বাড়িতে... ক্রোঁ, ক্রোঁ, সব্বাই শিগগির এস!”
উড়তে
লাগল আর বলতে থাকল। বুড়ো টিয়ার ডানা ব্যথা
করতে লাগল, ধোঁয়ার চোটে চোখ জ্বালা করতে লাগল, মুখে, গলায়, পেটে ধোঁয়া ঢুকে দম
বন্ধ হবার জোগাড় হল। তবুও সে থামল না। ময়নাকে যে বাঁচাতেই হবে!
বিষ্টুজেলে
মাছ ধরছিল পুকুরে। তার কানে গেল ‘আগুন’। জাল ফেলে দিয়ে ছোটো ডিঙিতে জল ভরে নিয়ে কাঁধে
তুলে সে দৌড়ল। মদনচাষা ক্ষেতের কাজ ফেলে, পানুমাঝি খেয়াঘাট ছেড়ে,
ঘুঁটেপিসি গোবরমাখা হাতেই ছুটল। গ্রামের যে যেখানে ছিল
দৌড়ে এল। যার কানে গেল ‘আগুন’, হাড়ি-কলসি-বদনা-ঘটি হাতের কাছে যে যা পেল তাতে করে
জল ভরে ছুট লাগাল ময়নাদের বাড়ি। জল ঢেলে নেভাতে লাগল আগুন। ওদিকে মাথার
ওপর বুড়ো টিয়া তখনও চিৎকার করে চলেছে, “ময়নাকে বাঁচাও... ক্র্যাঁও... ক্র্যাঁও...”
লোকে
বুঝল, ময়না ঘরের ভিতর। আগুনের মধ্যে ঢুকে তারা বের করে আনল ময়নাকে। শুইয়ে দিল গাছতলায়।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বুড়ো টিয়া। চোখে মুখে জলের ছিটে দিতে চোখ তুলে তাকাল ময়না। লোকে তাকে
বলল, “জোর বাঁচা বেঁচে গেলি রে ময়না। সময়ে খবর না পেলে কী যে হত আজ!”
ময়না
আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল, “খবরটা দিল কে?”
ভিড়ের
মধ্যে গুনগুন, “কে দিল? কে খবর দিল?”
কেউ
বলতে পারল না ঠিক। তবে অনেকেই বলল, খুব মিহি গলায় কেউ একজন চিৎকার করে লোক জড়ো
করেছে। আসল ঘটনা বুঝতে ময়নার একমুহূর্তও দেরি লাগল না। নিশ্চয়ই বুড়ো টিয়া আগুনের
খবর সবাইকে জানিয়েছে। তার প্রাণ বাঁচিয়েছে। কিন্তু সে কোথায়?
ততক্ষণে
আগুন শান্ত হয়েছে। ময়নার মাসি-মেসোও ঘরে ফিরেছে। কিন্তু ময়না অস্থির হয়ে
খুঁজতে লাগল বুড়ো টিয়াকে। গাছের ওপর সে নেই। হঠাৎ ময়নার নজর গেল কাঁটাঝোপের দিকে।
দৌড়ে গিয়ে সে দেখে, বুড়ো টিয়া নিথর হয়ে পড়ে আছে ঝোপের ওপর। পরম যত্নে তাকে দু’হাত
দিয়ে তুলে নেয় ময়না। আলতো করে বুকে চেপে ধরে। এই প্রথম অন্য কারও জন্য কষ্ট হয়
ময়নার ছোট্ট বুকে। টপ টপ করে তার চোখ দিয়ে ঝরে পড়ে জল। সে জল বুড়ো টিয়ার গায়ে-মাথায়
পড়তেই চোখ তুলে তাকায় সে। শুকনো গলায় খুব কষ্টে বলে, “বোকা মেয়ে। কাঁদছ কেন?
দ্যাখো, গ্রামের সব লোক আজ তোমাদের বাড়িতে। ওরা তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। ওরা তোমাকে কত ভালোবাসে। ওরা সবাই খুব ভালো।”
ময়না
বুড়ো টিয়ার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে, “বুঝতে পেরেছি আমি, সবাই ভালো, কেউই
খারাপ নয়। শুধু আমিই এতদিন তা জানতাম না। তবে সবচে’ ভালো তুমি বুড়ো টিয়া...
না না, ভালো টিয়া।”
সেই
থেকে ভালো টিয়া আর ময়না হয়ে গেল খুব বন্ধু। আর ময়না হয়ে উঠল এক লক্ষ্মী মেয়ে।
-----
অলঙ্করণঃ
সুজাতা চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment