গল্পের ম্যাজিক:: অপেক্ষা - প্রতিম দাস


অপেক্ষা
প্রতিম দাস

বাড়িটা রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে মিনিট খানেকের দূরত্বে। চারকাঠা জমি সস্তায় পেয়ে যখন বাড়িটা করেছিলেন তখন চারপাশটা খা খা করতএখন জমজমাট। নিজেদের বাড়ি ছিল না মিঃ মজুমদারদের। সামান্য মুদির দোকানে কাজ করে বাড়ি বানাতে পারেননি ওঁর বাবা। তবে কষ্ট সহ্য করে ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার ফল ভোগ করে গেছেন জীবনের শেষ কয়েকটা বছরেছেলের বানানো বাড়িতে থেকে সুখেই দিন কাটিয়েছেন।
এ পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে যায় যার কোনও ব্যাখ্যা মেলে না। সাধারণ মানুষ তাকে অলৌকিক আখ্যা দেয়যে ঘটনার কথা এখানে জানাতে চলেছি সেটা অলৌকিকের তকমা পাবে কি না জানা নেই, তবে অবিশ্বাস্য বটেই। না-মানুষ জীবের ভালোবাসার এক অভূতপূর্ব উদাহরণ এই আখ্যান। মানুষ ভালোবেসে ভুলে যায়; ওরা ভোলে না।

* * *

মিঃ মজুমদারের বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট টাইম লেকচারার থেকে পাকাপাকি প্রফেসর হতে সময় লেগেছিল বেশ কয়েকটা বছর। কর্মজীবনের শুরুটাও কলেজ জীবনের মতো মেসেই কাটিয়েছিলেন। হাতে একটু অর্থ জমতেই শুরু করেছিলেন খোঁজ যদি কাছেপিঠে কোনও বাড়ি পাওয়া যায়। বাড়ি জোটেনি, বদলে জুটেছিল এই জমিটা। তারই এক ছাত্রের সূত্রেবিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র ছ’টা স্টেশন আগে। সুযোগটা ছাড়েননি সমর
তারপর কেটে গেল অনেকগুলো বছর। চারবছর আর বাকি রিটায়ারমেন্টের। বাবা-মা দু’জনেই বিদায় নিয়েছেন ধরাধাম থেকে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাশের শহরে। ঝাড়া হাত-পা জীবন। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে বাড়িটাকে। কিছু সত্যিকারের গরিব মেধাবী ছাত্রকে বিনা পয়সায় পড়া দেখিয়ে দেওয়া ছাড়া প্রাইভেট টিউশন করেন না। টিভি দেখে, বই পড়ে সময় কাটতেই চায় না। একটা কিছু পোষার কথা আলোচনা করেন ওরা। অন্তত একটা কুকুর।
“আমি কলেজ চলে গেলে তোমার একটা সঙ্গী তো থাকবে।”
“বাড়ি সামলাতেই সময় যায়, ওর দেখাশোনা করব কখন? না না, ওসব তোমার রিটায়ারমেন্টের পরই ভেবো।”
চারদিকে ফাঁকা জায়গা ছেড়ে দিয়ে জমিটার ঠিক মাঝখানে বাড়িটা বানিয়েছিলেন সমরবাবু। বেশ কিছু গাছগাছালি লাগানো আছে ওই ফাঁকা জায়গায়। এরকমই দুটো গাছের মধ্যে একফালি জায়গায় একটা ছোট্ট ঘর বানালেন মিস্ত্রি ডেকে। বিদেশি সিনেমায় যেমন দেখা যায়, কুকুর থাকে। আর সেটা দেখেই ওর স্ত্রী বললেন, “মনে আছে তো কথাটা? রিটায়ারমেন্টের পর কিন্তু
“ঠিক আছে রে বাবা, ঠিক আছে, তাই হবে। যদি হুট করে কিছু একটা জুটে যায় দরকারে একটা লোক রাখবতোমায় চিন্তা করতে হবে না।”

* * *

সময়টা শীতকাল। কলেজের বিশেষ মিটিং সেরে ফিরতে ফিরতে ঘড়ির কাঁটা পৌঁছেছে রাত ন’টার ঘরে। কোটের পকেটে হাতটা ঢুকিয়ে ট্রেন থেকে নামলেন সমরবাবু। ছোট্ট স্টেশন, ফলে বেশি লোক নামে না। চায়ের দোকান থেকে পিকলু বলল, “স্যার, আজ অনেক দেরি হল?”
“হ্যাঁ রে, আজ বেশ দেরিই হয়ে গেল।”
ছোটো স্টেশনের ছোটো অফিসঘর থেকে বেরিয়ে এলেন স্টেশন মাস্টার সঞ্জীব বসাক।
“চলুন প্রফেসর, আজ একসঙ্গেই যাওয়া যাক।”
“কাজ কমপ্লিট?”
“হ্যাঁ, মোটামুটি। বিজন থাকল দরকার হলে ফোন তো আছেই।”
কুঁই কুঁই ধরনের একটা শব্দ কানে এল সমরবাবুর। এদিক ওদিক তাকালেন। সেটা লক্ষ করে সঞ্জীববাবু বললেন, “কী হল, প্রফেসর? কাকে খুঁজছেন?”
“নাহ্‌, মানে একটা কুঁই কুঁই শব্দ পেলাম যেন...”
আঙুল তুলে সঞ্জীববাবু বললেন, “ওই বেঞ্চির তলা থেকে আসছে। কারা ফেলে দিয়ে গেছে। ভাগ্য ভালো যে এদিকে কুকুরটুকুর বিশেষ আসে না। না হলে এতক্ষণ...”
একটু এগিয়ে গিয়ে পকেট থেকে টর্চটা বার করে বেঞ্চির তলায় আলো ফেললেন সমরবাবুদুটো টিপ্পির মতো গোল বস্তু চকচক করে উঠলকাছে গিয়ে নিচু হয়ে হাত বাড়াতেই গরগর আওয়াজ করে উঠল বাচ্চাটা। ঠক ঠক করে কাঁপছে।
“ওরে বাবা, তেজ আছে দেখছি! দেখি কত জোর তোর দাঁতে
হাতটা আরও একটু বাড়িয়ে দিতেই গরগরানি থামিয়ে নাকটা এগিয়ে দিল বাচ্চাটা। আলতো করে আঙুল ছোঁয়ালেন সমরবাবুএকটু শুঁকে আঙুলটা চেটে দিল বাচ্চাটা। দিন ছয়েকের হবে আন্দাজে মনে হল।
“একটু দাঁড়ান সঞ্জীববাবু, প্লিজ!” বলে এগিয়ে গেলেন চায়ের দোকানটার দিকে। “পিকলু, দুধ আছে? থাকলে এক কাপ দে তো।”
মানিব্যাগ বার করতে দেখেই পিকলু বলল, “স্যার, এর জন্য আবার... এই নিন
প্লাস্টিকের কাপটা সামনে রাখতেই দুধের গন্ধ নাকে টেনে এগিয়ে এল বাচ্চাটা এবং শুরু করল খেতে। শোনা গেল চক চক শব্দ। বাচ্চাটাকে ভাল করে দেখলেন সমরবাবু একেবারে নেড়ি নয়, দো-আশঁলা মনে হচ্ছে কালো-খয়েরি মাটি, হলুদ মেশানো লোম থাবাগুলো বেশ প্রশস্ত
“চলুন সঞ্জীববাবু, এবার যাওয়া যাক।”
গেট পার হতেই কানে এল ছোট্ট আধো ‘ভুক’ শব্দ। পেছন ফিরে সমরবাবু দেখলেন, বাচ্চাটা পেছন পেছন চলে এসেছে। একরত্তি লোমে ভরা লেজটা নাড়াচ্ছে টুকটুক করে।
“প্রফেসর ও ঠিক মানুষটাকে চিনে নিয়েছে। অ্যাই, যাহ্‌, যাহ্‌,” জুতোটা মাটিতে ঠুকে ভয় দেখালেন সঞ্জীববাবু।
বাচ্চাটি একটু পিছিয়ে থপ করে বসে পড়ল মাটিতে। ওরা আবার হাঁটা শুরু করলেন। কয়েক পা হেঁটে পেছনে তাকালেন সমরবাবুনা, আর আসছে না।
ওই যে শুরুতেই বলে ছিলাম না, অনেক ঘটনা ঘটে যায় যার ব্যাখ্যা মেলে না। ঠিক সেভাবেই সমরবাবুর জীবনপথে আগমন হল জিমির।
বাড়ির চারপাশের সীমানা প্রাচীরের সঙ্গে যুক্ত প্রবেশদ্বারটি খুলে ভেতরে ঢুকতে যেতেই আবার কুঁই কুঁই শব্দটা কানে এলফিরে তাকিয়ে থমকে গেলেন। বাচ্চাটা! লেজ নাড়ছে।
“একি রে, তুই চলে এসেছিস এতদূর! মরেছে, কী করি তোকে নিয়ে এখন? যাহ্‌, পালা
‘ভউ... উ... ভুক ভুক’ ডাক ছেড়ে লেজ নাড়ানোর মাত্রাটা আরও বাড়িয়ে দিল বাচ্চাটা। একটু ভাবলেন সমরবাবু তারপর হাত বাড়িয়ে তুলে নিলেন বাচ্চাটাকে দরজা লাগিয়ে এগিয়ে গেলেন ছোট্ট ঘরটার দিকে
ঘরটা ফাঁকাই যদিও ধুলো জমেছে তাছাড়া শীতের দিন মেঝে ঠাণ্ডা
“তোর তো খুব কষ্ট হবে রে এই ঠান্ডায় থাকতে না, এখানে তোকে রাখা যাবে না
কথাগুলো শুনে কী বুঝল কে জানে, বাচ্চাটা ছোট্ট তুলতুলে জিভটা দিয়ে একবার চেটে দিল সমরবাবুর হাতটা
“নাহ্‌, যা হবার হবে, চল তোকে ভেতরেই নিয়ে যাই।”
কথাগুলো বলা শেষ হতে না হতেই ভেসে এল ওঁর স্ত্রীর আওয়াজ, “এত রাতে ওখানে আবার কী করছ ঠান্ডার মধ্যে?”
“না মানে... অ্যাই শোন, একেবারে চুপ করে থাকবি, বুঝলি? কিছু না সুরমা, এই...”
“কী না, হ্যাঁ করছ! বয়স হয়েছে, ঠাণ্ডা লাগানোর শখ জেগেছে নাকি?”
“আরে, না না বলছিলাম কী সুরমা...”
পেছন ঘুরতেই সুরমার চোখ গেল বাচ্চাটার দিকে। “ও, এই ব্যাপার! তাই তো বলি... যোগাড় হয়ে গেল তাহলে? বলেছিলাম না? আমার কোন কথাই শোনো?”
“সুরমা, একটা রাতের ব্যাপার। কালকেই কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসার ব্যবস্থা করবস্টেশনে ঠাণ্ডায়...”
“বুঝলাম। তা ওটাকে কি ঘরে ঢোকানোর কথা ভাবছ?”
“এই ঘরটার মেঝে খুব ঠাণ্ডা। কিছু একটা পেলে এখানেই... একটা ছেঁড়া কাপড়-টাপড় পেলে...”
কিছুক্ষণ বাদে একটা পিচবোর্ডের বাক্সে পুরনো কাপড় দিয়ে বানানো গদির ওপর থাকার ব্যবস্থা হ বাচ্চাটার। ওই ঘরেই। প্লাস্টিকের বাটিতে কিছুটা দুধ আর পাউরুটির কুচি ভিজিয়ে খাইয়ে দরজাটা লাগিয়ে ফিরে এলেন সমরবাবু।
মাঝরাতে ঘুম ভাঙল সুরমার খুটখাট শব্দে। হাত বাড়িয়ে বেড স্যুইচ অন করে দেখলেন, সমরবাবু বিছানায় নেই।
“বাথরুমে গেলে নাকি?”
কোনও সাড়া না পেয়ে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে গেলেন জানালার কাছে। আস্তে করে খুলতেই অনুমান সত্যি হল। ছোটো ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সমরবাবু। আবারও নিঃশব্দেই সুরমা ফিরে এলেন বিছানায়।

পরেরদিন সকালে সুরমার যখন ঘুম ভাঙল সমর তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছেন। ডাকলেন না সুরমা। কারণ, উনি জানেন, আরও দু’বার রাতে উঠেছিলেন সমর। কারণ একই।
প্রাতঃকর্মাদি সম্পন্ন করে রান্না ঘরে গিয়ে আগে খানিকটা দুধ গরম করে কালকের বাটিটায় ঢেলে নিয়ে এবার নিজেই গেলেন ছোটো ঘরটার কাছেফিরে এসে চায়ের জল চাপিয়ে ডাক দিলেন, “কী গো, আজ কলেজ যাবে না, নাকি? আটটা তো বাজল!”
উঠেই আগে সমর তাকালেন ছোটো ঘরটার দিকে।
“ওকে দুধ খাওয়ানো হয়ে গেছে।”
কৃতজ্ঞতা মাখানো একটা হাসিতে ভরে উঠল সমরের মুখটা। “থ্যাঙ্ক ইউ, সুরো!”
“থ্যাঙ্ক ইউ-টিউ পরে হবে চা খেয়ে আগে ওর কাপড়টা বদলে দাও। আর ঝন্টুকে একটা ফোন করে আসতে বলোঘরটায় একটা আলো লাগাতে হবে তো।”
এবার বিস্ময় সমরবাবুর চোখে
“ওরকম হাঁ করে তাকিয়ে আছ কেন? রাতে তো ভালো করে ঘুমাতে পারছিলে না। তাও তো বাড়িতেই আছে। ছেড়ে এসে থাকতে পারবে?”
আসলে সমর যা জানতেন না তা হল সুরমাও কুকুর ভালোবাসেন। ছোটোবেলায় ওদের বাড়িতে একটা কুকুর ছিল। হনুমানকে তাড়াতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছিল। ছোটোবেলার সেই কষ্টের স্মৃতির রোমন্থন চান না বলে নিজে রাজি না হওয়ার অভিনয় করে এসেছেন এতদিন। কিন্তু ওই যে, যেটা হওয়ার সেটা কে আটকাবে।
অতএব পাকাপাকি জায়গা হয়ে গেল জিমির। নামটা সুরমাই রাখলেনদুই নিঃসঙ্গ মানুষের জীবনের সিংহভাগ ভরাট হয়ে গেল জিমির সাহচর্যে। রাতের বেলাটা ছাড়া সারাদিন মূল বাড়িতেই থাকে জিমি। ইতিমধ্যে মেয়ে-জামাই এসেছিল একদিন। মেয়ে সাগরিকা তো রীতিমতো রাগ দেখাল মাকে, “সেই পুষলে! অথচ আমি কত্তবার চেয়েছি...”

জিমির মজাদার বিভিন্ন আচরণের স্মৃতি মনের খাতায় জমতে জমতে কেটে গেল একটা বছর। সমরবাবু যখন কলেজে যান, জিমি ওঁর সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত যায়। দু-একটা কুকুর দূর থেকে ডাক ছাড়লেও কাছে ঘেঁষে না আদরযত্নে তৈরি হওয়া তাগড়াই শরীরটা দেখে। তার সঙ্গেই আছে গুরুগম্ভীর আওয়াজ। ট্রেন আসা ও সমরবাবুর চাপা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তারপর একাই ফিরে যায়। স্টেশনের লোকেরা এই ব্যাপারটা ভালোই বুঝে গেছে। জিমি আজ অবধি কাউকে কিছু বলেনি।
মাসখানেক বাদের একটা দিন। বিকেলবেলায় সুরমা মগ্ন মাসিক ম্যাগাজিনের গল্পের পাতায়কানে এল গেট ঝাঁকানোর শব্দ। তাকিয়ে দেখলেন জিমি গেটটা খোলার চেষ্টা করছে। কে ডাকছে নাকি? বাইরে বেরিয়ে এলেন। ওকে দেখেই জিমি ছুটে এলনা, গেটের ওপারে তো কে নেই। জিমি আবার ছুটে গেল গেটের কাছে। ব্যাপারটা দেখার জন্য সুরমা গিয়ে দরজাটা খুলতেই জিমি সটান ছুট দিল স্টেশনের দিকে।
“জিমি! জিমি, অ্যাই জিমি!”
ও ফিরেও তাকাল না।
ওদিকে স্টেশনে পিকলুও অবাক হল জিমিকে অসময়ে দেখে।
“কী রে জিমি, তুই এখন?”
জিমি একবার পিকলুকে দেখে নিয়ে আস্তে-সুস্থে গিয়ে উঠে বসল সিমেন্টের বেঞ্চিটায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে গেল ট্রেন। যা থেকে নামলেন সমরদেখতে পেয়েই ‘ভো-ও-উ’ ডাক ছেড়ে জানান দিল নিজের উপস্থিতির। সমর চেনা শব্দে অবাক হয়ে তাকালেন। জিমি! এক-পা এগোতেই ছুটে এসে দু’পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল সমরের গায়ে। ইতিমধ্যে সুরমাও এসে গেছেন স্টেশনেদেখতে পেলেন এক অভূতপূর্ব মিলনদৃশ্য।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সব বললেন সুরমা। খুব একটা অবাক হলেন না সমর। কারণ, জীবজন্তুদের এই বিশেষ অনুভূতির কথা উনি বইয়েতে পড়েছেন। সেটা স্ত্রীকে বলেন
এরপর থেকে স্টেশনে অপেক্ষা করাটা রুটিন হয়ে গেল জিমির। সমরবাবু কলেজ থেকে যখনই ফিরে আসেন ও কী করে যেন বুঝতে পারে। মিনিটখানেক আগেই স্টেশনে পৌঁছে যায়। কিছুদিন ওর গেট নাড়ানো দেখে সুরমা গেট খুলে দিতেন। পরে মিস্ত্রি ডেকে জিমির বেরোনোর মতো একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যেটা বুঝে নিতে জিমির মিনিট দশেক লেগেছিল মাত্র।
কিছু মানুষ আপত্তি তুলেছিলেন জিমির স্টেশনে আসার ব্যাপারে। সঞ্জীববাবুর হস্তক্ষেপে জল বেশিদূর গড়ায়নি। বরং ইদানীং জিমিকে না দেখলেই কে কে প্রশ্ন করেন পিকলুকে, “কী ব্যাপার, আজ প্রফেসর কলেজে যাননি নাকি?”

দুমাস পর
আজ সমরবাবুকে কলেজ যেতে বারণ করছিলেন সুরমা। গত চারদিন অসুস্থ ছিলেন।
“আর একটা দিন বিশ্রাম নিয়ে গেলে কী এমন ক্ষতি হত?”
“ক্ষতি কিছুই হ না। সামনেই পরীক্ষা, এটা ভুলে গেলে তো চলবে না জরুরি কিছু কাজ আছে, ওটা সেরেই তাড়াতাড়ি ফিরে আসব
কথাটা শুনেই কানটা খাড়া হয়ে গেল জিমির। এই চারদিন সমানে সমরের বিছানার পাশে শুয়ে থেকেছে। এমনকি রাতেও। সুরমাও কিছু বলেননি।
যথারীতি সমরবাবুকে ট্রেনে চাপতে দেখে বাড়ি ফিরে এল জিমি। বেলা গড়িয়ে দুপুর হল। জিমি চলে গেল স্টেশনে। বসে থাকল ট্রেনের অপেক্ষায়।
ট্রেন এল বেশ কয়েকটা কিন্তু সমর এলেন না কোনওটাতেই। জিমি নড় না। বসে থাকল একঠায়। রাতের খাবার খাওয়ার জন্য অফিস থেকে বেরিয়ে জিমিকে দেখে অবাক হলেন সঞ্জীববাবু।
“কী ব্যাপার রে, জিমি! প্রফেসর ফেরেননি এখনও?”
প্রশ্নটা শুনে বোবা করুণ চোখে তাকিয়ে থাকল জিমি। রাত পেরিয়ে সকাল হল জিমি বসেই থাকল
কেন ফিরলেন না সমরবাবু? এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো অনুমান করে নিয়েছেন অনেক পাঠক-পাঠিকাই। এ পৃথিবীর কোনও স্টেশনের কোনও ট্রেন থেকেই আর নামবেন না সমর মজুমদার। কলেজেই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়। ওখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। কিছুই করা যায়নি। সহকর্মীরা খবরটা পাঠান মেয়ে-জামাইকেখবর পৌঁছায় সুরমার কাছেও। আকস্মিক এই দুঃসংবাদে বাহ্যিক জগতের জ্ঞান লুপ্ত হয় ওঁরএকটু ধাতস্থ হতেই চেনা একজনের মারুতি গাড়িতে রওনা দেন কলকাতা অভিমুখে। মনেও থাকে না জিমির কথা।
দেহ আর ফিরিয়ে আনেননি। ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশানে শেষকৃত্য সেরে ফিরে আসেন। গাড়িতে গেলেও ফিরে আসেন ট্রেনে। প্রায় চল্লিশ-বিয়াল্লিশ ঘন্টা পর। নেমেই দেখতে পান অপেক্ষমান জিমিকে। না, ওদের দেখে ও ছুটে আসে না। শুধু সেই বোবা দৃষ্টি দিয়ে খুঁজতে থাকে একটি বিশেষ মানুষকে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে যান সুরমা। জিমির সামনে একটা পাউরুটি, এক ভাঁড় দুধ রাখা। ছুঁয়েও দেখেনি ও। সুরমাকে দেখে একটা মৃদু কুঁই কুঁই আওয়াজ করে। হাল্কা গরগরে একটা শব্দ করে অনুযোগ জানায়।
“বাড়ি চল জিমি, ও আর ফিরবে না।” জিমির মাথায় হাত রেখে কান্না জড়ানো গলায় কোনওমতে বলেন সুরমা।
এই প্রথম কথার অবাধ্য হয় ও। মুখ তুলে তাকায় পেছনে চলতে শুরু করা ট্রেনটার দিকে। সাগরিকা টান দেয় বেল্টটা ধরে। নাহ্‌, বৃথা চেষ্টা। নড়ানো যায় না জিমিকে ওর জায়গা থেকে।
সুরমা বলেন, “থাক রে গুড্ডি, ও থাক। ওর যখন ইচ্ছে হবে ও ঠিক ফিরে আসবে।”

* * *

না, এ কাহিনির আর বিস্তারের জায়গা নেই। জিমি বাড়িতে আর ফেরেনি। আরও দশবছর অপেক্ষা করেছিল। সুরমা প্রত্যেকদিন দু’বেলাই ওকে খাইয়ে দিয়ে আসতেন নিজের হাতে। তারপর একদিন জিমিও চলে যায় সেখানে যেখানে ওর অপেক্ষায় বসে আছেন ওর পালক-পিতা।
( এটি একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। সেই প্রভুভক্ত কুকুরটার নাম ছিল হাচিকো। ১৯২৩ সালের শিবুয়া রেইড রোড স্টেশনে ওকে পেয়েছিলেন প্রফেসর ইসাবুরই। এর একবছর পর ইসাবুরইর দেহাবসান হয়। ১৯২৪ থেকে ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত হাচিকো ওই স্টেশনে প্রফেসরের জন্য অপেক্ষা করেছিল। ওই স্টেশনের ভেন্ডাররা ওর দেখাশোনা করতসংবাদপত্রে এই খবর প্রকাশিত হয়েছিল। দেশবিদেশ থেকে এসেছিল অনেক অর্থ সাহায্য। পরে সেই অর্থে ওই স্টেশনে হাচিকোর মূর্তি বসানো হয়। আজও ওটা এক দ্রষ্টব্য বস্তু জাপানের। এক মানবেতর প্রাণী অপেক্ষা করে আছে তার প্রিয় মানুষটার জন্য। )
_____
অলঙ্করণঃ নন্দন ঘর

1 comment:

  1. সিনেমাটা দেখে মন মোচড় না দিয়ে উঠে পারে নি :(

    ReplyDelete