টাঁড়বাড়োর শিং
পুষ্পেন মণ্ডল
সেদিন
অফিস থেকে বেরোতে বেশ রাত হয়েছিল। নতুন
প্রজেক্টের ডিজাইন রেডি করার জন্য বসের পরপর তাগাদা আসছে। সেজন্যই আদাজল খেয়ে পড়া।
পাহাড়ের কোলে বিস্তীর্ণ অরণ্য কেটে একটা বৃহৎ স্টিল ফ্যাক্টরি তৈরি হবে জঙ্গলমহলে।
তারই ব্লু-প্রিন্টের কাজ চলছে ঝড়ের গতিতে। শনিবার না হলে অফিস সংলগ্ন কোয়ার্টারে
থেকেই যেতাম। কিন্তু পরের দিন ছুটি থাকায় যত রাতই হোক নিজের বাসায় ফেরার জন্য
উচাটন হয়ে ছিল মন। শঙ্করকে বললাম, গাড়ি করে স্টেশনে
পৌঁছে দিতে। শেষ ট্রেনটা ধরতে পারলে আর চিন্তা নেই।
কিছুক্ষণ
পর অন্ধকার রাস্তায় ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে রেলগেটটা পেরিয়ে দৌড়
দিলাম। হাতে সময় বেশি নেই। লাস্ট ট্রেনটা ছেড়ে গেলে সারারাত বসে থাকতে হবে
স্টেশনেই। তিরবেগে বাঁক নিয়েই অযাচিত একটা জোরালো ধাক্কা খেয়ে কিছু বোঝার আগেই
ছিটকে পড়লাম কাদার মধ্যে। ছাতাটা হাত
থেকে ছিটকে পড়েছে দূরে। ব্যাগটা ছিঁড়ে চলে গেছে কাঁধ থেকে। অসহ্য
যন্ত্রণায় কুঁকড়ে কোনওরকমে উঠে দাঁড়ালাম। একটা কালো
মোষ দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। আর একটা মুশকো দেহাতি লোক তাকে বৃষ্টির মধ্যেই লাঠিপেটা
করছে দমাদম। কী ব্যাপার! ছাতা আর ব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। মোষটার পিছনে বিশাল
বড়ো একটা মালবোঝাই ট্রলি। সেটা বেল্ট দিয়ে বাঁধা মোষটার ঘাড়ের সঙ্গে। শত
লাঠিপেটা করা সত্ত্বেও ট্রলিটা একচুলও টানতে পারছে না সে। মৃদু আলোতে দেখলাম,
মারের চোটে ঘাড় থেকে রক্ত পড়ছে প্রাণীটির।
“কী
ব্যাপার, দাদা? অবলা জীবটিকে ওরকম মারছেন কেন?” তার ভাষাতেই করলাম প্রশ্নটা।
“আপনি
যান না আপনার রাস্তায়। অত দরদ দেখাতে হবে না।” দাঁত খিঁচিয়ে বেশ মেজাজ নিয়ে কথাটা
বলল লোকটা।
মাথা
গেল গরম হয়ে। হঠাৎ যেন দপ করে একটা আগুন জ্বলে উঠল। সোজা
তেড়ে গিয়ে সজোরে ঘুষি মারলাম একটা নাকের ডগায়। একসময়ে রীতিমতো বক্সিং প্র্যাকটিস
করতাম পাড়ার ক্লাবে। দেখি জোর একটুও কমেনি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাট্টাকাট্টা
লোকটা উলটে পড়ে গেল ট্রলির উপর থেকে। মাথাটা গিয়ে ঠুকল পথের পাশে একটা পাথরে। তারপর
লোকটা মুখ গুঁজে পড়েই রইল জলকাদার মধ্যে। আর উঠছে না। বুকটা কেঁপে গেল। মরে
গেল নাকি! চারপাশে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই কোথাও। শুনশান রাস্তায় রক্ত ভেসে যাচ্ছে
বৃষ্টিতে। তাড়াহুড়ো করে মোষটাকে বাঁধন থেকে খুলে দিয়ে দৌড় দিলাম স্টেশনের দিকে।
খোঁড়াতে
খোঁড়াতে দৌড়ে উঠলাম রাতের শেষ ট্রেনে। ছেড়ে
দিয়েছে তখন। কামরায় দু’জন লোক। আমাকে নিয়ে তিন।
ট্রেন ছুটতে শুরু করেছে। একটা জানালার ধারের সিটে বসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাঁধের ব্যাগ
থেকে জলের বোতলটা বের করে শুকনো গলায় ঢালতে গিয়ে দেখি সেটা পুরো খালি। কাজের চাপে
খালি বোতলটা ভরা হয়নি সময়মতো। এখন ঘণ্টা
দেড়েকের রাস্তা তৃষ্ণার্ত গলায় বসে থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
“জল
খাবেন? এই নিন।” আওয়াজটা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি পিছনের সিটে একজন মাঝবয়সী লোক হাসিমুখে
জলের বোতলটা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
আমি
একটু ইতস্তত করতে তিনি আদেশের সুরে বললেন, “জলটা খান আগে। গলাটা
তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে তো। কতটা দৌড়ে ধরলেন ট্রেনটা।
আবার মোষের ধাক্কা।”
কথাটা
শুনে থমকে গেলাম। ইনি কী করে জানলেন! তারপর সাতপাঁচ না ভেবে এগিয়ে দেওয়া বোতলের
ছিপি খুলে ঢেলে দিলাম গলায়। আহ্! প্রাণটা জুড়াল। অর্ধেক
বোতল শেষ করে ওঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফেরত দিলাম। ভদ্রলোক আমার পিছনের সিট থেকে উঠে
সামনে এসে বসেছেন ততক্ষণে। চলন্ত ট্রেনের মৃদু আলোয় দেখলাম রোগাটে চেহারা, থ্যাবড়া
নাক, গায়ের রং শ্যামলা, কাঁচাপাকা উসকোখুসকো চুল, সপ্তাহ দুয়েকের না কামানো দাড়ি,
চোখে পুরানো ধাঁচের চশমা, কাঁধে ঝোলা একটা কাপড়ের ব্যাগ, পরনে সস্তা দামের হাফ
শার্ট আর প্যান্ট, আর মাথায় একটা তোয়ালে জড়িয়ে ফেট্টি বাঁধা। মুখে অমায়িক হাসিটা
লেগে রয়েছে।
আমি
একটু অবাক গলায় বললাম, “আপনাকে কি আগে কোথাও দেখেছি?”
“দেখেছেন।
তবে সেটা আপনার চিনতে পারার কথা নয়।”
“বুঝলাম
না।”
“সব
জিনিস চট করে বুঝতে চাইলেই বোঝা যায় না, মশাই। বলছি, ধীরেসুস্থে। হাতে
সময় আছে অনেক।” বলে হাত ঘড়িটা উলটে দেখে আবার বললেন, “এখন এগারোটা পাঁচ। ট্রেন শেষ
স্টেশনে ঢুকবে বারোটা কুড়ি। অনেক সময়
আছে। হে হে হে...” হেঁয়ালির সুরে কানে এল কথাটা।
ট্রেনের
টাইম-টেবিল জানি আমি। শেষ স্টেশনে নেমে আমার ভাড়াবাড়ি হাঁটা পথে দশ মিনিট। তাই
নিশ্চিন্ত মনে জানালার রডে মাথাটা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। সেই কোন সকালে বেরিয়েছি।
আটটা পাঁচের ট্রেন ধরে অফিসে আসা। ফেরার সময়ে সাতটা বারো ধরি প্রতিদিন। ওভারটাইম
হলে দেরি হয়। হালকা দুলুনিতে তন্দ্রাভাবটা গ্রাস
করল সহজেই। চোখের সামনে ভেসে উঠল টেবিলভর্তি ফাইল। চোখ একবার কম্পিউটারে আর একবার
ফাইলে। একটা করে টিক দিচ্ছি সংখ্যাগুলোর গায়ে। আচমকা কম্পিউটারের স্ক্রিনে ভেসে
উঠল একটা সতর্কীকরণ বার্তা। ভাইরাস ঢুকেছে। কিন্তু এমন হওয়ার কথা নয়। সবসময়ে অ্যান্টিভাইরাস
আপডেট করা থাকে মেশিনে। তাহলে! তারপর আচমকা স্ক্রিনটা কালো হয়ে গেল। এরপর দু-একটা
সুইচ টিপতে একটা একটা করে ইংরাজি সংখ্যা লাফাতে লাগল। আমি প্রমাদ গুনলাম।
ব্যাপারটা কী হচ্ছে! রিস্টার্ট করার চেষ্টা করতে হিতে বিপরীত হল আরও। এবার
সাদা-কালো হয়ে মনিটরটা ঝিরঝির করতে করতে একটা ছবি ভেসে উঠল। অস্পষ্ট একটা কালো
ষাঁড়ের ছবি। তার সারা গা থেকে যেন রক্ত ঝরে পড়ছে। ভয়ংকর একটা বীভৎসতায় চোখটা বন্ধ
করে নিলাম।
এর
মধ্যেই কানে এল একটা খ্যাঁকখ্যাঁকে হাসির আওয়াজ। চোখটা খুলে যেতে বুঝলাম, তন্দ্রার
মধ্যে স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু সামনের লোকটা কেন হাসছে কে জানে। আমি জানালা দিয়ে
বাইরের দিকে তাকালাম। হু হু করে ঝড়ের মতো হাওয়া ঢুকছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি
আচমকা প্রশ্ন করলেন, “রমেশ দত্তর ডায়েরিটা পড়েছেন?”
আকাশ
থেকে পড়লাম আমি। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম। রমেশ দত্ত! সে আবার কে?
তিনি
আবার বললেন, “মাসখানেক আগে কলকাতায় বিবাদী বাগের ফুটপাতে মনসুর চাচার কাছ থেকে
কিনেছিলেন কুড়ি টাকা দিয়ে। ভুলে গেছেন?”
ধাঁ
করে মনে পড়ল। যেমন পুরনো জিনিস কেনার শখ থাকে অনেকের, আমার তেমনই পুরনো বই কেনার
শখ। রাস্তার ধারে, ফুটপাতে যেখানেই পুরনো বই দেখতে
পাই, দাঁড়িয়ে যাই। হাতে নিয়ে পাতা উলটেপালটে পড়ে দেখি যদি কিছু লেখার রসদ পাওয়া
যায়। বলা বাহুল্য নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে হতাশ হতে হয়। আবার মাঝে মধ্যে দু-একটা
মণিমাণিক্যও উঠে আসে ভাগ্য ভালো থাকলে। সেদিন
অফিসের কাজে গিয়েছিলাম ডালহৌসিতে। বিকালে বিবাদী বাগ থেকে হেঁটে ধর্মতলা আসছিলাম।
গ্রেট ইস্টার্নটা পেরিয়ে রাস্তার পাশে চোখে পড়ল এক বয়স্ক দাড়িওলা মানুষ বসে আছেন
পুরনো কিছু বইপত্র বিছিয়ে। আমি পাশ কাটিয়ে চলে আসতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লাম স্বভাবগুণে। তারপর
নিচু হয়ে দেখতে শুরু করলাম বইগুলো। কানের মধ্যে হাজারো গাড়ির আওয়াজ তখন আর ঢুকছিল
না। কিন্তু মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই উঠে পড়লাম খালি হাতে। মাথা নেড়ে বললাম, “সেরকম
বিশেষ কিছুই নেই।”
চাচা
হঠাৎ ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা ডায়েরি বের করে এগিয়ে দিলেন আমাকে। পাতাটা উলটে
দেখি ঝরঝরে ইংরাজিতে লেখা। তবে লেখকের নাম খুঁজে পেলাম না। প্রথম কয়েকটা পাতা নেই।
সময়কাল স্বাধীনতার কয়েক বছর আগে। ব্যস, চাচাকে খুশি করে দিয়ে ডায়েরিটা পকেটস্থ করে
রওনা দিলাম। কিন্তু হাজারো কাজে সেটা আর পড়া হয়ে
উঠল না। ডায়েরিটার স্থান হল বসার ঘরের একগাদা পুরনো বইপত্রে ঠাসা র্যাকের এককোণে। কিন্তু
সেই ডায়েরির কথা ইনি জানলেন কী করে?
আমার
মনের কথাটা অদ্ভুতভাবে লুফে নিয়ে বললেন, “ডায়েরিটা পড়লে জানতে পারতেন। আচ্ছা, আপনার
ডান হাতের কবজির উপরে ঐ দাগটা কীসের?” লোকটার দৃষ্টি আমার হাতের দিকে।
আমি
একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “এটা তো জড়ুল। আমার হাতে জন্ম থেকে আছে।”
তিনি
গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন, “দেখুন, ঠিক যেন একজোড়া শিং। এটা কীসের সিম্বল জানেন?”
আমি
চুপ করে আছি দেখে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “দেবতা ইনকাইডুর। এ-চিহ্ন
সবার হাতে থাকে না। আপনার শরীরে আছে মানে আপনি তাঁর আশীর্বাদধন্য।”
“ইনকাইডু!
নামই শুনিনি কোনওদিন।”
“বাইসন,
নীলগাই, ষাঁড় বা বলদ এদের আদি দেবতা হলেন ইনকাইডু। এবার বলুন তো, গ্ল্যাডিয়েটর
বলতে আপনার চোখে প্রথম কী ছবি ভেসে ওঠে?”
বাপ
রে! এ তো মহা সমস্যায় পড়া গেল! লোকটা আমাকে কী ভেবেছে? কোনও উত্তর না দিয়ে মুখটা
আবার জানালার দিকে ঘোরালাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তরটা উনি নিজেই দিলেন।
“রোমান
মল্লযোদ্ধা। হাতে বর্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা একটা গ্যালারি।
সেখানে ছেড়ে দেওয়া হল একটা বাইসন। সবাই জানে মানুষের থেকে বাইসনের গায়ের জোর অনেক
বেশি। কিন্তু নির্দয় মানুষের বুদ্ধি আর অস্ত্রের জোরে বাইসনটা রক্তাক্ত হতে হতে
ক্রমশ ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। দর্শকরা হাততালি দিয়ে বাহবা দিল বিজয়ী মানুষটিকে। আর
সারা গায়ে রক্ত মেখে ছিন্নভিন্ন শরীর নিয়ে পড়ে রইল বাইসনটা। অসহ্য যন্ত্রণায়
মৃত্যুর জন্যে খাবি খাচ্ছে। কিন্তু মরণ তার আসছে না। আচ্ছা, বলুন তো ঐ বাইসনটার কী
দোষ?”
“এসব
কথা আমাকে বলছেন কেন?”
“কারণ,
আপনার সঙ্গে এর যোগসূত্র আছে তাই। আমি শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছি। ঘটনাটা শুরু হয়েছিল,
চার হাজার বছর আগে। মেসোপটেমিয়ায়। দেবতাদের ষাঁড় ইনকাইডু আর রাজা উরুকের যুদ্ধ
হয়েছিল। সেবার ইনকাইডু মারা পড়ল। কারণ, রাজা
উরুক যুদ্ধের নিয়ম না মেনে ছলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর মানুষের ইতিহাসে লেখা হল
উরুকের বীরগাথা। অথচ এর আগে কয়েক লক্ষ বছর ধরে মানুষ হেরে আসছে ষাঁড় আর বাইসনের
কাছে। কখনও-সখনও যে মানুষ জেতেনি তা নয়। কিন্তু সেটা ছিল ব্যতিক্রম। কিন্তু
ইনকাইডু মারা যাবার পর থেকে এটা ক্যান্সারের মতো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল সারা পৃথিবীতে।
ক্রমশ রোম, স্পেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, তানজানিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, এমনকি ভারতেও
এসে পৌঁছাল সেই নৃশংস খেলা।”
“কীসের
খেলা?”
“বিনা
কারণে বাইসন, মোষ, ষাঁড় এদেরকে ইচ্ছাকৃত রাগিয়ে দিয়ে মানুষের সঙ্গে লড়িয়ে দেওয়া।
কোথাও লাল কাপড় দেখিয়ে তাদের খেপিয়ে তোলা হয়। আবার কোথাও একপাল ষাঁড়কে ছেড়ে দেওয়া
হয় মানুষের পেছনে ধাওয়া করার জন্য। তাদের কাছে এটা একটা মনোরঞ্জনমূলক খেলা। কিন্তু
ভেবে দেখেছেন, ঐ নিরীহ পশুগুলির কী অবস্থা হয়?”
কথাটা
শুনে আমার একটা কথা মনে পড়ল। আমার বাবার
ছিল বদলির চাকরি। সেজন্য ছোটোবেলাতেই প্রায় সারা
ভারতবর্ষ ঘোরা হয়ে গিয়েছিল। একবার মাদুরাইতে ছিলাম কয়েক বছর। দক্ষিণ ভারতে পোঙ্গল
নামে যে উৎসবটা হয় তাতে ‘জালিকাট্টু’ বলে একটা ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াই থাকে। বয়েস তখন বারো-তেরো। স্কুলের
বন্ধুদের সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম দেখতে। মাঠের মাঝে বাঁশের ব্যারিকেড করে একটা একটা
ষাঁড়কে ছেড়ে দৌড় করানো হচ্ছে। আর তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে এক সঙ্গে পঞ্চাশজন লোক। সেবার
আমার হঠাৎ কী হল, রে রে করে তেড়ে গেলাম ওদের মারতে। সবাই মিলে ধরে আমাকে চ্যাংদোলা
করে বার করে দিল মাঠের বাইরে। কাঁদতে কাঁদতে দৌড়লাম বাড়ির দিকে।
“টাঁড়বাড়োকে
মনে আছে?” চিন্তার জাল ছিঁড়ে আবার কানে এল সামনের লোকটির গলা।
“কে?”
“লবটুলিয়া
বৈহারের টাঁড়বাড়ো।”
বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক আমার সবথেকে প্রিয় লেখাগুলির মধ্যে একটি। প্রথম পড়েছিলাম
ক্লাস নাইনে। সেখানেই শুনেছি নামটা।
ভদ্রলোক
বলে চললেন, “মনে আছে সেই রাজু পাঁড়েকে? ধাতুরিয়া, ধাওতাল সাহু, মটুকনাথ,
যুগলপ্রসাদ, কুন্তা, মঞ্চী, রাজা দবরুপান্না আর রাজকুমারী ভানুমতী?”
আমি
বললাম, “তা আছে, কিন্তু আপনি এসব জানতে চাইছেন কেন?”
“ওদের
খুব বিপদ। জানেন, টাঁড়বাড়োকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?”
আমি
আবার হোঁচট খেলাম। “কী যা তা বলছেন! সেটা তো একটা গল্প।”
“না
না, গল্প নয়। বিশ্বাস করুন, প্রতিটা শব্দ সত্যি।”
শেষ
ট্রেনে আজ পর্যন্ত উঠিনি কোনওদিন। মানে উঠতে হয়নি আর কী। শুনেছি
এই রাতের ট্রেনগুলো চোর-ডাকাত, পাগল-ছাগলদের আস্তানা। সামনের মানুষটি কোন গোত্রের
সেটা বুঝতে আর একটু সময় লাগবে। তবে চুরি-ছিনতাই উদ্দেশ্য হয়ে থাকলে খুব একটা
সুবিধা হবে না। কারণ, এখন মাসের শেষ, পকেটে টাকাপয়সা নেই বললেই চলে। কুড়িয়ে-বাড়িয়ে
আড়াইশো থেকে তিনশো টাকা পাওয়া যাবে। সোনাদানা এক
ফোঁটাও নেই গায়ে। একমাত্র দামি জিনিস বলতে ফোন। তাও ওটা গিফট পাওয়া।
হঠাৎ
হো হো করে হেসে উঠল লোকটা। “আরে মশাই, আপনি যা ভাবছেন, আমি তা নই। মানে,
আমি চোর-ছ্যাঁচোড় তো নয়ই। তবে পাগল হলেও হতে পারি। আসলে পাগল তো অনেকরকমের হয়।
যেমন ধরুন, কেউ টাকার জন্য পাগল, কেউ বই পাগল, কেউ সিনেমা পাগল, কেউ ভগবানের জন্য
পাগল আবার কেউ... না থাক, সেটা পরে বলছি।”
আমি
কথাটা শুনে একটু তটস্থ হয়ে নড়েচড়ে বসলাম। লোকটার সঙ্গতিহীন কথাবার্তাগুলিতে ধাক্কা
লাগছে মনে। কিন্তু লোকটা কি অন্তর্যামী! মানে মাইন্ড রিড করতে পারছে? তা কী করে
সম্ভব! তথাকথিত বড়ো বড়ো জ্যোতিষীরাও যেটা করে সেটা লোকের চোখে ধুলো দেওয়া ছাড়া আর
কিছুই নয়। কিন্তু ইনি...
পরের
স্টেশন এল। কিছুক্ষণ থেমে আবার এগিয়ে চলল ট্রেন। কেউ
নামলও না, আর উঠলও না। এত রাতে স্টেশনে দু-একটা চায়ের গুমটি ছাড়া কিছু খোলা নেই।
ভাবছি, সামনের স্টেশনে নেমে কামরাটা বদলে নেব। পুরো রাস্তাটা পাগলের বকর বকর শুনতে
শুনতে যাওয়া মানে যখন নামব হয়তো মানসিক ভারসাম্য আর ঠিক থাকবে না।
বাইরে
বৃষ্টির বেগ আবার বেড়েছে। ঝাপটা ভিতরে আসছে ক্রমাগত। জানালার কাছ থেকে সরে এলাম। লোকটা
নিজের মাথা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে চুপ করে বসে রয়েছে। ধীরে ধীরে পাশের দিকে সরতে
শুরু করলাম। একটু একটু করে। লোকটা নির্বিকার। ট্রেন প্রচণ্ড গতিতে ছুটছে সামনের
দিকে। দুলছে ঝুলন্ত হাতলগুলি। ধাতব শব্দ হচ্ছে অনবরত। বাইরে ঝড়ো হাওয়া আর জমাট
অন্ধকার। পিছন ফিরে দেখলাম। আর কোনও প্রাণী নেই কামরায়। আশ্চর্য! যখন উঠলাম, তখন
তো ছিল। আর পরের স্টেশনে কেউ নামেনি বা ওঠেনি। তাহলে! কী ব্যাপার! আমারই মাথাটা
মনে হয় গুলিয়ে যাচ্ছে। সিট থেকে উঠে এগোলাম দরজার দিকে। শহরের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট,
গাছপালা সব দৌড়চ্ছে পিছনে। সারি সারি ছুটন্ত আলো।
তারাও যেন সবাই ভয় পেয়েছে খুব।
আমি
লম্বা মোটা রডটা ধরে দাঁড়িয়ে আছি সামনের স্টেশনে নেমে দৌড়ে চলে যাব পরের কামরায়।
বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি ক্রমশ।
কিন্তু
পরের স্টেশন আসতে এত সময় লাগার তো কথা নয়। ঘড়ির দিকে তাকালাম। বন্ধ হয়ে গেছে।
এগারোটা পাঁচে। মানে যখন ট্রেনে উঠেছি। পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। এ কী! অন হচ্ছে
না কেন! এইসব ইলেক্ট্রনিকস জিনিসগুলোর কোনও ভরসা নেই। ব্যাটারির চার্জ যখন তখন শেষ
হয়ে যায়!
আবার
চোখ গেল বাইরের দিকে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কী ঝামেলা! গোটা এলাকায় লোডশেডিং হল নাকি?
প্রচণ্ড বৃষ্টিতে কোনও গ্রিড বা ট্রান্সফর্মার বার্স্ট করলে এরকম হতে পারে। কিন্তু
ট্রেনটা তো চলছে। জ্বলছে এর ভিতরের টিমটিমে লাইটগুলোও।
সময়ের
কোনও হিসাব নেই। মাথাটা ঘুরিয়ে দেখলাম সেই লোকটার দিকে। একদৃষ্টিতে আমার দিকেই
তাকিয়ে আছে। চোখদুটো থেকে যেন সবুজ আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। চোখাচোখি
হতে বললেন, “তুমি বেকার ভয় পাচ্ছ। আমি তোমার কোনও ক্ষতি করব না।”
হঠাৎ
‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এলেন কেন? আবার কিছুক্ষণ পর তাকালাম। নাহ! আমারই মনের
ভুল। চোখদুটো একেবারেই স্বাভাবিক। কিছুক্ষণ আগে ট্রেনে ওঠার আগে ঘটে যাওয়া
দুর্ঘটনাটার জন্যই মস্তিষ্ক এসব কল্পনা করে নিচ্ছে। তিনি বললেন, “দরজার পাশে
দাঁড়িয়ে ভিজে যাচ্ছ তো। এসে বস এখানে। ট্রেন সময়মতো পৌঁছে যাবে, চিন্তা নেই।”
আমি
ভাবলাম, সত্যিই তো! বেকার ভয় পাচ্ছি। গুটি গুটি
পায়ে গিয়ে বসলাম আবার ওঁর সামনে। মনে হল যেন এই ট্রেনের চালক জেনে গেছে যে এতে
একটাই প্যাসেঞ্জার আছে যে একদম শেষ স্টেশনে নামবে। তাই আর মাঝের স্টেশনগুলিতে
দাঁড়িয়ে বেকার সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।
“বলছি,
জিওটালু গুহার কোনও কাথাই কি মনে নেই তোমার?”
“মানে?”
“আচ্ছা!
তাহলে এটার দিকে তাকাও দেখি কিছুক্ষণ।” বলে কাঁধের কাপড়ের ব্যাগ হাতড়ে একটা পিতলের
ঢাকনা দেওয়া কৌটো বের করলেন। সেটা খুলে অমসৃণ বাঁকা শঙ্কুর মতো একটা টুকরো এগিয়ে
দিলেন আমার দিকে।
আমি
সেটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলাম। কালচে বাদামি রঙের এবড়োখেবড়ো জিনিসটা সম্ভবত
কোনও জন্তুর শিং থেকে ভাঙা টুকরো। সেটা হাতের তেলোয় নিতেই সারা শরীর যেন
বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চিনচিন করে উঠল। তারপর সেটা এঁটে গেল চামড়ার সঙ্গে। এবার
যেটা ঘটল সেটা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করা অসম্ভব। জিনিসটা গলতে শুরু করল আমার
মুঠোর মধ্যেই। আমি ঘাবড়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেটা পড়ল না
হাত থেকে। মনে হল, জিনিসটা যেন ত্বকের ভিতর ঢুকে যেতে লাগল ক্রমশ। শিরা, উপশিরা,
ধমনীতে রক্তের সঙ্গে মিশে দৌড়তে শুরু করল শরীরের মধ্যে। গায়ের
তাপমাত্রা বাড়তে লাগল। খাড়া হয়ে উঠল সারা গায়ের সমস্ত রোম। হাতের খোলা অংশগুলিতে
চোখ পড়তে দেখি চাকাচাকা লাল লাল দাগ তৈরি হয়েছে। আর সেগুলি ফুলে উঠছে আস্তে আস্তে।
হার্টবিটের সঙ্গে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসও জোর হচ্ছে ক্রমশ।
আর
কিছু মনে নেই।
সংজ্ঞা
যখন ফিরল, চোখ খুলে দেখলাম ট্রেন দাঁড়িয়ে রয়েছে প্ল্যাটফর্মে।
গায়ে কেউ ধাক্কা দিচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে দেখি জি.আর.পি.। “উঠুন
দাদা, শেষ স্টেশন এসে গেছে।”
আমাকে
একাকি কামরায় ঘুমোতে দেখে ডেকে দিলেন। আমি তাঁকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে নামলাম নিচে।
বাইরে এসে অন্ধকারের মধ্যে জোরে হাঁটা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে
দেখি, দিব্যি চলছে। বারোটা কুড়ি। মানে
ট্রেনটা একটুও লেট করেনি।
মনে
পড়ল কিছুক্ষণ আগের কথা। ঘটনাটা কি সত্যি ছিল! না আমার স্বপ্ন? বাড়ি ফিরে সেদিন
খাওয়া সেরে আমার ঘরে গিয়ে সেই ডায়েরিটা বের করলাম খুঁজে পেতে। মনের
মধ্যে একটা অস্বস্তি লেগে রইল। বার বার মনে পড়ছে সেই লোকটার কথাটা। “জিওটালু
গুহার কোনও কথাই কি মনে নেই তোমার?”
নাহ!
আজ আর সারারাত ঘুম হবে না।
*
* *
জিওটালু...
জিওটালু... জিওটালু... একঘেয়ে একটা সুর যেন বাজছে কানের কাছে। মনে হচ্ছে, কতদূর
থেকে ভেসে আসছে আওয়াজটা। আমি অন্ধকারের মধ্যে পথ হাঁটছি। দীর্ঘ পথ। আমার সামনে
পিছনে আমারই মতো আরও দু’জন। সবারই হাতে, কোমরে, পিঠে ছোটোবড়ো আগ্নেয়াস্ত্র, আর বড়ো
বড়ো দা। জঙ্গলের ডালপালা কাটতে কাটতে সবাই এগোচ্ছি লাইন দিয়ে।
“আকাশের
রঙ লাল হতে এখনও অনেক বাকি। তার আগেই পৌঁছেতে হবে আমাদের।” ফিসফিস করে কেউ বলল
কথাটা কানের কাছে।
চারপাশে
বড়ো বড়ো ভিজে ঘাসের বন। পায়ের নিচে ভেজা মাটি আর তার সোঁদা গন্ধ মেশা বুনো হাওয়া।
লম্বা লম্বা গাছেদের সারি।
“ঠিক
জানো, এদিকেই আছে ওরা?”
“হ্যাঁ,
গুমর সিংয়ের কথা ভুল হবে না, স্যার। পুরো এই
জঙ্গলমহল আমার নখদর্পণে। বুনো মহিষগুলো প্রতি অমাবস্যার রাতে ঐ গুহার সামনে জড়ো
হয়। খোঁজ নিয়েছি আমি।”
“কিন্তু
কেন?”
“ঐ
গুহার ভেতরে নাকি ওদের দেবতা থাকে। স্থানীয় লোকেরা সবাই বিশ্বাস করে কথাটা।”
“টাঁড়বাড়ো!”
“যতসব
বোগাস! এসব বাজে কথা বিশ্বাস করার কোনও যুক্তি নেই। আর যদি কোনও বাধা আসেও আমাদের
রাইফেলের সামনে টিকে থাকতে পারবে বলে মনে হয় না।”
“সেটা
সময় এলেই বোঝা যাবে, সাহেব।”
“তবে
জনশ্রুতি যখন আছে, তখন ব্যাপারটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া কি ঠিক হবে, মিঃ পিটন?”
“এসব
জনশ্রুতি সবই প্রায় ভুয়ো, বুঝলে দাতা? অশিক্ষিত নেটিভরা কী দেখে, আর কী বলে সেই
নিয়ে মাথা ঘামালে আমাদের চলে না। ওপরতলার নির্দেশ, ট্রেনলাইন বসাতেই হবে। নইলে টন
টন আকরিক লোহা খনি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া যাবে না। আর লাইন পাতার জন্য জঙ্গল কাটতে
হবে। স্থানীয় আদিবাসীরা এ কাজ করতে রাজি হচ্ছে না।”
“বাইরের
শ্রমিক নিয়ে এসে লাগাতেও তো সুরাহা হল না কোনও।”
“হ্যাঁ,
রাতের অন্ধকারে জঙ্গল লাগোয়া কুলিদের তাঁবুতে বুনো মহিষের দল এসে আচমকা হানা দিচ্ছে।
বেশ কয়েকবার ঘটেছে ঘটনাটা।”
“শুনেছি
মারাও গেছে কয়েকজন। আর তাঁবু লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে প্রায় শ-খানেক বুনো মোষ।”
“সবথেকে
আশ্চর্যের বিষয়, অত মোষ দল বেঁধে যে কোথা থেকে আসছে, আর কোথায় গায়েব হয়ে যাচ্ছে
তার কোনও পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না।”
“ছ’মাসের
উপর হল বন্ধ হয়ে আছে লাইন বসানোর কাজ। কোম্পানির কত ক্ষতি হচ্ছে বুঝতে পারছ?”
“গুহাটার
নাম জিওটালু। সেখানে নাকি বুনো মহিষের দেবতার বাস।
টাঁড়বাড়ো।”
আর
কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটার পর সাহেব অধৈর্য হয়ে বললেন, “আর কতক্ষণ, গুমর সিং?”
“এসে
গেছি, সাহেব। ঐ তো আবছা অন্ধকারে আকাশের গায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়টা।
আর হয়তো তিনশো মিটার হবে।”
আরও
মিনিট পনের জঙ্গল ঠেলে এগোনোর পর গুমর সিং বলল, “আপনারা দাঁড়ান এই গাছের নিচে। আমি
উপরের ডালে উঠে দেখে আসি।”
“সেই
ভালো।”
গুমর
সিং নিজের বন্দুকটা পিঠে বেঁধে নিয়ে তরতর করে উঠে গেল উপরে। ঝুপসি গাছের পাতার
আড়ালে চলে যেতে সাহেব ফিসফিস করে আমার কানের কাছে বললেন, “দাতা, তুমি কি ভূতে
বিশ্বাস কর?”
“হঠাৎ
এ প্রশ্ন?”
“না,
মানে ভাবছি এই টাঁড়বাড়ো কি ভূত, না দেবতা? আমি অবশ্য এখানে আসার আগে পাদরির কাছ
থেকে মন্ত্রপূত ক্রস চেয়ে এনেছি। তিনি বলেছেন, কোনও শয়তান এর সামনে আসতে পারবে
না।”
বললাম,
“সাহেব, ভগবান যদি থাকেন তাহলে শয়তানও আছেন পৃথিবীতে। মানে একটা হল পজিটিভ এনার্জি
আর একটা নেগেটিভ।”
“হুম!
ঠিকই বলেছ কথাটা। এখন কথা হল, এই টাঁড়বাড়ো নামের জিনিসটি কি ভগবান না শয়তান?”
“জানি
না। তবে জঙ্গলের লোক তো দেবতাই বলে।
বুনো মহিষের দেবতা।”
গুমর
সিং যেমন নিঃশব্দে উঠেছিল গাছে, তেমনই চুপচাপ নেমে এল। ফিসফিস করে জানাল, “দলে দলে
মহিষরা যাচ্ছে গুহার দিকে। আসুন আমার পিছনে। তবে খুব সাবধান। বেশি শব্দ করবেন না।”
আমরা
আবার এগোলাম। কিছুটা এগিয়ে সামনে পড়ল একটা খাদ। খাদের ওপারে নিচু জমিতে অন্ধকারের
মধ্যে মিশমিশ করছে কালো পাথরের মতো চলন্ত বুনো মোষগুলি।
মাথায় পাকানো সিং নিয়ে তারা এগিয়ে চলেছে গুহার দিকে। কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে আমরা
তাকিয়ে রইলাম। ধীরে ধীরে কমে এল তাদের সংখ্যা। গুমর সিং ইশারায় জানাল, এবার এগোনো
যাক।
গাছের
ডালপালা খামচে ধরে খাদের ধার দিয়ে নেমে এলাম আমরা। পাথুরে মাটির উপর দিয়ে বয়ে
চলেছে জলের স্রোত। আঁশটে বুনো গন্ধ। আচমকা একটা
নিশাচর পাখি তীক্ষ্ণ শব্দ করে উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। আমরা মোষের পায়ের দাগ লক্ষ
করে এগিয়ে চললাম। মোষের দল তখন এগিয়ে গেছে অনেকটা।
গুহার
মুখটা দূর থেকে যতটা ছোটো মনে হচ্ছিল, এখানে এসে দেখলাম তা নয়। সেটা বেশ বড়ো আর নিচে
নেমে গেছে। আমরা চারমূর্তি এগোলাম সন্তর্পণে। একটা বড়ো পাথরের চাতাল পেরিয়ে পথটা
ভিতরে ঢুকেছে। অন্ধকারের মধ্যে বাইরে নক্ষত্রদের মৃদু আলোতে চোখ সয়ে গিয়েছিল
এতক্ষণে। মোটামুটি দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু এখানে
তো সেই আশা একেবারেই নেই।
পিটন
সাহেব টর্চ জ্বালাতে যেতেই গুমর সিং খপ করে হাতটা চেপে ধরে ধরা গলায় বলল, “কী
করছেন সাহেব? আলো জ্বালালে ওরা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যাবে।”
“কিন্তু
কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।”
“একটু
ধৈর্য ধরুন। একটু পরে এটাও সয়ে যাবে চোখে।”
আমরা
অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে চললাম ভিতরে। উঁচুনিচু জমিতে ঠোক্কর খেতে খেতে। আস্তে
আস্তে ফিরে পাচ্ছিলাম দৃষ্টিশক্তি। কিন্তু সেটা খুবই ক্ষীণ। বুনো মোষেদের গা থেকে
বেরনো একটা বোঁটকা গন্ধে ভরে আছে জায়গাটা। যত ভিতরে ঢুকছি তত যেন দম বন্ধ হয়ে
আসছে। গুমোট আবহাওয়াটা অসহ্য হয়ে উঠছে ক্রমশ। জ্বলজ্বল করছে শুধু মোষেদের সবুজ
চোখগুলি।
জাবর
কাটার মতো ঘোঁতঘোঁতানির আওয়াজের মাঝে কানে এল উচ্চৈঃস্বরে ঘড়ঘড় শব্দ। অনেকটা ভিতর
থেকে আসছে আওয়াজটা। দেখলাম সারিবদ্ধভাবে মোষগুলি দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রত্যেকেরই
কানগুলো খাড়া।
গুমর
সিংয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চুপি চুপি বললাম, “ব্যাপারখানা কী?”
“দেবতা
টাঁড়বাড়ো মোষেদের কানে মন্ত্র দিচ্ছেন।”
“তা
এমন ঘড়ঘড় করে শব্দ করছেন কেন?”
“মোষেদের
মন্ত্র তো তাদের ভাষাতেই হবে। মানুষের
ভাষায় বললে মোষেরা কি বুঝতে পারবে?”
“তা
ঠিক।”
সাহেব
জানতে চাইলেন, “টাঁড়বাড়োকে তো দেখা যাচ্ছে না?”
“তিনি
আছেন অনেক গভীরে। তাঁকে দেখা অত সহজ নয়।”
“তার
জন্যই তো এত কষ্ট করে আসা। চল, আরও এগোনো যাক।”
সাহেবের
নির্দেশে মৃত্যুকে হাতে নিয়ে অন্ধকার গুহার আরও অভ্যন্তরে এগিয়ে চললাম আমরা। একটা
জিনিস তো মানতে হবে, আমরা সবাই মহামহিম দোর্দণ্ডপ্রতাপ কোম্পানি বাহাদুরের বেতনভুক
কর্মচারী মাত্র। আমাদের প্রাণের দাম সামান্যই। তার
থেকে অনেক মূল্যবান কোম্পানির ব্যাবসা, বাণিজ্য। আর সেই জন্য প্রয়োজন আকরিক লোহা।
লোহা রফতানির জন্য দরকার রেললাইন। এবং সেই কারণে পথের কাঁটা মুখ্যুসুখ্যু
বনবাসীদের দেবতা টাঁড়বাড়োকে সরিয়ে দিতে হবে পৃথিবী থেকে। এমনই নির্দেশ এসেছে।
অগণিত
মোষগুলি জড়ভরতের মতো দাঁড়িয়েছিল সার দিয়ে। আমরা পাথরের
দেওয়ালের গা ঘেঁষে এগোচ্ছিলাম পা টিপে টিপে। বিশাল বড়ো গুহাটা ধাপে ধাপে নেমে গেছে
নিচে।
হঠাৎ
একটা চিৎকার কানে এল পাশ থেকে। কী
ব্যাপার! আমাদের মধ্যেই একজন পড়ে গেছে পাথরে পিছলে। আর সেই মুহূর্তেই জ্বলে উঠেছে
সাহেবের টর্চ। জোরালো আলোয় ধাঁধিয়ে গেল সবার চোখ। মোষগুলির মধ্যেও একটা হুড়োহুড়ি
পড়ে গেল। একমুহূর্ত দেরি না করে গুমর সিং লাফিয়ে গিয়ে একটা চাপড় মেরে ফেলে দিল
টর্চটা। মেঝেতে পড়ে সশব্দে ভেঙে নিভে গেল সেটা। আবার ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু
অন্ধকারের মধ্যেই কানে এল একটা ঘড়ঘড়ানি শব্দ। জোড়া জোড়া সবুজ চোখগুলি ঘুরে গেল
আমাদের দিকে। ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল এদিকে।
কাঁপা
গলায় গুমর সিং বলল, “পালাও! পালাও! নইলে সবাই মারা পড়বে!”
কিন্তু
পালাব কোন দিকে? গুহার কোল ঘেঁষে নেমে এসেছি অনেকটা। সামনে-পিছনে শুধু শয়ে শয়ে
বুনো মোষ। আর তারা আমাদের জীবিত যেতে দেবে বলে মনে হয় না। কারণ, তাদের প্রভু
টাঁড়বাড়ো নির্দেশ দিয়েছে আমাদের খুরের তলায় পিষে শিং দিয়ে গুঁতিয়ে মেরে ফেলার
জন্য। মোষগুলো দলবদ্ধভাবে এগোচ্ছে আমাদের দিকে। আমরা পিছোচ্ছি এক-পা এক-পা করে।
ঠিক
সেই সময়ে গর্জে উঠল সাহেবের রাইফেল। বন্দুক আমার হাতেও ছিল। কিন্তু ফায়ার করার
সাহস পাচ্ছিলাম না। আমাদের এক-একজনের কাছে সর্বসাকুল্যে দশ থেকে কুড়ি রাউন্ড গুলি
রয়েছে। কিন্তু প্রতিপক্ষের সংখ্যাটা এর থেকে
অনেক বেশি। এরা যদি সবাই মিলে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে এই কার্তুজগুলি কোনও
কাজেই আসবে না। কিন্তু পিটন সাহেব এসব সামনে পিছনে না ভেবে গুলি চালিয়ে বসলেন।
ফলে
যা হওয়ার তাই হল। একটার মাথায় গুলি লাগতেই তার ভবলীলা সাঙ্গ হল। আর বাকি বুনো
মোষেরা প্রবল আক্রোশে ঘিরে ধরল আমাদের। আলো বন্ধ করে রাখার আর কোনও মানে হয় না।
জ্বলে উঠল আমার টর্চ। সাহেব চিৎকার করে উঠলেন, “ফায়ার!”
মুহুর্মুহু
গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠল পাথরের দেয়াল। গমগমে কানফাটা আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হতে থাকল
গুহার মধ্যে। মোষগুলি ধুপধাপ শুয়ে পড়তে লাগল এর ওর গায়ের উপর। কিছুক্ষণ ছটফট করেই
নিথর হয়ে যাচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পাথরের মেঝে। কিন্তু ওদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই।
একে একে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমরা সবাই মিলে পালা করে গুলি চালাতে চালাতে গুহার
মুখের দিকে পিছু হটছি।
কিন্তু
বেরোনোর পথ এখনও অনেক দূর। গুলি কমে আসছে স্টকে। এর মধ্যেই তীক্ষ্ণ শিসের মতো শব্দ
এল একটা কানে। সারা শরীর কেঁপে উঠল আচমকা। তারপরেই হুড়মুড় করে তেড়ে এল ওরা সবাই এক
সঙ্গে।
সাহেবকে
দেখলাম পিঠের ব্যাগ হাতড়াতে। তারপরেই একটা ডিনামাইট বের করে আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে
দিলেন গুহার ভিতরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুনের ঝলকানির সঙ্গে কানফাটা এক বিস্ফোরণ। কেঁপে
উঠল গুহাটা, ভিতরে পাথরের চাইগুলি খসে খসে পড়ছে তার। কানে তালা লেগে গেছে আওয়াজের
ঠেলায়। ধোঁয়ায় ঢেকে গেল চারপাশ। বুনো মোষগুলি এবার থমকে গেছে। তারপর পিছন ফিরে দৌড়
দিল দুড়দাড় করে।
আর
সেই ধোঁয়ার মধ্যে দেখলাম একটা মোষের পিঠে চড়ে কালো চাদর মুড়ি দিয়ে বেরিয়ে গেল
একজন। সাহেব চিৎকার করে বললেন, “ধর ওকে!”
আমিও
দৌড় লাগালাম। গুহা থেকে বেরিয়ে হাতে উঠে এসেছে রিভলভার। একটার
পর একটা গুলি করে চলেছি সেই ছায়ামূর্তিকে লক্ষ্য করে। জঙ্গলের মধ্যে পশুপাখিরা তটস্থ
হয়ে চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে ভোররাতে। সাহেবও দৌড়চ্ছেন আমার সঙ্গে। ক্রমাগত
ফায়ার করে চলেছেন ছুটতে ছুটতে। আলো ফুটতে
শুরু করেছে সবে। বনের মধ্যে লম্বা লম্বা গাছের পাতা ফুঁড়ে নেমে আসছে আলোর রেখা। সেই
আলো-আঁধারের মধ্যেই ব্ল্যাক ম্যাজিকের মতো ভ্যানিশ হয়ে গেল লোকটা। আমরা বেশ
কিছুক্ষণ দৌড়ে গেলাম এদিক-ওদিক। কিন্তু কোথায় যে মিলিয়ে গেল লোকটা আর হদিশই পাওয়া
গেল না। আশ্চর্য!
পিছন
পিছন হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এল গুমর সিং আর বড়োবাবু। সাহেব ওদের দেখে উত্তেজিত হয়ে
বললেন, “আমার গুলিটা লেগেছে। আমি নিশ্চিত। জঙ্গলের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে সে। আহত
অবস্থায় বেশি দূর যেতেও পারবে না।”
কথাটার
মধ্যে সত্যতা ছিল। তার প্রমাণ আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই পেলাম হাতেনাতে। একটা
মহীরুহর নিচে গুল্মলতার উপর রক্তের দাগ পাওয়া গেল। একদম টাটকা। সেটা দেখে সাহেবের
ঠোঁটে ফুটে উঠল ক্রূর হাসি।
“কী
হে, গুমর সিং? ইনি দেবতা না সাঁওতাল? মোষের নয়, এটা মানুষের রক্ত।
দেখে চিনতে পারছ তো?”
গুমর
সিং চুপ। সাহেব আবার বলে উঠলেন, “একটা নেটিভ লোক, বুনো মোষের ভাষা রপ্ত করে তাদের
লেলিয়ে কোম্পানির কাজে ব্যাগড়া দিচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। টাঁড়বাড়ো, বুনো মহিষের দেবতা!
যত সব মূর্খের মতো কথা। আর সেই ভয়ে সব কাজ শিকেয় উঠেছে।
একবার ধরতে পারলে ব্যাটাকে গুলি করে মারব।”
আমরা
চারজন ছড়িয়ে পড়লাম চারদিকে। ঘন জঙ্গলে চিরুনি তল্লাশি করার জন্য আরও বেশি লোকজন
প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ক্যাম্পের ফোর্সকে খবর পাঠালে তারা আসতে আসতে হয়তো আমাদের
অপরাধী চলে যাবে হাতের বাইরে। এই ঘন জঙ্গলে বেশি দূরে চলে গেলে তাকে আর খুঁজে
পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। সেজন্য সাহেব রিস্ক নিতে চাইলেন না। আর এটাই ছিল
সবথেকে বড়ো ভুল।
কারণ,
মিনিট কুড়ির মধ্যেই বিকট আর্তচিৎকারে মৃত্যুর প্রথম পাঞ্জা টের পেলাম আমরা।
স্বাভাবিকভাবেই বড়োবাবু বয়েসের ভারে শারীরিক ক্ষিপ্রতা হারিয়েছেন। আর তিনিই হলেন
টাঁড়বাড়োর প্রথম শিকার। আওয়াজ শুনে আমরা দৌড়ে এলাম। ঝোপের নিচে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন।
সকালের রোদ পাতার ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে মুখের উপর। গোল গোল খোলা চোখে ভয়ার্ত চাহনি।
গলার নিচে বিঁধে আছে একটা পালকের হূল। শরীরে আর কোনও ক্ষত নেই। পিটন সাহেব এগিয়ে
এসে বসলেন পাশে। খুঁটিয়ে দেখে পালকটা তুলে নিলেন।
“ভেরি
স্ট্রেঞ্জ! ইটস অ্যা ব্লো পাইপ।”
পালকের
গোড়ায় বাঁধা বিষাক্ত কাঁটা।
“এখানেই
আছে সে। খোঁজ, দাতা। তোমরা দু’জন দেখ ওদিকে।
আমি এদিকটা দেখছি।”
আবার
শুরু হল তল্লাশি। দেখে নিলাম রিভলভারের সবক’টা খোল ভরা আছে কি না। তারপর এগিয়ে
চললাম জঙ্গল কেটে। গুমর সিং আমার পিছনে। ওর হাতেও উদ্যত রাইফেল। চারদিকে সতর্ক চোখ
ঘুরছে লাটাইয়ের মতো। বেশ অনেকক্ষণ ধরে জঙ্গল এফোঁড়-ওফোঁড়
করেও কিছু দেখতে পেলাম না।
হঠাৎ
কানে এল গুলির শব্দ। অনেকটা দূর থেকে। পিটন সাহেবের রাইফেলের আওয়াজ এটা। আবার
একটা। আমরা ততক্ষণে আওয়াজ লক্ষ করে দৌড়তে শুরু করেছি তিরবেগে।
আবার আওয়াজ, এবার পিস্তলের। পরপর ছ’টা। তারপরেই বীভৎস চিৎকার। কানে আসতেই রক্ত হিম
হয়ে গেল।
সেখানে
যখন পৌঁছলাম, সব শেষ। সাহেব মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত। রক্তে
ভেসে যাচ্ছে। গুমর সিং কাঁপতে কাঁপতে বলল, “বুনো মহিষের খুরের দাগ। পায়ের তলায়
পিষে দিয়েছে।”
পিটন
সাহেবের মুখ থেকে শেষ শব্দ যেটা বেরোলো, সেটা হচ্ছে, “শয়তান! শয়তান!”
তারপরেই
কানে এল একটা অদ্ভুত আওয়াজ। কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম, একপাল বুনো মোষ তেড়ে
আসছে এদিকে। আমাদের দু’জনের শারীরিক আর মানসিক অবস্থা তখন আর স্বাভাবিক ছিল না।
প্রাণভয়ে দৌড় দিল গুমর সিং। আর তার পিছনে আমি। জীবনে অত জোরে আর কোনও দিন ছুটেছি
কি না জানি না।
চার-পাঁচশো
মিটার ছোটার পর সামনে পড়ল একটা গভীর খাদ। নিচে দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী। পিছনে
একবার তাকালাম ঘুরে। কয়েকশো বুনো মোষ তেড়ে আসছে যমদূতের মতো। সোজা
ঝাঁপ দিলাম নদীতে। জলে পড়ার সময়ে শুধু খেয়াল হল অনেক উপরে মোষেদের সারির মাঝে একটা
বড়সড় মোষের পিঠে বসে আছে এক কালো জোব্বা পরা লোক।
হিংস্র চোখদুটি তার সবুজ। আর মাথায় দুটো শিং!
খাদের
ধার দিয়ে তারা নামছে হুড়মুড়িয়ে। আমরাও হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে নদীটা পেরিয়ে উঠলাম
ওপারে। তারপর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আবার দৌড়। পাহাড়ের কোলে একটা লুকোনোর
মতো জায়গা পেয়ে ঢুকে গেলাম। পাথরের কোল
দিয়ে সরু রাস্তা চলে গেছে ভিতর দিকে। ভিতরটা অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে।
যত
এগোচ্ছি তত কমছে আলো। গুমর সিং হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এটা একটা গুহা।”
“কিন্তু
কোনদিকে গেছে এটা?”
“জানি
না। মাথা আমার গুলিয়ে গেছে।”
সে
মিনমিন করে নিজের মনে বলে যেতে লাগল কত কথা। কিছু কানে ঢুকল, কিছু ঢুকল না।
“কবে
থেকে শুনে আসছি এই বুনো মহিষের দেবতা টাঁড়বাড়োর কথা। কেউ আজ পর্যন্ত তাকে চোখে
দেখেনি। যারা দেখেছে, তারা আর বেঁচে নেই। আমার ছোটোবেলায়, তখন রংপুরে থাকি, একবার
বুনো মোষে ওমরজীর খেতের ফসল নষ্ট করেছিল। ফলে বন্দুক নিয়ে তিনি জঙ্গলে ঢুকেছিলেন
মোষেদের তাড়া করে। ভোররাতে দূর থেকে গুলি করতে যাবেন, এমন সময়ে কালো জোব্বা পরা টাঁড়বাড়ো
সামনে এসে দু’হাত তুলে দাঁড়ালেন। ওমরজী ভয় না পেয়ে গুলি চালালেন দু’বার। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট
হল। তার ক’দিন পর তাঁর লাশ পাওয়া যায় নদীর তীরে বালির উপর।
ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত শরীর। চারপাশে কয়েকশো মোষের খুরের চিহ্ন। মাঝরাতে নিজের ঘর
থেকে জঙ্গল পেরিয়ে তিনি কী করে যে নদীর পাড়ে এলেন তা কেউ জানে না।
“দাদু
বলতেন, টাঁড়বাড়ো মানুষ আর মোষের শঙ্কর। আদি অনন্তকাল থেকে রক্ষা করে চলেছে
অরণ্যকে। এই নিবিড় বনানী, রাশি রাশি গাছ, মহীরুহ, বন্য আদিবাসী, এদের একমাত্র
রক্ষাকর্তা তিনি। যখনই সভ্যতার কালো ছায়া সবুজকে ধ্বংস করে বিজয়ধ্বজা ওড়াতে
চেয়েছে, তখনই তিনি কোনও মানুষের মধ্যে নিজের বীজ বপন করে আটকে দিয়েছেন সেই
ষড়যন্ত্র।”
* * *
প্রোজেক্টের
সার্ভে রিপোর্ট সমেত প্ল্যানের ব্লু-প্রিন্টটা গায়েব হয়ে গেছে। গোটা অফিস তন্ন
তন্ন করে খুঁজেও তার হদিস পাওয়া গেল না। আমাদের বসের বস শৈলেন্দর ধনোরিয়া রেগেমেগে
এসে হাজির হলেন আমাদের সাইট অফিসে। যা নয় তাই বলে গালাগালি দিলেন সমস্ত
কর্মচারীকে। নির্দেশ দিলেন আগামী তিনদিনের মধ্যে যেভাবেই হোক আবার তৈরি করতে হবে
প্রজেক্টের ব্লু-প্রিন্ট। ওটা না দেখাতে পারলে বিদেশি লগ্নি আসবে না। ফলে প্রজেক্টটাই
বাতিল হয়ে যাবে।
কিন্তু
অবাক কাণ্ড! পরের দিন সাইট থেকে তিন কিলোমিটার দূরে শৈলেন্দর ধনোরিয়ার মৃতদেহ
পাওয়া গেল। ক্ষতবিক্ষত চেহারা। আর কয়েকশো মোষের খুরের দাগ।
আমি
নিজের অজান্তে মাথা চুলকাতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলাম, ব্রহ্মতালুর দু’পাশে কোঁকড়ানো
চুলের নিচে দুটো শিংয়ের মতো কিছু একটা গজিয়েছে।
_____
অলঙ্করণঃ পুষ্পেন মণ্ডল
আমার কিছু প্রশ্ন আছে? প্রথমে একটা লোক মাথা ফেটে পরে রইলো, ওকে আসলে কে মারলো? ট্রেন এ লেখক এর সঙ্গে কার কথা হচ্ছিলো? লেখক কে কে প্রথমে ধাক্কা মেরেছিলো?
ReplyDeleteলেখক দৌড়াতে গিয়ে মোষের সাথে আচমকা ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছিল। দুর্ঘটনাবসত মোষের গাড়ি চালক মারা যায় লেখকের ঘুঁসিতে। আর ট্রেনে যাঁর সাথে লেখকের কথা হচ্ছিল তিনি কে? এই প্রশ্নের উত্তর গোটা গ্লপে দেওয়া নেই। তবে ধরে নিতে পারেন সে লেখকেরই অবচেতন মন।
ReplyDeleteমনে হল হঠাৎ করে লেষ হয়ে গেলো। সব কটা পয়েন্ট মিলল না। স্টেশনে মোষের গাড়ি চালকের মৃত্যুটার কি প্রয়োজন ছিল?
ReplyDeleteট্রেনের লোকটা ওর বিবেক মানলাম। বাটি টারবারোর ঘটনাটা শেষ হল না তো!!