গল্পের ম্যাজিক:: ডিম - ঋজু গাঙ্গুলী


ডিম
ঋজু গাঙ্গুলী

জলার যেদিকটা গাছের ছায়া আর নদীর বাঁক থেকে আসা ঠাণ্ডা হাওয়ায় বেশ গা-জুড়োনো রকম হয়ে থাকে, হলুদ গোলাটা মাথার ওপর চড়লে সেদিকটায় ভিড় হয়ে যায়।
বিরক্ত হয়ে নিজের পছন্দসই কাদার ঢিপিটার গায়ে শরীরটা ছেড়ে দিতে গিয়ে লগের মনে হল, ওর মতো একজন হিরোর অন্তত একটা নিজস্ব, ক্যাচোড়ম্যাচোড় থেকে মুক্ত বসার জায়গা পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এই জলায়, যেখানে এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই সবাই সবকিছু ভুলে যায়, সেখানে বেশ কয়েক মাস আগে ওর অ্যাডভেঞ্চার, তা যতই রোমহর্ষক হোক না কেন, অ্যাদ্দিনে কারও আর মনে নেই। ফলে জলার জন্তুরা তো বটেই, এমনকি উড়ুক্কুদের নিত্যনতুন ঝাঁক দিনের এই সময়টায় এখানে রীতিমতো আড্ডা জমায়। কয়েক মাস আগে জলার বাসিন্দাদের জীবনে যে বিপদ ঘনিয়েছিল, তাতে বিপত্তারণ হিসেবে অবতীর্ণ বৃদ্ধ স্টেগোসরাসটি ঠিক কী করেছিল, তা কারও মনে থাকে না বলে লগকে কোনওরকম বেশি খাতির করার কথাটাও তাদের খেয়াল হয় না তবে লগ নিজে সেই ঘটনাবহুল দিনটা, আর তারপরের সাঙ্ঘাতিক রাতটা কোনও দিন ভুলতে পারবে না।
আরও একজন হয়তো ভুলতে পারবে না তবে গত কয়েক মাসে তার কোনও পাত্তা পায়নি লগ। কিঁর হল কী?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বড়ো বড়ো মশা আর মাছিগুলোকে উপেক্ষা করে চোখ বুজতে গিয়ে হঠাৎ একটা জিনিস লগের নজরে পড়ে। পাহাড়ের যেদিকটা ঘন জঙ্গলে ঢাকা, সেদিকের বাসিন্দারা সচরাচর জলার এতটা গভীরে আসে না। অথচ অন্যদের তুলনায় ছোটোখাটো চেহারার একটা ডাইনোসরের ঝাঁককে লগ দেখে জলার ধারে উগ্র বেগুনি, টকটকে লাল, আর গাঢ় নীল ফুল আর ফলে ভরা নরম গাছ আর পানায় মুখ দিয়ে খাবার খুঁজতে। কয়েক মাস আগে হলে কী হত তা বলা যাচ্ছে না, তবে এখনকার লগ নিজের অজান্তেই কয়েকটা জিনিস খেয়াল করে।
প্রথমত, এই ঝাঁকে বড়ো পুরুষ নেই বরং মা আর শিশুরাই আছে।
দ্বিতীয়ত, সম্পূর্ণ নতুনরকমের লতাপাতার মধ্য থেকে নিরাপদ খাবার খুঁজতে গিয়ে জ্ঞান নয়, বরং মায়েদের অনুভূতিকেই কাজে লাগাচ্ছে এই দলটা।
অর্থাৎ, সচেতনভাবে তাড়া খেয়ে পালানো নয়, বরং দলের মাতৃস্থানীয়াদের নেতৃত্বে ছোটোদের একটা দল তাদের নিজস্ব বাসভূমি ছেড়ে এই জলায় এসেছে কিছু বা কারও খোঁজে কার খোঁজে জলার গভীরে এসেছে আদতে শুকনো পাহাড়ি বনের বাসিন্দা ড্রায়োসরাসদের এই দলটা?
“ওরা আমাদের খুঁজছে” তীক্ষ্ণ গলাটা শুনে লগ আঁতকে ওঠে কারণ, আশেপাশের হাজার একটা আওয়াজের মধ্যে কখন যে একটা বিশেষ টেরোড্যাকটাইল ওর ঘাড়ের কাছেই একটা ডালের ওপর এসে বসেছে, সেটা ও বুঝতেই পারেনি।
“অবশেষে আমাদের মাথা ঘামানোর মতো কিছু হয়েছে” কিঁর গলায় চাপা উত্তেজনাটা আর কেউ না বুঝলেও লগ ভালোই টের পায় কারণ, গত কয়েকটা মাস নিজের ঝিমধরা জীবনের ফাঁকে সুযোগ পেলেই ও নিজেও এই মুহূর্তটার অপেক্ষায় থেকেছে

জলার ছায়াঘেরা ভেজা জায়গাটা ছাড়তে ওর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না কিন্তু ওই হট্টগোলের মধ্যে যে কোনও সুস্থ আলোচনা সম্ভব নয়, এটা লগ বুঝেছিল। তাই কিঁর অধৈর্য ডানা ঝাপটানি সত্ত্বেও ড্রায়োসরাসদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো এবং বয়স্ক দুই মহিলার কাছে নিজের ও কিঁর পরিচয় দিয়েই ও মাথা আর লেজ ঝাপটে জলার অন্যপ্রান্তে একটা টিলার দিকে ইঙ্গিত করেছিল।
টিলাটার নির্জন অবস্থান কিঁর পছন্দ হয়েছিল। ড্রায়োসরাসদের দলটাও দুদ্দাড় করে সেদিকেই এগিয়েছিল জলার বাকি বাসিন্দাদের সাময়িক কৌতূহলের কারণ হয়ে। টিলাটায় যে শান্তিতে আলোচনা করা যাবে, সেটা লগ নিশ্চিতভাবে জানত। ট্রাইসেরাটপসদের পুরনো আড্ডার কাছে বলে ওই জায়গায় সচরাচর অন্য জন্তুরা যেতে চায় না। লগ আর কিঁ ওখানে যেতে পারে কারণ, ওদের চ্যালেঞ্জ করার ঝুঁকি ইদানিং কেউ নিতে চায় না। কয়েক মাস আগে কী হয়েছিল সেটা মনে থাকুক, বা না থাকুক
“আমাদের ডিমগুলো হারিয়ে যাচ্ছে” কোনওরকম বাজে কথা বলে সময় নষ্ট না করে একেবারে সোজাসুজি কাজের কথায় আসে নতুন জন্তুদের দলনেত্রী।
হতাশ হয় লগ। শুধু এই জলার চারপাশেই ডিমচোর কত যে ডাইনোসর ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই নিঃসন্দেহে পাহাড়ের ওপরে ঘন জঙ্গলের চারপাশেও এমন অনেক প্রজাতি আছে। তাদের লম্বা হাত থেকে কারও আস্তানাকে বাঁচানোর জন্য পাহারা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না লগের
“আপনারা নিশ্চয়ই পাহারা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন?” নরম গলায় জিজ্ঞেস করে কিঁ।
লগ অবাক হয়ে ভাবে, অন্য সময়ে ধারালো, এমনকি অভদ্র আর হিংস্র গলায় কথা বলা কিঁ মহিলাদের সঙ্গে কথা বলার সময় কত নরম হয়ে যায়! কিছুক্ষণ ইতস্তত করে দলনেত্রী। তার পেছনে একটা গুমরানো কান্নার রোল ওঠে হঠাৎই। বেশ কয়েকটি শিশু ও মহিলার গলার আওয়াজ এক সঙ্গে বেরোতে চেয়ে জট পাকিয়ে যায়। কিছুটা হতবুদ্ধি হয়েই লগ সেই জটিল শব্দসমষ্টির মধ্যে কয়েকটা অদ্ভুত কথা শুনতে পায়।
“খারাপ গন্ধ
“সর সর শব্দ
“পিষে ফেলেছিল একেবারে!”
কারো কথায় বাধা দেয় না ওরা। কিঁ লগের খুব কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, “গণ্ডগোল, বিস্তর গণ্ডগোল!”

জঙ্গলের এইসব এলাকা দানবের শাসন থেকে দূরে হলেও জলার জন্তুরা সচরাচর পাহাড়ের এইদিকে আসতে চায় না। লগ শুনেছে, এই এলাকায় নাকি খুব সাঙ্ঘাতিক সব বিপদ থাকে, যাদের এমনকি দানবও এড়িয়ে চলে। আর সেই এলাকায় স্থানীয় জন্তুদের একটা দলকে প্রায় নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে আসছিল লগ। এটা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না অবশ্য ওদের। দলের মহিলা আর শিশুদের কথার মধ্য থেকে বোঝার মতো কিছু আদায় করা যাচ্ছিল না কিছুতেই, শুধু এটুকু ছাড়া যে ছোটোখাটো ডাইনোসরদের এই ঝাঁকের প্রতিটি সদস্যই খুব ভয় পেয়েছে।
ঠিক জেরা করে নয়, বরং দুলকি চালে হেঁটে আসার ফাঁকে খুচরো প্রশ্ন তুলে ওরা জানতে পেরেছিল, দলের একাধিক পুরুষ এই ডিম চুরি ঠেকানোর জন্য পাহারা দিতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেছে। তার ফলেই ওদের দলটা ভেঙে গেছে। আর এখন এই মহিলা আর শিশুদের দলটাকে কিছুটা নিরাপত্তা আর কঠিন প্রশ্নের সহজ উত্তর দেওয়ার জন্যই লগ আর কিঁকে সরেজমিনে তদন্ত করতেই হবে।

নিজের ভারী শরীরটা নিয়েও পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরছিল লগ ছোটো ছোটো ঝোপ নয়, বরং বেশ গভীর জঙ্গল শুরু হয়েছে ড্রায়োসরাসদের আস্তানার নিচ থেকেইআগুনপাহাড় এখান থেকে খুব একটা দূরে নয় বলেই হয়তো জায়গাটা উঁচু হলেও ঠান্ডা হাওয়ার বদলে গরম, ঝাঁঝালো গন্ধের বাতাসের একেকটা ঝাপটা উঠে আসছিল জঙ্গলের দিক থেকে নিজের স্মৃতি হাতড়ে লগ বুঝেছিল, পাহাড়ের ঠিক নিচ দিয়েই বয়ে গেছে একটা লুকোনো নদী, যেটা আগুনপাহাড়ের গরম স্রোতের সঙ্গে মিশে গেছে ওদের পায়ের অনেক নিচে, পাথর আর মাটির গভীর অন্ধকারে। সেজন্যই তৈরি হয়েছে অদ্ভুত ধোঁয়া ধোঁয়া একটা পরিবেশ। ফলে ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে খুব অল্প দূরত্বেই কী ঘটছে বা কে সেখানে আছে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
লগের মাথার ওপর চক্কর কেটে পুরো জায়গাটা দেখে নিচ্ছিল কিঁ। ড্রায়োসরাসদের আড্ডার কাছে থাকা একটা লম্বা গাছের মাথায় বসে ভাঁটার মতো চোখজোড়া মেলে ও ডানা মেলল এবার।
নাক দিয়ে একটা জোরালো আওয়াজ করে দলনেত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল লগ। কিঁ আর ও মিলে জায়গাটা দেখে যা বুঝেছে সেটা সবার সঙ্গে খোলসা করা দরকার বিশেষত নদীর বাঁকের ওপরে আকাশটা লাল-কমলা হয়ে এবার যখন বেগুনিরঙা হয়ে উঠছে
ইতিমধ্যে দলের পুরুষেরা এসে যোগ দিয়েছে ওদের সবার সঙ্গে। তাদের হাবভাব দেখে ওরা বুঝতে পারছিল, এখানে যে সমস্যাই হোক না কেন, সেটার সমাধান করার বদলে পালিয়ে যেতে পারলেই তারা বাঁচে। এটাও কয়েকজন স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে জলা থেকে লগ আর কিঁকে ওদের নিজস্ব সমস্যায় জড়ানো বা তাতে ওদের নাক গলানোর মতে সায় ছিল না ওদের। কিন্তু বয়স্কা দলনেত্রীর কথার ওপর কারও কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। অগত্যা
“আপনাদের এই জায়গাটা বড়ো অদ্ভুত” কথাটা শুনতে খারাপ শোনালেও এটা বলেই শুরু করে কিঁ।
দলের বাচ্চাদের মধ্যে এতে অস্থিরতা তৈরি হলেও মহিলারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। আরও একবার লগের মনে হল, মা হিসেবে এই দলের মহিলারা নিঃসন্দেহে এই এলাকার গোলমেলে ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছেন কিন্তু দুটো কারণে তাঁরা সেটা বলছেন না।
প্রথমত, কথাগুলো কেউ মানতে চাইবে না বা তার পেছনে অন্যরকম কারণ খুঁজবে।
দ্বিতীয়ত, সমস্যাটার সমাধান হবে না তাতে বরং এই জঙ্গল ছেড়ে অচেনা পরিবেশে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া এই দলটার কাছে আর কোনও রাস্তা থাকবে না সেক্ষেত্রে।
“এখানে অন্য কোনও প্রাণী হামলা করা তো দূরের কথা, এদিকে আসতে গেলেই তারা আপনাদের নজরে পড়বে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনাদের আস্তানা থেকে ডিম চুরি হচ্ছে এটা যে আপনাদের দলের মধ্যে কেউ করছে না, সেটা আপনারা আগেই নিশ্চিত করেছেন। তাই আমি আর ওই নিয়ে কিছু বলছি না। তাহলে চোরের এদিকে আসার মাত্র একটাই রাস্তা পড়ে থাকে” কথা না বলে ডানা তুলে দিকটা দেখিয়ে দেয় কিঁ।
নিজের বুদ্ধির ওপর আস্থা ফিরে আসে লগের। কারণ, জায়গাটা খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে ওরও একই কথা মনে হয়েছিল। এই আস্তানার নিচে জঙ্গলটা ঘন হলেও ধাপ কাটা। পাথর আর মাটির সেই ধাপগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ডিম পাড়ে ড্রায়োসরাসরা। এতে সেগুলোকে নজরের বাইরে যেমন রাখা যায়, তেমনই ভেজা ভেজা অথচ গরম একটা পরিবেশ পায় ডিমগুলো।
“ওই ধাপগুলোতে ওঠা খুব একটা সহজ কাজ নয়,” বলে চলে কিঁ, “বিশেষত রাতে যখন ধাপগুলোর মুখে আপনারা পাহারা দেওয়ার জন্য দলের পুরুষদের মোতায়েন করছেন। অথচ
বাকিটা বলতে হয় না কারণ, দলের ভয়ার্ত সদস্যদের কাছ থেকে অনেক কষ্টে উদ্ধার করা কথাগুলো লগের এবং দলের সবার মনে পড়ে।
“একটা ছায়ার মতো কিছু!” ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে বলেছিল এক মা, ডিমের সঙ্গে নিজের পুরুষ-সঙ্গীটিকেও যে হারিয়েছিল ক’দিন আগের এক অন্ধকার রাতে, “পাহাড়ের গা বেয়ে এসেছিল ওটা আর তারপর তারপর ডিমের সঙ্গে ওকেও নিয়ে গেছিল ওটা!”
“হ্যাঁ,” কিঁর চড়া গলার আওয়াজে লগ আবার বর্তমানে ফিরে আসে, “পাহাড়ের গায়ের এই জঙ্গল থেকে এমন কিছু একটা উঠে আসছে আপনাদের আস্তানায়, যাকে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না, অথচ যে একবার কাউকে ধরতে পারলে তাকেও নিয়ে যাচ্ছে এখান থেকে। এতটাই জোর যার, অথচ যে বিন্দুমাত্র শব্দও করছে না
“আপনারা ওটার গন্ধ পেয়েছেন,” এবার লগ মুখ খোলে, “সর সর করে একটা আওয়াজও পেয়েছেন, যেমনটা হয় পাথরের গায়ে নরম লতানে কিছু টেনে নিলে
“অথচ,” তীক্ষ্ণ গলায় বলে কিঁ, “ওটার পায়ের কোনও ছাপ পাওয়া যায়নি কোথাও
দলটা চুপ করেই ছিল। তাই কিঁ ওর বক্তব্য শেষ করল, “কেউ তাকে দেখেনি তার অন্যতম কারণ বোধহয় এটাও যে সে আসে অন্ধকার বা মেঘলা রাতেই
অস্বাভাবিকরকম চুপ হয়ে যাওয়া জঙ্গলে লগের নিজের গলাটা ওর কানেই বড্ড জোরালো শোনায়, “আজকের রাতেও যেহেতু সাদা গোল থালাটা মাথার ওপর থাকবে না, তাই তার আসার সম্ভাবনা খুব বেশি। তাই,” একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে বলে লগ, “আজ রাতে আমি পাহারা দেব এই আস্তানার নিচে দাঁড়িয়ে
“আর আমি থাকব ওই ধাপের মুখে,” বলে কিঁ, “আর আমাদের দু’জনের নজর এড়িয়ে এই আস্তানায় ঢোকার ক্ষমতা কারও নেই


একটা বুনো ফুলের গন্ধ হঠাৎ নাকে ভেসে আসায় চটকা ভেঙে গেল লগের
ছোটোখাটো চেহারার ডাইনোদের আস্তানায় বাচ্চাদের কিচিরমিচির আর বড়োদের হুটোপাটি থেমে গেছিল অনেক আগেই। ডিমগুলো যে ছোটো ছোটো গর্তের মধ্যে রয়েছে, সেগুলোর দিকে দূর থেকেও নজর রাখা যায় এমন একটা মোটামুটি সমতল চাতালের মতো জায়গায় হাওয়ার উলটো দিকে আধা-বসা, আধা-শোয়া হয়ে অপেক্ষা করছিল লগ।
চটকাটা ভেঙে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে নিজের অবস্থাটা বুঝে নিতে চাইল লগ।
অনেক দূর আকাশে একটা নীলচে আলো দপদপ করছে। ছোটোবেলায় এই আলোগুলোকে জন্তুর চোখ ভাবলেও পরে লগ বুঝেছে, যে সব জন্তুজানোয়ার বা উড়ুক্কুর চোখ ওগুলো, তারা এতটাই দূরে আছে যে তাদের ভয় পাওয়ার কোনও মানে হয় না। তবে তাদের ওঠানামা থেকে সময়টা বোঝা যায়।
কিন্তু ওই আলোগুলো ছাড়া আর কোথাও কোনও আলো নেই। চারদিকে শুধু ঘুটঘুটে অন্ধকার কারণ, পাহাড়ের ঢালটা একদিক থেকে আকাশটাকেও অনেকটা আড়াল করে দিয়েছে এখানে।
আস্তানা থেকে কোনও আওয়াজ আসছে না। দানব বা অন্য কোনও মাংশাসী প্রাণীর হানা দেওয়ার মতো কোনও শব্দ বা গন্ধও আসছে না।
তাহলে ওর ঘুমটা ভেঙে গেল কেন?
হাওয়ায় আবার ভেসে এল গন্ধটা। ঝট করে লগের মনে পড়ে গেল কিঁর কথাটা, যেটা রাত নামার আগে ওদের প্রস্তুতিপর্ব চলাকালীন কিঁ বলেছিল।
“আমাদের শত্রু শুধু শক্তিশালী নয়, মারাত্মক চতুরও বটে। সে প্রায় অদৃশ্য এবং নিঃশব্দ,” গম্ভীর গলায় বলেছিল কিঁ, “তাই তাকে চিনে নেওয়ার একমাত্র উপায় হতে পারে গন্ধ
“গন্ধ?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল লগ, “কিন্তু তার গন্ধ আমরা চিনব কীভাবে?”
“তার আসার কয়েকটা সম্ভাব্য পথ আমি চিনতে পেরেছি,” ডানা ঝাপটে বলেছিল কিঁ, “সেই পথগুলোয় আমি এই এলাকায় ফোটে না এমন কিছু বুনো ফুল ছড়িয়ে দেব, যেগুলোয় চাপ পড়লেই ফুলগুলো চেপটে গিয়ে এমন গন্ধ বেরোবে, যেটা পাহাড়ের এই অংশে বা জঙ্গলের সঙ্গে বেমানান। নিজের সব কিছু লুকিয়ে ফেলতে পারলেও শরীরের ওজনটা সে লুকোতে পারবে না” ঠোঁটের ভেতরেই দাঁতগুলো ঘষে নিয়ে বলেছিল কিঁ।
সেই গন্ধটাই ভেসে এসেছে এখন!
একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এল আকাশ থেকে। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল লগ। তারপর কিঁর ডানার ঝটপটানি থেকে দিক চিনে নিয়ে সারা বিকেল আর সন্ধে ঘুরে ওর শরীরের ওজন নিতে পারে এমন যে পথটা ও নিজের জন্য বেছে রেখেছে, সেটা বরাবর ওপরে উঠতে থাকল ও
শত্রুকে দেখতে পেয়েছে কিঁ!
লগের ভারী শরীরের দ্রুত ওপরে ওঠার শব্দ আর কিঁর তীক্ষ্ণ চিৎকারে আস্তানার ছোটোবড়ো বাসিন্দারা জেগে ওঠায় সেই অন্ধকারেই পাহাড়ের গা জুড়ে হুলুস্থুল পড়ে গেল। ঠিক সেই সময়ে আকাশে জমে থাকা মেঘের একটা বড়ো টুকরোও হঠাৎ আসা হাওয়ার দাপটে সরে গেল। রাতের আকাশের আলোয় লগ একটা অস্বাভাবিক জিনিস দেখল। ওর মনে হল, যেন পাহাড়ের গায়ের হলদেটে সবুজ আর কালো মেশানো পাথরের একটা বড়ো অংশকে কেউ পাতলা আর লম্বা করে দিয়েছে। সেই পাথুরে লম্বা জিনিসটাই উঠে আসছে জঙ্গলের দিক থেকে, এই আস্তানার ভেতরে।
এক মুহূর্তের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে গেলেও কিঁর চিৎকার লগকে দ্রুত বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। ও বুঝতে পারে, ছিটকে সরে যেতে চাওয়া জন্তুদের পালাবার পথ করে দিতে গিয়ে ও পাহাড়ের ভাঁজে এমন একটা জায়গায় আটকে পড়েছে, যেখানে ওর সামনে এবং পেছনে দু’জায়গাতেই রয়েছে শত্রুর লম্বাটে শরীর, যেটা পাক খাচ্ছে এবং ওর চারপাশের খোলা জায়গাটা ক্রমেই ছোটো করে আনছে
সাপ!
লগ স্তম্ভিত বিস্ময়ে আবিষ্কার করে, জলায়, এমনকি নদীতেও ও নিজের লম্বা জীবনে যেসব সাপের মোকাবিলা করেছে বা যাদের দেখেছে, তাদের তুলনায় অনেক অনেক বড়ো এই সাপ প্রায় দানবের মতোই। নিজের স্মৃতি হাতড়ে লগ বোঝার চেষ্টা করে এমন এক অতিকায় দুশমনের সঙ্গে মোকাবিলা করার উপায় কী হতে পারে। সরাসরি লড়ার চেষ্টা করে লাভ নেই কারণ, একাধিক জন্তু যে এর শরীরের ভাঁজে বন্দি হয়ে বেপাত্তা হয়েছে, এটা ওরা আগেই শুনেছিল।
যেহেতু এই সাপটাকে পাহাড়ের গা থেকে আলাদা করে চিনতে পারেনি এই আস্তানার বাসিন্দারা, তাই তারা এটাকে একটা ছায়া বা একটা খারাপ গন্ধ, আর সর সর আওয়াজ দিয়েই চিনতে চেষ্টা করেছে।
গন্ধটা কীসের?
লগ বুঝতে পারল, সাপটা ওর যত কাছে এসে ওকে পেঁচিয়ে ধরার চেষ্টা করছে, ততই সাপটার গা থেকে একটা উগ্র ঝাঁঝালো গন্ধ ওর নাকে আসছে। এই গন্ধটা লগ আগেও পেয়েছে কোথাও কোথাও, যেখানে আগুনপাহাড় থেকে বেরোনো লাভা আর আগুন মাটির সঙ্গে মিশে যায়।
ঠিক তখনই আকাশ থেকে একটা ধারালো পাথর আছড়ে পরে লগের থেকে একটু দূরে। লগ বুঝতে পারে, অন্ধকারেও কিঁর নজর সাপটার মাথাটা খুঁজে পেয়েছে, আর সেইদিকেই ও পাহাড়ের ঢাল থেকে পাথর গড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
লগ বোঝে কিঁ ওকে কী বলতে চাইছে। নিজের গায়ের জোরে সাপটার বাঁধনের সঙ্গে লড়াই করলে লগ জিততেও পারে, নাও পারে কিন্তু তার চেয়ে বেশি কার্যকরী উপায় হল পাহাড়ের ঢালটাকেই নিজের পক্ষে কাজে লাগানো।
লেজের প্রবল ঝাপটে পাহাড়ের গা থেকে পাথর গড়িয়ে আনে লগ। পাথর আর গাছ আছড়ে পড়ায় সাপটা ক্রুদ্ধ হয়ে ওর দিকে বেঁকে আসার চেষ্টা করামাত্র সজোরে সেটাকে ধাক্কা দেয় লগ আর তারপর সাপটার শরীরের ওপর দিয়েই ছুট লাগায় ওপর দিকে।
তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠে কিঁ। লগ সাড়া দেয় না কারণ, ওর চারপাশে তখন প্রবল দাপটে আছাড়িপিছাড়ি করে নিজের শরীরটা ঝাপটাচ্ছে সাপটা। ঠাণ্ডা মাথায় লগ বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে ঠিক কোথায় যেতে চাইছে সাপটা।
অন্ধকার আকাশের বুকে জ্বলন্ত চোখজোড়া আর ডানার ঝাপট থেকে লগ বুঝতে পারে, কিঁ সাপটার চলাফেরার রাস্তা বুঝতে পেরেছে। দ্রুত ওপর দিকে উঠতে থাকে লগ যাতে সাপটা ফিরে যাওয়ার রাস্তা ফাঁকা পায়। সাপটার পিছু নেয় ওরা দু’জনেই।
নখ আর দাঁতে ভরা এই পৃথিবীতে শত্রুর শেষ রাখতে নেই। তাই আজ রাতেই শুধু নয়, এই সাপটা যাতে ওদের দিকে আর কখনও না আসে সেই ব্যবস্থা ওদেরকেই করতে হবে

পাহাড়ের গা ঘেঁষে সাপটা ঢুকে যেতে থাকে একটা প্রকাণ্ড গর্তের ভেতরে। অন্য সময়ে এই গর্তের মধ্যে ঢুকে সাপটার পিছু নেওয়ার কথা ভাবতেও পারত না লগ কিন্তু কিঁকে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে গর্তের ওপর দিয়ে পাহাড়ের একটা ভাঁজে ঢুকে যেতে দেখে লগ বোঝে, গর্তের মধ্য দিয়ে না হলেও সাপটার চলার পথ অনুসরণ করার একটা রাস্তা হয়তো কিঁ পেয়েছে। সেই রাস্তায় আলগা পাথর বা ঢাল থাকলেও সেটা যে লগের শরীরের ভার নিতে পারবে, এমনটাও কিঁ দেখে নিয়েছে, এই বিশ্বাসে এবার লগ ওই পাকদণ্ডিতে ঢুকে পড়ে।
পায়ের নিচে মাঝেমধ্যেই পাথরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকা গরম বাতাসের হলকা লগকে ঠিক পথে চলার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে। সাপটার গায়ে ও যে গন্ধ পেয়েছিল সেটা নিশ্চিতভাবেই ইঙ্গিত করেছিল, আগুনপাহাড়ের কাছাকাছি কোনও একটা গুহায় জল আর মাটির নিচে গজানো ঘাস-লতায় ভরা একটা বড়ো জায়গায় থাকে সাপটা।
কিন্তু হঠাৎ সাপটা পাহাড়ের ওপরে এই বনে ঢুকে ডিম খুঁজতে গেল কেন?
শত্রুর সম্বন্ধে এত কথা হয়তো ভাবা উচিত নয় কিন্তু জলার আশেপাশে ‘হয় মারো, নয় মরো’ নীতি মেনে সবাইকে বাঁচতে দেখে লগ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই ও সাপটাকে মারতে হবে এমন ভেবেও তার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করছিল।
কিঁ আবার চিৎকার করে একটা জায়গার ওপরেই ঘুরপাক খেতে থাকে। লগ বোঝে, পাহাড়ের ভেতরে ঢোকার একটা রাস্তা কিঁ খুঁজে পেয়েছে।
চাতালের মতো একটা জায়গা, আর তার একদিকে একটা গর্তের সামনে এসে বসেছিল কিঁ। ওর পাশে পৌঁছে দম নিয়ে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাস যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে নিয়ে নিচে তাকিয়ে জায়গাটা দেখে লগ। বৃষ্টির জল নেমে যাওয়ার জন্য নিজস্ব পথ বানিয়ে নিয়েছে এখানে। আগুনপাহাড়ের কাছে হওয়ায় এদিকের পাথরগুলো নিয়মিত ঝাঁকুনি খেয়ে একটু আলগাও হয়ে গেছে। ফলে শুধু গর্ত নয়, বরং একটা ধাপ তৈরি হয়েছে এদিকটায়, যেটা ধরে লগের পক্ষে সাবধানে নিচে গুহার মধ্যে নেমে যাওয়া সম্ভব।
অন্ধকারে এতক্ষণে ওদের দু’জনেরই চোখ সয়ে এসেছে। ফলে গুহার তলা দিয়ে সাপটার দ্রুত চলন দেখতে এবং গুহার ভেতরে মেঝে থেকে ছাদের দূরত্বটা যে যথেষ্ট তা বুঝতে ওদের অসুবিধা হয়নি। আর দুদ্দাড় শব্দ বা ডানার ঝাপট তুলে নয়, বরং যথাসম্ভব চুপচাপ ভঙ্গিতে সেই ভাঙা জায়গাটা ধরে গুহার ভেতরে নেমে আসে লগ আর কিঁ।
এই বিরাট সাপকে গায়ের জোরে হারানো শক্ত। তাছাড়া এই গুহার ভেতরে আর কী বা কারা আছে, সেটা সাপটা জানলেও ওরা জানে না। অতএব শিকারিকে শিকার করার জন্য ওদের চলন এখন নিঃশব্দ রাখাটাই জরুরি।
সাপটা কিন্তু লগের পায়ের কাঁপুনি টের পেয়েই দ্রুত গুহার গায়ে জলের চলাচলের ফলে তৈরি হওয়া একটা খাঁজের মধ্যে ঢুকে পড়ল। হতাশ হয়ে লগ দেখল, অন্ধকারে সইয়ে নেওয়া চোখেও সাপটাকে ও আর দেখতে পাচ্ছে না।
মাথার ওপর ছাদটা অনেক উঁচু হয়ে গেছে এখানে তাই কিঁ ওপরে উঠে একটা চক্কর দিয়ে উত্তেজিতভাবে একটা বিশেষ দিকে ডানা ঝাপটাতে শুরু করল। তরল অন্ধকারের মধ্যেও একটা হলদেটে লাল আভা ওইদিকে দেখতে পেল লগ। আগুনপাহাড়ের একটা মুখ ওইদিকেই আছে বুঝে ওরা আপাতত ওদিকেই এগোল।
বেশ কিছুক্ষণ পর গুহার মধ্যে একটা ঢালু জায়গার এক ধারে দাঁড়িয়ে সাপটার ডেরা খুঁজে পেল লগ আর কিঁ। অবাক বিস্ময়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা কারণ, পাহাড়ের নিচে মাটির গভীরে এমন একটা আলাদা জগত আছে, এটা ওরা ভাবতেই পারেনি।
বেশ কিছুটা তলা দিয়ে দ্রুত বয়ে যাচ্ছে একটা নদী। নদীটার ধারে বালির ফাঁকে ফাঁকে গজিয়েছে ঘন ঘাসের জঙ্গল। এমনকি পাথর ভেঙে জায়গায় জায়গায় রীতিমতো বড়ো গাছের ঝোপ হয়েছে নদীটার ধারে সেই জায়গাগুলোয়, যেখানে তলা থেকে উঠে আসা গরম আর ঘোলাটে জল মিশেছে নদীর ঠান্ডা জলে।
“ওই যে,” লগ অবাক বিস্ময়ে নিচের এই পরিবেশ দেখায় মগ্ন হলেও কিঁ শত্রুর ওপর থেকে নজর সরায়নি তাই তার উত্তেজিত গলা শোনা যায় এখন, “সাপটার বাসা ওই জায়গাটায়!”
লগ দেখে, সামনের ঘাসজমি যেখানে ঘন হয়ে বড়ো গাছের ভিড়ে মিশে গেছে, সেখানে পাক খেয়ে থিতিয়ে বসার চেষ্টা করছে সাপটা।
কিঁর তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনে লগ বোঝে, ওর একার নয়, কিঁর চোখেও ধরা পড়েছে দৃশ্যটা। সাপটার গায়ের ভাঁজের মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে তার বাসার ভেতরে জমে আছে নানা রঙের ডিমের ভাঙাচোরা টুকরো। আর কয়েকটা সাপ, যারা আকারে এই সাপটার তুলনায় অনেক ছোটো, অর্থাৎ এই সাপটার বাচ্চা!
“একটা নয়,” বিড়বিড়িয়ে বলে লগ, “সবক’টার ব্যবস্থাই করতে হবে আমাদের
“বাচ্চাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতেই সাপটাকে বাইরে বেরোতে হচ্ছিল,” কিঁ বলে, “ডিম, আর সম্ভব হলে বড়ো শিকার ধরে এনে নিজের বাচ্চাদের কাছে দিচ্ছিল সাপটা এতদিন
দ্রুত পায়ে নামতে থাকে লগ। অভিজ্ঞ চোখ আর স্মৃতি ওকে বলেছে, কী করতে হবে।
“হ্যাঁ, আগুনপাহাড়ের দিকের দেওয়ালটা ধসিয়ে দিলে আগুনের স্রোত সাপটার বাসার ওপর দিয়েই বয়ে যাবে,” স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক আস্তে বলে কিঁ, “তাহলে সাপও মরবে, আর আমাদের গায়েও আগুন লাগবে না
“না,” সংক্ষেপে বলে লগ, “মারামারি অনেক হয়েছে। আর নয়
একটা চিৎকার তুলে ডানা মেলে কিঁ আর তারপর গুহার ছাদ বরাবর চক্কর কেটে গুহার উলটো দিকের মুখটার কাছে এসে বসে ও লগ বোঝে, বাইরে বিরক্ত হওয়ার ভান করলেও লগ কী করতে চাইছে সেটা কিঁ বুঝেছে এবং সেটা সমর্থনও করছে।

সাপটা ওদের আক্রমণ করার চেষ্টা করেনি। তার অতি ক্ষুদ্র মাথায় হয়তো বাইরের লড়াইয়ের স্মৃতিটা বেশিই জোরালো হয়ে ছিল তাই এই অসম জুটিকে কাছে পেয়েও সাপটা তাদের চ্যালেঞ্জ না করে বরং নিজের বাচ্চাদের চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে তাদের বাঁচানোর চেষ্টাই করছিল।
লগ সেদিকে যায়নি। বরং কিঁ যেখানে বসেছিল, সেই গর্তের মুখটায় গিয়ে নিজের শরীরের সবটুকু জোর দিয়ে ও গর্তের ওপরের দেওয়ালটায় ধাক্কার পর ধাক্কা মেরেছিল অবশেষে ওপর থেকে একরাশ পাথর পড়ে গর্তটা বন্ধ হয়ে গেছিল।
ঠিক কোন কোন জায়গায় ধাক্কা দিলে পায়ের নিচের পথটাকে বিপন্ন না করেও গর্তটা বন্ধ করে দেওয়া যাবে, সেটা কিঁ দেখিয়ে দিয়েছিল লগকে আর তারপর বলেছিল, “সাপটা আর বেরোতে পারবে না এই পথে
কুণ্ডলী পাকাতে থাকা সাপটার দিকে শেষবারের মতো দেখেছিল লগ। তারপর যে পথ দিয়ে ও নেমে এসেছিল গুহার মধ্যে সেই পথ ধরে সাবধানে নিজের ভারী আর হাঁপাতে থাকা শরীরটাকে তুলে এনেছিল ওপরে, আকাশের নিচে।
বিশ্রাম নেওয়ার উপায় ছিল না ওর। আকাশের গায়ে অন্ধকার তরল হয়ে আসছিল কিন্তু হাত-পা ছুঁড়ে কসরত করার মতো করেই চাতালের ধারে বার বার পা দিয়ে জোরালো ধাক্কা দিচ্ছিল লগ, যতক্ষণ না চাতালটাও হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে নিচে। আর পাহাড়ের নিচ থেকে বাইরের জঙ্গলে আসার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।

নিঃশব্দে নেমে আসছিল ওরা দু’জন। নিচের ছোটোখাটো ডাইনোসরদের আস্তানায় ততক্ষণে সবাই জেগে গেছিল। অনেক কাঁপুনি আর আওয়াজ টের পেলেও সেগুলোর কারণ ওদের কাছে কেউ জানতে চায়নি। নিজের ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরটাকে প্রায় ছেঁচড়ে নিয়ে যেতে গিয়েও একবার শুধু দাঁড়িয়েছিল লগ আর বলেছিল, “সাপটা আর এদিকে কোনওদিন আসবে না
প্রায় জলার কাছে এসে পৌঁছোবার পর প্রথম মুখ খুলেছিল কিঁ।
“ওপরে আসার সব রাস্তা যে বন্ধ করে দিলে,” বলে কিঁ, “সাপটা ওর বাচ্চাদের নিয়ে তো না খেয়ে মরবে!”
“না,” মাথা নাড়ে লগ, “নদীর ধারে পাহাড়ের ভেতরে মাটিটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে যেদিকে, সেদিকে যথেষ্ট ঘন জঙ্গল আর ঘাসজমি আছে। এটা তুমিও দেখেছ
“তা দেখেছি,” খুঁতখুঁতে গলায় বলে কিঁ, “তবে ওগুলো তো বিরাট বিরাট ছাতার মতো গাছ, যেগুলো ভেজা জায়গায় হয়। ওই গাছের ভিড়ে কি সাপটার পেট ভরানোর মতো খাবার জুটবে?”
মুচকি হাসে লগ। ও বুঝতে পারে, কিঁ খুব ভালো করেই দেখেছে যে নদীর ধার দিয়ে ওই আলো-আঁধারি গাছ আর ছত্রাকের জঙ্গলে এমন অনেক জন্তু আর পোকামাকড় আছে, যাদের খেয়ে সাপটা দিব্যি টিঁকে থাকতে পারবে।
“আগুনপাহাড়ের দাপটটা ক্রমেই কমে আসছে,” স্বগতোক্তি করে কিঁ।
মাথা নাড়ে লগ। আগুনটা আরও কমে এলেই পাহাড়ের নিচেও জঙ্গলটা ঘন হবে, আর লুকোনো নদীর মুখ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে সাপটা। আসুক গে। যখন সময় হবে, তখন নাহয় আর একদফা টক্কর নেওয়া যাবে ওই দুশমনের সঙ্গে। ততদিন অবধি এই জলা আর পাহাড়ি জঙ্গল নিরাপদে থাক ওদের দৌলতেই
“সাপটাকে কী নামে ডাকা যায় বল তো?” জলার লাগোয়া একটা গাছে বসে বলে কিঁ।
“নামে কী আসে যায়?” বলে কাদায় শরীর ডুবিয়ে চোখ বুজে লগ লক্ষ-কোটি বছর পরে যাকে দু’পেয়েরা টাইটানোবোয়া বলবে, তার সঙ্গে মোলাকাতের পর বেঁচে থাকাটাই বড়ো কথা নয় কি?
_____
অলঙ্করণঃ সুমিত রায়

5 comments:

  1. খাসা লাগল 👌 রুদ্ধশ্বাসে পড়লাম!

    ReplyDelete
  2. বা, একদম নতুন রকমের অভিজ্ঞতা হল গল্পটা পড়ে। শেষের মানবিক লড়াই টাই সবচেয়ে ভালো। যুদ্ধ মানেই হত্যা নয়, আত্মরক্ষার মধ্যে দিয়ে অন্যকেও বাঁচতে দেওয়া। ক্ষুধার জন্যই তো প্রাণীরা হত্যা করে মানুষের মতো বিনা কারণে নয়

    ReplyDelete
  3. Log and Key Series এর দ্বিতীয় গল্প, ভালোই, তবে আগেরটার চমকটা নেই

    ReplyDelete
  4. বেশ একটা অন‍্য স্বাদ পেলাম। দারুণ

    ReplyDelete