দ্য
টেরিবল ওল্ড ম্যান
এইচ
পি লভক্রফট
অনুবাদঃ
নীলাভ ভাওয়াল
সেই ভয়ানক
বৃদ্ধ মানুষটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার দুরভিসন্ধিটি এঁটেছিল অ্যাঞ্জেলো রিক্কি, জোয়ি জেঙ্ক
আর ম্যানুয়েল ডিসিলভা - এই তিনজন মিলে। সমুদ্রতীরবর্তী ওয়াটার স্ট্রিটের এক
সুপ্রাচীন অট্টালিকায় এই বৃদ্ধ মানুষটির বাস। অত্যধিক ঐশ্বর্যের অধিকার এবং
শারীরিক দুর্বলতার জন্যে এই মানুষটি ছিলেন যথেষ্ট সুপরিচিত। কেননা, এই দুইয়ের
সংমিশ্রণ এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যা কিনা অত্যন্ত আকর্ষণীয় সেইসব ‘ভদ্র পেশায়’ নিযুক্ত
মানুষজনেদের কাছে। এই ভদ্র পেশাটি আসলে চৌর্যবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয় রিক্কি, জেঙ্ক, সিলভা এসব
মানুষজনেদের কাছে।
কিংসপোর্টের
বাসিন্দাদের মধ্যে এই বৃদ্ধ মানুষটির সম্পর্কে এমন কিছু গুজব রটেছিল যা কিনা তাকে
নিরাপদে রেখেছিল মিঃ রিক্কি আর তাঁর শাগরেদদের মতো তথাকথিত ‘ভদ্রলোকেদের’ কুনজর থেকে।
এটা জানা সত্ত্বেও যে সেই বৃদ্ধ তার পুরনো, জরাজীর্ণ, দুর্গন্ধময়
বাড়িটির কোনও এক গুপ্তস্থানে এক অনিশ্চিত আয়তনের ধনরত্ন সযত্নে লুকিয়ে রেখেছেন।
সত্যি বলতে
গেলে, এই
বুড়ো মানুষটি বড্ড অদ্ভুত স্বভাবের! লোকেদের বিশ্বাস, কোনও এককালে
পূর্ব ভারতের স্লিপার-ক্লাস এক জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। এখন তিনি এতটাই
বৃদ্ধ যে কোনও এককালে তিনি যে যুবক ছিলেন তা মনে করার মতোও কেউ আর বেঁচে নেই। তার
ওপরে তিনি এতটাই স্বল্পভাষী যে খুব অল্প লোকেই জানে তার আসল নামখানা কী!
তাঁর
জরাজীর্ণ, প্রাচীন
বসতভিটের সামনে একসারি গ্রন্থিল গাছের সমাহারের মধ্যে তিনি কতগুলো বড়ো বড়ো পাথরকে
রঙ মাখিয়ে পূর্বাঞ্চলের মন্দিরের মতো করে সাজিয়ে গড়ে তুলেছেন এক দুর্বোধ্য
প্রস্তরসজ্জা। যেসব ছেলেরা মাঝেমধ্যেই বুড়োকে তার সাদা দাড়িগোঁফের জঙ্গল নিয়ে
উত্যক্ত করতে কিংবা পাথর ছুঁড়ে বুড়োর বাড়ির জানালার কাঁচ ভাঙতে আসত, তাদের দূরে
রাখতে সাহায্য করেছিল বুড়োর এই অদ্ভুত পাথুরে সংগ্রহ! কিন্তু এসব বাদেও এখানে এমন
কিছু কিছু ব্যাপার ছিল যে তা এলাকার বড়োদেরকেও ভয় পাইয়ে দিত; ভয় পাইয়ে
দিত সেসব কৌতূহলী মানুষদের যারা চুপিচুপি বুড়োর বাড়িতে ঢুকে উঁকি মারত নোংরা
জানালার কাঁচের মধ্য দিয়ে।
এসব
মানুষদের কথানুযায়ী,
বুড়োর বাড়ির নিচের তলার একটা খালি ঘরের ভেতর একটা টেবিলের ওপর নানারকম
অদ্ভুতদর্শন বোতল নাকি সাজানো। প্রত্যেকটা বোতলের ভেতর সুতো দিয়ে পেন্ডুলামের মতো
করে ঝুলছে একটুকরো সীসা। তারা এও বলেন, বুড়ো নাকি সেই অদ্ভুত বোতলগুলোর
এক-একটাকে একেক নামে ডাকেন,
যেমন, জ্যাক, ভীতু-মুখো, ঢ্যাঙা টম, স্প্যানিশ
জোয়ি, পিটার।
যখনই তিনি কোনও বোতলকে প্রশ্ন করেন, তখনই নাকি সেই বোতলের ঝুলন্ত
সীসাখন্ডে মৃদু কম্পনের সৃষ্টি হয়, যেন সে উত্তর দিতে চায়!
যারাই
বৃদ্ধকে কথা বলতে দেখেছে বোতলদের সঙ্গে, তাদেরকেই ভবিষ্যতে আর খুঁজে পাওয়া
যায়নি! কিন্তু রিক্কি,
জেঙ্ক আর সিলভা কেউই এই কিংসপোর্ট অঞ্চলের বাসিন্দা নয়। তারা এ অঞ্চলে নতুন
এবং উদ্বাস্তু পরিবারের লোক যারা কিনা নিউ ইংল্যান্ডের জমকালো শহুরে জীবন আর শহুরে
চৌহদ্দির বাইরে বাস করে। তারা দেখেছে এই বৃদ্ধ একদম একা, অসহায়, টলোমলো যিনি
নিজের বেতের লাঠিটা ছাড়া হাঁটতেই পারেন না। তার দুর্বল, শীর্ণ
হাতগুলো থরথর করে কাঁপে বার্ধক্যে! এই অসহায়, অপরিচিত, একাকী
বৃদ্ধমানুষটার জন্যে তারা সত্যিই খুবই দুঃখিত যাকে কিনা সবাই পরিত্যাগ করেছে এবং
যার প্রতি প্রায় সকলেরই মনে একইরকম বিরূপ মনোভাব।
কিন্তু
ব্যবসা তো ব্যবসাই হয়! যেসব চোরেদের আত্মা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে তার জীবিকার
সঙ্গে, তাদের
তো কিছু কর্তব্য থেকেই থাকে সেসব বৃদ্ধ ও দুর্বলদের প্রতি যাদের ব্যাঙ্কে নিজস্ব
কোনও অ্যাকাউন্ট নেই এবং যারা নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটি করেন জমানো
সোনা-রূপার মুদ্রায়,
যেগুলোর কিনা বয়স প্রায় দুশো বছর।
তারা তিনজন
মিলে তাদের ‘অপারেশন’-এর সম্ভাব্য
দিন হিসেবে এপ্রিলের এগারো তারিখটিকে বেছে নিল। ঠিক হল, রিক্কি আর
সিলভা যাবে বাড়ির ভেতরে সেই বুড়োলোকটির সঙ্গে আলাপ করতে আর জেঙ্ক তাদের জন্য
অপেক্ষা করবে বাড়ির বাইরে তাদের সেই ঢাকা মোটরগাড়ির ভেতর। পুলিশের নজর যাতে না পড়ে
তার জন্যে খুব শান্তমতো আর দ্রুত তাদের কাজ হাসিল করতে হবে।
পুর্বপরিকল্পনামাফিক
কোনওরকম বাজে সন্দেহ এড়াতে সেই তিনবন্ধু পৃথক পৃথকভাবে রওনা হল সেই বাড়িটির
উদ্দেশ্যে। ওয়াটার স্ট্রিটে বৃদ্ধের সেই পুরনো বাড়িটির সদর দরজার সামনে মিলিত হল
তিনজনে। গ্রন্থিল বৃক্ষের কচি ডালপালার ফাঁকফোকর গলে আসা চাঁদের উজ্জ্বল আলোকছটায়
ভেসে যাচ্ছে পাথুরে পথঘাট যা কিনা একদমই পছন্দ নয় তাদের, শুধুমাত্র
কুসংস্কারের জন্যে। মনে মনে তারা বেশ ভয় পাচ্ছিল এই ভেবে যে, হয়তো লুকোনো
স্বর্ণ-রৌপ্য ভান্ডারের ব্যাপারে বৃদ্ধের মুখ খোলানোর কাজটা ভদ্রগোছের নাও হতে
পারে। কারণ, সেই
বুড়ো নাবিক নাকি বড্ড অবাধ্য আর গোঁয়ারগোবিন্দ স্বভাবের। তবুও ভরসা এই যে লোকটি
বয়েসে অতীব বৃদ্ধ আর শারীরিকভাবেও বেজায় দুর্বল, আর এদিকে তারা আবার দু’জন! একজন
অনিচ্ছুক মানুষের মুখ খোলানোর শিল্পে তারা যথেষ্ট পটু। আর কোনও বেগড়বাই যদি দেখে
তাহলে মুখ চাপা দিয়ে সেই বৃদ্ধের চিৎকার করা বন্ধ করে দেবে।
তারা দু’জনে এগিয়ে
গেল আলোকোচ্ছল জানালার দিকে। কান পেতে শুনতে পেল সেই বৃদ্ধটি বাচ্চাদের মতো একা
একা কথা বলছেন বোতল আর পেন্ডুলামের সঙ্গে। তারা দু’জনেই ঝটপট মুখোশগুলো পড়ে নিল এবং খুব
ভদ্রভাবে নক করল ওক কাঠের দরজায়।
বৃদ্ধের
বাসার পেছনের দরজার কাছে দীর্ঘ সময় ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করছে মিঃ জেঙ্ক।
এমনিতেই সে বড্ড দুর্বল হৃদয়ের, তার ওপর বাকি দুই বন্ধু অপারেশন আরম্ভ করার
কিছুক্ষণ পর ঐ পুরনো বাড়িটার ভেতর থেকে ভেসে আসা রক্তজল করা ভয়ানক আর্তনাদটিকে সে
ভালোভাবে নিতে পারেনি। সে তো বন্ধুদের পই পই করে বলে দিয়েছিল ঐ বুড়ো লোকটার সঙ্গে
যেন ভদ্র ব্যবহার করে। তারপরেও কেন...
খুব
নার্ভাসভাবে সে তাকিয়ে রইল সবুজ লতাগুল্মে ছাওয়া সেই উঁচু দেওয়ালটির গায়ে ওক কাঠের
সেই দরজাটির দিকে। বারবার তার চোখ চলে যেতে লাগল ঘড়ির দিকে আর বিস্মিত হতে থাকল এত
দেরির জন্যে! বৃদ্ধমানুষটা আবার মরে-টরে যায়নি তো গুপ্তধনের হদিশ পাওয়ার আগেই?
এভাবে
একটানা এতক্ষণ যাবৎ এরকম একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগছিল না মিঃ
জেঙ্কের। হঠাৎ সে শুনতে পেল মেঝেতে মৃদু পায়ের শব্দ। সন্দেহ নেই তা আসছে ঐ বন্ধ
দরজার ওপাশ থেকে। হাতড়ে-হাতড়ে মরচে ধরা লোহার খিল খোলার চাপা একটা শব্দ এবং
তারপরেই সে লক্ষ করল ভারী দরজার কপাটদুটো আস্তে আস্তে ভেতরদিকে খুলে যাচ্ছে।
রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের ঘোলাটে আলোয় সে চোখ কুঁচকে তাকাল এটা দেখতে যে তার
সঙ্গীরা এই অশুভ বাড়িটা থেকে কী কী নিয়ে আসতে পারল। ধীরে ধীরে প্রতীয়মান হয়ে উঠতে
লাগল সামনের সব দৃশ্য।
দৃষ্টি
স্পষ্ট হলে সে কিন্তু তার সঙ্গীদের দেখতে পেল না। তার বদলে দেখল সেই ভয়ানক
বৃদ্ধমানুষটি দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন বেতের একটা লাঠিতে ভর দিয়ে সামনে ঝুঁকে, আর হাসছেন
অত্যন্ত বিকটভাবে! বৃদ্ধের চোখদুটোর দিকে প্রথমে জেঙ্কের নজর যায়নি। এবার খেয়াল
করতেই চমকে উঠল। সে দুটোর রঙ ফ্যাকাসে হলুদ!
শেষাংশ
ছোটোখাটো
শহরতলী এলাকায় মাঝেমধ্যে কিছু কিছু ঘটনা চাপা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এই তিনটি
বেনামি লাশকে নিয়ে সেভাবেই কিংসপোর্টের মানুষজন বছরভর চাপা আলোচনা চালিয়ে গেল। লাশ
তিনটিকে কেউ যেন ধারালো অস্ত্রের কোপে নৃশংসভাবে টুকরো টুকরো করে কেটে অত্যন্ত
হিংস্রভাবে তাকে বুটজুতো দিয়ে থেঁতলে পিষেছে! জাহাজপল্লীর পাড়ায় সেই পরিত্যক্ত
গাড়িখানা পাওয়া যাওয়ায় কেন জানি না অনেকে আবার একে তুচ্ছ ঘটনা বলতে আরম্ভ করেছে।
আবার যারা সেই রাতে অমানুষিক রক্তজল করা সেই আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল, তারা বলছে এ
নিশ্চয় কোনও দিগভ্রষ্ট হিংস্র পশুর কিংবা পরিয়ায়ী পাখির কাজ।
কিন্তু সেই
বৃদ্ধমানুষটি বড়োই অদ্ভুতভাবে গ্রামের লোকেদের সেই আলাপ-আলোচনায় কোনওরকম উৎসাহ
দেখালেন না। স্বভাবগত কারণে এমনিতেই তিনি বড্ড চুপচাপ। তার ওপরে বয়সজনিত কারণে আর
শারীরিক দুর্বলতার জন্যে আজকাল তিনি আরও চুপচাপ হয়ে গেছেন। তাছাড়া হয়তো অতি বৃদ্ধ এই
নাবিকের সুদূর অতীতে এরকম সাংঘাতিক ব্যাপার-স্যাপার প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা থেকে
থাকবে, যার
জন্যে তিনি এত নিরুৎসাহী এসবে!
_____
অলঙ্করণঃ
শ্রীময় দাশ
No comments:
Post a Comment