![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiciQ9wa_UmVHlnaESLE0YeJkNi6kUOeUpKUdbaY0RgtJ0V0W31KkvYin69n_JEuo40LCdjcq4FvBTEOJ5mSywZ6Q_2887gy6GBhWQRtxd8NZivyRuRDRut5W0HcAtrtTrknPnByNsnWOs/s400/Nibat+kabach.jpg)
নিবাত কবচ, বিষবৈদ্য এবং
লেখকঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
আলোচনাঃ পার্থপ্রতিম
নিবাত কবচ অভিযান
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্যর ‘নিবাত কবচ অভিযান’
বইটি পড়া শুরু করতে গেলে প্রথমেই চোখ পড়া উচিত বইয়ের প্রচ্ছদে। মোটেই দৃষ্টিনন্দন
নয়, বা মনে তেমন কোনও আভিযাত্রিক উত্তেজনাবোধ জাগিয়ে তোলে
না। সুখের কথা, প্রচ্ছদপাতা উলটে গিয়ে মূল বইয়ে প্রবেশ করলে সেই ত্রুটির কথা আর
খেয়াল থাকে না। বরং বইটি যাঁকে কেন্দ্র করে সেই বিষবৈদ্য ক্রমশ বুঝিয়ে দেন তাঁর
বলা গল্পে বা তাঁর করা অ্যাডভেঞ্চারের কোনও মলাটের প্রয়োজন পড়ে না।
বিষবৈদ্য সিরিজের তৃতীয় বই আলোচ্য ‘নিবাত কবচ অভিযান’। ২০০৯ সালে আনন্দমেলার পাতায় যাঁর
আগমন, পরে ‘দোর্দুবুরুর বাক্স’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত;
আরও পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে বাস্তারের জঙ্গলে তাঁর অভিযান
‘পংখীলালের গুহা’। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাহাড়ে
জঙ্গলেও কিছু রোমহর্ষক অভিযান তিনি করেছেন যা আলোচ্য কাহিনিতে প্রসঙ্গরূপে আসে।
‘নি.ক.অ’ বইটি আকারে ছোটো হলেও প্রকারে একে
এককথায় প্রকাশ করা কোনও আলোচকের পক্ষে অসম্ভব। তাই সে প্রচেষ্টা পরিত্যাগ করে কী
কি বিষয় বইতে আনা হয়েছে তা দেখে নেওয়া যাক।
১২৪ পাতার ডাবল ডিমাই ষোল পেজ-ফর্মার কৃশতনু
পেপারব্যাকে প্রধান উপাদান হিসেবে এসেছে - মহাভারত, পুরাণ, ভূতত্ত্ব,
সঙ্গম সাহিত্য, ইতিহাস, কল্প-সিন্ধুসভ্যতা,
বিজ্ঞান এবং কল্পবিজ্ঞান। জঁর বিভাজনে উৎসাহী কেউ জ্বালাতে এলে বলতে
হয় এই বইকে বিশেষ কোনও জঁরে ফেলাটা বেশ সমস্যার। এমনকি মিশ্র জঁর বলেও ছাড় পাওয়া
যাবে না। যদি বিভেদকরণে বাধ্য একান্তই করা হয় তো একমাত্র ‘পৌরাণিক
কল্পবিজ্ঞান’ বললে ‘নি.ক.অ’-কে কিছুটা বোঝানো যাবে।
এবার এই পৌরাণিক কল্পবিজ্ঞানকে উপাদান অনুযায়ী
বিশ্লেষণ করা যাক।
(১) গল্পের সূচনা মহাভারতবিষয়ক একটি শব্দছক
প্রতিযোগিতা দিয়ে। কাহিনির নামকরণেই মহাভারতীয় অনুষঙ্গ। তিনযুগব্যাপী যুদ্ধের
দ্বিতীয়পর্ব, দ্বাপরযুগে।
বনপর্বে আছে তৃতীয় পান্ডব অর্জুন
স্বর্গে গমন করে দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন। শিক্ষাদান সমাপ্ত
হলে দেবরাজ প্রার্থনা করলেন গুরুদক্ষিণা - সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে থাকা ‘নিবাত কবচ’
দানবদের নিপাত। অর্জুন দেবাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে
চললেন পাথারগর্ভে নিবাতধ্বংসী অভিযানে। গো-হারান হারিয়ে শেষমেশ দানবজাতটাকে
পুরোপুরি ধ্বংস করবার বদলে মানবিক তাড়নায় নিবাত বৌ-বাচ্চাদের প্রাণভিক্ষা দিয়ে
মর্ত্যধামে ফিরলেন অর্জুন। ঝাড়ে বংশে নিপাত হল না নিবাত। অপেক্ষা করতে থাকল
বিষবৈদ্যের।
(২) পুরাণের অর্থ আদি। এই গল্পের আদিকান্ড
বা যুদ্ধের প্রথম পর্ব সেই আদি পৌরাণিক যুগে, যখন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর
উপকথায় প্রস্তরীভূত না হয়ে গিয়ে এই পৃথিবীতেই চলে ফিরে বেড়াতেন। দানবদের সঙ্গে
যুদ্ধে সাধারণ দেবতারা পরাজিত হয়ে লুকোলে ব্রহ্মাস্ত্র, সুদর্শন
চক্র এবং ত্রিশূল নিয়ে করতেন তাড়া। হাসি পাচ্ছে? নির্বাচিত
অংশ পড়ুনঃ
“পৃথিবীতে তখন সবে কলোনাইজেশন শুরু হয়েছে।
দেবতা বল আর যাই বল, সেই ভিনগ্রহী জীবেরা তখন স্বর্গ নামে
একটা বেজায় বড়ো স্পেস স্টেশন নিয়ে এসে ঘাঁটি গেড়েছে পৃথিবীর কাছে। সেখানে বসে বসেই
পৃথিবীর মানুষসদৃশ প্রাইমেটদের মধ্যে নিজেদের জিন প্রতিস্থাপন করে করে মানবসভ্যতা তৈরির
কাজে তখন তারা ব্যস্ত।... গ্যালাক্সির যে দিকটায় দেবতা-জীবের বাস, তার একেবারে উল্টোদিকে, হাজারো পারসেক পথ পেরিয়ে
এদের ঘাঁটি।… দেবতাদের তুলনায় এদের টেকনোলজি খানিকটা পিছিয়ে
ছিল। ফলে খোলা মহাকাশে খালি গায়ে উড়ে বেড়াবার কায়দা এদের রপ্ত হয়নি।
কিম্ভুতকিমাকার স্পেসস্যুটে ঢাকা (প্লিজ নোট!) এই দানবদের চেহারার বর্ণনা ধরা
রয়েছে ওদের নামের মধ্যে। দেবভাষায় এদের নাম দেওয়া হয়েছিল নিবাত কবচ, মানে বায়ুনিরোধক বর্মধারী।”
(৩) জলের তলায় অভিযান বললে প্রথমেই কী মনে
আসে? অবশ্যই জুলে ভার্নের ‘টুয়েন্টি
থাউজেন্ড লীগস আন্ডার দ্য সী’! বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের
ভগীরথ প্রেমেন্দ্র মিত্র তুলনামূলক অনুন্মোচিত এই অভিযান ক্ষেত্রটাকে তুলে
এনেছিলেন তাঁর ‘পাতালে পাঁচবছর’ উপন্যাসে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গত শতাব্দীর বিশের দশকে কলকাতার চাকুরির বাজার যখন অন্ধকার,
তখন সদ্য কলেজ উত্তীর্ণ একঘেয়েমিতে ক্লান্ত দুই যুবক - শরত এবং বিনয়,
অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় একটি মালবাহী জাহাজে সিগন্যাল অপারেটরের কাজ
নিয়ে ভেসে পড়েছিল প্রশান্ত মহাসাগরে। ভাগ্যের বিচিত্র পট পরিবর্তনে তারা
মহাসমুদ্রের তলার ‘এলিয়েন সভ্যতা’র বাসিন্দাদের হাতে বন্দি
হয় এবং তাদের আভ্যন্তরীণ ডামাডোলে জড়িয়ে পড়ে।
আজ থেকে প্রায় ৯০ বছর আগে প্রেমেন্দ্র যে উপন্যাস
লিখেছিলেন তা ফ্যান্টাসি জঁরের সাহিত্যে বিশ্বের যে কোনও সৃষ্টির সমতুল্য হতে পারে
অনায়াসে। কিন্তু যথার্থ বিজ্ঞানভিত্তিক বা কল্পবিজ্ঞানের উপন্যাস তাকে বলা যাবে
না। লেখক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কচকচির ভেতর ঢোকার চাইতে কল্পনার উধাও পক্ষ বিস্তারে
বেশি মনোযোগী ছিলেন এবং ফলস্বরূপ ‘পাতালে পাঁচবছর’ আদ্যন্ত
রোমাঞ্চকর ফ্যান্টাসি ‘টল টেলস’ হিসেবে
পরিগণিত হয়েছে।
‘নিবাত’-এর ক্ষেত্রে
তা বলা যায় না। লেখক এই কাহিনিতে কল্পনার সূত্র বিস্তার করেছেন বহুদূর - পুরাণ
থেকে বর্তমান পর্যন্ত। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তিনি
ভূবিজ্ঞান, প্রাকৃতিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা অথবা বিপর্যয়, তাদের
বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তিসমূহ কখনও অবহেলা করে এড়িয়ে যাননি। বরং
বৈজ্ঞানিক দুঃসাহসে ভর করে তিনি পৌরাণিক ঘটনাবলীকেও কল্পনা ও বিজ্ঞানের স্বাধীনতা
ও যুক্তির যুগলবন্দীতে বাঁধতে চেয়েছেন (পূর্বে উদ্ধৃতাংশ দ্রষ্টব্য)।
সুনামি সৃষ্টির কারণ ও তার ব্যাখ্যা, সাগরতলের রহস্যময়
পরিবেশ বর্ণনা, মহাদেশীয় ও সামুদ্রিক পাত এবং তাদের নড়াচড়া,
সামুদ্রিক ভূমিকম্প এবং ভূতাপীয় বিদ্যুৎশক্তি। উইকিপিডিয়া খুঁজে
তথ্য ভরাট নয়, অনায়াস নৈপুণ্যে লেখক বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যে
সুদৃঢ় করে তুলেছেন ‘নিবাত’-এর কল্পনার
ভিতটিকে।
(৪) ‘আহ নি
বালুগুয়াক্কা মেলুহান’ - জলের তলায় পুঁথি, যে পুঁথিকে
কেন্দ্র করে শুরু হল বিষবৈদ্যের সাগর অভিযান। ‘ইপ্পোঝুরে
তোলাইট্টুকাট্টু’- রচয়িতা জনৈক পদ্মনাভ নেদুনাকিল্লি। এটি
একটি এলিজি বা শোকগাথা; কোনও ব্যক্তির নয়, বরং একটি জনবহুল, ব্যস্ততম সমুদ্রবন্দরের, নাম পুমপুহার। কাবেরী নদীর মোহনায় চোল রাজা কারিকলের নির্মিত বন্দর।
সমুদ্রদানবদের সৃষ্ট পর্বতপ্রমাণ সমুদ্র-সুনামিতে ভেসে গিয়ে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে
যায় যে নগরী।
কাব্যটি কাহিনির প্রয়োজনে কল্পিত হলেও বর্ণিত
ঘটনাগুলি নয়।
তামিল সঙ্গম সাহিত্যের পঞ্চমহাকাব্যের অন্যতম হল
মণিমেখলাই। কোভালান এবং পুমপুহার নগরীর নর্তকীশ্রেষ্ঠা মাধবীর কন্যা মণিমেখলাই
পরবর্তী জীবনে বৌদ্ধ ভিক্ষুণী হয়ে যান। চোলরাজ অত্যাচারী উদয়কুমারণের হাত থেকে
তাঁকে রক্ষা করেন সমুদ্রদেবী মণিমেখলা। লেখকের কল্পনাসাগরে ভেসে মণিমেখলাই এসেছেন ‘নিবাত’-এও। তবে একটু অন্যভাবে। পায়ে হেঁটে সমুদ্র পার হবার সময় সমুদ্রতলবাসী
নিবাত দানবদের হাতে তিনি অপহৃতা হন। তাঁর অনুপম বুদ্ধভক্তি ফিরে আসার পথ করে দেয়
তাঁকে। বন্দী
হাতছাড়া হওয়ায় ক্ষেপে গিয়ে দানবরা ocean vibrator দিয়ে সুনামি সৃষ্টি করে
পুমপুহার ভাসিয়ে দেয়।
‘মণিমেখলাই’ কাব্যগ্রন্থে
এই গল্পই রয়েছে অন্যভাবে। চোলরাজ ইন্দ্রের পূজায় বিভ্রাট ঘটালে ক্ষুদ্ধ সমুদ্রদেবী
মণিমেখলা রাগান্বিত হয়ে সুনামি ঘটিয়ে পুমপুহারের সলিলসমাধি ঘটান।
সমুদ্রদেবী মণিমেখলার সাথে নিবাত কবচ দানবদলের মিল
স্পষ্ট। ‘নিবাত’ কাহিনিতে মণিমেখলাইকে বন্দী দশা থেকে উদ্ধার করে
আর কেউ নয়, মধুর বুদ্ধ ভজনগীতিতে বিবেক জাগরূক হওয়া এক নিবাত
দানবমাত্র।
কাহিনির আরেক অন্যতম প্রধান চরিত্র ‘কোভালান’। তার নামে রয়েছে সঙ্গম সাহিত্যের
স্ট্রং রেফারেন্স। শ্রেষ্ঠ সঙ্গম মহাকাব্য ‘শিলাপ্পাদিগরম’-এর
প্রধান চরিত্রের নামই কোভালান। তার স্ত্রী কন্নগীরস্বামী ছিল
পুমপুহার বাণিজ্য নগরীর বাসিন্দা। ঐতিহাসিক পুমপুহার নগরী এবং এক পৌরাণিক সমুদ্র প্লাবনের
প্রমাণ এভাবেই সঙ্গম সাহিত্যে স্পষ্ট হয়ে রয়েছে।
(৫) পৌরাণিক এবং দ্বাপরযুগ পর্বের পর কাহিনির
তৃতীয় তথা মূল পর্বের পটভূমি ঐতিহাসিক। ১৯৪০-এর দশক। শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের
আঁচ গল্পেও পড়েছে। এশিয়াব্যাপী কুটিল ঔপনিবেশিকতাবাদের অভিশাপ, দুর্মর অত্যাচারী
ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং একই সঙ্গে ব্রিটিশ পণ্যের গুণগত প্রশস্তি।
হিটলার, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ও গণহত্যা - নিবাত
দানবদের দানবীয় প্রযুক্তির কবলে ‘live-streaming’ হয়ে ধরা পড়েছে। ১৯৪১ সালের
সর্বগ্রাসী সুনামী গল্পে এসেছে দুরন্ত চূড়ান্তভাবে।
ইতিহাসের একটা মুছে যাওয়া এপিসোড হিসেবে এসেছে
সিন্ধু সভ্যতা, যা কল্প-সিন্ধুসভ্যতা বলাটাই বোধহয় ঠিক হবে, কারণ ‘দোর্দোবুরুর’ রেফারেন্সে জানা গেছে সেখানেও একুশশো খ্রিস্ট
পূর্বাব্দে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলেছিল দেবতার ভেকধারী ‘এলিয়েন’।
সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর-কলিযুগব্যাপী এই মহাকাহিনিতে বিজ্ঞান
আর কল্পনার অনন্য সমাবেশে উপকথা মহাকাব্য এবং ইতিহাসের সূক্ষ্মতম সুতোগুলো পর্যন্ত
টেনে ধরে সযত্নে গিঁটবদ্ধ করার কাজে যে অনায়াস পটুতার পরিচয় দিয়েছেন লেখক
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য তা একদিকে যেমন রাজকীয় কল্পনাশক্তির প্রমাণবস্তু অপরদিকে
রসজ্ঞ পাঠকের কাছে একটি অননুকরণীয় পাঠ-অভিজ্ঞতা। এমন গল্প পড়ার পর বাংলা সাহিত্যকে
নিয়ে গর্ব করা যায়। মনে
হয় হ্যাঁ, উপযুক্ত resource পেলে কোনও অন্নগত প্রাণ বাঙালি
লেখক ইংরেজি ভাষা-সংস্কৃতির পার্শ্ব চাপে ক্রমাগত কোণঠাসা বাংলা ভাষায়, হ্যাঁ,
হ্যারি পটারের জন্ম দিতে পারেন। তৈরি করে ফেলতেই পারেন Lord of the Rings-এর
ফ্যান্টাসি পৃথিবী বা Chronicles of Narnia-র মায়াজগৎ।
পুরাণ-উপকথা বিনির্মাণ করে বাংলাতেও কেউ হয়ে যেতে
পারেন Neil Gaiman। কিছুই অসম্ভব নয়। এই একটি ‘নিবাত কবচ অভিযান’
পড়ার অভিজ্ঞতা অথবা অভিঘাত মনে এই আশার জন্ম দেয়, Star Wars
saga বা Marvel শৈলীর Guardians of the
Galaxy বাংলা সাহিত্যে করাটা অলৌকিক কিছু নয়। দরকার এগিয়ে আসার। যদি
আশৈশব ইংরেজি লালিত, বিদ্যে-বোঝাই বাবুমশাই স্টাইলে বাংলা
সাহিত্যের তদবির করতে আসা উন্নাসিক পাঠকের Star Wars এবং Marvel
বা Neil Gaiman-এর নামে চোখ খানিক টেরছা হয়ে
যায় তাঁর অবগতির জন্য খানিক উদ্ধৃত করা যাক –
“শেষমেশ দেবতাদের জরুরি মিটিং বসল ব্রহ্মার
দরবারে। সেখানে সব মাথা এক করে বুদ্ধি বের হল একটা। দেখা গিয়েছিল, প্রতি মিলেনিয়ামে এই সৌভগুলো একবার করে গভীর মহাকাশে গিয়ে ডকিং করে। সেই
একে অন্যের সাথে জুড়ে যাবার মুহূর্তে শক্তিবর্মের আচ্ছাদন সরে যেতে বাধ্য। নইলে
জুড়বে কী করে? অতত্রব ঠিক সেই মুহূর্তটাতে যদি মোক্ষম একটা
ঘা দেওয়া যায় তবে কাজ হতে পারে কিছু।
এরপর, প্ল্যান অনুযায়ী আগুনের তৈরি দানবিক একটা
তির বানানো হল। গোটা পৃথিবীটা হল যুদ্ধযান। তারপর, পরের বার
সৌভ তিনটে ডকিংয়ের জন্য রওনা দিতেই পৃথিবীটাকে চালিয়ে নিয়ে ব্রহ্মা ধেয়ে গেলেন
গভীর মহাকাশে, আর ডকিংয়ের মুহূর্তে পৃথিবীযানে সওয়ার হয়ে বসা
মহাদেব ছুঁড়লেন তাঁর আগ্নেয়াস্ত্র। যুদ্ধনগরী ভেঙে পড়ল পৃথিবীর বুকে। দানবগুলোকে
সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে ব্রহ্মা আর মহাদেব ফিরে গেলেন।”
সম্ভাবনার বিপুলতা চোখ এড়িয়ে যাওয়ার নয়! সাহিত্যিক
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য কল্পবিজ্ঞানকে দেখেন একটা অন্যস্তর থেকে। তাই যখন তিনি লেখেন, শুধুমাত্র
ভবিষ্যত পৃথিবীর অবশ্যম্ভাবী যন্ত্রসভ্যতার বিজয়োল্লাস আর তদ্জনিত মানবপ্রজাতির
অন্তর্নিহিত ঘোর শূন্যতার বিশ্লেষণে ব্যস্ত থাকেন না, কল্পবিজ্ঞানকে
তিনি আয়াসসাধ্য প্রতিভায় গূঢ় দর্শনের তূরীয় উৎকর্ষে সাধন করতে পারেন।
ভারতীয় পুরাণ এবং তামিল সঙ্গম সাহিত্যের বিপুল স্তরবিন্যস্ত
ঘটনা এবং চরিত্রাবলী এই ‘নিবাত কবচ অভিযান’ নভেলায় এক কল্পবৈজ্ঞানিক রূপকের
রূপ নিয়েছে। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর দেবতাত্মা মাত্র নন, ভিনগ্রহের
জীব। নিঃস্বার্থ
মোটেই নন, নন নিরাকার। বরং চতুর, যুদ্ধপ্রিয়,
হিংস্র এবং রক্তলোলুপ।
‘মানুষের মধ্যেই ভগবান রয়েছেন’, তবে
প্রতিস্থাপিত জিনের মাধ্যমে। দানবদের দেখানো হয়েছে সহানুভূতির সঙ্গে। তার সঙ্গে
এটাও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে তাদের মূল দুর্বলতা তাদের প্রবল অহংকার। তীব্র
অহংবোধ তাদের নির্বোধ করেছে এবং সেই নির্বুদ্ধিতাই মহাশক্তিশালী তাদের পতনের
একমাত্র কারণ।
উপাখ্যান জটিল। বিন্যস্ত করতে ব্যবহৃত হয়েছে
সংস্কৃতগন্ধী তৎসম, আধুনিক কথ্য এবং সুপ্রচলিত ইংরেজি শব্দের মিশ্রণ আর সায়েন্টিফিক টার্মসের
ক্ষেত্রে আপাত খামখেয়ালিপনায় কখনও অবিকৃত রূপ, কখনও আক্ষরিক বাংলা রূপান্তর। ভাষার
এমন আপাত অপ্রচলিত ব্যবহারে কেউ ঠোক্কর খেতে পারেন বার বার, কেউ
কঠিন ভেবে সরিয়ে রাখতে পারেন, আবার কেউ উদ্ভট জগাখিচুড়ি গণ্য
করে শাপমন্যি করতে পারেন। অনভ্যস্ত পাঠ-অভ্যাস পদে পদে বাধা পাবে সন্দেহ নেই। নতুন
কথা বলতে গেলে তৈরি করে নিতে হয় নতুন ভাষা বা শৈলী, যা
অনেকটাই নিজস্ব। এই চিরকালের রীতি। পাঠকের দায় তৈরি হয়ে আসার।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEho8DbXKR9u5xsx4mCFRU3Hn_Hwu6xw4qetPgvI0aCNEe8mgYYHQz5ZhgFnLlMXRUbNdYXPlBYsEd4O8XC-l17v92MENu3dkJRzeYp-USNKE0O9iMNUNiOShXYTEMF2tNEg9IUcBTJUAdw/s640/ponkhilal.jpg)
বিষবৈদ্য এবং
বোধহয় অনেকেই গালাগালি দিচ্ছেন। শুরুতে বলা হয়েছে
বিষবৈদ্য এমন একজন চরিত্র যাঁর কোনও মলাটের প্রয়োজন হয় না, এদিকে পুরো
আলোচনায় বিষবৈদ্যর নামটাও নেওয়া হয়নি। স্বেচ্ছাকৃত।
বিষবৈদ্য এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যাঁর ইতিহাস-ভূগোল
একটি বা অসংখ্য ভিন্ন আলোচনার দাবি রাখে। ‘নিবাত’ তো তাঁর
একমাত্র অভিযান নয়। গত একশো বছরে স্বনামে বেনামে এমন কোনও অভিযান কি আছে যা তিনি
করতে বাকি রেখেছেন! তাঁর ‘তস্য তস্য’ পূর্বপুরুষগণকে
ধরলে তো অভিযানের সময়সীমা আরও পাঁচশো বছর বিস্তৃত হয়ে যাবে! ‘তস্য তস্য’র ছাড়া সুতোটা যাঁরা ধরতে পারলেন না,
তাঁদের জন্য ভণিতা আরও বিস্তৃত করা যাক।
বিষবৈদ্যর অভিযানগুলোর সময়সীমা লক্ষ করলে দেখা যাবে,
হারিয়ে যাওয়া সিন্ধুনগরে ‘দোর্দোবুরুর বাক্স’র রহস্য সন্ধানে অধুনা পাঞ্জাব-পেশোয়ার
ঘিরে বিষবৈদ্য তাঁর প্রথম অভিযান করেন উনিশশো বত্রিশ কি তেত্রিশ সাল নাগাদ। নিতুর
কাকা হয়ে সেই গল্প তিনি বলছেন পুরনো কলকাতার ক্লাবঘরে ১৯৮০-এর দশকে।
‘নিবাত কবচ অভিযান’-এর
সময়কাল বিধ্বংসীতার ইতিহাসে ঢুকে যাওয়া সেই ভারত মহাসাগরীয় সুনামিকে কেন্দ্র করে
১৯৪১ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন ফুল সুইংয়ে। সে গল্প পুনরায় ক্লাবঘরে
স্বভাবসুলভ বৈঠকি চালে বেগুনি সহযোগে হচ্ছে ১৯৭৯-৮০-র’ দশকের কলকাতাতেই।
নিতুর কাকা নামে পরিচিত বর্তমানে কোনও এক দাদার
বাড়িতে বৌদির আদরে-প্রশ্রয়ে থাকা হরেক কিসিমের ঔষধের দোকানদার অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়
বিষবৈদ্যের বয়স কত হতে পারে মনে হচ্ছে? অন্ততপক্ষে ষাট বা পঁয়ষট্টি, সত্তরও হলে হতে পারে। কিন্তু কাহিনির উপক্রমণিকা পড়ে পাঠকের কখনও কি
সচেতনভাবে মনে হয় বিষবৈদ্য প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায় পৌঁছেছেন?
না! বরং মুড হলে তক্ষুনি পুলু, নিতু, সুকল্যাণ আর কাহিনির কথক - এই চার নাবালকদের নিয়ে নতুন অভিযানে পাড়ি তিনি
দিতেই পারেন। অর্থাৎ, দেখে বয়সের গাছপাথর বোঝা যায় না।
এতক্ষণেও যদি না চিনতে পারেন তাঁকে তাহলে
কথাবার্তায় যিনি বাগাড়ম্বরভাব হয়তো লুকোতে চাইলেও মুদ্রাদোষে দু-একটা বাক্যে কেউ
কেউ চিনে ফেলতে পারেনই তাঁকে যেমন, “’চিকাজাই শহরের গোলকদেবতার মৃত্যুগুহায় আর
দশটা কঙ্কালের মতো আমার শুকনো হাড় কখানাও পড়ে থাকত।” বা
পুলুর ফুটকাটায় সেই শিবু, শিশির, গৌর
বা ঈষৎ বোকাটে সুধীরের ছায়াই যেন ফুটে ওঠে অজানিতে, “সেই বিদ্রোহী প্রজাটি নিশ্চয়ই
আপনি নিজেই ছিলেন?” অথবা সেই পুরনো ‘কাঠচেরা
গলা’টাও মাঝে মাঝে তিনি একদম আড়াল করে ফেলতে পারেননি। অথবা থেকে থেকে তাঁর সেই অদম্য স্বজাতি
ঐতিহ্যপ্রীতি, “ছোঃ। ওসব ক্লার্ক, এসিমভদের সাত হাটে বেচে আসতে পারবে আমাদের ব্যাসমুনি। অবশ্য
হবে নাই বা কেন? সাহেবগুলো তো বানিয়ে বানিয়ে লিখত। সত্যিকারের
গল্পের সাথে এঁটে উঠতে পারবে কেমন করে?”
এসবেও যদি নিতুর কাকা সেজে ক্লাবঘরে খবরের কাগজ ও
পাঁজি পড়া এবং নিতু-পুলুর কাজকর্ম কথাবার্তায় আড়ি পাতা হরেক কিসিমের ঔষধির
দোকানদারি করা বিষবৈদ্যকে ৭২ নম্বর বনমালী নস্কর লেনের তেতলা বাড়ির টঙের ঘরে যিনি
থাকেন, চিনে নিতে অসুবিধে হয় তাহলে নিদারুণ করুণা করা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে
না।
ঘনাদা!
আর কে হবেন! ঘনরাম দাসসহ তস্য তস্যদের সরিয়ে রেখে
হিসেব করলে বনমালী নস্কর লেনের সপ্তাহান্তের বৈঠকি আড্ডায় ঘনশ্যাম দাসের প্রথম
অভিযান ‘১৯৩৯ সালের ৫ অগাস্ট। শাখালীন দ্বীপে!’ সেখানে তিনি
একটি ‘মশা’ মেরেছিলেন।
তার গল্প তিনি করছেন ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের পুজোয় -
দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকী ‘আলপনা’য়।
যাঁদের এখনও ‘চিনব চিনব করছি কিন্তু চিনতে পারছি না’ দশা’,
লক্ষ করবেন বিষবৈদ্যর অভিযানের সময়ও ওই কাছাকাছি। ‘মশা’র পর আরও অর্ধশতাধিক অভিযানের কথা আমরা পাই ঘনাদার বিভিন্ন গল্পে।
মৌ-কা-সা-বি-স-এর অদ্ভুত কাহিনি বাদ দিলে ঘনাদার শেষ অভিযান ‘ঘনাদার চিংড়ি বৃত্তান্ত’ - প্রকাশিত হয়েছে ১৯৮৬-এর
আনন্দমেলায়। এই গল্পেই মেসবাসীদের মুখে তাঁর বয়সের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে ঘনাদা ‘প্লেটের ওপর প্যাগোডার’ মতো কচুরি সামলাতে গিয়ে
প্রবল বিষম খান। এই গল্পেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সদ্য হেরে যাওয়া, কিন্তু শয়তান হিটলারের অধিনায়কত্বে আবার বিশ্ববশ করার স্বপ্নে মশগুল এক
জার্মান ইবলিশের চরের ঘনাদার হাতে নাকানিচোবানি খাওয়ার কথা বর্ণিত আছে। সময়কাল
১৯১৯, সবে ভারসাই সন্ধি স্বাক্ষরিত, সইয়ের
কালি ফুরোতে না ফুরোতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা নির্মাণের
প্রস্তুতি।
এই গল্পের পর ঘনাদার বা ৭২ নম্বর বনমালী নস্কর
লেনের আর খোঁজখবর নেই। তার কারণ কি সেই লীলা মজুমদার যাকে বলেছিলেন ‘ভিজে বেড়াল’
সেই সুধীর-রূপী প্রেমেন্দ্র মিত্রের মহাপ্রয়াণ? তার জন্যই কি ঘনাদার ৭২ নম্বর মেসত্যাগ এবং নিতুর কাকা হয়ে ক্লাবঘরে
নাবালক আড্ডায় চলে আসা!
বিষবৈদ্যর ঠিকানা কিন্তু এখনও অজানা। যেটুকু জানা
যায়, কলেজ স্ট্রীট মার্কেটে তাঁর বিষবদ্যির দোকান আছে বা ছিল। মনে রাখতে হবে, ঘনাদার ঠিকানাও
একইভাবে প্রথম প্রথম জানানো হয়নি। ঘনাদার মেসের ঠিকানা যে বাহাত্তুরে বনমালী নস্কর
লেন তা জানানো হয়েছে পাঁচ-পাঁচটা গল্প বা অভিযান পেরিয়ে ছ’নম্বর ‘টুপি’তে। চো মো লঙ মা দিয়ে শুরু হয়ে সে অভিযান শেষ হয়েছিল বরফ-দানব ইয়েতির সাথে
ঘনাদার দেখাসাক্ষাতের মাধ্যমে।
বলুন, পাঠকের সাথে এমনতরো লুকোছাপাতে কি লেখকের
বা কথকের সাথে ঘনাদার একটা গুপ্ত যোগসাজশ স্পষ্ট হচ্ছে না? এবং
একইরকম কথক-নায়ক গুপ্ত যোগসাজশের অভ্যাস বিষবৈদ্যর ভেতরেও দেখা যাচ্ছে নাকি! গুপ্ত
যোগসাজস এবং অঙ্ককষা চালাকির প্রমাণ আরও জোর পাবে যখন দেখা যাবে ঘনাদার গল্পের কথক
‘আমি’ সর্বনামের আড়ালে নিশ্চুপে গা
ঢাকা দিয়েছিল ঘনাদার প্রথম আটাশটি গল্প বা অভিযানে। অন্যদের সাথে মাঝে মাঝে গলা
মেলানো বা তালে তাল দেওয়ার বাইরে তার অস্তিত্ব বিন্দুমাত্রও প্রকাশিত হয়নি। ঘনাদাই
প্রথম তাকে ‘বেকায়দায়’ ফেলে দেন তাঁর
২৯তম কাহিনির ভণিতায় –“আরে! শিবু-সুধীর যে!” বলে গলা ছেড়ে
হেঁকে তিনিই কথক সুধীরের সব লুকোছাপার দফারফা করেন। এই কাহিনির, যা ‘ধুলো’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল দেব সাহিত্য কুটিরের পূজাবার্ষিকী
‘ইন্দ্রনীল’ (১৯৬৮)-এ,
পরে যা ‘যাঁর নাম ঘনাদা’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়, পর থেকে সুধীর আর বেশি ট্যাঁ ফোঁ করতে পারেনি।
আমরা সবাই তাকে চিনে যাই।
একই কথা কি বিষবৈদ্যর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য নয়? ‘দোর্দোবুরুর
বাক্স’-এর সূচনায় ক্লাবঘরে বসে বসে পুলু, নিতু আর বিষবৈদ্যর বর্ণনা বিশদভাবে দিলেও নিজে মুখটি নাড়েনি গল্পের কথক। কোনও
কিছুই তার চোখ এড়িয়ে যায় না, কিন্তু সে নিজের পরিচিতির ব্যাপারে কঠোর নীরবতা পালন
করে।
ঘনাদার গল্পে উত্তমপুরুষ তথা কথক নিজের পরিচিতি তো
কোনও লুকনো চালাকি করে গোপন রেখেইছিল; ঘনাদা তাঁর স্বভাবসুলভ গলাবাজিতে তা ফাঁস
করে দেওয়ার আগে অবদি, এমনকি প্রথমদিককার গল্প বা অভিযানে
মুখও খোলেনি! শুধু জানা গেছিল, উত্তমপুরুষে যিনি উপস্থিত তিনিও
শিবু-শিশির-গৌরের মতো বাহাত্তুরে মেসেরই একজন বাসিন্দা। এই উত্তমপুরুষ (তথা, ২৯ নম্বর অভিযানে ঘনাদার কেরামতিতে যাঁর নাম জানা যাবে সুধীর, লীলা মজুমদার যাকে সার্থকভাবেই ‘ভিজে বেড়াল’ বলে অভিহিত করবেন) প্রথম মুখ খুলছেন ঘনাদার ষোলো নম্বর কাহিনি বা অভিযানে,
যা ‘ছুঁচ’ নামে ‘আবার ঘনাদা’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হবে।
ঘনাদাকে চটিয়ে দিয়ে তাঁর মুখ থেকে একটা দুর্ধর্ষ
রোমাঞ্চ কাহিনি বের করিয়ে নিয়ে সপ্তাহান্তের সন্ধেবেলার একঘেয়েমি দূর করার জন্য
বাহাত্তর নম্বরের সবাই মিলে মাঠে নামা হয়েছে। প্রথম পর্বের ব্যর্থতার পর
প্রথমবারের মতো তার মুখে সংলাপ শোনা যায়, ঘনাদাকে তাতানোর জন্য ‘আরও কড়া দাওয়াই’-এর সিদ্ধান্ত করছে সে।
বিষবৈদ্যর সঙ্গে মেলানো যাক। প্রথম অভিযান ‘দোর্দোবুরুর বাক্স’-এ তো চোখ-কান খোলা রেখে নিশ্চুপ থেকেছে সে, গল্পের
কথক। মুখ খুলছে তৃতীয় অভিযান ‘নিবাত’-এর
একদম শেষ পরিচ্ছেদের শেষভাগে। কোমরের গেঁজ থেকে খুলে নিতুর কাকা তথা বিষবৈদ্য ‘একটা স্টিলের ছোট্ট টুকরো’ বের করে আনতে সে যেন একান্ত নিরুপায়ভাবে, যেন
আর কেউ জিজ্ঞাসা করছে না বলেই তাকে করতে হচ্ছে এইভাবে, প্রথমবারের জন্য মুখ খোলে, “বললাম, ওটা কী?”
এখনও কিন্তু সে নিজের নাম প্রকাশ করেনি। হয়তো এক্ষেত্রেও
বিষবৈদ্যই হেঁকে উঠে কোনওদিন সুধীরের মতো তার নামটাও প্রকাশ করবেন পাঠকের কাছে। দুই কথকের এমন একইরকম লুকোছাপা যোগসাজশে কি ঘনাদা আর বিষবৈদ্যর
আঁতাতটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হচ্ছে না? তবুও
কথা রয়ে যায়। বলা যেতেই পারে, কই, বিষবৈদ্য তো ভাঁড়ামো করছেন
না ঘনাদার মতো। ক্লাবের শ্রোতারা মাঝে মাঝে একটু অবাক হলেও মোটামুটি অভিযানগুলোকে
মিথ্যে মনে যে করে না তার প্রমাণ কথকের বর্ণনাভঙ্গীতে স্পষ্ট।
তারও ব্যাখ্যা আছে। ঘনাদা বনমালী নস্করে আড্ডা
বসানোর আগে সান্ধ্যকালীন সরোবর সভায় সান্ধ্যভ্রমণে যেতেন মনে আছে? সেখানেও তিনি
আড্ডা জমাতেন। ‘মেদভারে যাঁর দেহ হস্তীর মতো বিপুল’ সেই ভবতারণবাবু, ‘কুম্ভের মতো উদরদেশ যাঁর স্ফীত’
সেই ভোজনপ্রিয় রামশরণবাবু, ‘মস্তক যাঁর
মর্মরের মতো মসৃণ’ সেই ইতিহাসের ভূতপূর্ব অধ্যাপক শিবপদবাবু,
‘মাথার কেশ যাঁর কাশের মতোই শুভ্র’ সেই
হরিসাধনবাবু সরোবরসভায় ঘনশ্যামবাবুর মুখ থেকে শুনতেন তাঁরই পূর্বপুরুষ তথা ‘তস্য তস্য’ ঘনরাম দাসের ইতিহাস উথালপাতাল করা কাহিনি। আর কেউই সেইসব কাহিনিকে
একটু আধটু সন্দেহ করলেও অবিশ্বাসে উড়িয়ে দিতে পারত না।
এমনকি ঘনাদার প্রথম গল্প ‘মশা’তেও আমরা দেখি মেসবাসী চাকুরিজীবী শিবু-শিশিররা ঘনাদার গল্পে চমৎকৃত হয়ে
ঘনাদাকে প্রায় একজন মহাপুরুষই ঠাউরে ফেলেছে। মোটেও তারা তাঁর কাহিনিগুলোকে ভড়ংবাজী
তো ভাবেই না, বরং অসম্ভব সব অভিযানকাহিনিতে কোনও খুঁত চেষ্টা করেও না খুঁজে পাওয়ার
চাপে কাহিল হয়ে একটু দূরে দূরে থাকারই চেষ্টা করে। কালে
কালে তাদের চৈতন্যোদয় হলেও ততদিনে তারা ঘনাদার নেশায় এতদূর পতিত হয়েছে যে ঘনাদার
অভিযানগুলো বকমবাজী জেনেও নতুন নতুন বাগাড়ম্বর শোনার জন্য নিত্যনতুন ভড়ংয়ের আয়োজন
করতে হয় তাদেরকেই। সঙ্গে ভুরিভোজন তো আছেই।
ক্লাবঘরে নিতুর কাকা সেজে যিনি বসে আছেন, পুলু-সুকল্যাণরা
জানেও না কিছুদিনের মধ্যেই কী চরম পরিস্থিতিতে পড়তে চলেছে তারা। বিষবৈদ্যর অ্যাডভেঞ্চারের
নেশায় তারাও পড়ল বলে। তখন হয়তো এই অধুনা বিষবৈদ্য শুধুমাত্র ‘রমেনের দোকানের বেগুনিভাজা’তেই সন্তুষ্ট থাকবেন না,
একথা একটু জোর দিয়েই বলা যায়।
‘নিবাত কবচ’-এর গল্প ফাঁদার ছলে সম্পূর্ণ
ফোকাস নিজের দিকে করে নেওয়া এবং একই সঙ্গে মহা তোড়জোড় করে সমবেত মহাভারতীয় কুইজ
কম্পিটিশনের দফারফা করে দেওয়ার ছলে আমরা তাঁর আগমনধ্বনিই যেন শুনতে পাই।
সেই ‘দাদা’ গল্পেই তিনি
মেসের মৌরসিপাট্টা ছেড়েছিলেন একবার। প্রায় মাস দুয়েকের জন্য। শিবু-শিশির-গৌরের ওপর
রাগ করেই হয়তো বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর তিনি আবার ছেড়েছেন।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhyRfpCAMGFTxQXZx7gAHTmQspZnpUnQPzZzPPRBMnxunBga4lntkNy5klmEEBGmW0vcpEDTGjL_YVlboqfxHgA07VeGwkgb1oXuDnIKSvxdoNCm_J4PUF4SwfmcSummVV1yoidQI4LzNs/s400/Nibat+olonkoron+2.jpg)
[ওপরের ছবিটি বিষবৈদ্যর, ‘নিবাত কবচ অভিযান’ গ্রন্থে অর্পণ সাধুখাঁর করা অলংকরণ। আর নিচের ছবিটি
ঘনাদা এন্ড কোং-এর, ওঙ্কারনাথ
ভট্টাচার্যর তুলিতে। উৎসাহী দ্রষ্টা পাঠক ছবিদুটি থেকে ঠিকই ধরে নিতে পারবেন,
দুই শিল্পীর কল্পনায় কিছু পার্থক্য থাকলেও, বিষবৈদ্য তাঁর ছদ্মবেশ যত্নসহকারে ধারণ
করলেও আসলে আত্মপরিচিতি লুকোতে পারেননি বা চাননি।]
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEgrIC-C9OnAZZp6nz8ymESqNPrNiScveShRYd2zfAPgwUsdVa42aYHmhKVE1CwpWJuaS3ehyphenhyphenlrPkDD7JL2SZChuAw0dHOy4VmZttJb3jE-OBmOFyRdGCxmzzSwEecdvYsicU5T6nMxsFvY/s400/Ghanada.jpg)
নিতুর কাকা হয়ে গল্প শোনানোর খাঁইয়ের পরিতৃপ্তি
ঘটাতেই যেন নাবালকদের ক্লাবে তাঁকে আসতে হয়েছে। হয়তো সিগারেটের অভাবে একটু কষ্ট
পাচ্ছেন। শিশির তো নেই যে ধার নেবেন। বাচ্চা ছেলেদের সামনে খাওয়াও যায়
না, সম্পাদকমশাই রাগ করবেন। সিগারেট এখন কিশোরসাহিত্যে নিষিদ্ধ।
তবে গল্পের কথক, যে সুধীরের মতোই লুকিয়ে লুকিয়ে মজাগুলো
নিচ্ছে, নামটা এখনও প্রকাশ করেনি, মহা বুদ্ধিমানের মতো একটা টেকনিক প্রয়োগ করে
বিষবৈদ্য তথা ঘনাদার আসল পরিচয় প্রায় লুকিয়েই ফেলেছিল বলা যায়। ‘দোর্দোবুরুর বাক্স’-এ ভণিতা বা উপক্রমণিকা যখন শেষপর্যায়ে,
বহু চেষ্টা করেও নামহীন কথক লুকোতে পারছে না বিষবৈদ্যর আসল পরিচয় যে
ইনিই সেই টঙের ঘরের তিনি; সবাই ধরে ফেলে ফেলে, তখনি মোক্ষম চাল দেন বিষবৈদ্য। চলে আসে একটি চরিত্র যার নামটাই হল ঘনা। সে
বাহাত্তর নম্বরের বনোয়ারির মতোই চা-বেগুনি আনার কাজটা করে। ব্যস! anti-thesis! ঘনা যখন আছে তো ঘনাদা আসেন
কেমন করে!
তাই হোক! তবে এই যন্ত্রযুগের চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন
বর্তমান প্রজন্ম প্রকৃত যোগাযোগের ব্যাপারটা মাথা থেকে মুছে ফেলে আইনস্টাইনবর্ণিত ‘generation of idiots’-এ পরিণত হয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে ঘনাদা থাকলে কী
করতেন তা জানতে ইচ্ছে করে। কারণ, ঘনাদাকে যদি দেখি তিনি ছিলেন অত্যন্ত সমসাময়িক।
ইউরোপকেন্দ্রিক বিশ্বজোড়া নিষ্ঠুর ঔপনিবেশিক চক্রান্তবাদের বিরুদ্ধে তিনি একা
হাতেই নিজেকে One Man Army রূপে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুধীর চলে যাওয়ায় ঘনাদাও এখন অজ্ঞাতবাসে।
বিষবৈদ্য ঘনাদা হোন বা না হোন, তিরিশ-চল্লিশ বা
সত্তরের পুরনো পৃথিবী, ইতিহাস, বিশ্বযুদ্ধ,
পুরাণের সঙ্গে সঙ্গে এই জটিল, প্যাঁচালো এবং
সম্পূর্ণভাবে দিশাহীন বর্তমানেও পা তিনি রাখবেন এই দুর্নিবার আশা রেখে নির্বুদ্ধি প্রদর্শক
লেখাটি এখানেই শেষ করলাম।
বিষবৈদ্য
মিস করবেন না,
ঘনশ্যাম এবং ঘনরাম দাসকেও না! যদি করেন, পাঠক
হিসেবে আপনার পাপের ভাগ কেউ নিতে আসবে না।
|| আলোচিত গ্রন্থ ||
১. নিবাত কবচ অভিযান - দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (অরণ্যমন
প্রকাশনী)
২. পংখীলালের গুহা - ঐ (সুচেতনা পাবলিশার্স)
৩. দোর্দোবুরুর বাক্স - ঐ (আনন্দ পাবলিশার্স)
এবং
★ ঘনাদা সমগ্র ১,
২, ৩ - প্রেমেন্দ্র মিত্র (আনন্দ পাবলিশার্স)
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhL_SoUsv0qZveadhv99I8pwtKAaCqhrSEze6DICphsLGD0cenhIm8mRoC61iz1f4APovRH7C_8VzzHy2CHlFNoXSx9tIb5XQXq5nLpxkZoIAkG5P2G3f-fx-G78Ewu889Tvj8L7a7vtXs/s320/dordoburu.jpg)
_____
No comments:
Post a Comment