গল্পের ম্যাজিক:: পিউ ও সেই গুলমোহর গাছটা - সুদীপ চ্যাটার্জী


পিউ ও সেই গুলমোহর গাছটা
সুদীপ চ্যাটার্জী

।। এক।।

পিউদের বাড়ির কাছে একটা গুলমোহরগাছ আছে ছাদে উঠলে গাছটা পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায় বেশিরভাগ সময়ই গাছটা ছেয়ে থাকে কমলা ফুলে, অনেক পাখি আর কাঠবেড়ালি এসে বাসা বেঁধেছে গাছটায় পিউর কেন যেন মনে হয় সবুজ কমলা রঙের গাছটা তার সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা বলেকিন্তু গাছ তো আর কথা বলতে পারে না পিউর সেটা মনের  ভুল তাকে দেখলেই যেন গুলমোহরগাছটা হেসে ওঠেতার পাতা আর ফুলের রঙে আলাদা একটা রোশনাই দেখতে পায় পিউ ছোটোবেলা থেকে পিউ অভিমান হলে কাউকে কিছু না জানিয়ে টুক করে চলে আসে ছাদে; এককোণে বসে তাকিয়ে থাকে তার প্রিয় গাছটির দিকে মনের সব কথা খুলে বলে তাকে বলতে বলতে তার মন ভালো হয়ে যায় পিউদের ছাদটা বিশাল বড়োঅনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায় সেখান থেকে বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে সে তার আঁকার খাতা নিয়ে চলে আসে ছাদে কতবার কতরকমভাবে যে পিউ তার বন্ধু-গাছের ছবি এঁকেছে, তা গুণে শেষ করা যাবে না তার মা ইয়ার্কি করে বলেন,পিউয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড স্কুলে যায় না রে সে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে সারাদিন আর পিউয়ের জন্যে অপেক্ষা করে
পিউর খুব ভালো লাগে তার বন্ধু সবচেয়ে আলাদা স্কুলে টুকুন, স্নেহা, দোলন, ছুটির কাছেও পিউ তার বন্ধু গুলমোহরের গল্প করে কোনও কোনও ছুটির দিন সবাই মিলে সেই ছায়াঘন গাছের নিচে বসে পিকনিক করে মাঝে মাঝে ঠান্ডা হাওয়ায় টুপটাপ করে গাছ থেকে ঝরে পড়ে শুকনো পাতা অথবা লাল রঙের ফুল তখন তাদের মনে হয়, গাছটাও ওদের সঙ্গে পিকনিকে যোগ দিয়েছে
পিউদের বাড়িটা শহর থেকে খানিকটা দূরে সেখানে এখনও গাড়িঘোড়ার কোলাহল এসে পৌঁছয়নি ছোটো ছোটো বাড়িগুলোকে ঘিরে থাকে ফুলের বাগান, আম, পেয়ারা, বট, কাঁঠালগাছ স্কুলের পাশে ছোটোদের জন্যে খেলার পার্ক আছে সন্ধের আগে কমলা রঙের পড়ন্ত আলোয় যখন মেঘ আর আকাশ একে অপরকে আবির লাগিয়ে দেয়, গুলমোহর আর পিউ এক সঙ্গে চুপ করে চেয়ে থাকে দিগন্তের দিকে পিউর বাবা চাকরির কাজে বেশিরভাগ সময়ে বাইরে থাকেনবাড়িতে আছেন তার মা, পিসি, দিদান আর বল্টুকাকা পিউর দাদু অনেকদিন হল নিখোঁজ তিনি সায়েন্টিস্ট ছিলেন দিদান পিউকে বলেছেন দাদু একবার কাজে গিয়ে আর ফিরে আসেননি সকলেই একটু একটু করে সেই দুঃখ মেনে নিয়েছে মানুষ তো চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যেতে পারে নাসকলে ধরেই নিয়েছে যে তিনি আর হয়তো বেঁচে নেই দিদান কিন্তু এখনও মনে মনে বিশ্বাস করেন যে দাদু একদিন ফিরে আসবেন দিদানের সঙ্গে পিউয়ের খুব ভাব রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে দিদান পিউকে রোজ একটা করে গল্প বলেন রূপকথার গল্প, দাদুর গল্প শুনতে শুনতে দিদানের কাছেই ঘুমিয়ে পড়ে পিউ
গত সপ্তাহেই পিউর জন্মদিন ছিল দিদান তাকে ইয়াবড়ো একটা রঙের বাক্স কিনে দিয়েছেন পিউ খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারে তার মা বলেন, চর্চা চালাতে পারলে পিউ বড়ো হয়ে ভালো আর্টিস্ট হতে পারে তার আঁকার একটা বিশেষত্ব হল একবার পিউ যা দেখে সেই দৃশ্য সে কখনও ভোলে না পরে কোনওদিন আঁকতে গেলে সে হুবহু সেই দৃশ্যের ছবি এঁকে দিতে পারে প্রথম প্রথম লোকে চমকে যেত কিন্তু এখন সকলে তার প্রতিভার কথা জেনে গেছে কিন্তু আজ সকালে যেটা হল সেটা একটু অন্যরকম সকালবেলায় পিউর ঘরে গিয়ে মা দেখলেন যে পিউ একটা ছবি আঁকতে আঁকতে ঘুমিয়ে পড়েছে সাবধানে তার মাথার তলা থেকে ড্রয়িং খাতাটা বের করে আনলেন মা ছবিটা খুব সুন্দর একটা সবুজ বাগান বাগানের ঠিক মাঝখানে শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে পিউর প্রিয় গুলমোহরগাছটা গাছে ফুল উপচে পড়ছে গাছের চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে দুটো কাঠবেড়ালি, একটা সাদা রঙের বেড়াল, একটা ময়ূর আর একটা সাদাকালো পান্ডা ভাল্লুক তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরও একটা ছেলে ভীষণ সুন্দর দেখতে তাকে, কিন্তু চোখগুলো উদাস কিন্তু সেই ছেলেটার হাতের জায়গায় দুটো সোনালি রঙের ডানা মা অবাক চোখে একবার ছবির দিকে, একবার ঘুমিয়ে থাকা পিউর দিকে তাকালেন তার ভুরু কুঁচকে গেল ছবিটা হাতে করে তিনি বাইরে পিউয়ের দিদানের কাছে চলে এলেন দিদানের হাতে ছবিটা দিয়ে বললেন,অন্তুর ছবি কিন্তু পিউ তো ওকে কোনওদিন দেখেনি তাহলে কি সত্যি সত্যি...!
দিদান একমনে ছবির দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ তারপর ধীরে ধীরে বললেন,পিউর এগারো বছর বয়স হয়ে গেছে সুলেখা সুপ্রতিম যা বলেছিল তা যদি সত্যি হয় তাহলে হয়তো আমাদের আর দেরি করা ঠিক হবে না আমাদের এবার ওকে সবকিছু খুলে বলা উচিত

।। দুই।।

অন্তুর খুব মনখারাপ সকালবেলায় উঠে হাত মুখ না ধুয়েই বাগানে চলে এল সে বাগানটা তার বড়ো প্রিয় নানারকমের ফুল আর লতানে গাছ আছে এখানে যখনই তার মনখারাপ করে এখানে এসে বসে থাকে সে আজ তার জন্মদিন এগারো বছর বয়েস হল তারকিন্তু জন্মদিন সেলিব্রেট করার জন্যে বাড়িতে আজ কেউ নেই অন্তু থাকে তার পিসির কাছে তার মা-বাবা নেই অন্তু যখন ছোটো ছিল মা আর বাবা একটা অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে অন্তুর পিসি মাসখানেক হল গুরুতরভাবে অসুস্থ বলে তাকে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তারা থাকে রূপছন্দপুরে এখানে বড়ো হাসপাতাল নেই তাই পিসির বন্ধু শাক্যজেঠু তাকে গাড়ি করে নিয়ে গেছেন শহরে অন্তু অবশ্য একলা নয় পিসির বাড়িতে দশটা বারোটা কাজের লোক, মালি, দুটো গাড়িও রাখা আছে অন্তুর দরকারের জন্যে কিন্তু তাও একা একা মনে হয় অন্তুকে যেন সবসময় চোখে চোখে রাখা যায়, সেইরকম ব্যবস্থা করা আছে বাড়িতে মঞ্জু বলে একটা মেয়ে সবসময় তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে
কিছুক্ষণ বাগানে বেড়িয়ে অন্তু ভিতরে চলে গেল সে সকালবেলা স্নান সেরে নেয় স্নান করে জামাকাপড় পরে যখন সে জলখাবার খাচ্ছে, মঞ্জুদি এসে বলল,অন্তুদা, তোমাকে একজন লোক ডাকছে
মঞ্জু তার চেয়ে বড়ো হলেও তাকে অন্তুদা বলে অন্তু ভারি অবাক হয়ে বলল,আমার সঙ্গে তো কেউ কোনওদিন দেখা করতে আসে না!
তাড়াতাড়ি ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল সে সামনে একটা বুড়ো লোক তাপ্পি মারা রংচঙে আলখাল্লা পরে গুল্লু গুল্লু চোখে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে তাকে দেখেই সুর করে বলে উঠল,
পক্ষিরাজের ডানার বেশে, আসবে রাজা সবুজ দেশে
সেই দেশেতে তোমায় নিতে বন্দি আসে ছদ্মবেশে

অন্তু তো অবাক এই লোকটা কে? একে তো আগে কোনওদিন দেখেনি সে! এরকম অদ্ভুত জামাকাপড়, তারপর আবার ভুলভাল কবিতা এইবার লোকটা একটু হেসে বলল,ছড়াটা একটু গুবলেট হয়ে গেছে, তাই না? কী করব, বল? আমার ওই এক সমস্যা এত চেষ্টা করি কিন্তু ঠিকঠাক কিছুতেই হয় না
অন্তু তাড়াতাড়ি বলল,না না, ঠিকই আছে কিন্তু...
লোকটা এবার নিজের মাথায় নিজেই একটা গাঁট্টা মেরে বলল,এই দেখ, আসল কথাটাই বলা হয়নি হ্যাপি বার্থডে অন্তুবাবুবলে কাঁধের ঝোলা থেকে একটা সবুজ রঙের টিয়াপাখি বের করে অন্তুর হাতে দিল
অন্তু আগে কোনওদিন ম্যাজিক দেখেনিআর টিয়াপাখিও দেখেনি সে চিড়িয়াখানাতেও যায়নি আগে এরকম কান্ড দেখে তো অন্তুর দারুণ মজা লাগল লোকটা বেশ মজার মজার কথা বলতে পারে তো কিন্তু তাকে এই লোকটা চিনল কী করে? লোকটা এতক্ষণ অন্তুর দিকেই তাকিয়ে ছিল এবার হাত নেড়ে বলল,
ভেব না গো ছেলে, আমি হলাম পেলে
ফুটবল খেলি, আর খাই জেলি
পিসিমণি আছে, ডেকেছে তোমাকে
এনেছি যে গাড়ি তোমাদের বাড়ি
তাড়াতাড়ি চল, কথা পরে বোলো
পথে যেতে যেতে, বেগুনের ক্ষেতে
বলব সে কথা, সময়ে যথা

বাবা! কী আজগুবি লোক রে বাবা এমন উদ্ভট কবিতা শুনে অন্তু তখন হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না কিন্তু একটা কথা বোঝা গেছে, এই লোকটাকে পিসিমণি তাকে নিতে পাঠিয়েছে তাহলে তো যেতেই হয় কিন্তু লোকটা যদি মিথ্যে কথা বলে থাকে? অবশ্য অন্তুর লোকটাকে বেশ ভালো লেগেছে এমনিতেও তার এখানে থাকতে মোটেই ভালো লাগছে না এখন এই লোকটার সঙ্গে বেরিয়েই পড়া যাক
অন্তুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তার হাত ধরে লোকটা হুড়মুড় করে চলে এল বাড়ির বাইরে ও বাবা, কোথায় গাড়ি, এ তো একটা মস্ত বড়ো রথ! সামনে তিনটে সাদা ঘোড়া কী সুন্দর তাদের দেখতে! কেশরগুলো চকচক করছে তার চোখে বিস্ময় দেখে পেলে বলল,অন্তুবাবু, এখনই এত অবাক হলে হবে? অ্যাডভেঞ্চার তো সবে শুরু উঠে পড়, উঠে পড়
রথে উঠে চালকের আসনে বসে লোকটা চেঁচিয়ে উঠল,
পক্ষিরাজের ছানা, লক্ষ্য কোথায় জানা
উড়িয়ে চল নিয়ে, সময় প্রাচীর দিয়ে

বলে সপাং করে একটা চাবুক কষাতেই অন্তুদের নিয়ে রথ ছুটে চলল সাঁই সাঁই করে ছুটছে ঘোড়া তিনটে হঠাৎ অন্তুর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠল আরে! আরে! কোথায় ছুটে চলেছে, রথ তো উড়ছে! ঠিকই তো নিচে তাদের বাড়িটা আরও অনেক ছোটো হয়ে আসছে ক্রমে পুতুল হয়ে যাচ্ছে তাদের বাড়ির বাগান, ক্ষেতখামার অন্তু কি স্বপ্ন দেখছে নাকি! সে নিজের হাতে একটা চিমটি কাটল এত জোরে চিমটি কেটেছে যে নিজেই উহ্‌’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছে কিন্তু এটা কী করে সম্ভব? আর এই লোকটাই বা কে? নিচে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না রথের নিচে তুলো তুলো মেঘের চাদর সরে সরে যাচ্ছে অন্তু বার বার চোখ কচলাতে লাগল তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না পেলে নামের লোকটা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে অন্তু ভ্যাবাচ্যাকা চোখে তার দিকে তাকাতেই সে আবার সুর করে বলল,
স্বপ্ন হলেও সত্যি, মিথ্যে নেই একরত্তি
আজ তোমার জন্মদিন, তাই পাল্টে গেছে দিন
কালের কাঁটায় ঘুরে, মোরা এগিয়ে যাব দূরে
আরও চমক আছে, বন্ধু তোমার কাছে

পেলে হো হো করে হেসে উঠল অন্তু এতক্ষণে অনেকটা সামলে নিয়েছে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল তিনটে ঘোড়া তাদের বিরাট রুপোলি ডানাগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে পক্ষীরাজ ঘোড়া

।। তিন।।

পিউ সন্ধেবেলায় ছাদে বসে রইল আজ অনেকক্ষণ কাল দিদান আর মা তাকে সবকথা খুলে বলেছে প্রথমে তো পিউর বিশ্বাসই হচ্ছিল না কিন্তু দিদান যখন পুরনো আলমারি থেকে অন্তুর ছবিটা বের করে নিয়ে এল তখন পিউ আর কোনও কথাই বলতে পারল না তার আঁকা ছবিতে যে ছেলেটা আছে, তাকে একদম অন্তুর মতো দেখতে পিউকে আগে কেউ কিচ্ছু জানায়নি দিদান আর মা যা বলল তাই যদি সত্যি হয় তাহলে খুব শিগগির তার জীবন বদলাতে চলেছে যদিও মা-দিদান বার বার করে বলছে তার কোনও ভয় নেই, কিন্তু তাও মাঝে মাঝে বুকটা কেঁপে উঠছে ছোট্ট পিউর সে আজ স্কুলে গেল নাসকালবেলাতেই গুটি গুটি পায়ে চলে গেল তার প্রিয় গুলমোহরগাছের কাছে গাছের নিচে খানিকক্ষণ বসতেই তার মনটা হু হু করে উঠল গাছের গুঁড়িটা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল সে বিকেলবেলায় অনেকক্ষণ সে তার আঁকা কালকের ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল এই ছেলেটাই অন্তু যে হারিয়ে গেছে দিদান বলেছে, একমাত্র পিউই তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে কিন্তু অনেকে তাকে সাহায্য করবে এই কাজে এর চেয়ে বেশি খুলে আর কিছু বলেনি মা আর দিদান
আজকে আর দিদানের কাছে গল্প শুনতে গেল না পিউ কলকাতা থেকে বাবাও ফিরে এসেছে মায়ের কাছে সব শুনে বাবার বুকে অনেকক্ষণ লুকিয়ে রইল পিউ তার মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বাবা তার চোখেও জল সেইদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় পিউর ভয় কেটে গেল যেমন করেই হোক না কেন সে অন্তুকে ফিরিয়ে আনবেই

।। চার।।

ঘন জঙ্গল আর পাহাড় পেরিয়ে পক্ষীরাজ ঘোড়ার রথ যেখানে থামল সেখানে একটা মস্ত বড়ো গুহা গুহার সামনে দিয়ে একটা ঝর্ণা বয়ে যাচ্ছে পেলে রথ নিয়ে সোজা ঝর্ণা ভেদ করে গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ল গুহার ভিতরটা একটা ঘরের মতো এককোণে আলো জ্বলছে সবুজ রঙের আকাশ দিয়ে উড়তে উড়তে একসময় সে ঘুমিয়েই পড়েছিল পেলে তাকে জাগিয়ে তুলল রথ ল্যান্ড করার আগে এর মধ্যে যতবার সে পেলেকে জিজ্ঞেস করেছে কোনও কথা, সে ইশারায় চুপ করতে বলেছে তাকে অন্তুকে যে পিসিমণি ডেকে পাঠাননি সেটা তো পরিষ্কার তাহলে কি পেলে নামের এই ম্যাজিশিয়ানটা তাকে সম্মোহন করে কিডন্যাপ করে এনেছে মুক্তিপণের লোভে? অন্তুর মাথার মধ্যে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে এদিকে পেলের কোনও হেলদোল নেই সে টেবিল থেকে ইয়াবড়ো একটা পেয়ারা নিয়ে খেতে লেগেছে অন্তুকে একথালা মিষ্টি আর ফল এগিয়ে দিয়ে পেলে বলল,
খাও গো ছেলে খাও, যত ইচ্ছে নাও
সামনে অনেক কাজ, জানবে তুমি আজ
ফিরতে যদি চাও, সময় নদীর জলে
সাহস জুগিয়ে নাও, পেলের ম্যাজিক ফলে

বলে অন্তুর হাতে একটা আপেল ধরিয়ে দিল সে অন্তুর ক্ষিদেও পেয়েছিল এক কামড় দিয়েই সে অবাক হয়ে গেলকোথায় আপেল! ভিতরটা তো আমের মতো! পরের কামড়ে অন্তুর আপেলটাকে কালাকাঁদের মতো মনে হল তার পরের বার লিচুর মতো কিন্তু বেশ লাগছে খেতে অন্তুর আর তেমন ভয় করছে না সে খাওয়াদাওয়া করে একসময় পেলের কাছে গিয়ে বসল পেলে তার দিকে তাকিয়ে বলল,অন্তুবাবু, তৈরি তো? গল্প শুনতে?
অন্তু বেশ বিশ্বাসী কণ্ঠে বলল,হ্যাঁ
পেলে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,গল্প বলছি বটে, কিন্তু এ সবই সত্যি ঘটনা শুনে তুমি ভয় পাবে না তো, অন্তুবাবু?
অন্তু মাথা নেড়ে বলল,না ভয় পাব কেন?
পেলে একটা মিষ্টিতে কামড় বসিয়ে বলতে শুরু করল,অন্তুবাবু, ঘটনার শুরু কোথায় আমি ঠিক জানি না কিন্তু আমাদের গল্প শুরু হচ্ছে দুই দলকে নিয়ে আমাদের পৃথিবীতে নানাধরনের লোক থাকে তাদের কেউ বেঁটে, কেউ মোটা, কারও বুদ্ধি বেশি, কারও আবার কম কিন্তু কয়েকজন এরকম লোকও থাকে যাদের কাছে কিছু বিশেষ ধরনের শক্তি থাকে এমন কয়েকজনকে নিয়েই আমাদের গল্প এই বিশেষ শক্তিসম্পন্ন লোকেরা একসময় দুই দলে ভাগ হয়ে গেল এক দলের নাম একসুসিয়াস আর অন্যদলের নাম এরেনিয়াস এরেনিয়াস দলের লোকেরা মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চাইতকিন্তু একসুসিয়াসদের তা পছন্দ ছিল না তারা পৃথিবীর অধিপতি হতে চাইত কিন্তু চাইলেই তো আর হয় নাপৃথিবীর কোটি কোটি মানুষদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে জনাকয়েক একসুসিয়াস কিছুই করতে পারবে নাতাই তারা দলে টানতে চাইল এরেনিয়াসদের
অন্তু এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল এবার বলল,কেন? এরেনিয়াসরা কি সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল?
সেই শুনে পেলে একবার ফুড়ুৎ করে নাক টানল তারপর বলল,না গো, এরেনিয়াসরা ছিল সংখ্যায় আরও কম কিন্তু এরেনিয়াসদের কাছে একটা বিশেষ শক্তি ছিল
অন্তু আবার বাধা দিয়ে বলল,সে তো তুমি বললে দু’জনের কাছেই বিশেষ শক্তি ছিল তাহলে আবার বিশেষের মধ্যে কী বিশেষ?
পেলে এবার একটু চুপ করে তাকিয়ে রইল অন্তুর দিকেআস্তে আস্তে বলল,সে বড়ো অন্যরকম শক্তি হে সেই শক্তি নিয়েই তো এই গল্প আচ্ছা, এবার মন দিয়ে শোনোএকসুসিয়াসদের ছিল প্রধান চার-রকমের শক্তি - সম্মোহন, মারণ, বস্তু পরিবর্তন আর অন্তর্ধান তারা যে কোনও প্রাণীকে সম্মোহিত করতে পারত, যে কোনও জড়বস্তুকে আকার দিতে পারত, ইচ্ছে করলে কাউকে মারতে পারত আর অদৃশ্য হতে পারত
অন্তু বড়ো বড়ো চোখ করে বলে উঠল,অদৃশ্য মানে ভ্যানিশ হয়ে যেত?
পেলে উদাস মুখে একটা আস্ত রসগোল্লা মুখে ঢুকিয়ে বলল,ঠিক ধরেছ ভ্যানিশ নিজেও হতে পারত, অন্যদেরও করতে পারত
তারপর?অন্তু জিজ্ঞেস করল
পেলে বলল,এরেনিয়াসদের শক্তিও কম ছিল না কিন্তু তাদের মন ছিল নরম তারা ইচ্ছেমতন রূপ ধরতে পারত, গাছ, পশুপাখিদের সঙ্গে কথা বলতে পারত, হাওয়ায় উড়তে পারত
অন্তু আর থাকতে না পেরে বলে ফেলল,কী বললে, উড়তে পারত? মানে, এমনি এমনি?
পেলে তার দিকে তাকিয়ে একটা মস্ত হাই তুলে বলল,নাহ্‌, তুমি অন্তুবাবু বড্ড ফুট কাটো
গল্প হলে শেষ, ফিরতে হবে দেশ
সামনে যে বাকি কাজ, করতে হবে আজ
করলে পরে দেরি, বিপদ হবে ভারি

অন্তু সেই শুনে নিজেকে সামলে বলল,না না, সরি সরি, তুমি তাড়াতাড়ি শেষ কর আমি আর ফুট কাটব না
একগাল হেসে পেলে আবার গল্প আরম্ভ করল,আরও অন্য ছুটকো-ছাটকা শক্তিও ছিল দুই দলেরই কিন্তু এগুলোই আসল এরপরেই আসল গল্প বলেছিলাম না, এরেনিয়াসদের কয়েকজনের একটা বিশেষ ক্ষমতা ছিল? তারা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত এই ভাব, তুমি যুদ্ধে হেরে গেছএবার তুমি সময়কে পিছিয়ে দিলে যে কারণে তুমি যুদ্ধে হেরেছিলে সেই কারণটাকে হতেই দিলে না সময়কে নিজের মতন করে ব্যবহার করলে তাহলে ভাব, তোমার শক্তি কতটা বেড়ে যাবে এরকম লোক কোনওদিন হারবে না, মরবেও না আরও অনেকরকমভাবে এই শক্তিকে প্রয়োগ করা যায় ইচ্ছে করলে তারা সারা পৃথিবীতে রাজত্ব করতে পারবে তাই একসুসিয়াসরা এই ক্ষমতা পেতে উঠেপড়ে লাগল কিন্তু কিছুতেই তারা এই শক্তি পেল না প্রকৃতির নিয়মে এই শক্তি যাদের থাকত, তারা খুব ভালো লোক ছিলেন এরেনিয়াসের অন্য কয়েকজন একসুসিয়াসদের সঙ্গে চলে গেলেও প্রধান শক্তিশালী যারা তাদের একসুসিয়াসরা দলে টানতে পারল নাবরং কয়েকজন একসুসিয়াস নিজের ভুল বুঝতে পেরে সাহায্য করতে লাগল এরেনিয়াসদের
এরেনিয়াস আর একসুসিয়াসদের প্রত্যেকের মধ্যেও সব শক্তি থাকত নাবড়োজোর চারটের মধ্যে একটা কিন্তু কোনও কোনও সময় এক-একজন মানুষের মধ্যেই একাধিক শক্তি পাওয়া যেত তখন তাকে সরাসরি আক্রমণ করত একসুসিয়াসরা তাকে সম্মোহিত করে তাদের শক্তি কাজে লাগাতে চাইত নিজেদের স্বার্থে এরেনিয়াসরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত সামনাসামনি যুদ্ধে তারা কিছুই করতে পারবে না হাজার হাজার বছর ধরে এই যুদ্ধ চলল অবশেষে একদিন এমন এল যে এরেনিয়াসদের মধ্যে শুধু একজনের কাছেই এই শক্তি রয়ে গেল সময়কে নিয়ন্ত্রণ করার এদিকে একসুসিয়াসরা চারদিক থেকে তার ওপর আক্রমণ করার চেষ্টা করছে এরেনিয়াসদের দলে বাকি মাত্র তিনজন সেইদিক থেকে একসুসিয়াসরা সংখ্যায় অনেক বেশি সেই একজন এরেনিয়াস আবার এক সঙ্গে চারটে শক্তির অধিকারী ছিলেন তাই একমাত্র তাকে বশ করে নিতে পারলেই একসুসিয়াসরা জিতে যাবে এত হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসা সাবধানতা জলে যাবে একসুসিয়াসরা তাদের শক্তির জোরে পৃথিবীতে রাজত্ব করবে তাদের না আছে দয়ামায়া, না আছে ভালোবাসা কোনও পাখি, পশু, জঙ্গল বেঁচে থাকবে না শেষপর্যন্ত সব ভেবেচিন্তে তিনি একটা উপায় বের করলেন
পেলের কথা শুনতে শুনতে অন্তু তার নিজের কথা ভুলেই গেছিল এবার সে বলল,থামলে কেন? তারপর কী হল?
পেলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,তারপর কী হল অন্তুবাবু, সে তো বলা যাবে না সে আমি তোমায় বলতে পারব না
অন্তু একটু হতাশ হয়েই বলল,কেন, বলতে কী অসুবিধে আছে?
পেলে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,যা চোখে দেখার উপায় আছে তা গল্পে শুনে কি আর অতটা বোঝা যায়?
পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করল পেলে নীল রঙের সেই ঘড়িতে অন্তত বারোরকম আলো জ্বলছে পেলে একটা বোতামে চাপ দিতেই অন্তুর চারপাশের দৃশ্য আবছা হয়ে এল

।। পাঁচ।।

দেরাজের গোপন কুঠুরি থেকে জিনিসটা বের করলেন পিউর বাবা, বিনয়বাবু বহুবছর আগে যখন তার বাবা সুপ্রতিমবাবু তাকে এই কৌটোটা রাখতে দিয়েছিলেন তখন যুবক বিনয় সেই জিনিসটার গুরুত্ব বুঝতে পারেননি কিন্তু পরে মায়ের কাছে শুনে আর বাবার তাকে লেখা চিঠি পড়ে তিনি সবই জানতে পেরেছিলেন সুপ্রতিমবাবুর প্রাণের বন্ধু ছিলেন কিশোরবাবু ছোটোবেলায় যখন বাবাকে বাগানে পাখিদের সঙ্গে আপন মনে কথা বলতে শুনতেন, তখন বিনয় জানতেন না তার বাবা শুধুমাত্র একজন সামান্য মানুষ বা কোয়ান্টাম ফিজিক্সের অধ্যাপক নন, এরেনিয়াসদের একজন তিনি পশুপাখিদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন কিন্তু এরেনিয়াসের সন্তান হলেই যে তার মধ্যে বিশেষ গুণ থাকবে সেরকম বাধ্যবাধকতা নেই সুপ্রতিমবাবু বিশেষ কোনও শক্তি পাননি এরেনিয়াসরা তাদের পরিচয় গোপন রাখে নিজের পরিবারের কাছে একসুসিয়াসদের লোকেরা জানতে পারলে তাদের মেরে ফেলতে বা আঘাত করতে দেরি করে না কিন্তু একটা বিশেষ কারণে সুপ্রতিমবাবুকে পরিবারের কাছে তার এই গোপন রহস্য জানাতে হয়েছিল
তার বন্ধু কিশোরবাবু ছিলেন এরেনিয়াসদের অন্তিম ব্যক্তি যিনি সময়ের রহস্য জানতে পেরেছিলেন সময়ে পিছিয়ে আসা অথবা এগিয়ে যাওয়া ছাড়াও তিনি এরেনিয়াসদের বাকি তিনটি শক্তির অধিকারী ছিলেন কিন্তু তিনি ছিলেন সৎ ও অমায়িক মানুষ অযথা শক্তির পরিচয় না দিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের মতো জীবন কাটাচ্ছিলেন রূপছন্দপুরে কিন্তু তারপরেই নেমে আসে বিপর্যয় একসুসিয়াসরা একদিন জানতে পেরে যায় তার পরিচয় জানামাত্র তাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা আরম্ভ করে দেয় তারা কিন্তু কোনওক্রমে তাদের ঠেকিয়ে রেখেছিলেন তিনি কিন্তু এরেনিয়াসরা জানত, এরকম করে শক্তি রক্ষা করা যাবে না তাই এরেনিয়াসদের সময়-শক্তির উৎস কিশোরবাবু ও সুপ্রতিমবাবু লুকিয়ে দেন একটা বিশেষ জায়গায়, আর তার চাবিকাঠি রেখে আসেন অতীতে কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যায়ভবিষ্যতে কি কেউই এই শক্তি মানুষের ভালোর জন্যে ব্যবহার করতে পারবে না? এরেনিয়াসদের সংখ্যা কমে আসছে ভবিষ্যতে যদি কোনও এরেনিয়াস না জন্মায়? কিংবা জন্মালেও যদি সে জানতে না পারে এই শক্তির কথা? সেইজন্যে সুপ্রতিমবাবু বহুবছর ধরে গবেষণা করছিলেন একটা যন্ত্র আবিষ্কারের জন্যে যার সাহায্যে অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপন করা যায় অবশেষে পরীক্ষা সফল হল যন্ত্র আবিষ্কার হল ভবিষ্যত আর অতীতে যদি কোনও লোক কব্জিতে এই যন্ত্র পরে থাকে, টাইমলাইন অ্যাডজাস্ট করলে মানুষ সশরীরে টেলিপোর্ট হয়ে যাবে অতীতে বাবা যদি ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চায় তাহলে ভবিষ্যত থেকে ছেলে সশরীরে তার কাছে চলে আসতে পারবেকিন্তু যে টেলিপোর্ট হবে যন্ত্র শুধু তার হাতে থাকবে, অপারেট করতে হবে অন্যজনকে
বাবার বন্ধু কিশোরবাবু সময়-শক্তির রহস্য জানতেন তার পরামর্শ আর এরেনিয়াসদের আদিগুরু স্যামুয়েলের কথামতো এই যন্ত্র তৈরি করেছিলেন সুপ্রতিমবাবু কিন্তু সেইসময় পরীক্ষা করার কোনও উপায় ছিল নাবছরখানেকের মধ্যেই সুপ্রতিমবাবু নিরুদ্দেশ হয়ে যান তার লেখা চিঠি পড়ে বিনয় জানতে পেরেছিলেন যে একসুসিয়াসরা তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেমেরেও ফেলতে পারেযদি ভবিষ্যতে তার পরিবারের কেউ অজ্ঞাতবশে অন্তুর সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ করতে পারে তাহলে তাকেই সেই যন্ত্র যেন পরিয়ে দেওয়া হয় গুরু স্যামুলেয়ের কথামতো নিয়তি তাকে অন্তুর কাছে পৌঁছে দেবেসেই একমাত্র ফিরিয়ে আনতে পারবে অন্তুকে
ধীরে ধীরে বাক্সটা খুলে ভিতর থেকে ঘড়িটা বার করলেন তিনি নীল রঙের ঘড়ির গা থেকে আজ এত বছর পরেও ক্রমাগত দ্যুতি বার হচ্ছে ঘড়ির ডায়ালের চারদিকের লাগানো বারোটি রঙের ঝিলমিলে আলো চিকচিক করে উঠল বিনয়বাবুর চোখে পিউকে ঘড়িটা পরিয়ে দিতে হবে তাকে পিউ তার একমাত্র মেয়ে বিনয়বাবুর বুক দুরুদুরু করছে কিন্তু এছাড়া কোনও উপায় নেই এখন ভয় পেলে চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে অন্তু ধীর পায়ে পিউর ঘরে গিয়ে পৌঁছলেন তিনি পিউ ঘুমিয়ে আছে আস্তে আস্তে তার কব্জিতে ঘড়িটা পরিয়ে দিলেন বিনয়বাবু

।। ছয়।।

একটা ঝাঁকুনি লাগতেই আশেপাশের দৃশ্য আবার পরিষ্কার হয়ে এল ঝাঁকুনির চোটে একটু বেসামাল হয়ে গেছিল অন্তুএদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল, পেলে চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে মাটিতে তার কাছে পৌঁছতেই পেলে কান্না কান্না মুখ করে বলল,আচ্ছা ঝামেলা! এমন ঝাঁকুনি কি আর এইবয়সে সয়? তা এখন একটু টেনে তোল তো আমাকে, অন্তুবাবু
এই লোকটার কান্ডকারখানা দেখে এত উদ্ভট কান্ডের মধ্যেও অন্তুর হাসি পেয়ে যাচ্ছে হাত ধরে অন্তু পেলেকে টেনে তুলল পেলে উঠে কোমরে হাত বুলিয়ে, মাথার চুল টেনে বলল,না সব ঠিক আছে মনে হচ্ছে চল, এবার এগোনো যাক আর অন্তুবাবু, এখন কিন্তু কথা বোলো নাকথা বললেই সব কাজ বানচাল হয়ে যেতে পারে শুধু চুপচাপ দেখে যাও
অন্তু মাথা নাড়ল খোলা একটা মাঠ মাঠের ওপর জ্যোৎস্নার আলো পড়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সব পেলে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে ঘন বাঁশগাছ আর আমবাগান পেরিয়ে এগোতে এগোতে এক জায়গাতে লণ্ঠনের আলো দেখা গেল পেলে মুখে হাত দিয়ে অন্তুকে চুপ করে থাকতে বলল কিছুটা এগোলে কয়েকটা লোককে দেখতে পাওয়া গেল মোট তিনজন সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি লম্বা, হাতে লণ্ঠন আর চোখে চশমা পরনে প্যান্ট-শার্ট বাকি দু’জনে নিচু স্বরে কিছু বলছে অন্তুরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কাজ শেষ হলে একটা লোক উঠে দাঁড়াল বাকি দু’জনের দিকে চেয়ে বলল,এছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় নেই শক্তির সূত্র আমি তিনভাগে লুকিয়ে রাখলাম অতীতে প্রথম দুই সূত্র পেতে গেলে অনেকরকম বিপদের মোকাবিলা করতে হবে তৃতীয় সূত্রর জন্যে অবশ্য আমি সুপুর ত্রিমাত্রিক ছবির সাহায্য পাবসেইভাবেই প্রোগ্রাম করেছি সময়কে তৃতীয় সূত্রর সমাধান একমাত্র আমাকেই করতে হবে এবার যদি স্যামুয়েলের কথা সত্যি হয় তাহলে এই সূত্র আবিষ্কার করতে সাহায্য করবে একটা এরেনিয়াস বংশের একটি মেয়ে
পাশের লোকটা একটু উসখুস করছিলএবার বলল,সুপ্রতিম, তুই যা বলছিস তা ঠিক কিন্তু যদি স্যামুয়েল ভুল করে থাকেন? গণনা আর জ্যোতিষে হেরফের অনেকক্ষেত্রেই হয়
এরপর তৃতীয়জন বলল,তোর কথা ঠিককিন্তু আজ পর্যন্ত উনি যা বলেছেন সবই মিলে গেছে তার কথা শুনে না চললে এত বছর ধরে এরেনিয়াসরা কি বেঁচে থাকতে পারত? অতীতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে আমার মনে হয়েছে আর কোনও উপায়ই আমাদের কাছে নেই আমরা মাত্র তিনজন বাকি এখন বাকিরা কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে কে জানে যে কোনও মুহূর্তে একসুসিয়াসরা আমাদের ধরে ফেলতে পারে আমাদের হাতে সময় কম যদি ভাগ্যে থাকে তাহলে এরেনিয়াসরা আবার একদিন ফিরে আসবে নয়তো ভাববি, আমরা ব্যর্থ হয়েছি
কিছুক্ষণ সকলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে দ্বিতীয় ব্যক্তি যার নাম সুপু, আস্তে আস্তে বলল,কিন্তু তোর কী হবে? তুই যা করতে চলেছিস তা আগে কেউ করেনি সময়-প্রাচীর পেরিয়ে যাওয়া অন্য ব্যাপার, কিন্তু তুই তোর বাস্তবিক জীবনকে, স্মৃতিকে হারিয়ে ফেলবি ইনফাইনাইট টাইমলাইনে ট্রাভেল করলে এমনটা কি সম্ভব? যদি কোনও কারণে স্যামুয়েলের কথা ঠিক না হয় তুই অনন্তকাল ধরে আটকে রয়ে যাবি অতীতে
কিশোর হাসল তারপর বলল,আর কী উপায় বল! একটা কম্পাঙ্কে যাওয়ার জন্যে এরেনিয়াসরা সময়-প্রাচীর টপকেছে বহুবার কিন্তু ভবিষ্যৎ বদলাতে পেরেছে কি? আমাদের শক্তির ওপর ভরসা করে আমি সময়কে কম্পাঙ্কে ভেঙে নিয়েছি আমার বয়সে সময় আটকে যাবে বিভিন্ন কম্পাঙ্কে আমার কিছু মনে থাকবে না যদিও আমি তো তখন আর এরেনিয়াস হইনি একমাত্র উপায়, যদি তোরা স্যামুয়েলের কথা ঠিক হওয়ার অপেক্ষা করিস তাহলে যদি আমাকে ফিরিয়ে আনতে পারিস তোদের বুদ্ধির সাহায্যে এবার আমাকে ছেড়ে দে, যাওয়ার সময় হয়ে গেছে
কিশোর কিছুক্ষণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তারপর আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল হাওয়ায় পেলে অন্তুর কাঁধে হাত রেখে বলল,চল
দু’জনে পিছন দিকে হাঁটতে আরম্ভ করল অন্তু কিছুই বুঝতে পারছিল না মানে এইটুকু বোঝা গেল যে এরেনিয়াসের শেষ কয়েকজন তাদের শক্তি লুকিয়ে রেখেছে কিন্তু কিশোর বলে লোকটা যে অতীতে হারিয়ে যাওয়ার কথা বলছিল সেটা কিছু বোঝা গেল না পেলে চুপচাপ হাঁটছিল হঠাৎ এদিক ওদিক দেখে সে সচকিত হয়ে উঠল গম্ভীর স্বরে বলল,অন্তুবাবু, বিপদ আসছে একসুসিয়াসরা আসছে পালাতে হবে
বলতে না বলতে গাছপালা ভাঙার প্রচন্ড জোরে শব্দ হল এক সঙ্গে কয়েক হাজার ঘোড়া দৌড়োলে যেরকম আওয়াজ হয়, ঠিক সেইরকম আওয়াজ পেলে হাতঘড়ির বোতাম টিপে দিয়েছে ততক্ষণে হাওয়ায় অদৃশ্য হওয়ার আগে অন্তু দেখল, বনজঙ্গল ভেদ করে ছুটে আসছে একসুসিয়াসরা

।। সাত।।

ঘুম ভাঙতেই পিউ দেখলো যে সে জঙ্গলের মধ্যে শুয়ে রয়েছে সে ভারি অবাক হয়ে গেল সে এখানে এল কী করে? এদিক ওদিক তাকিয়ে সে কাউকেই দেখতে পেল না হঠাৎ নিজের হাতের দিকে চোখ পড়তে পিউ দেখতে পেল, তার ডান কব্জিতে একটা ঘড়ি বাঁধা রয়েছে ভারি অদ্ভুত তো! সে আপন মনে বলে উঠল,এটা কেমন করে এল?
কেমন করে আবার? তোমার বাবা তোমাকে এটা পরিয়ে দিয়েছে
আরে, কে বলল কথাটা! পিউ এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেল না তার ভয় ভয় করতে লাগল ভূত নাকি রে বাবা! সে জোর পায়ে হাঁটা দিলতক্ষুনি পিছন থেকে আবার শোনা গেল,আরে, যাচ্ছ কোথায়? তোমার তো এইখানেই অপেক্ষা করার কথা
কে রে বাবা! পিউয়ের বুকের মধ্যে ঢিব ঢিব করছে একটু সাহস জড়ো করে সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,তুমি কে? তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
ও, এই ব্যাপার? দেখতে পাচ্ছ না বলে ভয় পাচ্ছ? তা আগে বললেই হতএই বলে গাছের ওপর থেকে উড়ে পিউর সামনে এসে দাঁড়াল একটা ময়ূর
ও বাবা! ময়ূর আবার কথা বলে নাকি! পিউ একদম হাঁ হয়ে গেছে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ময়ূরটা বলল,আরে, হলটা কী? আকাশ থেকে পড়লে দেখছি
পিউ একটু তেরিয়া হয়ে বলল,আরে, তুমি ময়ূর হয়ে কথা বলছ কী করে?
ময়ূরটা এবার ক্ষেপে গেল,আরে! আমি কথা বলব না কেন? এখন তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ সেটা আমার দোষ নাকি?”
পিউ ভেবে দেখল, ঠিকই তো এটা কী করে হল? ময়ূরটা তার ভেবলু মুখটা দেখে মনে হয় মজা পেয়েছে সে একবার লম্বা সরু নীল রঙের গলাটা ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,এই তোরা দেখে যা রে! পেলে এই মেয়েটার কথাই বলছিল এ তো একদম বোকা!”
সেই শুনে কোথা থেকে দুদ্দুড় করে দৌড়ে চলে এল কয়েকজন গাছ থেকে সর সর করে নেমে এল দুটো কাঠবেড়ালি পাশের গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটা দুধসাদা বেড়াল আর পড়ি কি মড়ি করে ডিগবাজি খেতে খেতে সামনে উপস্থিত হল একটা পান্ডা সাদা কালো ভাল্লুক সবাই তার দিকে চেয়ে হো হো করে হাসতে লাগল ভাল্লুকটা তো হেসে গড়াগড়ি খায় আর কী প্রথমে এতজনকে দেখে পিউ একটু ভড়কেই গেছিল এদের ছবিই সে সেদিন এঁকেছিল না! ততক্ষণে সবাই মিলে, ‘বোকা মেয়ে, বোকা মেয়ে’ বলে একে অপরের ওপর গড়িয়ে পড়ছে দেখে পিউর বড্ড রাগ হল সে চেঁচিয়ে বলল,এই, চুপ কর সবাই সবাইকে নিলডাউন করিয়ে দেব বেশি হাসলে
সে শুনে তো সবাই একদম চুপ কাঠবেড়ালির একজন ধীরে ধীরে বলল,নিলডাউন কী?
সবাইকার মুখ চুপসে গেছে পিউর রাগ দেখে ওদের মুখের দিকে চেয়ে তো পিউর বেজায় মজা হল সে সকলের কথাই বুঝতে পারছে সে গম্ভীর স্বরে বলল,একরকমের শাস্তি আমি তোমাদের দিদিমণি বেশি দুষ্টুমি করেছ কি গেছ
সেই শুনে সবাই লাইন দিয়ে বসে পড়ল পিউর সামনে ময়ূর মাথা নেড়ে বলল,না, পেলে ভুল বলেনি এই মেয়ের হবে
পিউ ততক্ষণে বেড়ালকে বা বা ব্ল্যাকশিপ’ মুখস্থ করাতে শুরু করে দিয়েছে হঠাৎ তার হাতের ঘড়ির আলোগুলো জ্বলে উঠল ভাল্লুক মুখ তুলে বলল,ওই যে পেলে এসে গেছে

।। আট।।

অন্তু তো প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিল এইসব কান্ড দেখে কিন্তু এখন সে সামলে নিয়েছে প্রথমে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় করে আকাশ সফর, তারপর গুহার মধ্যে অদ্ভুত খাবার, তারপর সোঁ সোঁ করে সোজা এরেনিয়াসদের আর একসুসিয়াসদের মাঝখানে গিয়ে পড়া, তারপর এই কান্ড কতগুলো কথা বলিয়ে জন্তু আর তার সঙ্গে তারই বয়েসের একটা পিউ বলে মেয়ে এসে জুটেছে পেলের সঙ্গে মেয়েটা একটা দশ নম্বরি পাগল সেই অদ্ভুত ঘড়িতে চড়ে পেলের সঙ্গে এই জঙ্গলে এসে তারা দেখে কী, না, ওই পুঁচকে মেয়েটা সব জানোয়ারগুলোকে লাইন করে বসিয়ে ছড়া মুখস্থ করাচ্ছে পেলে অবশ্য পিউকে দেখে মহাখুশি তাকে কীসব বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এল একটু পরে একটা মিটিং আছে পেলে একটা কিছু কাজের কথা বলবে মিটিংয়ে গিয়ে দেখে কী, না, পিউ সকলকে গোল করে বসিয়ে ছবি আঁকতে দিয়েছে বাবা গো! ভাল্লুক আর কাঠবেড়ালি ছবি আঁকছে, এরকম কেউ কখনও দেখেছে নাকি! ফেয়ারি টেলেও এইসব থাকে না আজকাল কিন্তু এখানে যা সব হচ্ছে তাতে রূপকথাও হার মেনে যাবে পিউ অবশ্য অন্তুকে দেখে মিষ্টি করে হেসে, হাই অন্তু!” বলল
পেলে এসে গেছে সকলে বসে পড়ল তাকে ঘিরে ধরে পেলে বলতে শুরু করল,বন্ধুরা, আমাদের জন্য একটা কাজ আছে কাজটা বলার আগে একটু কাজের কারণটা বলে নিই তোমরা সকলেই এরেনিয়াস আর একসুসিয়াসদের কথা জান পিউ জানত না, ওকে আমি সব বলে দিয়েছি এখন কথা হচ্ছে, একসুসিয়াসরা তাদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের ঢের ক্ষতি করছে বস্তু পরিবর্তনের শক্তি প্রয়োগ করে জঙ্গল কে জঙ্গল সরিয়ে সেখানে কংক্রিটের মহল বসাচ্ছে মারণশক্তি দিয়ে আমাদের বন্ধু জন্তুজানোয়ার মেরে ফেলছে, সকলকে ভয় দেখিয়ে নিজেরা শাসন করতে চাইছে এটা কি আমরা মেনে নেব?
সকলে এক সঙ্গে, না না, জোরজুলুম চলবে না,” বলে চেঁচিয়ে উঠল
পেলে তখন আবার বলল,তাহলে উপায় একটাই এরেনিয়াসদের ফিরিয়ে আনতেই হবে কিন্তু তাতে একটা সমস্যা আছে এরেনিয়াসদের একজন হারিয়ে গিয়েছে সময়ের-প্রাচীরের উল্টোদিকে তাকে খুঁজে না আনলে কেউ একসুসিয়াসদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না তাকে ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে তাদের সময় নিয়ন্ত্রণের শক্তির উৎস
সকলে আবার এক সঙ্গে, হ্যাঁ, হ্যাঁকরে উঠতেই পেলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল,কিন্তু সেইজন্যে আমাদের তিনটে সূত্রের সমাধান করতে হবে তাই আমাদের সকলকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে এবার আমি যাকে যা বলব, সে তাই করবে রাজি?”
কথা শেষ হতেই ভাল্লুক, বেড়াল, কাঠবেড়ালি, ময়ূর সকলে, “রাজি, রাজি,বলে চেঁচিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে যোগ দিল অন্তু আর পিউও
চল তাহলে সবাই, আমাদের অ্যাডভেঞ্চার শুরু
পেলে সবাইকে নিয়ে গাছতলায় এসে দাঁড়াল ঘড়ির কাঁটায় হাত রাখতেই তারা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল

।। নয়।।

পেলের দল এখন দাঁড়িয়ে আছে গভীর জঙ্গলের মধ্যে সামনে দিয়ে একটা বিশাল নদী বয়ে চলেছে নদীর ওপর যেখানে সেখানে পাথর পড়ে আছে ছোটো ছোটো পেলে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল,এই হল আমাদের প্রথম সূত্রের জায়গা ওই যে দূরে পাহাড়টা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের সেখানে যেতে হবে কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম এই নদী পেরোনো বড়ো শক্ত ভুল পাথরে পা রাখলেই সোজা জলের তলায় কোনটা ঠিক রাস্তা, কোনটা ভুল ঠিক করা অসম্ভব যদি কোনওমতে এই নদীটা পেরোনো যায়, তারপর একটা জঙ্গল পড়বে বাঁশের সেই জঙ্গলটা একটা গোলকধাঁধা বেশিরভাগ লোকে সেখানে গিয়ে হারিয়ে যায়, পথ ঘুরে ঘুরে মরে আর সঠিক পথ খুঁজে পায় না যদি আমরা জঙ্গলটা পেরিয়ে যেতে পারি তারপর একটা মস্ত বড়ো গুহা আছে সেই গুহায় বাস করে ইউনিকর্নরা এমনিতে তারা খুব শান্ত কিন্তু একবার রেগে গেলে সোজা তাদের শিং দিয়ে পেট ফাঁসিয়ে দেয় অচেনা লোক দেখলে তারা প্রথমে প্রশ্ন করে তাদের বুদ্ধি যাচাই করে ভুল উত্তর বললেই ঘ্যাচাং ফুঁ সেই গুহার পর আরম্ভ হয় পাহাড়ে চড়ার রাস্তা সেই পাহাড় ভীষণ খাড়াই আর ভয়ংকর পিছল কিন্তু কোনওভাবে যদি পৌঁছতে পারি চূড়ায়, সেখানে আগুনকৌটোয় রাখা আছে আমাদের প্রথম সূত্র সেই সূত্র আসলে একটা ছবিসেই ছবি যদি আমরা কোনওভাবে হাতে পাই তাহলে হয়তো পরের সূত্রে পৌঁছোতে পারব কিন্তু এখন কথা হচ্ছে, এতগুলো বাধা পেরিয়ে আমরা সেই ছবি পাব কী করে?
সবাই গোল হয়ে বসে ভাবতে লাগল বেড়াল হঠাৎ হাত উঁচু করে বলল,পেলে, এত সবের দরকার কী? তোমার ঘড়ি কি আমাদের সোজা সেই পাহাড় চূড়ায় পৌঁছাতে পারে না?
পেলে মাথা নেড়ে বলল,না, এই জায়গার পর থেকে আমরা আর ঘড়ির সাহায্য পাব না এই পথের রাস্তায় নানারকম রক্ষাকবচ আছে এখানে কোনওরকম ম্যাজিক কাজ করে না
এ তো মহা সমস্যায় পড়া গেল আবার সবাই মাথা চুলকাতে লাগল কিছুক্ষণ পরে পিউ হঠাৎ লাফিয়ে উঠল পেলের কাছে গিয়ে তার কানে কানে কিছু বলতেই পেলের মুখে হাসি খেলে গেল সে সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,পিউ আমাকে একটা আইডিয়া দিয়েছে কিন্তু সবটা তোমাদের এখনই বলতে চাই না তার আগে বল, তোমরা সবাই এই বিপদের পথে যেতে রাজি তো? ইচ্ছে হলে এখনও ফিরে যেতে পার
কথা শেষ হওয়ামাত্র সক্কলে মিলে শোরগোল আরম্ভ করে দিল তারা কেউ ফিরে যাবে না সবাই এক সঙ্গে এগিয়ে যাবে
তাহলে ঠিক আছে,” মাথা ঝাঁকালো পেলে,প্রথমে আমাদের নদী পার হতে হবে পিউর কথামতো আমাদের কাঠবেড়ালিবন্ধুরা তাদের হালকা শরীর নিয়ে প্রথমে নদীর পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে যাবে তাদের সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যাবে ময়ূর যদি বাই চান্স ভুল পাথরে পা পড়ে ময়ূর তাদের সাহায্য করবে উঠে আসতে সেই পথ দিয়ে আমরা এগিয়ে যাব
প্রস্তাবটা সকলের মনে ধরল কাঠবেড়ালি দু’জন এগিয়ে গেল নদীর দিকে তাদের সঙ্গে সঙ্গে উড়ে চলল ময়ূর সবাই তাদের বেস্ট অফ লাক’ উইশ করল এক এক করে
কাঠবেড়ালিদুটো যমজ ভাইতাদের নাম গিললু আর টিললু গিললু প্রথম পাথরের ওপর পা দিল পাথর নড়ল না সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল এক-একটা পাথরে পা রেখে তারা লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে হঠাৎ টিললু পা রাখতেই একটা পাথর জলের ভিতর ঢুকে গেল ময়ূর এরকম অবস্থার জন্যে তৈরি ছিল তক্ষুনি সে টিললুকে ঠোঁটের সাহায্যে পিছনের পাথরটার ওপর তুলে দিল মিনিট দশেকের মধ্যেই গিললু আর টিললু অন্যদিকে পৌঁছে গেল দু’জনেই বেশ কয়েকবার পা ফসকেছে
এবার অন্যদের পালা ময়ূরের কথামতো ঠিক ঠিক পাথরে একেক পা ফেলে সবাই একটা সময়ে পৌঁছে গেল অন্যদিকে সবাই আনন্দে চিৎকার করতে করতে পিউকে জড়িয়ে ধরল পিউ হাসিমুখে সকলকে ‘থ্যাংকু থ্যাংকু’ বলছে অন্তুও খুশিমেয়েটার বুদ্ধি আছে বটে এমন সময় পেলে মুচকি হেসে বলল,
লাফানি ঝাঁপানি ওকে, বাট লক্ষ রাখ চোখে
এগিয়ে যেতে হবে, মোদের সূত্র পেতে হবে

অনেকক্ষণ পর পেলে ছড়া কাটল দেখে অন্তু বুঝল সে তার হালকা মেজাজটা ফিরে পেয়েছে সামনেই আরম্ভ হয়েছে ঘন বাঁশের জঙ্গল এই বনের মধ্যে গোলকধাঁধা আছে এমন সময় পান্ডা ভাল্লুক একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করে বলল,আমি কিছু বলব নাকি?
পেলে বলল,হ্যাঁ, বল বালু বলবে না কেন?
ও, তাহলে ভাল্লুকবাবাজির নাম বালু অন্তু ভাবল বালু আবার সেরকম লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল,ওই বাঁশ-জঙ্গলে পথ দেখানোর ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও আমি সারাজীবন ধরে নানা বাঁশের জঙ্গলে ঘুরেছি চিনের সিচুয়ান আর গানসু পাহাড়ে তার তুলনায় এই জঙ্গল তো কিছুই নয় তোমরা সবাই আমার পিছন পিছন এস
বালুর কথা শুনে সবাই স্বস্তি পেল সবাই তার পিছন পিছন চলল লাইন করে জঙ্গলে ঢুকতেই চারদিকে ঝিঁঝিঁর শব্দ শোনা গেল এত গভীর বন যে দিনের বেলাতেও অনেক জায়গায় সূর্যের আলো পৌঁছচ্ছে না গাঢ় সবুজ রঙের গাছ আর শুকনো পাতা মাড়িয়ে চলেছে সবাই অন্তু আর পিউর চারদিক একরকম মনে হচ্ছে কিন্তু বালুর কোনও হেলদোল নেই মনের সুখে একটা গান ভাঁজতে ভাঁজতে এই গাছ সেই গাছ পেরিয়ে হাঁটছে সে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে গন্ধ শুঁকছে আবার হাঁটছে পেলে হাঁটতে হাঁটতে অন্তু আর পিউকে বলল,বালু আগে চিনের জঙ্গলে থাকত একসুসিয়াসরা সেখানে সব জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে দিচ্ছে বলে এরেনিয়াসদের রাজা তাকে অতীতে নিয়ে এসেছিলেন, যখন সারা পৃথিবীতে বনজঙ্গলের অভাব ছিল না কেমন লাগছে তোমাদের এই সবাইকে?
অন্তু আর পিউ হাঁটতে হাঁটতে বলল,খুব ভালো
ততক্ষণে বালুর পিছন পিছন তারা বেশ খানিকটা রাস্তা চলে এসেছে মাঝে মাঝে বাঁশের কচি ডাল চিবোতে চিবোতে বালু এগিয়ে চলেছে থপ থপ করে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তারা সকলে জঙ্গলের ধারে চলে এল সামনে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে একটা বিশাল গুহার মুখ সবাই মিলে বলে উঠল,থ্রি চিয়ার্স ফর বালু হিপ হিপ হুররে!
বালু নির্বিকার এখনও সে বাঁশের ডগা চিবোচ্ছে পেলে সকলকে সতর্ক করে দিল গুহায় ঢুকতেই কিন্তু ইউনিকর্নরা আমাদের ঘিরে ধরবে কেউ হুড়মুড় করে কিছু বলবে না আমাদের ভেবেচিন্তে ঠিক উত্তর দিতে হবে না হলে কিন্তু খুব বিপদ
সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল সবাই একে একে গুহায় প্রবেশ করল গুহার ভিতরে কোথা থেকে যেন একটা সবুজ আলোর রেখা আসছে নিচ দিয়ে একটা সরু জলের ধারা বয়ে চলেছে গুহার দেওয়ালগুলো মসৃণ পেলে নিচু স্বরে বলল,অনেক বছর আগে ইউনিকর্নরা জার্মানির হার্জ পাহাড়ে বাস করত এসকুসিয়াসদের বার বার আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে তারা চলে আসে এই পাহাড়ে মনে রেখ, তারা আমাদের শত্রু নয়, শুধু একটু রাগী
কথা শেষ হতে না হতেই গম্ভীর গলার স্বরে কে যেন বলে উঠল,আমাদের গুহায় তোরা কে রে?
অন্তু আর পিউ সামনের দিকে তাকাতেই দেখল সবুজ আভার মধ্যে কতগুলো চতুষ্পদ প্রাণী এসে দাঁড়িয়েছে সাদা চকচক করছে তাদের গায়ের চামড়া, যেন জোছনা দিয়ে তৈরি মাথার ঠিক মাঝখানে একটা লম্বা শিং সামনের ইউনিকর্নটা প্রায় ছয় ফুট লম্বা পেলে বিনয়ী স্বরে বলল,গুড মর্নিং আসলে আমরা এরেনিয়াসদের সূত্র খুঁজতে যাচ্ছি
সামনের নেতা শিং বাগিয়ে বলল,কী করবি সূত্র নিয়ে? এরেনিয়াসদের ফিরিয়ে আনতে পারবি? একসুসিয়াসদের হারাতে পারবি?
পেলে কিছু বলার আগেই পিউ বলে উঠল,হ্যাঁ, পারব
“কে বলল রে?বলে ইউনিকর্নদের নেতা পিউর দিকে ঘুরে তাকাল ওহ, একটা বাচ্চা মেয়ে? তা তুমি বাঁচাবে এরেনিয়াসদের? দেখি তো তোমার কত বুদ্ধি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে? যদি ঠিক উত্তর দাও আমরা তোমাদের সাহায্য করব সূত্রের কাছে নিয়ে যেতে কিন্তু যদি ভুল উত্তর দাও তাহলে তোমাদের ফিরে যেতে হবে
পিউ একবার সকলের দিকে তাকিয়ে বলল,আমি রাজি
ইউনিকর্নদের নেতা হেসে বলল,ঠিক আছে তাহলে আমি তোমাকে তিনটে প্রশ্ন করব কিন্তু তোমাকে তার উত্তরে আমাকে প্রশ্নই করতে হবে আর বলতে হবে কেন তুমি প্রশ্নটা করেছ ঠিক আছে?
পিউ সামনে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,আমি কি কারও সাহায্য নিতে পারি উত্তর দেওয়ার জন্য?
পার, কিন্তু শুধু একবার গম্ভীর গলায় শোনা গেল,এবার আমার প্রথম প্রশ্ন মন দিয়ে শোন এর উত্তরে তোমাকে আমায় প্রশ্নই করতে হবে একটা মুরগি একটা ছেলেকে বলল, সব মুরগিরা মিথ্যুকএখন প্রশ্ন হচ্ছে মুরগিটা ছেলেকে সত্যি বলছে না মিথ্যে? বল?
পিউ ভাবতে লাগল মুরগি যদি সত্যি বলে থাকে তাহলে তার বলা কথাটা মিথ্যে হয়ে যাবে মিনিট পাঁচেক ভাবার পর পিউ ক্লাসে যেমন করে উত্তর দেওয়ার জন্যে হাত ওপরে করে সেরকম করে হাত তুলল তার মুখে হাসি ইউনিকর্ন বলল,উত্তর পেয়ে গেছ? বল দেখি
পিউ বলল,আগে আপনাকে বলতে হবে ছেলেটা কি এরেনিয়াস ছিল?
ইউনিকর্নদের নেতা রে রে করে উঠল,কেন? কেন এ প্রশ্ন করছ?
পিউ বলল,মুরগি সত্যি বলতেই পারে কিংবা মিথ্যে সেটা পরের কথা কিন্তু সে তো আর মানুষের ভাষায় কোনও ছেলেকে কিছু বলতে পারবে না বড়োজোর কঁক কঁক’ করবে যদি না সেই ছেলেটা মুরগির কথা বুঝতে পারে তাই জিজ্ঞেস করলাম ছেলেটা কি এরেনিয়াস ছিল যে মুরগির কথা বুঝতে পারত?
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইউনিকর্নটা দু’পা হাওয়ায় তুলে আবার নামিয়ে নিল বলল,ঠিক ঠিক বলেছ প্রশ্নের ভিতরেই উত্তর থাকে এবার আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন
অন্তু, পেলে আর বাকিরা তারিফের চোখে তাকিয়ে রয়েছে পিউর দিকে অন্তু ভাবল পিউর তো খুব বুদ্ধি! ওকে দেখে কিছু বোঝা যায় না কিন্তু এখনও দুটো প্রশ্ন বাকি আছে এদিকে নেতা পিউর চোখে চোখ রেখে বলল,একটা ঝুড়িতে পাঁচটা আপেল আছে ঝুড়ির সামনে পাঁচটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে এবার পাঁচটা আপেল পাঁচজনকে কীভাবে ভাগ করবে যাতে প্রত্যেকে একটা করে আপেল পায় আর একটা আপেল ঝুড়িতে পড়ে থাকে?বলে চারপেয়ে জানোয়ারটা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল
এদিকে পেলে আর বাকিদের তো আক্কেলগুড়ুম এটা কী ধরনের উদ্ভট প্রশ্ন রে বাবা! পিউ কিন্তু তক্ষুনি ঠোঁট উলটে বলল,ইজি! ঝুড়িতে ফুটো নেই তো?
পিউর দিকে চেয়ে নেতা বলল,কেন?
পিউ হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,আরে, চারটে ছেলেকে চারটে আপেল ধরিয়ে দিয়ে ঝুড়িসুদ্ধ লাস্ট আপেলটা ভাগে পড়বে শেষ ছেলেটারকিন্তু আপেলটা ঝুড়িতেই থাকবে তো, যদি ঝুড়িতে ফুটো না থাকে। তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কী!”
এবার ইউনিকর্ন রেগে গেল দাঁতে দাঁত চিপে বলল,ঠিক পরের উত্তরটা দিলেই তোমার জিত একটা বেড়ালের নাম আংলি জাংলি ট্যাংলি কাঙলি ঢিডিং টক আলুর চপ কেন?
পিউ কিছু বলার আগেই পিছন থেকে সাদা বেড়াল মিনি এগিয়ে এসে বলল,পিউ, আমি এটার উত্তর দিচ্ছি তুমি তো সাহায্য নিতে পার একটা প্রশ্নে!
পিউ এই প্রশ্নের মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি সে মাথা নাড়তেই মিনি এগিয়ে গিয়ে ইউনিকর্নের নেতাকে বলল,স্যার, আমি বলব?
নেতা শিং নাড়িয়ে গোল গোল চোখে তাকিয়ে বলল,বল
মিনি পরিষ্কার গলায় বলল,স্যার, আপনি কি পাগল না আপনার মাথায় ছিট আছে?
মিনির কথা শুনে তো সবাই থ বেড়ালটা বলে কী! এদিকে তো চারপেয়ে সাদা প্রাণীটা রেগেমেগে মিনিকে কামড়ে দেয় আর কী! সে বলল, “কী! তুমি আমাকে অপমান করলে? এত বড়ো আস্পর্ধা?
মিনি অবশ্য একটুও না ঘাবড়ে ঠান্ডা স্বরে বলল,না না, অপমান করব কেন, স্যার? আমি তো জাস্ট প্রশ্নের উত্তর বলছিলামআসলে আমি তো নিজেই একটা বেড়াল, তাই জানি অমনি আলুর চপ গোছের নাম বেড়ালের কোনও কালে হয় না আপনি একটা ভুলভাল প্রশ্ন করে পিউকে ঠকাতে চাইছিলেন? তাই বলছিলাম, আপনি কি পাগল না আপনার মাথায় ছিট আছে?”
কিছুক্ষণের জন্যে সক্কলে এক্কেবারে চুপ হয়ে গেল মিনি বলে কী! এই ইউনিকর্নটা জোচ্চুরি করে তাদের হারিয়ে দিতে চাইছিল?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ইউনিকর্নের নেতা বলল,ঠিক আছে আমি হার স্বীকার করছি তোমরা সত্যিই বুদ্ধিমান আমরা তোমাদের সবরকম সাহায্য করব বল, তোমরা কী চাও
পেলে এগিয়ে গিয়ে তাকে বলল,তোমাকে আগেই বলেছি যে আমরা এরেনিয়াসের শক্তির উৎসে পৌঁছনোর জন্যে প্রথম সূত্রের সন্ধান করছি তুমি যদি সেটা পেতে আমাদের সাহায্য কর তাহলে আমাদের খুব সুবিধে হবে
নেতা ইউনিকর্ন বলল,ঠিক আছে আমার নাম এলেস্টের আমি এই ইউনিকর্নদের রাজা আমি তোমাদের সাহায্য করব এরেনিয়াসের শক্তির প্রথম সূত্র রাখা আছে এই গুহার বাইরে পাহাড়চূড়ায় আগুনকৌটোর ভিতর সে পাহাড়ে তোমরা কিছুতেই উঠতে পারবে না আমাদের সাহায্য না পেলে আমি তোমাদের সেখানে পৌঁছে দেব কিন্তু একটা কথা মাথায় রেখআগুনকৌটোর মধ্যে যে সূত্র আছে সেটা তোমরা নিয়ে যেতে পারবে না সেই কৌটো সেখান থেকে তুললেই ভূমিকম্প শুরু হয়ে যাবে এই গুহা, পাহাড়, জঙ্গল সব তছনছ হয়ে যাবে সেই আলোড়নে তোমরা নিশ্চয়ই তা চাও না তোমরা বড়জোর সেই সূত্র দেখতে পাবে কিছুক্ষণের জন্য কিন্তু নিয়ে যেতে পারবে না
এলেস্টেরের কথা শুনে পেলে, পিউ আর অন্তু মুখ চাওয়াচাওয়ি করল তারা অন্যদের দিকে চেয়ে বলল,তোমাদের কী মনে হয়?
ময়ূর ঘাড় নাড়িয়ে বলল,আমার মনে হয় আমাদের এলেস্টেরের সঙ্গে যাওয়া উচিত নিজেদের কাজের জন্যে আমরা ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি নিতে পারি না
পিউ আর বাকি সকলেও সায় দিলসকলেরই মত, সূত্রটাকে দেখতে পেলেও হয়তো তাদের কাজ চলে যাবে অবশেষে পেলে এলেস্টেরের দিকে ফিরে বলল,আমরা রাজি
চল তাহলে,” বলে এলেস্টের তাদেরকে নিয়ে এগিয়ে চলল কিছুক্ষণের মধ্যেই গুহা শেষ হয়ে এলবাইরে বেরোতেই সকলে হাঁ করে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে তাদের চোখের সামনে একটা বিরাট উঁচু বরফের পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে এতই তার উচ্চতা যে পাহাড় চূড়াটা দেখা পর্যন্ত যাচ্ছে না এমন সুন্দর দেখতে লাগছিল পাহাড়টাকে যে অন্তু চোখ ফেরাতে পারছিল না এমন সুন্দর আর বিশালাকার কোনও বিস্ময়ের সামনে দাঁড়ালে আপনা থেকেই মনটা অন্যরকম হয়ে যায় তাদের পিছনে ইউনিকর্নের দল এসে দাঁড়িয়েছে অন্তু এলেস্টেরের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল,আমরা কী করে পৌঁছব ওপরে?
এলেস্টের তার শিং নাড়িয়ে বলল,পেগাকর্ন তোমাদের নিয়ে যাবে ওই যে সে এসে গেছে
অন্তুরা পিছন ফিরতেই কেঁপে উঠল বিস্ময়ে বিশাল একটা সাদা রঙের ইউনিকর্ন তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তার উচ্চতা এলেস্টারের তিনগুণ, আর তার পিঠের দু’পাশে ঝটপট করছে রামধনু রঙের বিশাল দুটি ডানা
নাও, তোমরা উঠে পড় পেগাকর্নের পিঠে তাড়াতাড়ি পেগাকর্ন, এদের সকলকে নিয়ে যাও চূড়ার দিকে কিন্তু বেশি দেরি কোরো না যেন
পেলে অনেক ধন্যবাদ দিল এলেস্টেরকে অন্তু, পিউ, বালু, মিনি, ময়ূর, গিললু, টিললু, সবচেয়ে শেষে উঠে বসল পেলে পেগাকর্ন উড়ে চলল ওপরের দিকে অন্তু যেন স্বপ্ন দেখছে বিশাল পাহাড়টা আরও কাছে চলে আসছে একটু একটু করে তাদের পিঠে করে নিয়ে উড়ে চলেছে পেগাকর্ন বরফের উপর রোদ পড়ে সোনালি রঙে ঝকঝক করছে বরফের রং এত সুন্দর যে বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে হয় পিউ একদৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গলের সারি পেগাকর্ন মাঝে মাঝে ডানা ঝটপট করে দিক বদলাচ্ছে তখন বুকটা কেঁপে উঠছে সকলের একসময় তারা পাহাড়ের চূড়ায় এসে পৌঁছল পেগাকর্ন তাদের নামিয়ে দিতে দিতে বলল,তাড়াতাড়ি কর ওই সামনে দেখছ যে পাথর সাজানো আছে, তার নিচেই রাখা আছে এরেনিয়াসদের আগুনকৌটো আমরা বেশিক্ষণ এত উঁচুতে থাকতে পারব না খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিট তারপর তোমাদের আমি পৌঁছে দেব জঙ্গলের কিনারায়
অন্তুরা তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল পাথরের কাছে একের ওপর এক পাথর চাপিয়ে একটা আকার দেওয়া হয়েছে পেলে খুব সাবধানে একটা একটা করে পাথর সরাতে লাগল কয়েকটা পাথর সরাতেই আগুনের তাপ এসে লাগল সকলের চোখে পাথরের মাঝে সুন্দর একটা কৌটো সোনালি রঙেরতাকে ঘিরে রয়েছে একটা বাষ্প আগুনের তাপ হাতে এসে লাগলেও কৌটোটা গরম নয় কৌটোর ভিতর থেকে পেলে খুব সাবধানে একটা হলুদ কাগজ বের করে আনল সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেটা দেখার জন্যে কাগজটার মাঝখানে কয়েকটা লাইন লেখা আর তার চারদিকে আঁকা রয়েছে কয়েকটা প্রাণীর ছবি আঁকার লাইনগুলো এমন জ্বলজ্বল করছে যেন মনে হচ্ছে আগুনরং দিয়ে আঁকা হয়েছে সকলে খুব মন দিয়ে দেখতে লাগল ছবিটা ছবির মাঝখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা
রইল ম্যাজিক ছদ্মবেশে, ঘুমপাড়ানো ছবির বেশে
বন্ধু চেনে প্রথম দেখায়, জাগবে উঠে স্মৃতির রেখায়

।। দশ।।

অন্তুরা জঙ্গলের বাইরে চলে এসেছে কিছুক্ষণ আগে পেগাকর্ন তাদের নামিয়ে দিয়ে গেছে পাঁচ মিনিটের বেশি থাকা হয়নি চূড়ায় এর মধ্যে খালি কাজের কাজ হয়েছে এই যে অন্তু পেন্সিলে করে সূত্রের লেখাটা লিখে এনেছে কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু লাভ হয়নি পেলে অবধি কথাটার কোনও সুরাহা করতে পারেনি সবাই যদিও এখনও নিজের মতো করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে
অন্তু ছড়াটা আওড়াতে আওড়াতে পেলের কাছে গিয়ে বসল নদীর ধরে পিউকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে নাআসার পর থেকেই সে গাছের আড়ালে কাগজ-পেন্সিল নিয়ে বসে পড়েছে হয়তো ছড়ার সূত্র খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে পেলে অন্তুর দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে বলল,তোমরা কেউ কিছু বুঝতে পারলে?
অন্তু বলল,না এখনও কেউ কিছু বোঝেনি ছড়াটার কথামতো সূত্র ধরতে গেলে ওই ছবিটা সামনাসামনি দেখতে পাওয়া দরকার কিন্তু সেটা তো আমরা আনতে পারতাম না
পেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,তাহলে বোধহয় আমরা ব্যর্থই হলাম পরের সূত্র পাওয়া যাবে না আর
অন্তু খেয়াল করেনি কখন যেন পিছনে পিউ এসে দাঁড়িয়েছে পিউর গলা শুনতে পেয়ে পেলে আর অন্তু দু’জনেই চোখ ফেরাল পিউ উত্তেজিত গলায় বলল,পরের সূত্র পাওয়া যাবেই
পেলে বলল,কিন্তু ছবিটা যে নেই, পিউ!”
পিউ জোর দিয়ে বলল,কে বলল নেই? এই নাও ছবিযদিও আমি রং-পেন্সিলেই এঁকেছি, কিন্তু আগুন-কালির রংগুলো ছাড়া বাকিটার একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে
কই? কোথায় ছবি?পেলের উত্তেজিত গলা শুনে সবাই এইদিকে চলে এসেছে ততক্ষণে
পিউ হাতটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিল অন্তুকে বলল,মাঝের স্টার জায়গাটায় লেখাটা ছিল আমার মনে নেই ছড়াটা ছবিটা ভালো করে দেখছিলাম তুমি এই পেন্সিল দিয়ে সেটা এখানে লিখে দাও তো
সকলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল পিউর ছবিটার ওপর অন্তুর মনে হল একমাত্র কালির রং ছাড়া পিউ পুরো ছবিটাই হুবহু তুলে এনেছে কাগজের ওপর ছবিটার চারপাশে চারটে প্রাণী আঁকা হয়েছে - একটা সাপ, একটা সিংহ, একটা ছাগল আর একটা ড্রাগন


পেলে লাফিয়ে উঠে পিউকে জড়িয়ে ধরল আপ্লুত স্বরে বলল,তুমি যে স্মৃতির ওপর নির্ভর করে এমন নিঁখুত আঁকতে পার না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না
কথাটা শুনেই পিউ দ্বিগুণ উত্তেজিত হয়ে বলল,অন্তু! আমি বুঝে গেছি কুইক মাঝখানের স্টারটার মধ্যে ছড়াটা যেরকম করে লেখা ছিল, লিখে ফেল
অন্তু পেন্সিল দিয়ে মুখস্থ দু’লাইন লিখে দিল সেখানে
রইল ম্যাজিক ছদ্মবেশে, ঘুমপাড়ানো ছবির বেশে
বন্ধু চেনে প্রথম দেখায়, জাগবে উঠে স্মৃতির রেখায়

পিউ সকলকে বলল,সূত্রের প্রথম লাইনেই বলছে যে এই ছবিটাতে কোনও একটা ম্যাজিক লুকিয়ে আছেহয়তো এই প্রাণীগুলোই ঘুমিয়ে আছে সূত্রে কিন্তু যে সূত্র লুকিয়ে রেখেছিল সে জানত যে সেখান থেকে এই ছবি নিয়ে আসা চলবে না তাই সে বলেছে, বন্ধু চেনে প্রথম দেখায়, জাগবে উঠে স্মৃতির রেখায় মানে, যদি এই ছবির প্রাণীগুলোকে আমরা বন্ধু বলে মনে করি তাহলে সহজেই স্মৃতির ওপর নির্ভর করে তাদের রেখায় জাগিয়ে তুলব, মানে তাদের ছবি আঁকতে পারব যদি এই ছবি ঠিকঠাক হয়ে থাকে তাহলে এই ছবি থেকে আমরা দ্বিতীয় সূত্র পেয়ে যাব
সকলে লাফিয়ে উঠল পিউর কথা শুনে ঠিক সেই সময়ই পায়ের নিচের জমি কাঁপতে আরম্ভ করল ভূমিকম্প নাকি? না শব্দটা তো হচ্ছে মাটিতে রাখা ছবিটার ভিতর থেকে হঠাৎ ছবিটার মাঝখানের লেখাটা থেকে আগুনের একটা শিখা জ্বলে উঠল দপ করে সকলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকেউত্তেজনায় সকলের গলা শুকিয়ে গেছে আস্তে আস্তে সেই শিখার মধ্যে একটা প্রাণীর আদল দেখা গেল তার মাথাটা সিংহের মতো, শরীরটা ছাগলের, লেজের জায়গায় একটা সাপ
পেলে লাফিয়ে উঠে বলল,আমি চিনতে পেরেছি এ হল গ্রিকদেশের প্রাণী কাইমেরাসিংহ, ছাগল, সাপ আর ড্রাগনের মিশেল
প্রায় পাঁচ মিনিটের মধ্যে আগুনের মাঝ থেকে বেরিয়ে এল অতিকায় সেই প্রাণী নদীর দিকে তাকিয়ে হাঁ করতেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল দাউ দাউ করে আগুন অন্তু, পিউ, বালু, সকলে বিস্ময়ে আর উত্তেজনায় হতবাক হয়ে গেছে এবার কি তাহলে কাইমেরা তাদের সাহায্য করবে পরের সূত্রে নিয়ে যাওয়ার জন্যে? এই কি তাদের সেই বন্ধু, যার কথা পেলে বলেছিল?
হ্যাঁ, ঠিক কাইমেরা তার বিশাল মাথাটা তাদের দিকে ঘুরিয়ে সকলের দিকে তাকাল একে একে তারপর বলল,আমি জানি তোমরা আমার বন্ধু তা না হলে আমি আসতাম না তোমরা যে এরেনিয়াসের দ্বিতীয় সূত্রের সন্ধানে যেতে চাও তাও আমি জানি
পেলে মাথা নুইয়ে বলল,মহান কাইমেরা, তোমাকে সঙ্গে পেয়ে আমরা অভিভূত তুমি যেখানেই নিয়ে যাবে আমরা যাব
কাইমেরা জিভ লক লক করে বলল,চল তাহলে তোমরা সবাই আমার সঙ্গে এস
ইতিমধ্যে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে কাইমেরা হেঁটে চলল তার বিশালাকায় শরীর নিয়ে পাহাড়-পর্বত আর জঙ্গল পেরিয়ে তার পিঠে বসে রইল পেলের দল ভোর হওয়ার কিছুক্ষণ আগে তারা এসে পৌঁছল একটা গিরিখাতের কাছে কাইমেরা বলল,এর পরে আগুনপাহাড় শুরু হচ্ছে এই রাজ্য একসুসিয়াসদের কিন্তু আমি যতক্ষণ তোমাদের সঙ্গে আছি তারা তোমাদের কিছু করতে পারবে না তোমরা ভয় পেও না
কাইমেরা দ্রুত তাদের নিয়ে চলল গিরিখাতের ভিতর দিয়ে একটা বাঁক নিতেই অন্তুরা দেখল পাহাড়ের গা দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে যেদিকে দেখ, সেদিকে আগুন পুরো পাহাড়ে যেন আগুন জ্বলে গেছে আর তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেক মানুষ, একসুসিয়াস তাদের চেহারা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে নাকারণ, তারা সকলেই মুখোশ পরে আছে তাদের দেখতে পেয়েই একসুসিয়াসদের হাত থেকে বিদ্যুতের মতন আগুনের ফুলকি ছুটে আসতে লাগল তাদের দিকে কিন্তু একটাও কাইমেরা অবধি পৌঁছল না সেই দেখে একসুসিয়াসদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেল তারা দৌড়ে আসতে লাগল পাহাড়-পর্বতের সংকীর্ণ গোপন গুহাপথ দিয়ে কাইমেরা এদিকে সকলকে নিয়ে ছুটে চলেছে গিরিপথের সংকীর্ণ গলি দিয়ে চারদিক দিয়ে ঝরছে আগুন, আর ছুটে আসছে একসুসিয়াসদের মারণাস্ত্র পেলে অবধি গুম মেরে বসে আছে সে এক ভয়ানক অবস্থা একটা পাহাড় পেরোতেই সামনে দেখতে পাওয়া গেল হাজার হাজার লোক তাদের দিকে ছুটে আসছে
তোমরা শক্ত করে আমাকে ধরে থেক,” এই বলেই কাইমেরা হাঁ করে এক হুঙ্কার দিল সেই শব্দে কানে তালা লেগে যায় ভলকে ভলকে আগুনের হলকা বেরোচ্ছে তার মুখ দিয়ে কতজন যে সেই আগুনের সামনে এসে ছাই হয়ে গেল কে জানে কাইমেরা তাদের ওপর দিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলল
একসময় একসুসিয়াসদের রাজ্য শেষ হয়ে এল কাইমেরা একসময় এসে থামল একটা সবুজ মাঠের মাঝখানে পিউ, অন্তু সবাই লাফিয়ে নেমে এল তার পিঠ থেকে সকলের পিঠে ব্যথা হয়ে গেছে কাইমেরা বলল,ওই যে দেখছ সামনে একটামাত্র গাছ দাঁড়িয়ে আছে, তার কাছেই তোমরা দ্বিতীয় সূত্র খুঁজে পাবে এবার আমার ছুটি
কাইমেরাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে পেলে তাকে বিদায় দিল তারপর সকলে মিলে এগিয়ে গেল সেই গাছটার দিকে গাছটার গা থেকে হলুদ রঙের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে আর অসংখ্য রঙিন ফুলে ছেয়ে আছে তার শাখাপ্রশাখা কাছে এসে তারা দেখল, গাছের কান্ডের মাঝখানে একটা ছোট্ট ফোকরসেখান থেকে নীল আলো বেরিয়ে আসছে কিন্তু এইবার? গাছের আনাচে-কানাচে কিছু নেই এবার কী করা যায়? সকলে একসময় ফোকরে চোখ রাখল কিন্তু সেখান থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না এমন সময় গিললু আর টিললু বলল,আমরা ফোকরের ভিতরে গিয়ে দেখে আসছি
বাকিরা আর কী করে, অনিচ্ছাসত্ত্বেও সকলে সায় দিল তাদের কথায় পেলে বার বার তাদের বলে দিল, কোনওরকম বিপদের আশঙ্কা দেখলেই যেন তারা ফিরে আসে গিললু আর টিললু লাফিয়ে গিয়ে নীল ফোকরের ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল সকলে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল তাদের জন্য কিছুক্ষণ পরেই তারা ফিরে এল গিললু আর টিললু বলল,ভিতরে কিছুদূর গিয়েই ফোকর শেষ হয়ে গেছে এগোবার কোনও রাস্তা নেই শুধু গাছের কান্ডের ঠিক মাঝখানে একটা কৌটোর মধ্যে এই পাথরটা রাখা ছিল আমরা কৌটোটা নিয়ে এসেছি
সকলে ঝুঁকে দেখল সেটাএকটা সাধারণ পাথরের মতো দেখতে অন্তু পেলেকে বলল,আমরা কি এটা হাতে নিয়ে দেখব?
পেলে ঘাড় নাড়িয়ে সায় দিল নিচু হয়ে সেটা ধরতেই অন্তু অদৃশ্য হয়ে গেল সবাই অবাক হয়ে দেখল, পাথরটা একই জায়গায় পড়ে আছে পেলে চেঁচিয়ে উঠে বলল,ইউরেকা! বুঝেছি এটা একটা টেলিপোর্টিং ডিভাইস সকলে এক সঙ্গে এই পাথরটা স্পর্শ করলেই আমরা অন্তু যেখানে গেছে সেখানে পৌঁছে যাব সেখানেই আমাদের শেষ গন্তব্য তৃতীয় সূত্র সেখানেই আছে সকলে আমার সঙ্গে চল তিন বলতেই সকলে এক সঙ্গে পাথরটাকে স্পর্শ করবে
সকলে সামনে এগিয়ে এসেছে পেলে গুনতে লাগল,এক... দুই... তিন...

।। এগারো।।

চোখ খুলতেই অন্তু দেখল সে একা আশেপাশে পেলে, বালু, পিউ কেউ নেই ওই পাথরটাই তাকে পৌঁছে দিয়েছে এখানে তাহলে ওরাও এক্ষুনি এসে পড়বে কিন্তু কোথায় এল সে! সামনের দিকে চোখ পড়তেই সে অবাক হয়ে গেল আরে! এটা তো তারই বাড়ি, রূপছন্দপুরের বাড়ির সামনে বাগানে সে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু চারদিকে এত অন্ধকার কেন? কোনও লোকজনকেও দেখতে পাচ্ছে না পাথরটার তো হিসেবমতো তাদের তৃতীয় সূত্রের কাছে পৌঁছনোর কথা ছিল কিন্তু সে এখানে চলে এল কেন? অন্তু ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল এই বাড়িটাতে সে এত বছর ধরে আছে, কিন্তু এখন বাড়িটাকে পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে বহুদিন এখানে যেন কেউ বাস করেনি বাগানটাতেও আগাছায় ভরা এমন সময় পিছন থেকে কে যেন তার নাম ধরে ডাকল,অন্তু?
অন্তু ফিরে তাকাতেই দেখল, তারই বয়সী একটা ছেলে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে
তুমি কে?অন্তু জিজ্ঞেস করল অবাক হয়ে আমার নাম জানলে কী করে?
ছেলেটা হাসতে হাসতে তার দিকে এগিয়ে এল গাঢ় স্বরে বলল,চিনতে পারছিস না?
অন্তু একটু থতমত খেয়ে বলল,না, না তো
ছেলেটা তার কাঁধে হাত রেখে বলল,ঠিক আছে চল আমার সঙ্গে তোকে সব মনে করিয়ে দিচ্ছি
অন্তুর হাত ধরে ছেলেটা এগিয়ে গেল

*           *           *

পিউ, পেলে আর বাকিরা এসে পৌঁছেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে কিন্তু তারা অন্তুকে দেখতে পায়নি পেলে এখানে আসার পর থেকেই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর যখন ওরা অন্তুকে খুঁজে পেল না, পিউ এসে পেলেকে বলল,এবার আমরা কী করব?
পেলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,পিউ, আমার অনুমান যদি সত্যি হয় এখন আর অন্তুকে খুঁজে লাভ নেই সময় হলে সে নিজেই দেখা দেবে
পিউ খানিকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পেলের দিকেতার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে সে এক হাত দিয়ে জল মুছে বলল,আপনি খুব খারাপ আমি অন্তুকে নিতে এত দূর থেকে এসেছি শুধু ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে আপনি যা বলেছেন তাই করেছি এমনকি অন্তুকে বলিওনি যে আমি কেআর এখন আপনি বলছেন যে...পিউ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল
ততক্ষণে সকলে চলে এসেছে সেখানে পেলে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,কেঁদো না, পিউ আমি তোমাদের সব খুলে বলছি সব শুনলে তোমরা বুঝতে পারবে, অন্তু এবার নিজেই ফিরে আসবে
“একসময় রূপছন্দপুরে তিনটে ছেলে থাকত তাদের নাম ছিল সুপু, অন্তু আর পিলু তারা এত গভীর বন্ধু ছিল যে কোনও কারণেই কখনও একমুহুর্তের জন্যেও তাদের বন্ধুত্বে চিড় ধরেনি তাদের খাওয়া, খেলা থেকে শুরু করে স্কুল যাওয়া সব ছিল এক সঙ্গে অন্তু আর সুপু পাশাপাশি বাড়িতে থাকত অন্তুর মা-বাবা ছিল না সে থাকত তার পিসির কাছে আসলে অন্তুর মা-বাবাকে একসুসিয়াসরা ধরে নিয়ে গেছিল তাই অন্তুর পিসি তাকে একা কোথাও ছাড়তেন না সুপুর বাড়িতে সকলেই অন্তুকে নিজের বাড়ির ছেলের মতো ভাবত এগারো বছর বয়স হলে তারা জানতে পারল যে সুপু, অন্তু আর পিলু তিনজনেরই বিশেষ কয়েকটা শক্তি আছেমানে, তারা ছিল এরেনিয়াস পিলু পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাণীর সঙ্গে কথা বলতে পারত এমনকি যে প্রাণীরা আসলে কল্পনার জগতে থাকে তাদের নিয়ে আসতে পারত পৃথিবীতে তাদের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ করতে পারত সুপু ছিল রূপ বদলাতে ওস্তাদ চোখের নিমেষে সে বদলে যেত যে কোনও সজীব কিম্বা জড়বস্তুতে কিন্তু অন্তুর ক্ষমতা ছিল অদ্ভুত সে ইচ্ছে করলেই চলে যেতে পারত অতীতে বা ভবিষ্যতে এছাড়া এরেনিয়াসদের সব শক্তিই ছিল তার মধ্যে ধীরে ধীরে অন্তুর ক্ষমতা আরও বেড়ে চলল সে বুঝতে পারল, পৃথিবীর সমাজ আসলে সময়ের বিভিন্ন কম্পাঙ্কে দাঁড়িয়ে আছে এমনিতে একসময়ে বিভিন্ন কম্পাঙ্কে একই জীবন চলছে প্রতিটি প্রাণীর কিন্তু তাহলে কি মানুষ টাইম ট্রাভেল করে ভবিষ্যতের কিছুই বদলাতে পারবে না? অনেক খুঁজে একসময় উত্তর পেল অন্তু সময়ের এক কম্পাঙ্কে পিছিয়ে গিয়ে নিয়তিকে বদলানো যায় না, শুধু ঘটনার সাক্ষী হওয়া যায় কিন্তু যদি সময়ের অন্য কম্পাঙ্কে অতীতে চলে যাওয়া হয়, সেখানে গিয়ে এরেনিয়াসরা নিজের মতো করে সময়কে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে কিন্তু তাতে একটা সমস্যা আছে একবার নিজের জীবনের অতীত বদলে দিলে সময়ের যাত্রী আর নিজের সময়ে ফিরে আসতে পারে না সে ভ্যানিশ হয়ে যায় আর তার অতীতে যে জীবনে সে বাঁচে, সেই জীবনে আর কিছু মনে থাকে না
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই তিনবন্ধু বড়ো হয়ে উঠল কিন্তু একসুসিয়াসদের সঙ্গে এরেনিয়াসদের সংঘর্ষ ক্রমেই বাড়ছে এরেনিয়াসরা ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর নানা প্রান্তেতাদের শক্তি কমে এল একসময় এরকম হল যে সুপু, অন্তু আর পিলু ছাড়া এরেনিয়াসদের প্রতিনিধি আর কেউ থাকল না ততদিনে তারা নানারকম শক্তির মালিক একসুসিয়াসরা তাদের ধরতে পারলেই জিতে যাবে; পৃথিবীর ওপর একছত্র রাজত্ব করবে কোনও উপায় না দেখে অন্তু ঠিক করল, সে তার অতীত বদলে দেবে সময়ের অন্য কম্পাঙ্কে গিয়ে, যাতে একসুসিয়াসরা আর তাকে খুঁজে না পায় তার জীবন শুধু বাঁধা থাকবে জীবনের প্রথম বারো বছরের সময়ে যতদিন না সময় আসছে তাকে ফিরিয়ে আনার পিলু আর সুপুর সঙ্গে পরামর্শ করে সে তাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনার চাবিকাঠি এমনভাবে লুকিয়ে রাখল সময়ের বিভিন্ন স্তরে যে একসুসিয়াসরা কোনওদিনই তার নাগাল পাবে না এরেনিয়াসদের আদিগুরু স্যামুয়েলের কথামতো অন্তু, সুপু আর পিলুকে সময়ের রহস্য বুঝিয়ে দিল সুপু সেইমতো তৈরি করল টাইম ট্রাভেল করার একটি ঘড়ি পিলুর কাছে থাকা এই ঘড়ি তাকে অতীত আর ভবিষ্যতের যাত্রী করে রাখবে এই পুরো সময়টা স্যামুয়েলের কথামতো ঠিক সময় এলে সুপুর পরিবারের একজন অন্তুকে ফিরিয়ে আনতে পিলুকে সাহায্য করবে অতীতে ফিরে গিয়ে কিন্তু অন্তুর সঙ্গে সেই মেয়েটির যোগাযোগ হবে কী করে? অন্তু চলে গেছে, পিলুও অতীতে একসুসিয়াসরা ক্রমাগত আক্রমণ করে চলেছে তার ওপর সুপু তখন একটা ভীষণ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল সে তার শক্তি ব্যবহার করে তার রূপ বদলে ফেলল তার বাড়ির সামনে একটা গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বছরের পর বছর তার স্ত্রী, ছেলে কেউ জানত না এই কথা কী ভীষণ সেই সিদ্ধান্ত! কিন্তু সুপু বন্ধুকে ফিরিয়ে আনার জন্যে সবকিছু করতে রাজি সুপু গাছ হয়ে সময় হলে সেই মেয়েটির সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ স্থাপন করে পিলুকে ঠিক সময়ের কথা জানিয়ে দেবে সেইমতো পিলু গিয়ে অন্তুকে ফিরিয়ে আনার জন্যে ব্যবস্থা নেবে
পেলে চুপ করল পিউর চোখে জল বালু, মিনি, ময়ূর সকলে হতবাক হয়ে তার কথা শুনছে পেলে বলল,তোমরা বুদ্ধিমান নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ সবকিছু সেই পিলুই হল তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই পেলে পিউ, তোমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তোমার বন্ধু গুলমোহরগাছটা শুধু তোমার বন্ধু নয়, সেই আমার বন্ধু সুপু ওরফে সুপ্রতিম তোমার হারিয়ে যাওয়া দাদু আর সেই এরেনিয়াস, যাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আমরা এক সঙ্গে আছি আজ, সেই হল আমার বন্ধু কিশোর ওরফে অন্তু
কেউ কথা বলল না পিউ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে কাছে চলে এল পেলের তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল

।। বারো।।

অন্তু কোনও কথা বলছে না ছেলেটি তাকে বলল,অন্তু, আমি চললাম বাকি কাজ তোকেই করতে হবে
অন্তু উদাস চোখে তাকাল তার দিকে কোনও কথা বলতে পারল না তার বন্ধু সুপুর ত্রিমাত্রিক ছবি তার চোখের সামনে ম্যাজিকের মতো উবে গেল হাসতে হাসতে অন্তু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল পিউ আর পিলুকে খুঁজে বের করতে হবে

*           *           *

“ওই তো অন্তু পেলে চেঁচিয়ে উঠল
বাড়ির পিছন দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে অন্তু পেলের কাছে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরল সেতার কানে কানে বলল,থ্যাঙ্ক ইউ, পিলু!
পেলে চোখের জল সামলাতে সামলাতে আস্তে আস্তে বলল,মনে পড়েছে? সুপুকে দেখলি? তোর তৃতীয় সূত্র?
অন্তু বলল,হ্যাঁ এখনও একটা শেষ কাজ বাকি
পেলেকে ছেড়ে সে সকলের দিকে তাকাল বলল,তোমাদের সকলকে ধন্যবাদ তোমাদের নিশ্চয়ই পিলু সব বলেছে আমি তৃতীয় সূত্র খুঁজে পেয়েছি কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমরা দেখতে পাবে পিউ, থ্যাঙ্ক ইউ! তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে
পিউ তাকিয়ে রইল ভেজা চোখে কোনও কথা বলতে পারল না অন্তু ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সকলের মাঝখানে পেলেকে বলল,তোমার ঘড়িটা আমাকে দাও পিউ তোমারটাও দাও
তারা কোনও কথা না বলে ঘড়িদুটো এগিয়ে দিল অন্তুর দিকে অন্তু দু’হাতে দুটো ঘড়ি মুঠো করে বলল,এরেনিয়াসদের শক্তি তাদের ম্যাজিকে নয়, তাদের মনে আমরা বিশেষ শক্তি চাই না সময়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ চাই না শুধু চাই পৃথিবীতে সকলে আনন্দে বেঁচে থাকুক, এক সঙ্গে তৃতীয় সূত্রে সময়-শক্তি উদ্ধারের কথা বলা নেইবলা আছে সেই শক্তিকে ধ্বংস করার কথা এই শক্তি না থাকলে একসুসিয়াসরা কোনওদিনই পৃথিবীতে রাজত্ব করতে পারবে না
সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অন্তুর দিকে অন্তু সকলের সামনে মুঠো করা দু’হাত প্রসারিত করে চোখ বন্ধ করল তার দু’হাতের মুঠো থেকে ধীরে ধীরে কমলা রঙের আভা বেরোতে লাগল আস্তে আস্তে অন্তুর হাতের জায়গায় দুটো বিশাল সোনালি ডানা প্রসারিত হল ঠিক যেমন পিউ ছবিতে এঁকেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্তুর সারা শরীর ধরে একটা উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল অন্তু সকলের দিকে তাকিয়ে বলল,বিদায়
একটা প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ হল পিউর আর কিছু মনে নেই

।। তেরো।।

চোখ খুলতেই পিউ দেখল সে গাছের তলায় শুয়ে আছে তার কানে আসছে পাখির ডাক ভোরের আলো ফুটছে আস্তে আস্তে পিউ উঠে বসল সামনের দিকে চেয়েই সে দেখতে পেল তার প্রিয় গুলমোহরগাছটা চোখ তুলে দেখল সে তার বাড়ির সামনের বাগানে শুয়ে আছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল গুলমোহরগাছটা তার মাথায় টুপ টুপ করে ঝরে পড়ল কতগুলো ফুল কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সে জানে না একসময় কে যেন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল পিউ দেখল, সে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে একজন মানুষকে তার দাদু দু’দিকে এসে দাঁড়িয়েছে আরও দু’জন বয়স্ক মানুষ সকলে তার দিকে তাকিয়ে আছে স্নেহের দৃষ্টিতে একজন মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ পিউ, ফর এভরিথিংআমি যদিও এখন তোমার চেয়ে বড়ো, সবসময় আমি তোমার বন্ধুই থাকব, অন্তু হয়ে
ডানদিকে তাকিয়ে পেলেকে চিনতে পারল সে ভোরের নরম আলোয় বহু বহু বছর পর পিউর চোখের সামনে তিনবন্ধু একে অপরকে জড়িয়ে ধরল অন্তু, সুপু আর পিলু পিউর চোখের কোণটা চিকচিক করে উঠল সে কি কোনওদিন এরকম বন্ধু হতে পারবে?
_____
অলঙ্করণঃ রূপশ্রী নাথ

2 comments: