সাফাই অভিযান
সহেলী চট্টোপাধ্যায়
আমাদের মেজদা সাতদিনের
জন্য বেড়াতে চলে গেল। বেড়াতে নয়, বিদেশে কী একটা সেমিনারে যোগ দিতে। যাওয়ার আগে বলে গেল,
“আমার ঘরগুলো তোমরা পরিষ্কার করে রাখবে।”
“হ্যাঁ, এ আর এমন কী! আমরা সব ঝকঝকে করে রাখব। মেঝেতে তুমি নিজের মুখ দেখতে পাবে।”
বলেছিল টুকাইদি।
মেজদা নিশ্চিন্ত হয়ে
বিদেশে চলে গেল।
আমরা সবাই কাজিন। কেউ
স্কুল বা কলেজে পড়ছি। মেজদা, বড়দা, ছোড়দা অনেক বড়ো। পড়াশোনা
শেষ।
সাতদিন কেটে গেল। নানা
কারণে আমাদের আর মেজদার ঘর পরিষ্কারের কথা মনেই ছিল না। কিন্তু আজ রবিবার। মেজদা
বাড়ি ফিরবে। কাল ফোন করে বলেছে। এবার না করলেই নয়। মেজদার ঘরে পা দিয়েই বুঝতে
পারলাম কাজটা মোটেই সহজ নয়। এই ঘর পরিষ্কার একমাত্র পি. সি. সরকারই করতে পারবেন।
প্রচুর বইপত্র, জামাকাপড় চারদিকে ছড়ানো। টুকাইদি বলল, “ওরে বাবা! এত
কাজ করতে হবে! আমি তো পাগল হয়ে যাব!”
দিদিভাই বলল, “দাঁড়াকে দাঁড়াকে
ক্যা দেখতা হ্যায়! কাম শুরু করো!”
এত কাজ করতে হবে ভেবে
দিভাইয়ের মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেছে। তাই আমাদের এইভাবে ধমক দিল।
“বেশ তো পরিষ্কারই
আছে। আমাদের কিছুই করার নেই।” বিন্দুদি বলল।
“হ্যাঁ, এর থেকে বেশি
পরিষ্কার করলে মেজদা আর নিজের ঘর চিনতে পারবে না।” মেজদিও বিন্দুদির সঙ্গে একমত।
টুকাইদি তো চেয়ারে বসে
ঢুলছে।
“প্রথমেই আমি এক ঝাপটে
বিছানাটা ঝেড়ে ফেলব।” বলেই বিছানার চাদর ধরে একটান দিল ইন্দুদি।
ঝনাৎ করে একটা শব্দ হল।
“কী ভাঙলে গো, ইন্দুদি?”
“আমি কিছুই ভাঙিনি। যে এখানে ঘড়িটা রেখেছে
দোষ তারই। বালিশের নিচে কেউ ঘড়ি রাখে!”
“এই, আস্তে কাজ কর প্লিজ!”
টুকাইদির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে ওই ঝনাৎ শব্দে এবং আমাদের কিচিরমিচিরে।
মেঝেতে ঘড়ির কাচভাঙা পড়ে
আছে। ইন্দুদি এক জায়গায় সব সরিয়ে রাখল। বিন্দুদি টিভি চালাতে গেল। কিন্তু চলল না।
কারেন্ট তো আছে। তাহলে টিভি চলছে না কেন!
“তুই কি এখন টিভি দেখবি
নাকি!” মেজদি জিজ্ঞাসা করল।
“টিভি না চালিয়ে আমি কাজ
করতে পারি না। একটা গান অন্তত হওয়া চাই। কিন্তু টিভি অন হচ্ছে না কেন!”
“দে, আমাকে দে। এসব তোর
কাজ নয়।” দিভাই টিভি চালাতে পারল বটে কিন্তু টিভিতে কিছুই হচ্ছে না। নো সিগন্যাল
দেখাচ্ছে।
“হয়ে গেল। নো সিগন্যাল!”
“এইরকম নো সিগন্যাল
দেখালেও ঘাবড়াবার কিছু নেই রে বোকা! একটা কাজ করবি। সেট-টপ বক্সে যে কার্ডটা দেখা
যাচ্ছে ওটা তুলে নিয়ে আবার গুঁজে দিবি।”
দিভাই ঠিক তাই করল। পরপর
ছ’বার করল। সেট-টপ বক্সকে দু-চারটে চড়ও মারল। কাজ একটাই হল, টিভিটা যাও বা চলছিল
সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। আর চড়েও কাজ হল না। এখন আর অনই হচ্ছে না।
“দিভাই, এটা কী হল!”
বিন্দুদির জিজ্ঞাসা।
“যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।
কাজের সময় টিভি দেখা ঠিক নয়। চটপট হাত লাগিয়ে ফেল।”
বেশ, আগে কাজ-টাজ করে
নিই। কিন্ত কী করব বুঝতে পারছি না। বইটইগুলো একটু ঝাড়াঝাড়ি করা যাক। এমনিতে দিদিরা
থাকলে আমায় কোনও কাজই করতে হয় না।
বিন্দুদি একটা চেয়ারে উঠে
ঝুল ঝাড়ছে। ও বরাবরই খুব করিতকর্মা। খুব তাড়াতাড়ি কাজ করছে। বাবা রে, আমার পায়ের
ওপর দিয়ে একটা ইঁদুর চলে গেল! ইন্দুদি ইঁদুর দেখে লাফিয়ে উঠে পড়ল প্লাস্টিকের
চেয়ারটায় যেটার ওপর বিন্দুদি উঠেছিল। দু’জনের ভার সহ্য করতে না পেরে মড়মড় করে ভেঙে
গেল চেয়ারটা। দু’জনে পড়ে গেল। আমরা ছুটে এসে দু’জনকে ধরে তুলি। আঘাত একদম মারাত্মক
কিছু ছিল না।
“প্লাস্টিকের চেয়ারে ওঠা
খুব বিপজ্জনক।” ইন্দুদি বলল।
“হ্যাঁ, এবার থেকে কাঠের
চেয়ারে উঠব।” বিন্দুদি মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল।
টুকাইদি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে
বলল, “ভূমিকম্প
হচ্ছে বুঝি! শাঁখ বাজাও কেউ।”
আমরা একটু রেস্ট নিলাম।
মেজদি বলল, “একটু চা করে আনি।”
“হ্যাঁ, একটু চা হোক। টি-ব্রেকের
পর আবার কাজ শুরু হবে।” দিভাই বলল।
টুকাইদি হাই তুলতে তুলতে
বলল, “আমাকেও এক কাপ দিও।”
“সেই তো। সবচেয়ে বেশি
পরিশ্রম তো তুইই করছিস, টুকাই।”
মেজদি চা করে আনল। কাচের
কাপে করে চা নিয়ে এসেছে। দিদিভাই বলল, “বিস্কুট নিয়ে আসি।”
“বিস্কুট নেই রে। মেজদা
বিস্কুটের কৌটোয় বাদামভাজা রেখেছে।”
“কী বাদাম?”
“মেলাতলায় যেগুলো পাওয়া
যায়। খোলা ছাড়িয়ে খেতে হয়।”
“দারুণ লাগে আমার। নিয়ে
আয় না প্লিজ!”
মেজদি বাদামভাজার কৌটো
নিয়ে এল। একটু নরম হয়ে গেছে, তবে খেতে খারাপ না।
“খোলাগুলো কোথায় ফেলব?” আমি জিজ্ঞাসা
করলাম।
“এই মেঝেতেই ফেলি। আমরা
তো সব পরিষ্কার করবই। তখন ফেলে দেব।” বিন্দুদির জবাব।
সেই ভালো। আমরা ঘরের মেঝেতেই
বাদামের খোলা ফেলতে লাগলাম।
মেঝেতে গোল হয়ে বসে চা
খাচ্ছি। টুকাইদি ঘুমের ঘোরে এক কাপ চা ফেলে দিল মেঝেতে। চায়ের নদী বইছে ঘরের মধ্যে
দিয়ে। বাদামভাজার খোলাগুলো চায়ের নদীতে ভিজে গেল। কাচের কাপটাও ভেঙেছে। দিদিভাই চেঁচিয়ে ওঠে, “টুকাই রে, কী
করলি!”
টুকাইদি ভয় পেয়ে যায়।
মেজদার একখানা জামা এনে চায়ের নদীর ওপর ফেলে দেয়। মনে হয় নদীতে বাঁধ দেওয়ার চেষ্টা
করে। মেজদি কপাল চাপড়ে বলল, “হায় হায়, এ কী করলি! এ তো মেজদার সেই নতুন শার্ট।
ছোড়দা রিও দি জেনিরো থেকে এনে দিয়েছিল!”
টুকাইদি পাথরের মূর্তি
হয়ে যায়। বিন্দুদি বেসিনে হাত ধুতে গেছিল। ফিরে এল উদ্বিগ্ন মুখে।
দিদিভাই বলল, “কী হল!
কিছু ভেঙেছিস নিশ্চয়ই?”
“না। হাত ধুতে গেছিলাম
বেসিনে। কল খুলতে গেছি, কলের মাথাটাই খুলে এসেছে আমার হাতে। জল পড়েই যাচ্ছে। কী
হবে এখন!”
আমরা ছুটে যাই। ডাইনিংয়ের
একটা বেসিনের কলের মাথা নেই। সেটা এখন বিন্দুদির হাতে। জল পড়ে সব ভেসে যাচ্ছে।
মেজদি আবার একটা মেজদার পাঞ্জাবি নিয়ে এসে শক্ত করে বাঁধল। তাও জল পড়েই চলেছে। জল থইথই
ডাইনিং। ঘরের ভেতর চায়ের নদী, বাদামের খোলা, ঘড়ির
কাচভাঙা, ভাঙা কাপের টুকরো, চায়ে ভেজা
জামা দেখতে দেখতে মনে হল এই সংসারের সবই মায়া। সব অনিত্য। আমাদের এখনই উচিত
হিমালয়ের পথে পাড়ি দেওয়া। কালবিলম্ব করা উচিত নয়।
নিচে একটা গাড়ি থামার
আওয়াজ হল। জানালায় ছুটে চলে গেল ইন্দুদি। এই রে! মেজদা এসে গেছে। কী হবে এইবার!
হিমালয় যাওয়ার সুযোগটুকুও মেজদা আমাদের দিল না। আবার মায়ার বাঁধনে পড়ে যাব। আগেই বেরিয়ে
গেলে ভালো হত।
মেজদা ঘরে পা দিয়েই বলল, “সরি,
আমি ভুল করে অন্য বাড়িতে চলে এসেছি। কিছু মনে করবেন না। আপনারা কাজ করুন।”
মেজদা আবার সিঁড়ি দিয়ে
নেমে গেল। আমাদের আর পায় কে! দে দৌড়। আমি একছুটে আম্মার খাটের তলায় সেঁধোলাম। মেজদার চিৎকার শোনা
যাচ্ছে। “বদমাইশ মেয়েগুলো কোথায় লুকোলো! দেখতে পাচ্ছি না তো!”
বড়দার গলা, “শান্ত হ। তুই আর
ঘর পরিষ্কার করানোর লোক পেলি না!”
এদেশের পুরনো নিয়ম,
চিরকাল যার ওপর অত্যাচার হয়েছে তারই দোষ দেখে সবাই। দিদিরা কোথায় কে লুকোলো জানি
না। আগে নিজে তো বাঁচি!
_____
অলঙ্করণঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment