অয়স
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
অয়স জঙ্গলের এইদিকটায় আগে
কখনও আসেনি। ঘন বনের ভিতর থেকে সূর্যকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে
সন্ধ্যা হতে বেশি দেরি নেই। সকালে গ্রামের যুবকরা প্রতিদিনের মতো একত্রে শিকারে
বেরিয়েছিল। অয়স অন্যদের থেকে বয়সে ছোটো, শক্তিও কম। তাই একা কোথাও যাওয়ার কথা ওর
নয়। কিন্তু ভল্লের জন্যই এখানে আসতে হয়েছে।
গায়ে বেশি জোর বলে ভল্ল শুধু অয়স নয়, অন্যদেরও
তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, সেটা ঠিক। ওর কয়েকজন পেটোয়া অনুচর আছে যারা ওর সবকথায় সায়
দেয়। কিন্তু কেন যে অয়সের উপরই ওর এত বেশি রাগ, তা অয়স বুঝতে পারে না। কোনও সন্দেহ
নেই যে ভল্ল গ্রামের সবচেয়ে শক্তিমান যুবক। গ্রামের প্রধান বৃকসুতার মেয়ে শীলা আর
অয়স একই বয়সী, ছোটোবেলা থেকে এক সঙ্গে খেলা করেছে। শীলা যে অয়সকে আলাদা করে ডেকে
কথা বলে, অনেক সময় বন থেকে আনা ফল অয়সকে দেয়, সেটা কি ভল্লের পছন্দ নয়? শীলার
সঙ্গে যে ভল্লেরই জুড়ি হবে, সেকথা গ্রামের সকলেই জানে। অয়সও জানে যে ভল্লকে শীলার
পছন্দ না হতেই পারে, কিন্তু গ্রামের প্রধানের মেয়ে সবসময়েই তো সঙ্গী হিসাবে সবচেয়ে
শক্তিশালী যুবককে বেছে নেয়, সেটাই রীতি। বৃকসুতার পরে শীলাই তো হবে গ্রামের প্রধান।
তাকে তো গ্রামের সমস্ত সমস্যা সামলাতে হবে।
আজকের কথাই ধরা যাক না কেন। জঙ্গলে
হরিণ শিকারের উদ্দেশ্যে ঢুকেছিল ওরা পাঁচজন। সকলেরই হাতে ছিল বল্লম। কর্মকার অনেক
যত্ন নিয়ে এই বল্লমগুলো বানায়। কর্মকার এই গ্রামের লোক নয়। কোথা থেকে এসেছে কেউ
জানে না। অনেক বছর আগে সওদাগরদের সঙ্গে একবার গ্রামে এসেছিল, তারপর আর ফিরে যায়নি।
বল্লমের ফলা তৈরি করতে দুটো ধাতু লাগে। তার মধ্যে তামাটা সহজেই পাওয়া যায়। গ্রামের
পাশ দিয়েই বয়ে গেছে সুবর্ণরেখা নদী, সেখানে একরকম পাথর পাওয়া যায়।
তার থেকে তামা বার করে নেয় কর্মকার। কিন্তু আর একটা ধাতু লাগে, তা বহুদূর থেকে
আসে। বর্ষার শেষে যখন ফসল ওঠে, তখন নৌকা করে আসে সওদাগরের দল। তারা আরও অনেক
গ্রামেই যায়, অয়সদের গ্রামটাই ওদের শেষ গন্তব্য। তারা
ফসল নিয়ে যায়, তামা নিয়ে যায়, কখনও কখনও হরিণের চামড়াও নেয়। বিনিময়ে অন্য অনেক
কিছুর সঙ্গে রেখে যায় রাং নামের এক ধাতু। কর্মকার তামা আর রাং মিশিয়ে এক নতুন
সঙ্কর ধাতু বানায় যেটা তামার থেকে অনেক শক্ত। তার
থেকেই তৈরি হয় বল্লমের ফলা, ফসলের নিড়ানি। তাই বল্লম দেওয়ার সময় বৃকসুতা বার বার
বলে দিয়েছিল বল্লমটা যেন না হারায়, ফলাটা ভেঙে গেলেও টুকরোগুলো যেন ফেরত আসে।
অয়সের পরিষ্কার মনে আছে যে
হরিণ খোঁজার মাঝে যখন ও নদীতে জল খেতে নেমেছিল, বল্লমটাকে নদীর থেকে অনেকটা দূরে
রেখেছিল। কিন্তু যেই ও জল খেয়ে উঠেছে, ভল্ল হঠাৎ চিৎকার করে বলল, “অয়স, তুই
বল্লমটাকে ঠিকমতো রাখতে পারিসনি। দেখ, নদীতে
পড়ে গেছে।”
চমকে ঘুরে অয়স দেখল, সত্যিই
নদীর খরস্রোতে ধাক্কা খেতে খেতে বল্লমটা ভেসে যাচ্ছে।
“আমি তো ঠিকই রেখেছিলাম।”
অয়স বলে।
“ঠিকই যদি রাখবি, তাহলে পড়ে
গেল কেন? আচ্ছা, তোরা দেখেছিস অয়স কেমন করে বল্লমটা রেখেছিল?” বাকিদের সাক্ষী মানে
ভল্ল।
বাকিরা সবাই তো ভল্লের মোসায়েব। তাই
মল্ল, বিক্রম, সারব, সবাই একবাক্যে বলল দোষটা অয়সেরই। ও নাকি
অস্ত্রের যত্ন নিতে শেখেনি। অথচ কর্মকার কাজের সময় সাহায্যের দরকার হলে গ্রামের
মধ্যে একমাত্র অয়সকেই ডাকে।
“কখনওই না। ভল্ল,
তুইই নিশ্চয়ই ওটা নদীতে ফেলে দিয়েছিস।” অয়স রেগে
বলে।
“তুই আমার নামে এরকম কথা
বলছিস?” মুহূর্তে রূপ পালটায় ভল্ল। এক ধাক্কায় অয়সকে মাটিতে ফেলে বুকের উপর চেপে
বসে। অয়স শত চেষ্টাতেও তাকে সরিয়ে দিতে পারে না।
“যা, তোর বল্লম খুঁজে নিয়ে
আয়। না হলে তোকে আর গ্রামে ঢুকতে দেব না।” কোমরের
খাপ থেকে তলোয়ার বার করে দেখায় ভল্ল।
তলোয়ার গ্রামে আর কারও নেই।
কর্মকার তলোয়ার বানায় না। অনেকেই তাকে কারণটা জিজ্ঞাসা করে, কর্মকার কোনও উত্তর
দেয় না। খালি অয়সকে তো খুব ভালোবাসে, ওকে একবার বলেছিল যে তলোয়ার তো শিকারে লাগে
না, চাষেও না। শুধু মানুষ মারার কাজে যে জিনিস লাগে তা বানানোর রুচি কর্মকারের
নেই। ভল্লের এই তলোয়ারটাও বল্লমের ফলায় ব্যবহৃত একই সঙ্কর ধাতু দিয়েই তৈরি। কিন্তু
তা খুব মজবুত, ধারও বেশি। এক সওদাগরের থেকে এটাকে জোগাড় করেছিল ভল্ল।
অয়স বাধ্য হয়ে নদীর পাড় ধরে
পা বাড়ায়। বল্লমটা আর চোখে পড়ছে না। কত দূরে
চলে গেছে কে জানে। গ্রামে এক বৃকসুতা আর শীলা ছাড়া সবাই ভল্লকে ভয় পায়। বৃকসুতার
থেকে কোনও সাহায্য পাওয়ার আশা নেই। ভল্ল
যা বলে, তাই তার মত। শীলা কি মায়ের অবাধ্য হবে? বল্লমটা না পেলে সত্যিই হয়তো
গ্রামে ঢুকতে দেবে না।
চলতে চলতে কোথায় এসে পড়েছে
অয়স খেয়াল করতে পারেনি। হঠাৎ দেখল, গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। এদিকে জঙ্গলের
শেষ কোথায় কেউ তো জানে না। তাহলে কোন
জায়গায় এসে পড়ল সে? ভালো করে দেখল, জঙ্গল শেষ হয়নি, কিন্তু সামনে গাছগুলো অনেক
ছোটো। নদীটার লাগোয়া একটা বড়ো জলাশয়, সেটা নদীর জলে ভর্তি।
এতক্ষণে বুঝতে পারে অয়স। এই
জায়গার কথা ও শুনেছে। কিন্তু এখানে তো মানুষ আসে না, এ তো
দেবতার স্থান। বৃকসুতা গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ।
বৃকসুতা বলে, ও যখন ছোটো ছিল তখন তারা খসার মতো করে আগুনের দেবতা একদিন এখানে নেমে
এসেছিল। এমন আওয়াজ হয়েছিল যে এক সঙ্গে কুড়িটা বাজ পড়লেও অত জোরে শব্দ হত না। ওদের
গ্রামের মাটি পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। এই জায়গার সমস্ত গাছ পুড়ে গিয়েছিল।
বৃষ্টির দেবতা সারারাত ধরে জল ঢেলেও তাদের বাঁচাতে পারেনি। একরাতের মধ্যে ঐ বড়ো
জলাশয়টা খোঁড়া হয়েছিল। দেবতা ছাড়া আর কারোর পক্ষে সেটা
সম্ভব? তারপর থেকে কোনও মানুষ এখানে পা দেয় না।
অয়সেরও পা সরতে চাইছিল না।
কিন্তু বল্লমটা তো খুঁজে পেতেই হবে। সাহস করে এগোল। জলাশয়টার
পাশে গিয়ে বল্লমটাকে দেখতে পেল অয়স। নদীর টানে সেটা এখানে চলে এসেছে। কিন্তু জলে
নামতে হবে অয়সকে। জলের মাঝখানে একটা গাছে বল্লমটা আটকে
গেছে। সে যা হোক, সাঁতার অয়স ভালোই জানে।
জলটা বেশ পরিষ্কার, তলা
পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সাঁতরে গিয়ে বল্লমটা হাতে নিল অয়স। কিন্তু ফলাটা কোথায়?
নিশ্চয়ই জলের ধাক্কায় লাঠির আগা থেকে সেটা খুলে গেছে। ডুব দিয়ে দেখার চেষ্টা করল
অয়স, যদি পাওয়া যায়। কী একটা চকচক করছে যেন? ভালো করে দেখল, ফলাটা দু’টুকরো হয়ে
পড়ে আছে। ডুবসাঁতার দিয়ে তুলে আনতে হবে।
কিন্তু ফলাটা ভাঙল কেমন করে?
জলের তলায় নিশ্চয়ই পাথর আছে, তার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে। সত্যিই
তাই। জলের তলায় একটা বিরাট পাথর। এত বড়ো পাথর কখনও
দেখেনি অয়স। এদিকে কোথাও আছে বলেও শোনেনি। ফলার টুকরোগুলো তোলার সময় ভালো করে
দেখল, একটা ছোটো ছুঁচলো পাথর পড়ে আছে। মনে হয় বড়োটার থেকেই কোনওভাবে ভেঙেছে। ঠিক
বল্লমের ফলার মতোই দেখতে। সেটাকেও হাতে নিয়ে জল থেকে উঠল অয়স।
এর মধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে।
পথ চেনাটা সমস্যা নয়, নদীর ধার ধরে গেলেই হল। কিন্তু অন্ধকারে হিংস্র জন্তু বেরোতে
পারে, একটা অস্ত্র দরকার। ফলাটা লতা দিয়ে বল্লমের আগায় বাঁধার
চেষ্টা করল অয়স। কিছুতেই পেরে উঠল না। কী মনে করে পাথরের টুকরোটা হাতে নিল। বেশ
ভারী। সেটাকেই বল্লমের আগায় বেঁধে নিল। কোনও
অস্ত্র না থাকার থেকে তো ভালো।
রাত হয়ে এসেছে। আজ পূর্ণিমা বলে তবুও বাঁচোয়া।
তাও বুক ঢিপঢিপ করছে অয়সের। সাবধানে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে হাঁটার চেষ্টা করছিল। এমন
সময়ে একটা খসখস আওয়াজ এল ডানদিক থেকে। ঘুরে তাকিয়ে
রক্ত হিম হয়ে গেল অয়সের। সামনেই বিরাট একটা ভাল্লুক। ভয়ে চারদিকে চোখ ফেরাল অয়স। সামনেই
একটা গাছ যার একটা ডাল খুব নিচে। তাড়াতাড়ি করে তার উপর চেপে বসল। শক্ত করে বল্লমটা
ধরল অয়স। কিন্তু ওর যা মোটা চামড়া, এই বল্লমে কী হবে?
ভাল্লুকটা বুঝতে পেরেছে, অয়স
ভয় পেয়েছে। গাছের তলায় এসে দাঁড়াল। তারপর
পিছনের দু’পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে অয়সের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। এভাবে
পাচ্ছে না বটে, কিন্তু ভাল্লুক তো গাছে চড়তেও পারে। ভয়ে অয়স ভাল্লুকটার দিকে
বল্লমটা গায়ে যত জোর আছে তা দিয়ে ছুঁড়ে মারল। লক্ষ্য ছিল চোখ।
কিন্তু ভয়ে নিশ্চয়ই হাত কেঁপে গিয়েছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট
বল্লমটা লাগল ভাল্লুকের মাথায়। চোখ বুজে ফেলেছিল অয়স। ও
জানে যে ওর বল্লমে ভাল্লুকের মাথার হাড় ভাঙবে না। কিন্তু একটা কাতর আর্তনাদ শুনে
চোখ খুলল। দেখল ওর বল্লমটা ভাল্লুকের মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে।
একটু ছটফট করে জন্তুটা নিথর হয়ে গেল।
গাছ থেকে নেমে বল্লমটা টেনে
বার করে নিল অয়স। পাথরটার কোনও ক্ষতি হয়নি। মনে মনে বনের দেবতাকে ধন্যবাদ দিয়ে অয়স
আবার পা বাড়াল।
বল্লমটা সারাতে হবে।
তাই গ্রামে ঢুকে প্রথম গেল কর্মকারের কাছে। সে অবাক হয়ে বলল, “এত রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলি তুই?”
অয়স ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। ফলার
টুকরোগুলো হাপরের পাশে রেখে বসে পড়ল। সারাদিনের
গল্পটা বলতে সময় লাগবে। সব শুনে কর্মকার বলল, “সেই পাথরের টুকরোটা
কোথায়? ফেলে দিয়েছিস নাকি?”
“না না, ওটাই তো আমার প্রাণ
বাঁচিয়েছে। ওই তো ওখানে রাখা আছে।”
হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে দেখল কর্মকার। তারপর বলল, “এ যে সে পাথর নয় রে। ভালো করে দেখ, এ আসলে একটা
ধাতুর টুকরো। আমি এই ধাতুর কথা আগে শুনেছি। এ নাকি আকাশ থেকে
আসে। তাই সবাই বলে দেবতাদের দান। আমরা যে ফলা বানাই,
তামা আর রাং দিয়ে, তার চেয়ে এ অনেক বেশি শক্ত। অনেক দূরের এক দেশের সৈন্যরা নাকি
এই ধাতু দিয়ে তৈরি তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছে।
তাদের সামনে কেউ দাঁড়াতেই পারে না। যেখানে পেলি, সেখানে আরও আছে নাকি?”
“হ্যাঁ, বিরাট একটা চাঁই পড়ে
আছে জলের তলায়।”
“কাল আমাকে দেখাতে নিয়ে যাবি
তো। অন্য কাউকে বলিস না এর কথা।”
পরের দিন দু’জনে গিয়ে একটা
বড়ো টুকরো তুলে নিয়ে এল। তারপর কর্মকার চুল্লিতে আগুন দিয়ে সেটা
গলানোর চেষ্টা করল অনেকক্ষণ ধরে। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “যা ভেবেছি তাই।
দেবতাদের ধাতু কি আর আমাদের উনুনে গলানো যাবে?”
“তাহলে এটা কোনও কাজে লাগানো
যাবে না?”
“তা বলিনি। ধাতু না গলিয়ে কি
জিনিস বানানো যায় না নাকি? তার অন্য কায়দা আছে?”
“তোমাকে একটা কথা বলব, রাখবে?
আমাকে এই দিয়ে একটা তলোয়ার বানিয়ে দেবে?”
“আমি তোকে বলেছিলাম তলোয়ার
আমি বানাই না। কেন, কী করবি?”
“ভল্ল আমাকে মেরে ফেলার তাল
করছে। একটা তলোয়ার থাকলে একটু সাহস পেতাম। শীলা
আর তুমি ছাড়া গ্রামের কেউ আমার পক্ষ নেবে না। ভল্লের আমার ওপর এত রাগ কেন জানি না।”
“জানিস না?” কর্মকার অর্থপূর্ণ
দৃষ্টিতে তাকায় অয়সের দিকে।
“সত্যিই জানি না।”
“আমি কিন্তু জানি। ঠিক আছে,
কিন্তু আমি নিজের হাতে বানাব না। তোকে শিখিয়ে দিচ্ছি কেমন করে তৈরি করতে হয়।
কিন্তু শুধু বানাতে জানলে তো হবে না, চালাতে জানতে হয়। ভল্ল তো জানে। দুটো কাঠের তলোয়ার
বানিয়ে নিয়ে আসিস কাল।”
একটা তলোয়ার বানাতে যে এত
কিছু জানতে হয় আর এত পরিশ্রম করতে হয়, তা অয়সের ধারণা ছিল না। সবাইকে লুকিয়ে কাজ
করতে হত; তাই রাতের পর রাত জেগে কাটত। আর যখন তলোয়ার বানাচ্ছে না, তখন কর্মকারের
কাছে চালানো শিখছে। অবশেষে একদিন সত্যি সত্যিই কাজটা শেষ
হল।
“ভল্লর তলোয়ারটা দেখতে অনেক
ভালো।” খুঁত খুঁত করে অয়স।
“দেখতে কেমন সেটা কথা নয়,
কতটা কাজের সেটা দেখতে হবে। এটা হাতে নেওয়ার আগে তোকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে
নিরস্ত্র লোকের বিরুদ্ধে কখনও একে ব্যবহার করবি না। আরও প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে
কোনও যুদ্ধে প্রথম আঘাত তুই করবি না।”
“প্রতিজ্ঞা করলাম।”
পরের দিন সকালে উঠে তলোয়ারটাকে
একটা কাপড়ে মুড়ে নিল অয়স। শীলার বাড়ির বাইরে থেকে ওকে ডাকল অয়স, “একটা জিনিস তোকে
দেখাব, চল।”
“তুই এতদিন ছিলি কোথায়?” শীলা
অবাক হয়ে জানতে চায়। “কতদিন তোকে দেখিনি।”
“নদীর ধারে চল, সব বলছি।”
নদীর ধারে বসে সব গল্প শীলাকে
বলল অয়স। ভল্ল ওকে কেমন বিপদে ফেলেছিল শুনে শীলার চোখগুলো রাগে লাল হয়ে উঠেছিল।
বলল, “আগে বলিসনি কেন? দাঁড়া, ওকে দেখাচ্ছি।”
শীলার রাগ দেখে ভালোই লাগছিল
অয়সের। বলল, “পুরো গল্পটা শোন।”
সব শুনে শীলা বলল, “দেখি তলোয়ারটা।”
অয়স বার করে শীলার হাতে দিল।
দু’জনের কেউই খেয়াল করেনি,
ভল্ল ওদের দূর থেকে দেখতে পেয়েছে। রেগে দৌড়ে এল ভল্ল।
বলল, “অয়স, তোর এত সাহস যে তুই শীলার সঙ্গে কথা বলছিস? কী দিলি তুই ওকে?”
“তোর তাতে কী?” শীলা বলে।
“আমার কী তোর মা তোকে বলে
দেবে। বৃকসুতা আমাকে কথা দিয়েছে যে আমিই হব তোর সঙ্গী। এটা কী, তলোয়ার? অয়স চালাবে
তলোয়ার? ওটা ধরতে শিখেছে ও? ওটা তলোয়ার না নিড়ানি?”
অয়স চুপ করে রইল। শীলা তলোয়ারটা
অয়সের হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। “ভল্ল, ভালো হচ্ছে না কিন্তু।”
“কী ভালো হচ্ছে না? অনেকদিন
ধরে দেখছি তুই আমাকে ছেড়ে অয়সের সঙ্গে ঘুরছিস। আজ ওকে এখানেই কেটে নদীতে ভাসিয়ে
দেব। গ্রামের কেউ আমার বিরুদ্ধে একটা কথাও বলতে পারবে না। যে বলতে আসবে, তারও একই
হাল করব। আগে এটাকে দেখি, তারপর তোকে কেমন করে শিক্ষা দিতে হয় আমি জানি।”
শীলাকে এমন ধাক্কা মারল ভল্ল,
যে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তারপর তলোয়ার বার করে অয়সের দিকে এগোল।
শীলার অবস্থা দেখে অয়সের
মাথায় রক্ত উঠে গেল। অনেক সহ্য করেছে, আর নয়। তলোয়ারটা তুলে নিয়ে দাঁড়াল।
“আয় তবে।”
শীলা আর্তনাদ করে উঠল, “অয়স, পালা।
ভল্লের সঙ্গে তুই পারবি না।”
আর কথা বলার সময় হল না। ভল্ল
আক্রমণ করল। কিন্তু যুদ্ধ কয়েক মুহূর্তের বেশি চলল না। ভল্লের শক্তি অনেক বেশি, ও
নিজের তলোয়ার তুলে অয়সের উপর আঘাত করতে গেল। ভেবেছিল এক আঘাতেই শেষ করে দেবে।
কর্মকারের শিক্ষামতো নিজের অস্ত্রটা শুধু শক্ত করে ধরেছিল অয়স। ভল্লের তলোয়ার তাতে
লেগে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
নিজের হাতে ধরা তলোয়ারের
হাতলের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে ছিল ভল্ল। অয়স তলোয়ার নামাল। বলল, “আর কোনওদিন যদি
শীলার দিকে তাকিয়েছিস, তাহলে তোর হাল তোর ঐ তলোয়ারের মতো করব। এই অস্ত্র দেবতার
দান। এর সঙ্গে তুই কোনওদিন পেরে উঠবি না।”
দেবতার কথা শুনে ভল্লের মুখ
ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। সত্যি সত্যি দেবতার আশীর্বাদ না থাকলে অয়সের ক্ষমতা কী তার
সঙ্গে যুদ্ধে পারে? কোনও কথা না বলে পিছন ফিরে দৌড়ে পালাল ভল্ল।
শীলা উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলল, “তুই
হঠাৎ ভল্ল আমার দিকে তাকালে ওকে মেরে ফেলবি বললি কেন?”
“কেন? তুই কি চাস ও তোর দিকে
তাকিয়ে থাকে? তোর দিকে যে কেউ তাকালেই আমার ভালো লাগে না।”
“ঠিক আছে, তাহলে কেউ যাতে
আমার দিকে চোখ তুলে না তাকায় সেই দায়িত্বটা তুই নে।”
“আর বৃকসুতা? তোর মা?”
“মা যখন শুনবে ভল্লকে তুই
হারিয়ে দিয়েছিস, আর আপত্তি করবে না। মা শুধু চায় যে আমি যেন গ্রামের সবচেয়ে
শক্তিশালী পুরুষকে বেছে নিই। তুই ভল্লকে হারিয়ে দিয়েছিস, তার উপর তোর হাতে আছে
দেবতার দেয়া অস্ত্র। কার সাহস আছে তোর উপর কথা বলবে?”
“শীলা, সত্যি সত্যি এটা তো
দেবতার দেয়া নয়।”
“সে আমি জানি।
খালি ভল্ল না জানলেই হল। আচ্ছা, এই নতুন ধাতুটার নাম কী?”
“কর্মকার এই ধাতুটার নাম
দিয়েছে লোহা।”
_____
অলঙ্করণঃ পুষ্পেন মণ্ডল ও সৃজিতা রায়
No comments:
Post a Comment